ইনসাইড গ্রাউন্ড

ফুটবল পায়ে যুদ্ধ করেছিল যারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/12/2019


Thumbnail

স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ যা করেছেন, তার কোন তুলনা হয় না। কেউ কলম তুলে নিয়েছেন। কেউ গান গেয়েছেন। কেউ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন। তবে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ফুটবলাররা। হাতে বন্দুক নিয়ে নয়, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গড়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিলেন এ দেশের ফুটবলাররা।

যখন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের তাণ্ডবে পুরো দেশ তছনছ হয়ে পড়ে, মানুষ ছুটতে থাকেন বনপোড়া হরিণীর মতো, সেই বেসামাল পরিস্থিতিতে শরণার্থী হয়ে বিদেশের মাটিতে একটি ফুটবল দল গড়ে তুলে বাংলার দামাল ছেলেরা খেলে গেছে ১৬ টি ফুটবল ম্যাচ!

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত ও তহবিল গড়ে তোলার জন্য ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল যা করেছে, তা ব্যতিক্রমধর্মী ও অবিশ্বাস্য। যখন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের তাণ্ডবে পুরো দেশ তছনছ হয়ে পড়ে, মানুষ ছুটতে থাকেন বনপোড়া হরিণীর মতো, সেই বেসামাল পরিস্থিতিতে শরণার্থী হয়ে বিদেশের মাটিতে একটি ফুটবল দল গড়ে তুলে বিভিন্ন স্থানে ম্যাচ খেলাটা মোটেও সহজ ছিল না।

স্বীকৃতিহীন একটি ছন্নছাড়া দেশের পক্ষে চাইলেও কোনো ফুটবল ম্যাচ খেলা সম্ভব ছিল না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ফুটবলার ও ছাত্রনেতা সাইদুর রহমান প্যাটেল, ফুটবলার আলী ইমাম, আওয়ামী লীগের নেতা মো. সামছুল হক এমএনএ, লুৎফর রহমান প্রমুখ।

প্রাথমিকভাবে ভারতে শরনার্থী হিসেবে অবস্থানরত বাংলাদেশের ফুটবলারদের নিয়ে দল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। অল ইন্ডিয়া রেডিও ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা ফুটবলারদের ট্রায়ালের জন্য কলকাতায় শরণার্থী শিবিরের আসার আহ্বান জানায়। অবশেষে ২৫ জন খেলোয়াড়কে ভারত সফরের আগে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য মনোনীত করেন।

ক্যাম্পের পর অল্প কয়েকজন দলে যোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাধর কাজী সালাহউদ্দিন। সালাহউদ্দিন তখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। কলকাতার একজন চিত্র সাংবাদিক তাকে ফুটবল দলের ক্যাম্পেইনের কথা জানান।

তিনি তখন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে নিয়মিত খেলতেন এবং পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন। সালাহউদ্দিন অবিলম্বে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি প্লেনে করে কলকাতায় দলের সঙ্গে যোগ দেন। এভাবে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জন্ম।

প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল নদীয়া জেলা একাদশ। ম্যাচটি ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় কৃষ্ণনগরে। কোনো দেশের মুক্তিসংগ্রামে ফুটবল খেলা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, সেদিনের আগে দেখা যায়নি। ম্যাচ শুরুর আগে বাংলাদেশ দল ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত বাজানোর অনুরোধ জানায়।

বাংলাদেশ যেহেতু স্বীকৃত দেশ নয়, এ কারণে স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে। তবে শেষ অবধি বাংলাদেশ দল ও দর্শকদের দাবির মুখে তারা সম্মতি দেয়। আর এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নেন নদীয়ার জেলা প্রশাসক ডি কে ঘোষ। সে দিনটি ঐতিহাসিক এক দিন। স্বাধীন দেশ না হয়েও ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং বাজানো হয় জাতীয় সংগীত।

এই দিন মেহেরপুর সীমান্ত এলাকা দিয়ে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ম্যাচ উপভোগ করতে স্টেডিয়ামে আসে। ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়। স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে প্রথম গোল করেন শাহজাহান। এ ঘটনা যুদ্ধরত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে।

বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানোয় নদিয়াকে ভারতীয় ফুটবল এসোসিয়েশন থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বিতীয় ম্যাচটি কলকাতায় আয়োজিত হওয়ায় বিপুলভাবে সাড়া পড়ে। তবে আগের ম্যাচের বিতর্কের কারণে মোহন বাগান নাম পাল্টে গোষ্ঠ পাল (গোষ্ঠ পাল ছিলেন কিংবদন্তি ভারতীয় ফুটবলার) একাদশের ব্যানারে খেলতে রাজি হয়।

এ ম্যাচকে কেন্দ্র করে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক কভারেজ দেওয়া হয়। গোষ্ঠপাল একাদশের অধিনায়ক ছিলেন ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক চুনী গোস্বামী। ম্যাচে প্রধান অতিথি ছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার গোষ্ঠপাল। এরপর ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল খেলায় অংশ নেয়।

মুম্বাই সফরটিও বেশ আলোচিত হয়। মুম্বাই দলের হয়ে খেলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মনসুর আলী খান পতৌদি। উপস্থিত ছিলেন বলিউড কাঁপানো অভিনেতারা। ড্যাশিং ক্রিকেটার মনসুর আলী খান পতৌদি ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব পালন করেন এবং ‘স্পোর্টস উইকের’ হয়ে একমাত্র গোলটি করেন।

ম্যাচটি বাংলাদেশ ৩-১ গোলে জয়লাভ করে। পরে পতৌদি, মুম্বাই গভর্নর এবং বলিউড তারকা দিলীপ কুমার বাংলাদেশের ত্রাণ তহবিলে বিপুল অর্থ দান করে। ম্যাচের টিকেট বিক্রি করে ১৮০০ মার্কিন ডলার সংগ্রহ হয়েছিল এবং সেটিও তহবিলে জমা করা হয়।

বাংলাদেশ তাদের সর্বশেষ ম্যাচটি খেলেছিল পশ্চিবঙ্গ বালুরঘাট একাদশের বিপক্ষে। বাংলাদেশের গেরিলা ক্যাম্পটিও ছিল বালুরঘাটে। খেলা শুরুর আগে খেলোয়াড়রা গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে। এরপর বাংলাদেশ একাদশ

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল । ততদিনে ভারতে ১৬ টি প্রীতি ম্যাচ খেলে তারা মুক্তি তহবিলে ৫ লক্ষ টাকা জমা দিয়েছে, যা তখনকার দিনে অনেক। যার ১২টিতে জয়, ৩টিতে ড্র এবং একটিতে হেরেছে। দিল্লিতে তহবিল সংগ্রহের জন্য যখন খেলতে যাওয়ার কথা, এমন সময় তারা বহুল প্রতীক্ষিত সংবাদটি পেল- বাংলাদেশ পাকিস্তানের রোষানলমুক্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।

সব যুদ্ধ যে শেষ, এবার বাড়ি ফেরার পালা। স্বাধীন মায়ের কোলে মুক্ত সন্তানদের ফেরার পালা। দেশেও সবাই উদগ্রীব হয়ে রয়েছে তাদের প্রতীক্ষায় । বাংলাদেশে সবাই তাদের বরণ করে নিল মুক্তির বার্তাবাহক, বিপ্লবের মুখবন্ধ হিসেবে।

সেদিন নিশ্চয় ফুটবল ঈশ্বর খুব আনন্দ পেয়েছিলেন আর মিটিমিটি হেসেছিলেন এই বিপ্লবী দামাল ফুটবল সন্তানদের দেখে, আর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল? তারা কেউ নিযুক্ত হন জাতীয় আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের গৌরব বাড়াতে। কেউ বা নিজেকে সঁপে দেন বাংলাদেশ প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে।

বাংলা ইনসাইডার/এসএম

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭