ইনসাইড থট

ভ্যাকসিন জটিলতায় কেন এখনও চলমান ভ্যাকসিনের প্রতি সবার আস্থা রাখা উচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২:১৩ পিএম, ১৭ এপ্রিল, ২০২১


Thumbnail

গতরাতে আমি বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজ দেখছিলাম এমন এক ব্রাজিলের যুবতী মায়ের অত্যন্ত দুঃখের গল্প যার এক বছরের বাচ্চা কোভিড-১৯ এ মারা গেল। তিনি বলেছিলেন, ছেলেটির নাক দিয়ে পানি এবং উচ্চ তাপমাত্রা শুরু হবার কারণে তিনি তার ছেলেকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান এবং তাদেরকে কোভিড -১৯ পরীক্ষা করার জন্য বার বার অনুরোধ করেছিলেন। কোভিড-১৯ এর কোনও পরীক্ষা না করেই চিকিৎসক তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন আর কিছু লক্ষণ প্রতিকারমূলক ঔষধ দিয়ে বাসায় পাঠান। বাসায় ছেলেটি যখন শ্বাসকষ্টে তীব্র অসুবিধাগুলি বোধ করতে শুরু করেছিল, তখন সে আবার ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এবার, ডাক্তাররা তাঁর অনুরোধ শুনেছিল এবং একটি কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে এবং তা ইতিবাচক বলে প্রমাণিত হয়। তবে অনেক দেরি হয়ে যাবার কারণে, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পাবার কারণে ছেলেটি মারা যায়। এখন ব্রাজিলে প্রতিদিন আনেক শিশু কোভিড-১৯ এ মারা যাচ্ছে।

যখন ভারতে প্রতিদিনের নতুন করোনা ভাইরাস রোগীর সংবাদ বিশ্বে সর্বোচ্চ, ঠিক সে সময় আমরা হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভক্তদের দেখছি, নদীতে পবিত্র ডুব বা অনুষ্টানিক স্নানের জন্য গঙ্গায় গাদাগাদী করে জড়ো হয়েছে। ১০ কোটি (একশ মিলিয়ন) উদযাপনকারীদের জন্য - শুধু মাএ এপ্রিল ১২, ১৪ এবং ২১শের সবচেয়ে শুভ দিনগুলিতে প্রতিদিন ৫০ লাখেরও বেশি লোকের সমাবেশ প্রত্যাশিত করা হচ্ছে। কারো কোনও সামাজিক দূরত্ব বা কোনও মুখোশ নেই। কর্তৃপক্ষরা মানুষকে ক্রমাগত কোভিড-১৯ রোধে যথাযথ আচরণ অনুসরণ করার জন্য আবেদন করছে। তবে প্রচুর ভিড়ের কারণে এটি ব্যবহারিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। ঐ সমাবেশের মধ্যে অনেকের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং কয়েক হাজার ইতিবাচক বলে পাওয়া যায়। তারাও কোন যথাযত আচরণ পালন করছে না। আজ ভারত সারাদেশে দিনে ১২ লাখেরও বেশি পরীক্ষা চালাচ্ছে এবং আশ্চর্যের কিছু নেই কেন গতকাল সারাদেশ ২১৬,০০০ এরও বেশি লোককে (১৮% ইতিবাচকতা) ইতিবাচক পাওয়া গেছে। সাথে সাথে প্রতিদিনের মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বাড়ছে।

থাইল্যান্ডে প্রতিদিন রিপোর্ট অনুযায়ে নতুন কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যাটি দেখায় যে এপ্রিলের ১ লা এপ্রিলের মাত্র ২৬ জন আক্রান্ত লোক ছিল যা খুব দ্রুত বেড়ে ১৫ই এপ্রিলে এসে দাঁড়ায় ১৫৩৩ জনে। তাদের বেশিরভাগ যুক্তরাজ্য রূপের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত যা সেখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। শনাক্ত করা এই রুপটি থাইল্যান্ডে পূর্বের তুলনায় আরও সহজেই সংক্রামিত হওয়ায় কারণেই অনেক লোক সংক্রামিত হচ্ছে। বর্তমান প্রকোপটি তরুণ বয়সের লোকদেরও প্রভাবিত করছে যাদের কিছু লক্ষণ থাকতে পারে বা তেমন কোনও লক্ষণও নেই, যারা সবচেয়ে গতিশীল, সেই কারণে এটি নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন করে তুলেছে। এমন কিছু প্রমাণও রয়েছে যে এই রুপটি আরও মারাত্মক রোগের কারণ হতে পারে। সুতরাং কর্তৃপক্ষ তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে যেন জনগন অপরিহার্য ভাবে প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলি প্রয়োগ করার জন্য সর্বদা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় যেমন প্রত্যেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া এবং মুখ স্পর্শ করা এড়ানো, বাহিরে এবং জনাকীর্ণ স্থানে মুখোশ পরা এবং শুধুমাত্র একটি ভাঁজ করা কনুইতে কাশি করে শ্বাস-প্রশ্বাসের শিষ্টাচার মেনে চলা।

৮ই মার্চ থেকে বাংলাদেশে প্রতিদিনের কোভিড-১৯ এর ইতিবাচকের সংখ্যা ৮৪৫ জন ছিল। তারপর লাফিয়ে সংক্রমণের হারের ফলন ২.৬% থেকে ২ এপ্রিল ২৩% এরও বেশি বেড়েছে। এপ্রিলে দৈনিক রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬২৬ জনে, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রতিদিনের সংখ্যক ইতিবাচক কোভিড রোগীর সংখ্যা। আরও বেশি লোক পরীক্ষার জন্য আসতে শুরু করায় পরীক্ষার সংখ্যাও বেড়ে যায়। গত দুই সপ্তাহে প্রায় ১০০,০০০ নতুন কোভিড রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। তবে, যারা পুনরুদ্ধার করেছেন তাদের প্রতিদিনের সংখ্যা আজ সংক্রামিত সংখ্যার চেয়ে বেশি। আজ ১৬ এপ্রিল ৪৪১৭ নতুন রোগীর শনাক্ত করা হয়েছে এবং ৫১৯৮ জন সংক্রামিত মানুষ পুনরুদ্ধার করেছেন এবং ১১১ জন মৃত্যু বরণ করেছেন, যা এখন পর্যন্ত একদিনের সর্বোচ্চ সংখ্যার মৃত্যু। সার্বিক মৃত্যুর হার এখনও ১.৪-১.৫% এর মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। মোট রোগীর সংখ্যা (কতজন ইতিবাচক বিয়োগ নম্বর পুনরুদ্ধার করেছে এবং মারা গেছে) ২০ই আগস্ট ছিল ১১৫,৭৭৯ জন আর তা ১৭ই মার্চে ছিল ৩৮১৫৫জন এবং বেড়ে ১৫ই এপ্রিলে হয়েছে ১০০,০৬৫ জনে। তবে আইইডিসিআর অনুসারে বাংলাদেশের পক্ষে আরও বেশি বেদনা হচ্ছে, এখন বুধবার অবধি এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশের বেশি ২১-৪০ বয়সের লোক ছিলেন। রোগীদের ২৭.৬ শতাংশ ২১-৩০ বছর বয়সী এবং ২৭.১ শতাংশ ৩১-৪০ বছর বয়সী। এরা আমাদের তরুণ সক্রিয় জন গোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের এই জনসংখ্যার গোষ্ঠী অতি প্রয়োজন। এটি দেখা গেছে যে যুক্তরাজ্যের বৈকল্পিকতা ছড়িয়ে পড়ার পরে বেশিরভাগ দক্ষিণ আফ্রিকার রূপের আরও সংক্রামক এবং মারাত্মক কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।

একদিকে আমরা বিশ্বজুড়ে যে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি যে লোকেরা মাসের পর মাসে লকডাউন, সীমাবদ্ধ চলাচলের এবং সামাজিকীকরণের অনুমতি না পাওয়ার কারনে বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তারা আনেকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে, কোন সীমাবদ্ধতা আর মানতে পারছে না বা অনুসরন করছে না। লোকেরা স্বাস্থ্য পরামর্শ অনুসরণ করেছে না। অনেক সংখ্যক লোক মুখোশ না পরে, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখে ঘোরাফিরা করছে। ভারত ও বাংলাদেশে আমরা দেখলাম যে কীভাবে হাজার হাজার মানুষ ধর্মীয় উত্সব পালন করতে জড়ো হয়, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় জনসমাবেশে যোগ দেয়। ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া বাড়ছেই। মুখোশ, কোনও সামাজিক দূরত্ব নেই বললেই চলে। সংক্রমণ আরও প্রসারিত হলে তা ভ্যারাস রূপান্তরকে আরও বাড়িয়ে তুলবে, নতুন এবং মারাত্মক রূপগুলি উদ্ভূত হবে এবং যদি আমরা সংক্রমণ বন্ধ না করতে পারি তবে তার উত্থান অবিরত থাকবে। এই অবস্তা চলতে থাকলে আমরা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে পারব না। এই অবস্তা বিবেচনা করে আমাদের ভাবতে হবে কোন কৌশলটি সবচেয়ে কার্যকর ভাবে এই মহামারী মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।

অন্যদিকে আমরা কোভিড-১৯ বিরুদ্ধে ইস্রায়েল, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক ইউরোপীয় দেশগুলির প্রচুর এবং সফল টিকা দেওয়ার কারণে দেখতে পাচ্ছি, সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক আচ্ছাদন শিথিল করছে। সোমবার থেকে সুইজারল্যান্ডও জিম খুলবে। এই বছর কঠোর ভাবে কয়েকটি স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে দোকানগুলিও সবসময় খোলা ছিল।

তাহলে শুধু দ্রুত টিকা দেওয়া কি একমাএ সঠিক উত্তর? অথবা যেহেতু ভ্যাকসিন সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করবে না তাই আমাদের একটি একত্রিত (ভবিষ্যতে কিছু সময়ের জন্য টিকাদানের পাশাপাশি স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণকে বজায় রাখা) কৌশল গ্রহণের প্রয়োজন হবে? আগামী বছরগুলিতে আমাদের জীবনযাত্রাকে অন্যরকমভাবে পরিবর্তন করে চলতে হবে। এটাই হয়ত জীবনের নতুন বাস্তবতা।

ভ্যাকসিন জাতীয়তার কারণে, বেশিরভাগ ভ্যাকসিনগুলি ধনী দেশগুলি অধিগ্রহণ করে ধরে রেখেছে। কেউ ভাবছে না যে আমরা একটি গ্লোবাল গ্রামে থাকি, তাই বিশ্বের সবাই যদি নিরাপদে না থাকে তবে কেউই নিরাপদ নয়। ভ্যাকসিন ছাড়াই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এবং নতুন মারাত্মক রূপগুলি বর্তমান ভ্যাকসিনগুলিকে কম কার্যকর করে তুলবে এবং আমাদের পুনরায় বার বার টিকা দেওয়ার দরকার পড়তে পারে।

আমি মনে করি জনগণকে এখনও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলি অনুসরণ করতে উত্সাহিত করার পাশাপাশি, কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, যেমন কোনও বৈধ কারণ ছাড়াই বাইরে না যাওয়া, বাইরে বেরোনোর সময় মাস্কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘন ঘন হাত ধোয়া ইত্যাদি। একই সাথে আমাদের অবশ্যই দ্রুত মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই সমস্ত দরজার কড়া নাড়াতে হবে।

এটি কোনও অলৌকিক ঘটনার কম ছিল না যখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিজ্ঞানীরা কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে এক বছরেরও কম সময়ে বেশ কয়েকটি কার্যকর টিকা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দ:খের বিযয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটিশ ওষুধ নিয়ন্ত্রকদের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র কাছ থেকে গত সপ্তাহে ঘোষণা করা হল অ্যাস্ট্রাজেনেকার আর জনসন ও জনসন এবং বিরল রক্তের জমাটগুলির মধ্যে সংযোগ হতে পারে বলে তারা সন্ধান করছে। এটি অনেকের মধ্যে সন্দেহ এবং ভ্যাকসিন দ্বিধা তৈরি করছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ যারা বেশিরভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় দেশগুলি বা ভারত বা রাশিয়া বা চীন থেকে ভ্যাকসিনের উপর নির্ভরশীল তাদের জন্য কী বিকল্প রয়েছে?

যেখানে কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জাতীয় পরিকল্পনাকারি নেতাদের যাতে লোকেরা নিজের এবং অন্যদের সুরক্ষার জন্য কী করতে পারে সে সম্পর্কে শওিশালী বার্তার দেওয়া উচিত ছিল, তার বিপরিতে আপেক্ষিক অনুপস্থিতি বা শূন্যতায় কিছু রাজনীতিবিদ এবং পন্ডিত বিদ্যমান ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। কিছু "শক্তিশালী ব্যক্তিবাদী" মতাদর্শের লোকেরা নিজেদেরকে ভুল করে ভাবছে যে তাদের এই নুতন কর্ণাভাইরাসকে মোকাবেলায় অতিরিক্ত অনাক্রম্যতা রয়েছে এবং তার কারনে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক গর্বের বিষয় বলে মনে করছে।

বাংলাদেশ সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশগুলোর তাদের জন্য কী বিকল্প রয়েছে, তা বলার আগে আসুন প্রথমে বিজ্ঞানের দিকে নজর দেই।

১. অস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন কমপক্ষে ১১৫ টি দেশে কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার জন মোতায়েন করা হয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বেশ কয়েকটি মাস ধরে ভ্যাকসিন দেওয়া চলছে। তবে এটি গত মাসে বা তার মধ্যেই যখন দেখা গেল যে, এক বিরল রক্ত জমাট বেধে যাওয়ার, কয়েকটি ক্ষেত্রে - কিছু মারাত্মক - এমন ঘটনা ঘটেছিল যে অনেক ইউরোপীয় জাতি সকল বয়সের মধ্যে এর ব্যবহার সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা শুরু করে।

২. এপ্রিল ৪ অবধি, ইউরোপীয় নিয়ামকরা ব্রিটেন এবং ৩০ দেশীয় ইউরোপীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিরল রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যার ২২২টির খবর পেয়েছিলেন। তারা বলেছিল যে প্রায় ৩৪ মিলিয়ন (তিন কোটি ৪০ লাখ) মানুষ সেই দেশগুলিতে অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন পেয়েছিল এবং রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যাগুলি ১০০০০০ জন প্রাপকদের মধ্যে এক জনের হওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছিল।

৩. ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের গবেষণায় (এখনও পিয়ার রিভিউয়ের অপেক্ষায়) পরামর্শ দেয় যে মস্তিষ্কে বিপজ্জনক, বিরল রক্তের জমাট বাঁধার অভিজ্ঞতা হওয়ার ঝুঁকিগুলি যারা অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফাইজার এবং মোদার্নার দ্বারা তৈরি ভ্যাকসিন পান তাদের তুলনায় করোনাভাইরাস রোগে আক্রান্তের লোকদের রক্তের জমাট বাঁধা মধ্যে অনেক গুনে বেশি। করোনার সংক্রমণ অনেক বেশি বিপজ্জনক।

৪. সেই একই তথ্য থেকে দেখা গেছে যে আমেরিকান তৈরি ভ্যাকসিনগুলি প্রাপ্ত প্রতি ১০ লাখ লোকের মধ্যে প্রায় ৪ জনের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল ভেনাস থ্রোমোসিস (সিভিটি), বা রক্ত জমাট বাঁধার অভিজ্ঞতা হতে পারে। যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন এবং অনুরূপ জনসন অ্যান্ড জনসন (যে ভ্যাকসিন গুলো ভিন্ন উপায়ে কাজ করে) নিয়েছে তাদের প্রতি ১০ লাখের মধ্যে প্রায় ৫ জনের রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।

৫. করোনাভাইরাস সংক্রামিত লোকদের রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা ফাইজার বা মোদার্নার ভ্যাকসিন পাওয়া লোকদের তুলনায় ১০ গুন বেশি ঝুঁকির সমান এবং কোভিড-১৯ রোগ অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন দেওয়া লোকদের চেয়ে ৮ গুণ বেশি ঝুঁকির সমান।

৬.সর্ব মোট ৬০ লাখ ৯০ হাজার লোকের মধ্যে যারা জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন পেয়েছিল তাদের মধ্যে ৬ জনের রক্ত জমাট বেঁধেছিল। ১৮ থেকে ৪৮ বছর বয়সী সাদা বর্নের মহিলাদের মধ্যে ছয়টি ঘটনা ঘটেছিল। ঐ লক্ষণগুলি দেখা দেয় ভ্যাকসিন পাওয়ার পরে ৬ থেকে ১৩ দিনের মধ্যে।

৭.যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক বছর ৩০০,০০০ থেকে ৬০০০০০ লোক তাদের ফুসফুসে বা পায়ে বা দেহের অন্যান্য অংশে রক্ত জমাট বাঁধে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যায় প্রতিদিন প্রায় ১০০০ থেকে ২০০০ রক্ত জমাট বাঁধা হয়। একদিনে কয়েক মিলিয়ন লোককে এখন ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, এই পটভূমি বিবেচনার করে বলা যেতে পারে যে পরিমান রক্ত জমাট বাঁধা ভ্যাকসিন গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘটবে কেবলমাত্র উপরের পটভূমিতে সাধারণত ঘটা রক্ত জমাট বাঁধার হারের অংশ হিসাবেই সম্ভবত হবে, হয়ত তা ভ্যাকসিনের সাথে সম্পর্কিত নয়।

রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাব্য লক্ষণ ও উপসর্গগুলো

ইউরোপীয় নিয়ামকরা পরামর্শ দিয়েছেন, যে লক্ষণ ও উপসর্গগুলো ভ্যাকসিন দেওয়ার ১৩দিনের মধ্যে হতে পারে যা লোকদের সচেতন হওয়া উচিত। উপসর্গ গুলো হতে পারে: ভ্যাকসিন গ্রহণকারীরা পায়ে ফোলাভাব, অবিচ্ছিন্ন পেটে ব্যথা, তীব্র ও অবিচ্ছিন্ন মাথাব্যথা বা ঝাপসা দৃষ্টি, এবং ইনজেকশনের জায়গা ছাড়িয়ে অন্য জায়গায় ত্বকের নীচে ক্ষুদ্র রক্তের দাগগুলি। তারা এমন অনেকগুলি লক্ষণগুলির দেখা দিলে চিকিত্সার সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে লক্ষণগুলি এতই অস্পষ্ট যে প্রায় অবিলম্বে, ব্রিটিশ জরুরী কক্ষগুলিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার পরে স্বাস্থ্যসেবার জন্য রোগীদের ভিড় তীব্র বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনেকেই তাদের লক্ষনগুলো উপরের বিবরণটির সাথে মেলে ভেবে চিন্তিত ছিলেন। ফলস্বরূপ, কিছু জরুরি কক্ষের চিকিত্সকরা অপ্রয়োজনীয় হাসপাতালের পরিদর্শন কি ভাবে কমানো যায় সেজন্য লক্ষনগুলোর আরো সংবেদনশীল করার সম্পর্কে আরও স্পষ্ট কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা চেয়েছেন।

সম্ভাব্য চিকিৎসা

জার্মান গবেষকরা বিশেষায়িত রক্ত পরীক্ষাগুলি বর্ণনা করেছেন যা এই ব্যাধিটি নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে এবং ইনট্র্যাভেনাস ইমিউন গ্লোবুলিন নামক একটি রক্ত পণ্য, যা বিভিন্ন প্রতিরোধ ক্ষতির চিকিত্সার জন্য ব্যবহৃত হয়, দেয়ার জন্য চিকিত্সার পরামর্শ দিয়েছেন। অ্যান্টি-কোগুল্যান্ট বা রক্ত পাতলা হিসাবে পরিচিত ড্রাগগুলিও দেওয়া যেতে পারে তবে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হওয়া - হেপারিন না দেওয়ার সুপারিস করেছেন। কেননা, (যদিও খুব কম) ভ্যাকসিন সম্পর্কিত রক্ত জমাট অবস্থা হ্যাপারিন প্রদত্ত লোকদের মধ্যে দেখা যায়।

ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ, যাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে বিকল্প ভ্যাকসিন রয়েছে সেই দেশগুলো এখন অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন শুধু মাএ বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে ব্যবহার সীমিত করেছে এবং কয়েকটি দেশ একেবারে এটি ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও এই জমাট বাঁধার প্রকোপগুলি অত্যন্ত কম, নিয়মকারিক এবং গবেষকরা মাথাব্যথা, পা ফোলা এবং পেটের ব্যথা সহ - নির্দিষ্ট লক্ষণগুলির সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে চেষ্টা করছেন - বিশেষত কম বয়সীদের মধ্যে যারা ইতিমধ্যে তাদের ভ্যাকসিন নিয়েছে।

বাংলাদেশ সহ উন্নয়নশীল দেশগুলি কয়েকটি দেশে উত্পাদিত ভ্যাকসিনগুলির উপর নির্ভরশীল। তাদের জন্য অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা বা জেএন্ডজে, স্পুটনিক ভি এবং সোনোভাক ভ্যাকসিনগুলি অর্থনৈতিকভাবে এবং অপারেশনগতভাবে সবচেয়ে উপযুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ এই দেশগুলি ঐ ভ্যাকসিনের কয়েক মিলিয়ন ডোজ অর্ডার করেছে। করোনার ভাইরাসের কারণে মৃত্যুর তুলনায় বিরল ভ্যাকসিন দেওয়ার পরের রক্ত ​​জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বিবেচনা করে (বেশিরভাগ ইউরোপীয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাদা মহিলাদের মধ্যে, এশিয়া বা আফ্রিকান দেশগুলিতে এখনও এমন কোনও গবেষণা হয়নি) বলা যায় উপরের ভ্যাকসিনগুলি দিয়ে টিকা দেওয়ার ব্যতীত অন্য কোনও বিকল্প নেই। কিছু হালকা লক্ষণ ব্যতীত লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারত এবং বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন গ্রহন করেছে। রক্ত জমাট বাঁধার খবর এখনও পাওয়া যায়নি। এই পরিস্থিতিতে, আমাদের যা আছে তা দিয়ে আমরাদের টিকা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং ভাইরাস থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর সাথে সাথে অর্থনীতি উন্মুক্ত করতে এবং অর্থনৈতিক কষ্ট ও ক্ষুধা থেকে জীবন বাঁচানোর বিকল্প নেই।

অনেক মিডিয়া এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলি অনিবার্যভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে জনস্বাস্থ্যের সেবায় যা কিছু করা হয়েছে তা তাদের ব্যক্তিগত অধিকারের লঙ্ঘন। এমনকি তারা এটি ইঙ্গিত দেয় যে জোর করে কোনও দ্রুতগতিতে চলমান সংক্রামক ভাইরাসের সংস্পর্শে না আসাই আসলে তাদের খুব উপকার করে। তবে আমরা বিধিনিযেদ নিয়মত পালন করে নিশ্চিত ভাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাহায্য করতে পারি যেন তারা তাদের কাজগুলি সঠিক ভাবে করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে নতুন তথ্যের প্রতিক্রিয়াতে তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করা এবং ভ্যাকসিনগুলির ব্যয় এবং সুবিধাগুলিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে রাখা।

রক্ত জমাট বাঁধা বিশেষত মহিলাদের বেশীর ভাগে আক্রান্ত হওয়া তাদের জীবনের একটি বড় ট্র্যাজেডি। তবে ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন বিরোধী বিশ্বাসে কাজ করা লোকেরা আত্মবিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য সক্রিয় একটি প্রচেষ্টা না করে, রক্ত জমাট বাঁধা এবং ভ্যাকসিন সংযোগটিকে কলঙ্ক হিসাবে চিত্রিত করবে এবং ভ্যাকসিন বিতরণকে /টিকার বিরুদ্ধে কাজ করবে। টিকা দেয়ার পরে ভ্যাকসিনের জটিলতার প্রভাবগুলি আরও গবেষণার জন্য বার্তা বিতরণ এবং প্রোটোকল বিকাশের মাধ্যমে ভ্যাকসিন উত্পাদনকারী দেশগুলোর ড্রাগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ একটি স্বচ্ছতা প্রদর্শন করছে। এই স্বচ্ছতা প্রদর্শন যারা ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিন নিয়েছে এমন অনেকের মতো এবং যারা এখনও এটির জন্য অপেক্ষা করছেন তাদের আশ্বাস দেবে যে এই নতুন চিকিত্সাগুলির সুরক্ষা যতটা সম্ভব গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হচ্ছে। আসুন জনগনের ভ্যাকসিন পেতে এবং জীবন বাঁচানোর জন্য একত্র হয়ে কাজ করি।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

একজন শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি


Thumbnail

একটি বাউন্ডুলে কিশোর থেকে আমি ও আমার মত হাজার জনের আজকের অবস্থানে আসার বাস্তবতা পদ্মা পাড়ের রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ আর পদ্মারমতোই উদার ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী শিক্ষকদের কাছে ঋণী। পদ্মা যেমন স্বচ্ছ পানি আর উর্বর পলি দুকূলে বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না,  ঠিক তেমনি আমাদের সময়ের শিক্ষকেরা তাদের জ্ঞান বিতরণে কখনো কার্পণ্য করতেন না। তবে তার চেয়েও বড় কথা হলো, কেবল জ্ঞান সম্পন্ন বা শিক্ষিত হওয়ার চেয়েও আমাদের পিতৃতুল্য শিক্ষকরা জোর দিতেন ভালো মানুষ হওয়ার উপর। তেমনি একজন পিতৃতুল্য শিক্ষক সবার প্রিয় নজরুল ইসলাম স্যার আমাদের কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে যাত্রা করেছেন গত ১৯ মে ২০২৪ তারিখে।

 

আমরা ১১ - ১৩ বছরের কিশোররা ক্যাডেট কলেজে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। তখনও আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন ছেড়ে থাকার মতো শক্ত মনের অধিকারী ছিলাম না। নজরুল ইসলাম স্যার সহ চারজন স্যার তখন হাউজ মাস্টার (হোস্টেল পরিচালক) হিসাবে পরম মমতায় আমাদের বরণ করে নেন। থাকা, খাওয়া, লেখাপড়া, বইপত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা বহির্ভূত সৃজনশীল কাজ, বাগান করা, পিকনিক, শিক্ষা সফর ইত্যাদি অনেক কিছুর ভেতর দিয়ে শিক্ষকরা আমাদের সম্পৃক্ত করেছিলেন উন্নত মানুষ গড়ার মহান ব্রত নিয়ে।

 

আমাদের স্বভাব ছিল  নানা প্রকৃতির। কেউ দুরন্ত, কেউ শান্ত, কেউ সাহসী, কেউ ভীতু, কেউ ধনী, কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ গরিব, কেউ শহুরে, কেউ গেঁও, কেউ মেধাবী, কেউবা আবার অমনোযোগী। এমন নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে যোগ দেয়া সবাইকে  হাউজ মাস্টার হিসেবে নজরুল স্যার এক সুতোয় বেঁধেছিলেন। যার যে প্রতিভা ছিল, সেটাই শানিত করে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিতেন সবাইকে। মনে পড়ে স্যার কখনো দেয়াল পত্রিকা লেখার কৌশল দেখাচ্ছেন, আবৃতি-বক্তৃতা-বিতর্ক শেখাচ্ছেন, নাটকের মহড়া করাচ্ছেন, খেলার মাঠে অন্য  হাউসকে ঘায়েল করার মন্ত্র দিচ্ছেন আবার পড়ার সময় পুরো পড়া আদায় করে ছাড়ছেন। সাধারণজ্ঞান  প্রতিযোগিতার প্রস্তুতির সময় মনে হতো কি জানেননা এই পন্ডিত।   

 

ক্যাডেট কলেজে সব ছিল ধরা বাধা বা ছকে আঁকা। সকালে শারীরিক প্রশিক্ষণ বা প্যারেড, এরপর ক্লাস, দুপুরে নির্জনে বিশ্রাম, বিকালে খেলাধুলা, সন্ধ্যায় নামাজ শেষে লেখাপড়া আর রাত দশটায় আলো নিভিয়ে ঘুম - সাধারণত এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। সপ্তাহে দুদিন আমরা নাটক এবং খবর দেখতে পেতাম দেশে একমাত্র টিভি চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনের কল্যাণে। অথচ এরই মাঝে নজরুল স্যার কিভাবে যেন দেয়াল পত্রিকা, নাটক, আবৃতি, বাগান, নামাজ সবকিছুই আমাদের হাতে-কলমে শিখিয়ে ছেড়েছেন।

 

স্যার ছিলেন অর্থনীতির শিক্ষক। ক্যাডেট কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্ররা বেশি পড়ে আর মানবিক বিভাগে ছাত্র থাকে তুলনামূলক ভাবে কম। তাই নজরুল স্যার মানবিক বিভাগ তথা অর্থনীতির ছাত্রদের বুকে টেনে নিতেন। অর্থনীতির মত একটি নিরস ও জটিল বিষয়ও স্যারের উপস্থাপনা গুনে জীবন্ত হয়ে উঠতো । আজকের দিনেও হঠাৎ যখন পেঁয়াজ কিংবা ডিমের দাম বেড়ে যায়, নজরুল স্যারের কথা মনে পড়ে,  যিনি কি সুন্দরভাবে বুঝিয়েছিলেন চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে কৃত্রিম সংকট, যুদ্ধ বা রাজনীতি ঢুকে গেলে অর্থনীতিতে কিভাবে বিপর্যয় ঘটে।

 

মনে পড়ে বেশি নাম্বার পাওয়ার লোভে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় কত কিছু লিখে খাতা ভরাতাম। ভাবতাম, সার কি আর এত কিছু পড়বেন? বাস্তবতা হলো, স্যার দাড়ি, কমা, সেমিকোলন পর্যন্ত পড়ে সব ভুল ধরিয়ে দিতেন এবং সঠিক উত্তর বুঝিয়ে দিতেন। মনীষীদের প্রতিটি কোটেশন যেন স্যারের মুখস্থ ছিল। একটু এদিক ওদিক হলেই ধরা পড়ে যেতাম। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় অর্থনীতিতে ছাত্ররা বরাবরই সর্বোচ্চ নাম্বার পেত। এসব ছাত্রদের অনেকেই আজ দেশ-বিদেশের নাম করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কেউ কেউ  নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক।

 

৭০ দশকের শেষে ও আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা। নজরুল স্যার ছিলেন আমাদের রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের বিতর্ক দলের মেন্টর তথা অভিভাবক বা পরিচালক। আমরা স্কুল পড়ুয়া হলেও আমাদের প্রতিপক্ষ থাকতো বুয়েট বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটি হলের বিতার্কিকরা। নজরুল স্যার একটা কথাই বলতেন, তুমি তোমার সেরাটা উপস্থাপন করো, অপরপক্ষে কে আছে, তা দেখার দরকার নেই।

 

স্যার দুপুরের বিশ্রামের সময় বা বিকেলের খেলার সময় আমাদের নিয়ে বসতেন। ঘড়ি ধরে বিতর্ক করাতেন। তারপর বাসে করে রাজশাহী থেকে ঢাকায় নিয়ে আসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যামাগার ও সুইমিং পুলের পাশে খেলোয়াড়দের জন্য একটি ডরমেটরি আছে। তার এক প্রাক্তন ছাত্রের আশীর্বাদে আমাদের নিয়ে সেখানে উঠতেন। আরেক ছাত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ'র শিক্ষক। তাকে বলে সেমিনার হল খোলাতেন আমাদের অনুশীলন করানোর জন্য। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বিপক্ষ দলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চেহারা দেখানো, যাতে আমরা বিতর্কের সময় ভয় না পাই। সেই সেমিনার হলের মঞ্চে দাঁড় করিয়ে আমাদের বিতর্ক অনুশীলন করাতেন। 

 

চূড়ান্ত দিনে বিটিভি ভবনে আগেভাগে নিয়ে যেতেন। তিনি জানতেন বক্তৃতা দেয়ার ডায়াস বা রোস্ট্রাম (লেকচার স্ট্যান্ড) আমাদের উচ্চতার তুলনায় বেশ উঁচু হবে। কারণ আমরা ছিলাম স্কুল কলেজ পড়ুয়া কম উচ্চতার। তাই আগেভাগেই প্রযোজককে বলে পায়ের নিচে দেয়ার মত কাঠের চৌকি জোগাড় করতেন, যাতে টিভি ক্যামেরায় আমাদের ভালোভাবে দেখা যায়। এত দিকে নজর থাকতো স্যারের। 

 

বিতর্ক শুরুর আগে দর্শক সারিতে বসা স্যারের দিকে তাকাতাম। স্যার মৃদু হেসে হালকা করে হাত উঁচু করে একটা ইশারা দিতেন। সেই ইশারা দেখে মনে হতো আমি বিশ্বের সেরা বক্তা, আজ আমাকে দিয়ে বিশ্বজয়ও সম্ভব। সত্যিই আমরা পেরেছিলাম। স্কুল পড়ুয়া হয়েও একে একে বহু কলেজ, বুয়েট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে হারিয়ে পর পর কয়েক বছর আমরা উপরের রাউন্ডে যেতে পেরেছিলাম। এক রাউন্ড জিতলেই বিটিভি ভবন থেকে সোজা এলিফ্যান্ট রোডে নিয়ে যেতেন চাইনিজ খাবার খাওয়াতে। স্যারের মুখে থাকত বিশ্বজয়ের হাসি ও তৃপ্তি।

এমন মহান শিক্ষকের মৃত্যু নেই। তবুও তার চলে যাওয়া অনেক কষ্ট দেয় আমাদের। এমন শিক্ষক খনজন্মা। এমন শিক্ষক স্রষ্টার আশীর্বাদ। ওপারে ভালো থাকুক আমাদের প্রিয় নজরুল স্যার।


শ্রদ্ধাঞ্জলি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি: শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত কর্মী

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২১ মে, ২০২৪


Thumbnail

আজ   ২১ মে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র জন্মদিন। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই এক অনুষ্ঠানে ছোট বোন শেখ রেহানার এই ছেলের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘ববি সিআরআই এ পরিচালক হিসেবে কাজ করে। ইউএনডিপিতেও কাজ করে। সরকারের অনেক উদ্ভাবনী আইডিয়াতে সে কাজ করছে। সে নীরবে কাজ করে।’ ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেন নিজেকে। এর আগে অবশ্য ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের আক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পে দুই বছর মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাইবার প্রচার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ববি ওই প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। তখন জাতীয় নির্বাচনে অনলাইন প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর অনলাইনভিত্তিক প্রচার বা সাইবার স্পেসের মূল দায়িত্বে ছিলেন ববি। সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মাঠ দখল ও নির্বাচনে জয়লাভের কৌশল হিসেবে ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কাজ নিয়ে ‘আপনি জানেন কি’ শিরোনামে ১৭টি প্রামাণ্য চিত্র এবং অন্যান্য সরকারের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের তুলনামূলক ১৯টি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি এবং নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে আসার অনুষ্ঠান ‘ইয়াংবাংলা’র পেছনের অন্যতম মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ববি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একইভাবে আওয়ামী লীগের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ সকল রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ফলে প্রচার-প্রচারণা করে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচনে জয়ী করার কৌশল গ্রহণ করতে হয় শেখ হাসিনার দলকে। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ অনলাইন মিডিয়া ব্যবহার করে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর কাছে নৌকা প্রতীক পৌঁছে দিতে সক্ষম হন সেসময়। এজন্য ভারতের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ লিখেছিল- ‘ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নেতৃত্ব দেন ইন্দিরা গান্ধীর দৌহিত্ররা তেমনি ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়েছেন ববি ও জয়।’

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। এক্ষেত্রে ‘ইয়াংবাংলা’, ‘জয়বাংলা কনসার্ট’ এবং ‘মুজিব’ সিরিজের কাজের কথা প্রথমেই মনে আসবে। তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আইকন। তিনি আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) এর ট্রাস্টি। সিআরআই’র হেড অব স্ট্রাটেজি অ্যান্ড প্রোগ্রাম হিসেবে কাজ করছেন যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা ববি।

তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও পরামর্শে পরিচালিত ‘সিআরআই’ ও ‘ইয়াং বাংলা’র ব্যানারে তিনি নতুন জীবনের সন্ধান দিচ্ছেন যুব সমাজকে। নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে নেওয়া অন্যতম কর্মসূচি ‘ইয়াং বাংলা’ সারাদেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একইসঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে করে তুলেছে উজ্জীবিত। এই কর্মসূচির অন্যতম পরিকল্পনাকারী তিনি। তার নির্দেশনায় প্রকাশিত হচ্ছে ‘মুজিব’ নামের একটি শিশুতোষ প্রকাশনা। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবলম্বনে গ্রাফিক নভেল সিরিজ মুজিব-৬ পর্বের পর নতুন পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে সিআরআই-এর উদ্যোগে। জীবনীভিত্তিক এই প্রকাশনার মধ্য দিয়ে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই গ্রাফিক নভেলটি। ইংরেজির পাশাপাশি আরো কয়েকটি বিদেশি ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে বইটি। আসলে রাদওয়ান মুজিব রাজনৈতিক কোনো পদে না থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি সুপরিচিত নাম। বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকেও তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর জয়বাংলা কনসার্টের আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশের তরুণদের অন্যতম বড় প্লাটফর্ম ইয়াংবাংলা। মুজিববর্ষ এবং তার আগে তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় চেতনায় উদ্দীপিত করেছে আয়োজিত এসব কনসার্ট। কারণ কনসার্টের বড় অংশ জুড়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের গান। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণ উপলক্ষে ২০১৮ সালে জয়বাংলা-কনসার্ট আয়োজন করে ইয়াংবাংলার সেক্রেটারিয়েট সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। চতুর্থবারের মতো চলা ইয়াংবাংলার ওই আয়োজনে উপস্থিত ছিল এ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় মুখগুলো। দেশাত্মবোধে নিজের চেতনাকে আরও একবার ঝালিয়ে নিতে কনসার্টকে দারুণভাবে স্বাগত জানায় তরুণ প্রজন্ম।

রাদওয়ান মুজিব ববি ২০১৮ সালে বলেছেন, তরুণদের লবিস্ট হিসেবে কাজ করবে  ‘ইয়াংবাংলা’। সেসময় তিনি মাইক্রোসফট ইয়াংবাংলা সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে ছিলেন যে সামিটে অংশ নেয় সারাদেশের ২৫০ টি দল। অংশগ্রহণকারী দল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খেলাধুলা, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ অবকাঠামো নানা বিষয়ে উদ্ভাবনী প্রস্তাবনা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। বিজয়ী দলগুলোকে সম্মাননাসহ প্রস্তাবিত আইডিয়া বাস্তবায়নের অর্থ দেয়া হয়। ২০২০-২০২২ সালে মুজিববর্ষে তরুণদের চিন্তা চেতনার সঙ্গে মিল রেখে ইতিহাসকে উপস্থাপন করা উচিত বলে জানিয়েছিলেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। এ সময় তিনি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ পদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে সকলের ভাবা উচিত বলে মন্তব্য করেন।

বঙ্গবন্ধু-দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র অবদানের কথা বলতে গেলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের উল্লেখযোগ্য দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার। ১৯৭৫ সালে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর আগে দশম জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, তিনি ও তার সন্তান এবং বোন রেহানা ও তার সন্তানদের নিয়েই তার পরিবার। এর বাইরে তার পরিবারে আর কোনো সদস্য নেই। তবে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে লিখেছেন- ‘একদিকে জনগণ এবং অন্যদিকে আমার সন্তান কাউকেই আমি ভিন্ন চোখে দেখতে পারি না।’ প্রধানমন্ত্রীর পিতা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিশারি, স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী, ছেলে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, মেয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। একটি পরিপূর্ণ আলোকিত পরিবারের প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী বাল্যকাল থেকেই পিতার রাজনৈতিক আদর্শে বেড়ে উঠেছেন। এজন্য শেখ হাসিনা পরিবারের ঔদার্য বিশাল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক ঘটনা দিয়ে সেই উদার-হৃদয়ের মানুষদের আমরা চিনতে পারি।

মহাজোট সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার নামে বরাদ্দকৃত বাড়িটি সরকারি কাজে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার ঘটনাটি অধিকাংশ মানুষের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে ২০০১ সালে ১১ জুলাই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধানমণ্ডিতে এক বিঘা জমির প্লটে একতলা একটি বাড়ির মালিকানা পান শেখ রেহানা। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বিক্রয় দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হয় এবং বাড়িটি তার নামে ‘নামজারি’ও হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সেই বরাদ্দ না মেনে বাড়িটি ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশকে দিয়ে দেয়। তবে শেখ রেহানার পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করায় মামলাধীন বাড়িটির বরাদ্দপত্র বাতিল করতে ব্যর্থ হয় জোট সরকার। প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারিসূত্রে পাওয়া বাড়িটি নিজের দখলে আনার চেষ্টা না করে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছেন শেখ রেহানা। নামমাত্র ১০০১ টাকা মূল্যে সরকারের কাছে বাড়িটি দলিল করে দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান হিসেবে তার পক্ষেই ঘটানো সম্ভব। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানও বাল্যকাল থেকে পরের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করতে শিখেছিলেন আর নিজে ধনপতি না হয়ে সাধারণ জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত ছিলেন। ২০০১-০৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে জোট সরকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনেককেই প্লট বা বাড়ি বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু কেড়ে নিয়েছিল এ দেশের গর্বিত সন্তান শেখ রেহানার বাড়িটি। মনে রাখা দরকার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ধানমন্ডির পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা নিজেরা ভোগদখল না করে ‘স্মৃতি জাদুঘর’ করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অথচ জাতির পিতার কন্যাদ্বয়ের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা রাষ্ট্রেরই করা উচিত। আমরা দেখলাম বিপরীত চিত্র শেখ রেহানার বাড়িটি দখলের জন্য জোট সরকার ২০০৫ সালে থানা হিসেবে উদ্বোধন করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে। বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি বিদ্বেষের কারণ কি? পক্ষান্তরে শেখ রেহানা নিজের বাড়িটি স্বেচ্ছায় জনস্বার্থে পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন।এটা বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঔদার্যের প্রকাশ। ব্যক্তিগত ভোগদখলের চিন্তা ত্যাগ করার এই মানসিকতা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য। এ জন্যই শেখ রেহানা বলেছেন- ‘এক সরকার দেবে, আরেক সরকার নেবে, এই ঝামেলায় তার দরকার নেই।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকতে হয়েছে বড় বোন শেখ হাসিনাসহ শেখ রেহানাকে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো কেউ তাদের প্রতি সদয় হয়নি। বরং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মাত্র ১০১ টাকায় তার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য গুলশানে ৩২ কাঠার প্লটে একটি বাড়ি বরাদ্দ করা হয়। সে সময় কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলেননি। ৩২ কাঠার গুলশানের বাড়িটি বরাদ্দ পাওয়ার পরও খালেদা জিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের ২২৮ কাঠার বিলাসবহুল বাড়িতেই থাকতেন। প্রচলিত আইন ভেঙে একইসঙ্গে দুটি সরকারি বাড়ি দখল করার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ একটিবারও প্রশ্ন তোলেননি কেন? অবশেষে আদালতের রায়ে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ছাড়তে হলেও তিনি প্রেস কনফারেন্স করে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান। আশ্চর্যের বিষয় হলো সেনানিবাসে বসে দিনের পর দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়েও প্রতিবাদ করেননি প্রতিক্রিয়াশীল ঘরানার বুদ্ধিজীবী মহল। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের দলীয় রাজনীতির দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু কন্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ শেখ রেহানা কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনকি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ঔদার্যের তুলনাও হয় না। শেখ রেহানার মাথা গোজার ঠাঁই কেড়ে নিয়ে তাঁর নামে রেজিস্ট্রি ও নামজারিকৃত বাড়ি থেকে কর্মরত ৯ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয় জোট সরকার। কেবল জাতির পিতার কন্যা হওয়ায় শেখ রেহানাকে সেদিন অপদস্ত করা হয়েছিল। সেই উপেক্ষা, কুরুচিপূর্ণ আচরণ মানুষ ভুলে যায়নি। জনগণ তার জবাবও দিয়েছে ভোটের মাধ্যমে।

শেখ হাসিনা ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। তার তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নৃশংসভাবে নিহত হন। একমাত্র বোন শেখ রেহানা তখন তার সঙ্গে জার্মানিতে। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং ১৭ মে ৬ বছর নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন তিনি। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পরে তাদেরও বন্দী করে রেখেছিল পাকিস্তানি আর্মি। বন্দী মুহূর্তগুলো ছিল উৎকণ্ঠায় ভরা। পিতা জীবিত আছেন জানতে পারেন স্বাধীন দেশে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু প্রথমে পরিবার নয় গিয়েছেন জনতার কাছে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন পরিবারটির প্রেরণা। মার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল দেশ স্বাধীন হবে। মায়ের কাছ থেকে শিখেছেন অনেক কিছু। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু মনে করতেন বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড এবং সাউথ এশিয়ার শক্তিশালী দেশ। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে এ দেশ। বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবনাও।

বাংলাদেশের মানুষের কথা চিন্তা করে শেখ হাসিনা কষ্ট পান; তেমনি রেহানাও। যে মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন কষ্ট করলেন, সেই মানুষের জন্যই নিজের জীবনটাই দিয়ে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি আমলের মতো যে কষ্ট সেই কষ্টই পেয়েছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে বর্তমানে তিনি চেষ্টা করছেন মানুষের অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হবে, মানুষের জন্য কিছু করতে হবে- এ ভাবনা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ সকল আওয়ামী লীগ বিশ্বাসীর।

ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার মতো শেখ রেহানারও টুঙ্গিপাড়ার প্রতি রয়েছে গভীর টান। হিজলের স্মৃতি তাকে ডাক দিয়ে যায়; জলে ঢাকা সবুজ ক্ষেত তাকে আহ্বান জানায়। মহান পিতার কবর স্নিগ্ধ সান্নিধ্য প্রদান করে। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন বলেই প্রাণে রক্ষা পান তিনি। কলেজ পড়ুয়া রেহানার লেখাপড়া বিঘ্নিত হচ্ছিল দেশে। কারণ তাদের ছোট বাড়িতে অনেক মানুষ; আর রাজনৈতিক পরিবারে বিচিত্র মানুষের আনাগোনা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এজন্য বড় বোনের সন্তানদের দেখাশোনা ও নিজের পড়ার কাজের সুবিধার জন্য মাতৃনির্দেশ পালন করে বিদেশ পাড়ি দেন তিনি। রাষ্ট্রপতি হয়েও বঙ্গবন্ধু একটি ছোট বাড়িতে থাকতেন। কারণ বেগম মুজিবের বিশ্বাস ছিল বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার সন্তানরা নষ্ট হয়ে যাবে। এজন্য কখনো রাষ্ট্রপতি ভবনে বসবাসের উদ্দেশ্যে যাননি বরং সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন। দেশে ফিরতে না পেরে ১৯৭৬ সালে রেহানা লন্ডনে পৌঁছান। বিয়ে করেন পিতার পছন্দের পাত্রকেই। ১৯৭৭ সালে শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তিনি প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন সুইডেনে একটি কনফারেন্সে। ১৯৮০ সালে শেখ হাসিনা লন্ডনে বক্তব্য রাখেন। এ সময় দুই বোন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে সোচ্চার হন। ১৯৮১ সাল থেকে শেখ হাসিনা পার্টির জন্য নিরলস কাজ করেছেন; নেতৃত্ব দিয়েছেন; সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। আর প্রেরণা জুগিয়েছেন ছোট বোন শেখ রেহানা। শেখ রেহানা লন্ডনে থাকেন। বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বোন, তারপরও তাকে চাকরি করে চলতে হয়। একটা গাড়ি নেই, তার বিরুদ্ধেও মামলা করে জোট সরকার এবং পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তার ছেলে জামাল লন্ডনে সেলসম্যানের চাকরি করে নিজের পড়ার খরচ নিজে চালাতেন। পরিবারটি এ ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বেড়ে উঠেছে। হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা দেয় ২০০৭ সালের কেয়ারটেকার সরকার। অথচ তারা কোনো দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। যাদের গায়ে কালি নেই তাদের কালি দিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। সৎ যোগ্য হয়েও তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বহুবার। এ দেশে মানুষের ভালোবাসা ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবার কিছুই পায়নি। উপরন্তু শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা রাষ্ট্রের কাছে থেকে কিছুই নেননি। রাষ্ট্রপতি পরিবার হিসেবে তো রাষ্ট্রের কাছ থেকে সবাই পায় শুধু তাঁরাই কিছু নেননি। কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ নেই; ছিল না কখনো।এজন্য জনগণের স্বার্থ রক্ষা করেছেন; জনগণের দিকে তাকিয়েছেন; জনগণের জন্য কিছু করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা কর্তব্য মনে করে নিজের বরাদ্দকৃত বাড়িটি পুলিশকে দিয়ে দিয়েছেন। শেখ রেহানার মহানুভবতার তুলনা নেই। মানব দরদি ও মহৎ ব্যক্তির আদর্শ তিনি।

শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর এই ছোট মেয়ের (জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫) তিন সন্তান। একমাত্র ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং দুই মেয়ে হলেন টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। ববি ১৯৭৮ সালের ২১ মে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী পেপি কিভিনিয়ামি সিদ্দিক, মেয়ে লীলাতুলী হাসিনা সিদ্দিক (জন্ম ৩১ অক্টোবর, ২০১০), ছেলে কাইয়াস মুজিব সিদ্দিক (জন্ম ৩০ মার্চ, ২০১৩)। জীবনের একটা বড় অংশ দেশের বাইরে কাটালেও রাদওয়ান মুজিব শেখ রেহানার পরিবারের রাজনৈতিক আবহ ও আদর্শ নিয়েই বড় হয়েছেন। এখন একটানা এক দশকের বেশি সময় বাংলাদেশেই আছেন তিনি। এ সময়ে সরাসরি রাজনীতির মাঠে না থেকেও দেশ গড়ার কাজে সক্রিয়। বিশেষত বড় খালা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ পরিচালনায় গবেষণাভিত্তিক তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে সহযোগিতা করছেন তিনি। সিআরআই থেকে এ কাজগুলো করা হচ্ছে।

লেখাবাহুল্য, বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স (এলএসই) থেকে গ্রাজুয়েট রাদওয়ান মুজিব বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। লন্ডনের ওই প্রতিষ্ঠানে তার অধ্যয়নের প্রধান বিষয়গুলো ছিলো গভর্মেন্ট অ্যান্ড হিস্টরি, পলিটিক্যাল থিওরিজ, ইন্টারন্যাশনাল হিস্টরি। ২০০২-২০০৩ সেশনে একই প্রতিষ্ঠান থেকে কমপারেটিভ পলিটিক্স, পলিটিক্যাল সায়েন্স, কনফ্লিক্ট রেগুলেশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি বিষয়ে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হওয়ায় রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি প্রথম থেকেই রাজনীতিসচেতন। ২০০৮ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনাকে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারাগার থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন তখন লন্ডনে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই সময় ববি বিখ্যাত ‘ফ্রস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর  স্যার ডেভিডকে প্রধানমন্ত্রীর গ্রেফতারের বিরুদ্ধে যে সাক্ষাৎকার দেন যা বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখে।

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার ক্ষেত্রে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও  সজীব ওয়াজেদ জয় বেশি উৎসাহী মনে করা হয়। অবশ্য জয় অতটা মাঠের রাজনীতি বা তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে যুক্ত নন। তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা। আবার প্রধানমন্ত্রীর কন্যা পুতুল রাজনীতির সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত না থাকলেও জনসেবামূলক কাজেই বেশি নিবেদিত। মার সঙ্গে সার্বক্ষণিক তার দেখা মেলে। যার ফলে অনেকেই বলেন রাজনীতিটা প্রধানমন্ত্রী হাতেকলমে শেখাচ্ছেন মেয়েকে। অন্যদিকে শেখ রেহানা রাজনীতিতে কখনো দলীয় পদে না থাকলেও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারিগর তাকে বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী নানা সময়ে বলেছেন, ‘রেহানা আমার ছায়াসঙ্গী।’ শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টির তুখোড় রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে লন্ডনের হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সূত্রে খালা-মা ও বোনের পথ ধরে ববিই হতে পারেন আওয়ামী লীগের উত্তরসূরি। তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশ গড়ার কাজে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তৃণমূলের নেতারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর তাকে দলে ডেকে নেয়া উচিত। তাতে আওয়ামী লীগ একজন দক্ষ নেতা পাবেন। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৯ম বারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমি থাকতে নতুন নেতৃত্ব আসুক। আমি চাই বেঁচে থাকতেই নতুন নেতা নির্বাচিত করে দলকে শক্তিশালী করতে। কিন্তু তখন কাউন্সিলরা তাঁর বক্তব্য সমস্বরে প্রত্যাখান করেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডয়চেভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি থেকে অবসরের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে চতুর্থবার আমি প্রধানমন্ত্রী। আমি আর চাই না, একটা সময় এসে বিরতি দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, যেনো তরুণ প্রজন্মের জন্য জায়গা করে দেওয়া যেতে পারে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তার শেষ মেয়াদ হতে পারে, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চান। অথচ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলেও তরুণ নেতৃত্বের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

সব দিক বিবেচনায় তিনি না থাকলে তাঁর আদর্শকে বহন করতে পারবেন রাদওয়ান ববি। তাঁর হাতেই দেশ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত থাকবে। এই নেতা বাংলা ও বাঙালির আশার প্রতীক হবেন। ববি দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে সকলের বিশ্বাস। রাজনৈতিক দক্ষতা, দলীয় আনুগত্য ও পরিপক্বতা (ম্যাচিউরিটি) থাকায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ২০ তম সম্মেলন হওয়ার আগে দলীয় নেতাকর্মীরা জয় ও ববিকে দলের মূল ধারার রাজনীতিতে পুরোপুরি সক্রিয় দেখতে চেয়েছিলেন। তখন থেকেই তারা মনে করেন, আধুনিক প্রযুক্তিশীল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলকে এগিয়ে রাখতে তরুণ নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীপুত্র এবং শেখ রেহানাপুত্র দুজনই যোগ্য। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র হিসেবে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সকলে। অন্যদের দাবি সত্ত্বেও ২০১৬ সালে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত না হলেও দলের বিভিন্ন কাজকর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ববি।

বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক ধারা বহমান তা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি- এই তৃতীয় প্রজন্মের নতুন নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সকল আকর্ষণ এখন কেন্দ্রীভূত। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর বাংলাদেশে নেতৃত্বের বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। উপমহাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক ঐতিহ্য একটি ব্যাপক বিস্তারি প্রসঙ্গ। ভারতের দিকে তাকালে বর্তমান রাজনীতির পারিবারিক ধারা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়। জওহরলাল নেহেরু গান্ধীর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময় মোরালি দেশাইয়ের মতো অনেক যোগ্য নেতা থাকলেও ইন্দিরা গান্ধীই হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জুলফিকার আলী ভুট্টো, তাঁর কন্যা বেনজীর ভুট্টো, বেনজীরের স্বামী ও ছেলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা যেমন সত্য তেমনি শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় লক্ষণীয়। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকেই রাজনৈতিক মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত আবদুল জলিল, আবদুর রাজ্জাক, কামাল হোসেন প্রমুখ বড় বড় নেতারা দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনাকেই জনগণের সামনে দাঁড় করান। খালেদা জিয়া যেভাবে তারেক জিয়াকে রাজনীতিতে এনে দলের পদে সমাসীন করেছেন জয় কিংবা ববি’র জীবনে তেমনটি ঘটেনি। বরং জয় কিংবা ববি রাজনীতিতে নামতে পারেন ধরে নিয়ে ২০০৪ সালে ‘হাওয়া ভবনে’র মালিক তারেক জিয়াকে বিএনপি লুফে নিয়েছিল। জয় ও ববি বাংলাদেশের মৃত্তিকার সন্তান। তাঁদের রাজনীতিতে আসাটা আকস্মিক হলেও দলকে সংগঠিত করা, দলের কোন্দল মেটানো, দলকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ রাখা তাদের প্রধান কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় সবসময়।

রাদওয়ান ববি’র ভেতর রয়েছে বঙ্গবন্ধুর মতো জনগণের সঙ্গে মেশার তাগিদ। রয়েছে পরিশ্রমী ও তারুণ্যের প্রাণময়তা। এজন্য লন্ডন থেকে তাঁর এদেশে চাকরি নেয়া, রাজনীতিতে পরোক্ষভাবে যোগ দেয়া আমাদের জন্য শুভ সূচনা। দেশের মধ্যে যারা একসময় দুর্নীতি ও নাশকতার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তাদের মসনদ কেঁপে উঠেছে তাঁর কার্যক্রমে। তিনি মূলত বঙ্গবন্ধুর মতোই তরুণসমাজকে আশাবাদী করে জাগিয়ে তোলার জন্য কাজ করে চলেছেন। একসময় তাঁর মতো বয়সে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষকে জাগিয়েছিলেন; ববিও তেমনি নির্বাচনে জয়ী এবং ইশতেহার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দিতে সক্ষম। তাঁর ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধুর মতোই সম্মোহনী চেতনা স্ফুরিত হচ্ছে। তিনি এদেশে অবস্থান করেই মানুষকে উজ্জীবিত করছেন। বিএনপি-জামায়াতের গাত্রদাহের কারণ এজন্য যে ববি উচ্চশিক্ষিত এবং যে বাংলাদেশ করোনা মহামারি জয় করে উন্নত রাষ্ট্রের পথে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে তার পুরোভাগে তিনি আছেন।

আমাদের মতে, শেখ হাসিনা যেমন নির্লোভ, মানুষকে ভালোবাসেন নিজের অন্তর থেকে ববিকেও তেমনিভাবে এগিয়ে যেতে হবে। বিরুদ্ধ মানুষের মন জয় করতে হবে। এজন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে কাজে লাগাতে হবে। সাধারণ মানুষকে শেখ হাসিনা সরকারের কর্মসূচি ও সাফল্য বর্ণনা করতে হবে। অনেকে ভাবতে পারেন তিনি ব্রিটিশ সিটিজেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে শেখ রেহানা কিংবা শেখ হাসিনাও বিদেশে চলে যাবেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধু কন্যারা এই মাটি ও মানুষের নিকটজন সেহেতু ববিও তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন।

এদেশে বিএনপির মতো দলের অপপ্রচার মোকাবেলা ও সরকারের সফলতা জনগণের সামনে তুলে ধরতে ভিন্ন রকম কৌশলী হতে হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের নেতারা সারা দেশে সফর করে অপপ্রচারের জবাব দিতে পারবেন না। তাই বিরোধী দলের অপপ্রচারের জবাব দিতে দলীয় নেতাকর্মীদের উৎসাহ প্রদান করতে হবে। রাদওয়ান ববি’র নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতোমধ্যে তরুণদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমাদের তরুণদের সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যাশায় উজ্জীবিত করেছে। একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন-এ প্রচারিত অনুষ্ঠানে দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি নানা প্রসঙ্গে গঠনমূলক রাজনৈতিক কথা বলেছেন। তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের নতুন চিন্তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। যদিও তাঁকে তৃণমূল জনগণ সরাসরি রাজনৈতিক মঞ্চে দেখেনি, কেবল তাঁর কথা অনুসারে শিক্ষিত যুবসমাজ কাজ করছে। তবু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার মতো আন্তরিক হৃদ্যতায় সাধারণ মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। এর আগে তিনি দেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আত্মসুখ ত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধুর নাতি এবং শেখ হাসিনার পারিবারিক সূত্র ববিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ তিনি যে মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করতে এসেছেন তা বোঝা সহজ। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের পক্ষে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করাটাই স্বাভাবিক।

ববি’র মতো নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব আমাদের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবে। রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের পদচারণা আমাদের এগিয়ে চলার পথে বাড়তি প্রাপ্তি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে প্রতিবছর ভোটার তালিকায় তরুণ ভোটার আসছে প্রায় অর্ধ লক্ষ। প্রায় ১০ কোটি ২১ লাখ ভোটারের মধ্যে ৫ কোটি ভোটারের বয়স ৪০ বছরের নিচে। মোট ভোটারের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন প্রজন্মের। তাদের জন্য নতুন প্রজন্মের নেতা অনিবার্য। ববি এসব নতুন ভোটারদের প্রত্যাশার ভাষাকে ঠিকই বুঝতে পারেন। ভবিষ্যতে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আগামীতে আওয়ামী লীগের কমিটিতে দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি যথাযোগ্য মর্যাদায় তা পালন করতে সক্ষম হবেন।

এটা ঠিক যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ এখনো রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দল। এখানে অন্য কোনো দলের এতো শক্তি নেই যে তারা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সমান হতে পারে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের যে গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে তা অন্য কোনো দলের নেই। ববি সেই গৌরবকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যাবেন। মধ্যবিত্তের সন্তান বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের ফাঁসির ভয়কে উপেক্ষা করেছেন; জেল খেটেছেন মাসের পর মাস। সেই ত্যাগী নেতার নাতি হিসেবে ববিকে মনে রাখতে হবে, দেশের মূঢ়, মূক মানুষের মুখে দিতে হবে ভাষা। তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় নিয়েই। জাতির পিতা নিজের সন্তানকে (শেখ মনি, শেখ কামাল) রাজনীতিতে এনেছিলেন। আর তা ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পারিবারিক পর্যায়ে তিনি যা করেছিলেন তা ছিল দেশের স্বার্থে, মানুষের মঙ্গল চিন্তা করে। অনেকেই তাঁর বাকশাল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচারণ করেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেশের জন্য মমত্ববোধকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। ববি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচারে নিষ্ঠার পরিচয় দিবেন। 

এখন জনগণের প্রত্যাশা নতুন ও আধুনিক একটি বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। মহামারি-কবলিত বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলা করা এ শতাব্দীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজে জয়ী হওয়ার জন্য তরুণ জনগোষ্ঠীর নেতা রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি’র দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার। আগামী দিনের নেতৃত্বে মেধাবী, সৎ, ত্যাগী ও প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর তরুণদের সুযোগ দিলে দলের পাশাপাশি জাতি উপকৃত হবে। ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে দলকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। বিতর্কিত, দুর্নীতি ও পদবাণিজ্যে জড়িত, অযোগ্য ও সুবিধাবাদী প্রভাবশালী নেতাদের চেয়ে তরুণরা নিঃসন্দেহে বেশি অবদান রাখতে পারবেন। রাজনীতি স্থিতিশীল রাখা এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন গতিশীল করার জন্য ভালো নেতৃত্ব দরকার। আর দেশের কল্যাণের স্বার্থেই ববি’র মতো তরুণকে ক্ষমতায় দেখতে জনগণ উন্মুখ।

মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও শেখ রেহানার পুত্র ববি এগিয়ে এসেছেন মানুষের আকর্ষণে। শেখ হাসিনার মমত্বময় সান্নিধ্য তাঁকে রাজনীতির শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। তাঁর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী সমর্থক সকলেই খুশী হবেন। কারণ তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নেতৃত্ব ও উন্নয়নকে একইসঙ্গে আলিঙ্গন করতে হবে। ববি হঠাৎ আবির্ভূত নেতা নন। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর আছে দৃঢ়চেতা অভিভাবকবৃন্দ। যাঁরা সকল বিষয়ে সুপরামর্শ দিতে পারঙ্গম। কখনও পথ চলতে ছিটকে পড়লে শেখ হাসিনা পরামর্শ দিয়ে ঠিক পথে আনতে পারবেন তাঁকে। কারণ ববি একান্তই খালা অনুগত।

তবে নতুন প্রজন্মের কাছে দলের আবেদন বাড়াতে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে অনেককিছু করতে হবে। ছাত্রলীগ-যুবলীগকে গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে পরিকল্পনা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজে নামতে হবে। যোগ্য ও জনগণের নেতাকে কাছে টানতে হবে। দেশ-বিদেশের রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের কৌশলপত্র প্রণয়ন ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধিতে নিয়োজিত হতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে বাধ্যতামূলক প্রযুক্তিমুখী করতে হবে। মূল সংগঠন ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর দেশব্যাপী শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। সংগঠনের দুর্বলতা কাটানোর জন্য নেতাকর্মীদের নিয়ে সংকট উত্তরণের পথ আবিষ্কার করা খুবই জরুরি। শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনায় ববি যেমন তৎপর তেমনি নিজের নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা নিয়ে জনসমক্ষে হাজির হওয়া প্রয়োজন। আওয়ামী লীগের নতুন কাণ্ডারী রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। তাঁর বিজয়ী অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক।

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)


ববি   শেখ হাসিনা   বিশ্বস্ত   তরুণ প্রজন্ম   বঙ্গবন্ধুর দোহিত্র  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবরে গাফ্ফার ভাই সাংঘাতিক ভাবে ভেঙে পড়েন


Thumbnail

১৯ মে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যু দিবস। ২০২২ সালের আজকের দিনে তিনি আমাদেরর ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাঙালী এমন একজন সন্তান হারিয়েছে যার স্থান কোনদিন পূরণ হবে না। তাঁর সাথে আমার অনেক সময় আমার আলাপ হয়েছে। তার সবকিছু লেখা উচিত না, সম্ভবও না।

এক এগারোর সময় আমার ছেলে ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছিল। সেখান থেকে সে আমার এবং আমার স্ত্রীর নামে একটা দাওয়াত আয়োজন করে। কারণ এক এগারোর সময় আমার বিদেশের ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ না থাকলেও আমার একটা দায় ছিল যা হয়তো যেতে দেবে না। যখন আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিই তখন আমাকে একজন বুদ্ধি দিল যে আমার মেডিকেল ডকুমেন্টসগুলো যাতে আমি যেকোন মাধ্যমে পাঠিয়ে দেই। কারণ সাথে নিলে হয়তো আমাকে চেকআপ করতে হতে পারে। আমি সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র সুলতান সজিব ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর লন্ডনে যাওয়ার একদিন একটা রেস্টুরেন্টে গফ্ফার ভাই, সুলতান ভাই, আমি এবং মোকাম্মেল সাহেব একসাথে বসি। তখন আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে গাফ্ফার ভাই বললেন, বঙ্গবন্ধুর ছায়াতে যে কোন মানুষকেই খুব বড় মনে হতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারা শূন্য। তিনি আরও বিস্তারিত বললেন, যে যত বড় নেতাই হোন না কেন, যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর ছায়াতে থাকলে হয়, না হলে হয় না। অর্থাৎ এগুলো আসলে বঙ্গবন্ধুরই বুদ্ধি থেকে অংশ পায়। যেমন বর্তমানে আমরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সাথে মেশার পর অনেক কিছু জানি এবং আমাদের অনেকে সালামও করে। এই সালামটা আসলে তারা আমাদের না বঙ্গবন্ধুর কন্যাকেই দেই। শেখ হাসিনার সালামটা পাই আমরা। যদি দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একটু মুখ কালো করে আমাদের সাথে কথা বলে তাহলে পরেরদিন সালামের সংখ্যা কমে যাবে। এ হচ্ছে বাস্তবিকতা। এটা গফ্ফার ভাইয়ের সাথে আমার একটা শিক্ষা। 

আরেকটা বিষয় আমি বলি, বঙ্গবন্ধুর সময় তিনি (আব্দুল গাফফার চৌধুরী) বঙ্গবন্ধুর অভ্যুদয় নামে একটা বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করতো আমিনুল হক বাদশা এবং মোজাম্মেল আলীসহ আরও কয়েকজন মিলে। সেই পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধু একসময় আমাকে লোকের মাধ্যমে জানায় যে, লন্ডনে একটি বাড়ি কিনলে সে বাড়ির কিছু অংশ ভাড়া দিয়ে আমার চলে যাবে। কিন্তু তা আমার নামে কিনতে হবে যাতে সে সম্পত্তি চিরকাল আমাদের থাকে। আমাকে তখন এফআরসিএস করার জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পাঠিয়েছেন সেজন্য আমি তখন ব্যস্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে সেসময় আমার যোগাযোগ তো দূরের কথা, যারা এইসব খবর দিতে পারে তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ ছিল। শুধুমাত্র সুলতান শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। এবং আমি এ ব্যাপারে রাজি হলাম না। সুতরাং বাড়ি কেনা হয়নি। ঐ পত্রিকা থাকতে তখন  বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনা করে তিনি একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন সম্ভবত ১৯৭৫ সালের জুন মাসের দিকে। তখন এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়টি জানানো হলে, তিনি বললেন, ‘বাচ্চাটিকে পাঠিয়ে দে’। ঐ পত্রিকাকে বললো, ‘তোদের কাছে যে টাকা পয়সা আছে তাই দিয়ে ওকে একটা বিলেত থেকে পাঠিয়ে দে দেশে। তো উনি আসলো। কি আলাপ হলো সে ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। কিন্তু যাওয়ার কিছুদিন পর আরও একটি আর্টিকেল লিখলেন। তার মূল সুর হচ্ছে এই যে, বঙ্গবন্ধুকে বিপ্লবীরা ধ্বংস করার চেষ্টা করছে কিন্তু আমরা সকলে সেটা বুঝেও কিছু করতে পারছি না। মোটামুটি একটা একই রকম লেখা ১৯৭২ সালে শেখ ফজলুল হক মণি। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদেরকে ধ্বংস করা হচ্ছে।’ তবে তিনি খুব সন্তুষ্ট হননি। এটা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর শোনার সাথে সাথে গাফ্ফার ভাই সাংঘাতিক আকারে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। গাফ্ফার ভাইয়ের আঘাতটা আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের সকলের চেয়ে বেশি। যা তার পরবর্তী লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে। 

এক এগারোর সময় যখন তার সাথে আমার আলাপ হয় তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে অনেক কথায় বললেন। যে বঙ্গবন্ধুর ছায়াতলে অনেকে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু তিনি একটি কথা কখনো বলেনি যে, বঙ্গবন্ধু লোক চিনতে ভুল করেছেন বা এমন কিছু। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ষড়যন্ত্রদের যদি চেনা যায় তাহলে তো তারা ষড়যন্ত্র করত পারবে না। এবং ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রে মনে হতো যে, আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেক ষড়যন্ত্রকারী অবস্থান নিয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে তারা বড় ভূমিকা পালন করবে। বিদেশী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিলো, জিয়াউর রহমান সাহেবের ষড়যন্ত্র ছিলো। ভেতরের ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ে কিন্তু আওয়ামী লীগ এখনো সেইভাবে পর্যালোচনা করছে বলে মনে হয় না। 

আজ গাফ্ফার ভাই চলে গেছেন। অনেক কারণে চিরকাল তিনি মানুষের হৃদয়ে থাকবেন। তাঁর ভিতরে সবচেয়ে বড় যে কারণটি তা হলো, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো এ গানটির জন্য। কিন্তু এর সাথে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে কঠিন সময়ে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্লেষণ দিয়ে আওয়ামী লীগকে সবসময় কিভাবে ক্ষতি হতে পারে সে সম্পর্কে সতর্ক করতেন। সুতরাং আমার মনে হয় আজকে গফ্ফার ভাইয়ের কথা মনে করতে গিয়ে একথা বলতেই হবে যে, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কাছের প্রতিটি লোকও কিন্তু তার প্রমাণিত লোক এবং চিরকাল তাঁর সাথে থাকবে ব্যক্তিগতভাবে আমি তা বিশ্বাস করি না। বরং অনেক লোক যারা এর চেয়ে বিশ্বস্ত ছিল তারা আস্তে আস্তে নিভৃতে চলে যাচ্ছে। এবং অনেকে পৃথিবী ছেড়েই চলে যাচ্ছে। সুতরাং আমার মনে হয় এ বিষয়টি নিয়ে আমি বলবো, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনারও চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। আজকে গাফ্ফার ভাইয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগের একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে যেকোন সময় তিনি যেভাবে স্পষ্ট বলতেন সেই কারণের জন্য।

আব্দুল গাফফার চৌধুরী  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

উপজেলায় ভোটার কম কেন?


Thumbnail

#সবচেয়ে বেশি ক্ষেতলালে ৭৩ ভাগ
#শতকরা মাত্র ১৭ ভাগ মিরসরাইতে

১৩৯ টি উপজেলার মধ্যে ৩০টি উপজেলায় শতকরা ৩০ ভাগের কম ভোট পড়েছে। আর শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে মাত্র ২৩ টি উপজেলায়। সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে ইভিএমে ভোট নেয়া উপজেলাগুলোতে। ২০টি উপজেলায় ইভিএমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনোটিতেই ৫০ ভাগ ভোটও পড়েনি। ইভিএমে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে পাবনার সুজানগর উপজেলায়, শতকরা ৪৯.৭৮ ভাগ। এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আব্দুল ওয়াহাব, তার প্রাপ্ত ভোট ৬২ হাজার ৭৫২। নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী শাহীনুজ্জামান পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৪৪১। মাত্র ৪ হাজার ৩১১ ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ায় বলা যায় ভোটের লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। কারণ প্রথম ধাপের খুব কম উপজেলাতেই প্রতিদ্বন্ধীতামূলক নির্বাচন হয়েছে, অন্তত ভোটের ফলাফল তাই বলে। ইভিএমে সবচেয়ে কম শতকরা মাত্র ২২.৭০ভাগ ভোট পড়েছে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায়। এখানে বিজয়ী মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন পেয়েছেন ৪৭ হাজার ৮০৭ ভোট। আর মাত্র ৩ হাজার ৮২৩ ভোটে হেরেছেন মো. রাশেদ ইউসুফ। ভোটের লড়াই ভালো হলেও হতাশার ব্যাপার হচ্ছে এখানকার ৪ লাখ ৫৬ হাজার ২২২ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ৩ হাজার ৫৫৬ জন। কেন এতো কম ভোটার? প্রশ্নের জবাব কে খুজবে নির্বাচন কমিশন, দলীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক প্রার্থী না দিয়ে অংশগ্রহনকারী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নাকি অন্য কেউ ? দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষাথীরা কি গবেষণা করবেন?    

সবচেয়ে বেশি শতকরা ৭৩.১৬ ভাগ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট ক্ষেতলাল উপজেলায়। এখানে ৯৫ হাজার ১৯১ ভোটের মধ্যে পড়েছে ৬৯ হাজার ৬৩৯টি। জয়ী দুলাল মিয়া সরকার পেয়েছে ৩০ হাজার ৪০০ ভোট আর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী তাইফুল ইসলাম তালুকদার ২২ হাজার ৯০০ ভোট। এখানে তৃতীয় হয়েছেন সর্বশেষ উপজেলা চেয়ারম্যান মুস্তাকিম মন্ডল। যিনি পেয়েছেন ১৪ হাজার ৯২৮ ভোট। এই তিনজনই আওয়া লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নাকি আরেকজনও ছিলেন, নাজ্জাষী ইসলামের ভোট নাকি পেয়েছেন নামমাত্র ভোট,টেকেনি জামানতও। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো প্রার্থীরা ভোটারদের জয়ী দুলাল মিয়া ক্ষেতলাল পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর তাইফুল ইসলাম এর আগে ১৯৯০ ও ২১০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। মুস্তাকিম মন্ডল ২০১৮ সালে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এখানে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ ছিল, কারণ বর্তমান ও সাবেক দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেও দুলাল মিয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে প্রথম থেকেই। তিনি জয়ী হলেও অন্য দুজনও ভালো ভোট পেয়েছেন। টাকা খরচেও নাকি কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। এই এলাকার সাংসদ জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন প্রত্যক্ষভাবে কারো পক্ষে নেননি বলেই জানালেন জয়পুরহাটের দুজন সাংবাদিক। তবে প্রথম দিকে তার একজনের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন থাকলেও পরবর্তীতে দলের নেতাকর্মী বা ভোটারদের কোনো একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে তিনি এমপি হিসেবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। আর সুষ্ঠু ভোটের জন্য কয়েকজন প্রশংসা করলেন জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলমের। হায় অন্য উপজেলাগুলোতে এমন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে “ ভোটারহীন নির্বাচনের’’ অপবাদ সইতে হতো না। আওয়ামী লীগ প্রধান যে বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের কৌশল হিসেবে দলের নেতাদের মধ্যেই উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্ধিতামূলক করতে চেয়েছিলেন তাও সফল হতো, যদি প্রথম ধাপের নির্বাচনের মধ্যে ৭০ টির অবস্থা ক্ষেতলাল উপজেলার মত হতো। তবে উল্লেখ করতেই হয় ক্ষেতলালে ভোটের হার বেশি হলেও ভোটারের উপস্থিতি অনুযায়ী খুবই খারাপ ভোট হয়েছে একই জেলার আক্কেলপুর উপজেলায়। ভোট পড়েছে মাত্র শতকরা ১৯.৯৩ ভাগ। ১ লাখ ২২ হাজার ৮৪২ ভোটের মধ্যে ভোটার হাজির হয়েছিলেন ২৪ হাজার ৪৮৮ জন। যার মধ্যে মোকসেদ আলি মন্ডল ১৯ হাজার ৫৩৯ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রার্থী নুরন্নবী আরিফ ভোট পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৮৮। বলা যায় নূন্যতম প্রতিদ্বন্ধিতা হয়নি এখানে। এই জেলার অন্য একটি উপজেলা কালাইতে ভোট পড়েছে ৬৯.৭৫ ভাগ। 

এবার বলি সবচেয়ে কম, শতকরা মাত্র ১৭ ভাগ ভোট পড়া চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কথা। এখানে মোহাম্মদ এনায়েত হোসেন নয়ন ৩৩ হাজার ৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত, আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমান পেয়েছেন ২০ হাজার ৭৬৭ ভোট। এখানে আরো তিনজন চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। এদের মধ্যে ফেরদৌস হোসেন আরিফ ৩ হাজার ৪৩৪, উত্তম কুমার র্শমা ৩ হাজার ৩৪৬ এবং মোহাম্মদ মোস্তফা ৬৬৫ ভোট পেয়েছেন। এই উপজেলায় মোট ভোটারের সংখ্যা  ৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫৭টি । এই উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের এলাকা। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি নিজের ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেলকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য সুপারিশ করে দলের মনোনয়নে তাকে এমপি করতে পেরেছেন। তখন উপজেলা আওয়ামী লীগের যারা তার জন্য কাজ করেছেন তারা এবারের উপজেলা নির্বাচনে সরাসরি কোনো চেয়ারম্যান প্রার্থীর জন্য প্রচারে নামেননি। আর প্রতিদ্বান্ধতা হয়েছে যে দুজনের মধ্যে তাদের দুজনই চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা। এনায়েত হোসেন নয়ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আর শেখ আতাউর রহমান সাধারন সম্পাদক । তিনি কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একএম জাহাঙ্গীর ভূইয়ারি একটি বিতর্কিত বক্তব্য নির্বাচনে দারুণভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। স্থানীয় পত্রিকার খবর অনুযায়ী তিনি ২৯ এপ্রিল একটি সমাবেশে শেখ আতাউর রহমানের পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “ আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রিয়নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ‍সুযোগ্য সন্তান মাহবুব উর রহমান রুহেলকে জিতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোনো অপকর্ম ছাড়া ভোট কেন্দ্র খোলা রাখবো।’’ এই বক্তব্যের জন্য তাকে কেন্দ্র থেকে শোকজ করা হয়েছে। আবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর নিজেই উপজেলা নির্বাচনে আগ্রহী ছিলেন। স্থানীয় দুজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে বর্তমান সাংসদের পরোক্ষ সমর্থন নাকি ছিল এনায়েত হোসেন নয়নের পক্ষেই। ফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বুঝতে পারেনি দল কাকে চায়, আর যেহেতু দলীয় প্রতীকও ছিল না, তাই তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী ছিল না। আর মাঠের বিরোধীদল বিএনপি বর্জন করেছে, জাতীয় পার্টি উপজেলা নির্বাচনে থেকেও নাই। ফলে ৩ লাখ ৭২ হাজার ভোটারের মাত্র ৬৩ হাজার ২৬৬ ভোট দিয়েছেন মিরসরাইয়ের উপজেলা নির্বাচনে। 
কেন ভোটারের উপস্থিতি কম? তা নিয়ে কারো মাথা-ব্যাথা নেই। সাধারন মানুষের ভাবনা এমন যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তাদের ভোট দেয় না দেয়ায় কিছুই আসে যায় না। দেশের দুই বড় দলের একটি আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও তারা দলীয় প্রার্থী না দিয়ে উন্মুক্ত করেছে,দেয়নি প্রতীকও। বিএনপি আছে বর্জনে। জাতীয় পার্টি নিজেরাই বিপর্যস্ত। একটি পৌরসভায় স্থানীয় মানুষ যেভাবে তার সেবা পায়,উপজেলা পরিষদ থেকে নাগরিক সেবা কম,উন্নয়নের কাজও বেশি হয় ইউনিয়ন পরিষদে। ফলে ভোটারের আগ্রহ কম। তারই প্রতিফলন পড়েছে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোটে। এখন দেখা যায় দ্বিতীয় পর্বে কাল ২১ মে ভোটে কেমন ভোটার আসে ভোট কেন্দ্রে?


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

আমার চোখে দেখা ১৭ মে, ১৯৮১


Thumbnail

আমি ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেতে এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করার প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরি। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরার পরে তখন আমি একধরনের দোটানায় ছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। যার কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল তিনি নেই। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে আছেন, তারাও দেশে নেই। আমি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমি হাসপাতালে যাই, কাজ করি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা আমার কাছে আসতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ছাত্রলীগ ও বিএমএ’র জুনিয়র ডাক্তারদের সাথেই তখন আমার সময় কাটে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর নেতৃত্বে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আমার বাসায় আসতো। তাদের সাথে কথা বলে অন্তত পক্ষে এটা মনে হতো যে, ঠিকই দেশে ফিরেছি। কিন্তু তারপরও একটা অপূর্ণতার ভাব ছিল। 

শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় এবং ১৭ মে তিনি দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন দেশের ভেতরে বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় যা শুনতাম তাতে আমার নিজের মনে হতো, তিনি বোধহয় দেশে না আসলেই ভালো হতো। কারণ, আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তখন উৎপন্ন হয়েছিল। আর এই ধারণাটি ছিল, আসার সাথে সাথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে! তাই ভাবলাম অন্তত বিদেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বেঁচে থাকুক এটাই বড় কথা। কিসের রাজনীতি, কিসের কি? বঙ্গবন্ধু নেই। সত্যিকার অর্থে বলা চলে আমি একপ্রকার রাজনীতিবিমুখ ছিলাম তখন।
 
তারপর যখন ১৭ মে আসলো তখন আমি ভাবলাম, এয়ারপোর্টে যাই। এয়ারপোর্টে আমাকে একজন বুদ্ধি দিল, একটু দূরে গাড়ি রেখে হেটে যাওয়ার জন্য। আমি তাই করলাম। তখন প্রথমদিকে খুব বেশি লোকজন নজরে পড়েনি। কিন্তু যখন বিমান নামলো এবং নেত্রী শেখ হাসিনা বিমান থেকে নামলেন তখন চতুর্দিকে হঠাৎ দেখি লক্ষ লক্ষ লোক। আমার তখন চোখ দিয়ে তখন পানি। এখনও তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের প্রতি ভালোবাসা মানুষের যায়নি। 

এর আগে আমার মনে হতো যে, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আর স্বপ্ন দেখতে যদি কেউ ভুলে যায় তাহলে সে মানুষের বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমার সত্যিকার মানসিক অবস্থা তখন এমনই স্বপ্নহীন ছিল। স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন ভালোবাসা দেখে আমার তখন মনে হলো এই বুঝি আবার জীবিত হলাম। তখনও শেখ হাসিনার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি। কারণ সেই সময় তাঁর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। 

মানুষের ভিতরে যে ভাবাবেগ তা পরদিন মানুষের সঙ্গে মিশে বুঝলাম। তখন একটা সুক্ষ্ম মিল আমি খুঁজে পেলাম। তাহলো, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসেন, তখন আমরা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জনগণ যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, আমাদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণতা পেল। ঠিক তেমনি একটা ভাব আমার মনে হল। তখন মাত্র শেখ হাসিনা এসেছেন। শুধুমাত্র তাকে দেখার ফলে জনগণের মধ্যে একটা উজ্জ্বীবিত ভাব এলো। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতারা এদের সবার ভেতরে একটি গণজোয়ারের ভাব লক্ষ্য করা গেল। 

এত বছর পরে আজ আমি বলছি, সেদিন আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এই শেখ হাসিনা নেত্রী শেখ হাসিনা হবেন, দার্শনিক শেখ হাসিনাতে রূপান্তরিত হবেন। এবং তাঁর দর্শন দ্বারা বাংলাদেশে সোনার বাংলা হিসেবে গঠন করতে পারবে। সেদিন আমার মধ্যে আবেগ ছিলোৎ কিন্তু এই চিন্তাগুলো ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে তিনি কীভাবে দেশ গড়েছে তা সমস্ত লোকই জানে। সেই ১৭ মে যে জনসাধারণ তাকে একটু দেখবার জন্য গিয়েছিল, তাদের মনের ভাষা, মুখের ভাব এসব যদি অনুভব করা যায় তাহলে বোঝা যায়, সত্যি বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে সেদিন প্রবেশ করেছিল। এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শীতা এবং দার্শনিক ভিত্তির কারণে জনগণের আশা আকাঙ্খাকে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং বাংলাদেশকে আজ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার দারপ্রান্তে। 

সেই ১৭ মে’র কথা যদি চিন্তা করি, তখন অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে এতোদূর পর্যন্ত দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবে তা চিন্তা করিনি। এখন যেমন তিনি সমস্ত বিশ্বে নন্দিত বিশ্বনেতা। সেই তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সেই ১৭ মে’র কথা আজকে মনে পড়ে। আমি প্রার্থনা করি দার্শনিক শেখ হাসিনাকে যেন সৃষ্টিকর্তা ভালো রাখেন এবং দেশ গড়ার সুযোগ যেন তিনি অনেকদিন পান।  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন