নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:০০ এএম, ১১ অক্টোবর, ২০১৯
একথা বহুল ভাবে প্রচারিত হচ্ছে যে এক বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন অবস্থানের উন্নতি হয়েছে তিন ধাপ। ১৮৯টি দেশকে অতি উন্নত, উন্নত, মধ্যম ও নিম্ন মানব উন্নয়নের চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে এবং ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০১৮ থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ রয়েছে মানব উন্নয়নের মধ্যম দেশের স্তরে। প্রতিবেদনে ১৮৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩৬তম যার বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১,৭৫১ ডলার যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সর্ব্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৮৬%। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার প্রসার উন্নয়নের একটি বিশেষ চিত্র তুলে ধরলেও প্রকৃত চিত্র বলছে এখনও অনেক মানুষ উন্নয়নের তলানিতেই পড়ে আছে। দেশের এই ২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে যার মধ্যে ১২ শতাংশই হতদরিদ্র এবং এই ১২ শতাংশ হতদরিদ্রদের মধ্যে যাদের অবস্থান অগ্রগন্য তারা সমতল ও পাহাড়বাসি সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়। শুধুমাত্র মাথাপিছু গড় আয়ের উলম্ফন দিয়ে এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার বহুমাত্রিক প্রান্তিকতা বিচার করা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা সরকারের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠ, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনা, রূপকল্প ২০২১ , বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ ইত্যাদি অর্জনের পথে সুস্পষ্ট বাঁধা তৈরী করবে। তাই সরকারের চলমান উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখতে এবং উল্লিখিত বহুমাত্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তব রূপ দিতে প্রয়োজন বাংলাদেশের সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদাইয়ের বহুমাত্রিক প্রান্তিকতা দূর করে স্থায়ীত্বশীল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সরকার উদ্ভাবনী উন্নয়ন উদ্যোগ নিতে হবে। এই নতুন ও উদ্ভাবনী উন্নয়ন উদ্যোগ নিঁখুতভাবে বাস্তবায়নের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বাংলাদেশের সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করতে না পারা। তাই সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় সরকারের ইচ্ছা থাকলেও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, শিক্ষাবৃত্তি, কারিগরী দক্ষতা উন্নয়ন অবকাঠামো সম্প্রসারণ, আবাসন তৈরীতে সহায়তা, উদ্যোক্তা পর্যায়ে নগদ সহায়তা ইত্যাদি উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাংলাদেশের সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়কে নিশ্চিত ভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারছে না এবং অন্যদিকে, সামাজিক ও বেসরকারি সংগঠন গুলোও সরকারি সঠিক জমমিতি না পাবার ফলে সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিতে পারছে না। এই সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারের ২০২১ সালের জনসুমারিতে যেন সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা যায় সরকারকে যে ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ বহুমাত্রিক জাতিগোষ্ঠীর একটি দেশ। বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্যান্য ধর্মালম্বী সকলেই বাঙ্গালি নয়। এদেশে বাস করছে বাঙ্গালি মুসলমান, অবাঙ্গালি মুসালমান, বাঙ্গালি হিন্দু, অবাঙ্গালি হিন্দু, বাঙ্গালি খৃষ্টান, অবাঙ্গালি খৃষ্টান, বাঙ্গালি বৌদ্ধ, অবাঙ্গালি বৌদ্ধ এবং অন্যান্য জাতিসত্ত্বা এবং ধর্মালম্বী মানুষ। এই নানামুখি বৈচিত্রতার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী হচ্ছে সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায় এবং এই সব মানুষের সংখ্যা বেসরকারি নানা হিসেবে প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন। এই সড়ে সাত মিলিয়নের মধ্যে ২.৫ মিলিয়ন হচ্ছে সমতলে ও পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং ৫ মিলিয়ন জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের। প্রায়ই ব্যাবহৃত এই সংখ্যাটি নিয়ে যদিও গবেষক মহলে ভিন্নমত আছে। সংখ্যা ভিত্তিক এই ভিন্নমত সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের সঠিক সংখ্যা নির্নয়ে জটিলতা হিসেবে বিরাজ করে এবং সরকারি হিসেবের সাথে সাংঘর্সিক। এই সংখ্যা গত সংঘর্স আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্য ব্যাবহারে নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্ন বিদ্ধ করে বারবার। ভৌগলিক ভাবে এই জনগোষ্ঠী অতীতকাল থেকে বাসকরে আসছে বাংলাদেশের দক্ষিন-পুর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১৮ টি জেলাতে। এই ১৮ টি জেলাতে বসবাসরত সমতলের এবং পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ মায়ানমানের আরাকান অঞ্চল থেকে, ভারিতের ত্রিপুরা, খাসিয়া, পশ্চিম বাংলা এবং অনেকে জনগষ্ঠী মধ্য ভারত থেকে সুদূর অতীতে বাংলাদেশে অভিবাসন নিয়েছে এবং আদিবাসী হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। এই নৃগোষ্ঠী গুলো যেহেতু নিজস্ব জাতি রাষ্ট্র গঠন করতে পারে নাই তাই তারা বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দ্বারা হরহামেশাই প্রভাবিত, নির্যাতিত এবং প্রিতারিত। এই সমতলের এবং পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ ব্যাতিত অন্যান্ন জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত অমুসলিম এবং দলিত সম্প্রদায়ের বসবাস বাংলাদেশের সর্ব অঞ্চলে, বিশেষত শহরাঞ্চলে। এই গোষ্ঠী পেশাগত, সনাতনী ধর্মাশ্রিত বর্ন এবং জাত-পাতের কারণে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষণের শিকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ৫ম আদমশুমারি ও গৃহগণনা-২০১১ হিসাব বলছে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তথা আদিবাসীদের সংখ্যা ২৭টি এবং মোট জনসংখ্যা ১৩,৮০,৪৮৮ জন, অর্থাৎ ১.৪ মিলিয়ন। এই ১.৪ মিলিয়নের মধ্যে পেশাগত, সনাতনী ধর্মাশ্রিত বর্ন এবং জাত-পাতের কারনে অচ্ছুত গোষ্ঠী গুলোও রয়েছে। এই গোষ্ঠী গুলো আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর থেকে নানা মাত্রায় স্বতন্ত্র হলেও তাদের আলাদা হিসেবে গন্য করা হয়নি। তাই তার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ৫ম আদমশুমারি ও গৃহগণনা-২০১১ এর রিপোর্টে যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে তার বাইরে রয়ে গেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তারা হচ্ছেঃ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চ্যঙ্গা, বম, পাঙ্খুয়া, চাক, খেয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ, সাঁওতাল, ডালু, উসাই, রাখাইন, মণিপুরী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মং, ওঁরাও, বর্ম্মন, পাহাড়ি, মালপাহাড়ি, মুন্ডা, কোল, কন্দ, পাংখো, পাংগোন, মুর, রাজবংশী, পাত্র এবং গঞ্জু। দেখাযাচ্ছে সরকারি হিসাব আর বেসরকারি হিসাবের মধ্যে বিশাল ফাক রয়েছে। সরকারি হিসাবে পাকপাকি ৬.১ মিলিয়ন সমতলের, পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের কোন হদিস নেই। কেন এই বিশাল তথ্যগত ফারাক? বলতে চাচ্ছি না যে বেসরকারি হিসাবই সঠিক এবং সরকারি হিসাব সঠিক নয়। এখানে অস্বীকৃতির এবং রাজনীতির একটা ব্যাপার রয়ে গেছে। এই অস্বীকৃতির এবং রাজনৈতিক অণুঘটকের উপস্থিতি পরিষ্কার বোঝা যায় যখন দেখা যায় সরকারের দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তথ্যের ফারাক রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর যেখানে ২৭ টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তথা আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিচ্ছে সেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন তারিখ: ০৫ চৈত্র ১৪২৫ বক্সগাব্দ/১৯ মার্চ ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ এস. আর. ও. নং-৭৮-আইন/২০১৯। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ২৩ নং আইন) এর ধারা ১৯ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি তফসিল বলছে ৫০ টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তথা আদিবাসীদের কথা। এই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাম হচ্ছেঃ ওরাওঁ, কোচ, কোল, খাসিয়া/খাসি, খিয়াং, খুমি, গারো, চাক, চাকমা, ডালু, তঞ্চক্সগা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া/পাংখো, বম, বর্মণ, মণিপুরী, মারমা, পাহাড়ী/মালপাহাড়ী, মুন্ডা, ম্রো, রাখাইন, লুসাই, সাঁওতাল, হাজং, মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো, কন্দ, কড়া, গঞ্জু, গড়াইত, গুর্খা, তেলী, তুরি, পাত্র, বাগদী, বানাই, বড়াইক/বাড়াইক, বেদিয়া, ভিল, ভূমিজ, ভূঁইমালী, মালো/ঘাসিমালো, মাহালী, মুসহর,রাজোয়াড়, লোহার, শবর, হুদি, হো, খারিয়া/খাড়িয়া এবং খারওয়ার/খেড়োয়ার। বিশ্লেষন করলে দেখা যাচ্ছে ২৩ টি গোষ্ঠী সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন ২০১৯ এ নতুন ভাবে যুক্ত হতে পেড়েছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ২০১১ সাল হতে ২০১৯ অর্থাৎ ৮ বছর তারা সরকারের কাছে অস্বীকৃত ছিলো। সহজেই অনুমেয় যে এই ২৩ দল সরকার থেকে নিদেন পক্ষেও কোন অধিকার ভোগ করতে পারেনি। সরকার তাদের কোন প্রকার উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে গন্যই করেনি। এই ২৩ টি অস্বীকৃত জাতি গোষ্ঠী হচ্ছেঃ মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো, কড়া, গঞ্জু, গড়াইত, গুর্খা, তেলী, তুরি, বাগদী, বানাই, বড়াইক/বাড়াইক, বেদিয়া, ভিল, ভূমিজ, ভূঁইমালী, মালো/ঘাসিমালো, মাহালী, মুসহর,রাজোয়াড়, লোহার, শবর, হুদি, হো, খারিয়া/খাড়িয়া এবং খারওয়ার/খেড়োয়ার। আবার দেখাযাচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ৫ম আদমশুমারি ও গৃহগণনা-২০১১ যারা তালিকা ভূক্ত ছিলো যেমনঃ পাংগোন, মুর, রাজবংশী, উসাই, মং, বর্মন এরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন ২০১৯ থেকে ছিটকে গেছেন। আবার মালপাহাড়ি এবং পাহাড়ি যারা ২০১১ এর আদমশুমারিতে এক গোত্র ভুক্ত ছিল সেই গোত্রকে ২০১৯ সালের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রানালয়ের প্রজ্ঞাপনে আলাদা গোত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রানালয়ের প্রজ্ঞাপন নিয়েও প্রশ্ন রয়ে যায়। পাংগোন, মুর, রাজবংশী, উসাই, মং, বর্মন এরা তবে কি আলাদা নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত হবে না? তাহলে তারা কি সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং কর্মকান্ড থেকে বাদ পড়ে যাবে? সংখ্যা নিয়ে এইসব অস্বচ্ছতা সরকারী এবং বেসরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ডে জটিলতা বাড়িয়ে চলবে। বাংলাদেশের সমতল ও পাহাড়বাসি সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের সংখ্যা নির্ধারনে এই চলমান জটিলতা সমাধা না হলে সমতা ভিত্তিক উন্নয়নের বদলে অসমতা ব্যাপক হয়ে উঠবে।
২০১২-১৩ আর্থিক বছরে সরকার “মাইনরিটি অ্যান্ড আন্ডারপ্রিভিলেজড কমিনিটি” দের জন্য জাতীয় বাজেটে ২১৮ এবং ২২১ নম্বর উপ-ধারায় উন্নয়ন বাজেট নির্ধারন করে। পরিতাপের বিষয় যে সেই উন্নয়ন বাজেট রাখা হয়েছিল শুধুমাত্র পাহাড়ি আদিবাসিদের জন্য, তাও অপ্রতুল। সে সময় সরকারের সমতলবাসি আদিবাসিদের স¤পর্কে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। কারন পরিসংখ্যান গত কোন তথ্যই ছিলো না সরকারের কাছে। এই অনুন্নয়নের ধারাবাহিকতা ২০১৩-১৪ অর্থ বছরেও অপরিবর্তিত রয়ে যায় তবে সে বছর দলিত, হিজড়া, বেদে এদের জন্য কিছু বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১১-১২ সালে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয় সমতলের আদিবাসীদের নামে যার পরিমান ছিল মাত্র ১৫ কোটি। সরকারী আদমশুমারি ২০১১ মেনে নিয়েও যদি মাথাপিছু হিসেব করা যায় তবে সমতলের সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের জন্য জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল ১০৯ টাকা। এমন হাস্যকর বরাদ্দের কথা নাই বা বললাম কিন্তু এই চরম নিগৃহতার কারন জাতি হিসেবে তাদের রাজনৈতিক অস্বীকারের সংস্কৃতি আর যথাযথ পরিসংখ্যানের অভাব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অফিসের স্পেশাল অ্যাফিয়ারস ডিভিশন এই বরাদ্দ পরিচালনা করতো এবং তারাই বলেছে যে বিশেষ বরাদ্দ পরিকল্পনার সময় তাদের ধারনা ছিল না যে সমতলের সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের প্রকৃত সংখ্যা কত এবং সমতলের ক্ষুদ্র জাতি গুলোর কোন প্রতিনিধি নেয়া হয় নাই। তাই বলতেই হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্রতা কমলেও এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষ উন্নয়নের মূলস্রোতধারার বাইরে রয়ে গেছে। ফলে তাদের জীবনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যেও ব্যাপক। ২০১০ সালের জরিপ অনুসারে গ্রামাঞ্চলে ৩৫.২% মানুষ এবং শহরাঞ্চলে ২১.৩% মানুষ চরম দারিদ্রের ভেতর বসবাস করছে । এই বছর জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী “সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ। সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের” শীর্ষক ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য যে প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেছেন, সেখানে আদিবাসী, বঞ্চিত, অবহেলিত, পিছিয়েপড়াসহ সকল মানুষের আশা আঙ্খাকার প্রতিফলন ঘটবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিলো। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে আসা নতুন সরকার দেশের উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি এবং অবহেলিত আদিবাসী মানুষের প্রতি সরকারের অঙ্গীকার, সকল বিবেচনাতেই ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেট নিয়ে উন্নয়ন কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেই বাজেট ৫০ টি আদিবাসী ও অন্যান্ন পিছিয়ে রাখা জাতিগোষ্ঠীর ৭০ লক্ষাধিক জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। বরং জাতীয় বাজেটে আদিবাসীরা বরাবরই অবহেলার শিকার হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দ্রারির্দ্য হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। অতি দ্রারির্দ্যের হার ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১১ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন বেড়ে ১,৯০৯ ডলার হয়েছে। কিন্তু সরকারের কাছে সমতলের এবং পাহাড়ের সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায় স¤পর্কে কোন বিভাজিত তথ্য নাই যা এই সব জনগোষ্ঠীদের মাঝে দারিদ্যের হার স¤পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারে। তাদের প্রকৃত মাথাপিছু আয় কত কিংবা তাদের মাঝে আসল দারিদ্যের হার কত এখন? শুধুমাত্র গড়ের হিসাবে উন্নয়নকে পরিমাপ করা হলে আদিবাসীরা বঞ্চিতই থেকে যাবে, কখনই তাদের প্রকৃত বঞ্চনার তথ্য বেরিয়ে আসবে না। আমাদের ধারণা মতে, আদিবাসীদের মাঝে দারির্দ্যের হার এখনো ৬৫% এর কম হবে না। রাঙামাটি আর বান্দরবানে দারির্দ্যের হার যথাক্রমে ৬৪ শতাংশ এবং ৬৩.২ শতাংশ, সমতলের আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা দিনাজপুরে এই হার ৬৪.৩ শতাংশ। আদিবাসীদের গড় আয় জাতীয় গড় থেকে কম। পাহাড়ের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ কম, সমতলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ কম। সমতলের দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী কার্যত ভূমিহীন। এটি বাস্তবতা যে সমতলের বিশ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বরাবরই উন্নয়ন বাজেটে অবহেলিত ও বঞ্চিত থাকে। তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন এবং মন্ত্রণালয় বা খাতভিত্তিক বাজেট প্রণয়ণের দাবি করে আসছে আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করে আসছে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও । কিন্তু কোনবারই এ উদ্যোগ গ্রহণে বরাদ্দ রাখা হয় নি। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৭৪,৩৬৭ কোটি সামাজিক সুরক্ষায় বাজেট ধরা হয়েছে । যা বাজেটের ১৪.২১ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। গত বাজেটের চেয়ে এটি ১০,১৯০ কোটি টাকা বেশি। খুবই দুঃখজনক যে, বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত)-র জন্য থোক বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা ছাড়া সামাজিক সুরক্ষায় আদিবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সামগ্রিকভাবে সামাজিক সুরক্ষার এই বরাদ্দ বৃদ্ধি যদি অবহেলিত ও প্রান্তিক মানুষের অবস্থার উন্নতির লক্ষ্য হয় তাহলে এখানে অবশ্যই আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা উচিত এবং আরো প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার।
এই সব অতি বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য চাই ২০২১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনয় সমতলের ও পাহাড়ি সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের প্রকৃত সংখ্যা কত তা পুংখানুপুংখু রূপে বের করা এবং সঠিক প্রতিবেদন পেশ করা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ১০ বছর পর পর আদমশুমারি পরিচালনা করে থাকে। জনসংখ্যা এবং খানা জরীপ হচ্ছে একটি দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন কাজ যা সরকারের দেশ পরিচালনা, নীতি নির্ধারন, উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন, বাজেট বরাদ্দ নির্ধারন ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য অতীব প্রয়োজন। জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠ ১৭ তে সরকারের জাতীয় পর্যায়ে জনসংখ্যা এবং খানা জরীপকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। কারন যে কোন সংখ্যাগত উপাত্তের জন্য জনসংখ্যা এবং খানা জরীপ তথ্যই একমাত্র গ্রহণযোগ্য মাধ্যম। সেখানে বলা হয়েছে ২০২১ এর আদমশুমারিরে যেন কোন প্রান্তিক, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী এমন কি ভবঘুরে যেন না বাদ যায় এবং দেশের প্রতিটি ভৌগলিক এলাকা যেন এর আওতা থেকে বাদ না পড়ে। ২০১১ আদমশুমারি তিন পর্যায়ে স¤পন্ন হয়েছে এক. মূল গণনা, দুই. পোস্ট এনুমারেশন চেক তিন. সাধারণ গণনা: একটি নির্দিষ্ট এলাকা যাচাই। ১৬ জুলাই ২০১১ সালে আদমশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।২০২১ সালে ষষ্ঠবারের মতো আদমশুমারি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এবারেও একই পদ্ধতি অনুসরন করা হবে। এরই মধ্যে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি। উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান গুলো চেষ্টা করছে এবারের সুমারিতে যেন সমতলের ও পাহাড়ের সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের স¤পৃক্তটা ঘটে। সেই নিমিত্ত্বে আন্তর্জাতিক দাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে এবারই প্রথমবারের মত সট এবং লং প্রশ্নপত্র তৈরীর কাজে চলছে। এই শুমারিতে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে এবং আশা রাখি আগত জনমিতি সার্ভেতে সমতলের ও পাহাড়ি সংখ্যালঘূ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং জাত ও পেশাভিত্তিক অচ্ছুত মানুষ অমুসলিম এবং মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের প্রকৃত সংখ্যার পাশাপাশি এদেশের মুসলিম অছ্যুত জাতি যেমন পাঙ্গাল এবং মানতা যারা যথাক্রমে সিলেট, মৌলভিবাজার এবং পটুয়াখালি অঞ্চলে বাস করে তাদের সংখ্যাও নিরূপিত হবে। আর তা না হলে বাংলাদেশর পক্ষে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট অর্জন অসম্ভব হয়ে থাকবে।
(অনিক আসাদ একজন নৃবিজ্ঞানী এবং একই সাথে একজন মানবাধিকার কর্মী, তিঁনি বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের জন্য কাজ করছেন। বর্তমান তিনি বাংলাদেশে হেক্স/ইপার এর কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসাবে কর্মরত আছেন। হেক্স/ইপার বাংলাদেশে বহুল আলোচিত আন্তজার্তিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান যারা মানবাধিকার ভিত্তিক সমভূমি আদিবাসী ও দলিত সম্পদায়ের সামাজিক অন্তভূক্তির বিষয়টি বিশেষ ভাবে আলোকপাত করে।)
বাংলা ইনসাইডার
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৪:০০ পিএম, ১৭ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও তিনি কাঁদছিলেন।
প্রকৃতিও সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল। পৌনে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতি তাঁর কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। কুর্মিটোলা থেকে তিনি যান বনানী গোরস্থানে। সেখানে যেয়ে আবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বনানী থেকে তিনি যান শেরে বাংলা নগরে। সেখানে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ জনতা অপেক্ষা করছিল। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বক্তব্য রাখেন।
কি বলেছিলেন তিনি লাখ লাখ জনতার সমাবেশে? হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া ফলাও করে এসব খবর সেদিন কোন পত্রিকা বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। ৪৩ বছর আগের সে সব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াও আজ কষ্টসাধ্য। সেদিনের ভাষণের যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই বোন, আরো অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল, আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আমি আপনাদের কাছে এসেছি।
বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা নেতা হবার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসাবে, মেয়ে হিসাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসাবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।
আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলার মানুষের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার পরিজন হত্যা করে বলেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমানো ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কি? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দিনে দুপুরে মানুষ খুন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না, আর একশ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে।
ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃংখলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তবে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকতো না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তববায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি; আপনাদের ভালবাসা নিয়ে, পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। আপনারা আমার সাথে শপথ করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।
স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি।
আপনাদের ভালবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।
(তথ্যসূত্র: সংবাদপত্রে শেখ হাসিনার বক্তৃতা: ১৯৮১-১৯৮৬; প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩)
প্রত্যাবর্তন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০১:০০ পিএম, ১৭ মে, ২০২৪
আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। “বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই ও বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই ও স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।’
ওই লিফলেটে আরো লেখা ছিল: “আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তি সংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে।...তিনি আমাদের কর্ম ও চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।”
প্রচারপত্রে
আরও বলা হয়েছিল: “...ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী ও তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।...আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশা—জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে এ প্রত্যাবর্তন। বাঙালী জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই এ প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।”
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বস্তিতে ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কায় সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শঙ্কিত বোধ করছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরূদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির এক সভায় শেখ হাসিনাকে বিদেশি শক্তির তল্পিবাহক বলে অভিহিত করা হয়। একই দিনে আরেকটি সভা থেকে বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, বাকশালিরা ভারতের গোলাম। তারা বিদেশি সৈন্যের সহায়তায় ক্ষমতায় বসতে চায়। যে দলের প্রধান দিল্লিতে, সে দল জনগণের কল্যান করতে পারে না। সাতাশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুনী মুশতাক গংদের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে বলা হয়েছিল, ইন্দিরার নীলনকশা এখন বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, “৭৫ এর পর তারা দিল্লি ও লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচেষ্টা চালায়। লন্ডনে জমে ওঠে দিল্লির সেবাদাসদের আড্ডা। তারাই আজ বাকশালী কমিটির ছত্রচ্ছায়ায় দেশে ফিরছে। সমস্ত কিছু ঠিক করে হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।”
সে সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের খবরে সে সময়কার জিয়া সরকারের ভিতরে উদ্বিগ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে গিয়েছিল ; আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান)- ওরকমভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর আর্দশের কর্মীরা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেমন একটি সময় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়াকে তৎকালীন জিয়া সরকার মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে তাই ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠন’ করা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালিন জাতীয় সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) ৩ মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না ।
বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন ‘শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।’ পরদিন ৪ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না ।’ এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জানিয়ে দেন তাঁকে যদি হত্যা করার চেষ্টাও করা হয় তাহলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন । গণআকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠন’ শেখ হাসিনা আসার আগেই তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।
দীর্ঘ ছ'বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলে লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে তাদের নেত্রীকে বরণ করে নেন। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকেই শহরজুড়ে কেবলি মিছিল আর মিছিল। সেদিন শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা জানাতে ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের ঢাকা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বন্দীশালা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন, সেদিনটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।
কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান অবতরণ করবে সেদিকে নজর রেখে লক্ষাধিক মানুষ মধ্যাহ্ন থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকেই বিমানবন্দরে কোন নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। হাজার হাজার মানুষ ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে নিয়োজিত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে প্রথমে দেয়ালের উপর ওঠে। একই সময়ে বিমানবন্দর ভবনের দোতলায় কন্ট্রোল টাওয়ারের যেখানে স্থান করা সম্ভব সেখানেই জনতা উঠে যায়। সবারই উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখা। পুলিশ বারবার চেষ্টা করেও তাদের সরাতে পারে নি। বিমানবন্দরের বাইরে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
সাদা-কালো রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যখন ৪টা ৩২ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে সজ্জিত ট্রাকে নামছিলেন; তখন লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই– 'শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব', 'শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা' 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'। বিমান থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত হাসিনাকে নিয়ে আসতে ট্রাকটির ১৫ মিনিট সময় লাগে। সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়। এ পরিবেশ উচ্ছ্বাসের, এ পরিবেশ আনন্দে অশ্রু ফেলার। বিমান থেকে নামার আগে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক যখন শেখ হাসিনার গলায় মালা দিচ্ছেলেন, তখন তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা আসার পথেও শেখ হাসিনা পাঁচ-ছয়বার অঝোরে কেঁদেছিলেন।
বিকেল চারটার দিকেই আকাশে কালো মেঘ ছিল। পৌনে পাঁচটায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে মিছির শুরু হবার পরপরই চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। রাত আটটা পর্যন্ত সেদিন মুষলধারে বিরতীহীন বৃষ্টি ঝরেছিল। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেইসাথে তীব্র ঝড়। প্রকৃতি ভয়াল রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। এরই মাঝে ট্রাকে ও রাস্তার দুপাশের জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান। বর্ষণসিক্ত শেখ হাসিনা ঝড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে যাচ্ছিলেন বনানী হয়ে শেরেবাংলানগরের সভাস্থলে। বনানী গোরস্থানে শেখ হাসিনার মা ও নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি কান্নায় আকুল ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কবরে শায়িত মাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, আমাকে কেন রেখে গেলে?’
কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত আট মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগার কথা খুব বেশি হলে ত্রিশ মিনিট। প্রায় তিনঘন্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরের সভাস্থলে পৌছিয়েছিলেন। তখনও চারদিক অন্ধকার, মুষলধারে বৃষ্টি। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন তখন প্রায় বিপন্ন, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সভাস্থলে তখনো লক্ষ লক্ষ লোক উপস্থিত। শেখ হাসিনাকে তারা দেখবেনই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসম্বর্ধনা সভার মঞ্চে এলেন।
লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সমাবেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।"
বক্তৃতাদানের এক পর্যায়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, "আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।"
বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা পাথেয় করে আমি আগামীদিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করে দেবো।”
১৭ মে রাতে শেখ হাসিনা ছোট ফুপুর বাসায় ছিলেন। সেই সময়েও শেখ হাসিনাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। বাধ্য হয়েই তিনি তখন কিছুদিন ছোট ফুপুর বাসায়, কিছুদিন মেঝো ফুপুর বাসায় থাকতেন। দেশে ফিরে তিনি ধানমন্ডিতে নিজেদের বাসায় গেলে সেখানে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া ও মিলাদ পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ধানমন্ডির বাসাটা সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যকেই এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।
১৮ মে সকালে শেখ হাসিনা দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন এবং পরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্জন করেন। ওইদনই বিকেলে তিনি পিতা শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তিনি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বাড়ির ও গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্রন্দনরত শেখ হাসিনাকে অনেকে সান্ত্বনা দেন। তিনি সেখানে সমাধিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মাজার জিয়ারত করেন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
২০ মে গোপালগঞ্জের ঈদগাঁ ময়দানে মেখ হাসিনার সম্মানার্থে এক গণসম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংষার করছিলাম। আপনাদের ডাকে সবকিছু ছেড়ে এসেছি। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবর দান করতে চাই।” তিনি আরো বলেছিলেন, “গত ছয় বছরে দেশের মানুষের কোনরকম উন্নতি তো আমি দেখি নি। মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কৃষক-শ্রমিক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য পাচ্ছে না।” তিনি উত্তাল জসমুদ্রের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, “তবে কেন বঙ্গবন্থু, শেখ মনি ও চার নেতাকে হত্যা করা হলো?”
লেখক: ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন: সভাপতি, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ১৭ মে, ২০২৪
আজ ১৭ মে,
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৪৩তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়,
শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা খুনিদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।
পশ্চিম জার্মানি থেকে সেই সময় ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন শেখ হাসিনার স্বামী পরমানু বিজ্ঞানী এ এ ওয়াজেদ মিয়া। ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লি পৌছান শেখ হাসিনা,
শেখ রেহানা,
ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান।
বিমানন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। সেখানে কারো সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরিচয় না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাদের। সেই সময় ভারতীয় পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোন খবরাখবর ছাপা হচ্ছিল না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একরকম অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। দিল্লিতে পৌছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানে শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের পুরো ঘটনা জানতে পারেন।
১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে। আব্দুর রাজ্জাক কাবুলে যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান,
আব্দুস সামাদ আজাদ,
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং যুবনেতা আমির হোসেন আমু দিল্লিতে যান। তাদের সবার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিতে রাজি করানো।
পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালের ১৪,
১৫ ও ১৬ ফেব্রয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ ২৪ ফেব্রæয়ারি আব্দুল মালেক উকিল,
ড. কামাল হোসেন,
জিল্লুর রহমান,
আব্দুল মান্নান,
আব্দুস সামাদ,
এম কোরবান আলী,
বেগম জোহরা তাজউদ্দীন,
গোলাম আকবর চৌধুরী,
সাজেদা চৌধুরী,
আমির হোসেন আমু,
আইভি রহমান,
আব্দুর রাজ্জাক,
তোফায়েল আহমেদ ঢাকা থেকে দিল্লিতে পৌছান। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করেন তারা।
দেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে রাতে দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তখনকার রাজনীতির মতোই প্রকৃতিও সেদিন ছিল ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ছিল কালবৈশাখী হাওয়া,
বেগ ছিল ঘন্টায় ৬৫ মাইল। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও সেদিন গতিরোঘ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল।
মুষলধারে বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন নেত্রী কখন আসবেন এই প্রতীক্ষায়। অবশেষে বিকাল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জনসমুদ্রের জোয়ারে এসে পৌছান শেখ হাসিনা। তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।
তখন স্বাধীনতার অমর শ্লোগান ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” ধ্বনীতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কন্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল-‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে,
শেখ হাসিনার ভয় নাই,
রাজপথ ছাড়ি নাই।’
দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন,
‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি,
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’
‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা,
ভাই রাসেল-সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।’
তিনি বলেন,
‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে,
মেয়ে হিসেবে,
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ তিনি আরো বলেন,
‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়,
মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত¡
থেকে বঞ্চিত হয়।’ দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার;
বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার ও স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হৃত গণতান্ত্রীক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা,
সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মানবতার জননী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে;
যা মোটেও সহজ কাজ নয়। এসব একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সম্ভব হচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা,
এমডিজি অর্জন,
এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ শিক্ষা,
স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন,
দারিদ্রসীমা হ্রাস,
গড় আয়ু বৃদ্ধি,
রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা,
পোশাক শিল্প,
ঔষধ শিল্প,
রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও পরিশ্রমের ফসল। এরই মধ্যে উদ্বোধন হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র,
বহুল কাঙ্খিত পদ্মা সেতু এবং ঢাকা মেট্রোরেল। এছাড়া চলমান রয়েছে দেশের মেগা সব প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে
আসুন আমরা দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি,
যা হবে জাতির জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণের একমাত্র পথ।
১৯৮১ সালের ১৭ মে তার দুঃসাহদী সিদ্ধান্তের কারণেই আওয়ামী লীগ আজ দল হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত বছর সরকারপ্রধান হতে পারেননি। এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। দলটি আজ তার নেতৃত্বে সামরিক শাসনের স্মৃতি পেছনে ফেলে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। তার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে, জাতি হিসেবে বাঙালিকে এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়।
শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ১৭ মে, ২০২৪
১৭ মে বাঙালি জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। তবে শুধু স্মরণীয় বললে হয়ত তার তাৎপর্য
ম্লান হতে বাধ্য। ১৯৮১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৬ বছর পর শেখ হাসিনা
বাধ্যতামূলক নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ২০০৭ সালে ৭ মে স্বল্প-সময়ের বিদেশ বাসের
পর বহু বাধা বিঘ্ন ঠেলে তিনি দেশে ফিরে আসেন; যদিও ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে না আসলে
২০০৭ সালের ৭ মে অপ্রাসঙ্গিক হতো।
এই দুটি উপলক্ষ ছাড়া বহুবার তিনি বিদেশ গিয়েছেন, আবার ফিরেছেন। তবে ঐ দুটি
তারিখে তিনি দেশে না আসলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানটি মুসলিমলীগের ন্যায় হয়ত টিম টিম
করে বেঁচে থাকত; যার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ হারিয়ে যেত। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের
কনফেডারেশন সম্ভব না হলেও দেশটি একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হতো। রাজাকাররা চিরস্থায়ী
রাজা বাদশাহ হয়ে সবার শিরে চেপে বসত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হোত, মুক্তিযোদ্ধাদের
একাংশ তিব্বতের দালাইলামার সম-অনুসারী কাঞ্চা ও কাঞ্চিতে রূপান্তরিত হতো। দেশে থাকলে
মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে খুন করা হতো। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন হয়ে যেত।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকতনা। ক্রমশ: প্রতিটি মানুষ ইসলামাবাদের
গোলামে পরিনত হতো, ধর্মের ধ্বজাধারীগণ দেশটা কে চষে বেড়াত, বাংলাভাষা ও জাতি বিলুপ্তির
পথে যেত।
দেশে প্রত্যাবর্তনের পর দীর্ঘ সময় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন না। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের
উপর এতটা চাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষরা সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন
এনে দেশটাকে ইসলামী রিপাবলিকের দিকে ঠেলে দিতে পারেনি। তিনি ফিরে না এলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ
ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যেত। আমাদের দেশটা হতো একান্তই সাম্প্রদায়িক দেশ।
শেখ হাসিনা ফিরে না আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান শান্তিটুকুও প্রতিষ্ঠিত
হোত না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন হওয়া ছিল অকল্পনীয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা
হোত দা-কুড়ালের। আজকে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমরা ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছি। বিশ্বের
বুকে একটা মর্যাদাবান জাতি হিসাবে আবির্ভূত হবার কিংবা মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের
দিন গনিয়ে আসত না।
আবারও বলছি শেখ হাসিনা দেশে না ফিরলে আওয়ামী লীগের ভাগ্য হোত মুসলিম লীগের ভাগ্য।
আর অন্যান্য সব কিছুর আকর হোত এই ক্ষমতাহীনতা। বিষয়টা একটু বিশ্লেষণ করছি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সব রাজনৈতিক দল বিলোপ করা হয়। জিয়াউর রহমানের
শাসনামলে ১৯৭৬ সালের ১ আগষ্ট থেকে দেশে ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়। সেই আগষ্টে আওয়ামী
লীগ পুনরুজ্জীবনে প্রয়াস নেয়া হয় এবং সাথে শুরু হয় দলীয় উচ্চাসন নিয়ে কামড়া
কামড়ি। দলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই জেলে। সে সময় প্রয়োজন ছিল ঐক্যের কিন্তু
তখনই দলের শীর্ষ পদ দখলের উলঙ্গ প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়। মোল্লা জালাল ও মিজান চৌধুরীর
নেতৃত্বে গঠিত আহ্বায়ক কমিটি আপোষকামিতা ও তৃণ মূলে অগ্রহণযোগ্যতার কারণে তেমন কোন
কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ১৯৭৭ সালের ৩রা এপ্রিলের কাউন্সিল অধিবেশনে তদ্রুপ
অবস্থার সৃষ্টি হয়। কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলেও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে
একটা দায় সারা গোছের কমিটি করা হয়। তিনি এক বছরও নেতৃত্বে থাকতে পারেন নি। ১৯৭৮ সালের
৩রা মার্চ পূর্বের ন্যায় নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতে মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাককে যথাক্রমে
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি
পুনরায় কাউন্সিলে পূর্ববত অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এবারেও যখন জোড়াতালি দিয়ে কমিটি
গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে ও দল ছিন্ন ভিন্ন হবার উপক্রম হয় তখন সাধারণ কর্মীরা শেখ হাসিনার
নামে শ্লোগান দিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনাকে দলের প্রধান
হিসেবে নির্বাচিত করে। সেদিন তাকে সভাপতি নির্বাচিত না করলে দল বহুধা বিভক্ত হোত, কেউ
মিজান আওয়ামীলীগ, কেউ বাকশাল কিংবা কেউ বা বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে ও তার উত্তরাধিকারীত্ব
দাবী করে বহু নামের আওয়ামী লীগ গঠন করে দালালী বলবত রেখে আত্ম—তরক্কি করতে পারত। সেনা
আশ্রিত দলে পরোক্ষভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে আশ্্রয় নিতে নিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী
দলটি নি:শেষ হয়ে যেত। দেশটাতে এমন সেনাশাসন চিরায়ত হয়ে যেত।
শেখ হাসিনা দেশে আসার কারণে তার দল অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পাঁচ পাঁচবার ক্ষমতায় এসেছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্প্রসারিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসায় যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে উল্লাসিত হয়েছিল তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস—চ্যান্সেলর, প্রো—ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার হয়েছে, ব্যাংক বীমার চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টর হয়েছে, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হয়েছে। আরও কত কি? ব্যক্তির পর্যায় ছাড়িয়ে সামষ্ঠিক পর্যায়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি নব মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে।
বিষয়গুলোর একটু গভীরে যাচ্ছি:
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার:
নির্বাসিত জীবন থেকে দলীয় নেতাদের বিশেষ অনুরোধে ও কর্তব্যবোধে তাড়িত হয়ে
শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এলেন। দেশে ফেরার দিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি ছিল। দুর্যোগ
উপেক্ষা করেও বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ তাদের মহান নেতার কন্যাকে দেখতে ও স্বাগত
জানাতে ভীড় জমালেন। দেশে ফিরে আসার আগেই তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তখন
তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই তিনি স্বৈরাচার বিরোধী
আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।
দেশে প্রত্যাবর্তনের ৬ বছরের মাথায় অর্থর্াৎ ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
তিনি প্রথমবারের মত নির্বাচিত হলেন ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসলেন। জনস্বার্থ বিবেচনা
করে তিনি ১৯৮৮ সালে পদত্যাগও করেন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট
গঠন করা হয়, তিনি সেই জোটের প্রধান ছিলেন। এরশাদ শাসনামলে তিনি বেশ কয়েকবার গৃহবন্দি
ছিলেন। শারীরিক আক্রমণের শিকারও হয়েছিলেন। তবুও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনিই মুখ্য
ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯০ সালে ১৫ দলের নেত্রী শেখ হাসিনার প্রচণ্ড গণআন্দোলনে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত
হলেন। তার জনপ্রিয়তা ও অনমনীয়তার কারণে সবাই ধরে নিয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের
পর হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন। শতাংশের হারে বেশি ভোট পেয়েও সুক্ষ্ণ কারচুপির কারণে
তিনি বিএনপি অপেক্ষা কম সিট পেলেন; যে কারণে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর
আকর্ষণীয় পদটি থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। জাতি বঞ্চিত হল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নেতৃত্ব
থেকে এবং তার মূল্যও জাতিকে দিতে হলো বহুভাবে। তারপর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে তিনি প্রধানমন্ত্রী
হলেন।
জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবার পর শেখ হাসিনা জনমঙ্গল নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা
ও জবাবদিহিতার অংশ হিসাবে সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত ও পুনর্গঠিত করেন। এ’সব কমিটিতে মন্ত্রীর
পরিবর্তে কোন সাংসদকেই চেয়ারম্যান করা হয়ে থাকে।
শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রশাসন ও নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ফলে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ হ্রাস পেয়েছে ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার:
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে না আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়—মুক্তিযোদ্ধাদের
বিচার হতো। বিচারের প্রক্রিয়াটি ১৯৯১ সালে পুনরায় শুরু হয়। ঘাতক দালাল নিমূর্ল জাতীয়
সমন্বয় কমিটির আহবায়িকা ও সদস্য—সচিব নির্বাচনে শেখ হাসিনার সক্রিয় সমর্থন ছিল।
আন্দোলনে শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ প্রধান শরিক সংগঠন হিসেবে যোগ দেয়। আন্দোলনকারী শক্তিসমূহ
বিশেষতঃ বুদ্ধিজীবীগণ অফুরন্ত অনুপ্রেরণা লাভ করে। শেখ হাসিনা না থাকলে জামায়াতের
ন্যায় ক্যাডার ভিত্তিক সশস্ত্র ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই কঠিন ছিল। ১৯৯২ সালেই
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০১ জন সংসদ সদস্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের রায় কার্যকরের
দাবি জানিয়ে তা স্পীকারের কাছে পেশ করেন। তার আন্দোলনের ফলশ্রম্নতিতে গণ আদালতের ২৪
জন তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহীর মুক্তি এবং গোলাম আজমের বিচার সহ ৪ দফা প্রস্তাব সংসদে গৃহীত
হয়।
দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি অনতি বিলম্বে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচারের সকল সাংবিধানিক বাধা দূর করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একে একে অভিযুক্তদের বিচার শুরু করেন। আজ পর্যন্ত ১০ জন শীর্ষ মানবতা বিরোধীসহ অনেকের বিচার কাজ একাধিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল প্রায় সকলকেই আদালত মৃত্যু দন্ডাদেশ দিয়েছে, কেউ কেউ কারাবন্ধি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি:
তাঁর প্রথমবারের সরকারের বিশাল অর্জন হচ্ছে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তি এবং সন্তুলারমার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন। এ’গুলো ছিল অনেক পুরানো সমস্যা। পানি সমস্যা পাকিস্তান আমলের আর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রায় ২৪ বছরের পুরানো ছিল। আত্নঘাতি ও ভ্রাতৃঘাতি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছে; স্বাধীনতা—সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছিল এবং বহির্বিশ্বে মানবিক ও অসা¤প্রদায়িক বাঙালির ভাবমূর্তিকে চুরমার করে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সংকট সৃষ্টি করেছিল। শেখ হাসিনা তার কৌশলী নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে এই অঞ্চলকে দেশের মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্তকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। গঙ্গার পানি চুক্তি ও পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্তসহ প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়েছে। শান্তি চুক্তির পাশাপাশি ছিটমহল সমস্যা ও সমুদ্র সীমা সমস্যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও দেশের আয়তন বৃদ্ধি করেছে। আমরা ব্লূ—ইকোনোমির স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পেয়েছি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার:
তার আমলের অপর একটি অর্জন হচ্ছে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল যা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের পথ সুগম করেছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ঘাতকদের বিচার না করে প্রচলিত আদালতেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু ২০০২ সালে বি এন পি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এই বিচারের রায় কার্যকরী না করলেও শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে তা কার্যকরী করেন। জাতির প্রত্যাশা মোতাবেক শেখ হাসিনা বিশেষ আদালতে নিষ্পত্তি না করে প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে বিচার কার্য শেষ করে দূরদর্শিতা নয়, রাষ্ট্র নায়ক সুলভ আচরণের প্রমাণ আরও একবার রাখলেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:
শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না আসলে দেশটা হতো মিনি পাকিস্তান। ভাষা—সংস্কৃতি যেত তলিয়ে।
শুধু ভাষা সংস্কৃতি রক্ষা নয়, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে
জাতিসংঘের ঘোষণা আদায়ও তাঁর অনন্য কৃতিত্ব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা
তার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল কিন্তু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার কারণে তার পূর্ণাঙ্গতা দেয়া সম্ভব
হয়নি।
দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও সোহ্রাওয়াদীর্ উদ্যানে স্বাধীনতা স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে। বাঙালির মনন বাংলা একাডেমির কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়াও আত্মিক পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রথম বারের জন্যে বাংলা একাডেমির জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা ধরে কাজ শুরু করেছিল।
বিশ্বকে পেছনে ফেলে সহস্রাব্দ উন্নয়নের সবক’টি লক্ষ্য মাত্রা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই
বাংলাদেশ অর্জন করেছে। ম্যাক্রো —মাইক্রো অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় অনন্য দক্ষতা দিয়ে
তিনি প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রেখেছেন। নিম্নের সারনীতে অর্থনৈতিক চাল—চিত্রের সামান্য
পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে ঃ
শিরোনাম |
2005-06 |
2017-18 |
2022-2023 |
২০২৪ এর প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রা |
জিডিপি প্রবৃদ্ধি |
5.40% |
7.86% |
7.50% |
7.97% |
মাথাপিছু আয় (মার্কিন ডলারে) |
427.00 |
1751.00 |
2793 |
2750.00 |
জাতীয় সঞ্চয় (জিডিপির শতাংশে) |
27.70 |
29.00 |
31.00 |
37.00 |
বিনিয়োগ (জিডিপির শতাংশে) |
24.70 |
30.50 |
32.00 |
37.00 |
বাজেট (কোটি টাকায়) |
64,683.00 |
4,64,000.00 |
- |
10,00,000.00 |
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (বিলিয়ন
মার্কিন ডলারে) |
3.88 |
34.00 |
35.00 |
50.00 |
রপ্তানী আয় (বিলিয়ন মার্কিন
ডলারে) |
10.05 |
36.60 |
55.56 |
72.00 |
আমদানি (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে) |
14.70 |
56.00 |
- |
110.00 |
দরিদ্র জনংখ্যা (শতকরা হারে) |
41.51 |
21.50 |
18.13 |
12.30 |
অতি দরিদ্র জনসংখ্যা (শতকরা হারে) |
25.10 |
11.30 |
5.6 |
4.50 |
বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা (মেগাওয়াটে) |
3,782.00 |
20,400.00 |
27500.00 |
28,000.00 |
সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তার:
দুঃস্থ মানুষের মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দিতে তার সরকার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বহু নির্মাণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। একটি বাড়ি, একটি খামার এক অনন্য কর্মসূচি। বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্যে কর্মসংস্থান ব্যাংক তাদের লেনদেন কাজ শুরু করেছে। বন্যা ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্ম অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করে শেখ হাসিনা দেশি ও বিদেশিদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার প্রথম শাসনামলে যেখানে বিদেশি পত্রিকার পূর্বাভাস ছিল যে আকস্মিক বন্যায় দু’কোটি মানুষ মারা যাবে, সেখানে মালের ক্ষতি মাত্রাতিরিক্ত হলেও মানুষ মরেছে ২ হাজারেরও অনেক কম, তাও কয়জন না খেয়ে মরেছে সে তথ্য বিরোধী পক্ষও উপস্থাপন করতে পারেনি। তিনি দেশে না এলে কি এমনটি হতো?
সামাজিক মঙ্গল:
তাঁর শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে তা পূর্বে কোন আমলে এমনটি হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ ও দুর্ভোগ, স্বদেশের হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, জ্বালাও—পোড়াও এর মধ্যেও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, মানুষের গড় আয়ু ৭৩ —এ ছুঁই ছুঁই করছে, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে প্রতিবেশী ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে, সুপেয় পানীয় জল সরবরাহে ঈর্ষান্বিত সফলতা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যে ভেজাল নিরোধ প্রয়াস ও চিকিৎসা ব্যবস্থা জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছিয়ে দেয়ার কারণে এমনটি অর্জন করেছে। তেমনি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে অন্যান্য ক্ষেত্রে, যার মাঝে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী বাহিনী প্রেরণ অন্যতম।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা:
শেখ হাসিনার প্রথমামলের সরকার ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত
করেছিল। সেই কবে ম্যালথাস নামক একজন ধর্মযাজক বলেছিলেন যে, ‘জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক
হারে আর খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে’। আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলাম
স্কুল জীবনে এবং এক জাতীয় হতাশা ও নৈরাশ্য আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমার ছেলে বেলায় বাংলাদেশ
তথা পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটির মত; আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ
ছিল এখন যা আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি। তখন জন্মের হার ছিল বেশি, শিশু মৃত্যুর হার ছিল
বেশী, ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল অনেক কম। বর্তমানে জনসংখ্যা বেড়েছে সেদিনের তুলনায়
প্রায় পাঁচগুণ। আবাদী জমির পরিমাণ বিবিধ কারণে অন্ততঃ এক—তৃতীয়াংশ কমেছে। ১৯৯৬ সালে
শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ৪০ লক্ষ টন।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দুটো বন্যা হয়েছে।
পরবর্তীতে দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি উত্তর বঙ্গের মঙ্গা বিতারণ কর্মসূচিকে বেগবান করা হয়। বর্তমানে মঙ্গা ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে পাটের জীবন—বৃত্তান্ত উৎঘাটিত হয়েছে। বিভিন্ন রকমের উচ্চ ফলনশীল ও দ্রুত ফলনশীল খাদ্যের উদ্ভাবন ঘটিয়ে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। একটি বাড়ী — একটি খামার কর্মসূচির পূর্ণসূচনার কারণে এবং ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বন্টন কর্মসূচি খাদ্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ:
কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দেবেন কিন্তু ২০১৩ সালের মধ্যে সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সব জেলায় ই—সার্ভিস সেন্টার চালু হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল স্বাস্থ্য—সেবা, ই—কমার্স ও ই—গভর্নেন্স উল্লেখযোগ্য হারে চালু হয়েছে। তিন কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছে। আর মোবাইলে থ্রি—জি সেবা চালু করা হয়েছে। এখন আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ; যার রূপায়ন ক্রমশ: দৃশ্যমান হচ্ছে।
শেষ কথা:
শেখ হাসিনা আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। তিনি দেশে ফিরে না এলে তার
তেমন কোন ক্ষতি ছিল না। দেশে না ফিরলে তার ব্যক্তি জীবন ও সন্তানদের জীবন মোটামুটি
সচ্ছলভাবে চলে যেত। দেশে ফিরে এসে তিনি নিজের জীবন ও সন্তানদের জীবনকে সংকটাপন্ন করেছেন।
সংকটাপন্ন করেছেন বোনের জীবন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমন নেতা আছেন কিনা যিনি ২৩ বার
হামলার শিকার হয়েও বেঁচে আছেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আল্লাহতায়ালা বঙ্গবন্ধুকে
পাঠিয়েছিলেন আমাদের গোলামী জিঞ্জির ভাঙার জন্যে আর শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন
দেশকে কোন উচ্চতর মাত্রায় পৌছে দিতে।
লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি
অব বাংলাদেশ।
মন্তব্য করুন
আমি ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেতে এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করার প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরি। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরার পরে তখন আমি একধরনের দোটানায় ছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। যার কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল তিনি নেই। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে আছেন, তারাও দেশে নেই। আমি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমি হাসপাতালে যাই, কাজ করি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা আমার কাছে আসতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ছাত্রলীগ ও বিএমএ’র জুনিয়র ডাক্তারদের সাথেই তখন আমার সময় কাটে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর নেতৃত্বে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আমার বাসায় আসতো। তাদের সাথে কথা বলে অন্তত পক্ষে এটা মনে হতো যে, ঠিকই দেশে ফিরেছি। কিন্তু তারপরও একটা অপূর্ণতার ভাব ছিল।
কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও তিনি কাঁদছিলেন।
আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। “বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই ও বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই ও স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।
আজ ১৭ মে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৪৩তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা খুনিদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।
১৭ মে বাঙালি জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। তবে শুধু স্মরণীয় বললে হয়ত তার তাৎপর্য ম্লান হতে বাধ্য। ১৯৮১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৬ বছর পর শেখ হাসিনা বাধ্যতামূলক নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ২০০৭ সালে ৭ মে স্বল্প-সময়ের বিদেশ বাসের পর বহু বাধা বিঘ্ন ঠেলে তিনি দেশে ফিরে আসেন; যদিও ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে না আসলে ২০০৭ সালের ৭ মে অপ্রাসঙ্গিক হতো।