ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ ও মার্কিন রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/10/2018


Thumbnail

‘যে রাজনৈতিক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে আমার সহকর্মী যাচ্ছিলেন, তা শেষ হতে চলেছে।’ ১৯৯৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এমন মন্তব্যই করেছিলেন মার্কিন রাজনীতিবিদ মার্ক হ্যাটফিল্ড। যে সহকর্মীর বিষয়ে তিনি মন্তব্যটি করেছিলেন তিনি হলেন ওরেগনের সিনেটর বব প্যাকউড। আর হ্যাটফিল্ড যে বিষয়টিকে দুঃস্বপ্নের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তা হলো, সিনেটের এথিক্স কমিটির একটি তদন্ত প্রক্রিয়া। ১৯৬০ সাল থেকে প্যাকউড তার অধস্তন বেশ কয়েকজন নারীকে যৌন নিপীড়ন  করেছেন বলে ওই তদন্তে উঠে এসেছিল। এর জের ধরে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। তিন বছর ধরে এথিকস কমিটির সঙ্গে লড়াই চালিয়েছিলেন তিনি। অপকর্মের প্রমাণ নষ্টেরও অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তদন্ত চলাকালীন সময়ে সিনেট কমিটির সামনে তাকে বিভ্রান্ত মনে হতো। স্বেচ্ছায় পদত্যাগের কারণে সিনেটরদের প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাদের কেউই যৌন হয়রানির শিকার নারীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেননি।

প্যাকউড পদত্যাগের পর বহু বছর পেরিয়ে গেছে। অন্য সবকিছুর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভে ওয়েইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের ভয়ঙ্কর অভিযোগের পর ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ ভাইরাল হয়ে গেছে। যৌন হয়রানির জের ধরে কংগ্রেসের নয়জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন কিংবা নির্বাচনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন। স্ত্রীর ওপর নির্যাতনের অভিযোগে হোয়াইট হাউসের দুজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। নারী কেলেঙ্কারির জের ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নির্বাচনের তিনজন প্রার্থীর প্রচারনা বন্ধ হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র পরিবর্তন আসলেও দেশটির রাজনীতিতে এর প্রভাব অসমভাবে পড়ছে বলেই দেখা যাচ্ছে। রিপাবলিকানরা এখনো প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুগত, যিনি বেশ কিছু যৌন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত। অন্তত ১৯ জন নারী তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ যৌন সম্পর্কের অভিযোগ তুলেছেন। শুধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই নন, তাঁর মনোনীত বিচারপতি ব্রেট কাভানার বিরুদ্ধেও রয়েছে যৌন হয়রানির অভিযোগ। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এই বিচারপতি অন্তত চারজন নারীকে যৌন নিপীড়ন করেছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।

হার্ভে ওয়েইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের ভয়ঙ্কর অভিযোগের মাধ্যমে #মিটু আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। কিন্তু ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ওই আন্দোলনের আগুনে পেট্রোল পড়ে বলে মনে করা হয়। গত বছরের ২১ জানুয়ারী ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে লাখ লাখ মানুষ ‘উইমেন্স মার্চে’ অংশ নিতে রাস্তায় নেমে আসে। ওই পদযাত্রায় অংশ নেওয়া অনেকেই বলেন, নির্বাচনে বড় একটি দলের প্রথম নারী প্রার্থীর পরাজয় দেখাটা অবশ্যই দুঃখজনক ছিল। তবে এমন একজন প্রার্থীর কাছে তাঁর হেরে যাওয়াটা সত্যিই গ্লানিকর যিনি বহুবার বহু নারীকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন।

আশার কথা এটাই যে, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এবছর মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে ডেমোক্রেটসদের অর্ধেক প্রার্থীই নারী। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমনটা ঘটল। এর আগে ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের ২৭ শতাংশ প্রার্থী ছিলেন নারী। অন্যদিকে রিপাবলিকানদের এই হার ছিল মাত্র ২০ শতাংশ। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়েও বেশ কয়েকজন নারী অংশ নেবেন এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ডেমোক্রেটিক দলে নারীদের ভীড় বাড়লেও রিপাবলিকানদের ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টোটা। দলটি থেকে বেশকিছু নারী সদস্যের প্রস্থানের ঘটনা ঘটেছে। এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচন ইতিমধ্যেই রিপাবলিকানদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ২০১৬’তে বেশকিছু অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু নভেম্বরের কংগ্রেস নির্বাচন এবং ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেতে হলে রিপাবলিকানদের অবশ্যই সমর্থক বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। যদিও আগামী দুই নির্বাচনে রিপাবলিকানরা নারী ভোটার বিশেষ করে শিক্ষিত ও অশেতাঙ্গ নারীদের ভোট হারাতে যাচ্ছেন বলেই মনে করা হচ্ছে।

বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ভোটারই মিটু ইস্যু নিয়ে দলগুলোর অবস্থানের বিষয়টি বিবেচনা করে। রিপাবলিকানরা এক্ষেত্রে বেশকিছু সুযোগ হারিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। গতবছর মি টু আন্দোলন জোরদার হওয়ার পরে ডেমোক্রেটরা যৌন হয়রানি ইস্যুতে তাদের দলীয় সিনেটর আল ফ্রাঙ্কেনকে পদত্যাগ করতে চাপ দিয়েছিল। কিন্তু রিপাবলিকানরা ঠিক উল্টো কাজই করেছে। অ্যালবামার সিনেটর প্রার্থী রয় মুরের বিরুদ্ধে কিশোরীদের যৌন নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ থাকার পরও দল তাকে সমর্থন দিয়ে গেছে। 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরাবরই যৌনতার দায়ে অভিযুক্তদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন বলে দেখা গেছে। এই তালিকায় রয় মুর ছাড়াও রয়েছে রব পোর্টার এবং বিল ও’রিলি। রব পোর্টারের বিরুদ্ধে স্ত্রী নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে বিল ও’রিলি যৌন হয়রানির অভিযোগে ফক্স নিউজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বিল শাইনও বেশকিছু অবৈধ কাজের জের ধরে ফক্স নিউজ ছেড়েছিলেন। পরবর্তীতে ট্রাম্প তাকে হোয়াইট হাউসের যোগাযোগ পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।

বিচারপতি ব্রেট কাভানার বিষয়েও ট্রাম্প তাঁর নীতিতে অটল ছিলেন। কাভানার পক্ষ নেওয়ার পাশাপাশি অভিযোগকারীদের নিয়েও ঠাট্টা- বিদ্রুপ করেছেন তিনি। দুঃখজনকভাবে তাঁর দলও অনেকটা একই নীতি গ্রহণ করে। রিপাবলিকান সিনেটররা কাভানিকে ভোট দিয়ে তাঁর নিয়োগ চুড়ান্ত করে।  

অনেকেই যৌন হয়রানিকে অপরাধ বলে মনে করেননা। নর্থ ডাকোটার সিনেটর পদপ্রার্থী কেভিন ক্রামার একে শুধুমাত্র একটি প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছেন, যেটা বাস্তবে ঘটেনি। ফ্লোরিডার কংগ্রেস প্রার্থী গিনা সোসা আবার বিষয়টিকে খুবই হালকাভাবে নিচ্ছেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন করেছেন, ‘হাই স্কুলের এমন কোন ছেলে আছে যে এসব করেনি?’

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে রিপাবলিকান রাজনীতি আদর্শচ্যুত হয়ে ক্রমেই ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। তিনি বারবার কেন অভিযুক্তদের পক্ষ নিচ্ছেন এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছেন অনেকেই। তারা জানতে চাচ্ছেন, প্রেসিডেন্ট কেন বিচারপতি হিসেবে কাভানার প্রার্থীতা বাতিল করে রক্ষণশীল অ্যামি কনি ব্যারেটকে মনোনয়ন দিলেন না। এর উত্তরও অবশ্য রয়েছে। ট্রাম্প কাভানার প্রার্থীতা বাতিল করলে সেটা একটি আদর্শকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করত যে, যৌন হয়রানির অভিযোগে কোন প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য করা যেতে পারে। আর এ বিষয়টি বুমেরাং হয়ে ট্রাম্পের দিকেই ফিরে আসত। কেননা অবৈধ যৌনতার বহু অভিযোগ থাকার পরও তিনি এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। 

সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড তাঁর সাম্প্রতিক বইয়ে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস সম্পর্কে অনেক তথ্যই ফাঁস করেছেন। বইটিতে তিনি প্রেসিডেন্টের একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্প যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত এক বন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘অবৈধ যৌনতার অভিযোগ উঠলে সবসময় তা প্রত্যাখ্যান করবে এবং ওই নারীদের আক্রমণ করে যাবে। যদি কখনো অভিযোগ স্বীকার করে নাও, তার মানে হচ্ছে, তুমি শেষ।’ একজন প্রেসিডেন্টের এমন মানসিকতা সত্যিই লজ্জাজনক।  এই মানসিকতার কারণে মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের পরাজয় ঘটলে তা দলটি থেকে ট্রাম্পিজমের বিদায়ের পথও তৈরি করতে পারে। শক্তিধর ট্রাম্প এ বিষয়টি ভুলে যাচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।

সূত্র: দি ইকোনমিস্ট

বাংলা ইনসাইডার/এএইচসি/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭