ইনসাইড ইকোনমি

চামড়ার কারবারিদের ভবিষৎ অন্ধকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/08/2019


Thumbnail

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এ বছর কাঁচা  চামড়ার দর পতনে রেকর্ড গড়েছে। চামড়ার দাম কমায় সংশ্লিষ্ট চামড়ার কারবারিদের ব্যবসার সমীকরণ মোড় নিয়েছে অন্য দিকে। বিগত সাত বছরে চামড়ার দাম কমতে কমতে এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, এই ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা শত বছরের অধিক সময় ধরে বংশ পরম্পরায় করে আসা পৈতৃক পেশা বদলে অন্য পেশা বা কর্মে মনোযোগী হচ্ছে। 

দেশের কাঁচা চামড়া প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণ করার জন্য একমাত্র স্থান  হচ্ছে রাজধানী ঢাকার লালবাগ থানার পোস্তা এলাকা। এই এলাকায় শত বছরেরো অধিক সময় ধরে বংশ পরম্পরায় চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যাবসার সাথে জড়িত ছিলো প্রায় দুই হাজারের অধিক পরিবার। যা কমতে কমতে এখন এসে দাঁড়িয়েছে ২৮৫ পরিবারে। এই এলাকায় মূলত চামড়ার কারবারিরা দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ হচ্ছে নিজেদের গোডাউনে চামড়া সংরক্ষণ করে ট্যানারী মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এদের চামড়া ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় থাকলেও এড়া মূলত এই ব্যাবসার মধ্যস্তভোগী। বিগত ত্রিশ বছর ধরে এই অংশটির সংখ্যা ছিলো ২০০ জন কিন্তু এখন সক্রিয়ভাবে ব্যবসা করছেন মাত্র ৮০ জন। অপর দিকে অন্য ভাগটি হচ্ছে স্থানীয় ভাষায় ফড়িয়া। এই অংশটিই দেশের প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ী। এরা  নিজেদের গাটের টাকা দিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া কিনে এনে গোডাউনের মালিক বা মধ্যস্তভোগীদের কাছে সংরক্ষণ করেন। এই ফরিয়াদের সংখ্যা ছিলো প্রায় সতের শতের মতো কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন অধিকাংশই। সতের শত থেকে কমতে কমতে এই অংশটির সংখ্যা এখন এসে দাড়িয়েছে সর্বচ্চ দেড় শত জনে। 

পোস্তার চামড়া ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টদের কেন এমন অবস্থা? জানতে কথা হয় একশত বছরের পুরনো চামড়া সংরক্ষণ ও মধ্যস্তভোগী প্রতিষ্টান আব্দুর রাজ্জাক এ্যান্ড সন্সের সহকারী ব্যবস্থাপক ফিরোজ আহমদের সাথে। প্রায় পয়ত্রিশ বছর থেকে এই ব্যবসার সাথে যুক্ত ফিরোজ বাংলা ইনসাইডারের সাথে আলাপকালে জানান, এর জন্যে সব থেকে বেশি দায়ী ট্যানারী মালিকরা। তিনি বলেন, হাজারিবাগের ট্যানারী মালিকদের কাছে পোস্তার ১৩৫ টি মধ্যস্তভোগী প্রতিষ্ঠান চারশত কোটি টাকার উপরে পাওনা আছে। এই টাকাগুলো কিন্তু এক দিনে জমা হয়নি তাদের কাছে। এগুলো কম করে হলেও বিশ বছর ধরে আটকা আছে। ট্যানারীর মালিকদের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে এই টাকাগুলো কবে পাবে মধ্যস্তভোগীরা। কোরবানির ঈদের আগে চারশত কোটি পাওনা টাকার মধ্যে পাঁচ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যা গড় হিসেব করলে প্রত্যেকে পাওনা টাকার শতকরা পাঁচ ভাগও পায়নি। শুধু এ্যাপেক্স,আজিজ আর সুপার ট্যানারী নিয়মিত ও নগদ টাকা পরিশোধ করে বলে জানান তিনি।

এই ব্যবসার সিস্টেম হলো, ফড়িয়ারা নিজেদের টাকা দিয়ে চামড়া কিনে এনে আমাদের এখানে সংরক্ষণ করতে দেয় এবং আমরা সংরক্ষণ করে সেগুলো ট্যানারীর মালিকদের কাছে বিক্রি করে  দেই। বিক্রির পরে ট্যানারী মালিকরা আমাদের যে টাকা দেয় সেই টাকা থেকে সংরক্ষণ ও মধ্যস্ততার কমিশন রেখে বাকি টাকাটা আমরা ফড়িয়াদের দেই। ওই টাকাটা নিয়ে তারা আবার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে। কিন্তু দেখেন, যখন যুগের পর যুগ টাকা আটকে থাকে ট্যানারির মালিকদের কাছে তখন ফড়িয়ারা আর কত দিন নিজেদের টাকা দিয়ে মাল কিনে ফেলে রাখবে। ব্যবসায় পুঁজি খাটিয়ে যদি সেই পুঁজি আটকে থাকে তখন সেখানে আর নতুন করে পুঁজি খাটাতে চায় না অনেকে। আবার অনেকে পুঁজি খাটাতে খাটাতে নিঃস্ব হয়ে গেছে এমন নজিরও আছে। 

উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, আমাদের আব্দুর রাজ্জাক এ্যাণ্ড সন্স পোস্তার পাঁচটা চামড়া সংরক্ষণ ও মধ্যস্তভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য একটা। আমরাই ট্যানারী মালিকদের কাছে পাওনা আছি বিশ কোটি টাকা অথচ কোরবানির ঈদের আগে আমাদের দেওয়া হলো মাত্র ৩১ লাখ টাকা। এখন এই টাকা দিয়ে আমরা ফড়িয়াদের পাওনা পরিশোধ করবো না কি কোরবানির সময় নতুন চামড়া কিনবো? সব কিছু হিসেব করে আমরা ফড়িয়াদের পাওনা সাধ্যমতো পরিশোধ করেছি এবং টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় কোরবানীতে কোন চামড়া আমরা কিনি নাই। অথচ সারা বছরে আমাদের লভ্যাংশের পঞ্চাশ ভাগ কিন্তু আসে এই কোরবানির চামড়া থেকেই। এই অবস্থা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি, ধাপে ধাপে এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের ব্যবসা। গত পাঁচ থেকে সাত বছর থেকে আমরা এমন লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বিগত কয়েক বছরে আমাদের প্রতিষ্ঠান ব্যবসার পরিধী ব্যাপক কমিয়ে ফেলেছে। শুধু আমরাই না এক সময় পোস্তায় দাপুটে প্রতিষ্ঠান ছিলো এমডি এন্টারপ্রাইস, সম্রাট এন্টারপ্রাইস, হাজী সিকান্দার ইন্টারপ্রাইসসহ মাহবুব এ্যান্ড সন্স।

এখন এই প্রতষ্ঠানগুলো কয়েকটা বন্ধ আর কিছু বন্ধের পথে। এসব প্রতিষ্টানের মালিক দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে আছে। সামাজিক ভাবে হেয়প্রতিপন্ন হবার আগেই অনেকেই ১ কোটি টাকার বাড়ি ৮০ লাখে বিক্রি করে দিতে চাইছেন। যিনি বাড়ি বিক্রি করতে চাইছেন ৮০ লাখ টাকায় তার ঋণ রয়েছে ৯০ লাখ টাকা। আবার অনেকেই চামড়ার গোডাউন বাদ দিয়ে সেগুলো প্ল্যাস্টিক ফ্যাক্টরির কাছে ভারা দিয়ে দিয়েছেন। কেও কেও বাবা-দাদার এই ব্যবসা গুঁটিয়ে নিয়ে শুরু করেছেন অন্য ব্যবসা। 

এতো গেলো মধ্যস্তভোগীদের কথা  কিন্তু যারা ফড়িয়া তাদের অবস্থা আরো করুণ। ফিরোজ আরো জানান, অনেকেই আটকে থাকা পুঁজি উঠাতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। চোখের সামনে অনেককেই নিঃস্ব হয়ে পান-বিড়ি,সিগারেটের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখতেছি। 

তাহলে দেশে এই ব্যবসা আর প্রাথমিক পর্যায়ের সংশ্লিষ্টদের ভবিষ্যৎ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এক কথা উত্তর দিয়ে বলেন, অন্ধকার। আসলে যেভাবে চলছে সেভাবে চললে পুরো দেশের চামড়া ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যাবে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ট্যানারী মালিকদের সদিচ্ছা আর সরকারের সঠিক পদক্ষেপই পারে চামড়া শিল্পেকে এই বেহাল দশা থেকে বাঁচাতে। উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, সরকার যখন কাঁচা চামড়া রপ্তানী করার কথা ঘোষণা দিলো তখন কিন্তু ট্যানরী মালিকরা উচিৎ মূল্যে চামড়া কিনতে শুরু করেছে, ঈদের এক দিন পরে যেই চামড়া বিনামূল্যে দিলেও কেও নেয় নাই সেই চামড়া এখন ট্যানারী মালিকরা  এগারশত থেকে তেরশত টাকায় কিনছে।

উল্লেখ্য, এবারের কোরবানী ঈদে জবাই করা পশুর কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট সরকারি ভাবে নির্ধারোন করে দেওয়া হয়েছিলো ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা আর ছাগলের চামড়া প্রতি বর্গফুট নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিলো ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা। কিন্তু ফড়িয়াদের হাতে টাকা না থাকায় চামড়া কেনার মতো মানুষ না পেয়ে দেশের নীলফামারি,বগুড়া,চট্টগ্রামসহ সিলেটের বেশ কিছু এলাকায় কাঁচা চামড়া মাটিতে পুতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।              



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭