“আমি অনেকটা নির্ভার হয়ে আবার ঢাকায় এসে এক বিকেলে বঙ্গবন্ধুর
সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বত্রিশ নম্বর বাসভবনের নিচতলায় বঙ্গবন্ধু নেতা-কর্মীদের দ্বারা পরিবৃত্ত হয়ে রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপে মত্ত। আমি বাসায় ঢুকতেই লিডার আমাকে দেখে শিশুর মতো অট্টহাসিতে চারদিক চমকিত করে তুললেন। আমি অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকলাম। এক পর্যায়ে খোঁজ
নিতে থাকলাম। শার্ট-প্যান্টের বোতাম ঠিকমতো লাগিয়েছি কি না অথবা
অন্য কোনো বৈসাদৃশ্য আছে কি না। আমাকে
হতভম্ব অবস্থা থেকে তিনিই উদ্ধার করলেন আরও রহস্যঢাকা কথা বলে। বললেন, ‘তোর জজ মারা গেছে!
তোর কথা তো না রেখে
পারি না। তুই তো আমার দাদা
হোস।’ উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর পিতামহের নাম শেখ আবদুল হামিদ। আমি আরও হতবুদ্ধিতে ডুবে গেলাম। শেষ পর্যন্ত পুরো বিষয়টি জানতে পারলাম। আমার সিটে বঙ্গবন্ধু যাকে এমএনএ পদে মনোনয়ন দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই অবসরপ্রাপ্ত জজ সাহেব আকস্মিকভাবে
মৃত্যুবরণ করেছেন। সুতরাং এমএনএ পদে আমার মনোনয়ন নিশ্চিত হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু প্রথম দিন আমার উপস্থাপিত আকাক্সক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করার সময় দুঃখভরা মুখাবয়ব মনে রেখেছিলেন এবং আমার সৌভাগ্যের চাকা এভাবে খুলে যাওয়ার বিষয়টি ভেবে সেদিন এমনভাবে অট্টহাসিতে পরিবেশটাকে স্মৃতিসিক্ত করে দিলেন। আমার জীবনে এ ধরনের সৌভাগ্যজনক
ঘটনার উদাহরণ বহু আছে।” (আমার জীবননীতি, আমার রাজনীতি- মো. আবদুল হামিদ, পৃষ্ঠা ১৫২)।
বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর আংশিক জীবনীগ্রন্থ এবার বইমেলায় প্রকাশ করেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থে তিনি তাঁর জীবনের ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সময়কাল তুলে ধরেছেন পাঠকদের জন্য। যদিও তাঁর রাজনীতির বিকাশকাল এরপর ব্যাপক বিস্তৃত। কিন্তু এ সময়টুকুর ঘটনাবলি প্রকাশে তিনি থেকেছেন সৎ এবং অকপট। জীবনের প্রাপ্তিগুলোকে ‘সৌভাগ্য’, ‘খোদাই রহমত’ কিংবা ‘অলৌকিক’ বলেই বারবার উল্লেখ করেছেন। নিজের আদর্শ, ত্যাগ, নিষ্ঠাকে সারল্য দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা আছে তাঁর এ জীবনী গ্রন্থে। কিন্তু তারপরও সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ তৃণমূলের তরুণদের উদ্দীপনা জোগাতে এ গ্রন্থটি অসাধারণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি। তবে আমি খুশি হয়েছি গ্রন্থটি প্রকাশের সময় নির্বাচনে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদের বিদায়ের আয়োজন শুরু হয়েছে। এখন তিনি বিদায়ী রাষ্ট্রপতি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রপতি থেকেছেন ‘ভাটি শার্দূল’। একদিকে তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষ। হাস্যরসে তিনি তাঁর রুটিন বক্তৃতাগুলোকেও উপভোগ্য করে তুলতেন। একেবারে খোলামেলা ভাষায়, কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক টানে কথা বলে তিনি মুগ্ধতা ছড়াতেন। জনগণ তাঁকে নিজের মানুষ, আপনজন ভাবতেন। রাষ্ট্রপতির ভাবগাম্ভীর্যের দেয়াল তিনি উপড়ে ফেলেছিলেন। আবার আদর্শের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল, অনড়। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এ মানুষটি তাঁর জীবনীগ্রন্থেও এর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এভাবে- ‘আসলে জীবনে কোনো বিষয়ে আমার সিদ্ধান্ত একবার গৃহীত হয়ে গেলে এর থেকে ফিরে এসেছি এমন উদাহরণ আমার মনে পড়ে না। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জীবন বাজি রেখে নেমে পড়তাম।’ (পৃষ্ঠা ১২৮, আমার জীবননীতি, আমার রাজনীতি)। ৬০-এর দশকে গুরুদয়াল কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এখান থেকেই রাজনীতিতে প্রবেশ। দীর্ঘ ৬০ বছরের বেশি সময়ে রাজনীতির মাঠে আবদুল হামিদের বিচরণ। এ দীর্ঘ সময়ে তাঁর রাজনীতিতে আদর্শিক বিচ্যুতি নেই। পদস্খলন নেই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, এলাকায় রাজনীতি করার জন্য যেমন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মায়া ত্যাগ করেছিলেন, তেমনি তাঁর নির্দেশেই ’৭১-এর মার্চে উত্তাল সময়ে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ট্রেনযাত্রা করেছিলেন ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ। ’৭৫-এর পর যেমন আবদুল হামিদ বিভ্রান্ত হননি, খুনি মোশতাকের প্রলোভনে নিজেকে বিকিয়ে দেননি, তেমনি এক-এগারোর সময় তাঁর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতারা তাঁর অবস্থান নড়চড় করতে পারেননি। শেখ হাসিনার পক্ষে অটল অবস্থানে থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন আদর্শে তিনি কতটা অনড়। কত দৃঢ়। ‘সৌভাগ্য’ অথবা ‘খোদাই রহমত’ তো তাঁর ছিলই। কিন্তু প্রতিটি সৌভাগ্যকে তিনি যথাযথ প্রমাণ করেছেন নিজ যোগ্যতায়। এ কারণেই গত ৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং সংসদীয় দলের নেতা রাষ্ট্রপতির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। রাষ্ট্রপতির আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেন। সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় দলের ভিতর থেকেও নির্বাচন নিয়ে কেউ কেউ রাষ্ট্রপতির কাছে বিভ্রান্তিকর তথ্য পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তখন ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন।’ ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের সমাপনী অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির পদ অনেকটাই অলংকারিক। কিন্তু নির্বাচনের সময় সংবিধানের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, দাতাসংস্থা, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের নানা প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় বঙ্গভবন। এ সময় রাষ্ট্রপতির দৃঢ়তা, গ্রহণযোগ্যতার চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। তার চেয়েও বড় কথা, নির্বাচনকালীন অশুভ গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির অবৈধ ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যবস্তু হন রাষ্ট্রপতি। ব্যক্তিত্বহীন, লোভী, আদর্শহীনরা এ সময়ে ভয়ে বা প্রলোভনে গণতন্ত্রকে বিকিয়ে দেন। যেমন দিয়েছিলেন ড. ইয়াজউদ্দিন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ এ পরীক্ষায় দুবার উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁর রাষ্ট্রপতি মেয়াদকালে দেশে দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দুটি নির্বাচনের সময়েই সংবিধানের বাইরে গিয়ে গণতন্ত্রকে ক্ষতবিক্ষত করার শঙ্কা ছিল। চেষ্টাও ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি এ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন অসাধারণ দক্ষতায়। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও রাষ্ট্রপতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং সম্মান দেখান। টানা ১০ বছর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকেও আবদুল হামিদ বিদায় নিচ্ছেন তুমুল জনপ্রিয় অবস্থায়। রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর চেয়ে বেশি দিন যেমন কেউ থাকেননি, তেমনি তাঁর মতো অভাবনীয় জনপ্রিয়তা নিয়েও কেউ দায়িত্ব পালন করেননি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কতটুকু, তিনি দেশের জন্য কী করলেন, সে প্রশ্ন ছাপিয়ে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটে জিএস হিসেবে জয়ী হওয়া, ভিপি পদে বিপুল ভোটে বিজয় কিংবা ’৭০-এর নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীর জামানত হারানো, আবদুল হামিদের তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ। এ জনপ্রিয়তা তিনি ধরে রেখেছেন বিদায় বেলাতেও। কীভাবে? এর একটি কারণ আমরা শুরুতেই আলোচনা করেছি। আদর্শে অবিচল থাকা। এর চেয়েও বড় কারণ হলো- তাঁর বাঙালিত্ব। তিনি এ দেশের কাদা-জলে বেড়ে ওঠা সন্তান। শেকড় থেকে তিনি বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছেন। এর এক ঝলক পাওয়া যায় রাষ্ট্রপতির লেখা গ্রন্থটিতে। তিনি কিশোর বয়সে ছিলেন ডানপিঠে। খেত থেকে শসা চুরি করেছেন। ডাব চুরি করে হোস্টেলের ছাত্রদের বিলি করেছেন। এমনকি তামাকপ্রীতির কথা অকপটে বলেছেন- ‘আমার তামাকপ্রীতির হাতেখড়ি হাওরে দাওয়াইল্লা কামলাদের সঙ্গে। শৈশবের এই প্রথম প্রেমটা আজও ছাড়তে পারিনি। সহস্রবার চেষ্টা করেছি, পারিনি।’ (পৃষ্ঠা-৪২)। অকপটে লিখেছেন- ‘এই সময়টাতে ছাত্রদের মধ্যে পৌরুষ প্রদর্শনের জন্য উত্তম কুমারের মতো সিগারেট খাওয়ার বাতিক ধরলো আমাকে।’ (পৃষ্ঠা ৭৭)। এটাই আবদুল হামিদ। এখনো তাঁর নিজের কথাগুলো বলেন অকপটে, ভনিতাহীনভাবে। এ কারণেই মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। বিশ্বাস করে। আপন ভাবে। কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সে প্রথম প্রেম, নারীর প্রতি ভালোলাগা, সুন্দরীদের প্রতি মুগ্ধতা তাঁকে তাড়িত করত। মেহের নিগারের প্রতি দুর্বলতার কথা এ বয়সেও মনে রেখেছেন। কৈশোর-উত্তীর্ণ রোমান্টিকতা নিয়ে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি যে কোনো পাঠককেই বিস্মিত করবে। এ প্রসঙ্গে বইটির একটি অংশ উদ্ধৃতি না করে পারছি না।
“আমার নিকলী জিসি হাইস্কুলের দেড় বছরের ছাত্রজীবনের বহু মজার ঘটনা স্মৃতির আকাশে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এগুলো থেকে আরও একটি মজার কথা বলি। আমার দুই শ্রেণি নিচে একটি সুদর্শনা মেয়ে পড়ত। নিকলীতেই তার বাড়ি। মেয়েটি চালচলনে ছিল খুবই চটপটে। অনেকেই তার সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য ঘুরঘুর করত। মনে মনে নিজেকে রাজা-উজির ভাবলেও তখনকার দিনে অনেকের দৌড়ই থেমে যেত কল্পনাতেই। কানাঘুষায় শুনতে পেলাম আমার এক সহপাঠী তাকে পাওয়ার জন্য প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। খবর পেলাম সে নাকি সাফল্যের কাছাকাছিও এসে গেছে। মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। তাকে বিষাদের বড়ি খাওয়াতে হবে। একদিন একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈয়ার করে তাকে বললাম, আমি মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাই। লোকমুখে শুনলাম তুমি নাকি ওর দিকে চোখ দিয়েছ। চাঁদনি রাতে সাপ দেখার মতো চমকে উঠল সে। আশা ভঙ্গের আতঙ্কে আমার সহপাঠী দুমড়েমুচড়ে গেল। সে জানে আমি হাত বাড়ালে তার স্বপ্ন সুদূরে পালিয়ে যাবে। এতটুকু জানিয়েই চলে এলাম। পরদিন তাকে স্কুলে দেখা গেল না। মেয়েটাও নেই। কিছুকাল পর শুনলাম তার বিয়ে হয়ে গেছে। তবে সেই সহপাঠীর সঙ্গে হয়নি। কয়েক বছর পর নিকলীর পথে লঞ্চে সেই সুদর্শনার সঙ্গে দেখা। সে এখন মেয়ে থেকে পুরোপুরি মহিলায় পরিণত হয়েছে। আমি তাকে অকপটেই বললাম, আমি তো তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম মনে মনে। বিবাহিতা মহিলা দেখি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। একটু চমকের সুরে সে বলে, ‘হামিদ ভাই যে কী কয়, লজ্জা শরম নাই।’ আমি বললাম, ‘বিয়ে করাতে লজ্জা কীসের?’ থেমে গেল সে, মুখ দেখে বুঝলাম গভীর ভাবনায় ডুবে গেছে। মনে মনে হয়তো বলছে ‘আগে কইলেন না কেন?’ কথাবার্তা শেষ না হতেই লঞ্চ চুনতি ঘাটে এসে ভিড়ল। সবকিছু অসমাপ্ত রেখেই নেমে গেল সেই মহিলা। তারপর মেঘনায় অনেক জল বয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হলো। বহুদিন পর আমি তখন স্পিকার। হঠাৎ এক বিকেলে টেলিফোন। অপর প্রান্ত থেকে জানাল একজন মহিলা কথা বলতে চায়। আমি জানতে চাইলাম কোন মহিলা। নিকলীর সেই চটপটে মেয়ে। স্মৃতিতে খুঁজে পেলাম না। তবু ফোন লাগাতে বললাম, পরিচয় দিল। সর্বশেষ দেখা হয়েছিল চুনতি ঘাটে নামার আগে, লঞ্চে। হঠাৎ করে রঙিন স্মৃতি জেগে উঠল মনের আকাশে। আলাপে আবারও হারিয়ে গেলাম। সে আবদার করল তার ছেলেটার যেন একটা ব্যবস্থা করে দেই। আমি আবারও হাস্য-রসিকতা করে বললাম, অবশ্যই করব। তোমাকে বিয়ে করলে এই ছেলে তো আমারই হতো। আবারও সেই লঞ্চে বিয়ের মতো কথা থেমে গেল তার। হয়তো অনেক কিছু ভেবে থাকবে। জীবন কত বিচিত্র।” (পৃষ্ঠা ৯৭)।
বাল্য প্রেমের স্মৃতি স্পিকার হয়েও আঁকড়ে রেখেছেন। এটা প্রকাশে কোনো কপটতার আশ্রয় নেননি। এভাবেই সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। তাদের মনের ভিতর জায়গা করে নিয়েছেন। এ ভন্ডামিহীন স্বভাবই তাঁকে রাজনীতিতে দিয়েছে অতুলনীয় জনপ্রিয়তা। জনগণের ভালোবাসা।
আমাদের চারপাশে এখন যারা রাজনীতি করেন তারা কজন এরকম অনায়াসে নিজের কথাগুলো অবলীলায় বলতে পারবেন? কজন বলতে পারবেন তারা আবদুল হামিদের মতো। তিল তিল করে বেড়ে উঠেছেন, কিন্তু নিজেকে পাল্টাননি। একই রকম আছেন। চারপাশে তাকালেই দেখা যায় বদলে যাওয়ার হিড়িক। যখন বিরোধী দলে ছিলেন দেখা হলেই জড়িয়ে ধরতেন। তারপর এমপি হলেন। দামি পাজেরো হাঁকিয়ে যান। দেখা হলে মেকি এক উৎকট হাসি দিতেন। এরপর যখন মন্ত্রী হলেন, তখন দুঃসময়ের সাথীদেরও চেনেন না। কথাবার্তা আচরণে মনে হয় জমিদার। এরকম উদাহরণ বহু। চারপাশে অগণিত এরকম মুখোশ পরে অতীত ঢেকে রাখা মানুষ। অহংকারে এদের যেন মাটিতে পা পড়ে না। এরা মানুষকে মানুষ মনে করে না। সেদিন সরকারি দলের একজন হুইপকে জিজ্ঞেস করলাম ‘সারা দেশে এত উন্নয়ন, তারপরও কেন আওয়ামী লীগের ভোটে জয় নিয়ে সংশয়। কেন অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা তলানিতে।’ তিনি উত্তর দিলেন- ‘ব্যবহার। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের অনেকের মধ্যে দাম্ভিকতা এবং অহংকার প্রকট আকার ধারণ করেছে। এটা সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না। ঘৃণা করে। কিছু কিছু এমপির জনপ্রিয়তা ধসের এটি একটি বড় কারণ।’ এরা তো রাষ্ট্রপতির জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি অতি সাধারণ হাস্যরসে ভরপুর স্বভাবের মানুষ। মাটিতে পা রেখেছেন।
কদিন আগে সরকারের একজন মেধাবী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি আমাকে তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। লিবিয়ার দায়িত্ব শেষ করে ওই কর্মকর্তা সপরিবারে ঢাকায় ফিরছেন। বিমানবন্দরে বসে আছেন। এ সময় দেখলেন, একজন বাঙালি যাত্রী অসুস্থ। তিনি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- বাংলাদেশে যাবেন নাকি। ভদ্রলোক হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন। সরকারি কর্মকর্তা দেখলেন লোকটি বেশ অসুস্থ। তিনি অসুস্থ ব্যক্তিকে সহায়তা করার জন্য আরেক বাংলাদেশিকে খুঁজে বের করলেন। তাকে অনুরোধ করলেন, দুবাইতে যেন অসুস্থ ব্যক্তিকে সহযোগিতা করে এবং কানেকটিং ফ্লাইটে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। ওই সহৃদয় ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। কিন্তু প্লেনে যাত্রীদের ওঠানোর সময় ওই যাত্রীর অসুস্থতার মাত্রা বেশি হওয়ায় তাকে ‘অফলোড’ করা হলো। সরকারি কর্মকর্তা এয়ারলাইনসের লোকজনকে অনুরোধ করলেন বটে। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। তিনি দূতাবাসের গাড়ির ড্রাইভারকে ফোন করে বললেন, একজন অসুস্থ ব্যক্তি যাচ্ছেন, তাকে দ্রুত যেন হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অসুস্থ ব্যক্তিকেও তিনি বললেন, বাইরে তার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। ওই গাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাবে। যথারীতি ত্রিপোলি থেকে প্লেন ছাড়ল। দুবাইতে ট্রানজিটের সময় সরকারি কর্মকর্তাকে খুুঁজে বের করলেন সেই তরুণ। যার সহায়তা অসুস্থ ব্যক্তির জন্য তিনি চেয়েছিলেন। তরুণটি বলল, ‘অসুস্থ ব্যক্তিকে খুঁজে পাচ্ছি না।’ সরকারি কর্মকর্তা তাকে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন। প্লেনে তাকে নেয়নি। আমি দূতাবাসকে বলেছি। দূতাবাসের গাড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।’ তরুণ এবার হতাশ। বললেন, ‘আহারে, মানুষটার যা-ও বাঁচার সম্ভাবনা ছিল দূতাবাসের পাল্লায় পড়ে এখন তার আর বাঁচার আশা নেই।’ ওই সরকারি কর্মকর্তা আমাকে বলছিলেন, ‘এটাই হলো বাস্তবতা। সাধারণ মানুষ সরকারি কথা বিশ্বাস করে না।’ আবদুল হামিদের বইটি পড়তে পড়তে আমার ওই মেধাবী কর্মকর্তার গল্পটা মনে পড়ল। জনগণ এবং সরকারের মধ্যে অবিশ্বাসের দেয়াল ক্রমশ যেন বড় হচ্ছে। একটি সরকার মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়েই। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কজন মন্ত্রীর কথা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে? মন্ত্রী যখন বলেন জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না, তখন মানুষ মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়। সরকারি কর্মকর্তা যখন বলেন ‘দেশের অর্থনীতিতে কোনো সংকট নেই’, তখন মানুষ আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটের কথায় শঙ্কিত হয়। এমপি সাহেব যখন বলেন ‘আমি জনগণের পাশে আছি’, তখন সাধারণ জনগণ ভয় পায়, আমার কি সমস্যা হবে। কেন এ অনাস্থার সংকট? এর কারণ দুটি। প্রথমত, সরকারের লোকজন অকপটে সত্যি কথা বলেন না। দ্বিতীয়ত, তারা জনগণের ভাষায় কথা বলে না। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। কখনো কোনো নির্বাচনে পরাজিত না হওয়া এ মানুষটি অকপটে সত্যটা বলতেন। এমনটি তাঁর জীবনীগ্রন্থেও তিনি চাইলে অনেক ঘটনাই এড়িয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সত্যের মুখোমুখি হওয়ার যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন সেটাই তাঁকে মহিমান্বিত করেছে। তাঁর অকপট সত্য ভাষণই তাঁকে বিশ্বাসযোগ্য করেছে। দ্বিতীয়ত, আবদুল হামিদ সারা জীবন জনগণের ভাষায় কথা বলেছেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তাঁর হাস্যরস এবং হিউমার কোনো ভাড়িক্কির আড়ালে ঢেকে যায়নি। যে কোনো রাজনীতিবিদের জন্য এটি বড় শিক্ষা।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর গ্রন্থে একাধিকবার নিজেকে সৌভাগ্যবান বলেছেন। তিনি লিখেছেন ‘... জীবনে আমি মনে মনে যুক্তিসম্মত যা কিছু চেয়েছি, অনেকটাই অলৌকিকভাবেই তা পেয়ে গেছি। যদিও অলৌকিকতায় আমার একেবারেই আস্থা নেই। তবে বাস্তবে এমন কিছু পেয়েছি যা অলৌকিকত্বের পর্যায়েই পড়ে।’ (পৃষ্ঠা ১৯)। সত্যিই তো। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া এক ডানপিঠে, দুরন্ত বালকের ধীরে ধীরে রাষ্ট্রপতি হওয়ার ঘটনা তো রূপকথার মতোই। তিনি সুযোগ পেয়েছেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন নিজ যোগ্যতায়। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার হওয়ার আগে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে পাদপ্রদীপে ছিলেন না। স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর মতো কেতাদুরস্ত স্পিকারের পাশে তিনি নিজেকে উজ্জ্বল করে মেলে ধরেছেন। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁকে স্পিকার করতে একমুহূর্তও ভাবতে হয়নি কারও। স্পিকার হিসেবে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি বিরোধী দলের উপনেতা হন। তাঁর এ নিযুক্তি যে সঠিক ছিল তা আবদুল হামিদ প্রমাণ করেছেন ২০০৭ সালে অনির্বাচিত সরকারের সময়, সাহসী অবস্থান নিয়ে। জিল্লুর রহমানের রাষ্ট্রপতি হওয়াটা ২০০৯ সালে ছিল অবধারিত। তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি পদকে মহিমান্বিত করেছেন আবদুল হামিদ আপন যোগ্যতায়, মেধায়। তিনি প্রমাণ করেছেন এ পদের জন্য রাজনীতিবিদরাই সবচেয়ে যোগ্য। সম্মান এবং মর্যাদা নিয়েই তিনি বিদায় নিচ্ছেন। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের জন্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এখন এক অদ্ভুত ধাঁ ধাঁ। মিঠামইনে বেড়ে ওঠে, অজপাড়াগাঁয়ের নিকলী জিসি হাইস্কুলে পড়ে, গুরুদয়ালে ছাত্ররাজনীতি করা কাদামাটির গন্ধমাখা কেউ আর কি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন? রাষ্ট্রপতি তো দূরের কথা এলিট স্কুল-কলেজ না পড়ে বিপুল বিত্তের মালিক না হয়ে কি কেউ এমপি হতে পারবেন? নেতা হতে পারবেন?
পাদটীকা : রাষ্ট্রপতির আত্মজীবনীটা ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত। আমি আশা করব তিনি অবসরে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লিখবেন। বাংলাদেশের জন্য, রাজনীতির জন্য এরকম একটি গ্রন্থ খুবই জরুরি।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশ টেলিভিশন আমার পরিচয়। আমি মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে। ১৯৯৬ সালে এই টেলিভিশনে আমি নিউজ রিপোর্টিং শুরু করি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠান চালু হয়। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনধর্মী এই অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবার দুই গুগ পরেও এখনও মানুষ ঐ অনুষ্ঠানকে মনে রেখেছে। আমার সাংবাদিকতা জীবনে পূর্ণতার নাম ‘পরিপ্রেক্ষিত’। পরিপ্রেক্ষিত আমাকে তারকা খ্যাতি দিয়েছে। একারণেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছে আমি সব সময় ঋণী। বিটিভি আমার আবেগের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা, আমার সত্তার অংশ। সেই বিটিভি যখন পুড়ছিল তখন আমি আবেগ সামাল দিতে পারিনি। ৭১ এর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী, রাজাকারাও বিটিভিতে আগুন দেয়নি। প্রায় ২৫ ঘণ্টা বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ ছিলো। এখনও রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি পৈশাচিকতার চিহ্ন বহন করে আছে। শুধু বিটিভি কেন? গত বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাংলাদেশ জুড়ে টার্গেট নাশকতা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে লুট হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। মেট্রোরেল আমাদের গর্বের পরিবহণ ব্যবস্থা। অল্প সময়ের মধ্যে এই গণ পরিবহনটি আমাদের সবার প্রিয় বাহনে পরিণত হয়েছে। এবার হায়নাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলো মেট্রোরেল। তিন দফায় হামলা হয়েছে মেট্রোরেলের উপর। মেট্রোরেলের উপর কোন সাধারণ নাগরিক হামলা করতে পারে, আমি বিশ্বাস করি না। একমাত্র যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা যাদের জন অসহ্য তারাই এমন ন্যাক্কারজনক কাণ্ড করতে পারে। কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ সেতু ভবনে, দুর্যোগ ভবনে কিংবা অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় এভাবে হামলা করতে পারে না। গত বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোন আন্দোলন না, শ্রেফ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই আন্দোলন কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে কোনো ছাত্র আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন। উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নব্য রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির নতুন প্রজন্ম এই অপকর্ম করেছে। ৭১ এর স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিতরা তাদের প্রতিশোধ গ্রহণের মিশনে নেমেছিলো। এজন্যই তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করেছে। বাংলাদেশ এরকম ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন, কোভিড হাসপাতালের মতো জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়নি। যেসব স্থাপনা স্বৈরাচার বা তার দোসরদের নিয়ন্ত্রিত কেবল সেই সব প্রতিষ্ঠানের উপর হামরা চালানো হয়েছিল। কর্নেল মালেক, ব্যারিস্টার হাসনাত, আদেলের মতো স্বৈরাচারের দোসরদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছিল ৯০ এর আন্দোলনে। এটি ছিলো সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনেও ভাঙ্গচুর, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ঐসব কোন ঘটনার সঙ্গেই গত ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের তাণ্ডবের তুলনা করা যায় না। এই দুই দিন হয়েছে রীতিমতো গুপ্ত হামলা, পরিকল্পিত নাশকতা এবং উন্নয়নের চিহ্ন মুছে ফেলার বীভৎস জিঘাংসা। এটি ছিলো ৭১ এর পরাজিত শক্তির প্রতিহিংসার প্রকাশ।
কোটা আন্দোলন নিয়ে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল তা ছিলো যৌক্তিক এবং শান্তিপূর্ণ। শুরুতেই সরকার এই আন্দোলনকে সমঝোতার পথে নিয়ে যেতে পারতো। সরকারের একটি মহলের অতিরিক্ত অহংকার, কোন কিছুকে পাত্তা না দেয়ার মানসিকতার কারণে এই আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে সব কোটা বিলোপ করে। দ্রুত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ঐ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সরকারের ঐ সিদ্ধান্ত ছিলো সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু তারপরও শিক্ষার্থীরা ঐ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। গত ৬ বছর কোটা ছাড়াই সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এনিয়ে কোন আপত্তি ওঠেনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরা পরিপত্র বাতিল এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনঃবহাল চেয়ে রিট পিটিশন দাখিল করে। আইন মন্ত্রণালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের তখনই উচিত ছিলো এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। এই রিটের বিরুদ্ধে শক্ত আইনি লড়াই করা। কিন্তু এনিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ছিলো নির্লিপ্ত। কোটা নিয়ে সরকারি পরিপত্রটি যখন হাইকোর্ট বাতিল করে দেয় তখন শিক্ষার্থীরা নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। এসময়ও ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হয় আইন মন্ত্রণালয়। বিষয়টি যখন আপিল বিভাগে আসে তখন সঙ্গত কারণেই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেনি। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের ভিত্তিতে লিভ টু আপিল করার নির্দেশনা দেয় আপিল বিভাগ। এসময় যদি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করতো, তাহলে হাইকোর্টের রায় স্থিতাবস্থায় নেয়ার জন্য আপিল বিভাগকে অনুরোধ জানাতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। আপিল বিভাগ যখন হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে তখন আন্দোলন গতি পায়। এসময় শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করায় একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ খুব দরকার ছিলো। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভরপুর আওয়ামী লীগ আসন্ন ধেয়ে আসা সংকটের গুরুত্ব অনুভব করতে পারেনি। এসময় পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে সরকারকে একটি সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর ঐ আগাম সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি ক্ষমতাসীন সরকার। এই কোটা আন্দোলন যে বহুদূর গড়াতে পারে সে সম্পর্কেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছিলো। কোটা আন্দোলনের পরিধি যখন বিস্তৃত হতে শুর করে তখন মাঠে নামে বিএনপি-জামায়াত। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ছাত্রদল এবং ছাত্র শিবির। ঢাকায় গোপনে জড়ো করা হয় হাজার হাজার কর্মী। উত্তপ্ত কোটা আন্দোলনে ভড় করে সরকার পতন আন্দোলন শুরু করে বিরোধী দল।
কোটা আন্দোলনের উৎপত্তি এবং বিকাশ গবেষণা করলে দেখা যায় এই আন্দোলনটি আসলে স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের গর্ভজাত। ১৯৯১ সালে ছাত্র শিবির ‘ছাত্র সমাজের দাবি-দাওয়া’ শীর্ষক ২০ দফা দাবি নামায় কোটা সংস্কারের কথা প্রথম উল্লেখ করে। ২০০১ সালে ছাত্র শিবির সব কোটা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং মুক্তিযুদ্ধের কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারক লিপি প্রদান করে। শুরু থেকেই কর্মী হিসেবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চালিকা শক্তি ছিলো শিবির। আর ছাত্র শিবিরের মাধ্যমেই এই আন্দোলনের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। ১৪ জুলাই গণ ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য বিকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয় ছাত্র শিবির। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করা। কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে সরকার পতনের আন্দোলনকে বেগবান করার এক নীল নকশা বেশ আগে থেকেই বাস্তবায়নের চেষ্টায় ছিলো বিএনপি-জামায়াত। ১৪ জুলাই রাত থেকে সেই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেও স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্তবীজ ধ্বংস করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এরা সংগঠিত হয়েছে। সরকারকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এতো বড় সংকটে আগে পরেনি।
স্বাধীনতা বিরোধীরা ১৮ ও ১৯ জুলাই আরেকবার জানিয়ে দিলো তারা উন্নয়ন বিরোধী। বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চায় তারা। আর একারণেই সামনের দিনগুলোতে মুক্ত বুদ্ধি ও প্রগতির চর্চার বিকাশ ঘটাতে হবে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে। একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে এর চেয়েও বড় সংকটে পরতে হতে পারে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটি। বাংলাদেশ মুখোমুখি হতে পারে এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতিতে।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
সহিংসতা হায়না রুখতে হবে বিটিভিতে আগুন জ্বালাও পোড়াও সন্ত্রাস
মন্তব্য করুন
অবশেষে
কারফিউ জারি করা হলো।
আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামানো হলো
সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবারের পর শুক্রবার ঢাকা
সহ সারাদেশে যে তান্ডব হয়েছে
তার প্রেক্ষিতে সরকারের সামনে কোন বিকল্প ছিলো
না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা
বিরোধী জামায়াত-শিবির এই আন্দোলন
ছিনতাই করে। যেভাবে সরকারী
স্থাপনা গুলো আক্রমণ করা
হয়েছে, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে তা
মধ্য যুগীয় পৈশাচিকতা। যারা বাংলাদেশের অস্তীত্ব
বিশ্বাস করেনা, এদেশের অগ্রযাত্রায় যারা ঈর্ষান্বিত, এটি
তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। এটা
কোন আন্দোলন না রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ। এটি কঠোর ভাবে
দমন করতেই হবে। কিন্তু পরিস্থিতি
এমনটি হবার কথা ছিলো
না। কেন এমন সংকটময়
পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো?
কেন
টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ
এরকম একটি জটিল সংকটের
মুখোমুখি। বর্তমান পরিস্থিতি ২০১৩ সালে নির্দলীয়
নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের
আন্দোলন, ২০১৪ সালের আগুন
সন্ত্রাস অথবা গত বছরের
বিরোধীদলের এক দফা আন্দোলনের
চেয়েও ভয়াবহ। এমনকি-২০১৮ সালের কোটা
আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চেয়েও
এবারের আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও অনেক বেশী।
বৃহস্পতিবার থেকে এটি আসলে
বাংলাদেশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। মেট্রোরেলে হামলা,
এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েতে হামলা, বিটিভিতে আগুন ইত্যাদি সবই
৭১ এর বর্বরতার সাথে
তুলনীয়। সরকারি স্থপনা এবং উন্নয়নের স্মারক
অবকাঠামো গুলোতে আগুন লাগানো হয়েছে।
এসব কোন ঘটনার পেছনেই
শিক্ষার্থীরা ছিলো না। সন্ত্রাসী
ভাড়া করে দেশে একটি
অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এই
আন্দোলন স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা শহরে বিভিন্ন
জেলা থেকে প্রায় ৫
লাখ শিবির ছাত্রদল, যুবদলের কর্মীরা এলো। সরকারের বিভিন্ন
সংস্থা কি করলো? এরকম
একটি পরিস্থিতি সৃষ্টিতে তাই ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতাও
কম নয়। আওয়ামী লীগের
বোঝা উচিত ছিলো যেকোন
আন্দোলন খারাপ দিকে মোড় নিতে
লাগে এক মুহূর্তে। আওয়ামী
লীগ তার জন্মের পর
থেকে আজ পর্যন্ত রাজপথে
যত আন্দোলনে সফলতা অর্জন করেছে তার সবগুলোতে অগ্রভাগে
ছিলো শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু টানা ক্ষমতায় থাকার
ফলে অতি আত্ম বিশ্বাস,
অতি অহংকারের কারণে আওয়ামী লীগ সবকিছুকে তুচ্ছ
করেছে। সবকিছুকে উপেক্ষা করার এক সংস্কৃতি
তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীদের
মধ্যে। আওয়ামী লীগের এমন এক হাইব্রীড
প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা
মিছিল করেনি, আন্দোলন করেনি, পুলিশের মার খায়নি তারা
পরিপাটি বাবু। এরা জনবিচ্ছিন্ন। রাজনীতি
মানে এদের কাছে নিজেদের
আখের গোছানো। সবচেয়ে
খারাপ যে প্রবণতাটি তৈরি
হয়েছে পুরো আওয়ামী লীগে
তাহলো শেখ হাসিনার দিকে
তাকিয়ে থাকা। তিনি সবকিছু করবেন
এমন একটি আশায় আওয়ামী
লীগের নেতারা যথেচ্ছাচার করেন। কেউ অনৈতিক সুবিধা
আদায় করেন, কেউ দুর্নীতি করেন,
কেউ লুটপাট করেন, কেউ নিজের আখের
গোছাতে ব্যস্ত থাকেন। ইদানিং আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ
ভাবতে শুরু করে তারা
অক্ষয়, অবিনশ্বর। চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু এই আন্দোলন ক্ষমতাসীনদের
একটি কঠিন সংকেত দিলো।
এই আন্দোলনের ধাক্কায় আওয়ামী লীগ কি তার
ভগ্ন দশা দেখতে পেরেছে?
আওয়ামী লীগ কি সতর্ক
বার্তাটা বুঝতে পেরেছে?
কোটা
সংস্কার আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগ
যে সতর্ক বার্তা পেল তার মধ্যে
অন্যতম হলো দ্রুত সরকারকে
আমলা নির্ভরতা থেকে সরে আসতে
হবে। এই সংকটে আমলারা
ছিলেন নির্লিপ্ত, নিরাপদ দূরত্বে। হঠাৎ আমলা বাবুরা
কেতা দূরস্থ নিরপেক্ষ হয়ে গেছেন। আওয়ামী
লীগের চেয়ে বড় আওয়ামী
লীগ হয়ে ওঠা আমলারা
রাজনৈতিক সরকারের পাশে থাকেনি। কোন
সহযোগিতাও করেনি। আমলাদের সুবিধাবাদী চেহারা দেখা যাচ্ছে উৎকটভাবে।
সংকটে ভোল পাল্টাতে এদের
যে এক মুহূর্ত সময়
লাগেনি। শুধু আমলা কেন
আওয়ামী লীগের ১৫ বছর শাসনামলে
সুবিধাভোগী অনেকেই ভোল পাল্টে ফেলেছেন
মুহূর্তেই। শুধু
বড় আমলারা নন জেলা উপজেলায়
ছোট বাচ্চা আমলারও অনেকে নিরপেক্ষ মুখোশ পরেছেন।
এক শিক্ষক দেখলাম ফেসবুকে বলেছেন, তিনি নাকি ছাত্রলীগের
কাউকে পাঠদান করাবেন না। ভালো কথা।
তার ঠিকুজী ঘাটতে গিয়ে দেখলাম, আওয়ামী
লীগ আমলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া এই শিক্ষিকের চৌদ্দ
গোষ্ঠী বিএনপি করে। দুর্নীতির মাধ্যমে
এভাবেই ‘রাজাকার’ আর বিএনপিকে লালন
করেছে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ। শো
বিজের যে সব তারকারা
মন্ত্রী এমপিদের গা ঘেঁষে সেলফি
তুলেছেন, তারা এখন ফেসবুকে
লম্বা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কোটা সংস্কারে বিপ্লব
দেখছেন। সরকারকে নসিহত দিচ্ছে। গত ১৫ বছরে
যেসব রাজাকারের বাচ্চা, সুবিধাবাদী মতলববাজরা সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন এখন তারা জাতির
বিবেক বনে গেছেন। কোটা
আন্দোলন রাজাকার পুনঃউত্থানের আন্দোলনে রূপ নেয়। এতে
রাজাকারের বংশ এবং মনস্তাত্বিক
রাজাকাররাও যুক্ত হন। শিক্ষার্থীরা যে
অরাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তা স্বাধীনতা বিরোধী
আন্দোলনে রূপ নেয়।
কোটা
নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটিতেই শুরু
থেকে আমলাদের একটি বিতর্কিত ভূমিকা
ছিলো। ভুল পরামর্শ দিয়েছিলো।
বিশেষ করে ২০১৮ সালে
এক সাথে সব কোটা
বাতিল করে দেয়াটা ছিলো
সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি। সেই সময় আমলারাই
সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘ মাথা ব্যাথায় মাথা
কেটে ফেলে’ সমস্যার সমাধানের জন্য। আর সেকারণেই সমস্ত
কোটা বাতিল হয়েছিলো। তখন আমলারা কেন
কমিশন গঠনের সুপারিশ করেনি? আমলাতান্ত্রিক পরামর্শে প্রস্তুতকৃত পরিপত্রটি নিয়ে রিট পিটিশনটি
ছিলো একটি যৌক্তিক আবেদন।
কারণ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরা না করলেও এই
রিট পিটিশন হয়তো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, নারীরা বা পিছিয়ে পরা
জনগোষ্ঠী করতেই পারতো। এখন শিক্ষার্থীরা সব
কোটা বাতিলের কথা বলছে না।
সংস্কারের দাবি করেছে। আমলারা
এভাবেই সরকারকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করছে, ভুল পরামর্শ দিচ্ছে।
বিশেষ করে পেনশন স্কিম
নিয়ে সংকট আমলাদের সৃষ্টি।
এই সংকট আওয়ামী লীগকে
জানিয়ে দিলো সরকার পরিচালনায়
রাজনীতিবিদদের ড্রাইভিং সীটে বসতে হবে।
আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতায় হোঁচট খেতে হবে।
কোটা
সংস্কার আন্দোলনের থেকে আরেকটি যে
সতর্ক বার্তাটি হলো, ছাত্রলীগকে এখনই
থামাতে হবে। ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি
নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছিলো নানা
কথাবার্তা। ছাত্রলীগের সীমাহীন ঔদ্ধত্য বিভিন্ন জায়গায় তাদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিটি বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য ইত্যাদি
নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা।
বিভিন্ন স্থানে তাদের অপকর্মের ফিরিস্তি নিয়ে বিস্তর চর্চা
হয়েছে। কিন্তু তারপরও ছাত্রলীগকে সরকার সামাল দেয়নি। আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ছাত্রলীগ।
এবার কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগের
ছেলেরা যেভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিটুনি খেয়েছে তা নজীরবিহীন। ২০০১
সালে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হল
দখল করে ছাত্রদলও ছাত্রলীগকে
এভাবে পেটানোর সাহস পায়নি। ছাত্রলীগ
তার ইতিহাসে এরকম লজ্জা জনক
অবস্থানে কখনো পড়েছে কিনা
আমার জানা নেই। আর
এটির কারণ হলো
ছাত্রলীগ সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক ধারণা। সহজ সরল ভাষায়
বললে বলা যায়, শিক্ষার্থীদের
মধ্যে ছাত্রলীগ সম্বন্ধে একটি ঘৃণা তৈরি
হয়েছে। আর এই ঘৃণা
বোধ থেকেই শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে প্রতিহত করেছে এবং বিভিন্ন শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে
দিয়েছে। এটি অন্যায্য, এটি
অন্যায়। বিভিন্ন ছাত্রলীগের নেতার সাথে যে বর্বরোচিত
আচরণ করা হয়েছে আমি
তার সমালোচনা করছি। কিন্তু এটাও সত্যি এটি
একদিনে তৈরি হয়নি। এই
ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যদি ছাত্রলীগে শুদ্ধি অভিযান করে, ছাত্রলীগকে ঢেলে
সাজানোর উদ্যোগ নেয় সেটি হবে
সবচেয়ে ভালো কাজ। এই
আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হয়তো একটি
নতুন পরিশুদ্ধ ছাত্রলীগের নবযাত্রা শুরু করতে পারবে।
এঘটনার আরেকটি দিক হলো ছাত্রলীগের
ভেতর অনুপ্রবেশকারী এবং হাইব্রিডরা। যারা
সুযোগ সন্ধানী, সুযোগ পেলেই যারা দল ত্যাগ
করে, মতলববাজি করে। আন্দোলনের মাঝপথে
অনেক ছাত্রলীগ পদত্যাগ করার ঘটনা নজিরবিহীন।
ছাত্রলীগের যে আদর্শের চর্চা
হয় না। এঘটনাগুলো তার
প্রমাণ। ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানোর বার্তা
দিলো এই সংকট।
কোটা
সংস্কার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ভঙ্গুর সাংগঠনিক অবস্থা ফুটে উঠেছে। আওয়ামী
লীগ যে পুলিশ এবং
প্রশাসন ছাড়া অক্ষম, রাজপথে
দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখে না কোটা
সংস্কার আন্দোলনে তা দগ্ধ ঘাঁ
এর মতো করে ফুটে
উঠেছে। আওয়ামী লীগের এরকম ভগ্ন দশা
আগে কখনো ছিলো কিনা
আমার জানা নেই। কোটা
আন্দোলনে যখন জামায়াত-শিবির-ছাত্রদল রাজপথে বেরিয়ে এসেছে তখন আওয়ামী লীগের
সুবিধাবাদী মতলববাজরা সটকে পড়েছে। কিছু
নেতা-কর্মী রাস্তায় গিয়ে ছাত্র শিবির
আর ছাত্র দলের হাতে মার
খেয়েছে আর কেউ কেউ
পালিয়ে গেছে। ঢাকা মহানগরীতে আওয়ামী
লীগের কিন্তু অযোগ্য, অর্থলোভী নেতা ছাড়া যে
আর কিছু নেই তা
প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকার রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করার মতো নেতা-কর্মীর সংকট এবার সংকটে
দৃশ্যমান। নির্বাচনের আগে থেকেই আওয়ামী
লীগে বিভক্তি ছিলো। টানা ক্ষমতায় থাকার
কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
আওয়ামী লীগের নেতারাও স্বীকার করেছেন যে, আওয়ামী লীগের
ভেতর কোন্দল থামেনি। নিজেরা নিজেরা কোন্দল করা আওয়ামী লীগের
যে একটি নিয়মিত ব্যাপার
হয়ে দাড়িয়েছে। এর ফলাফল কি
হতে পারে কোটা সংস্কার
আন্দোলনে ক্ষমতাসীনদের বেহাল দশা তার একটি
উদহারণ মাত্র। দলকে কোন্দল মুক্ত
করে ত্যাগী পরীক্ষিতদের রাজপথে লড়াই করতে পারে
এমন কর্মীদের সামনে না আনলে সামনে
দলটির সংকট আরো বাড়বে।
কোটা
সংস্কার আন্দোলনের আরেকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়েছে।
বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে আওয়ামী
লীগ। ৭৫ বছর পার
করা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির পাশে কেউ নেই।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্ক নেই। যেসমস্ত টেলিভিশন,
সংবাদ পত্র, মিডিয়া প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে চাটুকারিতায় মুখরিত হন তারাই সরকারের
বিরুদ্ধে সানাই বাজিয়েছে। শো বিজের সুন্দরীরা
হঠাৎ কোটার জন্য হাহাকার করছেন।
যেসমস্ত লেখক, বুদ্ধিজীবীরা এটা-সেটা পাওয়ার
আশায় সরকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দেন-দরবার করেন
তারা নিরপেক্ষ হয়ে গেছেন। যেসমস্ত
আমলারা আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় আওয়ামী
লীগ হয়ে গিয়েছিলেন তারা
একেবারে নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে পাথরের মূর্তির
রূপ ধারণ করেছেন। নিরপেক্ষ
হয়ে ঘটনা যাচাই বাছাই
না করেই সরকারকে আসামীর
কাঠগড়ায় দাঢ় করিয়েছে। সবকিছু
মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে
সবার অবস্থান ছিলো অনেকটাই গা
বাঁচিয়ে চলার মতো। পুলিশ,
প্রশাসন কেউই সরকারের জন্য
উজাড় করে দিয়ে দায়িত্ব
পালন করেনি। আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট সঙ্গীরা দূরে
থেকে তামাশা দেখছে। শুক্রবার রাতে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে
১৪ দলের নেতাদের
নিয়ে বৈঠক করেন। তার
আগে অভিমান দূরে রেখে ১৪
দলের নেতাদের সক্রিয়
দেখা যায়নি। এতো একা কবে
ছিলো আওয়ামী লীগ? বন্ধুহীন আওয়ামী
লীগকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির ঐক্যে নেতৃত্ব দিতে হবে আওয়ামী
লীগকেই।
ছাত্র শিবির এই আন্দোলনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলো। এই আন্দোলনটি আসলে ছাত্র শিবিরের গর্ভজাত একটি সন্তান । আর সেকারণেই কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বিরোধী দলকে যতোই অবজ্ঞা করা হোক, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হোক বিশেষ করে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এখনো শক্তিশালী । যেকোন সময় তারা ডাল পালা মেলতে পারে। বাংলাদেশে ৭৫’র পর থেকে রাজাকারের যে রক্তবীজ রোপিত হয়েছে তা এখন মহীরুহের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পরেছে। এবং এদের প্রতিহত করার জন্যই যে সাংস্কৃতিক চেতনা এবং মনোজাগতিক উৎকর্ষতা অর্জন করানো দরকার ছিলো তা করতে পারেনি টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগে সংস্কৃতির চর্চা নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুখে বলে জনবিরক্তির কারণ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রস্ফুটিত করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অঙ্গনে যে মেধা ও মননে আবহ তৈরি করা দরকার সেটি করতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। হেফাজতের পরামর্শে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন, মুক্ত চিন্তাকে বাঁধা দানের প্রবণতার ফলে ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়েছে। আর একারণেই রাজাকারের বংশধরদের উত্থান ঘটেছে। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এখন সারাদেশে জাল বিস্তার করেছে। বিএনপিকে নিয়ে যে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য আওয়ামী লীগের নেতারা করেছে এই ঘটনায় তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন আওয়ামী লীগকে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা আওয়ামী লীগের জন্য একটি সতর্ক বার্তা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি এই সতর্ক বার্তা অনুধাবন করতে পারে তাহলেই তাদের মঙ্গল।
সৈয়দ
বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
১৭ জুলাই থেকে দেশে যা হয়েছে তা কোনো আন্দোলন না। এ ঘটনাকে এক কথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমি মনে করি, এটি উন্নয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ধ্বংসস্তূপে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পিত সন্ত্রাস। কোনো শিক্ষার্থী তো নয়ই, ন্যূনতম বিবেকবান মানুষের পক্ষে এ ধরনের বীভৎসতা ঘটানো সম্ভব নয়। যারা এটা করেছে তাদের লক্ষ্য একটাই- বাংলাদেশকে ধ্বংস করা। প্রশ্ন হলো, কারা এটা করতে চায়? এটি কি শুধু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, জঙ্গি এবং বিএনপির নাশকতা? আমি অন্তত তা মনে করি না। বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল-ছাত্রশিবির, জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অবশ্যই এই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু হুট করে তারা এত ক্ষমতাবান কীভাবে হলো? কোথায় এত টাকা-পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র পেল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে নির্মোহভাবে। আর সে কারণেই এ আন্দোলনের শুরু থেকে এর গতি প্রবাহ এবং সময়কাল বিশ্লেষণ জরুরি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে কোটাবিরোধী প্রচারণার উৎসকাল নব্বই দশক। ’৯০-এ এরশাদের পতনের পর দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে সহযোগিতা করে জামায়াত। এ সময় যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযম প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু করে। জামায়াত মজলিসে শূরার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী এবং ’৭১-এর নরঘাতক গোলাম আযমকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের আমির ঘোষণা করে। ওই মজলিসে শূরায় আরেকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’সহ অযৌক্তিক সব কোটা বাতিল করে মেধাভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব নেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে। এই ২০ দফার মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ দাবিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গত ৩২ বছর ‘কোটা সংস্কার’ নিয়ে কাজ করছে ছাত্রশিবির। ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জামায়াত যখন লণ্ডভণ্ড, তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীরা আরও গভীরভাবে কাজ শুরু করে। বিশেষ করে, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ ছাত্রশিবির এবং জামায়াতকে নতুন করে পরিকল্পনা সাজানোর পথ দেখায়। ছাত্রশিবির তার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। আধুনিক জীবনাচার, তরুণদের আগ্রহগুলো রপ্ত করানো হয়। দাড়ি, টুপি ছেড়ে আধুনিক বেশভূষায় অভ্যস্ত হয় শিবির। দ্রুতই তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশে যেতে শুরু করে। মেধাবী, জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল তরুণদের মধ্যে কোটা নিয়ে অসাম্য তুলে ধরতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে কোটা সংস্কার শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার নিয়ে প্রথম ছাত্র বিস্ফোরণ হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দ্রুত পদক্ষেপ নেন। আন্দোলন থামাতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়। সরকারের ওই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। সুস্পষ্টভাবেই এ সিদ্ধান্ত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসময় আমলারা ‘মাথা ব্যথায় মাথা কেটে ফেলা’র সহজ সমাধান দিয়েছিল। আমলাতান্ত্রিক সমাধানের এটাই হলো সবচেয়ে বড় ব্যাধি। আমলারা একটি সমস্যা ধামাচাপা দিতে আরেকটি সমস্যা সৃষ্টি করেন। ২০১৮ সালে যদি কোটা নিয়ে আন্দোলনকারী এবং এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি স্থায়ী সমাধান করা হতো তাহলে হয়তো বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। যাই হোক, ২০১৮ সালের ওই সরকারি পরিপত্রের পর কোটা আন্দোলন বন্ধ হয়। ছয় বছর দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগ হয়েছে কোনো রকম কোটা ছাড়াই। বছর তিনেক পর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পক্ষ থেকে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের দাবিতে হাই কোর্টে একটি রিট পিটিশন করা হয়। এই রিট পিটিশন এত দূর গড়ালো কেন? ওই রিট পিটিশনের বিরুদ্ধে আইন মন্ত্রণালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস কি তখন এখনকার মতো অবস্থান নিয়েছিল? না নেয়নি। এমনকি, হাই কোর্টের রায়ের পরও আইন মন্ত্রণালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেল যদি দ্রুত আপিল বিভাগে গিয়ে হাই কোর্টের রায় স্থগিত চাইতেন, তাহলেও আন্দোলন এত দূর গড়াতো না। ধাপে ধাপে ছিল উপেক্ষা এবং উদাসীনতা। সবাই যেন পরিস্থিতিকে ভয়াবহ হতে সহায়তা করেছেন। অথবা পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধিই করতে পারেননি। ২০১৮ সালের আন্দোলনের তীব্রতা বুঝতেই পারেননি ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। হাই কোর্টের রায়ের পরই কোটা আন্দোলন সংগঠিত হতে শুরু করে। বিক্ষিপ্তভাবে যখন আন্দোলন দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু হয়, তখনই সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার সুযোগ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের কিছু নেতার দম্ভ, দায়িত্বহীনতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। টানা চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে কিছু জনবিচ্ছিন্নতার মারাত্মক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। সবকিছুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, আত্মতুষ্টি, অহংকার দলের কিছু নেতাকে মোটামুটি ‘মানসিক প্রতিবন্ধীতে’ পরিণত করেছে। এসব নেতা মনে করেন, সবকিছু করবেন প্রধানমন্ত্রী। কিছু বাঁচাল নেতার কথাবার্তা জনবিরক্তি থেকে জনক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নেতা মনে করেন তারা অমর, অবিনশ্বর। এরা আওয়ামী লীগ সংগঠনের যেমন বারোটা বাজিয়েছেন, তেমনি দেশকে ফেলেছেন সংকটে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, কোটা আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে তার আগেই প্রধানমন্ত্রী শুরু করেন দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা, অর্থপাচার এবং কিছু ব্যক্তির সীমাহীন দুর্নীতি এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের কারণে অর্থনৈতিক সংকট গভীর হতে থাকে। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান একটি সাহসী ও সময়োপযোগী উদ্যোগ। এ সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তির লুটপাটের খবর বেরোতে থাকে গণমাধ্যমে। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের ‘আলাদিনের চেরাগ’ কাহিনি গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করে। সরকারের বিশ্বস্ত এবং ঘনিষ্ঠ হিসেবে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেনজীর। এসব পদে থেকে তিনি রীতিমতো লুণ্ঠন করেছেন। আদালতের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিপুল সম্পদ জব্দ করে। কিন্তু সরকারের ভিতর থাকা বেনজীরের দুর্নীতির দোসরদের সহযোগিতায় বেনজীর দেশত্যাগ করেন। বেনজীরের পর তোলপাড় শুরু হয় এনবিআরের সদস্য মতিউরকে নিয়ে। ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কেনার কাণ্ডে বেরিয়ে আসে মতিউরের রত্ন ভাণ্ডারের খবর। মতিউরের পরিবারের হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য গোটা দেশে রীতিমতো ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। এরপর থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে নানা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কেচ্ছাকাহিনি। দুর্নীতি দমন কমিশন একের পর এক সম্পত্তি জব্দ শুরু করে। দুর্নীতিবাজদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আসতে থাকে। কিন্তু বেনজীরের মতো মতিউরও ‘অদৃশ্য মানব’ হয়ে যান। দেশ ছাড়েন মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী সবাইকে ম্যানেজ করে বহাল তবিয়তে আছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর যুদ্ধে সরকারের মধ্যেই যেন দুটি পক্ষ। এক পক্ষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন অনুযায়ী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আরেক পক্ষ দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে তাদের পালাতে সহযোগিতা করে। দুর্নীতি নিয়ে সরকারের ভিতর চলছে দ্বৈতদ্বন্দ্ব। এর মধ্যেই চীন থেকে দেশে ফিরে দুর্নীতি নিয়ে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি’র ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। গত ১৪ জুলাই চীন সফরের ওপর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, ‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ এ সময় শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের জানান চাঞ্চল্যকর তথ্য। বলেন, ‘আমার পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক।’ পরে জানা যায়, ওই পিয়ন হলেন জাহাঙ্গীর। নোয়াখালীর চাটখিল থেকে হতদরিদ্র অবস্থায় ঢাকায় আসেন। শেখ হাসিনার ফাই ফরমায়েশ খাটতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাহাঙ্গীর হয়ে যান প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী, এমপি এমনকি আমলারাও জাহাঙ্গীরকে সমীহ করতেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানার পর গত বছরই তাকে বাদ দেন। নিষিদ্ধ করেন গণভবনে। কিন্তু তারপরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময়ে তাঁর পিয়নের ৪০০ কোটি টাকার তথ্য জাতিকে জানান, যখন পিএসসির এক গাড়িচালকের শত কোটি টাকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তুলকালাম চলছে। বছরের পর বছর ওই ড্রাইভার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আবেদ আলী এবং জাহাঙ্গীর যেন দুর্নীতির বৃত্ত পূরণ করেন। প্রমাণ হয়ে যায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ড্রাইভার-পিয়ন পর্যন্ত দুর্নীতির ক্যান্সারে আক্রান্ত। পরিস্থিতি এমন যে, সরকারের মাথাটি কেবল ঠিক আছে। যাকে দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। আর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতির ক্যান্সার। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে, ‘এসব দুর্নীতিবাজকে গ্রেপ্তার করলে সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয় না। আমি এ ধরনের দুর্নীতির তথ্য জাতিকে জানাতে ভয় পাই না।’ আমার বিবেচনায় ওই সংবাদ সম্মেলনে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্ট একটি বার্তা দিয়েছিলেন। এর ফলে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরা এবং সরকারের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা সহযোগীরা বুঝেছে পরিস্থিতি ভালো নয়। বাঁচার উপায় হিসেবে কোটা আন্দোলন এবং বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের ওপর তারা ভর করে।
প্রধানমন্ত্রীকে ওই (১৪ জুলাই) সংবাদ সম্মেলনে কোটা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলো, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের চেয়ে চাটুকারিতাই বেশি হয়। অনেকে সাংবাদিকতা ভুলে আওয়ামী লীগের কর্মীর মতো মন্তব্য করেন, পরামর্শ দেন। ‘কোটা’ নিয়ে যে দুটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, তা ছিল বর্ণনাধর্মী, মন্তব্যসূচক। রাজাকারের নাতি-পুতি আর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতি সমান যোগ্যতাসম্পন্ন হলে কাকে চাকরি দেবেন?-এটা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। সংবিধান অনুযায়ী চাকরি দেওয়ার এখতিয়ার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের। এরকম মতলবী প্রশ্নেরও বিচক্ষণ উত্তর প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার কন্যা। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার সন্তান। কাজেই তিনি তো বলবেনই মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিই এক্ষেত্রে চাকরি পাবে। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা কখনো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলেননি। কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত হয়ে গেল। তিলকে তাল বানানো হলো। রাতের মধ্যে অদৃশ্য ইশারায় মিছিল বের করল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো। এই আন্দোলন যেন ‘রিমোট কন্ট্রোল’ চালিত আন্দোলন। এক ইশারায় নাচন শুরু হলো সর্বত্র। এ পরিস্থিতির মধ্যেই ক্যাম্পাসগুলোতে ঢুকে পড়লো ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের সশস্ত্র ক্যাডাররা। তাদের লক্ষ্য কোটা সংস্কার নয়, আবাসিক হল দখল। ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলেরা’ বুঝতেই পারেনি কী হচ্ছে। বেধড়ক মার খেল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কহীন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। এরপর সারা দেশে শুরু হলো তাণ্ডব।
গত রবিবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। জাতীয় সংকট নিরসনে আপিল বিভাগের এই অসাধারণ এবং সাহসী ভূমিকা বাংলাদেশের আইনের শাসনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে আপিল বিভাগ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংকটের সমাধান করেছে। কোটা সংস্কার নিয়ে যারা আন্দোলন করেছেন তাদের এ রায়ের বিরোধিতা করার কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু আমার মনে হয় না, এত দ্রুত এই আন্দোলন থেমে যাবে। সংকট থেকে সরকার হয়তো বেরিয়ে আসবে, তবে সময় লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সরকারের দুর্বলতাগুলো উন্মোচিত হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে অনেকে সুযোগ নেবে। নানা ইস্যুতে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করবে। ভাঙা বেড়ার সন্ধান পেলে যেমন ‘শিয়াল’ বারবার বাড়িতে হানা দেয়, তেমনি দুর্বৃত্তরা সুযোগ খুঁজবে।
প্রশ্ন হলো, সরকার তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবে কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের আগে খুঁজে বের করতে হবে, এই বিপুল সন্ত্রাসী ও সহিংসতার মূল কারিগর কারা? নেপথ্যের ‘গডফাদার’ কে? এই অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যের নীলনকশা কার? এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল কোটা আন্দোলন থেকেই। কিন্তু মেট্রোরেলে হামলা, বিটিভি ভবনে হামলা, সেতু ভবন, দুর্যোগ ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনার চিত্রনাট্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের রচিত নয়। এ ধরনের তৎপরতা চালানোর জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ এবং পেশাদারিত্ব লাগে। কাজেই ১৮ থেকে ২০ জুলাই সারা দেশে যে তাণ্ডব হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়। এটা পেশাদার সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত অপকর্ম।
আওয়ামী লীগ এ ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছে। বিএনপির একাধিক শীর্ষনেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এসব ভাঙচুরের সঙ্গে গত ২৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ হাসপাতালে অগ্নিসংযোগের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। বিএনপি এবং জামায়াতের কয়েক লাখ কর্মী কোটা আন্দোলনের ফায়দা লুটতে ঢাকায় ঢুকে ছিল। তারা আন্দোলন বেগবান করেছে। সহিংসতার মাধ্যমে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছে। গুজব ছড়িয়েছে। পুলিশের ওপর ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা চড়াও হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এ পরিকল্পনা ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের পক্ষে প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। নাশকতা পরিচালিত হয়েছে প্রশিক্ষিত কমাণ্ডের মাধ্যমে। এমন এক বা একাধিক ব্যক্তি এ সন্ত্রাসী পরিকল্পনায় জড়িত যিনি পুলিশের দুর্বলতা জানেন, পুলিশের কৌশল সম্পর্কে অবহিত। ঢাকা শহরের স্পর্শকাতর পয়েন্টগুলো তার নখদর্পণে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সম্পর্কে যিনি প্রচুর জ্ঞান রাখেন। সন্ত্রাসী তাণ্ডবের ভিডিও ফুটেজগুলো খুঁটিয়ে দেখলে প্রমাণ মিলবে অনেক কিছুরই। যেমন বিটিভিতে যখন আক্রমণ হয়েছে তখন দেখা যাচ্ছে, রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে লড়াই করছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং ভাড়াটে বাহিনী। এদের মধ্যে থেকে প্রশিক্ষিত কিছু তরুণ পুলিশের ফাঁক গলে বিটিভিতে ঢুকে পড়ে এবং হামলা চালায়। একই ঘটনা লক্ষ্য করেছি সেতু ভবন এবং দুর্যোগ ভবনেও। এরা কারা? এখানেই আমি এই নারকীয় তাণ্ডবের সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাই। এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দুর্নীতিবাজ সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ। তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। কিন্তু দেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। তার সাঙ্গপাঙ্গ আছে সর্বত্র। বেনজীর এক সময় ঢাকার পুলিশ কমিশনার ছিলেন। র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন, পুলিশ প্রধান ছিলেন। পুলিশ বাহিনীর ভিতর তার নিজস্ব লোকজন এখনো আছে। তার চেয়েও বড় কথা তিনি পুলিশের দুর্বলতা জানেন, জানেন কীভাবে তাদের চাপে ফেলা যায়। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকাটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে জঙ্গি দমন করতে গিয়ে তিনি অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছেন। অনেককে বাঁচিয়েছেন। কাউকে কাউকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই নেটওয়ার্ক তার অজানা নয়। সরকারকে উৎখাত করতে পারলে তার ‘দুর্নীতি’ নিয়ে চর্চা হবে না। তিনি নিরাপদ হয়ে যাবেন। এ ভাবনা থেকে এ আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা কি সরকার উড়িয়ে দিতে পারবে? বেনজীর আহমেদের যেসব ঘটনা ও অপকর্মের কাহিনি সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত হয়েছে তাতে নিঃসন্দেহে তাকে ‘গডফাদার’ বলা যায়। এ নারকীয়তার গডফাদার বেনজীরসহ দুর্নীতিবাজরা নয় তা কে হলফ করে বলতে পারবে?
এ তাণ্ডবে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত এত টাকা খরচ করবে তা আমি বিশ্বাস করি না। এরকম অর্থ খরচ করতে পারলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেই তারা করত। এ রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসে এ সময় আলোচিত দুর্নীতিবাজ বেনজীর, মতি, জাহাঙ্গীরের বিনিয়োগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।
নরসিংদী কারাগারে হামলা হয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান কে? প্রত্যেকটি ঘটনার যোগসূত্র খুঁজতে হবে, সমীকরণ মেলাতে হবে। শুধু ‘বিএনপি-জামায়াতের কাজ’ বলে সকাল-সন্ধ্যা কাকের মতো চিৎকার করলে আসল শত্রুকে চিহ্নিত করা যাবে না। ভবিষ্যতে আবার সরকার উৎখাতের চেষ্টা হবে আরও ভয়ংকরভাবে। তাই এখনই সাবধান। আসল শত্রু চিহ্নিত করতে হবে সবার আগে।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
গত সপ্তাহের প্রায় পুরোটা জুড়ে সারা দেশে যে তাণ্ডব হয়েছে তা অবিশ্বাস্য, অনভিপ্রেত এবং দুর্ভাগ্যজনক। এই তাণ্ডবকে একমাত্র একাত্তরের নৃশংসতার সাথেই তুলনা করা যায়। বেছে বেছে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে হামলা করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন স্মারক চিহ্ন। বিটিভি, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো নির্মাণগুলোতে বেছে বেছে হামলা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জানিয়েছেন যে, ‘যারা নাশকতার সাথে জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’ তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন যে, তাদেরকে খুঁজে বের করা হবে এবং আইনের আওতায় নেয়া হবে। প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিরাও একই রকম বক্তব্য দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন আমার পরিচয়। আমি মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে। ১৯৯৬ সালে এই টেলিভিশনে আমি নিউজ রিপোর্টিং শুরু করি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠান চালু হয়। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনধর্মী এই অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবার দুই গুগ পরেও এখনও মানুষ ঐ অনুষ্ঠানকে মনে রেখেছে। আমার সাংবাদিকতা জীবনে পূর্ণতার নাম ‘পরিপ্রেক্ষিত’। পরিপ্রেক্ষিত আমাকে তারকা খ্যাতি দিয়েছে। একারণেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছে আমি সব সময় ঋণী। বিটিভি আমার আবেগের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা, আমার সত্তার অংশ। সেই বিটিভি যখন পুড়ছিল তখন আমি আবেগ সামাল দিতে পারিনি। ৭১ এর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী, রাজাকারাও বিটিভিতে আগুন দেয়নি। প্রায় ২৫ ঘণ্টা বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ ছিলো। এখনও রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি পৈশাচিকতার চিহ্ন বহন করে আছে। শুধু বিটিভি কেন? গত বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাংলাদেশ জুড়ে টার্গেট নাশকতা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে লুট হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। মেট্রোরেল আমাদের গর্বের পরিবহণ ব্যবস্থা। অল্প সময়ের মধ্যে এই গণ পরিবহনটি আমাদের সবার প্রিয় বাহনে পরিণত হয়েছে। এবার হায়নাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলো মেট্রোরেল। তিন দফায় হামলা হয়েছে মেট্রোরেলের উপর। মেট্রোরেলের উপর কোন সাধারণ নাগরিক হামলা করতে পারে, আমি বিশ্বাস করি না। একমাত্র যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা যাদের জন অসহ্য তারাই এমন ন্যাক্কারজনক কাণ্ড করতে পারে। কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ সেতু ভবনে, দুর্যোগ ভবনে কিংবা অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় এভাবে হামলা করতে পারে না। গত বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোন আন্দোলন না, শ্রেফ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই আন্দোলন কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে কোনো ছাত্র আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন। উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নব্য রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির নতুন প্রজন্ম এই অপকর্ম করেছে। ৭১ এর স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিতরা তাদের প্রতিশোধ গ্রহণের মিশনে নেমেছিলো। এজন্যই তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করেছে। বাংলাদেশ এরকম ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন, কোভিড হাসপাতালের মতো জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়নি। যেসব স্থাপনা স্বৈরাচার বা তার দোসরদের নিয়ন্ত্রিত কেবল সেই সব প্রতিষ্ঠানের উপর হামরা চালানো হয়েছিল। কর্নেল মালেক, ব্যারিস্টার হাসনাত, আদেলের মতো স্বৈরাচারের দোসরদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছিল ৯০ এর আন্দোলনে। এটি ছিলো সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনেও ভাঙ্গচুর, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ঐসব কোন ঘটনার সঙ্গেই গত ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের তাণ্ডবের তুলনা করা যায় না। এই দুই দিন হয়েছে রীতিমতো গুপ্ত হামলা, পরিকল্পিত নাশকতা এবং উন্নয়নের চিহ্ন মুছে ফেলার বীভৎস জিঘাংসা। এটি ছিলো ৭১ এর পরাজিত শক্তির প্রতিহিংসার প্রকাশ।
অবশেষে কারফিউ জারি করা হলো। আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামানো হলো সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবারের পর শুক্রবার ঢাকা সহ সারাদেশে যে তান্ডব হয়েছে তার প্রেক্ষিতে সরকারের সামনে কোন বিকল্প ছিলো না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির এই আন্দোলন ছিনতাই করে। যেভাবে সরকারী স্থাপনা গুলো আক্রমণ করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে তা মধ্য যুগীয় পৈশাচিকতা। যারা বাংলাদেশের অস্তীত্ব বিশ্বাস করেনা, এদেশের অগ্রযাত্রায় যারা ঈর্ষান্বিত, এটি তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। এটা কোন আন্দোলন না রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটি কঠোর ভাবে দমন করতেই হবে। কিন্তু পরিস্থিতি এমনটি হবার কথা ছিলো না। কেন এমন সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো?
১৭ জুলাই থেকে দেশে যা হয়েছে তা কোনো আন্দোলন না। এ ঘটনাকে এক কথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমি মনে করি, এটি উন্নয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ধ্বংসস্তূপে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পিত সন্ত্রাস। কোনো শিক্ষার্থী তো নয়ই, ন্যূনতম বিবেকবান মানুষের পক্ষে এ ধরনের বীভৎসতা ঘটানো সম্ভব নয়। যারা এটা করেছে তাদের লক্ষ্য একটাই- বাংলাদেশকে ধ্বংস করা। প্রশ্ন হলো, কারা এটা করতে চায়? এটি কি শুধু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, জঙ্গি এবং বিএনপির নাশকতা? আমি অন্তত তা মনে করি না। বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল-ছাত্রশিবির, জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অবশ্যই এই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু হুট করে তারা এত ক্ষমতাবান কীভাবে হলো? কোথায় এত টাকা-পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র পেল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে নির্মোহভাবে। আর সে কারণেই এ আন্দোলনের শুরু থেকে এর গতি প্রবাহ এবং সময়কাল বিশ্লেষণ জরুরি।