ইনসাইড বাংলাদেশ

জাতির পিতা হত্যায় জিয়ার কুকীর্তি ফাঁস করে গেছে খুনি মাজেদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 15/08/2020


Thumbnail

গত বছর ১২ এপ্রিল জাতির পিতার হত্যাকারী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। তবে এর আগে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতার অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করে গেছেন তিনি। 

জবানবন্দিতে মাজেদ জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের সবাই বঙ্গভবনে আশ্রয় নেয়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের পাশের ভিআইপি স্যুটে (দ্বিতীয় তলা) তারা অবস্থান করতেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতেন। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের পুরষ্কার হিসেবে খুনিদের একটি করে পদোন্নতি এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেওয়া হয়। তবে এর আগে থেকেই খুনিরা সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করতেন। তাদের সব চাহিদা পূরণে দেখভাল করতেন খোদ জিয়াউর রহমান।

জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ সমর্থন ছিল উল্লেখ করে মাজেদ বলেছেন, আগের রাতে হত্যাযজ্ঞ শেষে পরদিন ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান সকাল ১০টা-১১টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট অডিটোরিয়ামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সব জওয়ান ও অফিসারকে অ্যাড্রেস করেন। ওইখানে উনি (জিয়াউর রহমান) মটিভেট করেন যে, যে ঘটনা গত রাতে ঘটে গেছে তোমরা সেসব নিয়ে কোনওরকম মাথা ঘামাবে না। তোমরা সব চেইন অব কমান্ডে ফিরে যাও। সবাই কাজকর্ম কর। এটা জাতির ব্যাপার, এটা আমাদের ব্যাপার নয়।

জিয়াউর রহমানের বিষয়ে মাজেদ বলেছেন, তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহীও ক্যু’র বিষয়ে জানতো না। তাদের তো কোনও অফিসারও তাতে জড়িত ছিল না। তবে ওই বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’-তিনজন রিটায়ার্ড অফিসার ছিল। আর বাকিরা ট্যাংক রেজিমেন্ট, আর্মড কোরের লোক। তিনি (জিয়াউর রহমান) বক্তৃতা দিয়েছেন, মটিভেট করেছেন। সমর্থন না থাকলে আগ বাড়িয়ে উনি করতে যাবেন কেন? রেগুলার ওরাই ডিক্টেক্ট করত সবকিছু। হুকুম চালাত ওইখান থেকে। ওরা যা চাইত তাই উনি করে দিতেন। 

মাজেদ বলেছেন, উনি (জিয়াউর রহমান) বঙ্গভবনে খুনিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন এবং খুনিরাও তার সঙ্গে ওইখান থেকে যোগাযোগ করতেন ডাইরেক্ট এবং আর্মির চেইন অব কমান্ড বলতে কিছু ছিল না। ওরাই চালাত প্র্যাকটিকালি। ওইখান থেকে। মাঝখানে সেনা হেডকোয়ার্টারে একবার আমি ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে উনাকে (জিয়াউর রহমান) আমার জন্য একটি সিভিল সার্ভিসের ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলাম। ইন্ট্যারভিউতে তিনি (জিয়াউর রহমান) প্র্যাকটিকালি এই ক্যু’র ব্যাপারে পক্ষপাতসূলভ কথাবার্তা বলছেন। বুঝা গেছে, ক্যু’র সমর্থকদের সঙ্গে উনার (জিয়াউর রহমান) সব ধরনের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীতে যখন বিদেশে যাওয়ার প্রশ্ন এল তখন তিনি (জিয়াউর রহমান) দফায় দফায় বঙ্গভবনে মিলিটারি সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। এইগুলো আমরা দূরে থেকে দেখেছি।

পরে (জিয়াউর রহমান) বললেন, এখানে (বঙ্গভবনে) যে সমস্ত অফিসার আছে তারা সবাই বিদেশে যাবে। তাদের কাগজপত্র তৈরি করার জন্য তৎকালীন মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার মাশহুর হককে নির্দেশ দেন। ওই সময় আমি বঙ্গভবনে স্কট ডিউটিতে ছিলাম। পরবর্তীতে আমাদের ব্যাংককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পরই জিয়াউর রহমান সাহেব পুরো ক্ষমতা নিয়ে নেন। কিছুদিন পর আমাদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে আমরা শুনলাম রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে মেরে ফেলা হয়েছে। রিসালদার বলছিল, তার সঙ্গে দু’জন সিপাহীও ছিল। সিপাহীরা তো ওইখানে যাওয়ার কথা নয়।

জবানবন্দিতে মাজেদ উল্লেখ করেছে, লিবিয়ায় যাওয়ার পরে বলা হল সবার ফরেইন সার্ভিস হবে। জিয়াউর রহমান ফরেইন সার্ভিস দেবেন সবাইকে প্রাইজ হিসেবে। একটা করে প্রমোশনও দিয়ে দেবেন। কিছুদিন পরে (আমার এক্সাট ডেট মনে নাই) জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল নুরুল ইসলামকে (শিশু) আমাদের কাছে পাঠানো হয়। কার কার কোথায় ফরেইন পোস্টিং হবে সেই চয়েজ নিতেই তিনি গেছেন ওইখানে।

ফরেন সার্ভিসে যাদের চাকরি দেয়া হয়েছিল, তাদের সেই যোগ্যতাই ছিল না জানিয়ে মাজেদ বলেছেন, উনার (জিয়াউর রহমান) সরাসরি পৃষ্ঠপোষকাতার কারণেই তাদের একটা করে প্রমোশন জাম্পড এবং একটা করে ফরেইন প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। তবে ওই অফিসারেরা ফরেইন সার্ভিসের জন্য কোয়ালিফাইড ছিলেন না, এমনকি গ্রাজুয়েটও ছিলেন না। তাদের বেশিরভাগই স্বল্প মেয়াদী কমিশনড অফিসার ছিলেন।

তাদের (ক্যু’ অফিসারের পরিবার) বঙ্গভবন থেকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল লিবিয়াতে। অনেকে বিয়ে না করেও তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে চলে গেছে। মেজর শাহরিয়ার এক ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে চলে যায়। মেজর হুদা নারায়ণগঞ্জের এক মেয়েকে বিয়ে না করেই নিয়ে যায়। পরে এসব কাজের বৈধ কাগজপত্র তৈরি করে লিবিয়ায় পাঠানো হয়।

খুনিদের বঙ্গভবনে অবস্থানের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তার বিষয়ে মাজেদ বলেছেন, আমরা শুনেছি যে উনি (শহীদ খালেদ মোশাররফ) বলেছেন ওই মেজররা শুধু শুধু বঙ্গভবনে বসে থাকবে কেন? তারা চলে আসবে। ইউনিটে চলে আসবে। তারা কমান্ডে ফিরে আসবে। ওইটা তার (খালেদ মোশাররফের) একটা ন্যায্য দাবি। সঠিক দাবি, চেইন অব কমান্ড। চেইন অব কমান্ড ছাড়া ফোর্স চলে নাকি? তবে শহীদ খালেদ মোশাররফকে যারা শহীদ করছে তাদের পিছনেও ক্যু’ পার্টির সমর্থন ছিল। জিয়াউর রহমান এলে ডাইরেক্ট লিফ্ট দিয়ে দোতলায় উঠে (ভিআইপি সুইট) যেতেন। সেখানেই তাদের কথোপকথন হত। 

হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা ওই স্বীকারোক্তিতে মাজেদ উল্লেখ করেছেন, অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে তিনিও খুনিদের সঙ্গে ছিলেন। এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেন। রিসালদার মোসলেহ উদ্দীন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের একে একে গুলি করে হত্যা করেন। পরদিন স্টেশন সদর দফতরে গিয়ে স্টেশন কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করে ইউনিটে যোগ দিতে চাইলেও তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল হামিদ তাকে যোগদান করতে না দিয়ে বেতার ভবনে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

ইতিহাসের গর্হিত এই হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বারবার আড়াল করার চেষ্টা করে গেছেন মাজেদ। তবে খুনিদের দেওয়া সব ধরনের সুবিধা ভোগ করে গেছেন। সেনেগালেরর রাষ্ট্রদূত করার বিষয়টি তার পছন্দ হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে মাজেদের ইচ্ছানুযায়ী দেশে ফিরিয়ে এনে উপ-সচিব পদমর্যাদায় বিআইডব্লিউটিসিতে পদায়ন করা হয়। সবশেষ যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে পরিচালক করা হয় তাকে।

 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭