কালার ইনসাইড

আজ ২১ সেপ্টেম্বর এবং স্মৃতিতে বাকের ভাই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 21/09/2021


Thumbnail

বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে আর কোনো নাটক কি মানুষ এতটা ভালোবেসেছিল? ভালোবেসেছিল আর কোনো নাটকের চরিত্রকে? চরিত্রটা আসলে কার? একজন পাড়ার চালচুলোহীন মাস্তান বৈ তো বাকের আর কিছু ছিল না। কিন্তু এই বাকেরকেই মানুষ হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিল। মুনার কষ্টের চোখের পানি ঝরেছিল মানুষের চোখেও। আত্মার ক্রন্দনে ক্রন্দসী এই জাতি চেয়েছিল বাকের ভাইকে যেন আবারও ফিরিয়ে আনা হয়।

শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট হুমায়ূন আহমেদ তখন আত্মগোপনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসার সামনে রোজ মানুষ মিছিল করে যাচ্ছে। তাদের দাবি একটাই, প্রাণপ্রিয় বাকের ভাইকে ফাঁসি দেয়া যাবে না কোনোমতেই। আজ ২০২১ সালে এসে আমাদের ভাবতেও কষ্ট হয়, নাটকের একটা চরিত্রকে মানুষ কতটা ভালবাসতে পেরেছিল ৯০ এর দশকে।

কোথাও কেউ নেই নাটকটার সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালে। শুরু থেকেই দর্শকপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে এসেছিল সেটি। চিত্রনাট্য আর পরিচালনা, দুটোই ছিল হুমায়ূন আহমেদের। নাটক যতো এগিয়ে যেতে থাকলো, দর্শকেরা ততই পছন্দ করে ফেললো কেন্দ্রীয় চরিত্র বাকের ভাইকে। আসাদুজ্জামান নূর অভিনীত এই চরিত্রটা সম্ভবত বাংলাদেশের টিভি ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। বাংলা সিনেমাতেও কি বাকের ভাইকে টেক্কা দেয়ার মতো শক্তিশালী কোন চরিত্র তৈরি হয়েছে?

হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দোপাট্টা মাল মাল- গানটি তখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। পাড়ার দোকানে, চায়ের কাপের আড্ডায়, স্কুল-কলেজগামী কিশোরদের মুখে তখন প্রেয়সীদের মুখের সলজ্জ হাসি দেখবার জন্য এই গানের কলি। জনপ্রিয় করেছিল কে? আমাদের প্রিয় বাকের ভাই। আসাদুজ্জামান নূরকে তখন কেউ নূর হিসেবে জানতো না। তাকে চিনতো বাকের ভাই নামেই। এই চরিত্রটা এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল যে, আসাদুজ্জামান নূর যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে নীলফামারী-২ আসন থেকে নির্বাচন করেছেন, তখন তার কর্মীরা বাকের ভাইয়ের নামে ভোট চেয়েছে, নূরের নামে নয়!

বাকের ভাইয়ের জন্য মুনা যতটা কেঁদেছে, ততটাই কেঁদেছে এই দেশের আপামর তরুণীরা। এই দেশের তরুণীরা তখন মুনা হতে চাইতো, বাকের ভাইয়ের মতো কাউকে ভালোবাসতে চাইতো। শক্তিশালী অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা গল্পের মুনাকে যেন পর্দায় সত্যিকার অর্থেই প্রাণ দিয়েছিলেন।

আরেকজনের কথা না বললেই নয়- হুমায়ূন ফরিদী। এই নাটকের সবচেয়ে শক্তিশালী সংলাপগুলো সম্ভবত তার মুখ থেকেই বেরিয়েছে। সাদা আর কালোর মাঝামাঝি অদ্ভুত এক ধূসর রঙে রাঙা চরিত্র তার, শেষদিকে আদালতে বাকেরকে বাঁচানোর জন্যে তার আপ্রাণ চেষ্টাটা মনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল দারুণভাবে।

বাকের ভাইকে যখন ফাঁসি দেয়া হবে, তখন ঘটলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রিয় চরিত্রের ফাঁসি হয়ে যাবে, এটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। হুমায়ূন আহমেদের শহীদুল্লাহ হলের বাড়িতে পাঠানো হলো উড়ো চিঠি, প্রেসক্লাবের সামনে হলো মানববন্ধন। ঢাকার বাইরেও মিছিল বের হলো, স্লোগান উঠলো- ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন, কুত্তাওয়ালী জবাব চাই’, ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে…’

অবস্থা বেগতিক দেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিটিভিতে ফোন গেল। প্রযোজক বরকতউল্লাহ খানকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নিজে অনুরোধ করলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদকে বলুন, নাটকের শেষে বাকেরকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কিনা।’ বরকতউল্লাহ খান ফোন দিলেন হুমায়ূনকে, তিনি রাজী হলেন না। হুমায়ূন বিশ্বাস করেন লেখকের স্বাধীনতায়, পরিচালকের স্বাধীনতায়। সেই জায়গা থেকে তিনি ভেবে রেখেছেন বাকেরের ফাঁসির কথা, মানুষের দাবীর মুখে তিনি তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন না।

সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে কোথাও কেউ নেই এর শেষ পর্ব প্রচারিত হবার কথা, ঢাকা শহরে এর আগেই অবশ্য গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। আগের পর্বে বদি (আবদুল কাদের) কুত্তাওয়ালীর হুমকিতে বাকেরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজী হয়ে গেছে। ১৪ তারিখে শেষ পর্ব প্রচারিত হলো না, কারণ সেই পর্বের শুটিংই শেষ হয়নি! পরে হুমায়ূন আহমেদ অজানা এক লোকেশনে শেষ করলেন শুটিং, একদম গোপনে।

পরের সপ্তাহে, সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে শেষ পর্বটা প্রচারিত হলো। সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকার অবস্থা থমথমে, জেলা শহর আর মফস্বলের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ, ভূতুড়ে রূপ নিয়েছে সেগুলো, যেন কারফিউ চলছে! হুমায়ূন আহমেদ নিজের বাসা ছেড়ে আত্মগোপনে গিয়েছেন আবদুল কাদেরকে নিয়ে, কাদেরের বাসায় হামলা হয়েছে এর আগে, প্রাণভয়ে তিনি থানায় জিডি করেছেন। নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো।

এরপরের গল্পটা তারা জানেন, নব্বইয়ের সেই গুমোট রাতে যারা বিটিভির পর্দায় কোথাও কেউ নেই নাটকের শেষ পর্বটা দেখেছিলেন, যারা সাক্ষী হয়েছিলেন মুনার কান্নার, অসীম শূন্যতার এক বোবা অনুভূতি তাদের ঘিরে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। ভোররাতে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মুনা কাঁদিয়েছেন হাজারো দর্শককে। আপনি আসামীর কি হন?- জেলারের এই প্রশ্নের প্রশ্নের জবাবে মুনা যখন বলছেন, ‘আমি ওর কেউ না’- তখন চোখের জল আটকে রাখতে পেরেছেন হাতেগোনা কয়েকজন দর্শকই।

আজ ২১ সেপ্টেম্বর, কোথাও কেউ নেই নামের একটি নাটক এদেশে প্রচারিত হয়েছিল। মানুষ বাকের ভাইয়ের জন্য কেঁদেছে, কেঁদেছে তার প্রয়াণে। কিন্তু মন থেকে এই চরিত্রটিকে মুছে ফেলতে পেরেছে কি? মনে হয় না। বাকের ভাই চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের আপামর নাট্যপ্রেমীদের মননে।  

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭