মন্তব্য করুন
‘চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ শেষ হয়ে গেল। যারে যেদিকে পাঠাই কেবল চুরি করে।... দুর্নীতি, দুর্নীতি, উহঃ আল্লাহ। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব। এত দুর্নীতিবাজ যে আগে কোথায় ছিল, জানি না।’ না, এটি সাম্প্রতিককালের কোনো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য নয়। ১৯৭৩ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই মন্তব্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি যেন বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এখন কোনো অনুষ্ঠানে বা জনসভায় একই বক্তব্য দেন, তাহলে তিনিও বিপুল করতালিতে অভিষিক্ত হবেন, সন্দেহ নেই। শুক্রবার রাতে টেলিভিশনে বিমানবন্দরে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনিশ্চিত অপেক্ষায় থাকা মানুষের কান্না দেখেছিলাম। নিজের অজান্তেই কখন অশ্রুসজল হয়েছিলাম, জানি না। এই গরিব মানুষের সঙ্গে কারা প্রতারণা করেছে? সরকারের ভেতরে থাকা কিছু সংসদ সদস্য, তাদের স্ত্রী ও কন্যা। এই ৩০ হাজার মানুষকে পথে বসানোর দায় কে নেবে? প্রতারিত এই মানুষের আর্তনাদ শুনে বঙ্গবন্ধুর উক্তি মনে পড়ল।
শুধু এই বক্তব্য নয়, বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নে বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। চারপাশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চিৎকার করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ‘সোনার বাংলা’ গড়া সম্ভব হবে না। জাতির পিতা তার জীবদ্দশায় পালিত শেষ স্বাধীনতা দিবসের বক্তব্য দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চের এই বক্তৃতায় দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচন করেন জাতির পিতা।
শুধু আর্থিক অনিয়মকারীরাই নয়, আদর্শচ্যুত মতলববাজদেরও দুর্নীতির সংজ্ঞায় এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ, যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ।
এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। ... ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে। এত চোরের চোর, এই চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে, তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই চোরদের তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।’
কে বলে বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য পঁচাত্তরের? মুখে বলুন আর না বলুন-প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এই বক্তব্যের সত্যতা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করেছেন। শুধু জনগণ নয়, তিনিও এখন ‘চাটার গোষ্ঠীর’ যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। শেখ হাসিনা ‘যারে যেখানে পাঠাচ্ছেন কেবল চুরি করছে’। সাম্প্রতিককালে আজিজ আহমেদ, বেনজীর আহমেদ, মালয়েশিয়ায় রিক্রুটিং সিন্ডিকেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর চুনোপুঁটি ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের যেসব কেচ্ছা-কাহিনি বেরোচ্ছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যাকেও ইদানীং অসহায় মনে হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এটুকু, বঙ্গবন্ধু তার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান প্রকাশ্যে বলতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে আর্তনাদ করতেন, শেখ হাসিনা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি ‘নীলকণ্ঠী’। চারপাশের দুর্নীতিবাজদের অত্যাচার সহ্য করেন, যতক্ষণ না তারা সীমা লঙ্ঘন না করে।
সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের কথাই ধরা যাক। যোগ্যতা, দক্ষতা এবং বিশ্বস্ততার বিবেচনায় বেনজীর তার চাকরি জীবনে সবকিছু পেয়েছেন। চাকরি জীবনের একটা বড় সময় ধরে মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে তার সুনাম ছিল। কিন্তু তিনি পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে যত ওপরের দিকে উঠছেন, ততই বেপরোয়া এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠেছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন তার যে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করছে, তা রীতিমতো ‘রত্নভান্ডার’। শীর্ষ পদে একজন ব্যক্তি যখন লোভে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন, তখন সরকার বা রাষ্ট্র কী করবে? শীর্ষ পদে গিয়ে লাগামহীন দুর্নীতি একজন ব্যক্তির একান্তই নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তারা রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য ক্ষতিকর।
তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই, সরকার বেনজীরের কথিত দুর্নীতির দায় এড়াতে পারে না। দেশে রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানদার পর্যন্ত সাবেক এই পুলিশপ্রধানের দুর্নীতির কেচ্ছা-কাহিনি জানত। তাহলে সরকার এই অপকর্মের বিন্দু-বিসর্গও জানত না, এটা হতে পারে না। সরকার কি বেনজীর আহমেদকে ভয় পেত? তিনি কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন? নাকি সরকার জেনেশুনে এসব অন্যায় প্রশ্রয় দিয়েছে। সবাই নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। কদিন আগে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বিস্মিত এবং হতবাক। বলছিলেন, ‘চুরি কমবেশি সবাই করে। কিন্তু এটা তো লুণ্ঠন! এতটা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি।’ এ রকম বক্তব্য অনেকের। তারা বলেছেন, বেনজীরের এই অধ্যায় তাদের অজানা ছিল।
আমি মনে করি, এটি সুশাসন এবং জবাবদিহির ব্যর্থতা। বেনজীর আহমেদকে পুলিশপ্রধান করে কি তাকে পুলিশ বাহিনীর জমিদারি বা ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছিল? তিনি কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন? কেউ কেন তাকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় বেনজীর আহমেদের নাম এসেছিল। কিন্তু সেটিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা চাকরিতে থেকে কীভাবে বোট ক্লাবের হর্তাকর্তা হন, এ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু সে প্রশ্ন আমলে নেওয়া হয়নি। সীমা লঙ্ঘনের সব সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর সবার ঘুম ভেঙেছে। এখানেও সন্দেহ। বেনজীর যখন বিদেশে সপরিবারে পালিয়ে গেলেন, তারপর শুরু হলো হৈচৈ? সরকারের ভেতর থেকেই কি কেউ তাকে আগাম তথ্য দিয়েছে? পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে? তার পরও দুদক এবং সরকারের এই অবস্থানকে আমি স্বাগত জানাই। এর ফলে আমাদের দুটি উপকার হলো।
প্রথমত, বেনজীরের বিরুদ্ধে এখনকার তৎপরতা সুস্পষ্টভাবে সবার জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা। অন্যায় করলে একদিন না একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে-এই চিরন্তন সত্যটা সামনে এলো। বেনজীর একজন না। বেনজীর একটি ব্যক্তি না। বেনজীরের মতো বহু বিতর্কিত ব্যক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন বা ছিলেন। বেনজীররা রাষ্ট্রের জন্য দানব। তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। এ ঘটনা এসব দানবের জন্য একটা সতর্কবার্তা। বেনজীর আহমেদের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে যে কোনো দুর্নীতিবাজের যে কোনো সময় একই পরিণতি হতে পারে। ‘ক্ষমতা’ জোয়ার-ভাটার মতো। ভাটার সময় কেউ পাশে থাকে না। যেমন বেনজীর, আজিজ, তুষার, লিকুর পাশে কেউ নেই। এর ফলে দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে রাখা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। এই ঘটনার পর শীর্ষপদে দুর্নীতি করার আগে যে কেউ দশবার চিন্তা করবে।
দ্বিতীয়ত, জনগণের বিচার। যে কোনো বিচারের দুটি দিক আছে। একটি আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার, যা দুদক এখন করছে। সাবেক পুলিশপ্রধানের অবৈধ সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনুসন্ধানে যখন সম্পদের অস্বাভাবিক স্ফীতি লক্ষ করেছে, তখন কমিশন আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। দুই দফায় বেনজীর এবং তার পরিবারের বিপুল সম্পদ জব্দ করার আবেদন করেছে। দুদক ৬ জুন সাবেক পুলিশপ্রধানকে তলব করেছে। ৯ জুন তলব করেছে স্ত্রী ও সন্তানদের। এভাবেই ধাপে ধাপে আইনি প্রক্রিয়া এগোবে। দুদক তদন্ত শেষে অভিযোগগুলো আদালতে জমা দেবে। চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ, যুক্তি-তর্ক, সাক্ষ্য-প্রমাণের পর বিচারক রায় দেবেন বেনজীর আহমেদ দোষী না নির্দোষ। এর আগে আইনের দৃষ্টিতে তাকে অপরাধী বলা যাবে না। কিন্তু আইনের এই প্রক্রিয়ার বাইরেও একটি বিচার আছে, তা হলো জনভাবনা, জনমত। যেটাকে আমরা বলি ‘পাবলিক ট্রায়াল’। যে কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের নাগরিক ওই ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব একটি মতামত গ্রহণ করে। জনগণের মধ্যে একটি সামষ্টিক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। আইনের প্রক্রিয়ার আগেই সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কাউকে দোষী বা নির্দোষ হিসেবে রায় দেয়। বেনজীর আহমেদের ব্যাপারে জনরায় তার বিরুদ্ধে। সপ্তাহজুড়ে এ ঘটনায় জনগণের মধ্যে একটি বিজয়ী ভাব লক্ষণীয়। তারা মনে করে, বেনজীর আহমেদ দুর্নীতিবাজ। দুদকের অ্যাকশনে তারা খুশি। জনতার আদালতে বিচারের আগেই বেনজীর অপরাধী। আমি মনে করি, এ ধরনের মানুষের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় শাস্তি। এই সামাজিক ঘৃণা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও মানুষের সম্মিলিত কোরাস।
বেনজীর কি একা? তিনিই কি উচ্চপদে থাকা একমাত্র কর্মকর্তা, যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ? না। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন স্তরে এ রকম অনেক বেনজীর আছেন। যাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি দীর্ঘ। এসব ব্যক্তিকে সবাই চেনে, জানে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, শুধু বেনজীরকে কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে, অন্যরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি’ ঘোষণা করেছে। তাই ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখতে চায় জনগণ। শুধু একটি ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হলে তার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে বলে ধরে নিতে হবে। জনগণ শুধু এক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির তদন্ত চায় না, সব দুর্নীতিবাজের মুখোশ উন্মোচন চায়। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তি চায়, অর্থ পাচারকারীদের বিচার চায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও একই রকম বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অপরাধী যত প্রভাবশালী হোন, সরকারের সাপোর্ট পাবে না।’ বেনজীর আহমেদের ঘটনায় আশাবাদী হয়ে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও তদন্ত দাবি করেছেন কয়েকজন আইনজীবী। তারা দুদকে এ ব্যাপারে চিঠিও দিয়েছেন। দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় হলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো অবস্থান এখন নানাভাবে দৃশ্যমান।
গত বুধবার (২৯ মে) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুজন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এ দুজনের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর। চুক্তি নবায়নের মাত্র চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল করা হলো। অনেকেই মনে করেন, এটাও অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের আরেকটি প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও শুদ্ধি অভিযান হচ্ছে-এমন সংবাদে আমরা আন্দোলিত। কিন্তু আমরা ঘর পোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। বিভিন্ন সময়ে নানা রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে হৈচৈ হয়েছে। তারপর সবকিছু থেমে গেছে। ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় সারা দেশে তোলপাড় হলো। আওয়ামী লীগের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা পদ হারালেন। অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। গণমাধ্যমে কয়েকদিন তাদের অবৈধ বিপুল সম্পদের ফিরিস্তি প্রকাশিত হলো। তারপর সব সুনসান। সে সময় যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের কারও সাজা হয়েছে? এ নিয়ে কেউ এখন কথা বলে না।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংক লুণ্ঠনের পর ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু কী হয়েছে তার পরিণতি? আমরা কি আবদুল হাই বাচ্চুর কিছু করতে পেরেছি? খেলাপি ঋণ এখন এভারেস্টের চেয়েও উঁচু। কারও কিছু হয়নি।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হলো, এর সঙ্গে জড়িত সরকারের ঘনিষ্ঠরা। যাদের কারণে ৩০ হাজার মানুষ পথে বসল, তাদের কি বিচার হবে? অর্থ পাচার নিয়ে কথা তো কম হলো না। কিন্তু একজন অর্থ পাচারকারীকেও এখনো আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দুই বছর আগে সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু আমলারা এতই ক্ষমতাবান, ১৯৭৯ সালের আইনটি তারা বন্দি করে রেখেছেন। এই আইন যদি কার্যকর থাকত, তাহলে কি বেনজীর এত বেপরোয়া হতেন? দুর্নীতিবাজদের এক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। আগে রাজনীতিবিদরা কিছু দুর্নীতিবাজ পুষতেন। নির্বাচন, রাজনৈতিক খরচ মেটানোর জন্য। এখন দুর্নীতিবাজরা রাজনীতিবিদ পোষেণ, তাদের অবৈধ সম্পদ পাহারা দেওয়ার জন্য। রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ এখন দুর্নীতিবাজদের পালিত, অনুগত। তাই বেনজীর, আজিজ নাটকের সমাপ্তি কোথায়, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিছুদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে আমরা আবার অন্য এক ইস্যুতে ঝাঁপ দেব? দুর্নীতিবাজরা বুক ফুলিয়ে আবার ঘুরে বেড়াবে?
আমরা যেন দুর্নীতির এক দুষ্টচক্রের জালে বন্দি। দুর্নীতির এক বীভৎস প্রতিযোগিতা চলছে দেশজুড়ে। বঙ্গবন্ধুর মতোই প্রধানমন্ত্রী যাকে যে দায়িত্বে দিচ্ছেন, তিনিই যেন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন। ‘চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ’ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কার ওপর আস্থা রাখবেন শেখ হাসিনা?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
দুর্নীতি বীভৎস প্রতিযোগিতা দেশজুড়ে
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
এক.
তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ে সপ্তাহজুড়ে তোলপাড় দেশ। একজন জনপ্রতিনিধি। একজন সাবেক সেনাপ্রধান। তৃতীয় ব্যক্তি সাবেক পুলিশপ্রধান। ভিন্ন ভিন্ন কারণে এবং ঘটনায় তারা আলোচনায়। তিন ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু তিন ঘটনায় এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অনিয়ম। একজন জীবন দিয়ে তার অন্ধকার জগতের দরজা খুলে দিয়েছেন। একজন ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন। তৃতীয়জনের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। এ তিনটি ঘটনার পর একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে—জনগণের সেবার দায়িত্ব কারা পাচ্ছেন? দুর্নীতিবাজরা, চোরাকারবারি, ক্ষমতা অপব্যবহারকারীরা কীভাবে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাচ্ছেন? এ ধরনের ব্যক্তিদের হাতে জনগণ কতটা নিরাপদ?
দুই.
প্রথমেই জনপ্রতিনিধি প্রসঙ্গে খানিকটা আলোকপাত করা যাক। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে কলকাতায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গত বুধবার এ খবরটি নিশ্চিত করে কলকাতা পুলিশ। গত ১২ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ১৮ মে থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। আনার হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে এখন পর্যন্ত যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা লোমহর্ষক। হিন্দি সিনেমার মতো। এ হত্যাকাণ্ডের পর চোরাচালানের ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’র চাঞ্চল্যকর সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ২৪ মে ‘কালবেলা’র খবরে বলা হয়েছে, ‘চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে স্বর্ণ চোরাচালানের ২০০ কোটি টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ ছাড়া সীমান্তকেন্দ্রিক চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণও খুনের আরেক কারণ হিসেবে কাজ করেছে...।’ আনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। বাংলাদেশে ও ভারতে সন্দেহজনক ব্যক্তিরা আটক হয়েছেন। নিশ্চয়ই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হবে শিগগির। তিনবারের সংসদ সদস্য আনারের মৃত্যুর পর তার জীবনের অন্ধকার অধ্যায় সামনে এসেছে। সন্দেহ নেই, প্রয়াত এ সংসদ সদস্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুর পর এলাকার জনগণের মধ্যে যে আবেগ এবং শোক দেখা গেছে, তা অভূতপূর্ব। কিন্তু মৃত্যুর পর জানা গেল তিনি চোরাচালান চক্রের একজন ‘গডফাদার’ ছিলেন। ওই এলাকার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন এই সংসদ সদস্য। এটি যে কোনো গোপন বিষয়, তা নয়। ওপেন সিক্রেট। সবাই জানতেন। আওয়ামী লীগেও নিশ্চয়ই বিষয়টি অজানা নয়। সবকিছু জেনেশুনে একজন চোরাকারবারিকে কীভাবে তিন-তিনবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিল? ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এর মধ্যে ২০১৪ এবং এ বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণই করেনি। তাই এমনটি বলার কোনো সুযোগ নেই যে, জেতার জন্য ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কৌশলগত কারণে আপস করতে হয়েছে। এসব নির্বাচনে সৎ, পরিচ্ছন্ন মানুষকে সামনে আনার সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতদের মনোনয়ন দিয়ে রাজনীতিকে শুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি। বিভিন্ন স্থানে এরকম করাও হয়েছে। তাহলে কেন সর্বহারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন চোরাকারবারিকে বারবার মনোনয়ন দেওয়া হলো? কার স্বার্থে এ ধরনের বিতর্কিত, অন্ধকার জগতের লোকজনকে জনপ্রতিনিধি বানানো হয়? আনারের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর একটি বিষয় সামনে এসেছে, আমাদের জনপ্রতিনিধি কারা হচ্ছেন? কারা আমাদের ‘ভাগ্যবিধাতা’ হয়ে সংসদে যাচ্ছেন। এর আগেও একজন আদম ব্যবসায়ীকে সংসদে আনা হয়েছিল। বিদেশে তিনি গ্রেপ্তার হন। পরে জানা যায়, আওয়ামী লীগের প্রয়াত এক নেতাকে বিপুল অর্থ দিয়ে তিনি ‘স্বতন্ত্র’ভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্ত্রীকেও টাকার দাপটে সংসদ সদস্য বানিয়েছিলেন। আমরা প্রায়ই বলি, জাতীয় সংসদ ব্যবসায়ীদের দখলে। রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই। কিন্তু রাজনীতি এখন কি ক্রমশ কালো টাকার মালিক, অন্ধকার জগতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে? ভবিষ্যতের রাজনীতি কি মাফিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করবে?
তিন.
জেনারেল আজিজ আহমেদ সাবেক সেনাপ্রধান। তিন বছর সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালনের পর ২০২১ সালের জুনে তিনি অবসরে যান। ২০ মে সোমবার মধ্যরাতের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ক্ষমতার অপব্যবহার, তিন ভাইয়ের অপরাধ ধামাচাপা দিতে প্রভাব খাটানো এবং ভাইদের সেনা কেনাকাটায় অবৈধ সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছে, তা নতুন নয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরায় এ নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করেছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনের ভেতর ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আবিষ্কার করা হয়েছিল। এ কথা সত্য, আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত ওই প্রামাণ্যচিত্রে অযৌক্তিক এবং অন্যায়ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে জড়ানোর একটি কুৎসিত চেষ্টা ছিল। এ কারণেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে সেনাপ্রধান এবং তার ভাইদের বিভিন্ন অপকর্মগুলোর নিরপেক্ষ ও নির্মোহ তদন্ত করা ছিল সরকারের দায়িত্ব। সরকার অভিযোগগুলো আমলেই নেয়নি। বিশেষ করে নাম, ঠিকানা, পিতৃপরিচয় পরিবর্তন করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নেওয়ার মতো বিষয়গুলো প্রমাণিত। এসব জালিয়াতি ও প্রতারণার বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের অপরাধ তাদের ব্যক্তিগত। রাষ্ট্র বা সরকার কেন তার দায় নেবে? চাকরি জীবনে জেনারেল আজিজ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সেনাপ্রধান হওয়ার আগে তিনি বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন। দুই জায়গাতেই তার ব্যাপারে নানা মুখরোচক আলোচনা শোনা যায়। সরকারের ঘনিষ্ঠ এরকম একটি ধারণা দিয়ে তিনি দাপট দেখিয়েছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে বিস্তর অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব অভিযোগ তদন্ত তো দূরের কথা, আমলেই নেওয়া হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের গৌরবের সশস্ত্র বাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের অহংকার, দেশের গর্ব। এখনো এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে জনগণের আস্থা আশাতীত। হত্যা ও রাজনীতির উচ্চাভিলাষ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি চৌকস, পেশাদার বাহিনী হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। ২০০৯ সাল থেকে সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক মানের একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেনাপ্রধানরা অবসরের পর নিভৃত জীবনযাপন করেন। দায়িত্ব পালন করে তাদের পেশাদারিত্ব, সততা ও নিষ্ঠা তরুণদের জন্য অনুকরণীয় হয়। কিন্তু জেনারেল আজিজদের সময়ে ব্যাপারটি তেমন ছিল না। বিজিবির প্রধান বা সেনাপ্রধান হিসেবে তার অনেক কর্মকাণ্ডেই পেশাদার অফিসাররা অস্বস্তিতে পড়েছেন। বিব্রত হয়েছেন। সেনাপ্রধানের চেয়ে সরকারের ঘনিষ্ঠ—এ পরিচয়টি তার ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে উঠেছিল। আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্য ছিলেন কি না, সেটা ভিন্ন বিতর্ক। আমি সে বিতর্কে যাব না। তবে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তির জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পদের সঙ্গে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা ও সম্মান জড়িত। আজিজ আহমেদের কর্মকাণ্ড অনেক আগেই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত ছিল। তার বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগগুলোকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। আমার প্রশ্ন, শীর্ষ পদে যাওয়ার পর একজন ব্যক্তি কেন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার দাপটে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন? কেন তার লাগাম টেনে ধরা হয় না? এ ধরনের স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কি যথেষ্ট সতর্ক? কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত কি না, আজিজ আহমেদের ঘটনার পর সেই বিতর্ক সামনে এসেছে।
চার.
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) ঢাকার একটি বিশেষ আদালত সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী, কন্যার সব স্থাবর সম্পদ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই আদেশ। গত কিছুদিন ধরেই সাবেক এই পুলিশপ্রধানের বিপুল অবৈধ সম্পদ নিয়ে তোলপাড় চলছিল। একটি জাতীয় দৈনিকে তার দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি হাইকোর্টের দৃষ্টিতে আনেন একজন আলোচিত সংসদ সদস্য। হাইকোর্টে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে। দুই মাসের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত নির্দেশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে। তদন্তের স্বার্থেই দুদক বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ ক্রোক করার আবেদন করে। বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের যখন ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন আমি আশা করেছিলাম তিনি এর কড়া প্রতিবাদ জানাবেন। কিন্তু তা না করে সাবেক এই পুলিশপ্রধান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘ এক বক্তৃতা দেন, যা ছিল অনেকটাই আত্মরক্ষামূলক। তার ওই বক্তব্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর জুতসই জবাবও ছিল না। তাই এখন দেখার বিষয়, দুদক তদন্ত করে কী পায়। বেনজীর আহমেদ দুর্নীতি করেছেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু মেধাবী এই পুলিশ কর্মকর্তার বেপরোয়া হয়ে ওঠার নানা কেচ্ছা-কাহিনি অলিগলিতে আলোচনা হয়। পুলিশের প্রায় কর্মকর্তাই তার পরিবর্তনের বিস্মিত। এক সময় চৌকস, দক্ষ এই পুলিশ কর্মকর্তার বদলে যাওয়া নিয়ে রীতিমতো সিনেমা হতে পারে। হলি আর্টিসানের ঘটনায় তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, তা সত্যি অতুলনীয়। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরাই হতাশার সুরে বলেন, পুলিশপ্রধান হওয়ার পর তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নানা রকম বিতর্ক এবং অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড ক্ষমতার দাপটে তিনি যা খুশি তা-ই করেছেন বলেও অনেক মন্তব্য করেন। পুলিশপ্রধান থাকা অবস্থায় তার লাগামহীন দুর্নীতি সরকারের বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়েছিল। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষপদে থাকা একজন ব্যক্তির এসব কাণ্ড সরকারের জন্যও বিব্রতকর। এখন দেখার বিষয়, বেনজীর আহমেদের পরিণতি কী হয়।
পাঁচ.
আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায়। এ সময় দেশ পরিচালনায় সরকার অনেক শীর্ষ পদে বহুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকের সততা ও নিষ্ঠা এখনো অনুকরণীয় উদহারণ। আবার কেউ কেউ শীর্ষ পদে গিয়ে এমনসব কাণ্ড করেছেন যে, সরকারই তাদের কাজে বিব্রত হয়েছেন। দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা বিভিন্ন শীর্ষ পদে গেছেন তারাই বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সমালোচিত হয়েছেন। এর ফলে সরকারও ইমেজ সংকটে পড়েছে।
এই তিনটি ঘটনার একটি সহজ সমীকরণ আমার কাছে স্পষ্ট। পক্ষপাত করে, রাজনৈতিক বিবেচনায় বা প্রভাবিত হয়ে যোগ্যতার বাইরে কাউকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়। হোক না তা জনপ্রতিনিধি কিংবা পুলিশপ্রধান। ইদানীং অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন পাওয়ার কথা বেশ চালু হয়েছে। অযোগ্যরা তদবির করে, চাটুকারিতার মাধ্যমে অথবা সরকারকে নানাভাবে প্রভাবিত করে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন। এরাই বিতর্কিত হচ্ছেন, সরকারকেও করছেন বিব্রত। এদের লোভ, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট। এই তিন ঘটনা আমাদের একটি সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাই তা হলো গুরুত্বপূর্ণ পদে বা দায়িত্বে লোক বাছাই করতে হবে নির্মোহভাবে, শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে। না হলে ক্ষতি হবে সরকারের, দেশের।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
আনার আজিজ বেনজির দুর্নীতি নিষেধাজ্ঞা হত্যা
মন্তব্য করুন
ওয়ার্কার্স পার্টি রাশেদ খান মেনন চীন ভারত
মন্তব্য করুন
‘চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ শেষ হয়ে গেল। যারে যেদিকে পাঠাই কেবল চুরি করে।... দুর্নীতি, দুর্নীতি, উহঃ আল্লাহ। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব। এত দুর্নীতিবাজ যে আগে কোথায় ছিল, জানি না।’ না, এটি সাম্প্রতিককালের কোনো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য নয়। ১৯৭৩ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই মন্তব্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি যেন বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা।
বুধবার (২৯ মে) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর দুইজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাটাই হয়েছেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২, অন্যজন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব। টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল হলো। সাবেক সেনাপ্রধান এবং সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই দুই কর্মকর্তার ছাটাই নানা প্রশ্ন সামনে এনেছে। এটি কী সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের একটি অংশ নাকি অস্থিরতার প্রকাশ? হঠাৎ করেই দুর্নীতির ইস্যু জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে এসেছে। এটি কী সরকারের জন্য চাপ না কৌশলের অংশ? একের পর এক ঘটনার পর আকাশে বাতাসে না প্রশ্ন। সরকারের ভেতর কী হচ্ছে?
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গণভবনে কোটালীপাড়া উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বলেছেন, এখন একটাই কাজ তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় আনা। এই কথাটি তিনি খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন কিছু বলেন তখন নিশ্চয়ই তার কার্যকারণ থাকে এবং ভেবে চিন্তে তিনি কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ে সপ্তাহজুড়ে তোলপাড় দেশ। একজন জনপ্রতিনিধি। একজন সাবেক সেনাপ্রধান। তৃতীয় ব্যক্তি সাবেক পুলিশপ্রধান। ভিন্ন ভিন্ন কারণে এবং ঘটনায় তারা আলোচনায়। তিন ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু তিন ঘটনায় এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অনিয়ম। একজন জীবন দিয়ে তার অন্ধকার জগতের দরজা খুলে দিয়েছেন। একজন ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন। তৃতীয়জনের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। এ তিনটি ঘটনার পর একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে—জনগণের সেবার দায়িত্ব কারা পাচ্ছেন? দুর্নীতিবাজরা, চোরাকারবারি, ক্ষমতা অপব্যবহারকারীরা কীভাবে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাচ্ছেন? এ ধরনের ব্যক্তিদের হাতে জনগণ কতটা নিরাপদ?
চীন থেকেই ফিরে ভারতের সমালোচনায় মুখর হলেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন। সাম্প্রতিক সময়ে ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি চীন নিয়ে যান। এ সফরের উদ্দেশ্য কি ছিল বা কেনই বা চীন তাদেরকে জামাই আদর দিয়ে নিয়ে গেছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানায়নি ইদানিং সুবিধাভোগী নেতারা। তবে চীন থেকে ফিরে আসার পর যেন রাশেদ খান মেননের মগজ ধোলাই হয়েছে তা দিব্যি বোঝা গেল। চীন থেকে ফেরার পরেই তিনি এখন ভারত বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।