ইনসাইড বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রীর কিচেন কেবিনেটে কারা?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 06/07/2017


Thumbnail

সরকারের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয় মন্ত্রিসভায়। সেখানে মন্ত্রীরা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। মন্ত্রিদের বক্তব্য থেকে সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী।

তবে এর বাহিরে অন্য কারও পরামর্শও নিতে পারেন সরকার প্রধান। বিশ্বব্যাপী যা কিচেন কেবিনেট নামে পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতন্ত্রের আমলেও বিদ্যমান ছিল অলিখিত এই কেবিনেট। এই কিচেন কেবিনেটে স্থান হয় সাধারণত মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বা এর বাহিরে সরকারের শুভাকাঙ্খি বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে এই কিচেন কেবিনেটে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, রেহমান সোবহান, তোফায়েল আহমেদ ও আসম আবদুর রবসহ কয়েকজন।

পরবর্তীতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের কিচেন কেবিনেটে ছিলেন বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) কয়েকজন। আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও ছিল এমন কেবিনেট।

পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কিচেন কেবিনেটে স্থান হয় দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার।

পরবর্তীতে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেটি প্রথম সরকার। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিচেন কেবিনেটে স্থান হয়েছিল জিল্লুর রহমান, আবদুল হামিদ, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, তোফায়েল আহমেদ ও শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতার।

এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনার সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। এর আগে প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই আমলের ‘সংস্কারপন্থী’ বিবেচনায় পরবর্তীতে কিচেন কেবিনেটেও ভিন্নতা দেখা যায়। এই কেবিনেটে স্থান হয় এইচটি ইমাম, মতিয়া চৌধুরী, গওহর রিজভী ও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীসহ নতুন ও পুরাতন কয়েকজনকে।

তবে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তেমন কোন কেবিনেট আছে বলে মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের অনেকেই মনে করছেন, বিশ্বব্যপী স্বীকৃত এই ‘কিচেন কেবিনেট’ প্রথা এবার ভেঙ্গেছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে কারও কারও মতে, প্রধানমন্ত্রীকে হয়ত কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন, তবে তা পর্দার আড়াল থেকে।

২০০৮ সাল থেকে টানা দ্বিতীয় মেয়াদ পূর্ণ করতে যাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। এর মধ্যে সরকারের অন্যতম প্রশংসিত কাজ মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধীদের বিচার নিশ্চিত করা ও রায় কার্যকর করা।

এছাড়াও রায়েছে পদ্মা সেতু, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন, সমুদ্রসীমা মামলা, গণজাগরণ ও হেফাজত ইস্যু, সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবেলা, রহিঙ্গা ইস্যুসহ নানা বিষয়। এসব বিষয়ের সঙ্গে প্রশ্ন আসে প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পরামর্শক কে? জানা গেছে, বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ শুনলেও সিদ্ধান্ত নেন নিজেই। দলীয় বিষয়ে তৃণমূলের কথা শোনেন বেশি। তবে সার্বিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কারও ওপর নির্ভর করেন না তিনি।

জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে বাজেট আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরামর্শক বিষয়ক আলোচনা আরও সামনে এসেছে। বাজেট আলোচনায় কেবল সংসদ সদস্যরা নন, সরকারের কোনও কোনও মন্ত্রীও প্রস্তাবিত বাজেটের সমালোচনা করেন। যদিও প্রস্তাবিত এই বাজেট মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পরই সংসদে উপস্থাপন করা হয়। সদা সাম্প্রতিক প্রশ্ন ‘মন্ত্রিসভা কি কোন কিছু না দেখেই সব অনুমোদন দিয়ে দেয়?’ আরও দৃঢ় হয়ে সামনে আসে। কারণ কোন মন্ত্রীর আপত্তি থাকলে যে কোনও প্রশ্নে তিনি মন্ত্রিসভাতেই প্রশ্ন তুলতে পারেন। সর্বশেষ সংসদ নেতা শেখ হাসিনার পরামর্শে আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট বিষয়ে সংশোধনী আনার পর তা সংসদে পাস হয়।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার বা দল পরিচালনায় সবার কথাই শোনেন। তবে সিদ্ধান্ত নিজেই নেন। আর মন্ত্রিসভায় তেমন পরামর্শ মন্ত্রীদের কেউ দিলে তিনি তখনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন।

বলা হয়ে থাকে, দেশের একমাত্র ব্যক্তি শেখ হাসিনা, যিনি চেয়েছিলেন বলেই মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে এসব অপরাধীদের দফারফা করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও এগুতে হয়েছে খুব ভেবে-বুঝে। এক্ষেত্রে কখনো ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করতে হয়েছে নানামুখী সমালোচনার ঝড় মাথায় নিয়েও। কারণ আগে জনমত একীভূত করতে হয়েছে বা ‘তাড়াহুড়া করেছে’ বলে যেন কেউ অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে।

তাছাড়া বাংলাদেশের সম্মানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পদ্মাসেতু নিজস্ব অর্থায়নে করার সিদ্ধান্তও তিনি নিজেই নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মাসেতু থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের পুরোনো ছিটমহল বিনিময় চুক্তিও বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। তবে কোন দেশের সঙ্গে বিনা যুদ্ধে বা বিনা রক্তপাতে এমন একটি সমস্যা সমাধানের পথে এগুনোই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। যা সংশ্লিষ্টদের কথা শুনে নিজেই নিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইভাবে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধের পথে না গিয়ে মামলায় এগুনোর সিদ্ধান্তও একটি প্রশংসিত বিষয়। এক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের আইন চেয়ে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ এবং এর কাউন্টার হিসেবে গড়ে ওঠা হেফাজতে ইসলামের মতিঝিল তান্ডবের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও সরকারের ও দলসংশ্লিষ্টদের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তবে এ ক্ষেত্রেও কারও একক পরামর্শে নির্ভর করেননি শেখ হাসিনা।

সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে খোলামেলা এক ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এর আগে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার ফোন করার সিদ্ধান্তও ছিল প্রধানমন্ত্রীর একক। ওই সময় দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ফোন না করার জন্য। কারণ এর আগে খালেদা জিয়া সরকারের উদ্দেশ্যে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। আল্টিমেটামের সময়সীমার মধ্যেই ফোন করলে ওই যাত্রায় রাজনৈতিক কৌশলে খালেদা জিয়া জিতে যাবেন বলে যুক্তি ছিল নেতাদের।

কারণ আমাদের দেশের ভোটারদের প্রবণতা হচ্ছে, রাজনীতিতে বা আন্দোলনে জিতে যাওয়াদের ভোটেও জিতিয়ে দেয়া। ওই মন্ত্রী বলেন, কিন্তু নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) নিশ্চিত ছিলেন, এই জয় খালেদা জিয়া ক্যাশ (কাজে লাগানো) করতে পারবেন না। ফলে তা আওয়ামী লীগের পক্ষেই যাবে।

২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির পর বিএনপির টানা প্রায় তিন মাসের আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যান। ওই সময় সন্তানহারা মা খালেদা জিয়াকে সান্তনা দিতে যান আরেক মা শেখ হাসিনা। এই সিদ্ধান্তও প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে রহিঙ্গা ইস্যুতে নেয়া সিদ্ধান্তও প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করাসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। ওই সময় রহিঙ্গা শরণার্থীদের খাবার, ওষুধ ও নৌকার ইঞ্জিনের জন্য তেল সরবরাহ করলেও বানের ¯্রােতের মতো তাদের দেশে ঢুকতে দেয়নি প্রশাসন। বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গণকে বুঝিয়েছেন এ বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য। পরবর্তীতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গণ রহিঙ্গা ইস্যুতে তদন্তও করেছিল এবং স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরামর্শ নেন তাঁর একমাত্র পুত্র সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয়ের। আর স্বাস্থ্য বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কখনো কখনো নিজের একমাত্র কন্যা সায়মা হোসেন ওয়াজেদ পুতুলের পরামর্শ নেন।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার তালিকায় প্রথমেই আছে এইচ টি ইমামের নাম। দ্বিতীয় নামটি হচ্ছে মসিউর রহমান। তিনি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা গওহর রিজভী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা। চতুর্থ অবস্থানে আছেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। যিনি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা। পঞ্চম অবস্থানে আছেন তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তিনি নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তবে তাঁদের প্রায় সবাই কেবল কাগজে-কলমে উপদেষ্টা। মূলত সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রধানমন্ত্রীকেই। তবে কখনো কোনও বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ শুনলেও সার্বিক বিষয়ে কারও ওপর ভরসা করেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


বাংলা ইনসাইডার/এমএএম




প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭