ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

চীনে উইঘুর গণহত্যা ও পূর্ব তুর্কিস্তানের স্বাধীনতা দিবস


প্রকাশ: 12/11/2021


Thumbnail

চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ জিংজিয়াং বা শিনচিয়াং। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট চীন সরকার প্রদেশটিকে শিনচিয়াং প্রদেশ নামে ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটি চীনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রদেশটির মূল জনগোষ্ঠী হল উইঘুর মুসলিমরা। উইঘুররা প্রধানত তারিম অববাহিকা এবং তাকলামাকান মরুভু্মির নানা মরূদ্যানে বসবাসকারী তুর্কি বংশোদ্ভূত কৃষিজীবী মানুষ। যারা এই অঞ্চলটিতে প্রায় ৪০০০ হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে। কিন্তু কমিউনিস্ট শাসিত গণচীন সরকার প্রদেশটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে উইঘুর মুসলমানদের উপর যেনো এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। 

প্রদেশটিতে বর্তমানে ৪৫শতাংশ উইঘুর ও ৪০শতাংশ চীনের প্রধান ভাষাভাষী সম্প্রদায় হানগোষ্ঠীর বসবাস। চীন সরকার প্রদেশটিতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে আস্তে আস্তে চীনের অন্যান্য অঞ্চল থেকে হান গোষ্ঠীর মানুষদের এই অঞ্চলে স্থানান্তরের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। হানদেরকে ভালো কাজ ও বেশি বেতন দিয়ে এই অঞ্চলে স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। যার ফলে দিন দিন এই অঞ্চলের প্রধান জনগোষ্ঠী উইঘুররা সংখ্যা লঘিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। 

উইঘুর সংস্কৃতির সাথে মূলত টার্কিশ সংস্কৃতি দৃঢ় মিল বন্ধন রয়েছে। চীনারা মনে করে ইসলামের ছায়া তলে এসে উইঘুররা নিজেদের কলুষিত করে ফেলেছে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে খ্রিষ্টাব্দ নবম-দশম শতক থেকে উইঘুররা ইসলাম ধর্মে দীক্ষায়িত হওয়া শুরু করে। বর্তমান চীনা শাসকদের আগে থেকে চীনা রাজবংশের সাথে উইঘুরদের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিলো। চীনা রাজবংশও উইঘুরদের উপর জোর পূর্বক নিজেদের শাসন ব্যবস্থা জারি করে রেখেছিলো যা বর্তমানে এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। 

পূর্ব তুর্কিস্তান

পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলন অথবা উইঘুর স্বাধীনতা আন্দোলন এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন যার প্রধান লক্ষ্য চীনের শিংচিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে উইঘুর জাতির জন্য এক স্বাধীন দেশে পরিণত করা যার নাম হবে "পূর্ব তুর্কিস্তান"। তবে চীন সরকার পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে যেকোনো সমর্থনকে "জঙ্গিবাদ,সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের" অংশ বলে মনে করে। যারা এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হতে ইচ্ছুক কিংবা যুক্ত তাদের চীন সরকারের পক্ষ থেকে ‘ডিটেনশন সেন্টারে’ পাঠিয়ে শুদ্ধি করণ করার নামে ভয়ানক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আন্দোলন উইঘুররা বিংশ শতকের শুরু থেকেই চালিয়ে আসছে। উইঘুরদের এই আন্দোলনকে মোট দুটি সময়ের নিরিখে ভাগ করা যায়। 
১. চীন প্রজাতন্ত্রের অধীনে: এই সময়টা বিংশ শতকের শুরুর দিকের। তবে উইঘুরদের এই প্রচেষ্টা খুব বেশি দিন স্থায়ী রূপ পায় নি। `প্রথম পূর্ব তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র` (বা তুর্কি ইসলামি পূর্ব তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র) যার স্থায়ীত্ব ছিল ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত। কাশগরের বেশ কিছু অঞ্চল উইঘুররা দখলে নিলে চীন সেনাবাহিনী কাশগারের প্রথম যুদ্ধ(১৯৩৩) ও কাশগারের দ্বিতীয় যুদ্ধে(১৯৩৪) জয়ী হবার পর এই প্রজাতন্ত্রকে পুনরায় চীনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। 

২. দ্বিতীয় তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র: নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্রের আন্দোলন আবারো বেগ পায় যখন চীন প্রজাতন্ত্র নিজেদের শেষ সময়ে  চাইনিজ কমিউনিস্ট দের সাথে গৃহযুদ্ধে ব্যস্ত ছিল। ঠিক সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন শিনচিয়াং আক্রমণ করে এবং ইনিং শহর বিদ্রোহ ঘটাতে সাহায্য করে। এই বিদ্রোহের ফলে `দ্বিতীয় তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্রের` (১৯৪৪-১৯৪৯) সৃষ্টি হয় যা শিনচিয়াং এর উত্তরের তিনটি জেলায় সীমাবদ্ধ ছিল (ইলি,তারবাগাতাই,আলতাই)। নতুন গঠিত রাষ্ট্রটি গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য পেত। তবে ১৯৪৯ সালে গৃহযুদ্ধে জয়ের পর গণচীনের `লিবারেশন আর্মি`,শিনচিয়াংকে পুনরায় চীনে অন্তর্ভুক্ত করে।

জিংজিয়াংর বর্তমান পরিস্থিতি 

গণচীন জিংজিয়াংর পূর্ণ দখল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রদেশটিতে এক অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে চীন সরকার। জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ততা ও নানা ঠুনকো অভিযোগে উইঘুর মুসলিমদের আটক করছে চীনা সরকার। তবে এই পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নেয় যখন চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং ২০১৩ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হান সম্প্রদায়ের মানুষদের জিংজিয়াং্যে প্রবেশ আরো তীব্র থেকে তীব্র করা হয়। উইঘুর মুসলিম নারী ও পুরুষদের সংশোধনের নামে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে তাদের উপর তীব্র শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হচ্ছে। প্রদেশটিতে বিদেশি লোক বিশেষ করে কোন ধরণের সংবাদ কর্মীদের প্রবেশে কড়া বিধি নিষেধ আরোপ করা আছে। যদিও কিছু কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম কর্মীরা সেখানে প্রবেশের সুযোগ পেলেও তাদের প্রতিনিয়ত নজরদারির আওয়ায় রাখা হয়। 

গণমাধ্যম কর্মীরা চীনের প্রদেশটিতে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারলেও তারা সেখানে চীনা সরকারের অতিরিক্ত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উইঘুর মুসলমানদের উপর নজর রাখার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। প্রদেশটির প্রতিটি রাস্তায় পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি সিসি টিভি ক্যামেরার ব্যবহার, উইঘুর মুসলিমদের বাড়িতে বাড়িতে নজর রাখার জন্য কিউআর কোড স্ক্যান ও নানা অবৈধ কার্যক্রমের চিত্র সারা বিশ্বের কাছে সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইন্সটিটিউট (এএসপিআই) তার জিনজিয়াং ডেটা প্রজেক্ট প্রকাশ করে। যেখানে প্রদেশটিতে ৩৮০টির বেশি উইঘুর মুসলিমদের জন্য ডিটেনশন সেন্টার বা বন্দি শিবির এবং আটক কেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে আর এমন দাবি করা সত্ত্বেও ক্যাম্প নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। 

এইসব ক্যাম্পে নারীদের উপর ভয়াবহ রকমের শারীরিক নির্যাতনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। কোন কারণ ছাড়াই উইঘুরদের আটক করে ক্যাম্পে সংশোধনের নামে আটকে রাখা হচ্ছে। বন্দি শালা গুলো থেকে মুক্তি পাওয়া অনেক উইঘুর বাসিন্দা তাদের উপর ভয়াবহ নির্যাতনের কথা পশ্চিমা গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরতে শুরু করেছে। তাদের মতে চীন সরকারের হাতে ঐসব বন্দি শিবিরে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার উইঘুর জনগোষ্ঠী মৃত্যু বরণ করেছে যা একপ্রকার গণহত্যার শামিল বলছে পশ্চিমা দেশগুলো। তবে পশ্চিমা দেশগুলোর এমন অভিযোগ প্রতি মুহূর্তে মিথ্যা বলে নাকচ করে দিচ্ছে চীন সরকার। তাদের মতে এইসব ক্যাম্পে শুধু মাত্র অভিযুক্ত অপরাধীদের কেই নিয়ে গিয়ে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার কার্যক্রম তারা পরিচালনা করে আসছে। অনেক পশ্চিমা দেশের মতে প্রায় ৪০০মত বন্দি শিবিরে কম পক্ষে ১০ লক্ষের উপর উইঘুর মুসলিমদের বন্দি করে রেখেছে শির সরকার। 

আর এই প্রেক্ষিতে চীনের বিরুদ্ধে শিনচিয়াং এর উইঘুরদের আটকে রাখা ও "পুনঃশিক্ষাদান" এর নামে উইঘুর সম্প্রদায়ের ধর্ম,সংস্কৃতি,ভাষা এবং পরিচিতিকে মুছে ফেলার অভিযোগ ওঠায় পূর্ব তুর্কিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে। নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের যে চিন্তা উইঘুর মুসলিমরা শতাব্দী ধরে লালন করছে তা যেন নতুন রূপ পাচ্ছে চীন সরকারের এমন আচরণে। পূর্ব তুর্কিস্তান আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সংহতিটি প্রকাশ পায় যখন ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৪ তারিখে ওয়াশিংটন ডিসি-তে বিশ্বজুড়ে উইঘুর, কাজাখ এবং উজবেক পূর্ব তুর্কিস্তানই স্বাধীনতা কর্মীদের একটি দল দ্বারা নির্বাসিত পূর্ব তুর্কিস্তান সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে সারা বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলন একটি ভিন্ন মাত্রা পায়। তবে প্রথম পূর্ব তুর্কিস্তান প্রথম সরকার গঠিত হয় ১২ নভেম্বর ১৯৪৪ সালে। সেই সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আলিহান তরে। সেই দিনটি হিসেবে সারা বিশ্বে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করার জন্য প্রতি বছরের ১২ নভেম্বর পালন করা হয় পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীনতা দিবস।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭