ইনসাইড বাংলাদেশ

চুক্তিচ্যাপ্টা প্রশাসন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 31/05/2017


Thumbnail


প্রশাসনে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। বর্তমান সরকার শুরুর দিকে এই প্রবণতা এড়িয়ে চললেও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে এই প্রথা অব্যাহত রেখেছে। যার ফলে প্রশাসনে সচিব নিয়োগে চুক্তিচ্যাপ্টা হয়ে পড়েছে প্রশাসন।

১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী অবসর আইনের ৫(৩) ধারা অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীরা অবসরে যাওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্মচারীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই আইনের স্পিরিট হচ্ছে, সরকারি কাজে যদি কাউকে বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের ওই কর্মচারি অবসরে চলে যাচ্ছেন, সেই ক্ষেত্রে। হতে পারে কোনো একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে একটা বিশেষ কাজ শুরু করেছিল সরকার। কিন্তু কাজটি সম্পন্ন হতে আরও কয়েক মাস বাকি থাকলেও ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারি এখনই অবসরে চলে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা যেতে পারে।

তবে বাস্তবতা ভিন্ন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া এই গণকর্মচারীদের কমবেশি সবাই ক্ষমতাসীনদের ‘নিজের লোক’ বিবেচনায় এই নিয়োগ পেয়ে থাকেন। যারা সত্যিকারার্থেই প্রয়োজনে এই নিয়োগ পেয়ে থাকেন, তারাও সরকারের লোক বলে বিবেচিত হন।

বলা হয়ে থাকে, চুক্তিভিত্তিক একটি নিয়োগের ফলে নিচের দিকে ক্রমান্বয়ে প্রায় চারজন পদোন্নতি বঞ্চিত হন। তারাসহ পদোন্নতি বঞ্চিতরা সরকার পরিবর্তন হলে পদোন্নতির আশা করেন। কিন্তু এরই মধ্যে যাদের অবসরের সময় হয়ে যায়, তারা আবার নতুন সরকারের কাছে পদোন্নতি প্রত্যাশা করেন। আর এভাবেই বছরের পর বছর প্রজাতন্ত্রের প্রয়োজনে নয়, বরং রাজনৈতিক কারণে বাড়তে থাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তাছাড়া ‘নিজেদের লোক’ বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়া এবং ‘নিজেদের নয়’ বিবেচনায় পদোন্নতি বঞ্চিত করার রেওয়াজতো সব সরকারের মধ্যেই আছে।

তারা বলছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে পদোন্নতি বঞ্চিতদের মধ্যে কাজ করে হতাশা, কমে যায় কর্মস্পৃহা। যার ফলে নতুন ক্যাডারদের অনেকেই ছুটি নিয়ে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমান। পরবর্তীতে এসব মেধাবীদের অনেকেই আর দেশে ফেরেন না।

সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রজাতন্ত্রের সেবার স্থলে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি প্রধান হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সব দলই এই ধারাটি লালন করছে। কোন দলই এই ধারা থেকে বের হতে চায় না, বরং অব্যাহত রাখে।

জানা গেছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সরকারি কর্মকর্তাদের অবসরকালে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে নীতিমালা করার তাগিদ দিয়েছিলেন। এই বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠিও দিয়েছেন তিনি। চিঠিতে অর্থমন্ত্রী বলেছে, অবসরের পরে চাকরির মেয়াদ বাড়ালে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের কোনো দলের সদস্য বলে অপবাদ দেওয়া সহজ হয়।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে নিরুৎসাহিত করতে চিঠিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি কর্মচারীদের চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে তাঁদের চুক্তিভিত্তিক চাকরি পরিহার করতে হবে। আগে তাঁরা ৫৭ বছরেই চাকরি থেকে অবসরে যেতেন। ২০১১ সালে সেটা বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়েছে।
তবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টিকে একেবারে বাদও দেননি অর্থমন্ত্রী। সে কারণে এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। প্রস্তাবে তিনি বলেছেন, কী ধরনের জনবল ছয় মাস বা এক বছরের মধ্যে অবসরে যাবে, তাদের কোন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রজাতন্ত্রের প্রয়োজনে সরকারের দরকার, যে পদে বা ক্যাডারের কোন কর্মকর্তাকে অবসরের পরও সরকার ব্যবহার করতে চায় তাঁদের ক্যাডারবহির্ভূত বিশেষ পদে নিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি। অবশ্য অর্থমন্ত্রীর এসব প্রস্তাব ফাইলবন্দী অবস্থাতেই আছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।

জানা গেছে, সচিবদের মধ্যে সর্বশেষ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম। গতবছর ২৭ নভেম্বর জনপ্রশাসন সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পদে বদলি করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর তাঁর অবসরে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২৭ ডিসেম্বর অবসরোত্তর ছুটি বাতিল করে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পদে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।

তথ্যসচিব মরতুজা আহমদ গত ২২ জানুয়ারি এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। গত ২৭ নভেম্বর নতুন পদ ‘এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক’ সৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব মো. আবুল কালাম আজাদকে। গত ১০ অক্টোবর এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিক। সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব কাজী মো. আমিনুল ইসলামকে তিন বছরের জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দেওয়া হলেও চাকরি থেকে চলে যাওয়ার অনেক দিন পর সরকারি কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, নৌপরিবহন সচিব অশোক মাধব রায়কে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ১৯ জুলাই শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ভিয়েতনামে রাষ্ট্রদূত পদে প্রেষণে কর্মরত সরকারের সচিব মো. সাহাব উল্লাহকে গত ১৫ মে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরাকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটনের প্রধান কার্যালয়ে ‘বিকল্প নির্বাহী পরিচালক’ পদে যোগদানের জন্য ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞাকে তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। সম্প্রতি সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়েছে সরকার। আর বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল কে এম মমিনুর রহমানকে আরো এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পিআরএল বাতিল করে কেনিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মেজর জেনারেল আবুল কালাম মো. হুমায়ুন কবিরকেও চুক্তি ভিত্তিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এছাড়া সম্প্রতি বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ুয়া, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ভিত্তিতে কাজ করছেন।
সবমিলে বর্তমান প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা আছেন দেড় শতাধিক। তাছাড়া আরো শতাধিক সরকারি কর্মচারী রয়েছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ভিত্তিতে।

জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিবসহ দায়িত্বশীল পদ প্রায় ৮৩টি। এর মধ্য ১৭ জন অতিরিক্ত সচিব দিয়ে দায়িত্ব চালিয়ে নিচ্ছেন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সরকারের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সুপারিশের ভিত্তিতে সম্প্রতি ১৩ জনকে চুক্তিতে নিয়োজিত করা হয়েছে।

বাংলা ইনসাইডার/এমএএম



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭