বাংলাদেশের জন্য আজ একটি অনন্য দিন। গৌরবের দিন। আরেকটি বিজয় পালকের অর্জনের দিন আজ (১ নভেম্বর)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক প্রধান পদে নির্বাচিত হয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা। জাতির পিতার দৌহিত্র। কিন্তু এসব পরিচয় ছাপিয়ে আপন মহিমায় তিনি উদ্ভাসিত। আপন কৃতিতে তিনি উজ্জল। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও বাংলাদেশ এসব কোন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে যেতে পারেনি। সায়মা ওয়াজেদ হলেন প্রথম বাংলাদেশী যিনি জাতিসংঘের একটি সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হলেন।
বাংলাদেশ কখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পদে নির্বাচিত হতে পারেনি। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে সায়মা এই কৃতিত্ব অর্জন করলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছিলো প্রথম জাতিসংঘের কোন সংগঠন যেখানে বাংলাদেশ সদস্য পদ পেয়েছিল। আর পুতুলের আঞ্চলিক প্রধান হবার ঘটনার কাকতালীয় ভাবে সেই অভিযাত্রাকে পূর্ণতা দিলো। এই অর্জন সায়মার, এই বিজয় বাংলাদেশের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক প্রধান পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ১১টি দেশ নিয়ে এই অঞ্চল। এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশী দরিদ্র মানুষ বসবাস করে। বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, উত্তর কোরিয়া, নেপাল, ভুটান, তিমুর লেস্টে, ইন্দোনেশিয়া এবং মালদ্বীপ সমন্বয়ে এই দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল। মিয়ানমারও এই অঞ্চলের সদস্য কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা ভোট দিতে পারেনি। বিশ্বের প্রায় ৩৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব পালন করে এই অঞ্চল। সিয়ারোর আঞ্চলিক প্রধান নির্বাচিত হবার মধ্যে দিয়ে পুতুলের হাতে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ জনগণের স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব ন্যস্ত হলো। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবার জন্য নতুন পথের সন্ধান দেবেন তিনি।
আঞ্চলিক প্রধান যদিও সদস্য দেশগুলো ভোটে নির্বাচিত হন, কিন্তু প্রার্থীর ব্যক্তিগত মেধা, যোগ্যতা তার নেতৃত্ব গুণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা হয়। আঞ্চলিক প্রধান হলে তিনি কি অবদান রাখবেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উন্নয়নে তার পরিকল্পনা উদ্ভাবন ইত্যাদি বিষয়ে তাকে দিতে হয় বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনা। কোন দেশের প্রার্থী তার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা, নেতৃত্ব।
সায়মা ওয়াজেদ অবশ্য কয়েক বছর ধরেই বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আলোচিত ও প্রশংসিত নাম। ‘অটিজম’ ইস্যুকে বিশ্ব মঞ্চে পাদ প্রদীপে আনার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রপথিক। তার নেতৃত্বেই গোটা বিশ্ব অটিজম ইস্যুতে সচেতন হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এটি আগে উপেক্ষিত এবং অবহেলিত বিষয় ছিলো। পুতুল বিষয়টি বিশ্ব নেতৃত্বের নজরে আনেন। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি বিশ্ব জাগরণ তৈরী করেন। পুতুল বিশ্বে অটিজম ইস্যুতে বিশ্ব জাগরণের পথ প্রদর্শক। নিরন্তর ভাবে এই একটি ইস্যুতেই কাজ করেছেন তিনি। অটিজম ছাড়াও নারী স্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে সায়মা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
মা একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৪২ বছর ধরে। দম ফেলার কুসরত নেই। সন্তানদের সময় দিতে পারেন নি। বোডিং স্কুলে রেখে ছেলে-মেয়েকে পড়িয়েছেন। ছেলে-মেয়েরা মায়ের ভালোবাসা বঞ্চিত হয়েও বিপথে যায়নি। পথ হারাননি বরং আরো দায়িত্ববান হয়েছে। তারা মায়ের কষ্ট বুঝেছে। মা যে জনগনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, এই অনুভব তাদের আরো দৃঢ় করেছে। সৎ করেছে। সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজেদের তারা গড়ে তুলেছেন। আঞ্চলিক প্রধান হয়ে পুতুল প্রমাণ করেছেন, ন্যায়ের পথে, সততার আদর্শে থাকা অভিভাবকের সন্তানরাও ন্যায়নিষ্ট হন। তারা অভিভাবকদের কাছে থেকে আদর্শ শেখেন। মানুষের জন্য কাজ করার প্রেরণা পান। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, বিচক্ষণতা এবং দক্ষতা সঞ্চারিত হয়েছে পুতুলের মধ্যে। যে কারণে তিনি আজ বিশ্ব মঞ্চে নেতৃত্বের ভূমিকায় অভিসিক্ত হলো।
শেখ হাসিনা টানা ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রী। ২০ বছর দেশ পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর কন্যা আরাম আয়েশে জীবন কাটাবেন। উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতি করবেন কিংবা রাজনৈতিক সুবিধা নেবেন -এমনটাই আমরা দেখেছি। এদেশের এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র লুটেরা, দূর্বৃত্ত এবং সন্ত্রাসী হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত। তার দূর্নীতির নানা ঘটনা দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে বিশ্বে চর্চা হয়। বিশ্বেও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারদের আপন আলোয় উদ্ভাসিত হবার ঘটনা কম। সায়মা ওয়াজেদ সেপথে হাটেননি। সততা এবং আদর্শ তার ধমনীতে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাননি তিনি। কর্মক্ষেত্রে বিকশিত হয়েছেন আপন প্রতিভায়, কঠোর পরিশ্রম করে। মা প্রধানমন্ত্রী, এই পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রীয় কোন সুযোগ সুবিধা নেন নি। দেশ সেবার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন নিজস্ব পথ। রাজনীতি ছাড়াও সে দেশের জন্য যে অনেক কিছু করা যায় সায়মা ওয়াজেদ তা প্রমাণ করলেন।
এই বিজয় বাংলাদেশের এক অনন্য অর্জন। বাংলাদেশে সবার জন্য স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করার যাত্রা শুরু করেছিলেন জাতির পিতা। প্রান্তিক দরিদ্র মানুষ যেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আওতায় আসে সেজন্য বঙ্গবন্ধু একটি রূপ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য ভাবনাকে পূর্ণতা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলো দরিদ্র মানুষের দৌড়গড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক গঠন করেন। এই কমিউনিটি ক্লিনিক এখন বিশ্বে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার মডেল। কিছুদিন আগে জাতিসংঘে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিসিয়েটিভ’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মত ভবে গৃহীত হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নবজাতকের মৃত্যুরোধ, মাতৃস্বাস্থ্য সহ স্বাস্থ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্যে রোল মডেল। বিশ্বের হত দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনুকরণীয় উদাহরণ। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবীদ অমর্ত্য সেন এক নিবন্ধে বলেছিলেন ‘ভারতের উচিত তাদের বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়া।’ এরকম একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের একজন স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের নেতার দরকার ছিলো। যিনি বাংলাদেশের অর্জনের গল্প বিশ্বে ছড়িয়ে দেবেন। যার হাত ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আলোকিত হবে। যিনি বিশ্বকে পথ দেখাবেন বৈষম্য মুক্ত এক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কাঠামো বিনির্মানের নেতৃত্বে নিতে যাচ্ছেন সায়মা ওয়াজেদ। তার এই জয়টা বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। এটি শুধু সায়মা’র একক বিজয় না। গোটা বাংলাদেশের অর্জন।
সায়মা ওয়াজেদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শেখ হাসিনা আঞ্চলিক প্রধান
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’
সৈয়দ ইবরাহিম চৌকস সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কোরআন এবং ইসলামী ব্যাখ্যায় তিনি অনবদ্য। মুসলিম যুদ্ধের কৌশল নিয়ে একটি চমৎকার গ্রন্থের লেখক এই মেধাবী মানুষটি। সহজ সরল সদালাপী। নির্বাচনে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আছে সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। কিন্তু তার নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি শরিকরা। নির্বাচনী এলাকায় তিনি এখন বিএনপি কর্তৃক অবাঞ্ছিত। ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সৈয়দ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। নুর বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা কোরবানির গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন।’ শুধু নুর নয়, একই রকম বক্তব্য রেখেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত শুক্রবার এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, ‘এ বয়সে এসে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হতে চাই না।’ সৈয়দ ইবরাহিম গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। বরং নিজের বুদ্ধি বিবেচনার দ্বারাই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমার ধারণা। কোরবানির হাটে নিজেকে বিক্রির অভিপ্রায় থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তৃণমূল বিএনপি, কিংবা বিএনএমে যোগ দিতেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যোগাযোগ করতেন। সৈয়দ ইবরাহিম তা করেননি। এটি তার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। তবে নির্বাচনের মাঠে এখন কেনাবেচার খেলা জমে উঠেছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেক নেতাই বলছেন, ‘আমি গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হব না।’ রাজনীতিতে এ কেনাবেচার ইতিহাস অনেক পুরোনো। নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন। নিজেদের আদর্শকে কোরবানি দিয়েছেন।
বিএনপির এখন পর্যন্ত অবস্থান নির্বাচনে না যাওয়ার। এখনো দলটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্তত কাগজে-কলমে। অবরোধের ঘোষণা দিয়ে চুপচাপ বসে নদীর ঢেউ গুনছেন নেতারা। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল ৩৪টি দল। এদের মধ্যে বেশ কিছু দল এখন নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সামনে আরও চমক অপেক্ষা করছে।’ বিএনপির এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, নির্বাচন বর্জনের পক্ষে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়ানো। এজন্য রাজনীতিতে কেনাবেচার খেলা চলছে। জাতীয় পার্টির একজন নেতা স্বীকার করেছেন, জাতীয় পার্টি যেন নির্বাচনে না যায় সেজন্য ‘বড় অফার’ দেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। কান পাতলে নানা কথা শোনা যায়। এখনো জাতীয় পার্টি নাকি নিলামে আছে। দর-কষাকষি এখনো চলছে। শেষ মুহূর্তে ভালো দর পেলে, ২০১৪ সালের মতো, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে দলটি, এমন গুঞ্জনও শোনা যায়। বিএনপির শরিকদের মোটা অঙ্কের উপঢৌকনের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা নির্বাচনে না যায়। আদর্শ বা নীতি নয়, টাকার লোভে নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তও এক ধরনের কেনাবেচা। গরু-ছাগলের মতো কোন কোন রাজনীতিবিদের কত দাম ওঠে তা জানার অপেক্ষায় আমরা। বিএনপির প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনে না যাওয়াদের পাল্লা ভারী করা। নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর বলে—‘এটা পাতানো খেলা। আবার নির্বাচন করতে হবে।’ সে আশায় রাজনীতির হাটে এখন লন্ডনি পাউন্ডের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। শুধু জোট নয়, ঘরেই অবিশ্বাস-সন্দেহের দোলাচলে বিএনপি। দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে তারা গোপন আঁতাত করছেন। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তারা ‘গরু-ছাগলের’ মতো বিক্রি হয়েছেন। এজন্য ঘর সামলাতে ব্যস্ত বিএনপি। এর আগে সিলেট সিটি নির্বাচনে দলের নেতাকে ধরে রাখতে ‘নজরানা’ দিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেতা। নির্বাচনে না দাঁড়ানোর বিনিময়ে তিনি কী কী পেয়েছেন, তা গোপনই রয়ে গেছে। তবে দলীয় পদ প্রাপ্তিও যে এক ধরনের উৎকোচ, তা নিশ্চয়ই জনগণ উপলব্ধি করে। এবার বিএনপি আরও মরিয়া। জনপ্রিয় এবং নির্বাচনে যেতে আগ্রহীদের তা থেকে দূরে রাখতে নানা টোপ দেওয়া হচ্ছে। পদ-পদবির সঙ্গে আছে নগদ প্রলোভন। আন্দোলন নয়, বিএনপিতে চলছে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’র রাজনীতি। আদর্শহীন রাজনীতিতে টাকা-পয়সা ও পদ-পদবির লোভই শেষ অস্ত্র।
এটা স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়া একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন চায়। এমন একটি নির্বাচন যেখানে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। দৃশ্যত নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা তো নির্বাচন উৎসবমুখর করতে পারবে না। এজন্যই বাজারে এসেছে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, ইসলামী জোট, যুক্তফ্রন্টসহ নানা জাতের-রঙের বাহারি রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টিসহ এসব নতুন রং করা পুরোনো গাড়ি নির্বাচনী মহাসড়কে চলাচল শুরু করতেই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। জনগণ ধীরে ধীরে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী হতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করেছিল, এখনকার পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নয়, বরং দেশ স্বাভাবিক। বিএনপি রাজনীতির মূলধারা থেকে প্রায় ছিটকে যাচ্ছে ক্রমাগত। নির্বাচনের মহাসড়কে এত গাড়ি নামাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ কসরত করেছে। বিনিয়োগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ছোট একটি গল্প বলতে চাই। এক ব্যবসায়ী তার ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন, একজন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে একটা কাজ বাগাতে হবে। ম্যানেজার ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। এসে মালিককে বললেন, ‘উনি (ঘুষ) খান না।’ ব্যবসায়ী হেসে বললেন, ‘কত খান না?’ পরে ব্যবসায়ী নিজেই ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দফারফা করলেন। এখন আমরা এমন এক আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বসবাস করি, যেখানে আদর্শ মূল্যহীন, নীতি অর্থহীন। সবকিছুই কেনাবেচা হয়। রাজনীতিতে কেনাবেচা এখন ‘হালাল’। তাই কে ‘নগদে’, কে ‘আশ্বাসে’ নির্বাচনে এলো; তার হিসাব খুঁজে লাভ নেই। নির্বাচনী মাঠ এখন কোরবানির গরু-ছাগলের হাট। তবে এখানে ক্ষমতাসীনরা একাই ক্রেতা নয়। বিরোধীরাও নিলামে শক্তিশালী পক্ষ। বাংলাদেশে কেনাবেচার রাজনীতি নতুন নয়। সৈয়দ ইবরাহিমই প্রথম রাজনীতিতে ‘ডিগবাজি’ দিয়েছেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ’৭৫-এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গরু-ছাগলের হাট প্রথা চালু হয়। সহজভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগলের মতো কেনাবেচার জনক জিয়াউর রহমান। তিনি সামরিক গোয়েন্দাদের দিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। বিভিন্ন লোককে বিএনপিতে যোগদানের জন্য নগদ অর্থ, ব্যবসা, টেন্ডার, ব্যাংক ঋণ দেওয়ার প্রথা চালু হয় জিয়ার হাত ধরেই। তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ, মশিউর রহমানকে (যাদু মিয়া) দলে ভেড়ান, তেমনি চৈনিক বাম, গলাকাটা পার্টির তরিকুল ইসলাম, মান্নান ভূঁইয়াদেরও কাছে টানেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কে এম ওবায়দুল রহমানের মতো নেতাদের বিএনপিতে নিয়ে জিয়া আওয়ামীবিরোধী ‘ককটেল’ সৃষ্টি করেন, যার নাম বিএনপি। জিয়া রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে সত্যিই ডিফিকাল্ট করেছিলেন। তার নেতৃত্বে রাজনীতিতে প্রবেশ করে কালো টাকার মালিক, মাস্তান, দুর্বৃত্তরা। তবে রাজনীতিতে গরু-ছাগলে হাটকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ কবি ছিলেন, তাই রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগল বানিয়েছিলেন তিনি কাব্যিক ঢঙে। বিকেলে জনসভায় এরশাদকে তুলোধোনা করেছিলেন ব্যারিস্টার কোরবান আলী। সন্ধ্যায় গোটা জাতি অবাক বিস্ময়ে দেখল স্বৈরাচারের মন্ত্রী হয়ে নিজেকে কোরবানি দিলেন মুজিব সৈনিক। কাজী জাফর আহমেদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কিংবা মিজান চৌধুরীর জাতীয় পার্টিতে যোগদান ছিল একেকটি প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার অনুপম কাব্য। তাদের ডিগবাজি এত বিস্ময়কর যে, অলিম্পিকে এরকম কোনো খেলা থাকলে অবলীলায় তারা স্বর্ণপদক পেতেন। রাজনীতিকে এরশাদ রীতিমতো গরু-ছাগলের হাট বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হাটেই এরশাদ নিঃস্ব রাখালে পরিণত হন ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে। এরশাদের পতনের পর গরু-ছাগলদের রশি আর রাখালের হাতে থাকেনি। যারা এরশাদের জন্য জান কোরবার করার প্রতিযোগিতা করতেন, তাদের প্রায় সবাই যোগ দেন বিএনপিতে। স্বৈরাচারের দোসররাই যখন এরশাদকে স্বৈরাচার বলে গালি দেয়, তখন লজ্জায় মুখ লুকানো ছাড়া উপায় কি? এখানেও কেনাবেচার রাজনীতি। এরশাদের চাটুকার গোষ্ঠীর ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বহুজনকে সস্তায় কিনে নেয় বিএনপি। ভাবখানা এমন বুড়ো গরুর দাম কম! স্বৈরাচারের উপ-রাষ্ট্রপতি ২০০১ সালে বিএনপির আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বিএনপির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডিগবাজির রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ বিরোধী দল ভাঙার জন্য, বিরোধী নেতাদের ভাগিয়ে আনার যে ‘অস্ত্র’ বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি আবিষ্কার করেছিল, আজ সেই অস্ত্রেই তারা ঘায়েল হচ্ছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনের জন্য এরশাদ আ স ম আবদুর রবকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করতে বিএনপি মৃতপ্রায় খুনিদের দল ‘ফ্রিডম পার্টি’কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। ক্ষমতায় থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনীতিতে যারা ‘গরু-ছাগলের হাট’-এর প্রবর্তন করেছিলেন, তারাই এখন কোরবানির হাটের পণ্য। ’৭৫-এর পর রাজনীতির যে কেনাবেচার অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, সেই অধ্যায় আজ ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব’ হয়ে উঠেছে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি তাতেই ক্ষতবিক্ষত। শুধু রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন না। রাজনীতিই এখন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। সবচেয়ে বড় বাণিজ্য।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
কল্যাণ পার্টি নির্বাচন আওয়ামী লীগ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের নির্বাচন ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের নির্বাচন ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য করুন
প্রায় দু সপ্তাহ নীরব থাকার পর মাহমুদুর রহমান মান্না আবার সরব হয়েছেন। আবার রাস্তায় এসে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। কিন্তু গত দু সপ্তাহ তিনি কোথায় ছিলেন? বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে যে, এ সময় মান্না সরকারের সাথে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে দেন দরবার করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেন দরবারের রফা হয়নি। সেই কারণেই মান্না এখন আবার সরব হয়েছেন। আবার বিরোধী দলের লড়াকু সৈনিক হিসেবে মাঠে নেমেছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না যা চেয়েছিল তা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’
যেকোনো সংকট সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটও এক অসাধারণ সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। রাজনীতিকে আবর্জনামুক্ত এবং দূষণমুক্ত করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭৫ এর পর থেকে দূষিত, দূর্গন্ধময় হতে হতে এখন তাতে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তরুণরা। সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজনীতি হলো শর্টকাটে নির্বিঘ্নে লুটপাটের সহজ পথ। রাজনীতি এখন প্রধান ব্যবসা। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, দূর্বৃত্ত, অর্থপাচারকারীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে রাজনীতি। জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য সত্যিই তিনি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করেছেন। ভাড়াটেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে রীতিমতো দখল করেছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বাংলাদেশ নিয়ে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সরব ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং তারা বাংলাদেশে নির্বাচন সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন, হুমকিও দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তা নিশ্চিত করার জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে এবং সেই ভিসা নীতি গত সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলেও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে ২৮ অক্টোবর বিএনপি সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং তাণ্ডব করল, সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলে যেতে শুরু করে। এরপর অবশ্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস নির্বাচন কমিশন সহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলেন, বৈঠক করেছেন। মার্কিন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে চিঠি দিয়েছিলেন, তারা যেন শর্তহীন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত মুখোমুখি অবস্থানে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের ইচ্ছারই জয় হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অভিপ্রায় মেনে নিল। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এতদিনের যে আগ্রহ ছিল তা গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচন সেদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তারা চায়, বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়িত হোক। এটুকু প্রত্যাশা সকল দেশের, সকল বন্ধুরাষ্ট্রের এবং বাংলাদেশের সঙ্গে যাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে তাদেরও। আর তাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সহনীয় এবং সহনশীল অবস্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তনের হাওয়া সূচনা করেছে।