এডিটর’স মাইন্ড

আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন। যেহেতু কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্যোগকে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই এমন একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা সমীচীন নয়, শোভনও নয়। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি করতে চাই। তুমি যোগাযোগ কর। আমি বঙ্গভবনে যোগাযোগ করলাম। রাষ্ট্রপতি চিকিৎসা শেষে মাত্র যুক্তরাজ্য থেকে ফিরেছেন। একান্ত সচিব বললেন, ‘আমি দেখছি।’ দুদিন পর সময় পাওয়া গেল। আমি এবং সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী গেলাম বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি হবার পর এটা ছিলো আমার তৃতীয় সাক্ষাৎ। তিনবারের কোন বারেই তার আন্তরিকতার ঘাটতি পাইনি। দেশে সর্বোচ্চ পদে যাবার পরও তিনি সেই হাসিখুশী, বন্ধুসুলভ, প্রাণবন্ত, নির্ভেজাল মানুষ। সদ্য চিকিৎসা শেষ করে তিনি দেশে ফিরেছেন। জরুরী রাষ্ট্রীয় কাজ ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কিন্তু আমাদের অনুরোধ তিনি ফেললেন না। সচিবকে ডেকে একটা তারিখ ঠিক করতে বললেন। সেই থেকে এই আয়োজনের ব্যস্ততা। অবশেষে ৩০ এপ্রিল একটা সফল এবং গোছানো অনুষ্ঠান করলো ক্রিয়েটিভ মিডিয়া। অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। রাতের খাবারের পর সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে আধো ঘুমে টেলিভিশন সংবাদ দেখার চেষ্টা করছি। রাত বাজে সাড়ে দশটা। এমন সময় রাষ্ট্রপতির ফোন। আমি বেশ বিস্মিত হয়েই ফোন ধরলাম। রাষ্ট্রপতি বললেন ‘বোরহান খুব সুন্দর অনুষ্ঠান করেছেন। ধন্যবাদ।’ আমি আপ্লুত, হতবিহম্বল। রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘অনুষ্ঠানে আপনাকে খুঁজলাম। পেলাম না। দেখা হলো না, তাই ফোন করলাম।’ আমি জানালাম পর্দার পিছনে থেকে অনুষ্ঠান তদারকি করছিলাম। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি ফোন রাখলেন। দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির বিনয়, উদারতা মুগ্ধ করার মতো। আজকাল এই আচরণ অভাবনীয়। আমার জন্য এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর সম্প্রতি পূর্ণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে বঙ্গভবনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। মোঃ সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি হওয়াটাই ছিলো এক চমক এবং বিস্ময়কর ঘটনা। নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এনিয়ে নানা আলোচনা ছিলো। বিভিন্ন রথী মহারথীদের নাম সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে কোথাও মোঃ সাহাবুদ্দিনের নাম ছিলো না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গুলশানে আমি নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি আমি রাষ্ট্রপতি হবো।’ আমাকে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন এভাবে ‘পরদিন পাবনা যাবো। এজন্য সেলুনে গেছি, চুল কাটাতে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, কি করছি। আমি জবাব দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন আমার ব্যাংকে কোন লোন আছে কিনা, ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ইত্যাদি।’ তিনি বললেন, ‘তখনও আমি ভাবিনি, এরকম কিছু হচ্ছে।’ 

একটা কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্য সেই সময়টা ছিলো কঠিন, অনিশ্চয়তায় ভরা। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানী, বিরোধী দলের আন্দোলন, সুশীলদের চক্রান্ত। সব কিছু মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, সেটিই ছিলো এক বড় প্রশ্ন। এরকম পরিস্থিতি সব সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলের দরজা খুলে দেয়। চক্রান্ত ডাল মেলা মেলে। বাংলাদেশে অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রায়ই বঙ্গভবন হয় ষড়যন্ত্রের আঁতুড় ঘর। ২০০৭ সালের এক এগারো যার সর্বশেষ উদহারণ। সুশীলদের পক্ষ থেকে ‘নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য’ কাউকে রাষ্ট্রপতি করার আহ্বান ছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো চাইছিলো এমন কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে যার মাধ্যমে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেটানো যায়। 

আওয়ামী লীগের জন্য নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিলো অগ্নি পরীক্ষা। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগ যে ভুল করেছিল তার মাশুল চরম ভাবে দিতে হয়েছিল দলটিকে। কে নতুন রাষ্ট্রপতি হবেন, এনিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই ছিলেন অন্ধকারে। এরকম এক সময় আলোচনার বাইরে থাকা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। এটি ছিলো আচমকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আসন্ন চক্রান্ত মোকাবেলার জন্যই বেছে নিয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তিকে যিনি বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ এবং আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তার জীবনে কোন দিন আদর্শচ্যুত হননি। জাতির পিতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রতিবাদ করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারাভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তবে আদর্শের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিলো পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময়। ডাক সাইটে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা চেয়েছিলেন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগকে প্রশ্রয় দিতে। তারা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে কলংকিত করার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানও নন। একজন সদস্য মাত্র। দায়িত্ববানরা যেকোন পরিস্থিতিতেই আদর্শের প্রশ্নে অটল হিমালয়ের মতো দাঁড়াতে পারেন তার প্রমাণ সে সময় রেখেছিলেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। দুদকের কমিশনার থেকে একাই তিনি রুখে দেন ষড়যন্ত্র। কিন্তু এনিয়ে তিনি হৈ চৈ করেননি। আত্ম অহংকারে বেসামালও হননি। আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আমার দায়িত্ব। কোন কিছু প্রাপ্তির জন্য এটি আমি করিনি।’ সারাজীবন এভাবে নীরবে, নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এই মানুষটি। আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়াই। মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কেন্ডিক প্রসাদ ষড়যন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দেন শেখ হাসিনা। যারা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে ন্যূনতম চেনে তারা জানেন, আর যাই হোক নীতির প্রশ্নে তাকে এক চুলও টলানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য প্রয়োজনে তিনি জীবন দেবেন। 

আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনার দূরদর্শী, বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিলো একটি টার্নিং পয়েন্ট। এর মাধ্যমে নির্বাচন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোট হতচকিত হয়ে যায়। দায়িত্ব নিয়ে মোঃ সাহাবুদ্দিন নির্বাচন কেন্ডিক উত্তাপ সামাল দেন ঠান্ডা মাথায়। তার অভিভাবকত্বে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। একবার ভাবুন তো, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময় ভীরু, কাপুরুষদের কেউ যদি রাষ্ট্রপতি হতেন, তাহলে কি এভাবে নির্বিঘ্নে সব কিছু হতো? সংশোধিত শ্রম আইনে স্বাক্ষর না করে তিনি বুঝিয়েছেন বঙ্গভবন দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় কথা মোঃ সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার একজন যোগ্য অভিভাবক হিসেবে একবছরে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ক্ষমতার দম্ভ তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ পদ তার বিনয়, সৌজন্যতাকে ম্লান করতে পারেনি। এখনও তিনি যেন সেই প্রাণখোলা মানুষটি। কিন্তু নীতির প্রশ্নে অটল। ৩০ এপ্রিলের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মহামূল্যবান একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন ‘শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাই হলো ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ।’ এই বার্তাটি তিনি সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান। আমি মনে করি এই নির্দেশনাটি মহামূল্যবান। এটিই এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রধান করণীয়।  

মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি হবার পরও ঠিক আগের মতোই আছেন। জনবিচ্ছিন্ন হননি। নিরাপত্তার শৃংখল থেকেও তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সূতোটা কাটেননি। এই জীবনে তো বহু মানুষ দেখলাম, যারা ক্ষমতা পেলে এমন দম্ভ দেখান যে, মনে হয় সারাজীবন এরকম ক্ষমতাবানই থাকবেন। ক্ষমতাহীন অবস্থায় যারা বুকে টেনে নিতেন, ক্ষমতা পেয়েই তারা অচেনা মানুষ হয়ে যান। এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। যারা অযোগ্য, চাটুকার, মতলববাজ তারাই ক্ষমতা পেয়ে দিশেহারা হন। অতীত ভুলে যান। উপকারীকে এড়িয়ে চলেন। কৃতজ্ঞহীন এক অমানবিক মানুষে পরিণত হন। এদের একজনের গল্প বলি।  

তিনি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে হতাশায় মুষড়ে পরলেন। প্রায় প্রতিদিন আমার অফিসে আসতেন। তার পরিবারের কাছে কিভাবে তিনি ছোট হলেন তার বিবরণ দিতেন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে। দুপুরে আমার অফিসেই খাবার টেবিলে মনোনয়ন না পাওয়ার বেদনায় আক্রোশ ঝাড়তেন মুরগীর রান চিবিয়ে। শেখ হাসিনা তাকে মূল্যায়ন করলো না, এনিয়ে তার কি গোস্বা। কিছুদিনের মধ্যেই খবর এলো তাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হচ্ছে। এক বিকেলে উচ্ছ্বাসিত ভাবে এলেন অফিসে। প্রধানমন্ত্রী তার ফাইল অনুমোদন করেছেন। এখন রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলেই সরকারি আদেশ জারী হবে। রীতিমতো ঘামছেন। রাষ্ট্রপতি তখন যুক্তরাজ্যে। বিভিন্ন জন তাকে নানান তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেন না, ফলে তার অস্থিরতাও কমছে না। তার এই অবস্থা দেখে আমি সরাসরি ফোন করলাম রাষ্ট্রপতিকে। তিনি যুক্তরাজ্যে আছেন জেনেও। তিনি ফোন ধরে বললেন, ‘বোরহান আমি হাসপাতালে, আমার টেস্ট চলছে, জরুরী কিছু? আমি ঐ উপাচার্যের ফাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘আমি একটু আগেই ফাইলে স্বাক্ষর করেছি।’ আমার এই ধৃষ্টতা এবং বাড়াবাড়িতে তিনি এতটুকু বিরক্ত হলেন না। বরং নতুন উপাচার্যকে অভিনন্দন জানালেন। একজন মানুষ কতটা খাটি, নির্ভেজাল এবং আন্তরিক হলে এটা সহ্য করে। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এই বিনয়ের কারণ তিনি আদর্শবান, যোগ্য। আর যে ব্যক্তি এমপি না হতে পেরে উপাচার্য হলেন, তিনি কদিন পর বিরাট মানুষ হয়ে গেলেন। তার কথা বার্তা, আবার আচরণে মুহূর্তে অন্যরকম হয়ে গেল। আমি তার কাছে আবর্জনা হয়ে গেলাম। 

আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ফারুক আমাকে এক বিকেলে ফোন করলেন। অনুরোধ করলেন, ঈদের অনুষ্ঠানে নতুন উপাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়। আমি যেন তাকে বলে দেই। আমি উপাচার্যকে ফোন করলাম। তিনি ফোন ধরলেন না। আগে যিনি দিনে কয়েকবার ফোন করতেন। ফোন না পর্যন্ত বার বার ফোন করেই যেতেন, তিনি আমার ফোন রিসিভ না করাতে আমি এতোটুকু দুঃখিত হইনি। ভাবলাম নিশ্চয়ই ব্যস্ত। উপাচার্য বলে কথা। নিশ্চয়ই ফ্রি হলে ফোন করবেন। কিন্তু তিনি ফোন ব্যাক করলেন না। পরদিন বিকেলে আবার ফারুকের অনুরোধ। এবার আমি ফারুককে রেখেই উপাচার্যকে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে। বললেন, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমি ভীষণ ব্যস্ত।’ আমি একটু বিস্মিত হলাম। ধাতস্থ হয়ে ফারুকের প্রস্তাব বললাম। আমি যেন মহা অন্যায় করেছি। তিনি বললেন, ‘এসব এখন হবে না। আমি ব্যস্ত।’ আরো কিছু কথা শোনার পর আমি বললাম ‘ভাগ্যিস আপনি শুধু উপাচার্য হয়েছেন, মন্ত্রী এমপি হননি।’ কদিন আগে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রে মাষ্টার হেডে প্রধানমন্ত্রীর ছবিই বাদ দিয়েছেন। উপাচার্য হয়েই তিনি নিরপেক্ষ হবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই মাইনাস করলেন? অযোগ্যরা ক্ষমতায় গেলে এভাবেই সম্ভবত বদলে যায়, অহমিকার এক মুখোশ পরে। এই ব্যক্তি একা না। এরকম ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী ক্ষমতা যাদের মাথা খারাপ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। এর কারণ তারা ক্ষমতা লোভী, অযোগ্য। রাষ্ট্রপতি হলেন একজন অসাধারণ সাধারণ মানুষ। ক্ষমতা যার মৌলিকত্ব, অকৃত্রিম আন্তরিকতা কেড়ে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তিনি যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি গত এক বছরে কাজ দিয়েই তা প্রমাণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। 
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ শেষ হয়ে গেল’

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৩ জুন, ২০২৪


Thumbnail

চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ শেষ হয়ে গেল। যারে যেদিকে পাঠাই কেবল চুরি করে।... দুর্নীতি, দুর্নীতি, উহঃ আল্লাহ। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব। এত দুর্নীতিবাজ যে আগে কোথায় ছিল, জানি না।না, এটি সাম্প্রতিককালের কোনো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য নয়। ১৯৭৩ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই মন্তব্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি যেন বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এখন কোনো অনুষ্ঠানে বা জনসভায় একই বক্তব্য দেন, তাহলে তিনিও বিপুল করতালিতে অভিষিক্ত হবেন, সন্দেহ নেই। শুক্রবার রাতে টেলিভিশনে বিমানবন্দরে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনিশ্চিত অপেক্ষায় থাকা মানুষের কান্না দেখেছিলাম। নিজের অজান্তেই কখন অশ্রুসজল হয়েছিলাম, জানি না। এই গরিব মানুষের সঙ্গে কারা প্রতারণা করেছে? সরকারের ভেতরে থাকা কিছু সংসদ সদস্য, তাদের স্ত্রী কন্যা। এই ৩০ হাজার মানুষকে পথে বসানোর দায় কে নেবে? প্রতারিত এই মানুষের আর্তনাদ শুনে বঙ্গবন্ধুর উক্তি মনে পড়ল।

শুধু এই বক্তব্য নয়, বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নে বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। চারপাশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চিৎকার করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলেসোনার বাংলাগড়া সম্ভব হবে না। জাতির পিতা তার জীবদ্দশায় পালিত শেষ স্বাধীনতা দিবসের বক্তব্য দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চের এই বক্তৃতায় দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচন করেন জাতির পিতা।

শুধু আর্থিক অনিয়মকারীরাই নয়, আদর্শচ্যুত মতলববাজদেরও দুর্নীতির সংজ্ঞায় এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ, যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ।

এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। ... ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে। এত চোরের চোর, এই চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে, তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই চোরদের তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।

কে বলে বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য পঁচাত্তরের? মুখে বলুন আর না বলুন-প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এই বক্তব্যের সত্যতা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করেছেন। শুধু জনগণ নয়, তিনিও এখনচাটার গোষ্ঠীরযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। শেখ হাসিনাযারে যেখানে পাঠাচ্ছেন কেবল চুরি করছে সাম্প্রতিককালে আজিজ আহমেদ, বেনজীর আহমেদ, মালয়েশিয়ায় রিক্রুটিং সিন্ডিকেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর চুনোপুঁটি ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের যেসব কেচ্ছা-কাহিনি বেরোচ্ছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যাকেও ইদানীং অসহায় মনে হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এটুকু, বঙ্গবন্ধু তার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান প্রকাশ্যে বলতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে আর্তনাদ করতেন, শেখ হাসিনা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনিনীলকণ্ঠী চারপাশের দুর্নীতিবাজদের অত্যাচার সহ্য করেন, যতক্ষণ না তারা সীমা লঙ্ঘন না করে।

সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের কথাই ধরা যাক। যোগ্যতা, দক্ষতা এবং বিশ্বস্ততার বিবেচনায় বেনজীর তার চাকরি জীবনে সবকিছু পেয়েছেন। চাকরি জীবনের একটা বড় সময় ধরে মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে তার সুনাম ছিল। কিন্তু তিনি পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে যত ওপরের দিকে উঠছেন, ততই বেপরোয়া এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠেছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন তার যে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করছে, তা রীতিমতোরত্নভান্ডার শীর্ষ পদে একজন ব্যক্তি যখন লোভে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন, তখন সরকার বা রাষ্ট্র কী করবে? শীর্ষ পদে গিয়ে লাগামহীন দুর্নীতি একজন ব্যক্তির একান্তই নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তারা রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য ক্ষতিকর।

তবে কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই, সরকার বেনজীরের কথিত দুর্নীতির দায় এড়াতে পারে না। দেশে রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানদার পর্যন্ত সাবেক এই পুলিশপ্রধানের দুর্নীতির কেচ্ছা-কাহিনি জানত। তাহলে সরকার এই অপকর্মের বিন্দু-বিসর্গও জানত না, এটা হতে পারে না। সরকার কি বেনজীর আহমেদকে ভয় পেত? তিনি কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন? নাকি সরকার জেনেশুনে এসব অন্যায় প্রশ্রয় দিয়েছে। সবাই নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। কদিন আগে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বিস্মিত এবং হতবাক। বলছিলেন, ‘চুরি কমবেশি সবাই করে। কিন্তু এটা তো লুণ্ঠন! এতটা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। রকম বক্তব্য অনেকের। তারা বলেছেন, বেনজীরের এই অধ্যায় তাদের অজানা ছিল।

আমি মনে করি, এটি সুশাসন এবং জবাবদিহির ব্যর্থতা। বেনজীর আহমেদকে পুলিশপ্রধান করে কি তাকে পুলিশ বাহিনীর জমিদারি বা ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছিল? তিনি কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন? কেউ কেন তাকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় বেনজীর আহমেদের নাম এসেছিল। কিন্তু সেটিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা চাকরিতে থেকে কীভাবে বোট ক্লাবের হর্তাকর্তা হন, নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু সে প্রশ্ন আমলে নেওয়া হয়নি। সীমা লঙ্ঘনের সব সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর সবার ঘুম ভেঙেছে। এখানেও সন্দেহ। বেনজীর যখন বিদেশে সপরিবারে পালিয়ে গেলেন, তারপর শুরু হলো হৈচৈ? সরকারের ভেতর থেকেই কি কেউ তাকে আগাম তথ্য দিয়েছে? পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে? তার পরও দুদক এবং সরকারের এই অবস্থানকে আমি স্বাগত জানাই। এর ফলে আমাদের দুটি উপকার হলো।

প্রথমত, বেনজীরের বিরুদ্ধে এখনকার তৎপরতা সুস্পষ্টভাবে সবার জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা। অন্যায় করলে একদিন না একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে-এই চিরন্তন সত্যটা সামনে এলো। বেনজীর একজন না। বেনজীর একটি ব্যক্তি না। বেনজীরের মতো বহু বিতর্কিত ব্যক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন বা ছিলেন। বেনজীররা রাষ্ট্রের জন্য দানব। তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। ঘটনা এসব দানবের জন্য একটা সতর্কবার্তা। বেনজীর আহমেদের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে যে কোনো দুর্নীতিবাজের যে কোনো সময় একই পরিণতি হতে পারে।ক্ষমতাজোয়ার-ভাটার মতো। ভাটার সময় কেউ পাশে থাকে না। যেমন বেনজীর, আজিজ, তুষার, লিকুর পাশে কেউ নেই। এর ফলে দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে রাখা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। এই ঘটনার পর শীর্ষপদে দুর্নীতি করার আগে যে কেউ দশবার চিন্তা করবে।

দ্বিতীয়ত, জনগণের বিচার। যে কোনো বিচারের দুটি দিক আছে। একটি আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার, যা দুদক এখন করছে। সাবেক পুলিশপ্রধানের অবৈধ সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনুসন্ধানে যখন সম্পদের অস্বাভাবিক স্ফীতি লক্ষ করেছে, তখন কমিশন আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। দুই দফায় বেনজীর এবং তার পরিবারের বিপুল সম্পদ জব্দ করার আবেদন করেছে। দুদক জুন সাবেক পুলিশপ্রধানকে তলব করেছে। জুন তলব করেছে স্ত্রী সন্তানদের। এভাবেই ধাপে ধাপে আইনি প্রক্রিয়া এগোবে। দুদক তদন্ত শেষে অভিযোগগুলো আদালতে জমা দেবে। চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ, যুক্তি-তর্ক, সাক্ষ্য-প্রমাণের পর বিচারক রায় দেবেন বেনজীর আহমেদ দোষী না নির্দোষ। এর আগে আইনের দৃষ্টিতে তাকে অপরাধী বলা যাবে না। কিন্তু আইনের এই প্রক্রিয়ার বাইরেও একটি বিচার আছে, তা হলো জনভাবনা, জনমত। যেটাকে আমরা বলিপাবলিক ট্রায়াল যে কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের নাগরিক ওই ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব একটি মতামত গ্রহণ করে। জনগণের মধ্যে একটি সামষ্টিক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। আইনের প্রক্রিয়ার আগেই সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কাউকে দোষী বা নির্দোষ হিসেবে রায় দেয়। বেনজীর আহমেদের ব্যাপারে জনরায় তার বিরুদ্ধে। সপ্তাহজুড়ে ঘটনায় জনগণের মধ্যে একটি বিজয়ী ভাব লক্ষণীয়। তারা মনে করে, বেনজীর আহমেদ দুর্নীতিবাজ। দুদকের অ্যাকশনে তারা খুশি। জনতার আদালতে বিচারের আগেই বেনজীর অপরাধী। আমি মনে করি, ধরনের মানুষের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় শাস্তি। এই সামাজিক ঘৃণা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও মানুষের সম্মিলিত কোরাস।

বেনজীর কি একা? তিনিই কি উচ্চপদে থাকা একমাত্র কর্মকর্তা, যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ? না। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন স্তরে রকম অনেক বেনজীর আছেন। যাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি দীর্ঘ। এসব ব্যক্তিকে সবাই চেনে, জানে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, শুধু বেনজীরকে কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে, অন্যরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধেশূন্য সহিষ্ণুতা নীতিঘোষণা করেছে। তাই ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখতে চায় জনগণ। শুধু একটি ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হলে তার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে বলে ধরে নিতে হবে। জনগণ শুধু এক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির তদন্ত চায় না, সব দুর্নীতিবাজের মুখোশ উন্মোচন চায়। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তি চায়, অর্থ পাচারকারীদের বিচার চায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট।

প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও একই রকম বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অপরাধী যত প্রভাবশালী হোন, সরকারের সাপোর্ট পাবে না।বেনজীর আহমেদের ঘটনায় আশাবাদী হয়ে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও তদন্ত দাবি করেছেন কয়েকজন আইনজীবী। তারা দুদকে ব্যাপারে চিঠিও দিয়েছেন। দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় হলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো অবস্থান এখন নানাভাবে দৃশ্যমান।

গত বুধবার (২৯ মে) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুজন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। দুজনের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর। চুক্তি নবায়নের মাত্র চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল করা হলো। অনেকেই মনে করেন, এটাও অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের আরেকটি প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও শুদ্ধি অভিযান হচ্ছে-এমন সংবাদে আমরা আন্দোলিত। কিন্তু আমরা ঘর পোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। বিভিন্ন সময়ে নানা রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে হৈচৈ হয়েছে। তারপর সবকিছু থেমে গেছে। ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় সারা দেশে তোলপাড় হলো। আওয়ামী লীগের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা পদ হারালেন। অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। গণমাধ্যমে কয়েকদিন তাদের অবৈধ বিপুল সম্পদের ফিরিস্তি প্রকাশিত হলো। তারপর সব সুনসান। সে সময় যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের কারও সাজা হয়েছে? নিয়ে কেউ এখন কথা বলে না।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংক লুণ্ঠনের পর ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু কী হয়েছে তার পরিণতি? আমরা কি আবদুল হাই বাচ্চুর কিছু করতে পেরেছি? খেলাপি ঋণ এখন এভারেস্টের চেয়েও উঁচু। কারও কিছু হয়নি।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হলো, এর সঙ্গে জড়িত সরকারের ঘনিষ্ঠরা। যাদের কারণে ৩০ হাজার মানুষ পথে বসল, তাদের কি বিচার হবে? অর্থ পাচার নিয়ে কথা তো কম হলো না। কিন্তু একজন অর্থ পাচারকারীকেও এখনো আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দুই বছর আগে সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু আমলারা এতই ক্ষমতাবান, ১৯৭৯ সালের আইনটি তারা বন্দি করে রেখেছেন। এই আইন যদি কার্যকর থাকত, তাহলে কি বেনজীর এত বেপরোয়া হতেন? দুর্নীতিবাজদের এক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। আগে রাজনীতিবিদরা কিছু দুর্নীতিবাজ পুষতেন। নির্বাচন, রাজনৈতিক খরচ মেটানোর জন্য। এখন দুর্নীতিবাজরা রাজনীতিবিদ পোষেণ, তাদের অবৈধ সম্পদ পাহারা দেওয়ার জন্য। রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ এখন দুর্নীতিবাজদের পালিত, অনুগত। তাই বেনজীর, আজিজ নাটকের সমাপ্তি কোথায়, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিছুদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে আমরা আবার অন্য এক ইস্যুতে ঝাঁপ দেব? দুর্নীতিবাজরা বুক ফুলিয়ে আবার ঘুরে বেড়াবে?

আমরা যেন দুর্নীতির এক দুষ্টচক্রের জালে বন্দি। দুর্নীতির এক বীভৎস প্রতিযোগিতা চলছে দেশজুড়ে। বঙ্গবন্ধুর মতোই প্রধানমন্ত্রী যাকে যে দায়িত্বে দিচ্ছেন, তিনিই যেন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন।চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষশেষ হয়ে যাচ্ছে। কার ওপর আস্থা রাখবেন শেখ হাসিনা?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


দুর্নীতি   বীভৎস   প্রতিযোগিতা   দেশজুড়ে  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

সরকারের ভেতর কী হচ্ছে?

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ৩১ মে, ২০২৪


Thumbnail

বুধবার (২৯ মে) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর দুইজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাটাই হয়েছেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২, অন্যজন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব। টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল হলো। সাবেক সেনাপ্রধান এবং সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই দুই কর্মকর্তার ছাটাই নানা প্রশ্ন সামনে এনেছে। এটি কী সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের একটি অংশ নাকি অস্থিরতার প্রকাশ? হঠাৎ করেই দুর্নীতির ইস্যু জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে এসেছে। এটি কী সরকারের জন্য চাপ না কৌশলের অংশ? একের পর এক ঘটনার পর আকাশে বাতাসে না প্রশ্ন। সরকারের ভেতর কী হচ্ছে?

টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের বয়স মতে সাড়ে চার মাস। কিন্তু এর মধ্যেই সরকারের ভেতর সমন্বয়হীনতা প্রকট হয়ে উঠেছে। সরকারের কাজ-কর্মে স্ববিরোধিতাও স্পষ্ট। সরকারের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা। কোথায় যেন ছন্দপতন। এর মধ্যেই দুর্নীতির ইস্যু সবার আলোচনার প্রধান বিষয়। সব কিছু কী ঠিক আছে?

২০ মে, সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের কথাই ধরা যাক। এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ঢাকায় চলবে না, এ সিদ্ধান্ত তাকে জানানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বললেন, স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকার একটি উপায় হলো ব্যাটারি চালিত এই অটোরিকশা। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে হুট করে এভাবে রাজধানীতে অটো রিকশা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী। এদের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়নেরও নির্দেশনা দিলেন।  

ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চলে। এগুলোর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, কোন আইন, রুট পারমিট নেই। কীভাবে অটোরিকশা গুলো শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে বিদ্যুৎ সংকটের এই সময়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা গুলো অবৈধভাবে বিপুল বিদ্যুৎ ব্যবহার করতো। এটি বন্ধের জন্য আইন প্রণয়ন এবং ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাকে রাস্তা থেকে প্রত্যাহারের একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু তা না করে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান নেতা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে না। ১৭ মে থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছিলো। হুট করে নেয়া এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অটোরিকশা চালকরা রাজপথে নেমে আসেন। তাদের দাবি, তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন। এটিই তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। অটোরিকশা চালকদের মূল দাবি ছিল যে, বিকল্প ব্যবস্থা না করে অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত তাদেরকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেবে। জীবিকা এবং কর্মসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলবে। এই অবস্থা চলে দুইদিন। দুই দিনের মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে অটোরিকশা চালকদের আন্দোলন বন্ধের জন্য কোন সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে এলেন। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কারণে ঢাকা শহরে একটি আসন্ন শ্রেণী পেশার আন্দোলন থেকে সরকার রক্ষা পেল। প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রী যদি বোঝেন যে, স্বল্প আয়ের মানুষকে কর্মহীন করে হুটহাট এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। তাহলে মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেন বোঝেন না। ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিল? তাহলে কী প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে এরকম অনেক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়?

সরকারের মন্ত্রীরা প্রায় বলেন তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া ভাঁজা মাছটিও উল্টে খান না। বাজারে এমন একটি আবহ তৈরি করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া কোন মন্ত্রী যেন কোন কাজই করেন না। কিন্তু এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে কীভাবে হলো? 

শুধু যে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটছে, তা না। হর হামেশাই সমন্বয়ের সংকট এখন দৃশ্যমান। দেশে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে এখন লুকোচুরি কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছতার নীতি অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। সংসদ সদস্যদের বিনা শুল্কে গাড়ী কেনার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যেই ডিসি-ইউএনওদের জন্য ২৬১ টি বিলাস বহুল গাড়ী কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কার স্বার্থে এই গাড়ী কেনা? কৃচ্ছতা নীতি কী তাহলে আমলাদের জন্য প্রযোজ্য নয়? বিনা প্রয়োজনে বিদেশে না যাওয়ার অনুশাসন দেয়া হয়েছে। অথচ আমলাদের বিদেশ যাত্রার উৎসব অর্থবছরের শেষে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাজেটে বিদেশ ভ্রমণের খাত আছে, তাই টাকা উড়াও। প্রয়োজন থাক আর না থাক। 

টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করা আওয়ামী লীগ সরকারের সমন্বয়ের সংকট ক্রমশ একটি ব্যাধি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কদিন আগেই শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী চাকরির বয়স সীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে একটি চিঠি দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বাড়বে কী কমবে, বা চাকরিতে অবসরের মেয়াদ কত হবে এটি সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে কোথাও ঘোষণা করেনি যে, তারা ক্ষমতায় এলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বৃদ্ধি করবে। কিন্তু হুট করেই তরুণ শিক্ষা মন্ত্রী চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বৃদ্ধির জন্য একটি চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দিলেন। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দলের পরামর্শ ছাড়া এধরনের চিঠি তার সহকর্মীকে নিতে পারে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। একজন মন্ত্রী সরকার পরিচালনায় একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি একদিকে যেমন গোপনীয়তার শপথ নেন। তেমনি পক্ষপাতহীন দায়িত্ব পালনেরও শপথ গ্রহণ করেন। তাই শিক্ষা মন্ত্রী যখন এধরনের কোন চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেন এখন তা সরকারের ভেতর এক ধরনের সমন্বয়হীনতারই প্রকাশ। এই ঘটনার ফলে সরকারি চাকরিতে আগ্রহী তরুণরা উৎসাহিত হয়েছে, তাদের আন্দোলনের গতি বেড়েছে। গত কিছুদিন ধরে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। শিক্ষা মন্ত্রীর প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। সরকার আপাতত চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বাড়ানোর চিন্তা ভাবনা করছে না বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। নানা কারণে এখন সরকার চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে চায় না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক কী ভুল সেটি আলাদা বিষয়। কিন্তু একজন মন্ত্রী, যিনি সরকারের একজন নীতিনির্ধারকও বটে, তিনি সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে চিঠি লিখেন কীভাবে? সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ এ করার ক্ষেত্রে তার অসংখ্য যুক্তি থাকতে পারে। এটি দলীয় ফোরাম বা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি উত্থাপন করতে পারতেন। দলীয় ফোরামে এটি নিয়ে আলোচনা হলেই বিষয়টি সুষ্ঠু এবং গণতান্ত্রিক হতো। এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। কিন্তু মন্ত্রী যখন সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য বিষয়টি প্রকাশ্যে উত্থাপন করেন তখন জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠে সরকারের ভেতর কী হচ্ছে? সরকার কী ফ্রি স্টাইলে চলতে পারে?

সমন্বয়হীনতার এরকম নজীর অনেক। সাম্প্রতিক সময়ে মেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপ করা হবে কি না এ নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এনবিআরের কাছে এক চিঠি লিখে মেট্রোরেলের ভাড়ার উপর এখনই যাতে ভ্যাট আদায় না করা হয় সেজন্য অনুরোধ জানায়। এনবিআর সেই অনুরোধ নাকচ করে দেয়। এনবিআরের বক্তব্য হলো এখন মেট্রোরেল জনপ্রিয় হয়েছে কাজেই এখান থেকে ১৫% হারে ভ্যাট আদায় করাই সঠিক হবে। এনবিআরের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, এনবিআর এর এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে সাংবাদিকদের জানান। এনবিআর আর সেতু মন্ত্রীর লড়াই এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। এবারের বাজেটে এনবিআরের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির জন্য যে সমস্ত প্রস্তাবনা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে মেট্রোরেলে ১৫% ভ্যাটের বিষয়টিও অন্তর্ভূক্ত। এটি জানার পর সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এনবিআরের সিদ্ধান্তকে ভুল হিসেবে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। প্রশ্ন হলো, এনবিআর কি সরকারের বাইরের কিছু? এনবিআর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। সরকারের দুই প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ্য যুদ্ধ কেন? এতে কার লাভ? এর ফলে জনগণের মধ্যে ধারণা হচ্ছে, সরকারের চেইন অব কমান্ড নেই।

এনবিআর এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। এটিই গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এই মত পার্থক্য মাঠে আলোচনার বিষয় না। মত পার্থক্য প্রকাশ্যে বিতর্কেরও কোন বিষয় নয়। এনবিআর বা সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয় কী অনুধাবন করত পেরেছে এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। সরকারের সমন্বয়হীনতা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়। এই বিষয়টি অনেক শোভন এবং সুন্দরভাবে করা যেতে পারতো। এনবিআরের চেয়ারম্যান, অর্থমন্ত্রী, সেতু মন্ত্রী এবং মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আলাদা ভাবে বৈঠক করতে পারতেন। যে যার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারতেন এবং শেষ পর্যন্ত যদি তারা ঐক্যমতে না হয় তাহলে সকলে মিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারতেন। আমাদের সৌভাগ্য হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ, দায়িত্বশীল একজন মানুষ। তিনি দিনরাত ২৪ ঘণ্টা দেশের কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেন। তার একটি অভাবনীয় ক্ষমতা রয়েছে। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়। এরকম একজন প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার পর কেন দু’টি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করে জনগণের বিভ্রান্ত করেন? 

গত ২০ মে মধ্যরাতের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনা প্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে স্যাংশন দেয়। মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, এটি ব্যক্তির বিষয়। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আগেই সরকারকে অবহিত করা হয়েছিল বলেই তিনি উল্লেখ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হবে না। কিন্তু তার পরদিনই হুমকি দিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বললেন, নিশিরাতের স্যাংশনের পরোয়া করি না। আজিজ আহমেদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তাহলে কার বক্তব্য সঠিক? কোনটি সরকারের বক্তব্য? এখন আজিজ আহমেদ বেনজীররকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কথায় বাহাস চলছে। তারা যেন একেকজন ধোঁয়া তুলসীর পাতা। কারো কারো অতি কথনে জাতি বিভ্রান্ত। আসলে কী হচ্ছে?

একটি সরকার সামষ্টিক রূপ। সরকারের মধ্যে বিভিন্ন বিভাগ, মন্ত্রণালয় এবং নানারকম প্রতিষ্ঠান জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমন্বয় থাকা উচিত। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে একে অন্যের মধ্যে সমন্বয় থাকা উচিত এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা জরুরী। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় যদি কেউ তার ভিন্ন মত বা অবস্থান প্রকাশ্যে বলেন সেক্ষেত্রে তার লাভ হতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করে। যেটি এখন আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি। যেমন পেঁয়াজের মজুত কত বা পেঁয়াজের উৎপাদন কত এ নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবের সাথে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব নাই। বাজারে কাঁচা মরিচের দাম হু হু করে বাড়ছে। কাঁচা মরিচের চাহিদা কত তা নিয়ে একেক মন্ত্রণালয়ের একেক হিসেব। বাজার এখন সিন্ডিকেটের দখলে বলে চিৎকার চেঁচামেচি করা হচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেট বন্ধ করা কার দায়িত্ব এবং সিন্ডিকেট বন্ধের জন্য কারা কাজ করবে সেটা নিয়ে এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের ‘পিলো পাসিং’ খেলা চলে। সরকারের মধ্যে যদি ছোট ছোট অনেকগুলো সরকারের উদ্ভব ঘটে তাহলে সেটি বিপজ্জনক। মন্ত্রীরা যদি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে সরকার কে চালায়? 

টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মধ্যে একটি বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা যেকোন সংকট সমাধানের জন্য নিজেরা দায়িত্ব নিচ্ছে না এবং একে অন্যকে দোষারোপ করার একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। আত্মতুষ্টিতে বলীয়ান সরকার বেনজীরের সম্পদ জব্দ করা নিয়েও তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। কিন্তু বেনজীর তো একদিনে এই বিপুল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেনি। তখন তো কেউ কিছু করেনি। এখন এতো হৈ চৈ কেন? সরকার কি নিজের ফাঁদে পা দিচ্ছে? অন্ধকারে সরকার কী লক্ষ্যহীন ভাবে পথ হাতড়াচ্ছে?

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

তারেক জিয়াকে কী দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে?

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ২৭ মে, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গণভবনে কোটালীপাড়া উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বলেছেন, এখন একটাই কাজ তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় আনা। এই কথাটি তিনি খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন কিছু বলেন তখন নিশ্চয়ই তার কার্যকারণ থাকে এবং ভেবে চিন্তে তিনি কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি দূরদর্শীসম্পন্ন একজন দার্শনিক চিন্তাবিদও বটে। আজকে সবাই যা ভাবে তিনি তা ভাবেন অনেক আগেই। আগামীকালের ভাবনা তিনি আজকে করেন। আর এ কারণেই তিনি একজন দক্ষ এবং বিশ্বমানের রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী কোন প্রেক্ষাপটে কেন হঠাৎ করে তারেক জিয়ার প্রসঙ্গটি সামনে আনলেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এ নিয়ে নানামুখী আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময় এই বক্তব্যটি দিয়েছেন, যখন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য তারিখ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগামী ৪ জুলাই নতুন পার্লামেন্ট দিয়েছেন। এই সময় যুক্তরাজ্যের টানা ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টি একটি চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। এই নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি অনিবার্য বলেই মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে কদিন আগে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি তৃতীয় স্থান দখল করেছে। লেবার পার্টির ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় আগামী দিনে তাদের ক্ষমতায় আসার বার্তা দিয়েছে বলেই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন।

আর এরকম একটা পরিস্থিতিতে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে আগাম নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। ঋষি সুনাক সেই দাবি শুনেছেন কিনা তা জানা যায়নি, তবে তিনি আগামী নির্বাচন নিয়ে একটি বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন যে, শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হলে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা আরও খারাপ হবে, এরকম বাস্তবতা বিবেচনা করে তিনি আগাম নির্বাচন দিয়েছেন। কিন্তু তার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরপরই ৭৮ জন কনজারভেটিভ এমপি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে ঋষি সুনাকের নেতৃত্ব একটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। আর এই বাস্তবতায় শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে লেবার পার্টি যে দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় আসতে চাইছে সেটি অনেকের কাছে স্পষ্ট।

এরকম পরিস্থিতিতে লেবার পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে আওয়ামী লীগ বহুমুখী সুবিধা পাবে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকী ব্রিটিশ এমপি এবার নির্বাচনেও তার জয়ের প্রায় অনিবার্য বলেই মনে করা হচ্ছে। আর তিনি যদি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন এবং লেবার পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তিনি যে মন্ত্রী হবেন তা অনিবার্য। কারণ এরই মধ্যেই লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভায় তিনি অন্তর্ভুক্ত আছেন।

আর লেবার পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ৭৫’র নারকীয় ঘটনার পর লেবার পার্টির সংসদ সদস্যরাই জাতির পিতার হত্যার বিচার চেয়ে ছিলেন এবং সেটি নিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল ব্রিটিশ এমপিদের উদ্যোগে। আর এসব বাস্তবতা থেকেই লেবার পার্টি ব্রিটেনে সরকার গঠন করলে তারেককে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সহজ হবে বলেই অনেকে মনে করছেন। এরকম একটি বাস্তবতা থেকেই প্রধানমন্ত্রী হয়ত তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

তারেক জিয়া  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আনার, আজিজ, বেনজীর: কীসের ইঙ্গিত

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৭ মে, ২০২৪


Thumbnail

এক.

তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ে সপ্তাহজুড়ে তোলপাড় দেশ। একজন জনপ্রতিনিধি। একজন সাবেক সেনাপ্রধান। তৃতীয় ব্যক্তি সাবেক পুলিশপ্রধান। ভিন্ন ভিন্ন কারণে এবং ঘটনায় তারা আলোচনায়। তিন ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু তিন ঘটনায় এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অনিয়ম। একজন জীবন দিয়ে তার অন্ধকার জগতের দরজা খুলে দিয়েছেন। একজন ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন। তৃতীয়জনের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। এ তিনটি ঘটনার পর একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে—জনগণের সেবার দায়িত্ব কারা পাচ্ছেন? দুর্নীতিবাজরা, চোরাকারবারি, ক্ষমতা অপব্যবহারকারীরা কীভাবে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাচ্ছেন? এ ধরনের ব্যক্তিদের হাতে জনগণ কতটা নিরাপদ?

দুই.

প্রথমেই জনপ্রতিনিধি প্রসঙ্গে খানিকটা আলোকপাত করা যাক। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে কলকাতায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গত বুধবার এ খবরটি নিশ্চিত করে কলকাতা পুলিশ। গত ১২ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ১৮ মে থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। আনার হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে এখন পর্যন্ত যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা লোমহর্ষক। হিন্দি সিনেমার মতো। এ হত্যাকাণ্ডের পর চোরাচালানের ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’র চাঞ্চল্যকর সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ২৪ মে ‘কালবেলা’র খবরে বলা হয়েছে, ‘চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে স্বর্ণ চোরাচালানের ২০০ কোটি টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ ছাড়া সীমান্তকেন্দ্রিক চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণও খুনের আরেক কারণ হিসেবে কাজ করেছে...।’ আনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। বাংলাদেশে ও ভারতে সন্দেহজনক ব্যক্তিরা আটক হয়েছেন। নিশ্চয়ই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হবে শিগগির। তিনবারের সংসদ সদস্য আনারের মৃত্যুর পর তার জীবনের অন্ধকার অধ্যায় সামনে এসেছে। সন্দেহ নেই, প্রয়াত এ সংসদ সদস্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুর পর এলাকার জনগণের মধ্যে যে আবেগ এবং শোক দেখা গেছে, তা অভূতপূর্ব। কিন্তু মৃত্যুর পর জানা গেল তিনি চোরাচালান চক্রের একজন ‘গডফাদার’ ছিলেন। ওই এলাকার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন এই সংসদ সদস্য। এটি যে কোনো গোপন বিষয়, তা নয়। ওপেন সিক্রেট। সবাই জানতেন। আওয়ামী লীগেও নিশ্চয়ই বিষয়টি অজানা নয়। সবকিছু জেনেশুনে একজন চোরাকারবারিকে কীভাবে তিন-তিনবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিল? ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এর মধ্যে ২০১৪ এবং এ বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণই করেনি। তাই এমনটি বলার কোনো সুযোগ নেই যে, জেতার জন্য ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কৌশলগত কারণে আপস করতে হয়েছে। এসব নির্বাচনে সৎ, পরিচ্ছন্ন মানুষকে সামনে আনার সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতদের মনোনয়ন দিয়ে রাজনীতিকে শুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি। বিভিন্ন স্থানে এরকম করাও হয়েছে। তাহলে কেন সর্বহারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন চোরাকারবারিকে বারবার মনোনয়ন দেওয়া হলো? কার স্বার্থে এ ধরনের বিতর্কিত, অন্ধকার জগতের লোকজনকে জনপ্রতিনিধি বানানো হয়? আনারের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর একটি বিষয় সামনে এসেছে, আমাদের জনপ্রতিনিধি কারা হচ্ছেন? কারা আমাদের ‘ভাগ্যবিধাতা’ হয়ে সংসদে যাচ্ছেন। এর আগেও একজন আদম ব্যবসায়ীকে সংসদে আনা হয়েছিল। বিদেশে তিনি গ্রেপ্তার হন। পরে জানা যায়, আওয়ামী লীগের প্রয়াত এক নেতাকে বিপুল অর্থ দিয়ে তিনি ‘স্বতন্ত্র’ভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্ত্রীকেও টাকার দাপটে সংসদ সদস্য বানিয়েছিলেন। আমরা প্রায়ই বলি, জাতীয় সংসদ ব্যবসায়ীদের দখলে। রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই। কিন্তু রাজনীতি এখন কি ক্রমশ কালো টাকার মালিক, অন্ধকার জগতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে? ভবিষ্যতের রাজনীতি কি মাফিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করবে?

তিন.

জেনারেল আজিজ আহমেদ সাবেক সেনাপ্রধান। তিন বছর সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালনের পর ২০২১ সালের জুনে তিনি অবসরে যান। ২০ মে সোমবার মধ্যরাতের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ক্ষমতার অপব্যবহার, তিন ভাইয়ের অপরাধ ধামাচাপা দিতে প্রভাব খাটানো এবং ভাইদের সেনা কেনাকাটায় অবৈধ সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছে, তা নতুন নয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরায় এ নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করেছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনের ভেতর ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আবিষ্কার করা হয়েছিল। এ কথা সত্য, আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত ওই প্রামাণ্যচিত্রে অযৌক্তিক এবং অন্যায়ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে জড়ানোর একটি কুৎসিত চেষ্টা ছিল। এ কারণেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে সেনাপ্রধান এবং তার ভাইদের বিভিন্ন অপকর্মগুলোর নিরপেক্ষ ও নির্মোহ তদন্ত করা ছিল সরকারের দায়িত্ব। সরকার অভিযোগগুলো আমলেই নেয়নি। বিশেষ করে নাম, ঠিকানা, পিতৃপরিচয় পরিবর্তন করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নেওয়ার মতো বিষয়গুলো প্রমাণিত। এসব জালিয়াতি ও প্রতারণার বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের অপরাধ তাদের ব্যক্তিগত। রাষ্ট্র বা সরকার কেন তার দায় নেবে? চাকরি জীবনে জেনারেল আজিজ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সেনাপ্রধান হওয়ার আগে তিনি বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন। দুই জায়গাতেই তার ব্যাপারে নানা মুখরোচক আলোচনা শোনা যায়। সরকারের ঘনিষ্ঠ এরকম একটি ধারণা দিয়ে তিনি দাপট দেখিয়েছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে বিস্তর অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব অভিযোগ তদন্ত তো দূরের কথা, আমলেই নেওয়া হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের গৌরবের সশস্ত্র বাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের অহংকার, দেশের গর্ব। এখনো এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে জনগণের আস্থা আশাতীত। হত্যা ও রাজনীতির উচ্চাভিলাষ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি চৌকস, পেশাদার বাহিনী হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। ২০০৯ সাল থেকে সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক মানের একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেনাপ্রধানরা অবসরের পর নিভৃত জীবনযাপন করেন। দায়িত্ব পালন করে তাদের পেশাদারিত্ব, সততা ও নিষ্ঠা তরুণদের জন্য অনুকরণীয় হয়। কিন্তু জেনারেল আজিজদের সময়ে ব্যাপারটি তেমন ছিল না। বিজিবির প্রধান বা সেনাপ্রধান হিসেবে তার অনেক কর্মকাণ্ডেই পেশাদার অফিসাররা অস্বস্তিতে পড়েছেন। বিব্রত হয়েছেন। সেনাপ্রধানের চেয়ে সরকারের ঘনিষ্ঠ—এ পরিচয়টি তার ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে উঠেছিল। আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্য ছিলেন কি না, সেটা ভিন্ন বিতর্ক। আমি সে বিতর্কে যাব না। তবে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তির জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পদের সঙ্গে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা ও সম্মান জড়িত। আজিজ আহমেদের কর্মকাণ্ড অনেক আগেই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত ছিল। তার বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগগুলোকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। আমার প্রশ্ন, শীর্ষ পদে যাওয়ার পর একজন ব্যক্তি কেন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার দাপটে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন? কেন তার লাগাম টেনে ধরা হয় না? এ ধরনের স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কি যথেষ্ট সতর্ক? কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত কি না, আজিজ আহমেদের ঘটনার পর সেই বিতর্ক সামনে এসেছে।

চার.

বৃহস্পতিবার (২৩ মে) ঢাকার একটি বিশেষ আদালত সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী, কন্যার সব স্থাবর সম্পদ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই আদেশ। গত কিছুদিন ধরেই সাবেক এই পুলিশপ্রধানের বিপুল অবৈধ সম্পদ নিয়ে তোলপাড় চলছিল। একটি জাতীয় দৈনিকে তার দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি হাইকোর্টের দৃষ্টিতে আনেন একজন আলোচিত সংসদ সদস্য। হাইকোর্টে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে। দুই মাসের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত নির্দেশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে। তদন্তের স্বার্থেই দুদক বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ ক্রোক করার আবেদন করে। বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের যখন ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন আমি আশা করেছিলাম তিনি এর কড়া প্রতিবাদ জানাবেন। কিন্তু তা না করে সাবেক এই পুলিশপ্রধান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘ এক বক্তৃতা দেন, যা ছিল অনেকটাই আত্মরক্ষামূলক। তার ওই বক্তব্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর জুতসই জবাবও ছিল না। তাই এখন দেখার বিষয়, দুদক তদন্ত করে কী পায়। বেনজীর আহমেদ দুর্নীতি করেছেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু মেধাবী এই পুলিশ কর্মকর্তার বেপরোয়া হয়ে ওঠার নানা কেচ্ছা-কাহিনি অলিগলিতে আলোচনা হয়। পুলিশের প্রায় কর্মকর্তাই তার পরিবর্তনের বিস্মিত। এক সময় চৌকস, দক্ষ এই পুলিশ কর্মকর্তার বদলে যাওয়া নিয়ে রীতিমতো সিনেমা হতে পারে। হলি আর্টিসানের ঘটনায় তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, তা সত্যি অতুলনীয়। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরাই হতাশার সুরে বলেন, পুলিশপ্রধান হওয়ার পর তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নানা রকম বিতর্ক এবং অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড ক্ষমতার দাপটে তিনি যা খুশি তা-ই করেছেন বলেও অনেক মন্তব্য করেন। পুলিশপ্রধান থাকা অবস্থায় তার লাগামহীন দুর্নীতি সরকারের বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়েছিল। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষপদে থাকা একজন ব্যক্তির এসব কাণ্ড সরকারের জন্যও বিব্রতকর। এখন দেখার বিষয়, বেনজীর আহমেদের পরিণতি কী হয়।

পাঁচ.

আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায়। এ সময় দেশ পরিচালনায় সরকার অনেক শীর্ষ পদে বহুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকের সততা ও নিষ্ঠা এখনো অনুকরণীয় উদহারণ। আবার কেউ কেউ শীর্ষ পদে গিয়ে এমনসব কাণ্ড করেছেন যে, সরকারই তাদের কাজে বিব্রত হয়েছেন। দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা বিভিন্ন শীর্ষ পদে গেছেন তারাই বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সমালোচিত হয়েছেন। এর ফলে সরকারও ইমেজ সংকটে পড়েছে।

এই তিনটি ঘটনার একটি সহজ সমীকরণ আমার কাছে স্পষ্ট। পক্ষপাত করে, রাজনৈতিক বিবেচনায় বা প্রভাবিত হয়ে যোগ্যতার বাইরে কাউকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়। হোক না তা জনপ্রতিনিধি কিংবা পুলিশপ্রধান। ইদানীং অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন পাওয়ার কথা বেশ চালু হয়েছে। অযোগ্যরা তদবির করে, চাটুকারিতার মাধ্যমে অথবা সরকারকে নানাভাবে প্রভাবিত করে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন। এরাই বিতর্কিত হচ্ছেন, সরকারকেও করছেন বিব্রত। এদের লোভ, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট। এই তিন ঘটনা আমাদের একটি সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাই তা হলো গুরুত্বপূর্ণ পদে বা দায়িত্বে লোক বাছাই করতে হবে নির্মোহভাবে, শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে। না হলে ক্ষতি হবে সরকারের, দেশের।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


আনার   আজিজ   বেনজির   দুর্নীতি   নিষেধাজ্ঞা   হত্যা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

চীন থেকে ফিরেই ভারতের সমালোচনায় মেনন

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ২৬ মে, ২০২৪


Thumbnail

চীন থেকেই ফিরে ভারতের সমালোচনায় মুখর হলেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন। সাম্প্রতিক সময়ে ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি চীন নিয়ে যান। এ সফরের উদ্দেশ্য কি ছিল বা কেনই বা চীন তাদেরকে জামাই আদর দিয়ে নিয়ে গেছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানায়নি ইদানিং সুবিধাভোগী নেতারা। তবে চীন থেকে ফিরে আসার পর যেন রাশেদ খান মেননের মগজ ধোলাই হয়েছে তা দিব্যি বোঝা গেল। চীন থেকে ফেরার পরেই তিনি এখন ভারত বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। 

গতকাল ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত অভিন্ন পানি বন্টণ: প্রেক্ষিত পদ্মা ও তিস্তা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি গঙ্গার পানি চুক্তি ও তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে ভারতের তীব্র সমালোচনা করেন। এই অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষ থেকে যে তিস্তা মহা পরিকল্পনার জন্য যে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাকে জুতা মেরে গরু দান বলে অভিহিত করেন। এছাড়াও তিনি গঙ্গার পানি চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখন মাওলানা ভাসানীর মতো ফারাক্কা মিছিল করার মতোও গুরুত্ব আরোপ করেন। শুধু তাই নয়, ভারতের সঙ্গে যে অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে তার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তীব্র হিসেবে ধরা পরে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করে রাশেদ খান মেনন গঙ্গা এবং তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে এতো মরিয়া হলেন কেন? 

বাংলা ইনসাইডারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চীন দীর্ঘদিন ধরেই কুড়িগ্রাম অঞ্চলে তিস্তা নদীর চারপাশে জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব দিচ্ছিলো। ১০০ কোটি ডলারের এই প্রস্তাবের মূল বিষয়টি ছিল বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পানি থেকে এই জলাধারগুলোকে ভরানো হবে এবং শুষ্ক মৌসুমে এই পানিগুলো দিয়ে শুষ্কতা কাটানো হবে। তবে ভারত এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করছিল। এবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের সময় ভারত একটি ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’র এক বিকল্প প্রস্তাব দেয় এবং সেখানে ভারত অর্থায়ন করার জন্য প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে পানি বণ্টনের একটা সমাধান হবে বলে অনেকে মনে করেন। ভারতের পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়েছে যে, নির্বাচনের পর তারা বাংলাদেশের সঙ্গে পানি চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। 

সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেক আগ্রাসী হয়ে গেছে। বিভিন্ন লোভনীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে চীন আসছে। যদিও বাংলাদেশ এখন চীনের সাথে বিনিয়োগের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করছে। নতুন করে বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশ একটু রক্ষণশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর এ কারণেই চীন এখন বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক মিত্রের সন্ধান করছে। যারা বাংলাদেশে ভারত বিরোধীতা উষ্কে দিবে এবং ভারতের সমালোচনার মাধ্যমে চীনকে সামনে আনবে। চীন ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই এখন প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যেন চীন পন্থীদের প্রভাব বাড়ে সে চেষ্টা করছে। ১৪ দলের নেতাদের চীন সফরের পর এই সংবাদ সম্মেলন তারই ইঙ্গিত বহন করে। 

এখন ৫০ সদস্যের একটি আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল চীনে অবস্থান করছেন। এবং তারা ফিরে আসার পর পরই কাজী জাফর উল্লাহর নেতৃত্বে আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল চীন সফর করবে। সবকিছু মিলিয়ে রাজনীতিতে চীন প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে যেন রাজনীতিবিদরা ভারত বিরোধীতায় নামেন এবং চীনের প্রকল্পের স্বার্থগুলো বাস্তবায়িত হয়। আর এই কারণেই রাশেদ খান মেনন এখন নতুন করে আবার চীন পন্থী হিসেবে নিজেকে যালাই করে নিলেন। চীনে রাজনীতিবিদদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি মগজ ধোলাই করার জন্য- এ প্রশ্নটি এখন সামনে এসেছে। 


ওয়ার্কার্স পার্টি   রাশেদ খান মেনন   চীন   ভারত  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন