ইনসাইড থট

বাংলাদেশে আদিবাসী এবং দলিতদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় প্রসঙ্গ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/10/2019


Thumbnail

একথা বহুল ভাবে প্রচারিত হচ্ছে যে এক বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন  অবস্থানের উন্নতি হয়েছে তিন ধাপ। ১৮৯টি দেশকে অতি উন্নত, উন্নত, মধ্যম ও নিম্ন মানব উন্নয়নের চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে এবং ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০১৮ থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ রয়েছে মানব উন্নয়নের মধ্যম দেশের স্তরে। প্রতিবেদনে ১৮৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩৬তম যার বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১,৭৫১ ডলার  যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সর্ব্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৮৬%। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার প্রসার উন্নয়নের একটি বিশেষ চিত্র তুলে ধরলেও প্রকৃত চিত্র বলছে এখনও অনেক মানুষ উন্নয়নের তলানিতেই পড়ে আছে। দেশের এই ২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে যার মধ্যে ১২ শতাংশই হতদরিদ্র এবং এই ১২ শতাংশ  হতদরিদ্রদের মধ্যে যাদের অবস্থান অগ্রগন্য তারা সমতল ও পাহাড়বাসি সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়। শুধুমাত্র মাথাপিছু গড় আয়ের উলম্ফন দিয়ে এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার বহুমাত্রিক প্রান্তিকতা বিচার করা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা সরকারের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা,  টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠ, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা, রূপকল্প ২০২১ , বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ ইত্যাদি অর্জনের পথে সুস্পষ্ট বাঁধা তৈরী করবে।  তাই সরকারের চলমান উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখতে এবং উল্লিখিত বহুমাত্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তব রূপ দিতে প্রয়োজন বাংলাদেশের সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদাইয়ের বহুমাত্রিক প্রান্তিকতা দূর করে স্থায়ীত্বশীল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সরকার উদ্ভাবনী উন্নয়ন উদ্যোগ নিতে হবে। এই নতুন ও উদ্ভাবনী উন্নয়ন উদ্যোগ নিঁখুতভাবে বাস্তবায়নের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বাংলাদেশের সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করতে না পারা। তাই সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় সরকারের ইচ্ছা থাকলেও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, শিক্ষাবৃত্তি, কারিগরী দক্ষতা উন্নয়ন অবকাঠামো সম্প্রসারণ, আবাসন তৈরীতে সহায়তা, উদ্যোক্তা পর্যায়ে নগদ সহায়তা ইত্যাদি উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাংলাদেশের সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়কে নিশ্চিত ভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারছে না এবং অন্যদিকে, সামাজিক ও বেসরকারি সংগঠন গুলোও সরকারি সঠিক জমমিতি না পাবার ফলে সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিতে পারছে না।  এই সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারের ২০২১ সালের জনসুমারিতে যেন সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা যায় সরকারকে যে ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ বহুমাত্রিক জাতিগোষ্ঠীর একটি দেশ। বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্যান্য ধর্মালম্বী সকলেই বাঙ্গালি নয়। এদেশে বাস করছে বাঙ্গালি মুসলমান, অবাঙ্গালি মুসালমান, বাঙ্গালি হিন্দু, অবাঙ্গালি হিন্দু, বাঙ্গালি খৃষ্টান, অবাঙ্গালি খৃষ্টান, বাঙ্গালি বৌদ্ধ, অবাঙ্গালি বৌদ্ধ এবং অন্যান্য জাতিসত্ত্বা এবং ধর্মালম্বী মানুষ। এই নানামুখি বৈচিত্রতার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী হচ্ছে সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায় এবং এই সব মানুষের সংখ্যা বেসরকারি নানা হিসেবে প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন। এই সড়ে সাত মিলিয়নের মধ্যে ২.৫ মিলিয়ন হচ্ছে সমতলে ও পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং ৫ মিলিয়ন জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের।  প্রায়ই ব্যাবহৃত এই সংখ্যাটি নিয়ে যদিও গবেষক মহলে ভিন্নমত আছে। সংখ্যা ভিত্তিক এই ভিন্নমত সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যা নির্নয়ে জটিলতা হিসেবে বিরাজ করে এবং সরকারি হিসেবের সাথে সাংঘর্সিক। এই সংখ্যা গত সংঘর্স আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্য ব্যাবহারে নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্ন বিদ্ধ করে বারবার। ভৌগলিক ভাবে এই জনগোষ্ঠী অতীতকাল থেকে বাসকরে আসছে বাংলাদেশের দক্ষিন-পুর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১৮ টি জেলাতে।  এই ১৮ টি জেলাতে বসবাসরত সমতলের এবং পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ মায়ানমানের আরাকান অঞ্চল থেকে, ভারিতের ত্রিপুরা, খাসিয়া, পশ্চিম বাংলা এবং অনেকে জনগষ্ঠী মধ্য ভারত থেকে সুদূর অতীতে বাংলাদেশে অভিবাসন নিয়েছে এবং আদিবাসী হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। এই নৃগোষ্ঠী গুলো যেহেতু নিজস্ব জাতি রাষ্ট্র গঠন করতে পারে নাই তাই তারা বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দ্বারা হরহামেশাই প্রভাবিত, নির্যাতিত এবং প্রিতারিত।  এই সমতলের এবং পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ ব্যাতিত অন্যান্ন  জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত অমুসলিম এবং দলিত সম্প্রদায়ের বসবাস বাংলাদেশের সর্ব অঞ্চলে, বিশেষত শহরাঞ্চলে। এই গোষ্ঠী পেশাগত, সনাতনী ধর্মাশ্রিত বর্ন এবং জাত-পাতের কারণে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষণের শিকার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ৫ম আদমশুমারি ও গৃহগণনা-২০১১ হিসাব বলছে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তথা আদিবাসীদের সংখ্যা ২৭টি এবং মোট জনসংখ্যা ১৩,৮০,৪৮৮ জন, অর্থাৎ ১.৪ মিলিয়ন।  এই ১.৪ মিলিয়নের মধ্যে পেশাগত, সনাতনী ধর্মাশ্রিত বর্ন এবং জাত-পাতের কারনে অচ্ছুত গোষ্ঠী গুলোও রয়েছে। এই গোষ্ঠী গুলো আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর থেকে নানা মাত্রায় স্বতন্ত্র হলেও তাদের আলাদা হিসেবে গন্য করা হয়নি। তাই তার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ৫ম আদমশুমারি  ও গৃহগণনা-২০১১ এর রিপোর্টে যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে তার বাইরে রয়ে গেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তারা হচ্ছেঃ   চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চ্যঙ্গা, বম, পাঙ্খুয়া, চাক, খেয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ,  সাঁওতাল, ডালু, উসাই, রাখাইন, মণিপুরী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মং, ওঁরাও, বর্ম্মন, পাহাড়ি, মালপাহাড়ি, মুন্ডা, কোল, কন্দ, পাংখো, পাংগোন, মুর, রাজবংশী, পাত্র এবং গঞ্জু। দেখাযাচ্ছে সরকারি হিসাব আর বেসরকারি হিসাবের মধ্যে বিশাল ফাক রয়েছে। সরকারি হিসাবে পাকপাকি ৬.১ মিলিয়ন সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের কোন হদিস নেই। কেন এই বিশাল তথ্যগত ফারাক? বলতে চাচ্ছি না যে বেসরকারি হিসাবই সঠিক এবং সরকারি হিসাব সঠিক নয়। এখানে অস্বীকৃতির এবং রাজনীতির একটা ব্যাপার রয়ে গেছে। এই অস্বীকৃতির এবং রাজনৈতিক অণুঘটকের উপস্থিতি পরিষ্কার বোঝা যায় যখন দেখা যায় সরকারের দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তথ্যের ফারাক রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর যেখানে ২৭ টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তথা আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিচ্ছে সেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন তারিখ: ০৫ চৈত্র ১৪২৫ বক্সগাব্দ/১৯ মার্চ ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ এস. আর. ও. নং-৭৮-আইন/২০১৯। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ২৩ নং আইন) এর ধারা ১৯ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি  তফসিল বলছে ৫০ টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তথা আদিবাসীদের কথা। এই সব ক্ষুদ্র  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাম হচ্ছেঃ ওরাওঁ, কোচ, কোল, খাসিয়া/খাসি, খিয়াং, খুমি, গারো, চাক, চাকমা, ডালু, তঞ্চক্সগা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া/পাংখো, বম, বর্মণ, মণিপুরী, মারমা, পাহাড়ী/মালপাহাড়ী, মুন্ডা, ম্রো, রাখাইন, লুসাই, সাঁওতাল, হাজং, মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো, কন্দ, কড়া, গঞ্জু, গড়াইত, গুর্খা, তেলী, তুরি, পাত্র, বাগদী, বানাই,  বড়াইক/বাড়াইক, বেদিয়া, ভিল, ভূমিজ, ভূঁইমালী, মালো/ঘাসিমালো, মাহালী, মুসহর,রাজোয়াড়, লোহার, শবর, হুদি, হো, খারিয়া/খাড়িয়া এবং খারওয়ার/খেড়োয়ার। বিশ্লেষন করলে দেখা যাচ্ছে ২৩ টি গোষ্ঠী সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন ২০১৯ এ নতুন ভাবে যুক্ত হতে পেড়েছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ২০১১ সাল হতে ২০১৯ অর্থাৎ ৮ বছর তারা সরকারের কাছে অস্বীকৃত ছিলো। সহজেই অনুমেয় যে এই ২৩ দল সরকার থেকে নিদেন পক্ষেও কোন অধিকার ভোগ করতে পারেনি। সরকার তাদের কোন প্রকার উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে গন্যই করেনি। এই ২৩ টি অস্বীকৃত জাতি গোষ্ঠী হচ্ছেঃ মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো, কড়া, গঞ্জু, গড়াইত, গুর্খা, তেলী, তুরি, বাগদী, বানাই,  বড়াইক/বাড়াইক, বেদিয়া, ভিল, ভূমিজ, ভূঁইমালী, মালো/ঘাসিমালো, মাহালী, মুসহর,রাজোয়াড়, লোহার, শবর, হুদি, হো, খারিয়া/খাড়িয়া এবং খারওয়ার/খেড়োয়ার। আবার দেখাযাচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ৫ম আদমশুমারি  ও গৃহগণনা-২০১১ যারা তালিকা ভূক্ত ছিলো যেমনঃ পাংগোন, মুর, রাজবংশী, উসাই, মং, বর্মন এরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন ২০১৯ থেকে ছিটকে গেছেন। আবার মালপাহাড়ি এবং পাহাড়ি যারা ২০১১ এর আদমশুমারিতে এক গোত্র ভুক্ত ছিল সেই গোত্রকে ২০১৯ সালের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রানালয়ের প্রজ্ঞাপনে আলাদা গোত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রানালয়ের প্রজ্ঞাপন নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যায়। পাংগোন, মুর, রাজবংশী, উসাই, মং, বর্মন এরা তবে কি আলাদা নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত হবে না? তাহলে তারা কি সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং  কর্মকান্ড থেকে বাদ পড়ে যাবে? সংখ্যা নিয়ে এইসব অস্বচ্ছতা সরকারী এবং বেসরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ডে জটিলতা বাড়িয়ে চলবে। বাংলাদেশের সমতল ও পাহাড়বাসি সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের সংখ্যা নির্ধারনে এই চলমান জটিলতা সমাধা না হলে সমতা ভিত্তিক উন্নয়নের বদলে অসমতা ব্যাপক হয়ে উঠবে।

২০১২-১৩ আর্থিক বছরে সরকার “মাইনরিটি অ্যান্ড আন্ডারপ্রিভিলেজড কমিনিটি” দের জন্য জাতীয় বাজেটে ২১৮ এবং ২২১ নম্বর উপ-ধারায় উন্নয়ন বাজেট নির্ধারন করে। পরিতাপের বিষয় যে সেই উন্নয়ন বাজেট রাখা হয়েছিল শুধুমাত্র পাহাড়ি আদিবাসিদের জন্য, তাও অপ্রতুল। সে সময় সরকারের সমতলবাসি আদিবাসিদের স¤পর্কে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। কারন পরিসংখ্যান গত কোন তথ্যই ছিলো না সরকারের কাছে। এই অনুন্নয়নের ধারাবাহিকতা ২০১৩-১৪ অর্থ বছরেও অপরিবর্তিত রয়ে যায় তবে সে বছর দলিত, হিজড়া, বেদে এদের জন্য কিছু বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১১-১২ সালে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয় সমতলের আদিবাসীদের নামে যার পরিমান ছিল মাত্র ১৫ কোটি। সরকারী আদমশুমারি ২০১১ মেনে নিয়েও যদি মাথাপিছু হিসেব করা যায় তবে সমতলের সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের জন্য জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল ১০৯ টাকা। এমন হাস্যকর বরাদ্দের কথা নাই বা বললাম কিন্তু এই চরম নিগৃহতার কারন জাতি হিসেবে তাদের রাজনৈতিক অস্বীকারের সংস্কৃতি আর যথাযথ পরিসংখ্যানের অভাব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অফিসের স্পেশাল অ্যাফিয়ারস ডিভিশন এই বরাদ্দ পরিচালনা করতো এবং তারাই বলেছে যে বিশেষ বরাদ্দ পরিকল্পনার সময় তাদের ধারনা ছিল না যে সমতলের সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের প্রকৃত সংখ্যা কত এবং সমতলের ক্ষুদ্র জাতি গুলোর কোন প্রতিনিধি নেয়া হয় নাই। তাই বলতেই হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্রতা কমলেও এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষ উন্নয়নের মূলস্রোতধারার বাইরে রয়ে গেছে।  ফলে তাদের জীবনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যেও ব্যাপক। ২০১০ সালের জরিপ অনুসারে গ্রামাঞ্চলে ৩৫.২% মানুষ এবং শহরাঞ্চলে ২১.৩% মানুষ চরম দারিদ্রের ভেতর বসবাস করছে । এই বছর জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী “সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ। সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের” শীর্ষক ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য যে প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেছেন, সেখানে আদিবাসী, বঞ্চিত, অবহেলিত, পিছিয়েপড়াসহ সকল মানুষের আশা আঙ্খাকার প্রতিফলন ঘটবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিলো। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে আসা নতুন সরকার দেশের উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি এবং অবহেলিত আদিবাসী মানুষের প্রতি সরকারের অঙ্গীকার, সকল বিবেচনাতেই ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেট নিয়ে উন্নয়ন কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেই বাজেট  ৫০ টি আদিবাসী ও অন্যান্ন পিছিয়ে রাখা জাতিগোষ্ঠীর ৭০ লক্ষাধিক জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। বরং জাতীয় বাজেটে আদিবাসীরা বরাবরই অবহেলার শিকার হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দ্রারির্দ্য হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। অতি দ্রারির্দ্যের হার ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১১ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন বেড়ে ১,৯০৯ ডলার হয়েছে। কিন্তু সরকারের কাছে সমতলের এবং পাহাড়ের সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায় স¤পর্কে কোন বিভাজিত তথ্য নাই যা এই সব জনগোষ্ঠীদের  মাঝে দারিদ্যের হার স¤পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারে। তাদের প্রকৃত মাথাপিছু আয় কত কিংবা তাদের মাঝে আসল দারিদ্যের হার কত এখন? শুধুমাত্র গড়ের হিসাবে উন্নয়নকে পরিমাপ করা হলে আদিবাসীরা বঞ্চিতই থেকে যাবে, কখনই তাদের প্রকৃত বঞ্চনার তথ্য বেরিয়ে আসবে না। আমাদের ধারণা মতে, আদিবাসীদের মাঝে দারির্দ্যের হার এখনো ৬৫% এর কম হবে না। রাঙামাটি আর বান্দরবানে দারির্দ্যের হার যথাক্রমে ৬৪ শতাংশ এবং ৬৩.২ শতাংশ, সমতলের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা দিনাজপুরে এই হার ৬৪.৩ শতাংশ। আদিবাসীদের গড় আয় জাতীয় গড় থেকে কম। পাহাড়ের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ কম, সমতলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ কম। সমতলের দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী কার্যত ভূমিহীন। এটি বাস্তবতা যে সমতলের বিশ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বরাবরই উন্নয়ন বাজেটে অবহেলিত ও বঞ্চিত থাকে। তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন এবং মন্ত্রণালয় বা খাতভিত্তিক বাজেট প্রণয়ণের দাবি করে আসছে আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করে আসছে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও । কিন্তু কোনবারই এ উদ্যোগ গ্রহণে বরাদ্দ রাখা হয় নি। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৭৪,৩৬৭ কোটি সামাজিক সুরক্ষায় বাজেট ধরা হয়েছে । যা বাজেটের ১৪.২১ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। গত বাজেটের চেয়ে এটি ১০,১৯০ কোটি টাকা বেশি। খুবই দুঃখজনক যে, বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)-র জন্য থোক বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা ছাড়া সামাজিক সুরক্ষায় আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সামগ্রিকভাবে সামাজিক সুরক্ষার এই বরাদ্দ বৃদ্ধি যদি অবহেলিত ও প্রান্তিক মানুষের অবস্থার উন্নতির লক্ষ্য হয় তাহলে এখানে অবশ্যই আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা উচিত এবং আরো প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।

এই সব অতি বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য চাই ২০২১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনয় সমতলের ও পাহাড়ি সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের প্রকৃত সংখ্যা কত তা পুংখানুপুংখু রূপে বের করা এবং সঠিক প্রতিবেদন পেশ করা।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ১০ বছর পর পর আদমশুমারি পরিচালনা করে থাকে। জনসংখ্যা এবং খানা জরীপ হচ্ছে একটি দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন কাজ যা সরকারের দেশ পরিচালনা, নীতি নির্ধারন, উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন, বাজেট বরাদ্দ নির্ধারন ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য অতীব প্রয়োজন। জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠ ১৭ তে সরকারের জাতীয় পর্যায়ে জনসংখ্যা এবং খানা জরীপকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। কারন যে কোন সংখ্যাগত উপাত্তের জন্য জনসংখ্যা এবং খানা জরীপ তথ্যই একমাত্র গ্রহণযোগ্য মাধ্যম। সেখানে বলা হয়েছে ২০২১ এর আদমশুমারিরে যেন কোন প্রান্তিক, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী এমন কি ভবঘুরে যেন না বাদ যায় এবং দেশের প্রতিটি ভৌগলিক এলাকা যেন এর আওতা থেকে বাদ না পড়ে। ২০১১ আদমশুমারি তিন পর্যায়ে স¤পন্ন হয়েছে এক. মূল গণনা, দুই. পোস্ট এনুমারেশন চেক তিন. সাধারণ গণনা: একটি নির্দিষ্ট এলাকা যাচাই। ১৬ জুলাই ২০১১ সালে আদমশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।২০২১ সালে ষষ্ঠবারের মতো আদমশুমারি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এবারেও একই পদ্ধতি অনুসরন করা হবে। এরই মধ্যে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি। উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান গুলো চেষ্টা করছে এবারের সুমারিতে যেন সমতলের ও পাহাড়ের  সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের স¤পৃক্তটা ঘটে। সেই নিমিত্ত্বে আন্তর্জাতিক দাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে এবারই প্রথমবারের মত সট এবং লং প্রশ্নপত্র তৈরীর কাজে চলছে।  এই শুমারিতে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে এবং আশা রাখি আগত জনমিতি সার্ভেতে সমতলের ও পাহাড়ি সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের প্রকৃত সংখ্যার পাশাপাশি এদেশের মুসলিম অছ্যুত জাতি যেমন পাঙ্গাল এবং মানতা যারা যথাক্রমে সিলেট, মৌলভিবাজার এবং পটুয়াখালি অঞ্চলে বাস করে তাদের সংখ্যাও নিরূপিত হবে। আর তা না হলে বাংলাদেশর পক্ষে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট অর্জন অসম্ভব হয়ে থাকবে।

(অনিক আসাদ একজন নৃবিজ্ঞানী  এবং একই সাথে একজন মানবাধিকার কর্মী, তিঁনি বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের জন্য কাজ করছেন। বর্তমান তিনি বাংলাদেশে হেক্স/ইপার এর কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসাবে কর্মরত আছেন। হেক্স/ইপার  বাংলাদেশে বহুল আলোচিত আন্তজার্তিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান যারা মানবাধিকার ভিত্তিক সমভূমি আদিবাসী ও দলিত সম্পদায়ের সামাজিক অন্তভূক্তির বিষয়টি বিশেষ ভাবে আলোকপাত করে।)

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭