ইনসাইড পলিটিক্স

ঐক্যের মহাজোটে অনৈক্যের সুর?


প্রকাশ: 07/12/2021


Thumbnail

আওয়ামী লীগের জোটের রাজনীতি একাধিকবার রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা ছাড়ালেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সেই জোটগুলোতেই অনৈক্য দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে নির্বাচনী জোট-মহাজোট ও আদর্শিক জোট ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর সাথে দূরত্ব বাড়ছে ক্ষমতাসীন দলটির। একদিকে মহাজোটে থাকা জাতীয় পার্টি হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছে। পাশপাশি ক্যাসিনো কাণ্ডের পর রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কাস পার্টিও বলছে যে, তারা আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবে না। এছাড়া মন্ত্রীত্ব না পাওয়া নিয়েও ক্ষোভ আছে কয়েকটি শরিক দলের মধ্যে। শরিক দলের নেতাদের এ অবস্থান এবং বক্তব্যের কারণে জোটে অনৈক্যের বিষয়টি বারবার প্রকাশ্যে আসছে এবং একই সঙ্গে জোটে অস্থিরতারও বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
 
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বক্তব্য কিংবা জাপার নতুন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিভিন্ন বক্তব্য মহাজোটসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে গত তিন ডিসেম্বর জিএম কাদের বলেছেন, ‘দেশে এখন আর সুশাসন নেই। ১৯৯১ সালের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের সঙ্গে কথা রাখেনি। দেশের মানুষ এক বুক প্রত্যাশা নিয়ে জাতীয় পার্টির দিকে তাকিয়ে আছে। তারা আবারও জাতীয় পার্টিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায়।’ পাশাপাশি মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন ‘জাপার সঙ্গে প্রেম করে আওয়ামী লীগ তিনবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। এখন তারা আমাদের উপর নির্যাতন করছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর কোন প্রেম নেই আমাদের।’ জাপার শীর্ষ এ দুই নেতার বক্তব্যগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে নানারকম চিন্তার উদ্রেক করেছে। ১৪ দলের শরিক দলগুলোর নেতারা এখন বলতে শুরু করেছে যে 'সরকারের ব্যর্থতার দায় নেবে না ১৪ দল।' এছাড়াও কমপক্ষে চারটি শরিক জোটের কার্যক্রমে যুক্ত থাকার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বলে জানা গেছে। 

এই চার শরিকের মধ্যে জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ জাসদ অনেক আগে থেকেই জোটের সভা ও বৈঠকগুলো বর্জন করে আসছিল। প্রকাশ্যে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচক হিসেবে পরিচিত এই দলটি কোনোরকম ঘোষণা ছাড়াই জোটগত কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। পাশাপাশি এই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে অন্য তিন শরিক বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং কমিউনিস্ট কেন্দ্র- এর নাম। এর সঙ্গে রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কাস পার্টি অনেক আগেই বলেছে যে, সামনের জাতীয় নির্বাচনে তারা নৌকা প্রতীকে নয়, একা একা লড়বে। জাপা নেতাদের এ ধরনের বক্তব্যের পাশাপাশি অন্যান্য শরিক দলগুলোর নেতিবাচক মনোভাবের প্রেক্ষিতে অনেকেই আগামীতে এসব দলগুলোর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা না থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন।

অনৈক্য যেভাবে শুরু 

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২৯৩টি আসনে জয় লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। সরকার গঠন করলেও শরিক দলগুলো থেকে কাউকেই মন্ত্রী করা হয়নি। এবারই প্রথম একক মন্ত্রীসভা গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। সেই থেকে জোটের ভেতরে গৃহদাহ শুরু। নতুন সরকারে জোটের কেউ স্থান না পাওয়ায় তাদের অবস্থান বদলাতে শুরু করে। সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জোট শরিকদের সংসদে শক্তিশালী বিরোধী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হলে সেসময় শরিক নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু অভিন্ন সুরে বলেন, একসঙ্গে জোট করেছি, একসঙ্গে নির্বাচন করেছি, বিরোধী দলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এমনকি সরকার গঠন নিয়ে বা জোট শরিকদের ভূমিকা কী হবে তা নিয়েও তাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি বলেও তারা দাবি করেন। এখান থেকে সংকটের শুরু হয়েছে কিনা, সে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানারকম বিতর্ক আছে। এসব পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে জোটে অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।  

অনৈক্যর সমাধান হচ্ছে না যে কারণে 

প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম ১৪ দলের সমন্বয়ক থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ১৪ দলের জোটকে জিইয়ে রাখতেন। কিন্তু তিনি গত বছরের ১৩ জুন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর আমির হোসেন আমুকে ১৪ দলের সমন্বয়ক করা হয়। আমুর সমন্বয়ে এখন পর্যন্ত দু-একটি মিটিং হয়েছে মাত্র। বর্তমানে ১৪ দলের কর্মকাণ্ড একেবারেই স্থবির, নেই বললেই চলে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও সম্পৃক্ত করা হয় না ১৪ দলকে। 

তবে শরিক দলের নেতাদের কটু বক্তব্যের প্রভাব মহাজোট বা ১৪ দলীয় জোটে পড়বে না বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতৃত্বস্থানীয় একাধিক নেতা বলেছেন, জোটের মধ্যে কোনো সংকট নেই, সবাই ঐক্যবদ্ধ আছেন। প্রত্যেকটি দল আলাদা আলাদা রাজনীতি করে। তাদের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনাও আলাদা। আমাদের জোট দুইটি হয়েছে আদর্শ এবং নির্বাচনী ভিত্তিতে। এ দুইটি জায়গা এখনো মজবুত আছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, ১৪ দল অথবা মহাজোট যাই বলেন না কেন, এটি মূলত একদল। বাকি দলগুলোর কোনো ভূমিকা নেই। ফলে মহাজোট অথবা ১৪ দল ভাঙারও কোনো সম্ভাবনা নেই। আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাকি দলগুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে অবগত আছে। ওদের জন্য এটা স্বার্থের জোট। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে আওয়ামী লীগেরও একটা লাভ আছে। আওয়ামী লীগ বলতে পারে তারা একা নয়, তাদের সঙ্গে আরো অনেক দল আছে। এছাড়া অন্য কোনো নীতি নির্ধারণী বিষয়ে আওয়ামী লীগের কাছে তাদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। ফলে জোটের শরিকরা জোটে থাকলে এমপি হতে পারে। ক্ষমতা পাওয়া যায়। তাছাড়া রাজনীতি তো এখন একটি ব্যবসা। ফলে জোটভুক্ত অন্যান্য দলগুলো ওই ব্যবসাটাই করছে বলেই মনে করেন তিনি।

জাতীয় পার্টির দুই শীর্ষ নেতার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বদিউল আলম মজুমদার বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, সরকার যদি কর্তৃত্ববাদী হয়ে থাকে, জাতীয় পার্টি কি এর দায় এড়াতে পারে? তার দায় জাতীয় পার্টিরও নিতে হবে। বিরোধী দল হয়ে তারা গৃহপালিত বিরোধী দলের আচরণ করছে। তারাও কম দায়ী না। তারাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করে নাই। সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব হলো সরকারের ভুল ত্রুটি তুলে ধরা। সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এই প্রেমের জন্য সরকারি দল যেমন দায়ী, তারাও সমান দায়ী বলে মনে করেন তিনি।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭