ইনসাইড থট

আমলাতন্ত্রের দৌরাত্মে কোণঠাসা দেশ ও জাতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ২৫ জুলাই, ২০২১


Thumbnail

বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধান এদেশের জনগণকে দেশের মালিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। অনুচ্ছেদ ২১ এর (১) বলা আছে- সকল সময়ে জনগণের সেবা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। গণতান্ত্রিক বিধান অনুযায়ী সরকার ও তার প্রশাসন দেশের জনগণের সেবার উদ্দেশ্যেই তাদের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করবে। মানুষের জান ও মালের ওপর কর্তৃত্ব করা নয়, বরং জনসাধারণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করাই সরকার ও তার প্রশাসনের কাজ। কিন্তু বর্তমান অভিজ্ঞতার চিত্র পুরো উল্টো। মালিক আজ নেমে গেছে কর্মচারী-শ্রমিকের কাতারে। উপনিবেশিক রাজত্বের মতো যেন কর্মচারী বনে গেছে যেন দেশের মালিক। জনসাধারণের ওপর কর্তৃত্বপরায়ণ প্রভুর মতোই ছড়ি ঘোরাচ্ছে তারা সব সময়। জনগণ শুধু নয়, খোদ সরকারও অনেকটা যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে তাদের কাছে।

বলছি, দেশে চলমান আমলাতন্ত্রের আগ্রাসী অবস্থার কথা। আমলাদের সীমাহীন দৌরাত্মে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে যেন সবাই। সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ে আমলাতন্ত্রের দাপটে চারদিকে তৈরি হয়েছে চরম হতাশা। শোনা যায়, অনেক সচিবই মন্ত্রীদের গুরুত্ব দেন না (!)। সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের মতো করে। এমন একটা ভাব নিয়ে চলাফেরা করেন তারা যে, মন্ত্রী যাবেন, মন্ত্রী আসবেন, কিন্তু তাদের ক্ষমতার কোনো কমতি হবে না তারা চিরস্থায়ী জমিদার সরকারী কর্মচারী। বরং দিনকে দিন পদ-পদবী আরো বাড়বে তাদের। বাড়বে আরো কর্তৃত্ব। উপেক্ষিত মন্ত্রী, এমপি ও জনপ্রতিনিধি দুঃখ করেন রাজনৈতিক মহলে। সচিবদের দৌরাত্মের কাছে যেন এক প্রকার অসহায় তারা। তাদের ক্ষমতা শুধুমাত্র সরকারী কর্মচারীদের কাছে তদবির করার মধ্যে সীমিত।

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের মতো মাঠ পর্যায়েও কর্মরত অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা করেন না। সরকারের ভেতর তারা যেন সেজে বসেছে আরেক সরকার। তাদের ইচ্ছে ও অনুগ্রহ ছাড়া যেন কিছুই হয় না। জনপ্রতিনিধিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে কেউ কেউ অতি উৎসাহ নিয়ে যোগ দেন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে। অনেক কর্মকর্তাই নিজের অতীত রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রশাসনিক ক্ষমতার সাথে সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রদর্শন করে নিজের কর্তৃত্ব আরো বাড়িয়ে নিতে চান। তারা আচরণে, কার্যক্রমে চলেন রাজনীতিবিদদের মতো করে। আমলাদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদর্শন করার কারণে মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়ররা অনেক সময় নিজের কর্মীদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। অথচ এদেশের সংবিধান সেই ক্ষমতা বা অধিকার কোনটাই দেয়নি আমলাদের।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য (২) দফায় বলা হয়েছে: ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমলারা জনগণের সেবা করার পরিবর্তে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টায় মরিয়া সব সময়। নিজেদেরকে তারা সব সময়ই সাধারণ মানুষের তুলনায় সুপেরিয়র মনে করে। সাধারণ জনগণকে বাধ্য করে তাদেরকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে। অথচ দেশের মালিক সাধারণ এ জনগণের পকেটের টাকাতেই তাদের বেতন হয়, স্ত্রীর শাড়ি-গয়না হয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ হয়। কর্মচারী হিসেবে দেশের মালিক জনগণকে যেখানে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার কথা তাদের, সেখানে নিজেরাই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ববলে স্যার সেজে বসে থাকে। শুধু বসেই থাকে না, চারপাশ নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাপকভাবে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে একজন ইউএনও’র কার্যক্রমে দেশবাসী হতবাক হয়েছে। মাহামরি করোনার এ চলমান সংকটকালে অভাবে পড়ে ফরিদ আহমেদ নামের একজন লোক সরকারি তথ্যসেবা নাম্বার ৩৩৩ এ কল করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন। ইউএনও সাহেব খাদ্য নিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছেও ছিল। কিন্তু লোকমুখে উক্ত ব্যক্তির একটি বাড়ি আছে, এমন কথা শোনার সাথে সাথে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ইউএনও সাহেব। খাদ্য সহায়তা তো তাকে করলেনই না, উল্টো ১০০ জনকে তার খাদ্য সহায়তা দিতে হবে মর্মে জরিমানা ঘোষণা করলেন কোনোরকম যাচাই বাছাই ছাড়াই! খাদ্যের অভাবে পড়া লোকটি বাধ্য হয়ে স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে সুদের ওপর টাকা তুলে ষাট হাজার টাকা খরচ করে চোখের পানি মুছতে মুছতে সেই জরিমানা পরিশোধ করলেন। হ্যাঁ, বাড়ি তার একটি রয়েছে বটে। তবে সে বাড়ির মালিক তিনি একা নন। ভাইবোনদের সাথে এজমালি মালিকানা রয়েছে তার বাড়িটির ওপর। মাত্র তিনটি কক্ষের ওপর মালিকানা তার। তিনি একটি হোসিয়ারী ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে চোখ খারাপ হয়ে যায় এবং বিভিন্ন রোগের কারণে এখন ঠিকমত কাজ করতে পারেন না। এখন প্রায় মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করেন। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলমান করোনা সংকটের কারণে ব্যবসাপত্র বন্ধ থাকা কাজ হারিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঘরে বসেছিলেন তিনি। নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই সরকারি সহায়তা নম্বরে কল দিয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার মতো এত সময় ও ধৈর্য ইউএনও মহোদয়ের কোথায়! বাড়িওয়ালা শুনেই তিনি জরিমানা করে বসলেন! অথচ এভাবে ১০০ জনকে খাদ্য বিতরণের নির্দেশ দেওয়ার মতো অধিকার দেশের আইন তাকে দেয়ই না। বিষয়টা নিয়ে সারা দেশে যখন নানারকম আলোচনা সমালোচনার জন্ম হলো, তখন করা হলো একটি তদন্ত কমিটি। জেলা প্রশাসনের করা সেই কমিটি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরাকে দায়মুক্তি দিয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বার আইয়ুব আলীকে দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিলো। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে কাকে বলে আর। অন্যায় জরিমানাটা করলেন ইউএনও সাহেব আর এর জন্য দায়ী করা হলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি সদস্যকে!তাকে অভিযুক্ত করা হলো, তিনি নাকি সময়মতো প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করেননি। কী অদ্ভুত এ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন।

নারায়ণগঞ্জের এ ঘটনা শুধু ছোট্ট একটি উদাহরণ। সারা দেশে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মাঠ প্রশাসনের সামনে অসহায়। কী মেম্বার, কী চেয়ারম্যান, কী এমপি। ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা কাউকেই সমীহ করে না। শুধু সচিব নয়, যুগ্ম সচিব, মুখ্য সচিব, অতিরিক্ত সচিব, কারো প্রতাপের সমানেই যেন দাঁড়ানো যায় না। তাদের ভাবখানা এমন যেন, জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদরা নয়, সরকারে টিকিয়ে রেখেছে তারাই। রাজনীতিবিদদের চেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই যেন সর্বেসর্বা।প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সাথে সচিবালয়ে ঘটা ঘটনাটা সাম্প্রতিক সময়ে সচিবদের দৌরাত্মের অন্যতম বাজে উদাহরণ। নিয়মিত সংবাদ অনুসন্ধান করতে গেলে নজিরবিহীনভাবে সচিবালয়ে ৬ ঘন্টাব্যাপী রোজিনাকে আটকে রাখেন একজন অতিরিক্ত সচিব সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। তার সাথে কী দুর্ব্যবহার যে তারা করেছেন সে সময়ে, তার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। একজন নারী কর্মকর্তাকে দেখা গেছে, তিনি টুটি চেপে ধরছেন সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের। শুধু সাংবাদিক রোজিনার টুটি নয়, সেদিন তিনি যেন গোটা দেশের সব গণমাধ্যমের, সব মানুষের টুটিই চেপে ধরেছিলেন আদতে। শুধু টুটি চেপে ধরে তাকে নির্যাতন করেই ক্ষ্যান্ত হননি তারা। শেষপর্যন্ত অফিশিয়াল সিক্রেট এ্যাক্ট নামের এক ব্রিটিশ আইনে যারা শুধুমাত্র সরকারী কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেই আইনে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাকে। অথচ ব্রিটিশদের বানানো এ আইন খোদ ব্রিটিশরাও বাতিল করেছে বহু আগেই। কিন্তু এদেশের আমলারা সেই আইন ইতিহাসের আস্তাকূড় থেকে টেনে তুলে এনে তার জালেই আটকে দিলেন সাংবাদিক রোজিনাকে। কী এমন তথ্য নিয়ে পেয়েছিলেন রোজিনা! যে তথ্যের জন্য এমন মারমুখী হয়ে উঠলো আমলারা? হাজার রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খায় জনমনে। কিন্তু এসব প্রশ্নের কে চাইবে কার কাছে। প্রজাতন্ত্রের দেশ হয়ে উঠেছে আজ আমলাতন্ত্রের দেশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঐ অতিরিক্ত সচিব যিনি নাটের গুরু যার কানাডার ৩ টি বাড়ি, লন্ডনে ১ টি, ঢাকায় ৪ টি ফ্লাট রয়েছে আর রয়েছে ৮০ কোটি টাকার সঞ্চয়, কিন্তু তার কোনো শাস্তি হয়নি। শুধু বদলি হয়েছেন মাত্র অন্য মন্ত্রণালয়কে ধ্বংস করার জন্যে কোটি টাকা লুটপাটের জন্যে স্বাস্থ্য দপ্তরের ড্রাইভারের শাস্তি হয় তবে তার কর্তা ব্যক্তি যেন তুলসী পাতা।

আমলাতন্ত্র এখানে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, আমলাদের ছাড়া না হয় কোনো সিদ্ধান্ত, না হয় কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কমিটি। করোনার এ সংকটকালে মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে জেলা পর্যায়ে কমিটি করা হয়েছে সচিবদের নিয়ে। সচিবরাই যদি সব করবে, তবে মন্ত্রী, এমপি বা জনপ্রতিনিধিরা রয়েছে কী জন্য? প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এত ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব দিলে জনপ্রতিনিধিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ থেকে। লোকজন যখন বুঝবে, এমপি মন্ত্রীর আসলে কোনো কাজ নেই। কাজকর্ম, ক্ষমতা যা আছে, তা সব ওই প্রশাসনিক ব্যক্তিদের হাতে। তখন তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে রাজনীতিবিদ-জনপ্রতিনিধিদের কাছে ছুটে যাওয়ার অভ্যাস বাদ দেবে। আবার আমলা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছেও ভিড়তে পারবে না সহজে। উভয়দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। মধ্য থেকে আরো ফুলেফেঁপে উঠবে আমলাতন্ত্র। আর জনগণ সরকারের প্রতি আস্তা হারাবে জনরোষ পুনরুজ্জীবিত হবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সব সময়ই আমলাতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। যে লোককে দেখবে, তার চেহারাটা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মতো। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজেরা কামাই করে খায়।’ বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে দেশের মালিক মনে করতেন। আর আমলাদের মনে করতেন মালিকদের সেবার উদ্দেশ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী। কর্মচারীর কাজ সব সময় সেবা দিয়ে মালিককে সন্তুষ্ট রাখা।বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশিক দমনমুলক আইন-কানুন পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের রূপ দিতে। আমলাতন্ত্রের মূল দর্শন পরিবর্তন করে, স্বাধীন বাংলাদেশে একটি জনমুখী আমলাতন্ত্র তৈরি করতে, যার মূল চেতনাই হবে জনগণের সেবা করা। দমন বা শাসন করা নয়। সেই লক্ষ্যে, বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের গুরুত্ব কম দিয়ে জনসম্পৃক্ত মানুষদেরকে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ সরকারের সেবা পায়। বঙ্গবন্ধু তার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য- তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা কমিশন’ গঠন করেছিলেন। এ কমিশনই বাংলাদেশের প্রথম পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সেই কমিটিতে আমলাদের আধিক্য দেখা যায়নি। ছিলেন চার বা তারও অধিক অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক। বঙ্গবন্ধু অনেক রাজনৈতিক নেতা ও শিক্ষককে সে সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। যেমন অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ডা: টি রহমানকে স্বাস্থ্য সচিবের দায়িত্ব দেন। ১৯৭২ সালে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয় সেগুলো পরিচালনা করার জন্যে অনেক ব্যবসায়ী ও দলীয় কর্মীকে নিয়োজিত করেছিলেন - যারা ইতোপূর্বে কখনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন না কিন্তু, জনগণের কাছের মানুষ ছিলেন। অথচ আজকের কর্মচারীরা এমনভাবে মালিকের আসনে চেপে বসেছে যে, চারপাশের সবাই রীতিমত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তাদের দৌরাত্মের কাছে। বঙ্গবন্ধু জেলায় জেলায় ” জেলা গভর্নর” নিয়োগ করেন যার অধিকাংশই ছিলেন জন প্রতিনিধি। বড় বড় দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন জনপ্রতিনিধিদের। যেমন লন্ডনে এডভোকেট সৈয়দ সুলতান, ওয়াশিংটন জনপ্রতিনিধি এম আর সিদ্দিকী, নয়াদিল্লীতে অধ্যাপক ড. এ আর মল্লিক প্রমুখ।

করোনা মহামারির এ সময়ে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে দেশের মানুষের জন্য কাজ করছেন ডাক্তারগণ। পরিবার-পরিজন, ছেলে-মেয়ে সবার কথা ভুলে দিন রাত মানুষের সেবায় পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা। এমন একটি সময়ে মুভমেন্ট পাশ থাকার পরও একজন ডাক্তারকে পথে যেভাবে হেনস্তা করলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, যেভাবে তার পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে বলেন, তা কোনোভাবেই আইনের আওতার মধ্যে পড়ে না। সিনিয়র উক্ত ডাক্তার নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে পরিচয় দেওয়ার পরও প্রকাশ্যে জনসম্মুখে তার সাথে যেভাবে আর্গুমেন্ট করলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, তা তাদের ক্ষমতার দৌরাত্ম্যকে আরো একবার স্পষ্ট করে তোলে। কোন ক্ষমতার বলে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা? তাকে হেয় করার জন্যে রাজাকারের ছেলে হয়েও জোর গলায় দাবী করেন তিনিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তার জন্যে তার গুরুতর শাস্তি হওয়া উচিত। তবে তার শাস্তি হয়নি, তিনি শুধুমাত্র বর্তমান পদ থেকে বদলি হয়েছেন।

সরকার যখন লড়াই করছে করোনা মহামারি মোকাবেলায়, ডাক্তার ও অন্যান্য পেশাজীবীগণ আপ্রাণ চেষ্টা করছেন পরিস্থিতি মোকাবেলায়, তখনও থেমে নেই স্বাস্থ্যখাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্য। আমলাতন্ত্রের মারপ্যাঁচে স্থবির হয়ে পড়েছে আজ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আমলাদের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে দেশের করোনা চিকিৎসা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এমনকি জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাপিয়ে দেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে করোনা চিকিৎসাও ব্যাহত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটিসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল কমিটিকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেয়ায় আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে বারবার। এ কাজগুলো করেছে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কতিপয় স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তা। তারা এতই দাপুটে যে মন্ত্রীকেও পাশ কাটিয়ে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যাতে মন্ত্রীকে হতে হয়েছে বিব্রত। বলতে হয়েছে তিনি এসব সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানেন না। তাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এমন বক্তব্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিডিয়াতে বারবার দিয়েছেন। মন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বে স্বাস্থ্য খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সমন্বয়হীনতা এখন গোটা স্বাস্থ্যখাত জুড়ে। সচিবদের দৌরাত্বে এ সমন্বয়হীনতা যেন আরও বেড়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ইসরাইল নাম বাদ পড়েছে যা কোনো মন্ত্রী মিনিস্টার জানেন না, বাদ দিয়েছেন আমলাকুল।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো এসব আমলা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য যতই বাড়ুক, কিছুই হয় না তাদের। সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তারা। নারায়ণগঞ্জের জরুরি খাদ্য সহায়তা কেলেঙ্কারিতে ইউএনওকে বাদ দিয়ে স্থানীয় জনপ্রনিধিকে অভিযুক্ত করা হয়, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে বালিশ দূর্নীতির দায়ে মামলা হয় ঠিকাদারের নামে। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলারা ছাড়া কারো বাপেরও সাধ্য নেই এসব প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি করে। প্রকল্প পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া কারো পক্ষে কোনো প্রকল্প থেকে একটি সুতোও অন্যায়ভাবে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। যদি নেয়ও, তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু ওইসব কর্মকর্তাদের ওপরই বর্তায়। যেকোনো প্রকল্পে দুর্নীতির দায় প্রকল্পের পরিচালক কখনোই এড়াতে পারেন না। কিন্তু দেখা যায়, যখনই এমন কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা সামনে আসে, তখন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আড়াল কেউ তৃতীয়পক্ষ বা অপেক্ষাকৃত দুর্বল পক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এর দায়ভার।

করোনা ভাইরাসের এ মহামারির সময়ে দেশের জনগণের পাশে সবচেয়ে বেশি থাকার সুযোগ রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিগণের। কিন্তু দেখা গেল, ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাহায্য প্রদান কার্যক্রমে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত না করে জেলা পর্যায়ে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঠিক কীসের ভিত্তিতে এ দায়িত্ব পেলেন সচিবগণ? না তারা জনগণের সাথে সম্পৃক্ত, না আছে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা জনগণের কাছে। মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা কী সরকারি অফিসে বসে থেকে সেটাও জানার কথা নয় তাদের। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাদের হাতে ন্যস্ত করায় সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হয়েছে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা প্রাপ্তী থেকে। এর ফলে জনপ্রতিনিধিরা অসহায় জনগণকে ঠিকভাবে সহযোগিতা করতে পারেননি। সরকারের বরাদ্দ ঠিকই হয়েছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী প্রকৃত অসহায়দের কাছে পৌঁছায়নি সহায়তা।

সরকারের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা, নানা মহতী উদ্যোগ সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে আমলাতন্ত্রের এ লাগামহীন ঘোড়া। জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী তথা মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম মহতী উদ্যোগের একটি হলো গৃহহীনদের জন্যে একটি ঘর প্রকল্প। কিন্তু এই প্রকল্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতির ফলে পুরো উদ্যোগটিই সমালোচনার মুখে পড়েছে। জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ প্রকল্পে দায়িত্ব দেওয়ায় নজির বিহীন দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে দুঃস্থ মানুষদের আশ্রয়ের নিমিত্তে নির্মাণ করা এসব ঘরে। বহু এলাকায় ঘর নির্মাণের পরপরই ধ্বসে পড়েছে, ভেঙে পড়েছে বহু ঘর। গৃহহীনদের ঘর প্রদানের এ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অথচ এর জন্য কখনো কোনো আমলা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। সরকারের মহতী উদ্যোগের সুফল খেয়ে যাচ্ছে আমলাতন্ত্রের বিষপিঁপড়ারা!

আমলা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অসংখ্য ফিরিস্তি হাজির করা যায়। বলতে গেলে আমলাদের অধীনে ছেড়ে দেওয়া সকল প্রকল্পই যেন একেকটি দুর্নীতি ও লুটপাটের আখড়া। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয় বাংলাদেশে। ইউরোপে একেবারে নতুন চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণের খরচ পড়ে কিলোমিটার প্রতি ২৮ কোটি টাকা। চীনে কিলোমিটার প্রতি খরচ পড়ে মাত্র ১৩ কোটি টাকা, ভারতে ১০ কোটি টাকা! বাংলাদেশে একইরকম একটা সড়ক নির্মাণ করতে খরচ করা হয় কিলোমিটার প্রতি ১০৮ কোটি টাকা! ইউরোপের চেয়ে প্রায় ৪গুণ বেশি। চীনের চেয়ে ৮গুণ বেশি। ভারতের চেয়ে ১১গুণ বেশি। পৃথিবীর সকল দেশের চেয়ে বেশি খরচ করে রাস্তা বানালে কী হবে, এসব রাস্তার স্থায়িত্ব যে সব দেশের চেয়ে কম, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এক দিকে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই অন্যদিক থেকে ভাঙা শুরু হয় এসব রাস্তা! সড়ক নির্মাণের প্রতিটি প্রকল্পে কী পরিমাণ অর্থ নয়ছয় হয়, তা বিশ্বের অপরাপর দেশের নির্মাণ ব্যয়ের সাধারণ চিত্রের সাথে তুলনা করলে সহজেই বোঝা যায়। বছরের পর বছর ধরে একই কায়দায় সড়ক নির্মাণের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে চলেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ আর তাদের পাপের ফল ভোগ করেন জনপ্রনিধিগণ। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটের কারণে জনগণের মুখোমুখি হতে পারে না তারা।

কেন আমলারা থাকেন সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে, কেন কোনোভাবেই তাদেরকে অভিযুক্ত করা যায় না, বা করা হয় না? নানা সময়ে এক স্বাস্থ্যখাতের যেসব দুর্নীতি অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনটির জন্যই কখনো কোনো আমলা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে দেখা যায়নি। সব মন্ত্রণালয়, সব অধিদপ্তর গুলোর অবস্থাও স্বাস্থ্যখাতের মতোই। সব কলকাঠি নাড়েন আমলারা, অথচ তারা থাকেন সব সময় যেন তুলসী গাছের তলায়! পুতঃপবিত্র ভাব ধরে বসে থাকলেও আদতে তারা একেকজন তুলসী তলার ভূত!

কী শিক্ষক, কী ডাক্তার, কী উকিল, কী মোক্তার, কী সাধারণ মানুষ সবার উপরেই পড়েছে আমলাতন্ত্রের ভূতের আছর। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যেন সব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেছেন।প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান একজন ডাক্তারকে হেনস্তা করেন ম্যাজিস্ট্রেট! একবারও তার কর্তৃত্ব ও সীমার কথাটা মাথায় আসে না। একবারও তারা ভাবেন না, দেশের আইন তাদেরকে আদতেই এমন ব্যবহার করার অধিকার দেয় কি না। করোনার এ সংকটকালে কখনো ডাক্তারদেরকে ভয় দেখিয়ে নোটিশ দেয়া, কখনো টেলিভিশন মনিটরিংয়ের নামে প্রজ্ঞাপন জারি করা, কখনো বয়স্ক নাগরিকদের কান ধরে উঠবস করানো, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুকুর কেটে সেই পুকুর নিজের নামে করে নেওয়া, আবার এই বিষয়ে প্রশ্ন করার দায়ে সাংবাদিককে ক্রসফায়ার দিতে চাওয়ার সাথে সাথে তথ্যমন্ত্রণালয়ের DSA আইনে নামে প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে রাখা কিছুই বাদ নেই এখানে।

আমলাতন্ত্রের যে দৌরাত্ম চলছে দেশে, যেভাবে তারা দেশের সব কাজের কাজি হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপরে, এমনকি রাজনীতিবিদ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও বাদ দিচ্ছে না, দ্রুতই তাদের লাগাম টানতে না পারলে এ দেশের কপালে দুর্ভোগ আছে। সরকার যতই জনবান্ধব হওয়ার চেষ্টা করুক, যত বাজেটই বরাদ্দ দিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে, আমলাতন্ত্রের কালো ছায়া সরাতে না পারলে কোনো সুবিধাই জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে না। ইঁদুর যেমন ঘরের মেঝের মাটি কেটে বাইরে নিয়ে ফেলে, দুর্নীতিবাজ আমলারাও তাই। ঘাড়ের ওপর বসে থেকে ভেতরটা শুষে খেয়ে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দেশ পরিচালনার জন্য সরকার ব্যবস্থার যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন আছে আমলাদেরও। কিন্তু কোনভাবেই প্রশাসনিক কাজের বাইরে অতিরিক্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা তাদের দেওয়া চলবে না। জনগণের সেবা করাই হবে তাদের একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও জনগণের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেখার জন্য দায়িত্ব পালন করবে সরকার ও তার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এ কাজে তাদের দাপ্তরিক সহায়তা প্রদান করবে কেবল। রাষ্ট্রের অধীনে শ্রমিক হিসেবে অর্পিত দায়িত্বগুলোই কেবল পালন করবে তারা। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য আগ্রাসী আমলাতন্ত্রের রাশ টেনে ধরার বিকল্প নেই।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

খোকা থেকে জাতির পিতা


Thumbnail

১৯৬১ সালে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছি ইন্টারমিডিয়েটে সাইন্সে। তখন আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। তারা দুজনই আত্মীয়। এদের মধ্যে শহীদুল হক মুন্সি আমার খুব ঘনিষ্ট ভাগনা ছিলেন। সেই হিসেবে আব্দুর রাজ্জাকও আমাকে মামা বলতেন। নিউ এলিফ্যান্ট রোড়ে আমাদের বাসায় সবাই আসতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে আ স ম আব্দুর রব থেকে শুরু করে সবাই আসতেন। এভাবেই সমস্ত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ। 

আমি যখন ঢাকা কলেজে তখন শহীদুল হক মুন্সি আমাকে বললেন তুমি এখানে ছাত্রলীগ কর। এখনকার মতো সে সময় এতো সহজ ছিল না। সেজন্য আমরা স্থানীয় ভাবে কমিটি গঠন করেছিলাম এবং নাম দিয়েছিলাম ছাত্রফ্রন্ট। তবে কমিটি করলেও আমি কোন পোস্ট নিতে পারি নাই। এরপর একদিন আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সি আমাকে আরামবাগে শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতার পর যে ব্যক্তিকে আমি সবচেয়ে বেশি সম্মান করি তিনি হলেন এই শেখ মনি। আমি উনার বাসায় যাওয়ার পর সামাল করি। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাড়ি কোথায়? আমি বলি গোপালগঞ্জ। কোথায় ভর্তি হয়েছিস? ঢাকা কলেজে। কিসে? আমি বলি সাইন্সে। উনি আমাকে বলেন, সাইন্স অনেক কঠিন। খুব ভালো ভাবে লেখাপড়া করবি। কারণ তোর ব্যাকগ্রাউন্ড আমি রাজ্জাকের কাছ থেকে শুনেছি। লেখাপড়াই তোর একমাত্র মূলধন। সেদিন আমি খুব অবাক হয়ে যাই যে, সবাই যেখানে রাজনীতির ওপরই বেশি গুরুত্ব দেন, রাজনীতির কথাই বেশি বলেন সেখানে মনি ভাই আমাকে লেখাপড়ার প্রতি জোর দিতে বলেছেন। পরে আমরা উনার বাসায় খাওয়া দাওয়া করি। আসার সময় আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সিকে উনি বলেন যে, তাকে তোমরা মামার (বঙ্গবন্ধু) কাছে নিয়ে যাইস। 

এরপর একদিন আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সি আমাকে ৩২ নম্বরে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে ছিলেন মুজিব ভাই। আমি যাওয়াতে বঙ্গবন্ধু খুব খুশি হয়েছিলেন। সম্ভবত, রাজ্জাক আমার সম্পর্কে উনাকে আগে থেকে বলেছিলেন। আমি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পায়ে সামাল করি। তিনিও জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাড়ি কি গোপালগঞ্জ? আমি হ্যাঁ বলি। কোথায় ভর্তি হইছস? ঢাকা কলেজে। কিসে? সাইন্সে। সাইন্সে? এটা তো কঠিন সাবজেক্ট। তোমার ইচ্ছা কি? আমি বললাম আমার ইচ্ছা হল আমি ডাক্তার হব। তোর ইচ্ছার কথা মনে রাখবি আর এটা মনে রেখে পড়াশুনা করবি। বঙ্গবন্ধুর সেই কথা আমার ব্রেনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। এরপর লেখাপড়ায় মনোযোগী হলাম। বঙ্গবন্ধুও সেদিন রাজনীতি নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না। তখন থেকেই আমার হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু। তিনিই যেন আমার সবকিছু, আমার আদর্শ।যেহেতু আমরা জুনিয়র ছিলাম সেজন্য আমরা খুব একটা সুযোগ পেতাম না। যদিও বঙ্গবন্ধুর কাছে কোন সিনিয়র জুনিয়র ছিলেন না। কিন্তু তারপরও নিজের মধ্যে একটা দ্বিধা কাজ করতো। আব্দুর রাজ্জাক, শহীদুল হক মুন্সি তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে সন্তান মতোই ছিলেন। 

আমি ঢাকা কলেজে থাকতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। ভর্তি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন আবার জেলে থেকে বের হলেন একদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসলেন ছোট একটা গাড়িতে করে। তখন আমি মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে। তখন থেকেই আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ডাক্তার হয়ে গেলাম। তিনি বলতেন, কিরে ডাক্তার কেমন আছিস? উনি যেহেতু রোগী দেখতে যেতেন ঢাকা মেডিকেলে আমরা উনার পেছনে পেছনে ঘুরতাম। উনার সাথে থাকতাম। উনি আমাদের যে আদর করতেন তাতে মনে এখনকার মানুষের মধ্যে সেই আদর নাই। বঙ্গবন্ধু আদর আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। আমার একটা স্মৃতি ভালো ভাবে মনে আছে আমি একবার গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিয়েছিলাম উনাকে। উনি তখন বললেন, আমি তো সামনে বসি। এরপর তো বঙ্গবন্ধু জেলেই বেশি থাকতেন, মনি ভাইও জেলে থাকতেন। আব্দুর রাজ্জাক এবং শহীদুল হক মুন্সি তারাও অনেক দিন জেলে ছিলেন। তখন জেলে থেকে চাদর সোয়েটার সহ অনেক কিছু দিত। আমাকে শহীদুল হক মুন্সি একটি চাদর দিয়েছিলেন। সেটা আমি অনেকদিন পড়েছি। এইভাবে তাদের সাথে আমার সম্পর্ক অনেক গভীর ছিল। এদের সাথে ছাত্রলীগ করতাম। তখন ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের অবস্থান দ্বিতীয় ছিল। প্রথম সংগঠন ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। তখনকার মতিয়া আপার বক্তৃতা না শুনলে বুঝা যাবে না কেন মতিয়া আপাকে অগ্নিকন্যা বলা হয়। তার ঢং, তার বক্তব্য, কন্টেন্ট আর সময় সবকিছু মিলিয়ে যেভাবে কানে বাজত এখন সে ভাবে কানে বাজবে না। অগ্নিকন্যা বলা হলেও মনে হত অনেক কম বলা হচ্ছে। 

মুজিব ভাইয়ের মেয়ে শেখ হাসিনা তখন আজিমপুর গার্লস স্কুলে পড়ত। একদিন শেখ হাসিনা একটি মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসলেন। সে সময় একজন আমাকে বলল যে, উনি হলেন মুজিব ভাইয়ের মেয়ে। তখন থেকে আমি উনাকে জানি। এরপর ইন্টারমিডিয়েটে উনি ভিপি নির্বাচন করলে আমি একজন কর্মী হিসেবে কাজ করি। আমি যতটা না কাজ করেছি তার দশগুন বেশি করে উনি বলতেন এবং ১০০ বার বলতেন। এজন্য আমি উনার কাছে খুব কৃতজ্ঞ।

এক সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি হলাম। তখন ঢাকা কলেজ থেকে তারা সভাপতি করতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌশলে আমিই সভাপতি হয়েছি। কেন্দ্রীয় কমিটিরও ভাইস প্রেসিডেন্টও হলাম। সাবেক রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ উনিও তখন ময়মনসিংহের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। 

এরই মধ্যে আগরতলা মামলার ঘটনা ঘটে। তখন খুব কঠিন সময় ছিল। একের পর এক সমস্ত নেতারা গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে খুব কঠিন সময় যায়। এ সময় বঙ্গমাতার সাথে পরিচয় হয়। সে সময় লিফলেট ছাপার জন্য আমাদের কাছে টাকা পয়সা ছিল না। কার পরামর্শে যেন আমি একবার বঙ্গমাতার কাছে গিয়েছিলাম আমার মনে নেই। কিন্তু আমি বঙ্গমাতার কাছে গিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম আমরা লিফলেট ছাপব কিন্তু টাকা পয়সা পাচ্ছি না। পরে উনি আমাকে বললেন, তুমি বস। কিছুক্ষণ পরে উনি আমাকে একশ টাকা দিলেন। অনেক পরে আমি জেনেছি যে, ওই টাকা ছিল উনার গহনা বিক্রি করার টাকা। আগেও এরকম টাকা দেওয়ার জন্য তিনি গহনা বিক্রি করেছিলন। ওই টাকা থেকে আমাকেও দেন। এভাবে প্রতিটি পদক্ষেপে বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে।

আমরা সবাই মিলে আগরতলা মামলার জন্য যতটা না করেছি তার চেয়ে অনেক বেশি একা করেছেন বঙ্গমাতা। যেমন, জেলে থাকতে বঙ্গবন্ধুকে গোলটেবিলে নিয়ে যেতে অনেকে বুদ্ধি দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গমাতা যেতে দেননি। তিনি বলেছিলেন, আগে ছেড়ে দিতে হবে পরে যেতে হবে। সুতরাং বঙ্গমাতা আর বঙ্গবন্ধুকে আলাদা ভাবে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলন সেই ৫২ এর আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার আন্দোলন সমস্ত, এমনকি কিছু ৭ মার্চের ভাষণ সব জাগয়ার অবদান রয়েছে বঙ্গমাতার। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ মুজিব থেকে খোকা, খোকা থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু সব ক্ষেত্রে বঙ্গমাতারও সমান অবদান রয়েছে। এবং বঙ্গমাতার সহযোগিতার কারণেই বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হয়েছেন। এদেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন। আজ বঙ্গবন্ধু জন্মদিনে আমার এরকম হাজারো স্মৃতি কথা মনে পড়ছে।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

পদোন্নতি, নববর্ষ বা জন্মদিনে বসকে ফুল দেয়া কি ভুল?


Thumbnail

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ফুল সাম্রাজ্যের মধ্যে তোলা এক ছবি নিয়ে দেশ যেন আজ দু'ভাগে বিভক্ত। একদল বলছেন, উপাচার্য কাজটি ঠিক করেননি।  তাঁকে কেন এত ফুল দেয়া হয়েছে ? ফুল দাতাদের আসল উদ্দেশ্য কি ? নিয়েছেন ভাল কথা। তিনি কেন এমন ঘটা করে ছবি তুলেছেন ? ছবি তিনি তুলতে পারেন। কিন্তু তিনি কেন আবার সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করেছেন? আরেকদল বলছেন, একজন শিক্ষকের জীবনে উপাচার্য হওয়াটা স্বপ্নের মতন। তিনি উপাচার্য হয়েছেন, সবাই ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সে স্মৃতিগুলো ধরে রাখার জন্য তিনি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। তাতে দোষের কি ? কেন সবাই পরশ্রীকাতর ?

পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নব নিযুক্ত উপাচার্য ফেসবুকে একটি ছবি ছেড়েছেন।  ছবিতে দেখা যাচ্ছে পুরো অফিস কক্ষটি ফুলের তোড়ায় ভরা। মাঝে তিনি বসা। ছবিটি ভাইরাল হবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাতির দু'ভাগে বিভক্ত হবার লক্ষণ সুস্পষ্ট।

ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটিতে এবার দেশে ছিলাম। দুপুরের দিকে হঠাৎ করে একটি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার অফিসে গেছি। সংস্থাটির বড় কর্তা আমার পূর্বপরিচিত, ঘনিষ্ট। ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।  হাতে ঘন্টা দুয়েক সময় ছিল। ভাবলাম, সময়টা এখানে কাটিয়ে যাই। সাক্ষাতটি পূর্ব নির্ধারিত নয়।  তাই প্রথমেই নিরাপত্তা ও অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিরা আমাকে ভৎসনা করলেন। আগে থেকে সাক্ষাৎকারের সময় না নিয়ে কেন এসেছি ? এদিকে আমি সমানে চেষ্টা করছি কর্তা ব্যাক্তির মোবাইলে। কখনো দেশি নাম্বার থেকে, কখনো আমার বিদেশী নাম্বার থেকে। অপর দিক থেকে সাড়া মিলছে না। নিরাপত্তারক্ষীদের নিজ পরিচয় দেয়ার পর বড় কর্তার অফিসের সাথে যোগাযোগ করে একজন আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।  

বড় কর্তার সাথে দেখা। তিনি প্রথমে ফোন না ধরার কারণ ব্যাখ্যা দিলেন। আজ ইংরেজি বছরের প্রথম দিন। সকাল থেকে দলে দলে আসছেন অধস্তনরা। ফুল দিচ্ছেন। তিনি নিচ্ছেন। কেক কাটছেন। ততক্ষনে তিনি ক্লান্ত। বিকেল চারটে বাজে। তখনও তিনি দুপুরের খাবার খাননি। আমি বসে থাকাকালীন বেশ কটি দল এসেছে ফুলেল শুভেচ্ছা নিয়ে। ফুলে ফুলে 'গদখালি' বনে যাওয়া বিশাল ওই কক্ষে বসে ভাবছিলাম দেড় দশক যাবত আমি প্রবাসী। প্রবাসের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা আমি। বিগত পনেরো বছরে কোন ইংরেজি বা আরবি বছরের প্রথম দিনে সেদেশে এমন আদিখ্যেতা কেন দেখিনি ? আসলে দিন দুটিতে এখানে সরকারি ছুটি থাকে। পরদিন ? না, সেদিনও কোন আদিখ্যেতা নেই। দেখা হলে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় বলে "হ্যাপি নিউ ইয়ার"।
 
বাংলা নববর্ষে দেশে ছুটি থাকে। তাই দেশের অফিস আদালতে এ ধরণের  আদিখ্যেতা চলে না।  ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটি সরকারি ছুটি ঘোষণা করলে অফিসের কর্তা ব্যাক্তিরা ঠিক সময়ে 'মধ্যাহ্নভোজ' করতে পারতেন। এসব আদিখ্যেতা থেকে রেহাই পেতেন। বছরের প্রথম দিনটিতে উর্ধতন থেকে অধস্তন সবাই ফুল দেয়া নেয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কাজ কাম তেমন হয় বলে মনে হয় না। তাহলে দিনটি ছুটি থাকলেই বা ক্ষতি কি ?

এবার বলি, দেড় দশকের প্রবাস জীবনে অফিসে জন্মদিন পালনের অভিজ্ঞতার কথা। হাঁ, এখানেও অফিসে জন্মদিন পালন করা হয়। কেক কাটা হয়। খাওয়া দাওয়া হয়। তবে এসব চলে শুধুমাত্র অফিসে মধ্যাহ্ন বিরতির সময়। অফিসের কাজের ক্ষতি করে নয়। শুধু জন্ম দিন নয়, কখনো কখনো জন্ম মাসও পালন করা হয়।  এই যেমন রোজা শুরুর আগের দিন মার্চ মাসে যে সব সহকর্মীর জন্মদিন তাঁরা মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করেছেন। যাঁদের জন্মদিন, তাঁরা সব ব্যায় করে। যার জন্মদিন তিনি যদি বড় কর্তা হন, তাতে কি ? তিনিই খাওয়াবেন। যারা খাবে, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে উদ্যোক্তাদেরকে 'শুভ জন্মদিন' বলে উইশ করা। বড় জোর খুদে বার্তায় 'শুভ জম্মদিন' লেখা। ব্যাস, এ পর্যন্তই। কোন ফুলের তোড়া নেই। উপহার নেই। কোন আদিখ্যেতা নেই।

দেশে দেখি উল্টাটা। বড় কর্তার জন্মদিন হলে তো কথাই নেই। বড় কর্তার অফিস কক্ষটি সেদিন ফুলে ফুলে 'গদখালি' হয়ে যায়। হরেক রকমের কেকের প্রদর্শনী কক্ষ হয়ে যায়। বড় কর্তার কোন খরচ নেই। সব খরচ অধস্তনদের, তেলবাজদের। তেলবাজরা সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে কবে বড় কর্তার জন্মদিন। কবে বাড়ির আমগাছ থেকে আঙ্গুর পেড়ে এনে বড় কর্তাকে খাওয়াবে ! কবে বাড়ির পুকুর থেকে ইলিশ মাছ ধরে এনে বড় কর্তাকে খাওয়াবে ! এসব সংস্কৃতির পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। অনেক দেশে বাধ্যতামূলক ছুটির বিধান রয়েছে। জন্মদিনে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক ছুটির ব্যবস্থা করা যায়। তাতে অফিস আদালতে তেলবাজদের দৌরাত্ম থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

এবার আসি, ভাইরাল হওয়া ছবিটি ঘিরে দ্বিধা বিভক্তি নিয়ে। এখানে লক্ষণীয়, যাঁরা কারনে বা অকারণে ফুল দিতে বা নিতে অভ্যস্ত তাঁদের বেশিরভাগ উপাচার্যের ফুলের ছবি কাণ্ডের পক্ষে। ছবিটি নিয়ে ট্রলকে তাঁরা পরশ্রীকাতরতা মনে করেন। না পাওয়ার বেদনা থেকে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মনে করেন। আসলে কি তাই ? পদোন্নতি, নববর্ষ বা জন্মদিন উপলক্ষে যারা একজন কৃত মানুষকে ফুলের সাগরে ভাসাতে পারে, স্বার্থসিদ্ধির পরে তারা এমন কর্তাকে অথৈ সাগরে ডুবাতেও পারে। যাদের চারপাশে এত বেশী চাটুকার, মানুষ হিসেবে তারা কতটুকু স্বচ্ছ তা পরীক্ষা নিরীক্ষার দাবি রাখে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। 

লেখকঃ প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট 


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

কর ফাঁকি দেয়ার সংস্কৃতির প্রবর্তক ড. ইউনূস


Thumbnail

নিয়মিত কর দেয়া বা কর ফাঁকি না দেয়ার দিক থেকে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। এর মূল কারণ হচ্ছে আমাদের মানসিকতা। কর দেয়ার মত মানসিকতা আমাদের মধ্যে এখনও গড়ে উঠেনি। আরেকটি কারণ হলো যাদের মাধ্যমে আমরা কর প্রদান করি তারা আমাদের বুঝায় যে, কিভাবে কর ফাঁকি দেয়া যায় বা কর কম দেয়া যায়। আর এর সাথে তো দুর্নীতির বিষয়টি জড়িত আছেই।

সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ড. ইউনূস কর ফাঁকির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং তাকে কর পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অথচ তিনি একজন শান্তিতে নোবেলজয়ী। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, ড. ইউনূসের মত আরও রাঘববোয়াল কর ফাঁকি দিয়েছেন এটা নিশ্চিত।

ড. ইউনূস বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য রাখেন বেশ ভালো কথা কিন্তু তিনি নিয়মিত কর দেননি। আর এরকম মানুষের জন্য আমাদের দেশের কতগুলো ভাড়া করা বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দেন। আবারও বিদেশেও তার ভাড়া করা লবিস্ট আছে। একজন নোবেলজয়ী ব্যক্তি যদি কর ফাঁকি দেয় তাহলে অন্যদের কাছে কর আদায় করা বা প্রত্যাশা করা তো অন্যায়। ড. ইউনূস শুধু কর ফাঁকি দেননি, তিনি কর না দেয়ার একটি সংস্কৃতি এদেশে গড়ে তুলেছেন। ড. ইউনূসের মত আরও ছাড়া আছেন তাদেরকেও খুঁজে বের করতে হবে। অবাক করার বিষয় হলো কর ফাঁকি দেয়ার পরও ড. ইউনূস আবার সরকারের বিরুদ্ধে বিষেদাগার করছেন। অর্থাৎ আমাদের কাছে দেশ বড় হলেও ড. ইউনূসের কাছে তিনি নিজে বড়।

আমার সৌভাগ্য হয়েছে চারজন নোবেলজয়ীর কাছে মেশার। তাদের সাথে আমি বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছি। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন এর সাথে একবার বক্তব্য দেওয়া সৌভাগ্য হয়েছিল। দেখলাম উনি আমার বক্তব্য খুব কনভিন্সড হয়েছিলেন। আমি মাত্র চার মিনিট বক্তব্য দিয়েছিলাম। আমি দেখেছি এ সমস্ত নোবেলজয়ীরা সত্যিকার অর্থে একেক জন আইকন। আমরা তো আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আইকনের সন্ধানে আছি। আমরা কাকে অনুসরণ করব।

আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, দার্শনিক শেখ হাসিনা এদেশের যুব সমাজ থেকে শুরু করে সবার আইকনে রূপান্তরিত হতে পেরেছেন। তার কোন আয়কর ফাঁকির রেকর্ড নেই। এদেশে ড. ইউনূস ছাড়াও অনেকে আছেন আয়কর ফাঁকির তালিকায়। এদেশের অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত আয়কর ফাঁকির তালিকায় আছেন। প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান অনেক ভালো কাজ করেছেন বৈকি কিন্তু তিনিও আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন। কর ফাঁকির একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে এদেশে। আমরা যদি নিয়মিত কর না দেই তাহলে দেশ কিভাবে উন্নত হবে। এই সংস্কৃতি থেকে অবশ্যই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

আমি মনে করি আমাদের আইন-আদালত সঠিক ভাবে চলছে। একজন নোবেলজয়ী ব্যক্তি যিনি তার আয়কর ফাঁকি দিয়েছে, আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, তার হাতে আমাদের ভবিষ্যত নেই। তিনি আমাদের জন্য, দেশের জন্য ক্ষতিকর। দেশের দুর্যোগের সময় এদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদের অনুসরণ করলে আমাদের প্রজন্ম পিছিয়ে যাবে। এখান থেকে আমাদের অবশ্য মুক্তি পেতে হবে। আর সেজন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে ড. ইউনূসের মত লোকদের সঠিক ভাবে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যারা কর ফাঁকি দেয়া সহ এরকম নিয়ম বহির্ভূত উদাহরণ তৈরি করছেন বা সংস্কৃতি তৈরি করছেন তারা আমাদের দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবেন এটা নিশ্চিত। সুতরাং এদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে একটি বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কারণ শুধু আইনের দ্বারা দেশ সঠিক পথে চলে না। আইন না থাকলে দেশ যেমন সঠিক পথে চলে না, তেমনি শুধু আইনের মাধ্যমে দেশ সঠিক ভাবে চলবে না। জনগণকে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। সচেতন থাকলে ভবিষ্যতে এদেশের প্রজন্ম ড. ইউনূসকে অনুসরণ করবে না। ইউনূসের মত কর ফাঁকি দেয়া ব্যক্তি অত্যন্ত কারও পথপ্রদর্শক হবে না কিংবা তাদের খপ্পরে পড়বে না।


কর ফাঁকি   সংস্কৃতির প্রবর্তক   ড. ইউনূস   দার্শনিক শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

দ্য শেখ হাসিনা এন্ড দ্য উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট


Thumbnail

আজ ৮ মার্চ ২০২৪ সাল। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও নারী দিবস পালন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নারী জাগরণে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, নারীদেরকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এসেছেন তারা আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। তারা মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আজ নারী দিবসে আমি এমনই একজন নারীর কথা উল্লেখ করতে চাই। আর তিনি হলেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। দার্শনিক শেখ হাসিনা নারীদের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্র যেভাবে প্রশস্ত করেছেন আমার মনে হয় এটা বিশ্বে আর কেউ করতে পারেননি। বিশ্বে এমন উদাহরণ পাওয়া দুষ্কর। তিনি সেটা করতে পেরেছেন কারণ তিনি দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশ পরিচালনা করছেন। যার জন্য আজ তিনি সারা বিশ্বে ব্রান্ডিং হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

সারা বিশ্ব তাকে চেনেন, তার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এটা আমরা কেউ স্বীকার করি বা না করি কিন্তু এটাই আজ চিরন্তন সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিককে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর নারী জাগরণে দার্শনিক শেখ হাসিনা যে অবদান সেজন্য আমি তাকে ‘শেখ হাসিনা ফর দ্য আপলিফমেন্ট অব উইমেন্স ইন বাংলাদেশ এন্ড এক্সাম্পল ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাই। অর্থাৎ শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নে বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত।

এর কারণ আমি এভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই। আমি দার্শনিক শেখ হাসিনার নির্দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করি। যেখানে নারী জাগরণের এক নীরব বিপ্লব ঘটেছে। আর এটি ঘটিয়েছেন দার্শনিক শেখ হাসিনা। তিনি দেখলেন যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেয়েদের বাল্য বিবাহ বেশি হচ্ছে। তারা লেখাপড়ায় বেশি এগোতে পারছে না। এটা উপলদ্ধি করার পর শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিকে মেয়েদের প্রধান্য দিতে নির্দেশ দিলেন। অর্থাৎ তিনি শুধু স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ই খেয়াল করলেন তা নয়, তিনি সামগ্রিক ভাবে প্রান্তিক মানুষের কথা ভাবেন। কমিউনিটি ক্লিনিকে মেয়েদের প্রাধান্য দেওয়ার ফলে এখানে মেয়েদের একটা বিরাট ক্ষমতায়ন ঘটল। গ্রামে যারা আজ কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করছেন তাদের আলাদা একটি পরিচয় হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন বাল্য বিবাহ বন্ধ হয়েছে, তেমনি তাদের মধ্যে লেখাপড়ার গুরুত্ব বেড়েছে আবার একই সাথে আজ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। যার পুরো কৃতিত্বটা এই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার। এরকম উদাহরণ বিশ্বে বিরল।

কদিন আগেই দেশে পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখলাম যে, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। খুব সহজে চোখ আটকানোর মতো তাদের সংখ্যা। এটা গর্বের। কনস্টেবল থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত নারীর সংখ্যা ইর্ষনীয়।

আর্মিতেও আজ নারীরা খুব ভালো করছে। আগে আর্মিতে নারী বলতে শুধু ডাক্তারই মনে করা হতো। কিন্তু এখন সেটা পাল্টে গেছে। আনসার বাহিনীতেও নারীদের সংখ্যা বিরাট। প্রতিটি ক্ষেত্রে এভাবে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। এভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি নারীদের সুযোগ করে দিয়েছেন। তাদের পথটা প্রশস্ত করেছেন বিরামহীন ভাবে।

নারী ক্ষমতায়নের সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটেছে এবারের মন্ত্রিসভায়। এবারের মন্ত্রিসভায় রেকর্ড সংখ্যক নারী ঠাঁই পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ এবারের মন্ত্রিসভায় নারীর সংখ্যা আট। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য রেকর্ড। এর আগে বাংলাদেশে কোনো মন্ত্রিসভায় এত জন নারী সদস্য থাকেননি। ১১ জানুয়ারী যে ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তাতে চারজন নারী সংসদকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভায় আরও চারজনকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। এটি অনন্য রেকর্ড। শেখ হাসিনার এই অবদানকে আমি ব্যাখ্যা করতে চাই যে, দ্য শেখ হাসিনা এন্ড দ্য উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট। অর্থাৎ দার্শনিক শেখ হাসিনা এবং নারী ক্ষমতায়ন। সুতরাং আসুন আজ ১৭ কোটি মানুষ আমরা দার্শনিক শেখ হাসিনাকে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানাই। আজকের এই নারী দিবস আমরা দার্শনিক শেখ হাসিনাকে উৎসর্গ করি।


শেখ হাসিনা   উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ৭ই মার্চের ভাষণ


Thumbnail

যেসব সাফল্য গাঁথা ইতিহাসের পাতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনন্য উচ্চতায় ঠাই করে দিয়েছে, তার অন্যতম ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাস্থ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সরোয়ারদী উদ্যানে) প্রদত্ত এক অনবদ্য ও ঐতিহাসিক ভাষণ। ইতিহাসের গতি পাল্টে দেয়া সেই ভাষণে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্বায়ত্ব শাসন, রাজনীত, অর্থনীতি ও কূটনীতিসহ নানা বিষয় ঠাঁই পেয়েছিল। এসব বিষয় নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণা, বিশ্লেষণ ও আলোচনা হয়েছে, যা আজও বহমান এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। তবে সেই অসাধারণ ভাষণের সামরিক গুরুত্ব খুব একটা আলোচনায় আসেনি। অথচ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষণটির কিছু অংশ বিশ্লেষণ করলেই বঙ্গবন্ধুর মাঝে একজন পরিপক্ক সমর দার্শনিক ও সামরিক নেতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।

সামরিক বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য এবং পরবর্তীতে মৌখিক বা লিখিত আকারে যুদ্ধের আদেশ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানানোর জন্য শুরুতেই সুস্পষ্ট করে জানানো হয় আসন্ন অভিযান বা যুদ্ধের উদ্দেশ্য।‌ ৭ই মার্চের ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেন সুস্পষ্ট তিনটি উদ্দেশ্য। তার ভাষায় "আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়"।  সামরিক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের আলোকে রচিত হয় কর্মপরিকল্পনা। আর এক্ষেত্রে পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকাই যে মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল, তা প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পড়তে পড়তে । এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সংবিধান রচনার সময় এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দেশ পরিচালনার মৌলিক নীতিগুলো সাজানো হয়েছিল।

একটি সমর পরিকল্পনায় উদ্দেশ্য স্পষ্ট করার পর একজন অধিনায়ক যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ শত্রুর স্বরূপ তুলে ধরেন। ৭ ই মার্চের ভাষণে শত্রু পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু একে একে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ফলাফলকে গুরুত্ব না দেয়া, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের বাইরে রাখা, আমাদের টাকায় কেনা অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করা, আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ ইত্যাদি তুলে ধরেন।‌

যুদ্ধ পরিকল্পনায় উদ্দেশ্য ও শত্রু পরিস্থিতির ব্যাখ্যার পর মূল্যায়ন করা হয় নিজ শক্তি সামর্থের বিষয়টি । ৭ই মার্চের ভাষণে আত্মমূল্যায়ন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেদের অখন্ড পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টি হিসেবে তুলে ধরেন। "ঘরে ঘরে দুর্গ" এবং "সাত কোটি মানুষকে আর দাবাইয়া রাখতে পারবা না"  বলে বঙ্গবন্ধু তার মোট ঘাঁটি ও সৈন্য সংখ্যার জানান দেন।

উদ্দেশ্য ও শত্রু-মিত্র পরিস্থিতি ব্যাখ্যার পর একজন সমরবিদ ব্যাখ্যা করেন কার্যসম্পাদন পদ্ধতি নামে পরিচিত যুদ্ধ পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সামরিক পরিভাষায় এই অংশটিকে টাস্ক বা "মোদাস অপারেন্ডি" বলা হয়। ৭ ই মার্চের ভাষণে ক্রমান্বয়ে উন্মোচিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধ পরিকল্পনার নানা দিক।

এই পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশনা। ভিয়েতনাম, কিউবা, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইউক্রেন ও লিবিয়াসহ পৃথিবীর বহু দেশে মুক্তি সংগ্রামের নিয়ামক শক্তি ছিল বসতভিটা, দোকানপাট, বাজার, শহর, বন্দর, গ্রাম প্রভৃতিতে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও নিবেদিত প্রাণ প্রশিক্ষিত বা অর্ধ প্রশিক্ষিত সৈন্য মজুদ করা। এসব সৈন্য সাধারন জনগণের সাথে অতি সাধারণ পোশাকে মিশে থাকে ও সুযোগ পাওয়া মাত্র শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে শত্রুর সর্বোচ্চ ধ্বংস সাধন করে এবং মিশন শেষে আবারো সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যায়। বঙ্গবন্ধুও সেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। বর্তমানে পিপলস আর্মি গড়ে তোলারসহ বহু দেশে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যুদ্ধের এমন কৌশলকে অর্থাৎ প্রতিটি ঘরকে সামরিক দুর্গে পরিণত করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়।

"তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে' বলে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের কৌশল বাতলে দেন। এই নির্দেশনা পেয়ে একদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর বাঙালি সৈন্যরা এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (সীমান্ত রক্ষী), পুলিশ ও আনসার এর সশস্ত্র সদস্যরা বুঝে যায় যে সময় হয়েছে, তাদের এখন অস্ত্র নিয়ে ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং লড়াই করতে হবে। আর সাধারণ মানুষ দা, বল্লম, তীর-ধনুক এমনকি লাঠি হাতেও দাঁড়িয়ে যায়, যার সম্মিলিত শক্তি কোন অংশেই একটি প্রশিক্ষিত আধুনিক সামরিক বাহিনীর শক্তির চেয়ে কম নয়। এ প্রসঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বিপ্লবী কমুনিস্ট নেতা ও পরবর্তীতে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হো চি মিন মার্কিন সেনাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, তোমাদের প্রতিজনকে হত্যার কারণে তোমরা আমাদের ১০ জনকে হত্যা করতে পারো। তবে এমন প্রতিকূল অবস্থাতেও তোমরা পরাজিত হবে, আর আমরা হব বিজয়ী। হো চি মিন মিনের সেই তত্ত্ব সত্য প্রমাণ করেছিলেন জাতির জনক।

শত্রুকে ঘায়েল করার অন্যতম রণকৌশল হলো তার সামরিক ও প্রশাসনিক সরবরাহ ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেয়া, যাতে শত্রু যুদ্ধ ও প্রশাসন চালিয়ে যাওয়ার এমনকি সাধারণ জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সংকটে পড়ে। সমরবিদদের ভাষায় এ হলো মাছকে পানি থেকে তুলে নেয়া কৌশল, যা ক্রমেই শত্রুকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। আবার পশ্চিমা সমরবিদেরা এই কৌশল কে বলেন অবরোধ বা প্রতিবন্ধকতা পরিকল্পনা (ডেনিয়াল প্ল্যান)। এই কৌশল বঙ্গবন্ধুর ভাষায় "জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো"। এভাবে তিনি একপ্রকার গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশনা দেন এই ভাষণের মধ্যে দিয়ে।

বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধের জন্য মা ও যে দং এর খ্যাতনামা দর্শন হলো "শত্রু যখন ক্লান্ত হয়ে পিছু হটবে ও নিজেদের সংকুচিত করবে, তখন তাকে ধাওয়া করো এবং আঘাত করো।   আর শত্রু যখন এগোবে, তখন তার চলাচলের পথে অসংখ্য ছোট ছোট বাধা সৃষ্টি করো এবং নিজেরা চলে যাও নিরাপদ স্থানে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা ও যা যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা নির্দেশনা ছিল এমন গেরিলা যুদ্ধের কৌশলেরই প্রতিফলন ।

সামরিক আদেশের অপরিহার্য বিষয় বিকল্প নেতৃত্ব, যা বক্তব্যের এই অংশে "আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি" বাক্যটির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। বিকল্প নেতৃত্ব এবং দ্বিতীয় সারির সেনা বা "রিজার্ভ ফোর্স" নামে পরিচিত সামরিক শক্তি নিয়ে জাতির পিতার ভাবনা উঠে আসে তার প্রত্যেক গ্রামে প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশে।  এখানে লক্ষণীয় এই বক্তব্যের আগের অংশে "যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা" করার কথা বলার পরে তিনি অন্যদের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন, যা কেবল একজন দূরদর্শী সমর নায়কের পক্ষেই সম্ভব।

যেকোনো রণক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা বেতার বা তারের সাহায্যে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু এ সংক্রান্ত নির্দেশ ছিল "মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না।"। তিনি আরো বলেন "টেলিফোন ও টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সাথে দেয়া নেয়া চলবে না"।  এভাবেই তিনি একদিকে গণমাধ্যমকে শত্রুর প্রোপাগান্ডা প্রচারে বাধা দেন ও নিজেদের প্রোপাগান্ডা প্রচারে ব্যবহার করে। অন্যদিকে নিজেদের যোগাযোগের জন্য তার বা টেলিফোন নির্ভর যোগাযোগের নির্দেশনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে–শুনে কাজ করবেন”।

একটি সেনাবাহিনীর মূল শক্তি তার নিজস্ব ঐক্য ও সংহতি। জাতির পিতা এ প্রসঙ্গে এক অবিস্মরণীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে বলেন "শত্রু বাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে।  আত্মকলহ সৃষ্টি করবে।  লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি -অবাঙালি যারা আছে,  তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়"।  এক্ষেত্রে ও বাঙালি তথা পাকিস্তান সমর্থক বিহারীদের রক্ষার নির্দেশনা প্রদান করেন। একই সাথে তিনি যে কোন সামরিক বাহিনীর জন্য চরম ক্ষতিকর পঞ্চম শক্তি বা "ফিফ্থ কলামিস্ট" সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করেন।

৭ই মার্চের ভাষণের অপর অংশে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি এবং অস্ত্রধারীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্য "তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না' - ইত্যাদির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ প্রণীত ১৯৪৯ সালের ১২ ই আগস্টের  ঐতিহাসিক জেনেভা কনভেনশনের একাধিক ধারার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন, যা একজন বিবেকবান ও পেশাগত সমরবিদের অবশ্য কর্তব্যের অংশ।

এর বাইরে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, বিকল্প যুদ্ধস্বরূপ, হরতাল, , রাস্তায় অবস্থান, নিজেকে প্রধানমন্ত্রীত্ব ভিখারি নয় বলে দাবি, গরিবের চলাচল ও রুটি রুজির ব্যবস্থা, কর্মচারীদের বেতন সংগ্রহ প্রক্রিয়া, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া,  রিলিফ কমিটির মাধ্যমে আহত ও নিহতদের সাহায্য করা প্রভৃতির মাধ্যমে একটি যুদ্ধের প্রশাসনিক বা লজিস্টিক বিষয়গুলোর দিকনির্দেশনা দেন।

তবে ৭ই মার্চের ভাষণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, তিনি কমান্ডোদের "হয় শত্রুর দমন না হয় মরণ" মন্ত্র বাতলে দেন।  যুদ্ধের কৌশল হিসাবে তার দুটি অজেয় বাণী "আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না" এবং "রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইন শা আল্লাহ"  যেন একদল কমান্ডার প্রতি এক অকুতোভয় সমর নায়কের শেষ বার্তা।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যদের নেতৃত্ব দেয়া জেনারেল উইলিয়াম সি ওয়েস্ট মোরেল্যান্ড ১৯৬৭ সালের ২৮ শে এপ্রিল কংগ্রেসের একটি যৌথ সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলে ছিলেন যে, আমরা যুদ্ধ করছি অথচ আমাদের সামনে কোন সুনির্দিষ্ট যুদ্ধরেখা বা যুদ্ধ এলাকা নেই। কারণ শত্রুরা মানুষের মাঝে মিশে আছে । তারা জঙ্গলে, পাহাড়ে এবং সীমান্ত এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ করছে। কারো পক্ষে এমন একটি পরিবেশে যুদ্ধের অগ্রগতি ম্যাপের উপর  রেখা একে বুঝিয়ে দেওয়া‌ সম্ভব নয়। চার বছর পর এমন যুদ্ধ পরিকল্পনার মূল সুর বঙ্গবন্ধুর এই ৭ই মার্চের ভাষণে ফুটে উঠেছিল

আগেরকার দিনে পতাকা তুলে, ঢোল পিটিয়ে বা পশুর শিঙ্গায় ফু দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার মতো  তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সংকেত দিলেন এই বলে "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা"। 

উল্লেখ্য ৭ মার্চের ভাষণকে ভিত্তি করে ১৪ মার্চ জাতির পিতা ৩৫টি নির্দেশনা জারি করে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রদান করেন, যা ছিল মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের প্রশাসনিক নির্দেশনাবলি।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email: directoradmin2007@gmail.com

৭ই মার্চ   বঙ্গবন্ধু  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন