ইনসাইড থট

ভ্যাকসিন জটিলতায় কেন এখনও চলমান ভ্যাকসিনের প্রতি সবার আস্থা রাখা উচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/04/2021


Thumbnail

গতরাতে আমি বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ দেখছিলাম এমন এক ব্রাজিলের যুবতী মায়ের অত্যন্ত দুঃখের গল্প যার এক বছরের বাচ্চা কোভিড-১৯ এ মারা গেল। তিনি বলেছিলেন, ছেলেটির নাক দিয়ে পানি এবং উচ্চ তাপমাত্রা শুরু হবার কারণে তিনি তার ছেলেকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান এবং তাদেরকে কোভিড -১৯ পরীক্ষা করার জন্য বার বার অনুরোধ করেছিলেন। কোভিড-১৯ এর কোনও পরীক্ষা না করেই চিকিৎসক তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন আর কিছু লক্ষণ প্রতিকারমূলক ঔষধ দিয়ে বাসায় পাঠান। বাসায় ছেলেটি যখন শ্বাসকষ্টে তীব্র অসুবিধাগুলি বোধ করতে শুরু করেছিল, তখন সে আবার ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এবার, ডাক্তাররা তাঁর অনুরোধ শুনেছিল এবং একটি কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে এবং তা ইতিবাচক বলে প্রমাণিত হয়। তবে অনেক দেরি হয়ে যাবার কারণে, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পাবার কারণে ছেলেটি মারা যায়। এখন ব্রাজিলে প্রতিদিন আনেক শিশু কোভিড-১৯ এ মারা যাচ্ছে।

যখন ভারতে প্রতিদিনের নতুন করোনা ভাইরাস রোগীর সংবাদ বিশ্বে সর্বোচ্চ, ঠিক সে সময় আমরা হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভক্তদের দেখছি, নদীতে পবিত্র ডুব বা অনুষ্টানিক স্নানের জন্য গঙ্গায় গাদাগাদী করে জড়ো হয়েছে। ১০ কোটি (একশ মিলিয়ন) উদযাপনকারীদের জন্য - শুধু মাএ এপ্রিল ১২, ১৪ এবং ২১শের সবচেয়ে শুভ দিনগুলিতে প্রতিদিন ৫০ লাখেরও বেশি লোকের সমাবেশ প্রত্যাশিত করা হচ্ছে। কারো কোনও সামাজিক দূরত্ব বা কোনও মুখোশ নেই। কর্তৃপক্ষরা মানুষকে ক্রমাগত কোভিড-১৯ রোধে যথাযথ আচরণ অনুসরণ করার জন্য আবেদন করছে। তবে প্রচুর ভিড়ের কারণে এটি ব্যবহারিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। ঐ সমাবেশের মধ্যে অনেকের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং কয়েক হাজার ইতিবাচক বলে পাওয়া যায়। তারাও কোন যথাযত আচরণ পালন করছে না। আজ ভারত সারাদেশে দিনে ১২ লাখেরও বেশি পরীক্ষা চালাচ্ছে এবং আশ্চর্যের কিছু নেই কেন গতকাল সারাদেশ ২১৬,০০০ এরও বেশি লোককে (১৮% ইতিবাচকতা) ইতিবাচক পাওয়া গেছে। সাথে সাথে প্রতিদিনের মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বাড়ছে।

থাইল্যান্ডে প্রতিদিন রিপোর্ট অনুযায়ে নতুন কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যাটি দেখায় যে এপ্রিলের ১ লা এপ্রিলের মাত্র ২৬ জন আক্রান্ত লোক ছিল যা খুব দ্রুত বেড়ে ১৫ই এপ্রিলে এসে দাঁড়ায় ১৫৩৩ জনে। তাদের বেশিরভাগ যুক্তরাজ্য রূপের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত যা সেখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। শনাক্ত করা এই রুপটি থাইল্যান্ডে পূর্বের তুলনায় আরও সহজেই সংক্রামিত হওয়ায় কারণেই অনেক লোক সংক্রামিত হচ্ছে। বর্তমান প্রকোপটি তরুণ বয়সের লোকদেরও প্রভাবিত করছে যাদের কিছু লক্ষণ থাকতে পারে বা তেমন কোনও লক্ষণও নেই, যারা সবচেয়ে গতিশীল, সেই কারণে এটি নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন করে তুলেছে। এমন কিছু প্রমাণও রয়েছে যে এই রুপটি আরও মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে। সুতরাং কর্তৃপক্ষ তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে যেন জনগন অপরিহার্য ভাবে প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলি প্রয়োগ করার জন্য সর্বদা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় যেমন প্রত্যেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া এবং মুখ স্পর্শ করা এড়ানো, বাহিরে এবং জনাকীর্ণ স্থানে মুখোশ পরা এবং শুধুমাত্র একটি ভাঁজ করা কনুইতে কাশি করে শ্বাস-প্রশ্বাসের শিষ্টাচার মেনে চলা।

৮ই মার্চ থেকে বাংলাদেশে প্রতিদিনের কোভিড-১৯ এর ইতিবাচকের সংখ্যা ৮৪৫ জন ছিল। তারপর লাফিয়ে সংক্রমণের হারের ফলন ২.৬% থেকে ২ এপ্রিল ২৩% এরও বেশি বেড়েছে। এপ্রিলে দৈনিক রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬২৬ জনে, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রতিদিনের সংখ্যক ইতিবাচক কোভিড রোগীর সংখ্যা। আরও বেশি লোক পরীক্ষার জন্য আসতে শুরু করায় পরীক্ষার সংখ্যাও বেড়ে যায়। গত দুই সপ্তাহে প্রায় ১০০,০০০ নতুন কোভিড রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। তবে, যারা পুনরুদ্ধার করেছেন তাদের প্রতিদিনের সংখ্যা আজ সংক্রামিত সংখ্যার চেয়ে বেশি। আজ ১৬ এপ্রিল ৪৪১৭ নতুন রোগীর শনাক্ত করা হয়েছে এবং ৫১৯৮ জন সংক্রামিত মানুষ পুনরুদ্ধার করেছেন এবং ১১১ জন মৃত্যু বরণ করেছেন, যা এখন পর্যন্ত একদিনের সর্বোচ্চ সংখ্যার মৃত্যু। সার্বিক মৃত্যুর হার এখনও ১.৪-১.৫% এর মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। মোট রোগীর সংখ্যা (কতজন ইতিবাচক বিয়োগ নম্বর পুনরুদ্ধার করেছে এবং মারা গেছে) ২০ই আগস্ট ছিল ১১৫,৭৭৯ জন আর তা ১৭ই মার্চে ছিল ৩৮১৫৫জন এবং বেড়ে ১৫ই এপ্রিলে হয়েছে ১০০,০৬৫ জনে। তবে আইইডিসিআর অনুসারে বাংলাদেশের পক্ষে আরও বেশি বেদনা হচ্ছে, এখন বুধবার অবধি এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশের বেশি ২১-৪০ বয়সের লোক ছিলেন। রোগীদের ২৭.৬ শতাংশ ২১-৩০ বছর বয়সী এবং ২৭.১ শতাংশ ৩১-৪০ বছর বয়সী। এরা আমাদের তরুণ সক্রিয় জন গোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের এই জনসংখ্যার গোষ্ঠী অতি প্রয়োজন। এটি দেখা গেছে যে যুক্তরাজ্যের বৈকল্পিকতা ছড়িয়ে পড়ার পরে বেশিরভাগ দক্ষিণ আফ্রিকার রূপের আরও সংক্রামক এবং মারাত্মক কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।

একদিকে আমরা বিশ্বজুড়ে যে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি যে লোকেরা মাসের পর মাসে লকডাউন, সীমাবদ্ধ চলাচলের এবং সামাজিকীকরণের অনুমতি না পাওয়ার কারনে বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারা আনেকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে, কোন সীমাবদ্ধতা আর মানতে পারছে না বা অনুসরন করছে না। লোকেরা স্বাস্থ্য পরামর্শ অনুসরণ করেছে না। অনেক সংখ্যক লোক মুখোশ না পরে, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখে ঘোরাফিরা করছে। ভারত ও বাংলাদেশে আমরা দেখলাম যে কীভাবে হাজার হাজার মানুষ ধর্মীয় উত্সব পালন করতে জড়ো হয়, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় জনসমাবেশে যোগ দেয়। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া বাড়ছেই। মুখোশ, কোনও সামাজিক দূরত্ব নেই বললেই চলে। সংক্রমণ আরও প্রসারিত হলে তা ভ্যারাস রূপান্তরকে আরও বাড়িয়ে তুলবে, নতুন এবং মারাত্মক রূপগুলি উদ্ভূত হবে এবং যদি আমরা সংক্রমণ বন্ধ না করতে পারি তবে তার উত্থান অবিরত থাকবে। এই অবস্তা চলতে থাকলে আমরা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে পারব না। এই অবস্তা বিবেচনা করে আমাদের ভাবতে হবে কোন কৌশলটি সবচেয়ে কার্যকর ভাবে এই মহামারী মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।

অন্যদিকে আমরা কোভিড-১৯ বিরুদ্ধে ইস্রায়েল, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক ইউরোপীয় দেশগুলির প্রচুর এবং সফল টিকা দেওয়ার কারণে দেখতে পাচ্ছি, সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক আচ্ছাদন শিথিল করছে। সোমবার থেকে সুইজারল্যান্ডও জিম খুলবে। এই বছর কঠোর ভাবে কয়েকটি স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে দোকানগুলিও সবসময় খোলা ছিল।

তাহলে শুধু দ্রুত টিকা দেওয়া কি একমাএ সঠিক উত্তর? অথবা যেহেতু ভ্যাকসিন সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করবে না তাই আমাদের একটি একত্রিত (ভবিষ্যতে কিছু সময়ের জন্য টিকাদানের পাশাপাশি স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণকে বজায় রাখা) কৌশল গ্রহণের প্রয়োজন হবে? আগামী বছরগুলিতে আমাদের জীবনযাত্রাকে অন্যরকমভাবে পরিবর্তন করে চলতে হবে। এটাই হয়ত জীবনের নতুন বাস্তবতা।

ভ্যাকসিন জাতীয়তার কারণে, বেশিরভাগ ভ্যাকসিনগুলি ধনী দেশগুলি অধিগ্রহণ করে ধরে রেখেছে। কেউ ভাবছে না যে আমরা একটি গ্লোবাল গ্রামে থাকি, তাই বিশ্বের সবাই যদি নিরাপদে না থাকে তবে কেউই নিরাপদ নয়। ভ্যাকসিন ছাড়াই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এবং নতুন মারাত্মক রূপগুলি বর্তমান ভ্যাকসিনগুলিকে কম কার্যকর করে তুলবে এবং আমাদের পুনরায় বার বার টিকা দেওয়ার দরকার পড়তে পারে।

আমি মনে করি জনগণকে এখনও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলি অনুসরণ করতে উত্সাহিত করার পাশাপাশি, কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যেমন কোনও বৈধ কারণ ছাড়াই বাইরে না যাওয়া, বাইরে বেরোনোর সময় মাস্কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘন ঘন হাত ধোয়া ইত্যাদি। একই সাথে আমাদের অবশ্যই দ্রুত মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই সমস্ত দরজার কড়া নাড়াতে হবে।

এটি কোনও অলৌকিক ঘটনার কম ছিল না যখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিজ্ঞানীরা কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে এক বছরেরও কম সময়ে বেশ কয়েকটি কার্যকর টিকা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দ:খের বিযয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটিশ ওষুধ নিয়ন্ত্রকদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র কাছ থেকে গত সপ্তাহে ঘোষণা করা হল অ্যাস্ট্রাজেনেকার আর জনসন ও জনসন এবং বিরল রক্তের জমাটগুলির মধ্যে সংযোগ হতে পারে বলে তারা সন্ধান করছে। এটি অনেকের মধ্যে সন্দেহ এবং ভ্যাকসিন দ্বিধা তৈরি করছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ যারা বেশিরভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় দেশগুলি বা ভারত বা রাশিয়া বা চীন থেকে ভ্যাকসিনের উপর নির্ভরশীল তাদের জন্য কী বিকল্প রয়েছে?

যেখানে কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জাতীয় পরিকল্পনাকারি নেতাদের যাতে লোকেরা নিজের এবং অন্যদের সুরক্ষার জন্য কী করতে পারে সে সম্পর্কে শওিশালী বার্তার দেওয়া উচিত ছিল, তার বিপরিতে আপেক্ষিক অনুপস্থিতি বা শূন্যতায় কিছু রাজনীতিবিদ এবং পন্ডিত বিদ্যমান ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। কিছু "শক্তিশালী ব্যক্তিবাদী" মতাদর্শের লোকেরা নিজেদেরকে ভুল করে ভাবছে যে তাদের এই নুতন কর্ণাভাইরাসকে মোকাবেলায় অতিরিক্ত অনাক্রম্যতা রয়েছে এবং তার কারনে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক গর্বের বিষয় বলে মনে করছে।

বাংলাদেশ সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোর তাদের জন্য কী বিকল্প রয়েছে, তা বলার আগে আসুন প্রথমে বিজ্ঞানের দিকে নজর দেই।

১. অস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন কমপক্ষে ১১৫ টি দেশে কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার জন মোতায়েন করা হয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বেশ কয়েকটি মাস ধরে ভ্যাকসিন দেওয়া চলছে। তবে এটি গত মাসে বা তার মধ্যেই যখন দেখা গেল যে, এক বিরল রক্ত জমাট বেধে যাওয়ার, কয়েকটি ক্ষেত্রে - কিছু মারাত্মক - এমন ঘটনা ঘটেছিল যে অনেক ইউরোপীয় জাতি সকল বয়সের মধ্যে এর ব্যবহার সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা শুরু করে।

২. এপ্রিল ৪ অবধি, ইউরোপীয় নিয়ামকরা ব্রিটেন এবং ৩০ দেশীয় ইউরোপীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিরল রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যার ২২২টির খবর পেয়েছিলেন। তারা বলেছিল যে প্রায় ৩৪ মিলিয়ন (তিন কোটি ৪০ লাখ) মানুষ সেই দেশগুলিতে অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন পেয়েছিল এবং রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যাগুলি ১০০০০০ জন প্রাপকদের মধ্যে এক জনের হওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছিল।

৩. ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের গবেষণায় (এখনও পিয়ার রিভিউয়ের অপেক্ষায়) পরামর্শ দেয় যে মস্তিষ্কে বিপজ্জনক, বিরল রক্তের জমাট বাঁধার অভিজ্ঞতা হওয়ার ঝুঁকিগুলি যারা অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফাইজার এবং মোদার্নার দ্বারা তৈরি ভ্যাকসিন পান তাদের তুলনায় করোনাভাইরাস রোগে আক্রান্তের লোকদের রক্তের জমাট বাঁধা মধ্যে অনেক গুনে বেশি। করোনার সংক্রমণ অনেক বেশি বিপজ্জনক।

৪. সেই একই তথ্য থেকে দেখা গেছে যে আমেরিকান তৈরি ভ্যাকসিনগুলি প্রাপ্ত প্রতি ১০ লাখ লোকের মধ্যে প্রায় ৪ জনের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল ভেনাস থ্রোমোসিস (সিভিটি), বা রক্ত জমাট বাঁধার অভিজ্ঞতা হতে পারে। যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন এবং অনুরূপ জনসন অ্যান্ড জনসন (যে ভ্যাকসিন গুলো ভিন্ন উপায়ে কাজ করে) নিয়েছে তাদের প্রতি ১০ লাখের মধ্যে প্রায় ৫ জনের রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।

৫. করোনাভাইরাস সংক্রামিত লোকদের রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা ফাইজার বা মোদার্নার ভ্যাকসিন পাওয়া লোকদের তুলনায় ১০ গুন বেশি ঝুঁকির সমান এবং কোভিড-১৯ রোগ অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন দেওয়া লোকদের চেয়ে ৮ গুণ বেশি ঝুঁকির সমান।

৬.সর্ব মোট ৬০ লাখ ৯০ হাজার লোকের মধ্যে যারা জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন পেয়েছিল তাদের মধ্যে ৬ জনের রক্ত জমাট বেঁধেছিল। ১৮ থেকে ৪৮ বছর বয়সী সাদা বর্নের মহিলাদের মধ্যে ছয়টি ঘটনা ঘটেছিল। ঐ লক্ষণগুলি দেখা দেয় ভ্যাকসিন পাওয়ার পরে ৬ থেকে ১৩ দিনের মধ্যে।

৭.যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক বছর ৩০০,০০০ থেকে ৬০০০০০ লোক তাদের ফুসফুসে বা পায়ে বা দেহের অন্যান্য অংশে রক্ত জমাট বাঁধে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যায় প্রতিদিন প্রায় ১০০০ থেকে ২০০০ রক্ত জমাট বাঁধা হয়। একদিনে কয়েক মিলিয়ন লোককে এখন ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, এই পটভূমি বিবেচনার করে বলা যেতে পারে যে পরিমান রক্ত জমাট বাঁধা ভ্যাকসিন গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘটবে কেবলমাত্র উপরের পটভূমিতে সাধারণত ঘটা রক্ত জমাট বাঁধার হারের অংশ হিসাবেই সম্ভবত হবে, হয়ত তা ভ্যাকসিনের সাথে সম্পর্কিত নয়।

রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাব্য লক্ষণ ও উপসর্গগুলো

ইউরোপীয় নিয়ামকরা পরামর্শ দিয়েছেন, যে লক্ষণ ও উপসর্গগুলো ভ্যাকসিন দেওয়ার ১৩দিনের মধ্যে হতে পারে যা লোকদের সচেতন হওয়া উচিত। উপসর্গ গুলো হতে পারে: ভ্যাকসিন গ্রহণকারীরা পায়ে ফোলাভাব, অবিচ্ছিন্ন পেটে ব্যথা, তীব্র ও অবিচ্ছিন্ন মাথাব্যথা বা ঝাপসা দৃষ্টি, এবং ইনজেকশনের জায়গা ছাড়িয়ে অন্য জায়গায় ত্বকের নীচে ক্ষুদ্র রক্তের দাগগুলি। তারা এমন অনেকগুলি লক্ষণগুলির দেখা দিলে চিকিত্সার সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে লক্ষণগুলি এতই অস্পষ্ট যে প্রায় অবিলম্বে, ব্রিটিশ জরুরী কক্ষগুলিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার পরে স্বাস্থ্যসেবার জন্য রোগীদের ভিড় তীব্র বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনেকেই তাদের লক্ষনগুলো উপরের বিবরণটির সাথে মেলে ভেবে চিন্তিত ছিলেন। ফলস্বরূপ, কিছু জরুরি কক্ষের চিকিত্সকরা অপ্রয়োজনীয় হাসপাতালের পরিদর্শন কি ভাবে কমানো যায় সেজন্য লক্ষনগুলোর আরো সংবেদনশীল করার সম্পর্কে আরও স্পষ্ট কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা চেয়েছেন।

সম্ভাব্য চিকিৎসা

জার্মান গবেষকরা বিশেষায়িত রক্ত পরীক্ষাগুলি বর্ণনা করেছেন যা এই ব্যাধিটি নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ইনট্র্যাভেনাস ইমিউন গ্লোবুলিন নামক একটি রক্ত পণ্য, যা বিভিন্ন প্রতিরোধ ক্ষতির চিকিত্সার জন্য ব্যবহৃত হয়, দেয়ার জন্য চিকিত্সার পরামর্শ দিয়েছেন। অ্যান্টি-কোগুল্যান্ট বা রক্ত পাতলা হিসাবে পরিচিত ড্রাগগুলিও দেওয়া যেতে পারে তবে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হওয়া - হেপারিন না দেওয়ার সুপারিস করেছেন। কেননা, (যদিও খুব কম) ভ্যাকসিন সম্পর্কিত রক্ত জমাট অবস্থা হ্যাপারিন প্রদত্ত লোকদের মধ্যে দেখা যায়।

ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ, যাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে বিকল্প ভ্যাকসিন রয়েছে সেই দেশগুলো এখন অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন শুধু মাএ বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে ব্যবহার সীমিত করেছে এবং কয়েকটি দেশ একেবারে এটি ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও এই জমাট বাঁধার প্রকোপগুলি অত্যন্ত কম, নিয়মকারিক এবং গবেষকরা মাথাব্যথা, পা ফোলা এবং পেটের ব্যথা সহ - নির্দিষ্ট লক্ষণগুলির সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে চেষ্টা করছেন - বিশেষত কম বয়সীদের মধ্যে যারা ইতিমধ্যে তাদের ভ্যাকসিন নিয়েছে।

বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশগুলি কয়েকটি দেশে উত্পাদিত ভ্যাকসিনগুলির উপর নির্ভরশীল। তাদের জন্য অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা জেএন্ডজে, স্পুটনিক ভি এবং সোনোভাক ভ্যাকসিনগুলি অর্থনৈতিকভাবে এবং অপারেশনগতভাবে সবচেয়ে উপযুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ এই দেশগুলি ঐ ভ্যাকসিনের কয়েক মিলিয়ন ডোজ অর্ডার করেছে। করোনার ভাইরাসের কারণে মৃত্যুর তুলনায় বিরল ভ্যাকসিন দেওয়ার পরের রক্ত ​​জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বিবেচনা করে (বেশিরভাগ ইউরোপীয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাদা মহিলাদের মধ্যে, এশিয়া বা আফ্রিকান দেশগুলিতে এখনও এমন কোনও গবেষণা হয়নি) বলা যায় উপরের ভ্যাকসিনগুলি দিয়ে টিকা দেওয়ার ব্যতীত অন্য কোনও বিকল্প নেই। কিছু হালকা লক্ষণ ব্যতীত লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারত এবং বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন গ্রহন করেছে। রক্ত জমাট বাঁধার খবর এখনও পাওয়া যায়নি। এই পরিস্থিতিতে, আমাদের যা আছে তা দিয়ে আমরাদের টিকা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং ভাইরাস থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর সাথে সাথে অর্থনীতি উন্মুক্ত করতে এবং অর্থনৈতিক কষ্ট ও ক্ষুধা থেকে জীবন বাঁচানোর বিকল্প নেই।

অনেক মিডিয়া এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলি অনিবার্যভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে জনস্বাস্থ্যের সেবায় যা কিছু করা হয়েছে তা তাদের ব্যক্তিগত অধিকারের লঙ্ঘন। এমনকি তারা এটি ইঙ্গিত দেয় যে জোর করে কোনও দ্রুতগতিতে চলমান সংক্রামক ভাইরাসের সংস্পর্শে না আসাই আসলে তাদের খুব উপকার করে। তবে আমরা বিধিনিযেদ নিয়মত পালন করে নিশ্চিত ভাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য করতে পারি যেন তারা তাদের কাজগুলি সঠিক ভাবে করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে নতুন তথ্যের প্রতিক্রিয়াতে তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করা এবং ভ্যাকসিনগুলির ব্যয় এবং সুবিধাগুলিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে রাখা।

রক্ত জমাট বাঁধা বিশেষত মহিলাদের বেশীর ভাগে আক্রান্ত হওয়া তাদের জীবনের একটি বড় ট্র্যাজেডি। তবে ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন বিরোধী বিশ্বাসে কাজ করা লোকেরা আত্মবিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য সক্রিয় একটি প্রচেষ্টা না করে, রক্ত জমাট বাঁধা এবং ভ্যাকসিন সংযোগটিকে কলঙ্ক হিসাবে চিত্রিত করবে এবং ভ্যাকসিন বিতরণকে /টিকার বিরুদ্ধে কাজ করবে। টিকা দেয়ার পরে ভ্যাকসিনের জটিলতার প্রভাবগুলি আরও গবেষণার জন্য বার্তা বিতরণ এবং প্রোটোকল বিকাশের মাধ্যমে ভ্যাকসিন উত্পাদনকারী দেশগুলোর ড্রাগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ একটি স্বচ্ছতা প্রদর্শন করছে। এই স্বচ্ছতা প্রদর্শন যারা ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিন নিয়েছে এমন অনেকের মতো এবং যারা এখনও এটির জন্য অপেক্ষা করছেন তাদের আশ্বাস দেবে যে এই নতুন চিকিত্সাগুলির সুরক্ষা যতটা সম্ভব গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হচ্ছে। আসুন জনগনের ভ্যাকসিন পেতে এবং জীবন বাঁচানোর জন্য একত্র হয়ে কাজ করি।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭