কালার ইনসাইড

সেকরেড গেমস ২: দর্শক যা মিস করেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/08/2019


Thumbnail

নেটফ্লিক্সের ওয়েব কন্টেন্টকে যদি কৌরব ধরি আর পাণ্ডব ধরি হল বেইজড ফিল্ম কন্টেন্ট তাহলে নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার অশ্বত্থামা অবশ্যই সেকরেড গেমস। ওয়েব কন্টেন্ট বনাম থিয়েটার কন্টেন্টের লড়াই ইন্ডিয়া পর্যন্ত এসেছে তাই নেটফ্লিক্সের স্বাভাবিকভাবেই শুরুটা হতে হতো দুর্দান্ত। সেই শুরুটা তাদের এনে দিয়েছিল সেকরেড গেমসই। এক ধাক্কায় নেটফ্লিক্স পৌঁছে গিয়েছিল সাউথ এশিয়ার অনলাইন বেইজড ইয়ং কম্যুনিটির ঘরে ঘরে। সেকরেড গেমস সিজন ওয়ান শুধু ইন্ডিয়ার পার্স্পেক্টিভ থেকে নয় বরং নেটফ্লিক্সের পার্স্পেক্টিভ থেকেও দারুণ সংযোজন ছিল। 

অনুরাগ কশ্যপ ও বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানের মতো দুজন ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস একসাথে হাত লাগালে স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো গল্প, যেকোনো ক্রিয়েটিভ প্রসেস অসামান্য হতে বাধ্য। হলোও তাই, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি ও সাইফ আলি খানের হাত ধরে বিক্রম চন্দ্রের বইটি প্রাণ পেলো নেটফ্লিক্সের পর্দায়। ভারতীয় উপমহাদেশের মিথগুলোকে সঙ্গী করে গণেশ গায়তোন্ডে ও সরতাজ সিং এর দুটি চরিত্র দর্শককে ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো মুম্বাইয়ের ৪০ বছরের রাজনীতি, আন্ডারওয়ার্ল্ড, ধর্মকেন্দ্রিক ব্যবসা-দাঙ্গা ও ২৫ বছর ধরে বুনে যাওয়া একটা প্ল্যান। ২৫ দিনে বলে যাওয়া এই গল্পকে দু-ভাগে ভাগ করে দুটো সিজনের ১৬টি এপিসোডে দেখানো হয়েছে। প্রতিটি এপিসোডের নাম মিথিক চরিত্র বা উপাদান থেকে নেয়া, যে নামের গভীর সংযোগও থাকে গল্পের সাথে। প্রথম সিজনে গণেশ আর সরতাজের হাত ধরে যে মাস্টারপ্ল্যানের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল সেটিই পূর্ণতা পায় এই সিজনে এসে। কিন্তু কতটা পূর্ণতা পেল?

দ্বিতীয় সিজনের শুরুতেই আমরা গণেশকে আবিষ্কার করি কেনিয়ার সমুদ্র উপকূলে। কিন্তু সে কীভাবে এলো, কেন এলো সেটি এখনো ধোঁয়াশার জালে। ভারতীয় অ্যাম্বাসির ঝানু কর্মকর্তা কুসুম দেবী যাদব আর গুরুজির স্নেহধন্য ত্রিবেদীর হাত ধরে কেনিয়ায় পা রাখে গণেশ গায়তোন্ডে। তার মাঝে এখনো ঈসাকে হত্যা করার ক্ষোভ, আর অ্যাম্বাসির কুসুম চায় গণেশকে ব্যবহার করে ঈসার মাধ্যমে শহীদ খানকে খুঁজে পেতে। কে এই শহীদ খান সেটির উত্তর আমরা শেষের দিকে পেয়ে যাই। সময়টা নব্বই এর দশকে, গণেশ কেনিয়ায় তার ব্যবসা শুরু করে, ওদিকে মুম্বাইতে গ্যাং-গ্রুপ এগুলোর পেছনে পুলিশ লেগেছে খুব ভালো করেই। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়ছিল সে সময়ে। বর্তমান টাইমলাইনে সরতাজদের হাতে তখন মাত্র ১২ দিন সময়, এর মাঝে মুম্বাইকে রক্ষা করতে হবে পাশাপাশি অনেক প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে হবে। ‘সিদুরি’ পর্বে আমরা দেখা পাই গিলগামেশ মহাকাব্যের জ্ঞানী-বিজ্ঞ নারী সত্তা সিদুরিকেই, অর্থাৎ সরতাজের হাত ধরে দেখা পাই আশ্রমের প্রধান বাতিয়া এবেলমেনের। এই নারী গুরুজির কতোটা আপন সেটিও আমরা জানতে পারি পরে গিয়ে। ওদিকে গণেশ দেখা করতে যায় গুরুজির সাথে। ক্রোয়েশিয়ায় গুরুজির আশ্রমে আমরা দেখা পাই ম্যালকম, ভোসলেসহ তরুণ বাতিয়াকেও। তখনও গণেশ ভোসলে বাদে আর কাউকেই চেনে না। কিন্তু আমরা দর্শকরা জানি এদের প্রত্যেকের সাথে জড়িত গণেশ। ওদিকে সরতাজ আবিষ্কার করে তার পিতা দিলবাগ সিংও গুরুজির স্নেহধন্য ছিলেন। গণেশের সাথে দিলবাগের দেখাও হয়ে যায় আশ্রমে একদিন। গুরুজি সত্যযুগের স্বপ্ন দেখেন, কলিযুগ থেকে সত্যযুগে তিনি যেতে চান। কিন্তু সত্যযুগে যেতে হলে বলিদান দিতে হয় অনেককিছু। তাই তিনি তার স্নেহধন্যদের তৈরি করে নিতে চান সে কাজের জন্য। যে গণেশ মুম্বাই দাপিয়ে বেড়িয়েছে সে গুরুজির আশ্রমে এসে যেন বিশ্রাম খুঁজে পায়। তার তৃতীয় পিতা হিসেবে গুরুজিকে সম্মান করে এমনকি আশ্রমে দৈহিক সান্নিধ্যে সে গুরুজিকে কামনা করে। ওদিকে সরতাজ জানতে পারে মুম্বাইয়ে নিউক্লিয়ার এটাক হতে যাচ্ছে আর এই এটাক করতে যাচ্ছে শহীদ খান। সে আন্দাজ করে আশ্রমের সাথে, গায়তোন্ডের সাথে এই এটাকের কোন যোগসূত্র রয়েছে, যোগসূত্র রয়েছে তার পিতার সাথেও। সে আশ্রমে গিয়ে তথ্য আবিষ্কার করতে গিয়ে নিজেই আশ্রম থেকে দেয়া নেশাদ্রব্যে এডিক্ট হয়ে যায়। সে নেশাদ্রব্য তৈরির ইতিহাসও আমরা দেখতে পারে ফ্ল্যাশব্যাকে গণেশের টাইমলাইনে। গুরুজির সত্যযুগে নিয়ে যাবার জন্য গণেশকে সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন, দিলবাগ সিং-ম্যালকম-বাতিয়া-ভোসলে-ত্রিবেদী সকলেই এই মাস্টারপ্ল্যানে কোন না কোনভাবে যুক্ত হয়ে যায়। আর সরতাজ তখনও শহীদ খানের খোঁজে, এই শহীদ খানকে সাহায্য করেছে ম্যালকম। অর্থাৎ গুরুজির প্ল্যান বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে শহীদ খানের হাত ধরে। কিন্তু গায়তোন্ডে সেখানে বিপক্ষে চলে যায়। সে নিজেকে অশ্বত্থামা দাবী করে, কিন্তু আমরা দিলবাগ সিং এর নোটবুকে লেখা পাই দিলবাগ সিংকে গুরুজি অশ্বত্থামা বলেছিলেন। গণেশকে সবদিক থেকে ধোঁকা দেয়া হয়, একসময়ের মুম্বাইয়ের ত্রাস গণেশকে আমরা দেখি গুটিয়ে যেতে। কিন্তু গণেশ মৃত্যুর আগে ঠিকই সরতাজকে জানিয়ে যায় ব্লাস্টের কথা, গুরুজির প্ল্যান নাকি গণেশের চাওয়া কোনটা সফল হয় সেটিই দর্শক জানতে চাচ্ছিল কিন্তু শেষে গিয়েও সেটির উত্তর পাওয়া হল না।

সেকেন্ড সিজন অনেকদিক থেকেই প্রথম সিজনে বেঁধে দেয়া সুরের কাছাকাছি যেতে পারে নি। এর অনেকগুলো কারণই আছে। যার মাঝে প্রধান কারণ হল অতিরিক্ত সাবপ্লট এবং সেসব সাবপ্লটের ফিনিশিং না দেয়া।

এই সিজনে আসা সাবপ্লটগুলো-

- শহীদ খান সাবপ্লট

- ত্রিবেদী সাবপ্লট ( বাপ ত্রিবেদী)

- শহীদ খানের মা- সরতাজের মা এর সম্পর্কের কানেকশনের সাবপ্লট

- দিলবাগ সিং এর সাবপ্লট

- সরতাজ আর তার স্ত্রীর সাবপ্লট

- যাদব স্যারের সাবপ্লট

- মাজিদের সাবপ্লট

- পারুলকার আর ভোসলের সাবপ্লট

- জোজো আর জামিলার সাবপ্লট

- ম্যালকমের সাবপ্লট

- মুত্থুর সাবপ্লট

এসবের মাঝে একটা-দুটো বাদে সবগুলোই আনফিনিশড রেখে দেয়া হয়েছে সম্ভাব্য সিজনের জন্য অবশ্যই। যার কারণে প্রথম সিজনে স্ট্যাবলিশ করা অনেককিছুই হারিয়ে গিয়েছে। স্ট্যাবলিশড সাবপ্লট, ক্যারেক্টার অনেককিছুই এ সিজনে পাত্তাই পায় নি। বান্টি, কান্তা বাই, পারুলকার, ভোসলে, ত্রিবেদী এই ক্যারেক্টারগুলো একেবারেই স্ক্রিনটাইম পায় নি আর পেলেও কোন ভালো ফিনিশিং পায় নি। গুরুজি আর বাতিয়ার চরিত্রও একেবারেই একরৈখিক ছিল। এই দুটো চরিত্রই ওশো ও মা আনন্দ শীলার অনুকরণে করা। ওশোর রাজনীশ মুভমেন্ট, আশ্রম, নিজস্ব কাল্ট প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন টেরোরিস্ট এক্টিভিটিতে তাঁর অনুসারীদের আবিষ্কার করা সবকিছুই মিলে যায় গুরুজির ফিকশনাল চরিত্রের সাথে। সেদিক থেকে জোজো আর যাদব এই দুই চরিত্রে সুরভিন ও আম্রুতা এই দুই নারী চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। অন্যদিকে শাহিদ খানের স্ক্রিনটাইমই ছিল না বলতে গেলে, আমি নিশ্চিত এই চরিত্র তৃতীয় সিজনের প্রধান চরিত্র হবে কেননা চিত্রায়নে রনভীর শোরের মতো অনবদ্য অভিনেতা আছেন, তাকে ওয়েস্ট করার কোন মানেই হয় না। মূল চরিত্রের কথা বললে প্রথম সিজনে গণেশ যতটা উজ্জ্বল ততটাই অনুজ্জ্বল ছিলেন মনে হল দ্বিতীয় সিজনে এসে, আর প্রথম সিজনে গণেশের আড়ালে পড়ে যাওয়া সরতাজ এবার যেন জ্বলে উঠেছেন স্বমহিমায়। নাওয়াজের অভিনয় নিয়ে কিছুই বলার নেই তবে ওর চরিত্রের গভীরতা কমে গেছে মনে হল। হয়তো সোর্স ম্যাটেরিয়াল প্রথম সিজনেই সব ফুরিয়ে ফেলেছেন অনুরাগ। তা নাহলে অনুরাগের কাজ ঠিক অনুরাগের মতো হল না বলতে হবে। গায়তোন্ডের টাইমলাইন থেকে গতি একেবারেই হারিয়ে গেছে বলে মনে হল, স্রেফ লাফিয়ে লাফিয়ে সময় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া বাড়তি কিছু ছিল না। অন্যদিকে বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানের জায়গায় আসা নীরজা ঘেওয়ানের নির্দেশনা অপূর্ব লেগেছে। সরতাজের টাইমলাইন ও গল্প দুটোতেই দারুণ গতি ছিল। সবমিলিয়ে গতবার যেমন গায়তোন্ডের গল্প সরতাজের গল্পকে কমপ্লিমেন্ট করেছিল সেরকমটা এবার হয়নি বলেই হয়তো অগোছালো ঠেকছে সবকিছু। দুজন নিজেদের মতো করে নিজেদের গল্প বলে গেছেন বলেই কি এই অবস্থা নাকি এডিটিং এ গিয়ে সব গড়বড় হয়েছে বোঝা গেল না ঠিক। তৃতীয় সিজনের জন্য সাবপ্লট গোছানো আছে, সরতাজ-শহীদ খান-দিলবাগ-বাতিয়া কেন্দ্রিক গল্প হবার কথা। তবে গণেশকে যদি আবার গল্পে নিয়ে আসতে হয় সেক্ষেত্রে দারুণ কিছু করেই ফিরিয়ে আনতে হবে। গণেশকে গণেশের মতো ব্যবহার না করতে পারলে নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার এই অশ্বত্থামা সামনেই হয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে। দ্রোণাচার্য (অনুরাগ কশ্যপ) কী শুনছেন?

বাংলা ইনসাইডার/এমআরএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭