ইনসাইড বাংলাদেশ

খিচুড়ি নিয়ে জগাখিচুড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/09/2020


Thumbnail

 

খিচুড়ি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতম চলছে। যার ছোঁয়া দেশের মূল ধারার মিডিয়া পেরিয়ে দেশের বাইরেও পাড়ি দিয়েছে। খিচুড়ি নিয়ে প্রশাসনের ইমেজের চরম একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা। শিশুদের স্কুলে কীভাবে খিচুড়ি বা মিড ডে মিল দেওয়া হবে তাঁর মহড়া চলছে অনেক দিন ধরেই। খিচুড়ি ভারতীয় শব্দ খিচড়ি থেকে এসেছে এবং খিচড়ি এসেছে সংস্কৃত শব্দ খিচ্চা থেকে।

খিচুড়ির ইতিহাস পরে বলছি তাঁর আগে জেনে নিই খিচুড়ি কেন আলোচনায়। সরকারী সূত্রে জানা যায় যে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাদের ইমারজেন্সি প্রোগ্রামের আওতায় ২০০১ সালে যশোর জেলায় অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু করে। পরবর্তীতে যশোর জেলার অভিজ্ঞতা ইতিবাচক হওয়ায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচিকে তাদের নিয়মিত কান্ট্রি প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি’র তত্ত্বাবধানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পরামর্শক দ্বারা সম্পাদিত সমীক্ষা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যেসকল উপজেলাতে ফিডিং কর্মসূচি চালু ছিল, সে সকল উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার্থী ভর্তির হার, উপস্থিতির হার, প্রাথমিক শিক্ষা চক্র সমাপনীর হার, নন ফিডিং উপজেলার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেশী ছিল। এ ছাড়া ফিডিং উপজেলায় ড্রপ আউটের হারও নন ফিডিং উপজেলার তুলনায় কম ছিল।

প্রাথমিক শিক্ষাকে সকল স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার বুনিয়াদ হিসেবে বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পরিচালিত সমীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রথমবারের মত অপেক্ষাকৃত দারিদ্র পীড়িত উপজেলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্কুল ফিডিং প্রকল্প গ্রহণ করে এবং জুলাই ২০১০ সাল থেকে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এ প্রকল্পে একদিকে যেমন কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করেছে, অন্যদিকে তেমনি একই প্রকল্পের অধীনে নিজস্ব অর্থায়নে ফিডিং কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করে।

এই ধরণের প্রকল্প শুরুর পর থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ও লেখাপড়ায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বাড়লে বরগুনার বামনা, জামালপুরের ইসলামপুর এবং বান্দরবনের লামা উপজেলায় ডব্লিউএফপি’র সহযোগিতায় ২০১৩ সাল থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে মিড-ডে মিল বা দুপুরে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। এই পাইলট প্রকল্প ফলপ্রসূ হওয়ার পর জাতীয় মিড-ডে মিল নীতিমালা-২০১৯ এর আওতায় দেশের ১৬টি উপজেলায় দুপুরের রান্না করা খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে সরকার। তাঁর ধারাবাহিকতায় আগামী বছর থেকে সারা দেশের ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল কার্যক্রম চালু করবে সরকার। সপ্তাহের তিন দিন রান্না করার খাবার এবং তিন দিন উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন বিস্কুট দেওয়া হবে।  

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, অবিভক্ত ভারতে খিচুড়ির জন্ম। তাই খিচুড়িকে বলা হয়ে থাকে ভারতীয় উপমহাদেশের খাবার। এই উপমহাদেশে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেলেও এটি মূলত মিসরীয় খাবার `কুশারি` থেকে আগত। মিসরীয় কুশারি বহুকাল আগেই বিশ্বের অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। সাধারণত ওই সময় মিসর বা আশপাশের অঞ্চলে কুশারি নামের এই খাবারটি পুষ্টিকর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নানা ধরনের ডাল ব্যবহার করে তৈরি কুশারি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে বেশ সমাদৃত ছিল। পরবর্তী সময়ে সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এটি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, খিচুড়ি এংলো-ইন্ডিয়ান খাবার `কিজেরি`র একটি পরিবর্তিত রূপ।

১২০০-১৮০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বাংলায় খিচুড়ির আবির্ভাব। হালে ডালে গরিবের আমিষ বলা হলেও প্রথমদিকে ডাল ছিল উচ্চশ্রেণীর খাদ্য। ‘খিচুড়ির চার ইয়ার – ঘি পাঁপড় দহি আচার’ কথাটি চালু থাকলেও বাঙালি মানেই খিচুড়ি পাঁপড়। তবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রন্ধন পটীয়সীরা বলেছেন “দই দিয়ে খিচুড়ি খাইতে মন্দ লাগে না। মনসামঙ্গল কাব্যে স্বয়ং শিব যে খাবারটি খাবার আবদার পার্বতীর কাছে জানিয়েছিলেন, তা হল খিচুড়ি।

গ্রীক দূত সেলুকাস উল্লেখ করেছেন ভারতীয় উপমহাদেশে চালের সাথে ডাল মেশানো খাবার খুবই জনপ্রিয় ছিলো। মরোক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা কিশরির কথা উল্লেখ করেছেন যা চাল এবং মুগ ডাল দিয়ে প্রস্তুত করা হতো। ১৫ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘুরতে আসা রাশিয়ান পর্যটক আফনাসিই নিকতিন খিচুড়ির কথা তার লেখায় বর্ণনা করেছেন। চাণক্যের লেখায় মৌর্যযুগের চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে চাল, ডালের মিশ্রণে তৈরি খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের লেখাতেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজসভার রান্নাঘরে খিচুড়ির কথা পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতকে ফরাসি পরিব্রাজক তাভেরনিয়ের লিখেছেন, সে সময় ভারতের প্রায় সব বাড়িতেই খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আকবরের মন্ত্রী ও ঐতিহাসিক আবুল ফজল রাজকীয় রান্নাঘরে বিভিন্ন ধরনের খিচু়ড়ি রান্নার কথা লিখেছেন। আইন-ই-আকবরিতে বিভিন্ন প্রকার খিচুড়ির প্রস্তুতপ্রণালী পাওয়া যায়। সেখানে আকবর এবং বীরবলের খিচুরি রান্নার একটি গল্প উল্লেখ করা হয়েছে। মুঘল রান্নাঘরে জাহাঙ্গীরের প্রিয় বিশেষ ধরনের খিচু়ড়ি তৈরি করা হতো পেস্তা, কিসমিস দিয়ে। সেই খিচুড়িকে জাহাঙ্গীর নাম দিয়েছিলেন ‘লাজিজান’। সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রিয় ‘আলমগিরি খিচড়ি’র কথাও জানা যায়। এই খিচড়িতে চাল, ডালের সঙ্গে মেশানো হত বিভিন্ন প্রকার মাছ ও ডিম।  

রাজকীয় খাবার হিসেবে হায়দরাবাদের নিজামের রান্নাঘরেও খিচুড়ি জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই খিচুড়ির ভাঁজে ভাজে থাকতো সুস্বাদু মাংসের কিমা। ১৯ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগে দেশে ফেরত ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের হাত ধরে তা ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। এই খিচুড়ি জনপ্রিয় ইংলিশ ব্রেকফাস্ট ‘কেদেগিরি` হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকের মধ্যভাগে নিম্নবিত্ত মিশরীয়দের মধ্যে কুশারি নামে যে রান্নাটি জনপ্রিয় হয় তা খিচুড়িরই ভিন্নরূপ বলা যেতে পারে। এটি তৈরি হতো তুলশীমালা চাল, ডাল, চানা, ভিনিগার, টমেটো সস, পিঁয়াজ, আদা, রসুন ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে। পরে এই রান্নাটি তাদের সৈন্যশিবিরেও স্থান পায়।  

কোন দেশের মানুষের আচরণ কী হবে তা নির্ভর করে তাঁর পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির উপর। যেমন জাপানের রাজা যদি কোন নির্দেশ বা অনুরোধ করে তাহ তা জাপানের প্রায় সব জনগণ তা মেনে চলেন। একই ভাবে মেনে চলে ইংল্যান্ডের জনগণ। এটা তাঁদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি। একইভাবে তাঁদের পারিবারিক বা সামাজিক সংস্কৃতি উন্নত বলেই তাঁদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি এতো উন্নত। স্কুলে মিড ডে মিল দেওয়ার সময় বাংলাদেশের স্কুলের ছেলে মেয়েরা কী ধরণের আচরণ করে তাঁর উপর গত ১০ বছর স্কুলের শিক্ষক, স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য, প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের অফিসার-কর্মীরা জেনে গেছেন, তারা দক্ষতাও অর্জন করেছে। উনারা বিদেশে খিচুড়ি তৈরি বা তাঁর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কী শিখবেন? ১০ সন্তানের বাবা বা দাদার কী সন্তান বা নাতিদের কাছে সংসার চালানো আর সন্তানের জন্ম দান, মানুষ করা, ইত্যাদি নিয়ে কোন শিক্ষা নেওয়ার দরকার আছে? সরকারী কর্মকর্তাদের যে ব্যাখ্যা এখন দিচ্ছেন, তা গা বাঁচানো একটা জগা খিচুড়ি উত্তর বলে দেশের সাধারণ মানুষ মনে করছেন।           



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭