ইনসাইড পলিটিক্স

খুনীর মন্ত্রিসভায় কেন গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 03/08/2020


Thumbnail

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙালির জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ যেমন প্রতিবাদ করতে পারেনি, আওয়ামী লীগ নিরব দর্শকের মতো তাকিয়ে ছিল, তাঁর থেকেও ভয়ঙ্কর দিক হলো বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার মাত্র ৬ জন সদস্য ছাড়া প্রায় সব সদস্যই ঐ খুনী খন্দকার মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সর্বশেষ মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি। ঐ মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন ক্যাপ্টেন মো. মনসুর আলী। ৩০ সদস্যের এই মন্ত্রিসভায় যে মন্ত্রীরা ছিলেন তাঁরা হলেন-

১. শেখ মুজিবুর রহমান- রাষ্ট্রপতি

২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি

৩. মো. মনসুর আলী- প্রধানমন্ত্রী

৪. খন্দকার মোশতাক আহমেদ- বাণিজ্য মন্ত্রী

৫. এএইচ এম কামরুজ্জামান- শিল্প মন্ত্রী

৬. মোহাম্মদ উল্লাহ- ভুমি প্রশাসন, ভুমি সংস্কার মন্ত্রী

৭. আব্দুস সামাদ আজাদ- কৃষি মন্ত্রী

৮. অধ্যাপক ইউসুফ আলী- শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী

৯. শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার- এলজিআরডি মন্ত্রী

১০. ড. কামাল হোসেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী

১১. মো. সোহরাব হোসেন- পূর্ত, গৃহনির্মাণ মন্ত্রী

১২. আব্দুল মান্নান- স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী

১৩. আব্দুর রব সেরনিয়াবাত- মৎস্য, বন, বন্যা এবং বিদ্যুত শক্তি মন্ত্রী

১৪. শ্রী মনোরঞ্জন ধর- আইন, বিচার, সংসদ মন্ত্রী

১৫. এড. আব্দুল মোমিন- খাদ্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী

১৬. আসাদুজ্জামান খান- পাট মন্ত্রী

১৭. এম কোরবান আলী- তথ্য, বেতার মন্ত্রী

১৮. ড. আজিজুর রহমান মল্লিক- অর্থ মন্ত্রী

১৯. ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী- শিক্ষা, আনবিক শক্তি মন্ত্রী

২০. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী- বন্দর ও জাহাজ দফতর মন্ত্রী

২১. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর- প্রতিমন্ত্রী, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়

২২. আব্দুল মোমিন তালুকদার- প্রতিমন্ত্রী, এলজিআরডি

২৩. দেওয়ান ফরিদ গাজী- প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য, পাট, চা

২৪. অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী- প্রতিমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়

২৫. তাহের উদ্দিন ঠাকুর- প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও বেতার

২৬. মোসলেম উদ্দিন খান- প্রতিমন্ত্রী, পাট মন্ত্রণালয়

২৭. কে এম ওবায়দুর রহমান— প্রতিমন্ত্রী, ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ

২৮. ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল- প্রতিমন্ত্রী, সাহায্য ও পুনর্বাসন

২৯. রিয়াজ উদ্দিন আহমদ- প্রতিমন্ত্রী, বন, মৎস্য ও পশুপালন

৩০. সৈয়দ আলতাফ হোসেন- প্রতিমন্ত্রী।

বঙ্গবন্ধুর শেষ মন্ত্রিসভা

৭৫ এর ১৫ই আগস্ট যখন জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় সেই মন্ত্রিসভায় রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন খুনী মোশতাক, উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ এবং ঐ মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন-

১. খন্দকার মোশতাক আহমেদ- রাষ্ট্রপতি

২. মোহাম্মদ উল্লাহ- উপরাষ্ট্রপতি

৩. অধ্যাপক ইউসুফ আলী- মন্ত্রী, পরিকল্পনা দফতর

৪. শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার- মন্ত্রী, এলজিআরডি

৫. মো. সোহরাব হোসেন- মন্ত্রী, পূর্ত, গৃহনির্মাণ

৬. আব্দুল মান্নান- স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী

৭. শ্রী মনোরঞ্জন ধর- আইন, বিচার, সংসদ মন্ত্রী

৮. আব্দুল মোমিন তালুকদার- মন্ত্রী, কৃষি দফতর, খাদ্য

৯. আসাদুজ্জামান খান- মন্ত্রী, বন্দর ও জাহাজ চলাচল

১০. ড. আজিজুর রহমান মল্লিক- অর্থমন্ত্রী

১১. ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী- শিক্ষামন্ত্রী

১২. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী- মন্ত্রী, পররাষ্ট্র দফতর

১৩.  শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন- প্রতিমন্ত্রী, বিমান ও পর্যটন

১৪. তাহের উদ্দিন ঠাকুর- প্রতিমন্ত্রী, তথ্য, বেতার, শ্রম

১৫. কে এম ওবায়দুর রহমান— প্রতিমন্ত্রী, ডাক ও তার

১৬. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর- প্রতিমন্ত্রী, রেল ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়

১৭. দেওয়ান ফরিদ গাজী- প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য, খনিজ সম্পদ

১৮. অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী- প্রতিমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয়

১৯. রিয়াজ উদ্দিন আহমদ- প্রতিমন্ত্রী, বন, মৎস্য ও পশুপালন

২০. মোসলেম উদ্দিন খান- প্রতিমন্ত্রী, পাট মন্ত্রণালয়

২১. মোমেন উদ্দিন আহমেদ- প্রতিমন্ত্রী, বন্যা, পানি বিদ্যুত

২২. ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল- প্রতিমন্ত্রী, সাহায্য ও পুনর্বাসন

২৩. সৈয়দ আলতাফ হোসেন- প্রতিমন্ত্রী, সড়ক যোগাযোগ।

খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভা

দুটি তালিকার তুলনা করলে দেখা যায় যে, মাত্র ৭ জন খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় অনুপস্থিত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, মন্ত্রিসভার আরেক সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। জানুয়ারির মন্ত্রিসভায় তিনি মৎস্য, বন, বন্যা এবং বিদ্যুৎ শক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। এই মন্ত্রিসভা থেকে অন্যান্য যারা ঐ মন্ত্রিসভায় যোগদান করেননি তাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপরাষ্ট্রপতি), যিনি পরবর্তীতে ৩ নভেম্বর কারাগারে নির্মমভাবে শহীদ হন। ক্যাপ্টেন মসুর আলী (প্রধানমন্ত্রী), যিনিও ৩ নভেম্বর কারাগারে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন। আব্দুস সামাদ আজাদ (কৃষিমন্ত্রী), ৭৫ এর পরপরই যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ড. কামাল হোসেন (পররাষ্ট্র মন্ত্রী), যিনি ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন। এছাড়া সকলে কিভাবে খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন সেটা একটি বড় প্রশ্ন। গবেষকরা মনে করেন যে, মূলত কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যরা খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল। এই কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-

১. আদর্শিক চেতনার অভাব

মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে যে আদর্শিক চেতনা থাকা দরকার ছিল, সেই আদর্শিক চেতনা তাঁদের ছিলনা। যার ফলে তাঁরা খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় অংশ নিয়েছিলেন।

২. ভয় এবং আতঙ্ক

যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, তাই তাঁরা ভীতু এবং কাপুরুষের মতো ঐ মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন।

৩. ষড়যন্ত্রের অংশ

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার একটি বড় অংশই বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল। যেমন তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জুরসহ বেশ কিছু লোককে পাওয়া যায় যারা এই চক্রান্তের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এইজন্যে তাঁরা মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন।

আরেকটি বড় কারণ ছিল যে, তাঁরা হতবিহবল হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের কি করতে হবে কি করতে হবে না তা বুঝে উঠতে না পেরে মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন।

৭৫ এর ১৫ই আগস্টে আওয়ামী লীগের এই হেভিওয়েট নেতাদের খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের মধ্যে দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, রাজনীতিতে আদর্শ, সাহস এবং সততা না থাকলে তাঁরা কঠিন সময়ে দাঁড়াতে পারে না। ৭৫ এর ১৫ই আগস্টের এই মন্ত্রিসভা আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭