নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 03/06/2020
কভিড -১৯ শুধু আমাদেরই নয়, বিশ্বের সকলের ভাবনায় অভাবিত পরিবর্তন এনেছে। আর তাই নগর উন্নয়ন করতে হলে আমাদেরকে নির্বাচন করতে হবে সঠিক ও কার্যকরী সদূরপ্রসারী নগর উন্নয়ন দর্শন। নগর উন্নয়ন সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃংখলা ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু এখানে শেষ নয় যেতে হয় আরো দূরে, আরও গভীরে। জানতে হবে কেন আমরা নগরে বাস কি ? শান্তি, উন্নতি, সুখ, সামাজিক ন্যায়, স্বাধীনতা না কি অন্য কিছুর জন্য । সহজ উত্তর নেই এ প্রশ্নের।
সুস্থ সুন্দর জীবনের জন্য নগর। বিশৃংখলা সেখানে কারও কাম্য নয়। আজ বাংলাদেশের শহরগুলোতে যে বিশৃংখলা বিদ্যমান সেখান থেকে মুক্তি পেতে হলে নগরের বিশৃংখলার লাগাম টেনে ধরবার এখনই সময়। এখন যদি এটা না করা হয় তবে সরকারের সকল সাফল্য ম্লান হয়ে যেতে পারে!
দীর্ঘ ৬৬ দিন পর নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী সিদ্ধান্তকে আমি স্বাগত জানতে চাই। ভয়, হতাশাকে জয় করে বাঁচতে হবে, সুখ খুঁজতে হবে, সুখী সমাজ গড়তে হবে। সেজন্য আমাদের প্ৰয়োজন সঠিক জীবন দর্শন।
নতুন ভাবে যাত্রার প্রাক্কালে পত্রিকাগুলো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের ভাড়া বাড়ানো ও ভর্তি করে যাত্রী নেয়ার বিষয়টি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছিল- যা সকলের নজর কেঁড়ে ছিল। এটা নিয়ে যাঁরা হয়তো কোনোদিন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলেননি, সেরকম বরেণ্য ব্যক্তি ডক্টর কামাল হোসেনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
এর আগে আমি যখন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুলে দেয়ার কথা লিখে ছিলাম তখন প্রচন্ড প্রতিবাদ এসে ছিল। কালও তাদের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। বাসগুলো নিয়ম মানছে না। সড়কে যানজট সৃষ্টি করছে, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব মানছে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ।
তাদের জন্য বলতে চাই - বিশ্বের সেরা শহর মেলবোর্ণে একদিনএর জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয় নি ! তারা ভাড়া বাড়ায়নি। এবং তারা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছে। আমার জীবন দর্শন হলো হতাশায় থামা নয়। আর তাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগতম নতুন করে সব কিছু খুলে দেয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু যদি সেই ১৯৭২ সালে শুন্য হাতে যাত্রা করতে পারেন , যদি সুইডেন লক ডাউন না করে বাঁচতে পারে , যদি লক ডাউনের পরেও যুক্তরাষ্টের লক্ষ নাগরিক মারা যায়, তবে লক ডাউন কিছুই দিতে পারেনি আমাদেরকে। বরং আমাদের দায়িত্বশীল আচরণই মুক্তির উপায়। আমাদের উন্নয়ন টেকসই হবে না, যদি না আমরা দায়িত্বশীল হই।
আমার মনে হয়েছে, ১২ বছর ধরে সরকার উন্নয়নের যে নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে তা নানা ভাবে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। নগর পরিবহন তার অন্যতম। আমরা ২০১৮ সালে শিশুদেরকে রাজপথে দেখেছি এই অনাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। সরকার প্রমিজ করেছিল এই অনাচারের অবসান ঘটাবে। আমরা নগরে দুজন নির্বাচিত মেয়র পেয়েছি। ওনারা দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা প্রায়ত মেয়র আনিসুল হক এর কাছ থেকে শুনেছিলাম তিনি একটি পরিকল্পিত ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম নগরীকে দিবেন। সে অনুসারে গুলশান এলাকায় একটি মডেল সিস্টেম দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেটিও তেমন কার্যকর নয়। এখানে আরও বাস প্রয়োজন। রুটের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। আর প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এর সঙ্গে বাসের আলাদা লেন চালু করা ছাড়া সিস্টেমটি টেকসই করা সম্ভব নয়।
পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের মেয়রদের প্রতিশ্রুতি কোনোভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় যদি পুলিশ ও লাইসেন্সিং অথরিটি ওনাদেরকে সহযোগিতা না করেন। যেহেতু মেট্রোপলিটন পুলিশ নামে আলাদা একটি ব্রাঞ্চ আছে, সেক্ষেত্রে এই ব্রাঞ্চটি মেয়রদের অধীনে দেয়া যেতে পারে। নুতবা সড়কের শৃংখলা সদুর পরাহত থেকে যাবে।
নগরের উন্নয়ন কেবল সড়কের শৃংখলা আনলে হবে না। নির্মাণ, বাণিজ্য এর সঙ্গে যুক্ত। নগর উন্নয়ন বিদ্যমান সীমিত ক্ষমতা দিয়ে সম্ভব হবে- এরকম আশা করা সমীচীন হবে না।
নগর উন্নয়নের কোনো দর্শন আছে কি? আমার মনে হয় সেরকম কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। নগর উন্নয়ন যে কেবল কাঁচাবাড়ি থেকে পাকাবাড়ি, কাঁচা রাস্তা থেকে পাকা রাস্তা নির্মাণ বোঝায় না-তা হয়তো অনেকে বুঝি। সাম্প্রতিককালে ডেঙ্গু ও কভিড-১৯ মহামারীর বিষয়টি সকলকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। শৃংখলার পাশাপাশি নাগরিকের স্বাস্থ্য এখন উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।
যদিও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও আবর্জনার অপসারণ স্বাস্থ্য সম্মত হওয়া প্রয়োজন। এবং নগর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে থাকেন , তবে বিল্ডিং পারমিট দেয়ার সময় বিষয়টি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ মনে রাখেন বলে প্রতীয়মান হয় না। ফলে জন সংখ্যার ঘনত্ব যে ভাবে বেড়েছে তাতে কোয়ালিটি লাইফ শহরে এখন সোনার হরিণ। করোনা ভাইরাস এর বিস্তারের অন্যতম কারণ।
অবাক কাণ্ডের বিষয় হলো সরকারি আবাসিক এলাকাগুলোও কোনোভাবে স্বাস্থ্যকর বলা যায় না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বেশ কিছু সম্মানিত মন্ত্রী ও সম্মানিত সংসদ সদস্যের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে মশার কামড় খেতে খেতে ভাবছিলাম না জানি ডেঙ্গু আমাকে ধরে। ওনাদের বাসার পাশের ড্রেন দুর্গন্ধ ও ময়লায় ভরপুর। মশার ও পোকার শান্তির আবাসস্থল , নাগরিকের নয়। যখন দেখলাম ওঁনাদেরই এমন অবস্থা তখন আমার অবস্থা নিয়ে ভাবনার সুযোগ কোথায় ? যখন মাননীয় অর্থমন্ত্রী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতলে গেলেন তখন আরও ভীত হলাম আমাদের আগামী দিনগুলির কথা ভেবে।
আজ সারাদেশের মানুষ প্রায় তিনমাস ধরে হাহাকার করছে, উদ্বেগে জীবন যাপন করছে তার অন্যতম কারণ আমাদের উদাসীনতা। আমাদের উপরতলার মানুষগুলো সর্দি কাশি হলে সিঙ্গাপুর ব্যাংকক কিংবা লন্ডন চলে যেতেন। আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন-কোথায় ভুল ছিল তাদের ভাবনায়।
আজ আমরা লক্ষ্য করছি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্দোলনের মুখে বাইবেল হাতে চার্চে যাচ্ছেন, হিন্দুইজম দিয়ে মোদী ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চাইছেন; ৫০০ বছর পরেও সাদা -কালো বিভেদ বিরাজমান ; জর্জ ফ্লয়েড বলেন " আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা " সেখানে কিভাবে আমরা আশা করি বিদেশে বেগমগঞ্জ বানালে আমাদের ভবিৎষ্যৎ প্রজন্ম সুখে , নিরাপদে থাকবে ?
কিছুদিন আগে আমাদের গুরুজন বিদেশ থেকে শিক্ষক আমদানি নিয়ে ভাবছিলেন। আমরা আসলে কি চাই ? উন্নয়ন নাকি স্বাধীনতা ? আমরা কি ভুলে গেছি ব্রিটিশ পরাধীনতার কথা? আমরা শর্ট কাট সমাধান খুঁজি। অপরদিকে চাইনিজ বা ভারতীয়রা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজে। তারা তাদের সন্তানদেরকে বিদেশে পাঠায় এবং উচ্চ বেতন দিয়ে দেশে ফেরায়। মালয়েশিয়া , সিঙ্গাপুর , ইন্দোনেশিয়া এভাবে উন্নয়ন করছে।
আর আমরা কৌশল খুঁজি কিভাবে বিদেশ ডিগ্রিধারীদের বিতাড়ন করা যায়, Demoralize করে দেয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যগণ , বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে যেন ভাবে। উপাচার্যরা বিদেশ থেকে ফিরে আসা শিক্ষকদেরকে সুযোগ দেবেন না কি তাদেরকে বিতাড়ন করে উন্নয়ন করবেন । তাদের চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে যোগ্য শিক্ষকের স্বল্পতার সমস্যা মেটানো যৌক্তিক চিন্তা নয় কি ? দেশের সন্তানদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা কি ভাল নয়? অর্থাৎ, শিক্ষা উন্নয়নের দর্শন আসলে কি আমদানি নির্ভর হবে নাকি নিজেদের শক্তি বাড়ানো যৌক্তিক হবে ?
কিছুদিন আগে একটি গল্প একজন ডাক্তারের কাছ থেকে শুনেছিলাম। তিনি ট্রেনিংএ মালয়েশিয়ায় গিয়ে ছিলেন। তিনি তাদের উন্নয়নের চাবিকাঠি জানতে চেয়ে ছিলেন। তখন ওই মালয়েশিয়ান বাংলাদেশী ডাক্তারকে বলেছিলেন , একবার বেগম মাহাথির অসুস্থ হলেন। ডাক্তার বললো বিদেশ পাঠিয়ে দিন। মাহাথির বললেন না। বরং আপনারা বিদেশ যান , ট্রেনিং নিয়ে আসেন তার পর আমার বেগমের ট্রিটমেন্ট করেন। এবং সেটাই হয়েছিল।
বাঙালিদের মাঝে এমন দেশ প্রেম ছিল বলে ব্রজমোহন, ব্রজলাল নিজ নিজ এলাকায় কলেজ করেছেন। কুমুদিনী, বিনোদিনী নামে হাসপাতাল আছে। কিন্তু - বিগত দিনগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইভেট ক্লিনিক হলেও সরকারি জেলা হাসপাতলে কিছু হয়নি , আমার দেশে বাণ্যিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসার ঘটেছে ওই ব্যাঙের ছাতার মতো; যার মালিকরা বিদেশ থেকে শিক্ষক আমদানি করে সনদ বাণিজ্যের প্রসার সম্ভব চিন্তা করেন - তারা আসলে স্বাধীনতাকে হুমকিতে নিপতিত করেন- যেমন ব্রিটিশ এসেছিলো এদেশে বাণিজ্য করতে!
করোনা ভাইরাস তোমাকে অন্ততঃ এক কারণে ধন্যবাদ দিতে হয়। এবার তারা বুঝবে বিদেশে অর্থপাচার , বেগমগঞ্জ বানানো উন্নয়ন নয় , বিদেশ থেকে শিক্ষক আমদানি উন্নয়ন নয় , কাঁচা বাড়ি থেকে পাকাবাড়ি বানানো উন্নয়ন নয়, উন্নয়ন মানে পরিকল্পিত উন্নয়ন- যার পেছনে থাকে স্বাধীনতা বোধ এবং মযাদাপূর্ণ উন্নত জীবনবোধ বা কোয়ালিটি অব লাইফ ! আর কোনো বড় পদে যিনি বসেন, তিনি হবেন উদার মনের একজন দেশপ্রেমিক যিনি কোয়ালিটি কি বোঝেন। আমরা কিন্তু প্রতিযোগিতায় কোয়ালিটিতে মার খাচ্ছি। গুণগতমানের সমস্যা মোকাবেলায় শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ একান্ত জরুরি। এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুও বটে !
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭