দুটো খবর দুই দেশের। আপাতদৃষ্টিতে দুই খবরের কোনো মিল নেই। রাজনীতি-নির্বাচন, ই-কমার্সের নামে জালিয়াতি কিংবা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ খবরের ভিড়ে এ দুটি খবর একান্তই মূল্যহীন। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, দুটি ঘটনার অদ্ভুত যোগসূত্র আছে। দুটি ঘটনাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত সোমবার (১২ অক্টোবর) শ্রম আইনের এক মামলায় আদালতে গিয়ে জামিন নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দ্বিতীয় ঘটনাটি গত ৮ অক্টোবরের। ওই দিন ভারতে ১৮ হাজার কোটি রুপির বিনিময়ে টাটা গ্রুপের হাতে তুলে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া এবং এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। এ ছাড়াও এয়ার ইন্ডিয়া স্যাটসের ৫০ ভাগ মালিকানা কিনে নেয় টাটা। এ দুটো ঘটনার যোগসূত্র খুঁজতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন মেধাবী মানুষ। শিক্ষক ও গবেষক। একটি গবেষণার জন্য চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ড. ইউনূসের এই ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম ছিল মূলত কুমিল্লার বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আকতার হামিদ খানের মডেলের অনুসরণ। এ কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে ড. ইউনূস এরশাদ সরকারের সহযোগিতা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ১ অক্টোবর ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। আস্তে আস্তে ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ বিদেশি অনুদানে সম্প্রসারিত হয়। শিক্ষক এবং গবেষক থেকে ড. ইউনূস হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন থেকে গ্রামীণ টেলিকম সবক্ষেত্রেই হাত বাড়ান ড. ইউনূস। ড. ইউনূসের ব্যবসা ছিল ভিন্ন ধরনের। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বলে এসব প্রতিষ্ঠান আয়করমুক্ত থাকে। দেশের গণ্ডী পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি পরিচিতি পান। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এ নোবেল প্রাপ্তির পর গ্রামীণ ব্যাংক অন্তরালে চলে যায়। সব কৃতিত্ব ড. ইউনূসের দখলে চলে যায়। প্রচুর অনুদান, সহায়তায় ড. ইউনূস শুরু করেন সামাজিক ব্যবসার নতুন প্রকল্প। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁর চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে যায়। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আইনি যুদ্ধেও জড়ান এই নোবেলজয়ী। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরে যাওয়ার পর একে একে তাঁর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হতে শুরু করে। অনেকগুলো বন্ধ। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি ব্যস্ত তাঁকে নিয়ে। পুরস্কার, অনুদান আর খ্যাতির নেশায় এখনো ক্লান্তিহীন ড. ইউনূস। এ বছর টোকিও অলিম্পিকে তিনি পেলেন অলিম্পিক লরেল। ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁর এই পুরস্কার প্রাপ্তি অবিশ্বাস্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধারে সুশীল, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। কিন্তু প্রত্যেক কাজেরই একটা সীমারেখা আছে। আছে সুনির্দিষ্ট গণ্ডী। ড. ইউনূস যখন যে পরিচয় প্রয়োজন তখন তা ব্যবহার করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি একজন তুখোড় বক্তা। মটিভেটর। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের গুপ্ত আকাঙ্খাও মাঝে মধ্যে জাগরিত হয়। ব্যবসায়ী হিসেবে অন্যের টাকায় বিত্তশালী হওয়ারও প্রয়াস দেখা যায়। আবার রাষ্ট্রকে প্রাপ্য কর দিতে সব ফাঁকফোকর তিনি খুঁজে বের করেন অবলীলায়। একজন উদ্যোক্তাকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সামনে এগোতে হয়। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তেমন নয়। তিনি সবকিছুই করেছেন মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো। সরকারের টাকায় গ্রামীণ ব্যাংক করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় গ্রামীণ টেলিকম সেখান থেকে গ্রামীণফোনের মালিকানা পর্যন্ত নিয়েছিলেন। ড. ইউনূসের সব প্রতিষ্ঠানেই প্রতারণা, শ্রমিক ঠকানো, নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানও করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। গ্রামীণ টেলিকমের কথাই ধরা যাক। ড. ইউনূস শতাধিক কর্মচারীকে স্থায়ী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। করেননি। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ লাভের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতিও পূরণ করেননি। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল করেননি। এসব প্রতিষ্ঠানের লাভের টাকায় ড. ইউনূস দেশ-বিদেশে সেমিনার করেছেন, বক্তৃতা করেছেন। নোবেল পুরস্কারসহ বিভিন্ন পদক পেয়েছেন। কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেনি, নিজের দেশের জন্য কী করলেন? গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ টেলিকম সর্বত্র শ্রমিক নিগ্রহ, আয়কর ফাঁকির ঘটনার পরও গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। কারণ তিনি সুশীল। তিনি সাধু। ড. ইউনূস দাবি করেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা নারীরা নাকি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক। মালিকানার প্রধান শর্ত হলো হস্তান্তর। গ্রামীণ ব্যাংকের নারী ঋণগ্রহীতারা কি মালিকানা হস্তান্তর করতে পারেন? ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয় করে ড. ইউনূস ঘোষণা করেছিলেন, দরিদ্রকে জাদুঘরে পাঠাবেন। দরিদ্র এখন দাঁত কেলিয়ে হাসে। কিন্তু ড. ইউনূসের এসব কথা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। কারণ তিনি সুশীল। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয় করে ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারপর পিছু হটেন। ওয়ান-ইলেভেনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বহু প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই দেশের জন্য তিনি কী করেছেন? বন্যা, দুর্যোগ, করোনা মহামারীতে বিশ্বে দাপিয়ে বেড়ানো এ মানুষটি দেশের জনগণের কোনো উপকার করেছেন কি? ড. ইউনূসের আড়ালে আমরা বাংলাদেশে সুশীলদের একটি অংশের চেহারাটাই দেখি। আমাদের দেশের কিছু সুশীল সবকিছুই করতে চান, কিন্তু অন্যের সমালোচনা ছাড়া কিছুই পারেন না। রাষ্ট্র এবং বিদেশি অর্থে তারা প্রতিষ্ঠান বানান, সেসব প্রতিষ্ঠান টেকসই হয় না। দেশের সবকিছু খারাপ বলে এরা সারাক্ষণ বকবক করেন, কিন্তু দেশের জন্য, জনগণের জন্য কিছুই করেন না। এদের কাজ হলো, অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি চালানো। ড. ইউনূস অধ্যায়টা এ পর্যন্ত রেখে আসুন একটা টাটা অধ্যায়ে মনোনিবেশ করি।
ভারতবর্ষে ১৯৩২ সালে ‘টাটা এয়ারলাইনস’ চালু হয়েছিল। এ এয়ারলাইনসের প্রতিষ্ঠাতা জে আর ডি টাটা। কয়েক বছর পর নাম বদল করে টাটা এয়ারলাইনসের নাম রাখা হয় এয়ার ইন্ডিয়া। ভারতের স্বাধীনতার পর ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ৪৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। শুরু হয় টাটার মালিকানাধীন(৫১ শতাংশ)প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক অভিযাত্রা। মুম্বাই থেকে লন্ডনে ফ্লাইট যায় এয়ার ইন্ডিয়ার। কিন্তু এরপরই ঘটে বিপর্যয়। ১৯৫৩ সালে জওহর লাল নেহেরু সব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্তকরণের সিদ্ধান্ত নেন। তার আওতায় পড়ে এয়ার ইন্ডিয়াও। সে সময় ভারতের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ই বেসামরিক বিমান চলাচল দেখভাল করত। যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন জগজীবন রাম। জে আর ডি টাটাকে ডেকে জগজীবন রাম এয়ার ইন্ডিয়া অধিগ্রহণের সরকারি সিদ্ধান্ত জানান। বিস্মিত, হতবাক হয়েছিলেন জে আর ডি। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন প্রচণ্ডভাবে। গণমাধ্যমে সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্তকরণের সিদ্ধান্ত দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। জে আর ডি টাটা আশা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন। কিন্তু নেহেরু অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। তবে টাটাকে সান্ত্বনা দিতে এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান করেন। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। ক্ষোভ, দুঃখ নিয়েও জে আর ডি শেষ বন্ধনটুকু রাখতে রাজি হন। কিন্তু পরবর্তীতে টাটার জন্য আরও বড় অপমান অপেক্ষা করছিল। ১৯৭৮ সালে কংগ্রেস পরাজিত হয় নির্বাচনে। মোরারজি দেশাই হন প্রধানমন্ত্রী। এবার চিঠি দিয়ে জানানো হয় চেয়ারম্যান পদে টাটা থাকবেন না। চেয়ারম্যান পদে বসানো হয় একজন অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাকে।
টাটার অর্থে, জে আর ডি টাটার মেধা আর শ্রমে গড়া ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ হয়ে যায় সরকারি কর্মী-কর্তাদের লুটের খনি। আস্তে আস্তে টাটা পরিণত হয় এক লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে গেলে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিমান পরিবহন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় দ্রুত পিছিয়ে পড়তে থাকে এয়ার ইন্ডিয়া। ২০১৭ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ হাজার কোটি রুপি। এটি ভারতের ১০০ দিনের বাজেটের সমান। টাটা কিনে নেওয়ার আগে এই আগস্ট পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণ ৬২ হাজার কোটি রুপি। প্রতিদিন এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনে ২০ কোটি রুপি। এ অবস্থায় ভারত সরকার এয়ার ইন্ডিয়ার বোঝা আর বইতে পারছিল না। বিক্রির দরপত্রে টাটাই সবচেয়ে বেশি দর দেয়। টাটাদের জন্য বিষয়টি অন্যের দখলে থাকা নিজের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার মতোই। ভারত একবার জোর করে টাটার সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল। এখন টাটা ১৮ হাজার কোটি রুপি খরচ করে মধুর প্রতিশোধ নিল। এয়ার ইন্ডিয়া ফেরত পেতে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ করেননি রতন টাটা। এর পেছনে আবেগই কাজ করেছে সবচেয়ে বেশি। টেন্ডার জয়ের পর রতন টাটার টুইট বার্তাটি আবেগে ঘেরা। টুইটে রতন টাটা লিখেছেন- ‘ওয়েলকাম ব্যাক এয়ার ইন্ডিয়া। এ নিলাম দুর্দান্ত এক জয়। জে আর ডি টাটা আজ আমাদের মধ্যে থাকলে সবচেয়ে খুশি হতেন’ রতন টাটা এয়ার ইন্ডিয়াকে আবার নতুন জীবন দিতে পারবেন কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে সরকার এবং জনগণের কত বড় বোঝা যে টাটা তার নিজের কাঁধে তুলে নিল তা উপলব্ধির জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার নেই। এটাকে কী বলবেন, ব্যবসা না দেশপ্রেম?
এবার আসুন দুই প্রেক্ষাপটকে একটু মিলিয়ে দেখি।
ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাষ্ট্রের টাকায়। রাষ্ট্রের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি করে তিনি প্রতিষ্ঠানটি কুক্ষিগত করে ফেলেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের লাভের টাকায় ড. ইউনূস আরও এক ডজন প্রতিষ্ঠান করেছেন। সেগুলোর মালিকানা পেয়েছেন বিনা টাকায়। অন্যদিকে, টাটা গ্রুপের ইতিহাস সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। জামসেদ টাটা পিতার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ১৮৬৮ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজে কিছু করবেন। ১৮৭০ সালে মাত্র ২১ হাজার টাকার পুঁজিতে একটি ট্রেডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠান করলেন। সেখান থেকে যাত্রা শুরু। টাটা এখন বিশ্বব্যাপী পরিচালিত একটি বহুজাতিক কোম্পানি। ১৫৩ বছরে টাটার সম্পদের পরিমাণ ১০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রায় ৮ লাখ মানুষ টাটার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। এয়ার ইন্ডিয়া গড়ে তুলেছিল টাটা। সরকার বিনা টাকায় প্রায় জোর করে কেড়ে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ ভারত সরকার টাটার টাকায় গড়া একটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছিল। যেমন ড. ইউনূস জনগণের টাকায় গড়া একটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছিলেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের লাভের টাকায় ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইকবাল কাদির গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠা করলে ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমকে গ্রামীণফোনের সঙ্গে যুক্ত করেন। পরে গ্রামীণফোনের ৫৫ শতাংশের মালিকানা বেচে দেন নরওয়ের টেলিনরের কাছে। এখনো ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম করপোরেশন গ্রামীণফোনের ৩৪ শতাংশের মালিক। ১ টাকা বিনিয়োগ না করেও ড. ইউনূস দেশের প্রধান মোবাইল নেটওয়ার্কের অন্যতম মালিক। গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে ড. ইউনূস কত টাকা পেয়েছেন তার হিসাব কে রাখে। অন্যদিকে দেখুন টাটা নিজের প্রতিষ্ঠানই (এয়ার ইন্ডিয়া) কিনল ১৮ হাজার কোটি রুপি দিয়ে। একজন কোনো টাকা বিনিয়োগ না করেই একের পর এক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। সেই প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশি কোম্পানির কাছে। অন্যদিকে টাটা নিজের বিনিয়োগে গড়া এয়ার ইন্ডিয়া কেড়ে নেওয়ার দুঃখ বয়ে বেরিয়েছেন ৬৮ বছর। প্রথম সুযোগে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান আবার নিজেদের কাছে ফেরত এনেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরি হারানোর পর ড. ইউনূস কী না করেছেন। দেশে-বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে অভিযোগ করেছেন। হিলারি আবার এ জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও ফোন করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে ইউনূসের প্রস্থানে হিলারি প্রচণ্ড রাগ করেছিলেন। এ কারণে বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যেন বিনিয়োগ না করে সে জন্য বিশ্বব্যাংককে সুপারিশ করেছিলেন। দেখুন একটি পদ হারাতেই কীভাবে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠেন একজন সুশীল। অন্যদিকে টাটার আস্ত একটা বিমান কোম্পানি কেড়ে নিল ভারত সরকার। টাটা কিছু করল না। এরপরও টাটা ভারতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। কারও কাছে নালিশ করেনি। বরং টাটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বে ভারতের সম্মান বাড়িয়েছে।
ড. ইউনূসের শোকেসে পুরস্কারের শোভা। নোবেল জয়ের টাকা কী করেছেন? তার বক্তৃতা, সেমিনার বা বিদেশে বিনিয়োগ টাকা তিনি কী করেন? গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির টাকাই বা তিনি কী করলেন? কেউ কোনো দিন শুনেছেন, ড. ইউনূস গরিব মানুষকে ত্রাণ দিয়েছেন? দুস্থ শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন? প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করেছেন? না। সামাজিক দায়বদ্ধতার কোনো কর্মকাণ্ডে আমরা এই শান্তিতে নোবেলজয়ীকে পাই না। নিজের নামে একটি সেন্টার করেছেন। ইউনূস সেন্টারের প্রধান কাজ হলো ড. ইউনূসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, তাঁর ইমেজ বাড়ানো। অন্যদিকে টাটা সাসটেইনেবিলিটি গ্রুপ বছরে গরিব মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যয় করে ১ হাজার কোটি রুপির ওপরে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়নে টাটা আলোচিত এবং প্রশংসিত একটি নাম। সমাজসেবায় টাটার অবদান সর্বজনবিদিত।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের রাজনৈতিক অভিলাষ নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরই তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। তাঁর এই উদ্যোগে বাতাস দেয় এ দেশের চিহ্নিত সুশীল গোষ্ঠী। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে এত বিপুল অবদানের পরও টাটার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ শিল্প গ্রুপ হওয়ার পরও টাটার কারও মন্ত্রী-এমপি হওয়ার খায়েশ হয়নি। রাজনৈতিক দল গঠনেরও অভিপ্রায় জাগেনি। ড. ইউনূস এবং রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা পরিবারের তুলনা করলাম, কিছু বাস্তব কারণে। বাংলাদেশে প্রায়ই একটি মনোভাব দেখা যায়, সুশীলরা প্রচণ্ড সৎ। তারাই একমাত্র দেশপ্রেমিক। মানুষের জন্য জান কোরবান করতে পারেন তারাই। আর ব্যবসায়ীরা হলেন অসৎ, দুর্বৃত্ত, মানুষের টাকা লুটে খান। কিন্তু সুশীলদের শিরোমণি ড. ইউনূসের কর্মকান্ডের এক চিলতে আলোকপাত করতেই আমরা দেখলাম কী অবস্থা। বাংলাদেশে সুশীল নিয়ন্ত্রিত প্রায় সব প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিহীন। এর নিয়ন্ত্রকরা প্রতিষ্ঠানে রাজতন্ত্র কায়েম করে রেখেছেন। মৃত্যুর আগে এদের পদ থেকে কেউ সরাতে পারে না। আমি জানি, অনেকেই প্রশ্ন করবেন, বাংলাদেশে কি টাটার মতো প্রতিষ্ঠান আছে? আমাদের শিল্প পরিবারগুলো কি টাটার মতো? বাংলাদেশের ৫০ বছরে বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রুপ দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক এগিয়ে নিতে এরা অবদান রাখছে নিরলসভাবে। সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু তারপরও বেসরকারি খাত দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম সহযাত্রী। টাটা এক দিনে হয়নি। কিন্তু ভারতে বা বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের যে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়, বাংলাদেশে কি তা হয়? সব সময় ব্যবসায়ীদের খুঁত ধরার এক প্রচন্ড প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার সুশীল হলেই তিনি যেন বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যান। ড. ইউনূস এবং রতন টাটার ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেয়। রাষ্ট্র এবং সমাজে প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের দায়িত্বের সীমারেখা আছে। এই সীমারেখা অতিক্রম করা উচিত নয়। বাংলাদেশে আমরা দেখি, ব্যবসায়ীরা মন্ত্রী-এমপি হতে চান। আমলারা রাজনীতিবিদ বনে যান। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসা করতে চান। আর সুশীল সমাজের একটি অংশ রাজনীতি, ব্যবসা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। কিন্তু সীমানার বাইরে গেলে কোনো কাজ যে সফল হয় না তার প্রমাণ ড. ইউনূসের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক আকাঙ্খা। আর রাষ্ট্র যে ব্যবসা করতে পারে না এয়ার ইন্ডিয়া তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাই আমরা আমাদের দায়িত্বের সীমার মধ্যেই থাকি। যার যেটা কাজ নয়, সেটা করলে বিপত্তিই বাড়ে।
মন্তব্য করুন
৩০ নভেম্বর ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষদিন। শেষদিনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমরের
‘নৌকা’ প্রতীকে নির্বাচন করার ঘোষণা। কারাগার থেকে বেরিয়েই এ বিএনপি নেতা যেভাবে ঝালকাঠিতে
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন, তা বিস্ময়কর। শাহজাহান ওমরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত,
রওশন এরশাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া, রেকর্ড পরিমাণ স্বতন্ত্র প্রার্থী, আওয়ামী লীগে
চার শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেওয়া ইত্যাদি সবই ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী
কৌশল। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি আগামী নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে চায়। ভোট
উৎসব করতে চায়। সেজন্যই এতসব আয়োজন। বিএনপি এবং তার মিত্রদের বাদ দিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু
ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার রাজনৈতিক কৌশলে শেষ পর্যন্ত কি আওয়ামী লীগ সফল হবে? নাকি
এ কৌশল তাদের জন্য হবে বুমেরাং? এ কৌশলে আওয়ামী লীগের লাভ হলো না ক্ষতি?
বিএনপি-জামায়াত অংশ না নিলেও এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমসহ অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দল। দল এবং স্বতন্ত্র মিলিয়ে ৩০০ আসনে প্রার্থী হয়েছে ২ হাজার ৭৪১ জন। প্রায় ৮০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীই ৪০০-এর ওপর। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো হচ্ছে না। ওই নির্বাচনে বিনা ভোটে এমপি হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডব, নাশকতার কারণে শেষ পর্যন্ত জনগণ এবং বহির্বিশ্ব এ নির্বাচন মন্দের ভালো হিসেবে মেনে নেয়। ওই সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করে। এবার দেশি-বিদেশি সবাই ২০১৪-এর মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, সেজন্য ক্ষমতাসীনদের সতর্ক করেছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতিও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গণভবনে ডেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিনা ভোটে এমপি হওয়া যাবে না। প্রত্যেক আসনে ‘ডামি প্রার্থী’ দেওয়ার কৌশলের কথাও তিনি দলের নেতাকর্মীদের জানিয়েছিলেন। ব্যস, আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সবাই এটাকে সবুজ সংকেত হিসেবে মনে করেন। দলীয় মনোনয়ন যারা পাননি তারা ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হওয়াটাকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর বাম্পার ফলন হয়েছে এই নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরাও বুঝতে পেরেছেন এভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিস্ফোরণ দলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এরপর থেকে বারবার বলছেন, যথেচ্ছভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া যাবে না। দল ঠিক করে দেবে কে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবে। দলের সিদ্ধান্ত না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সারা দেশে আওয়ামী লীগের ‘চেইন অব কমান্ড’ রীতিমতো ভেঙে পড়েছে। নির্বাচন হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ ‘এ’ টিম আর আওয়ামী লীগ ‘বি’ টিমের লড়াই। কোথাও কোথাও ‘সি’ টিম, ‘ডি’ টিমও আছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত সময় আছে। এর মধ্যে যদি ক্ষমতাসীনরা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে না পারে, তাহলে সমূহ বিপদ। এর ফলে বহু আসনে নৌকা প্রার্থীর বদলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের বিজয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আওয়ামী লীগ অবশ্য মনে করতেই পারে যেই জিতুক, এমপি তো শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের। কিন্তু এর সুদূর প্রসারী তাৎপর্য হবে ভয়াবহ। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকাতেই আওয়ামী লীগ হয়ে পড়বে বিভক্ত। একপক্ষ অন্যপক্ষের সঙ্গে মারামারি, খুনোখুনি করবে। একে অন্যের চরিত্র হনন করবে। সারা দেশে সংগঠনে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে এমপি হবেন, তখন তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানো হবে কঠিন। কেউ মন্ত্রী হতে চাইবেন, কেউ বিক্রি হবেন। কেনাবেচার বাজারে তারা আওয়ামী লীগের ওপরই যে চাপ সৃষ্টি করবেন না, তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারবে?
এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটগত ঐক্য নিয়ে
এখন পর্যন্ত একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে। একমাত্র হাসানুল হক ইনু ছাড়া ১৪ দলের আর কোনো
নেতার আসন সংরক্ষিত নয়। ২০০৮-এর নির্বাচন থেকে গত তিনটি নির্বাচনী আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে
করেছে। মহাজোট এবং ১৪ দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের অংশ। জাতীয় পার্টি ছাড়া মহাজোটের
শরিক অন্য সব দলই নৌকা প্রতীকে গত তিনটি নির্বাচন করেছে। এবার কী হবে? যদিও আওয়ামী
লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৪ দলের শরিকদের জন্য তারা আসন ছেড়ে দেবে। মনোনয়ন প্রত্যাহার
পর্যন্ত সময় আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে কটি আসন দেবে, তা কি ১৪ দলের শরিকরা মানবে?
এ নিয়ে মনোমালিন্য, মান-অভিমান, তিক্ততার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের
ওয়ার্কার্স পার্টির কথাই ধরা যাক। দলটির প্রধান নেতা রাশেদ খান মেননের আসনে আওয়ামী
লীগ মনোনয়ন দিয়েছে দলের জনপ্রিয় নেতা বাহাউদ্দিন নাছিমকে। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই মেননকে
বরিশালের একটি আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তাব দেবে। ওই আসনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী
আছেন। আছেন বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী। দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার
করবেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন দলীয় সিদ্ধান্ত মানবে? আওয়ামী লীগের
স্থানীয় সংগঠন কি মেননের জন্য কাজ করবে, না বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্য কাজ করবে? রাজশাহীতে
ওয়ার্কার্স পার্টির আরেক নেতা ফজলে হোসেন বাদশার আসনেও হবে একই নাটক। এ লেজে-গোবরে
অবস্থায় যদি আওয়ামী লীগের শরিকরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, তাহলে আমি অবাক হব না।
সেটা হবে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার আরেক সংকট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের নেতারা
ভালো করেই জানেন ভোটের বাজারে তারা মূল্যহীন। আওয়ামী লীগের প্রতীক এবং কর্মী-সমর্থকরাই
তাদের ভরসা। সেই ভরসাতেও অপমান, উপেক্ষা সহ্য করে তারা অনেকটাই চাকরবাকরের মতো জোটে
আছেন। কিন্তু এবার সত্যি তাদের একটা অপমানজনক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ
সভাপতি বড় উদারতা না দেখালে জোট নিয়ে এক অস্বস্তিতে পড়বে আওয়ামী লীগ। আলাদা আলাদা নির্বাচনের
যে কৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছে, তা তাকে বন্ধুহীন করতে পারে।
জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল, ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত। দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের আচরণ, কথাবার্তা সবই ছিল সন্দেহজনক। গত দুই বছর ধরেই তিনি কখনো বিএনপির চেয়ে বড় বিরোধী দল, কখনো সুশীলদের চেয়েও বড় বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতেন। এ কারণেই সরকার ‘রওশন এরশাদ’কে একান্ত আপনজন করে রাখত। নির্বাচনের তপসিল ঘোষণার পর জাতীয় পার্টি যখন নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কালক্ষেপণ করছিলেন, তখন রওশন এরশাদই ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে। রওশন এরশাদ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জি এম কাদেরকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেন। নির্বাচনমুখী নেতাদের সামলাতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এতে নিশ্চয়ই সরকার খুশি হয়েছে। জি এম কাদেরের সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়া এবং সমঝোতার কারণেই রওশন এরশাদ জাপায় মাইনাস হয়ে গেলেন বলে আমি মনে করি। কিন্তু জি এম কাদেরের প্রতি আওয়ামী লীগের আস্থা কি ঝুঁকিপূর্ণ নয়? জি এম কাদেরকে আস্থায় আনতে যেভাবে রওশন এরশাদকে টিস্যু পেপার বানানো হলো, তার ফল খারাপও হতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কী করেছিলেন, তা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ ভুলে যায়নি। ওই নির্বাচনে রওশন এরশাদই শেষ রক্ষা করেছিলেন। এবার জি এম কাদের যে এরশাদের পথে হাঁটবেন না, তা কে বলবে। সেরকম একটি পরিস্থিতি তৈরি হলে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনী মাঠে কে ধরে রাখবে? জাতীয় পার্টি নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল কি ঝুঁকিপূর্ণ হলো না?
এবার নির্বাচনের আগে দুটি ‘কিংস পার্টি’ বেশ সরব হয়েছিল। একটি তৃণমূল বিএনপি, অন্যটি বিএনএম। দুটি দলেরই প্রধান টার্গেট ছিল বিএনপি থেকে লোক ভাঙানো। দুটি দলই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো দলই ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। বিএনপি থেকেও বড় কোনো নেতা এসব দলে যোগ দেননি। এখন এই দুটি দল আওয়ামী লীগের দায়ে পরিণত হয়েছে। এরা ভোটে নয়, সমঝোতায় এমপি হতে চায়। সরকার তাদের ভোটে জিতিয়ে সংসদে আনবে এমন প্রত্যাশায় এরা নির্বাচনে এসেছে। এসব দলের যে সাংগঠনিক অবস্থা এবং প্রার্থীদের যোগ্যতা তাতে দুয়েকজন ছাড়া আর কেউ ভোটের মাঠে জামানত রাখতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ। এদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে সরকারকে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে, এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করাটা কতটা জরুরি। ছোটখাটো অনিয়মও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করবে। গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়বে। আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবে না। কাজেই এত বড় ঝুঁকি সরকার বা আওয়ামী লীগ কি নেবে? আবার ভালো নির্বাচনে এরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে, আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করবে।
আওয়ামী লীগ কেন শাহজাহান ওমরকে দলে ভেড়াল? এ থেকে আওয়ামী লীগ কী পেল? আদর্শহীন ব্যক্তিকে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে ক্ষমতাসীনরা কি প্রমাণ করল না, তারাও ভাঙাগড়ার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের এরকম প্রক্রিয়ার যুক্ত হওয়া কি শোভন। এই কৌশলে কি লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হলো না?
নির্বাচন প্রসঙ্গ এলেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসে। সব দল অংশগ্রহণ করার পরও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ওই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। এর প্রধান কারণ ছিল প্রার্থী এবং প্রশাসনের যোগসাজশ। অতি উৎসাহীদের দায়িত্বহীন কাণ্ড। এবার নির্বাচন অনেকটাই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ লড়াই। বিরোধীরা এ নির্বাচনে তৃতীয়পক্ষ। তাই এ নির্বাচনে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ থাকার বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাউকে জেতাতে বা হারানোর দায় নেই কারও। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র, যারা প্রার্থী তারা সবাই প্রভাবশালী। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে প্রার্থীরা নানাভাবে ঘনিষ্ঠ। ক্ষমতার শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা কি শেষ পর্যন্ত জনগণের মতামতের ওপর নির্ভর করবে, না জয়ী হতে সব অপকৌশল প্রয়োগ করবে?
আগামী কয়েকটা দিন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তপসিল ঘোষিত হয়েছে, মনোনয়নপত্র দাখিলও হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন এখনো অনেক দূরের পথ। এ পথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আছে, তা সামাল দিতে পারবে আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল কি পারবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ঠিকানায় দেশকে নিয়ে যেতে?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’
সৈয়দ ইবরাহিম চৌকস সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কোরআন এবং ইসলামী ব্যাখ্যায় তিনি অনবদ্য। মুসলিম যুদ্ধের কৌশল নিয়ে একটি চমৎকার গ্রন্থের লেখক এই মেধাবী মানুষটি। সহজ সরল সদালাপী। নির্বাচনে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আছে সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। কিন্তু তার নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি শরিকরা। নির্বাচনী এলাকায় তিনি এখন বিএনপি কর্তৃক অবাঞ্ছিত। ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সৈয়দ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। নুর বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা কোরবানির গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন।’ শুধু নুর নয়, একই রকম বক্তব্য রেখেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত শুক্রবার এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, ‘এ বয়সে এসে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হতে চাই না।’ সৈয়দ ইবরাহিম গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। বরং নিজের বুদ্ধি বিবেচনার দ্বারাই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমার ধারণা। কোরবানির হাটে নিজেকে বিক্রির অভিপ্রায় থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তৃণমূল বিএনপি, কিংবা বিএনএমে যোগ দিতেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যোগাযোগ করতেন। সৈয়দ ইবরাহিম তা করেননি। এটি তার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। তবে নির্বাচনের মাঠে এখন কেনাবেচার খেলা জমে উঠেছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেক নেতাই বলছেন, ‘আমি গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হব না।’ রাজনীতিতে এ কেনাবেচার ইতিহাস অনেক পুরোনো। নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন। নিজেদের আদর্শকে কোরবানি দিয়েছেন।
বিএনপির এখন পর্যন্ত অবস্থান নির্বাচনে না যাওয়ার। এখনো দলটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্তত কাগজে-কলমে। অবরোধের ঘোষণা দিয়ে চুপচাপ বসে নদীর ঢেউ গুনছেন নেতারা। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল ৩৪টি দল। এদের মধ্যে বেশ কিছু দল এখন নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সামনে আরও চমক অপেক্ষা করছে।’ বিএনপির এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, নির্বাচন বর্জনের পক্ষে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়ানো। এজন্য রাজনীতিতে কেনাবেচার খেলা চলছে। জাতীয় পার্টির একজন নেতা স্বীকার করেছেন, জাতীয় পার্টি যেন নির্বাচনে না যায় সেজন্য ‘বড় অফার’ দেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। কান পাতলে নানা কথা শোনা যায়। এখনো জাতীয় পার্টি নাকি নিলামে আছে। দর-কষাকষি এখনো চলছে। শেষ মুহূর্তে ভালো দর পেলে, ২০১৪ সালের মতো, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে দলটি, এমন গুঞ্জনও শোনা যায়। বিএনপির শরিকদের মোটা অঙ্কের উপঢৌকনের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা নির্বাচনে না যায়। আদর্শ বা নীতি নয়, টাকার লোভে নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তও এক ধরনের কেনাবেচা। গরু-ছাগলের মতো কোন কোন রাজনীতিবিদের কত দাম ওঠে তা জানার অপেক্ষায় আমরা। বিএনপির প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনে না যাওয়াদের পাল্লা ভারী করা। নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর বলে—‘এটা পাতানো খেলা। আবার নির্বাচন করতে হবে।’ সে আশায় রাজনীতির হাটে এখন লন্ডনি পাউন্ডের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। শুধু জোট নয়, ঘরেই অবিশ্বাস-সন্দেহের দোলাচলে বিএনপি। দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে তারা গোপন আঁতাত করছেন। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তারা ‘গরু-ছাগলের’ মতো বিক্রি হয়েছেন। এজন্য ঘর সামলাতে ব্যস্ত বিএনপি। এর আগে সিলেট সিটি নির্বাচনে দলের নেতাকে ধরে রাখতে ‘নজরানা’ দিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেতা। নির্বাচনে না দাঁড়ানোর বিনিময়ে তিনি কী কী পেয়েছেন, তা গোপনই রয়ে গেছে। তবে দলীয় পদ প্রাপ্তিও যে এক ধরনের উৎকোচ, তা নিশ্চয়ই জনগণ উপলব্ধি করে। এবার বিএনপি আরও মরিয়া। জনপ্রিয় এবং নির্বাচনে যেতে আগ্রহীদের তা থেকে দূরে রাখতে নানা টোপ দেওয়া হচ্ছে। পদ-পদবির সঙ্গে আছে নগদ প্রলোভন। আন্দোলন নয়, বিএনপিতে চলছে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’র রাজনীতি। আদর্শহীন রাজনীতিতে টাকা-পয়সা ও পদ-পদবির লোভই শেষ অস্ত্র।
এটা স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়া একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন চায়। এমন একটি নির্বাচন যেখানে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। দৃশ্যত নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা তো নির্বাচন উৎসবমুখর করতে পারবে না। এজন্যই বাজারে এসেছে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, ইসলামী জোট, যুক্তফ্রন্টসহ নানা জাতের-রঙের বাহারি রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টিসহ এসব নতুন রং করা পুরোনো গাড়ি নির্বাচনী মহাসড়কে চলাচল শুরু করতেই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। জনগণ ধীরে ধীরে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী হতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করেছিল, এখনকার পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নয়, বরং দেশ স্বাভাবিক। বিএনপি রাজনীতির মূলধারা থেকে প্রায় ছিটকে যাচ্ছে ক্রমাগত। নির্বাচনের মহাসড়কে এত গাড়ি নামাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ কসরত করেছে। বিনিয়োগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ছোট একটি গল্প বলতে চাই। এক ব্যবসায়ী তার ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন, একজন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে একটা কাজ বাগাতে হবে। ম্যানেজার ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। এসে মালিককে বললেন, ‘উনি (ঘুষ) খান না।’ ব্যবসায়ী হেসে বললেন, ‘কত খান না?’ পরে ব্যবসায়ী নিজেই ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দফারফা করলেন। এখন আমরা এমন এক আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বসবাস করি, যেখানে আদর্শ মূল্যহীন, নীতি অর্থহীন। সবকিছুই কেনাবেচা হয়। রাজনীতিতে কেনাবেচা এখন ‘হালাল’। তাই কে ‘নগদে’, কে ‘আশ্বাসে’ নির্বাচনে এলো; তার হিসাব খুঁজে লাভ নেই। নির্বাচনী মাঠ এখন কোরবানির গরু-ছাগলের হাট। তবে এখানে ক্ষমতাসীনরা একাই ক্রেতা নয়। বিরোধীরাও নিলামে শক্তিশালী পক্ষ। বাংলাদেশে কেনাবেচার রাজনীতি নতুন নয়। সৈয়দ ইবরাহিমই প্রথম রাজনীতিতে ‘ডিগবাজি’ দিয়েছেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ’৭৫-এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গরু-ছাগলের হাট প্রথা চালু হয়। সহজভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগলের মতো কেনাবেচার জনক জিয়াউর রহমান। তিনি সামরিক গোয়েন্দাদের দিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। বিভিন্ন লোককে বিএনপিতে যোগদানের জন্য নগদ অর্থ, ব্যবসা, টেন্ডার, ব্যাংক ঋণ দেওয়ার প্রথা চালু হয় জিয়ার হাত ধরেই। তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ, মশিউর রহমানকে (যাদু মিয়া) দলে ভেড়ান, তেমনি চৈনিক বাম, গলাকাটা পার্টির তরিকুল ইসলাম, মান্নান ভূঁইয়াদেরও কাছে টানেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কে এম ওবায়দুল রহমানের মতো নেতাদের বিএনপিতে নিয়ে জিয়া আওয়ামীবিরোধী ‘ককটেল’ সৃষ্টি করেন, যার নাম বিএনপি। জিয়া রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে সত্যিই ডিফিকাল্ট করেছিলেন। তার নেতৃত্বে রাজনীতিতে প্রবেশ করে কালো টাকার মালিক, মাস্তান, দুর্বৃত্তরা। তবে রাজনীতিতে গরু-ছাগলে হাটকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ কবি ছিলেন, তাই রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগল বানিয়েছিলেন তিনি কাব্যিক ঢঙে। বিকেলে জনসভায় এরশাদকে তুলোধোনা করেছিলেন ব্যারিস্টার কোরবান আলী। সন্ধ্যায় গোটা জাতি অবাক বিস্ময়ে দেখল স্বৈরাচারের মন্ত্রী হয়ে নিজেকে কোরবানি দিলেন মুজিব সৈনিক। কাজী জাফর আহমেদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কিংবা মিজান চৌধুরীর জাতীয় পার্টিতে যোগদান ছিল একেকটি প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার অনুপম কাব্য। তাদের ডিগবাজি এত বিস্ময়কর যে, অলিম্পিকে এরকম কোনো খেলা থাকলে অবলীলায় তারা স্বর্ণপদক পেতেন। রাজনীতিকে এরশাদ রীতিমতো গরু-ছাগলের হাট বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হাটেই এরশাদ নিঃস্ব রাখালে পরিণত হন ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে। এরশাদের পতনের পর গরু-ছাগলদের রশি আর রাখালের হাতে থাকেনি। যারা এরশাদের জন্য জান কোরবার করার প্রতিযোগিতা করতেন, তাদের প্রায় সবাই যোগ দেন বিএনপিতে। স্বৈরাচারের দোসররাই যখন এরশাদকে স্বৈরাচার বলে গালি দেয়, তখন লজ্জায় মুখ লুকানো ছাড়া উপায় কি? এখানেও কেনাবেচার রাজনীতি। এরশাদের চাটুকার গোষ্ঠীর ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বহুজনকে সস্তায় কিনে নেয় বিএনপি। ভাবখানা এমন বুড়ো গরুর দাম কম! স্বৈরাচারের উপ-রাষ্ট্রপতি ২০০১ সালে বিএনপির আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বিএনপির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডিগবাজির রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ বিরোধী দল ভাঙার জন্য, বিরোধী নেতাদের ভাগিয়ে আনার যে ‘অস্ত্র’ বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি আবিষ্কার করেছিল, আজ সেই অস্ত্রেই তারা ঘায়েল হচ্ছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনের জন্য এরশাদ আ স ম আবদুর রবকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করতে বিএনপি মৃতপ্রায় খুনিদের দল ‘ফ্রিডম পার্টি’কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। ক্ষমতায় থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনীতিতে যারা ‘গরু-ছাগলের হাট’-এর প্রবর্তন করেছিলেন, তারাই এখন কোরবানির হাটের পণ্য। ’৭৫-এর পর রাজনীতির যে কেনাবেচার অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, সেই অধ্যায় আজ ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব’ হয়ে উঠেছে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি তাতেই ক্ষতবিক্ষত। শুধু রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন না। রাজনীতিই এখন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। সবচেয়ে বড় বাণিজ্য।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
কল্যাণ পার্টি নির্বাচন আওয়ামী লীগ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
৩০ নভেম্বর ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষদিন। শেষদিনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমরের ‘নৌকা’ প্রতীকে নির্বাচন করার ঘোষণা। কারাগার থেকে বেরিয়েই এ বিএনপি নেতা যেভাবে ঝালকাঠিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন, তা বিস্ময়কর। শাহজাহান ওমরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত, রওশন এরশাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া, রেকর্ড পরিমাণ স্বতন্ত্র প্রার্থী, আওয়ামী লীগে চার শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেওয়া ইত্যাদি সবই ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী কৌশল। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি আগামী নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে চায়। ভোট উৎসব করতে চায়। সেজন্যই এতসব আয়োজন। বিএনপি এবং তার মিত্রদের বাদ দিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার রাজনৈতিক কৌশলে শেষ পর্যন্ত কি আওয়ামী লীগ সফল হবে? নাকি এ কৌশল তাদের জন্য হবে বুমেরাং? এ কৌশলে আওয়ামী লীগের লাভ হলো না ক্ষতি?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে গত ২৬ নভেম্বর। এবারের নির্বাচন বড়ই অদ্ভুত নির্বাচন। এই নির্বাচনে একটিই ফলাফল হতে পারে। সেটি হলো আওয়ামী লীগের বিজয়। বিএনপি এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম সহ যে সব রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তাদের একটাই লক্ষ্য, ‘বিরোধী দল’ হওয়া। তবে নির্বাচন টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জের। পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই চায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন।
প্রায় দু সপ্তাহ নীরব থাকার পর মাহমুদুর রহমান মান্না আবার সরব হয়েছেন। আবার রাস্তায় এসে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। কিন্তু গত দু সপ্তাহ তিনি কোথায় ছিলেন? বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে যে, এ সময় মান্না সরকারের সাথে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে দেন দরবার করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেন দরবারের রফা হয়নি। সেই কারণেই মান্না এখন আবার সরব হয়েছেন। আবার বিরোধী দলের লড়াকু সৈনিক হিসেবে মাঠে নেমেছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না যা চেয়েছিল তা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’
যেকোনো সংকট সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটও এক অসাধারণ সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। রাজনীতিকে আবর্জনামুক্ত এবং দূষণমুক্ত করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭৫ এর পর থেকে দূষিত, দূর্গন্ধময় হতে হতে এখন তাতে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তরুণরা। সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজনীতি হলো শর্টকাটে নির্বিঘ্নে লুটপাটের সহজ পথ। রাজনীতি এখন প্রধান ব্যবসা। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, দূর্বৃত্ত, অর্থপাচারকারীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে রাজনীতি। জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য সত্যিই তিনি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করেছেন। ভাড়াটেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে রীতিমতো দখল করেছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।