ইনসাইড টক

শিল্পীরা শুধু নেয় না, শিল্পীরা দিতেও জানে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 08/01/2021


Thumbnail

একসময় টেলিভিশন পর্দায় বেশ নিয়মিত ছিলেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি উপস্থাপনা ও নাচেও ছিল তার জয় করা প্রতিভা। বর্তমানে পর্দায় সামনে খুব একটা দেখা না মিললেও পর্দার পেছনে ঠিকই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বলছি দর্শক প্রিয় মুনা চৌধুরীর কথা। ৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে জীবনের নানা জানা- অজানা বিষয় নিয়ে আলাপ করেন তিনি। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডারের প্রতিবেদক মেহেরুবা শহীদ।

বাংলা ইনসাইডার: ছোটবেলা থেকেই মিডিয়াতে কাজ করছেন। দীর্ঘ সময়ের সেই সব গল্পগুলো নতুন করে শুনতে চাই।

মুনা চৌধুরী: নৃত্যশিল্পী ছিলাম আমি। ছোটবেলায় নাচ শিখেছি। ভরতনাট্যম শিখেছি শুকলা সরকারের কাছে। সেই সঙ্গে গান করতাম, অভিনয় করতাম।বয়স যখন ৯/১০ বছর তখন আমি একদম রেগুলার বিটিভিতে নাচের প্রোগ্রাম করতাম, গানের প্রোগ্রাম এবং ছোট ছোট নাটিকা করতাম। অনেকগুলো TVC ও করেছি ।হানিফসংকেতের ইত্যাদিতে আমার প্রোগ্রাম ছিল নিয়মিত। বিটিভিতে অনেকগুলো নাটক করেছি। চ্যানেল প্রোগ্রাম উপস্থাপনা করতাম। এভাবেই আসলে আমার মিডিয়াতে কাজ করা। আমার বিয়ে আগ পর্যন্ত একটানা প্রায় ১০/১২ বছর মিডিয়াতেই  কাজ করেছি। একই সঙ্গে পড়াশুনাও করেছি। ২০০২ সালে ডিরেক্টর কমল চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। আমার হাসব্যান্ড এর ডিরেকসনেও বেশকিছু কাজ আমার করা হয়েছে।কিন্তু বিয়ের পর সন্তানদের নিয়ে ব্যবস্ততা আমার বেড়ে যায়।তবে হ্যাঁ আমি কাজ করেছি। ফিল্ম ফটোগ্রাফি করেছি। একটা সময়ে আমার মনে হলো আমি প্রডিউস করবো। তখন আমার কাছে মনে হল এটি একটি বিশাল সম্মানের জায়গা।  তখন মনে হলো টুকটাক কাজগুলো আর করবো না। তো রেগুলার যে উপস্থাপনাগুলো করতাম সেগুলো বন্ধ করে দিয়ে আমি প্রায় ৮৪ টা নাটক প্রডিউস করি। তার মধ্যে ছিলো ধারাবাহিক, ১ পর্ব, এক ঘন্টার নাটক। বিশেষদিনগুলো যেমন মাদার্স ডে, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, ঈদের ৭ পর্বের এরকম বিশেষ নাটকগুলো।  

বাংলা ইনসাইডার: একঝাঁক শিল্পীদের সমন্বয়ে গঠিত ইয়ুথ বাংলা কালচারাল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত আপনি। এই ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য কী।

মুনা চৌধুরী: আমাদের ‘ইয়ুথ বাংলা কালচারাল ফাউন্ডেশন’(YBCF) বরাবরই বাংলাদেশের ঐতিহ্য , সংস্কৃতি ও মানুষের জন্য কাজ করে আসছে। সুস্হ সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গঠনে জোড়ালো ভূমিকা রাখতে চায় ইয়ুথ বাংলা কালচারাল ফাউন্ডেশন । ফাউন্ডেশনটির সঙ্গে রয়েছেন বাংলাদেশের বিক্ষাত সব শিল্পীরা।আমাদের দেশে অনেকই মনে করেন যে, সংস্কৃতিকর্মীরা মানুষের কাছে হাত পাতে, শেষ বয়সে এসে অনুদান নিয়ে চিকিৎসা করায়। তো আমরা ফাউন্ডেশনের শিল্পীরা এটা বিশ্বাস করি না। আমরা বলতে চাই, শিল্পীরাও মানুষের পাশে থাকে, মানুষের সাথে থেকে মানুষকে সহযোগিতা করে এবং শিল্পীরাও দুস্থ রোগীদের কে সহযোগিতা করে। শিল্পীরা শুধু নেয় না, শিল্পীরা দিতেও জানে। আর  এই জিনিসটাই আমরা ইয়ুথ বাংলা কালচারাল ফাউন্ডেশন বিশ্বাস করি।

বাংলা ইনসাইডার: সম্প্রতি শুনেছি দুইজন চাষীকে গরু কেনার টাকা দিয়েছে ফাউন্ডেশনটি। ফাউন্ডেশনটি আসলে কিভাবে কাজ করে এবং তার স্বপ্ন কী? এই উদ্যোগে দুঃস্থদের কিভাবে খুঁজে বের করছেন? সেই সঙ্গে জানতে চাইবো এই ফাউন্ডেশনের স্বপ্ন কতদূর এবং এর ফলাফল নিয়ে কতদূর ভাবছেন।

মুনা চৌধুরী:  ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আনুষ্ঠানিকভাবে এ ফাউন্ডেশনটির লোগো উন্মোচন করে দিয়েছেন । সেই থেকে ফোরাম হিসেবে ফাউন্ডেশনটির যাত্রা শুরু হয়েছিলো। আমরা একেবারেই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে এমন সব গরিব-দুঃখীদের খুঁজে বের করি যারা আসলেই গরিব ও অসহায়। যার আসলেই সত্যিকার অর্থে একটি গরুর প্রয়োজন ।যে কিনা স্বাবলম্বী হতে চায়। সেইসঙ্গে আমরা ভাল মানুষকে খুঁজে বের করছি। ২০১৭ সালে আমারা রংপুরে বন্যার্তদের সাহায্য করেছি। আমাদের ফাউন্ডেশনের শিল্পী ও ছেলেমেয়েরা হাঁটু পানিতে নেমে ত্রান বিতরন করেছে। প্রতি বছর শীতে আমরা কম্বল বিতরণ করি। এ বছরও বিতরণ করা শুরু করেছি এবং এ কর্মসূচী আমাদের অব্যহত থাকবে।আমরা কুষ্টিয়াতে সেলাই মেশিন কেনার সামর্থ্য নাই কিন্তু তিনি খুব ভালো সেলাই জানেন। সে ক্ষেত্রে তিনি একটি সেলাই মেশিন পেলে স্বাবলম্বী হতে পারেন। এ রকম নারীদের খুঁজে বের করে আমরা সে খানকার নারীদের আটটি সেলাই মেশিন দিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ, গত দুই বছর ধরে শুনছি যে যে তারা একেবারেই স্বাবলম্বী হয়ে গিয়েছেন। তারা ৪০ টাকা থেকে  ১০০ টাকা ২০০ টাকা করে সেলাইয়ের মজুরি নিয়ে প্রতিদিন জামা কাপড় সেলাই করে একেবারেই সুন্দরভাবে খেয়ে-পড়ে সন্তান মানুষ করতে পারছেন।  এরকমই অনেক কাজই আমরা করছি।  শুধু যে এটা না, বিউটি ধর্ষনের সময় আমরা YBCF এর সকল মেম্বার পথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম । সংস্কৃতিতে অসামান্য ভূমিকা রাখার জন্যে ২০১৮ সালের ১০ই জানুয়ারী আমরা রাষ্ট্রপতির হাত থেকে ক্রেস্ট পাই।এন্ড্রুকিশোর দা যখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন তখন ও আমরা YBCF তার পাশে ছিলাম, এবার প্যানডেমিকে YBCF এর প্রত্যেকটি মেম্বার চাল, ডাল, তেল, মশলা, কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে মাস্ক ও স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে কতবার যে দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। আমাদের এই ফাউন্ডেশনটি মোট ২৭ টি দেশে আছে। YBCF এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক সীমা হামিদ এর নেতৃত্বে আমরা সবাই একত্রে কাজ করে যাচ্ছি। UAE(সংযুক্ত আরব আমিরাত) থেকে সাত দিন করে মোট ৮ বার প্রতিদিন ১৮০ জন মানুষের বাসায় খাবার পাঠানো হয়েছে।

বাংলা ইনসাইডার: মিডিয়াতে নতুন প্রজন্মের অনেকেই আছেন, দেশের তরুণ শিল্পীরা কি আপানাদের দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারেন কিনা?  

মুনা চৌধুরী:  নতুন প্রজন্ম যারা নতুন মিডিয়াতে এসেছে তারা আসলে কতটুকু শৈল্পিক মনের বা মিডিয়াকে সম্মান রেখে তা আসে তা আমি ঠিক বলতে পারবো না। তবে নতুনদের মধ্যে অনেকই বেশ ভালো ভালো কাজ করছেন। ১/২  বছর কাজ করে অ্যাওয়ার্ডও পাচ্ছেন। তো তারা যদি অনুপ্রাণিত হন সে ক্ষেত্রে আমি তাদের সমর্থন করি। মিডিয়াতে ২/৩ বছর ধরে কাজ করছেন এমন নতুন অনেকেই ফাউন্ডেশনটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। তারাও কিন্তু বেশ ভালো ভালো করছে। আমাদের সাথে মিশছে। আমাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তারাও আমাদের কাজ কে সমর্থন করছে, এপ্রিশিয়েট করছে এবং তারাও আগ্রহী হচ্ছে। আমরা আমাদের নিজেদের অর্থায়নেই কাজ করছি।আমরা সবাই একটি পরিবার।

বাংলা ইনসাইডার: যেহেতু আমাদের দেশে নারীদের এখনও অনেক প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হন তাই এখনও পর্যন্ত দেশে নারী প্রডিউসারের সংখ্যা একদমই নগণ্য। এমনকি এন্টারপ্রেনার হিসেবেও খুব কম সংখ্যক নারীরা জড়িত আছেন। তো নারীরা যেন লড়াইকরে নিজেদে জায়গা নিজেরাই করে নিতে পারে এ ব্যপারে আপনার কাছে থেকে কি কোনো অনুপ্রেরণা থাকতে পারে কিনা?  

মুনা চৌধুরী:  আমি চাই প্রত্যেকটা নারীই নিজ নিজ যোগ্যতা তুলে ধরে কাজ করুক। আমি কিছুদিনএকটা জব করেছি।পরবর্তিতে জবটা ছেড়ে নিজেই উদোক্তা হয়ে গেলাম। পড়াশোনার সাবজেক্ট ছিল ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে থাকার কারনে আমার বাড়ির উপরে বড় আকারে একটা কারখানা তৈরি করি। সে কারখানা থেকেই আমি আমার বুটিক শুরু করি “Color Touch”তো দশ বছর বুটিক নিয়ে করেছি।  আমার বনানীতে দোকান ছিল, উত্তরা দোকান ছিল, পিঙ্ক সিটিতে দুইটি দোকানে দোকানে কাপড় দিতাম। এমনকি নিউ ইয়র্কেও কাপড় পাঠাতাম। এভাবেই বেশ বড় করে বিজনেস শুরু করি। ২০০৫ এ শুরু করা সেই বিজনেস ২০১৫ তে শেষ করি কারণ তখন আমার ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে গেছে তাই তাদের সময় দিতে হতো। তো যখন বিজনেস ছিল তখন আমরা একটা মেলা করতাম। সেই মেলাতে আমাকে অনেক স্ট্রাগল করতে হতো। তো দেখা যেত যারা ছেলে ব্যবসায়ী ছিলেন তারা দুম করে এসে টাকা-পয়সার দিয়ে গাউছিয়া থেকে কাপড় নিয়ে এসে দুম করে স্টল নিয়ে ফেলতে। অন্যদিকে আমরা নারীরা নিজেরা কাপড়ের ডিজাইন করতাম, কষ্ট করে কারখানায় কাপড় বানাতাম। আমি যখন ২৯ জন কর্মী দিয়ে  একটি বুটিক হাউজ চালাতাম। তখন মনে হত কষ্ট করে মহিলার কাপড় বানাচ্ছি অথচ তারা অর্থাৎ ছেলেরা পাকিস্তান বা ইন্ডিয়া থেকে কাপড় নিয়ে আসছেন বিক্রি করছে। এতে করে রেডিমেট কাপড় নিয়ে আসায় তারা ৫০০ টাকা প্রফিট করলেও মাসে তাদের ৫ হাজার টাকা হলেও লাভ হচ্ছে। ফলে তাদের ব্যবসায় লাভও হয় বেশি । অন্যদিকে দেখা যেত আমি একজন মহিলা মানুষ, আমি একাই ফরম ফিলাপ করি, টাকা জমা দেই, সব করি। একদিকে ব্যবসা সামলানো, অন্যদিকে বাচ্চা সামলানো। অনেক ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে। আমী উদ্যোক্তা হোটে গিয়ে চিন্তা করলাম নারীদের নিয়ে কাজ করব। টাডেড় জোণয় একটা প্ল্যাটফর্মের চিন্তা করলাম। দেখা গেল যারা মধু সংগ্রহ করছেন, খেজুরের গুড় বের করছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কেউ ফুল বিক্রি করছে  তারা অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আমিও তাদের সাথে যোগাযোগ করে খোঁজ খবর নিয়ে সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। তাদের নিয়ে প্রোগ্রাম করছি। এমনো হয়েছে যে আমার প্রোগ্রামের ভিউ ২০/২২-কে হয়ে যাচ্ছে। এইত সেদিন সিরাজগঞ্জে থেকে এক ভদ্রলোক ফোন করে বলেছে, “আপনার এখানে ইন্টারভিউ দিয়ে ম্যাডাম মনে হচ্ছে আমার খুব বেশি বিক্রি হচ্ছে।” এই যে তাকে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দিলাম এই জিনিসটাই  আমাদের ফাউন্ডেশন ব্যানারে আমি নিয়েছি। আমি নারীদের বলতে চাই আপনারা বসে থাকবেন না। যতটুকুই পারেন তা হোক রান্না কিংবা পার্লার। নিজে নিকু একটা হলেও করুন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭