ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

সার্ক নয় ভারতের আগ্রহ বিমসটেকে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 26/09/2020


Thumbnail

 

কাশ্মির ইস্যু সার্কের প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। এই  সমস্যা ছাড়াও নদীর পানি বন্টন, সন্ত্রাসবাদ দমন কিংবা মাদকের মতো দক্ষিণ এশীয় সমস্যা সমাধানে সার্ক ছিলো অভিন্ন প্লাটফর্ম। দুঃখজনক হলেও সত্যি সার্ক ও পাকিস্তানকে একাকার করে ফেলেছে ভারত। মূলত, ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় বিরোধের জেরে  ক্রসফায়ারে পড়ে সার্ক এখন মৃত্যুপথযাত্রী। পাঁচ বছর হলো এই জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের একসঙ্গে কারো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। আপাতত সেই সম্ভাবনাও নেই। অথচ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একসঙ্গে বসার প্রয়োজনীয়তা এখন সবচেয়ে বেশি।

ভারত চাইছে সার্কের মৃতদেহের ওপর বিমসটেক সক্রিয় হয়ে উঠুক। কারণ,মোদি প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে সার্কভুক্ত দেশগুলোয় গাড়ি চলাচলের যে প্রস্তাব দেন, পাকিস্তান তাতে শীতল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। সার্ক স্যাটেলাইট বিষয়েও তাদের আগ্রহ কম ছিল।

একই সময়ে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডোর গড়তে শুরু করে। ভারত এই পরিস্থিতির উত্তর দেয় ১৯তম সার্ক সম্মেলন বন্ধ করিয়ে, যা ২০১৬ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানে হওয়ার কথা ছিল। পাকিস্তানকে সার্কের চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে অনিচ্ছুক ভারত, যার জন্য বিমসটেককে পুনরুজ্জীবিত করে তারা।

নয়াদিল্লী অবশ্য প্রকাশ্যে বলছে, সার্ক জোট হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে একদম সফল ছিল না। প্রায় তিন দশক একসঙ্গে পথচলার পরও সদস্যদেশগুলো পারস্পরিক অর্থনীতির ১০ ভাগও সমন্বিত করতে পারেনি। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেও সেটা করা যায়নি। বিমসটেক দিয়ে ভারত সেটাই করতে চায়। কিন্তু সার্কের যেকোনো ব্যর্থতার দায় যে বড় সদস্য দেশের ঘাড়েই বর্তায়, সেটা ভারতীয় কূটনীতিবিদেরা স্বীকার করতে অনিচ্ছুক।

এবার লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহারে খোলাখুলি ভাবে বলেছে বিমসটেককে নিয়েই এগোবে ভারত।

২০১৬ সালে পাকিস্তানে সার্কের যে সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, তাও ভারত সরকারের বিরোধিতায় হয়নি।

বিমসটেক বলতে বোঝানো হচ্ছে Bay of Bengal Initiative for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation। ভুটান ও নেপাল মোটেই বঙ্গোপসাগর–লাগোয়া দেশ নয়। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে তাদের কোনো কাজকারবারই নেই। মূলত, ভারতের চাপে বা অনুরোধেই যে তারা এই জোটভুক্ত হয়েছে, সেটা অনুমান করা যায়।

সার্ককে নিষ্ক্রিয় করে বিমসটেককে শক্তি জুগিয়ে ভারত মূলত দুটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছে। প্রথমত, আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে একঘরে করা—সার্কে থাকলেও বিমসটেকে তাদের নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, সার্ক ফোরামে নদীর পানি থেকে সীমান্ত বিরোধ পর্যন্ত আঞ্চলিক প্রায় সব বিষয়ে আলাপ-আলোচনার যে পরিসর ছিল তা বন্ধ করা। ভারতের সঙ্গে পানির হিস্যা ও বাণিজ্যিক ভারসাম্য স্থাপনের বিষয়ে যৌক্তিক আঞ্চলিক নীতিকৌশলের পক্ষে প্রকাশ্যে বলা যেত সার্কে। কিন্তু বিমসটেকে সে সুযোগ নেই।

বিমসটেককে ভারত গড়ে তুলতে চায় কেবল বাণিজ্যিক জোট হিসেবে। সেখানে পাকিস্তান না থাকায় কোনো বিষয়ে ভারতের অবস্থানের বিরোধিতার মতো দেশও থাকছে না। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় চীনের উদীয়মান আধিপত্য মোকাবিলাতে তার নেতৃত্বাধীন বিমসটেক কাজে লাগবে বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। তবে এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো ভারত ও ভুটান ছাড়া বিমসটেকের অপর পাঁচটি দেশ ইতিমধ্যে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরই) যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
সার্কের শুকিয়ে মরা বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়। কারণ বিশ্বে ঢাকার বড় কূটনৈতিক সফলতার স্মারক ছিল সার্ক। বাংলাদেশই এই জোটধারণার প্রস্তাবক। এর প্রতিষ্ঠায় প্রচুর খেটেছেও বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে ঢাকাতেই সার্ক এর যাত্রা।

নেপালের জন্যও সার্কের অপমৃত্যু বেদনাদায়ক। কাঠমান্ডুতে রয়েছে এই জোটের সচিবালয়। জোটের বর্তমান চেয়ারম্যানও তারা। তবে ভারত যখন সার্ককে ক্রমে নিষ্ক্রিয় করে ফেলছে, বাংলাদেশ তাতে জোরালো কোনো আপত্তি তোলেনি। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের কূটনীতিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ এক অবস্থানবদল। তবে নেপালের নেতৃবৃন্দ প্রায়ই সার্কের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন; বিশেষত নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তবে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের নতুন অবস্থানের পর নেপালও সার্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকখানি হতাশ।

অতীতে সার্ক কাশ্মীর কিংবা আন্তঃনদীগুলোর পানির হিস্যার মতো আঞ্চলিক জরুরি কোন বিবাদে ভূমিকা রাখতে পারেনি।  তাই সাধারণ মানুষদের আগ্রহ হারিয়েছে জোটটি। তেমনি রোহিঙ্গা বিবাদের কোনো মীমাংসা করতে না পারলে বাংলাদেশ-মিয়ানমারও বিমসটেকভুক্ত হয়ে কাছাকাছি আসতে পারবে না। বাংলাদেশের তরফ থেকে বিমসটেকের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের ইতিবাচক মনোভাবের ওপর। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার শুরুতেই ভারতের সমর্থন যায় মিয়ানমারের দিকে। বিমসটেক এ ক্ষেত্রে ঢাকার পক্ষে কোনো ভূমিকা দেখাতে পারেনি।
ভারত যদি সার্ক সচিবালয় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে, সেটা হতে পারে সার্কের মৃত্যু ঘোষণার সামিল।

সার্কের মৃত্যু ঘটিয়ে বিমসটেককে প্রাণবন্ত করার চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ আছে। এর বড় কারণ, বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বন্ধন সামান্যই। অথচ সমধর্মী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ধারণ করত সার্কভুক্ত দেশগুলো।

সেই ক্ষেত্রে বিমসটেককে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে শক্তিশালী জোট হিসেবে গড়ে তুলতে ভারতকে সদস্য দেশগুলোর স্বার্থ সংশ্লিস্ট বিষয়গুলো দেখভালের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও কূটনীতিক দুতিয়ালীও বাড়াতে হবে। 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭