জাতি হিসেবে বাঙালি বিভক্ত। নানা জনের নানা মত। দুজন বাঙালি এক হলে ঝগড়া করে। কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি। কেউ বলে দেশ ভালো চলছে, কেউ বলে দেশের অবস্থা ভয়াবহ। এ রকম এক বিভক্ত জাতিকে ঐক্যের সুতোয় বাঁধে যে কটি উপলক্ষ তার মধ্যে ক্রিকেট একটি। ক্রিকেট আমাদের সব বিভেদের রেখা উপড়ে ফেলে। গোটা জাতিকে এক আত্মায় পরিণত করে। ক্রিকেট আমাদের হাসায়, কাঁদায়। যে মানুষটির খেলাধুলা নিয়ে তীব্র অনীহা, তিনিও বাংলাদেশের ক্রিকেট হলে উৎসাহী হন। একবারের জন্য হলেও টেলিভিশনে চোখ রাখেন কিংবা বেতারে কান পাতেন। বাংলাদেশ যে ক্রিকেটে এগিয়েছে তার অন্যতম কারণ এ দেশের দর্শক। বাংলাদেশ যখন টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা পেল তখন যেসব কারণ বাংলাদেশের পক্ষে দেখানো হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো দর্শক। দর্শক এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় এ দেশের ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়েছে। এ দেশের ক্রিকেট অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের জনগণ ক্রিকেটের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়েছে। রাস্তায় বেরিয়েছে আনন্দ মিছিল। আবার খারাপ খেললে কেঁদেছে। খেলোয়াড়দের সমালোচনা করেছে। দর্শকদের ভালোবাসাই আমাদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শক্তি, সেই ভালোবাসা আমাদের অন্যতম দুর্বলতাও বটে। খেলায় হার-জিত থাকবেই। একদিন দল ভালো করবে, আরেকদিন খারাপ করবে। ভালো খেললে যেমন প্রশংসা পাওয়া যায়, তেমন খারাপ খেললে গালিও শুনতে হয়। বাংলাদেশের মতো আবেগপ্রবণ দেশে দুটোর মাত্রাই সীমা অতিক্রম করে। একটি জয় সব সমালোচনা ধুয়ে দেয়। এভাবেই অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু এবার টি-২০ বিশ্বকাপ যেন সেই আদলে নয়। এখানে যেন বাংলাদেশের হারগুলো মনে হয়েছে অনাকাঙ্খিত। বাংলাদেশ দলকে মনে হয়েছে ছন্নছাড়া, বোর্ডকে মনে হয়েছে দায়িত্বহীন এবং কোচিং স্টাফদের অর্বাচীন লেগেছে। এর আগেও বাংলাদেশ বহুবার হেরেছে। বিশেষ করে টি-২০ ফরম্যাটে বাংলাদেশ কখনই খুব ভালো দল নয়। এর আগে টি-২০ বিশ্বকাপের মূল পর্বে বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র একটি ম্যাচ। কাজেই বাংলাদেশ সেমিফাইনালে খেলবে বলে যারা হাঁকডাক করেছিলেন তারা যে যুক্তিহীন অতিরঞ্জন করেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ফলাফল নিয়ে আমার তেমন কোনো বক্তব্যও নেই। কিন্তু খেলায় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের যে শরীরী ভাষা তা ছিল সম্পূর্ণ অখেলোয়াড়সুলভ। তারা খেলাটা উপভোগ করতে পারেননি। মনে হয়েছে দলে কোনো সমন্বয় নেই। একজন আরেকজনকে চেনেন না। কখনো কখনো মনে হয়েছে খেলা শেষ হলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। হাসি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ছেলেরা এবং ক্রিকেট বোর্ডই যেন পরস্পর প্রতিপক্ষ হিসেবে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। প্রথম রাউন্ডের প্রথম খেলায় বাংলাদেশ যখন স্কটল্যান্ডের সঙ্গে হারল তখনই বোর্ড সভাপতি হুঙ্কার দিলেন। ভাবখানা দেখে মনে হলো এবার বাগে পেয়েছি। ক্রিকেটারদের ধুয়ে দিলেন। মনে হলো স্কটল্যান্ডের কাছে হারার জন্যই তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। আবার ওমানের সঙ্গে জয়ের পর পাল্টা আক্রমণ করলেন অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ। একটি জাতীয় দলে এ ধরনের প্রকাশ্য গৃহদাহ নজিরবিহীন। আমাদের দেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে কিছু অযোগ্য, দায়িত্বহীন মানুষ বসে আছেন। শুধু বসে নেই, এরা যেন পাথরের মূর্তি। এদের সরানোর কোনো উপায় নেই। আমৃত্যু এরা একটা পদ আঁকড়ে থাকেন। তেমনি একজন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। কোন যোগ্যতায় তিনি বছরের পর বছর ক্রিকেট বোর্ড শাসন করছেন সে প্রশ্নের উত্তর আমি অন্তত খুঁজে পাই না। তবে নাজমুল হাসান পাপনের একটা অদ্ভুত গুণ আছে। বাংলাদেশ ভালো খেললে সব সাফল্য তিনি শুষে নেন। ভাবখানা এমন বাংলাদেশ জিতেছে তাঁর জন্যই। এটা হতেই পারে। বিসিবির সভাপতি হিসেবে ক্রিকেটের অভিভাবক তিনি। দল ভালো করলে সাফল্য তো তাঁর পকেটে ঢুকবেই। নাজমুল হাসান সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হন। প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন। ভারিক্কি ভঙ্গিতে চামচাদের স্তুতিতে গদগদ করেন। আবার বাংলাদেশ হেরে গেলে তিনি যেন হাঁস হয়ে যান। ব্যর্থতার এক চিমটি দায় নিতে রাজি নন। তখন তিনি খেলোয়াড়দের ওপর চড়াও হন। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় তিনি যেন পাড়ার ‘বড় ভাই’। ক্রিকেটের কিছুই বোঝেন না, কিন্তু মাতব্বরি করেন ষোল আনা। পাড়ার ছেলেরা হারলে বড় ভাই পোলাপানকে রিমান্ডে নেন। খিস্তি করেন। কাউকে কাউকে কান ধরে উঠবোস করান। বেশি খারাপ খেলে যারা তাদের ওপর এক ঘা বসিয়ে দেন। পাপনও তেমনি, বাংলাদেশ হারলেই খেলোয়াড়দের ওপর এমনভাবে চড়াও হন যেন ক্রিকেটাররা অপরাধী, আসামি। পাপনতন্ত্রের মূল কথা হলো ‘সাফল্য যা আমার, ব্যর্থতা ক্রিকেটারদের’। তাঁর কোনো জবাবদিহি নেই। তিনি সর্বেসর্বা। আবার আমার মাঝেমধ্যে পাপনকে বোর্ডের সভাপতি নয়, হেড কোচ মনে হয়। কোন খেলোয়াড় খেলবেন না খেলবেন এ সম্পর্কে গণমাধ্যমে অকপটে বলেন। কোন খেলোয়াড় ওপেনিং করবেন, কে বোলিং করবেন এ নিয়ে বিসিবি সভাপতির বক্তব্য প্রায়ই শালীনতার সীমা অতিক্রম করে। বিশ্বকাপেই দেখলাম এমন ঘটনা। প্রথম খেলায় বাংলাদেশের পরাজয়ের পর দ্বিতীয় খেলা ওমানের বিরুদ্ধে। ব্যাটিং অর্ডারে একেবারে ওলটপালট ঘটানো হলো। দেশের সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিককে নামানো হলো ৭ নম্বরে। কেন এটা হলো? খুঁজতে গিয়ে দেখলাম এখানেও নাকি বোর্ড সভাপতির ভূমিকা ছিল। আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পক্ষে কোনো অজুহাত দাঁড় করছি না। এবার তারা আসলেই খারাপ খেলেছেন। কিন্তু এ খারাপ খেলায় বোর্ডের কি কোনো দায় নেই? আবার খেলোয়াড়দের সমালোচনার জবাব দিতে হয় মাঠে। প্রেস কনফারেন্সে নয়। বিসিবি সভাপতি যেমন ক্রিকেটারদের সাইজ করার সুযোগ খোঁজেন, তেমনি এবার বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও যেন বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজতেই ব্যস্ত ছিলেন। ওমানের সঙ্গে জয়ের পর রিয়াদ সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। এমনকি মুশফিকের ‘আয়নাতত্ত্ব’ও এ দেশের ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেছে। বাংলাদেশ যেন বিশ্বকাপ খেলতে যায়নি, বোর্ড বনাম ক্রিকেটারদের লড়াই করতে গেছে।
আমি ক্রিকেটবোদ্ধা নই। একজন দর্শক মাত্র। দর্শক হিসেবে আমি বুঝি ক্রিকেট হলো মূলত মাইন্ড গেইম। এটা যতটা না শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক। এটা মনঃসংযোগের খেলা। মাঠের বাইরে বোর্ড আর ক্রিকেটারদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের ফল আমরা তো হাতেনাতেই দেখলাম। লিটন দাস যেভাবে একের পর এক ক্যাচ ফেলে দিলেন তাতে মনে হয়েছে তিনি বোধহয় বল দেখেননি, বিসিবির সভাপতিকে দেখছেন। তাই ভয়ে সরে গেছেন। রিয়াদ যেন কিছু একটা করে সভাপতিকে এক হাত দেখিয়ে দেওয়ার জন্যই মাঠে নেমেছিলেন। এজন্য সাকিব-মুস্তাফিজকে বাদ দিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজেই বল করতে শুরু করলেন। রিয়াদ ভালো খেলোয়াড় সন্দেহ নেই। কিন্তু তার কিছু কিছু আচরণ বালখিল্যের পর্যায়ে পড়ে। জিম্বাবুয়ে সফরের মাঝপথে অবসরের ঘোষণা দিয়ে রিয়াদ তার ওপর অবিচারের ঝাল মিটিয়েছিলেন। এটা কোনো ক্রীড়াবিদের কাজ হতে পারে না। প্রশ্ন হলো, এ রকম এক অবুঝ আবেগীর হাতে কেন দলের নেতৃত্ব তুলে দিল বোর্ড? বোর্ডের সভাপতি তাকে পছন্দ করেন না এটা বোঝাই যায়। সেই অপছন্দের ব্যক্তির হাতেই কীভাবে দলের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয়? ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা এবার সদলবলে গেলেন সংযুক্ত আরব আমিরাত। অথচ সাইফুদ্দিন আর সাকিব ইনজুরিতে পড়লে দেখা গেল ১৩ জনের বাংলাদেশ দল। বোর্ডের ‘বিচক্ষণতা’র এর চেয়ে আর কী উদাহরণ দেওয়া যায়।
এবার বিশ্বকাপে আমাদের দল, কোচিং স্টাফ ও বোর্ডের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ক্রিকেটের অন্তিমযাত্রা শুরু হলো। ক্রিকেটের বারোটা কি বাজতে চলেছে? কেনিয়ার কথা মনে আছে? আকরাম খানের সেই অনবদ্য ইনিংসের মাধ্যমে আমরা কেনিয়াকে হারিয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম। সেই কেনিয়ার ক্রিকেটের আজ করুণ অবস্থা। বলা হয়, কেনিয়ার ক্রিকেট এখন মৃত। এর কারণ কেনিয়ার ক্রিকেটে রাজনীতি, দলাদলি। নতুন খেলোয়াড় না আসা। একই অবস্থা জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের। আমার শঙ্কা, বাংলাদেশের ক্রিকেটও কি কেনিয়া, জিম্বাবুয়ের পথে হাঁটছে?
একটা সময় বাংলাদেশের ফুটবল নিয়েও মাতামাতি ছিল বাঁধনহারা। সালাউদ্দিন, অমলেশ, চুন্নু, টুটুল একেকজন তারকা। মালদ্বীপকে বাংলাদেশ হাসতে হাসতে ৭ গোলে হারাত। সেই বাংলাদেশের ফুটবল এখন মৃত। মাঠে দর্শক যায় না। মালদ্বীপও বাংলাদেশকে বলে-কয়ে হারায়। ফুটবল নিয়ে এখন তরুণদের আবেগ নেই। নতুন খেলোয়াড় আসছে না। ফুটবলে স্পন্সর নেই। অথচ একসময় বাংলাদেশে ফুটবলাররাই ছিলেন সবচেয়ে বড় তারকা। দর্শক মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার ফলে ফুটবলও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন বাংলাদেশে ক্রিকেটাররাই সবচেয়ে বড় তারকা। কয়েকদিন খেললেই হলো, ব্যস। বিজ্ঞাপনের মডেলের জন্য প্রস্তাব আসতে থাকে হু হু করে। কদিন আগে অফিসে খেলা দেখছিলাম। বাংলাদেশের টপটপ উইকেট পড়ছেন আর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে উপস্থিত হচ্ছেন তারকা ক্রিকেটাররা। মুশফিক-রিয়াদ ‘আকাশ’-এর মডেল। সাকিব তো বুস্ট থেকে এয়ারকুলার, চাটনি থেকে সেভেন আপ- সবকিছুতেই আছেন। একজন সহকর্মী বলে উঠলেন, এরা প্র্যাকটিস করে কখন? সারা দিন তো মডেলিং করেন। ক্রিকেটাররা জনপ্রিয়। তারা পণ্যের প্রসারে ব্যবহৃত হতেই পারেন। আয়-রোজগারও করতে পারেন। আপত্তি নেই। কিন্তু এটা করতে গিয়ে যদি খেলাটাই গুরুত্বহীন হয়ে যায় তাহলে তো পরিণতি ফুটবলের মতোই হবে। এবার বাংলাদেশের দর্শক প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছেন। অনেক দর্শক খেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের শেষ দুটি খেলায় (দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া) টিভি দর্শক কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এ দেশের মানুষ প্রচন্ড আবেগপ্রবণ। জাতি যা চায় তার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে। যা চায় না তা প্রতিরোধ করার জন্যও অবলীলায় প্রাণ উৎসর্গ করতে পারে। এ জাতি ভালোবাসলে সবকিছু উজাড় করে দেয়। আর একবার মুখ ঘোরালে ফিরেও তাকায় না। আমাদের ক্রিকেট থেকে দর্শক মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন এবারের বিশ্বকাপে। একবার যদি মানুষ ক্রিকেটবিমুখ হয় তাহলে তাকে ফেরানো অনেক কঠিন হবে। আর দর্শক যদি খেলা না দেখেন তাহলে এত স্পন্সর, টাকাকড়ি কিছুই থাকবে না। আমাদের ক্রিকেটের অন্দরমহলে এখন খেলার উত্তাপের চেয়ে টাকার উত্তাপ অনেক বেশি। বোর্ডের কর্তারা তাদের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে ব্যাংকে কত শত কোটি টাকা আছে তার ফিরিস্তি দেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড নাকি বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ড এমন দাবিও করেন বোর্ডের কর্তারা। অন্য খেলোয়াড়দের তুলনায় আমাদের ক্রিকেটাররাও অর্থনৈতিকভাবে বেশ মজবুত। ক্রিকেট বোর্ড কিংবা ক্রিকেটাররা ধনী হওয়া দোষের নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দর্শক আছে বলেই টাকা-পয়সার বাড়বাড়ন্ত আমাদের ক্রিকেটে। তাই দর্শক যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণই ক্রিকেটের সুদিন থাকবে। দর্শক না থাকলে ক্রিকেটের অবস্থাও ফুটবলের মতো হতে সময় নেবে না। আমাদের দর্শক ফুটবলের বিশ্বকাপ দেখে, রাত জেগে ইউরোপের বিভিন্ন খেলা দেখে, ভোর রাতে আধোঘুমে কোপা আমেরিকার খেলা দেখে। মেসি, রোনালদো, নেইমারদের চেনে না এমন একজনও খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই ফুটবল-পাগল দর্শক কেন বাংলাদেশের খেলা দেখে না? আমাদের ক্রিকেট বোর্ড, খেলোয়াড়দের এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে। এমন দিন যদি আসে এ দেশের দর্শক ভারত-পাকিস্তানের খেলা দেখছে, অ্যাসেজ দেখছে, বাংলাদেশের খেলা দেখছে না- তাহলে সেজন্য কাকে দায়ী করবেন? বাংলাদেশের দর্শক ভারত-পাকিস্তানের দর্শকের মতো উন্মাদ নয়। তারা বাংলাদেশ দলের সীমাবদ্ধতা জানে। বাংলাদেশ এর আগেও অনেক খারাপ খেলেছে। দর্শক মন খারাপ করেছে। আবার ঠিক হয়ে গেছে। এ মন খারাপ অনেকটা গরিবের গাড়ি কেনার স্বপ্নভঙ্গের মতো। কিন্তু এবার ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি জানি না, অন্যরা আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না, এবার দর্শক প্রতারিত হয়েছেন। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশে জিম্বাবুয়ে এলো, অস্ট্রেলিয়া এলো, নিউজিল্যান্ড এলো। বাংলাদেশ এমন পিচ বানাল সেখানে একমাত্র বাংলাদেশই জিততে পারে। ক্রিকেট-কর্তাদের জন্য এ ‘জয়’ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জয় দেখিয়ে বিসিবিতে পাপন-রাজত্ব নিরঙ্কুশ করা হলো। আর সাধারণ মানুষকে বোঝানো হলো এবার টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কিছু একটা করে দেখাবে। তখন যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাদের ক্রিকেটজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো। যে দেশের উদ্বোধনী জুটি নেই, ফিনিশার নেই, হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান নেই সে দেশ টি-২০তে সেমিফাইনালে যাবে? অথচ বোর্ডের নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করার জন্য এ রকম একটি প্রতারণা করা হলো জনগণের সঙ্গে। এর পরের ঘটনা তো সবাই জানেন।
ক্রিকেট বোর্ড করা হয় ক্রিকেটের কল্যাণের জন্য। কিন্তু আমাদের ক্রিকেট বোর্ড যেন পুনর্বাসন কেন্দ্র। এরা ক্রিকেটকে কিছু দিতে পারে না, বোর্ডের পরিচয় দিয়ে সমাজে পরিচিত হয়। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন সবচেয়ে অসুখী পরিবার। এখানে ছেলেরা ম্যাচে নামছে যেন দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। কোচরা যেন ভিনগ্রহের মানুষ। বাংলাদেশকে কখনো একটা ঐক্যবদ্ধ দল মনে হয়নি। বিশ্বকাপের লজ্জার পর বোর্ড যথারীতি তদন্ত করবে। রিয়াদ হয়তো ছাঁটাই হবেন। নানা রকম বাণী দেবেন বোর্ড সভাপতি। তারপর আসবে পাকিস্তান। আবার ‘বিশ্বমানের পিচ’ তৈরি করে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করা হবে। বলা হবে, আমাদের ক্রিকেট সঠিক পথে। এই যে আবার ফর্মে ফিরেছেন টাইগাররা। এ তো খেলা নয় যেন প্রতারণা। রাজনীতি যখন নষ্ট হয় তখন বলা হয় রাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিক্স’ ঢুকে গেছে। এখন ‘পলিটিক্স’ আরও বড় পরিসরে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার হয়। বলা হয় প্রশাসনে ‘পলিটিক্স’, সাহিত্যে ‘পলিটিক্স’, সব দিকে ‘পলিটিক্স’। সে রকম এখন ক্রিকেটেও যেন পলিটিক্স ঢুকে গেছে। রাজনীতিবিদ বোর্ড সভাপতি খেলা নিয়ে জনগণের সঙ্গে নির্মম প্রতারণা করছেন। ক্রিকেট আমাদের ভালোবাসা। ভালোবাসার সঙ্গে প্রতারণা করলে ঘৃণা, উপেক্ষা তৈরি হয়। ক্রিকেট নিয়ে এ ভয়ঙ্কর প্রতারণার খেলা বন্ধ না হলে আমাদের ক্রিকেটের বারোটা বাজতে সময় লাগবে না।
মন্তব্য করুন
‘ব্ল্যাক
অক্টোবর’ একটি সাড়া জাগানো
কানাডীয় প্রামাণ্যচিত্র। সিবিসি ২০০০ সালে এই
প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করে। ১৯৭০ সালে
ব্রিটিশ ট্রেড কমিশনার এবং একজন প্রাদেশিক
মন্ত্রীর অপহরণ নিয়ে নির্মিত এ
প্রামাণ্য চিত্রে কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর সাক্ষাৎকারও রয়েছে। ৭০-এ এই
অপহরণ ঘটনায় কানাডার রাজনীতি টালমাটাল হয়েছিল। কমিউনিস্ট শাসন অবসানের শেষপ্রান্তে
রাশিয়ার (সোভিয়েত ইউনিয়ন) ক্ষমতার টানাপোড়েন নিয়েও ‘ব্ল্যাক অক্টোবর’ শিরোনামে একটি আলোচিত প্রামাণ্যচিত্র
রয়েছে। ১৯৯৩ সালে নির্মিত
ওই প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায়, রাশিয়ার
প্রেসিডেন্ট বরিস ইলিয়েৎসিনের সঙ্গে
রুশ পার্লামেন্টের প্রকাশ্য বিরোধের ঘটনা। একপর্যায়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট
আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনী তলব
করেন। রুশ পার্লামেন্টের সব
সদস্যকে গ্রেপ্তার করেন। এক ডিক্রি জারি
করে পার্লামেন্ট (সুপ্রিম সোভিয়েত) ভেঙে দেন। প্রেসিডেন্ট
হিসেবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে রাশিয়া
সোভিয়েত প্রথা বিলোপ হয়। রাশিয়ার জন্য
১৯৯৩-এর অক্টোবর ছিল
এক দুর্যোগপূর্ণ সময়। এরকম বিশ্বের
দেশে দেশে অক্টোবর নিয়ে
এরকম নানা আতঙ্ক এবং
ভয়াল গল্প আছে। বাংলাদেশে
এবারের অক্টোবর কেমন হবে? তা
নিয়ে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ, শোরগোল
শুরু হয়েছে। বিএনপি বলছে, অক্টোবরেই সরকারের পতন হবে। বিএনপি
মহাসচিব বলেছেন, ‘আগামী কয়েকটা দিন বাংলাদেশের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ।’ অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘এই অক্টোবরেই আছি,
আগামী অক্টোবরেও থাকব।’ অক্টোবর নিয়ে এ পাল্টাপাল্টি
অবস্থানের পর প্রশ্ন উঠেছে—বাংলাদেশে কি আবার এক
অন্ধকারাচ্ছন্ন অক্টোবর আসছে? কী হবে এ
অক্টোবরে?
বাংলাদেশে
অক্টোবর মাসটা একটু অন্যরকম। আকাশে
সাদা মেঘের ভেলা। হালকা বাতাসে দোল খায় কাশবনের
শ্বেতশুভ্র ফুল। শারদীয় উৎসবের
এক মোহনীয় মাস অক্টোবর। কিন্তু
বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই এ অক্টোবর মাস
ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ২০০১
সালের বিভীষিকাময় অক্টোবরের কথা ভুলি কী
করে। ২০০১ সালের ১
অক্টোবর দেশে জাতীয় সংসদ
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ
তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে। এর আগে জুলাইয়ে
দেশে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার
হাতবদল হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের কাছে। লতিফুর রহমান দায়িত্ব নিয়েই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শপথ নেওয়ার ১০
মিনিটের মধ্যেই ১৩ জন সচিবকে
বদলি করে তিনি জাতিকে
হতবাক করে দেন। সাফ
বুঝিয়ে দেন আওয়ামী লীগকে
হারিয়ে দেওয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য।
তার চেয়ে আরেক কাঠি
সরস ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এমএ সাঈদ। আওয়ামী
লীগের প্রার্থীদের শায়েস্তা করাই যেন তার
কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের একমাত্র পূর্বশর্ত। অল্প সময়ের মধ্যেই
আওয়ামী লীগের জন্য নির্বাচন করা
প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। তবুও
আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে।
গণতন্ত্রের স্বার্থে। ১ অক্টোবরের নির্বাচনে
প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনী ছিল নির্লজ্জ পক্ষপাতপূর্ণ।
আওয়ামী লীগকে পিটিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে হটিয়ে দেওয়ার
নির্দেশনা নিপুণ দক্ষতায় পালন করেন তারা।
সন্ধ্যায় ফলাফল ঘোষণায় কোনো চমক ছিল
না। নিরঙ্কুশ বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায়
চারদলীয় জোট। বিএনপি-জামায়াতের
অতি-উৎসাহী কর্মীদের আর তর সয়নি।
সারা দেশে তারা শুরু
করে তাণ্ডব। সারা দেশে আওয়ামী
লীগের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে আক্রমণ শুরু হয়। বাড়িঘর
জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুটপাট শুরু
হয় নির্বিচারে। সারা দেশে মুহূর্তেই
শুরু হয় সন্ত্রাসের রাজত্ব।
সংখ্যালঘুরা আওয়ামী ভোটার। এ কারণে তাদেরও
নির্মূল করা শুরু হয়।
হত্যা, ধর্ষণের এক নারকীয় উৎসব
চলে টানা ১০ দিন।
বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন কয়েকশ
সাধারণ জনগণ। পূর্ণিমা, ফাহিমা, শেফালীর মতো শত শত
নারী ধর্ষিতা হন। সেই ভয়াল
অক্টোবরের স্মৃতি ভুলি কী করে?
সেই সময় দেশে কোনো
আইন ছিল না, বিচার
ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার
নিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা দাঁড়িয়ে শুধু তামাশা দেখেছে।
২০০১-এর অক্টোবরে মানবতার
বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার হয়নি আজও।
২০০৬
সালের অক্টোবরও ছিল বাংলাদেশের জন্য
আতঙ্কের। অগ্নিগর্ভ ওই অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা ছাড়ার
আগে শেষ তাণ্ডব চালায়।
২৯ অক্টোবর রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পল্টন, বিজয়নগর,
বায়তুল মোকাররম এলাকা। জামায়াত-শিবিরের হিংস্ররূপ জাতি সেদিন দেখে
ভয়ে শিউরে উঠেছে। অক্টোবর এলেই তাই অজানা
আতঙ্ক মনে বাসা বাঁধে।
এবার আতঙ্ক আরও বেশি। কান
পাতলেই ফিসফাস আওয়াজ শুনি। কী হচ্ছে, কী
হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৭ সেপ্টেম্বর
‘কিছু একটা ঘটার’ নাটকীয়
ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিএনপির প্রয়াত নেতা হান্নান শাহর
সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিএনপি
মহাসচিব বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এক ভয়াবহ অবস্থার
মধ্যে আছে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকবে কি না, গণতান্ত্রিক
অধিকার থাকবে কি না, জনগণ
তার প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে কি
না—সবকিছু নির্ভর করছে আগামী কয়েক
দিনের ওপর।’ মির্জা ফখরুলের এ বক্তব্য বিচ্ছিন্ন
কোনো কথা নয়। বিএনপি
ভালো করেই জানে অক্টোবরেই
বিএনপিকে কিছু করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল
ঘোষণা করবে। একবার তপশিল ঘোষণা হলে দেশের রাজনীতি
নির্বাচনমুখী হবে। তখন বিএনপি
আন্দোলন জমিয়ে তুলতে পারবে না। তা ছাড়া
বিএনপি যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে, সেই
দাবি একমাত্র সংসদের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অন্য
কোনোভাবেই নয়। বিএনপি নেতারাও
তা-ই বলছেন। তারা
দাবি করেছেন, ‘আওয়ামী লীগের যেহেতু দুই-তৃতীয়াংশের বেশি
সংসদ সদস্য আছে, কাজেই তাদেরই
সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপন করতে হবে। তীব্র
গণআন্দোলনে তারা এটা করতে
বাধ্য হবে।’ বিএনপির দাবি হলো, ২০১১
সালের আগে সংবিধানে ‘নির্বাচনকালীন
সরকারে’র যে ব্যবস্থা
ছিল, তা ফিরিয়ে আনতে
হবে। সেটি সংসদ ছাড়া
অসম্ভব। এই অক্টোবরে সংসদের
শেষ অধিবেশন বসবে। তাই বিএনপি এবং
তার মিত্রদের আন্দোলন এমন একটা জায়গায়
নিয়ে যেতে হবে, যেখান
থেকে সরকার বিএনপির দাবি মানতে বাধ্য
হয়। এ কয়েক দিনের
মধ্যে যদি তারা ‘গণবিস্ফোরণ’
ঘটাতে না পারে, তাহলে
তাদের জন্য আরেকটি বড়
বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এ কথা ঠিক,
সম্প্রতি বিএনপির কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়ছে। তাদের হতাশা কিছুটা হলেও কেটেছে। এক
ধরনের চাঙ্গাভাব লক্ষ করা যায়
কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু বিএনপির আন্দোলনের মূল সমস্যা অন্য
জায়গায়। বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে জনগণ এখনো সম্পৃক্ত
নয়। জনগণ এখন আর
আগের মতো নেই। রাজনৈতিক
দল ডাকল আর জনগণ
রাস্তায় নামল—সেই দিন
এখন শুধুই স্মৃতি। জনগণ সংবাদপত্র পড়ে,
টেলিভিশনে টকশো শোনে, সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে ‘বিস্ফোরক সব ব্রেকিং নিউজ’
এবং ‘অবিশ্রান্ত ধারার মিথ্যাচার’ উপভোগ করে। তারপর আকাশের
ঠিকানায় গালি দিয়ে, বাতি
নিভিয়ে ঘুমুতে যায়। আন্দোলনে জনগণ
সম্পৃক্ত হয় না, এ
আক্ষেপ মির্জা ফখরুলেরও। তিনি ইদানীং বারবার
বলছেন, জনগণকে রাস্তায় নামতে হবে। জনগণ যদি
রাস্তায় বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম না হয়, তাহলে
আর যাই হোক, গণআন্দোলন
হবে না। যেমনটি হয়েছিল
৯০ ও ৯৬ সালে।
বিএনপির সময় দ্রুত ফুরিয়ে
আসছে। এখন ১৭ বছর
ক্ষমতায় বাইরে থাকা দলটি কী
করবে? জ্বালাও পোড়াও, ভাঙচুরের পথে হাঁটবে? হরতাল,
অবরোধ, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি দিয়ে
দেশ অচল করে দেবে,
এই অক্টোবরে?
যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশ নিয়ে বেশ মনোযোগী।
প্রায় প্রতিদিন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে ম্যাথিউ মিলার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছেন।
ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসও কম
যান কীসে? প্রতিদিনই শুনি এই অক্টোবরে
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর আরও চাপ
দেবে। অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরবে। সরকার
নাকি মার্কিন চাপে পদত্যাগে বাধ্য
হবে। এমন বক্তব্য আজকাল
প্রকাশ্যেই দিচ্ছেন মার্কিনপ্রেমী সুশীলরা। দেখা যাক অক্টোবরে
মার্কিন চাপ কতটুকু তীব্র
হয়। বিএনপির অনেক নেতাই বিশ্বাস
করেন, তাদের কিছুই করতে হবে না।
অক্টোবরেই যুক্তরাষ্ট্র এ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত
করবে। আগে বিএনপির নেতারা
এসব কথা আড়ালে-আবডালে
বলতেন। এখন বলেন প্রকাশ্যে।
শুধু নেতা নয়, বিএনপির
পাতিনেতা, এমনকি কর্মীরাও এখন পকেটে ভিসা
স্যাংশনের তালিকা নিয়ে ঘোরে। কে
কে স্যাংশন পাবে তারা হিসাব
করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। বিএনপির অনেকেই বিশ্বাস করে, অক্টোবরেই যুক্তরাষ্ট্র
টর্নেডোর মতো বাংলাদেশে আঘাত
হানবে। তাতে সরকার তছনছ
হয়ে যাবে। অক্টোবর মাসটা সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জিং। সরকার দেশকে কি একটি নির্বাচনের
দিকে নিয়ে যেতে পারবে
কি না, তা বোঝা
যাবে এ মাসেই। ৪
অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরবেন। অক্টোবর
জুড়ে আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়ন
উৎসব করবে। বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে সমান্তরালভাবে কর্মসূচি পালন করবে। এ
কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে
মোকাবিলা করতে চাইবে। দেশকে
নির্বাচনমুখী করাটাই অক্টোবরে আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, অক্টোবরে কিছুই হবে না। কোনো
ষড়যন্ত্রই সফল হবে না।
আওয়ামী লীগ কি পারবে
দেশ-বিদেশের চাপ সামাল দিতে?
২০১৪
বা ২০১৮ সালের মতো
নয়, সত্যিকারের একটা অবাধ, সুষ্ঠু
নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপায় সরকারকে বের
করতে হবে এ অক্টোবরেই।
যে নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য
হবে। আমার বিবেচনায় রাজনৈতিক
কারণে নয়, অর্থনৈতিক সংকটে
সরকারের জন্য অক্টোবর মাস
হতে পারে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও
চ্যালেঞ্জিং। প্রতিদিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। ২০ বিলিয়ন ডলারের
আশপাশে এখন রিজার্ভ। ডলার
সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
খোলা বাজারে ডলারের জন্য রীতিমতো হাহাকার।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বহু
আগেই। মানুষ হাঁসফাঁস করছে। মানুষের সীমাহীন কষ্ট আর আর্তনাদ
নিয়ে রীতিমতো তামাশা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ব্যাংকগুলোতে চলছে নৈরাজ্য। অর্থ
পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য কমেনি। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে
কোনো সুখবর নেই। তার চেয়েও
উদ্বেগের বিষয় হলো, সংকট
উত্তরণে কোনো দৃশ্যমান চেষ্টাও
নেই। বরং তথ্য ধামাচাপা
দিয়ে এক ধরনের আত্মতৃপ্তির
ভয়াবহ প্রবণতা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বাভাবিক সূত্র হলো, অর্থনীতি ঠিক
না থাকলে রাজনীতি পথ হারাতে বাধ্য।
অর্থনীতির চাপে আওয়ামী লীগ
সরকার অক্টোবরে কি পথ হারাবে?
রাজনীতি
গণিতের কোনো সূত্র নয়।
রাজনীতির অঙ্কের সব হিসাব সবসময়
মেলে না। অক্টোবরে কী
হবে, তা হয়তো সামনের
কয়টা দিনই বলে দেবে।
তবে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন, গণতন্ত্রের পথরেখা পরিষ্কার হবে এ অক্টোবরেই।
দেখার বিষয় কেমন হয়
অক্টোবর। শারদীয় শ্বেতশুভ্রতার উৎসবের অক্টোবর, নাকি সন্ত্রাস এবং
সহিংসতার উত্তাপে বাংলাদেশ দগ্ধ হবে এই
অক্টোবরে?
লেখক:
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল :
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
একজন
বিদেশীর সাথে কথা হচ্ছিল
কদিন আগে। ঢাকার এক্সপ্রেসওয়েতে
গাড়ী চালিয়ে তিনি মুগ্ধতার কথা
বলেছিলেন। কুড়ি বছর আগে
একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন এই উন্নয়নকর্মী। কুড়ি
বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া দৃশ্যপট
দেখে তিনি উল্লাসিত, আপ্লুত।
একটি দেশ কিভাবে এতো
কম সময়ে এভাবে উন্নতি
করতে পারে? প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তর
দিলেন। দুটি কারণ, এদেশের
জনগণের অদম্য প্রাণশক্তি আর অসাধারন নেতৃত্ব।
একজন যোগ্য এবং সঠিক নেতা
যে জনগণের শক্তিতে কোথায় নিয়ে যেতে পারেন,
তার প্রমাণ বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনা।
একটানা কথা গুলো বলে
থামলেন ভদ্রলোক। একটু দম নিয়ে,
আবার কথা শুরু করলেন।
আচমকা আমাকে প্রশ্ন করলেন শেখ হাসিনার পর
কে? নিজেই উত্তর দিলেন ‘আই ডোন্ট সি
এনি ওয়ান’ (আমি কাউকে দেখিনা)। তার এই
প্রশ্ন আমাকে কিছুটা হলেও ভাবনার সাগরে
নিয়ে গেল। শেখ হাসিনা
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ৭৭
তম জন্মদিন পালন করলেন। শুধু
বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের
বিবেচনায় তিনি অন্যতম প্রবীন
রাজনীতিবিদ। এধরনের বয়সে অনেকে অবসর
জীবন যাপন করেন। নাতি-নাতনী নিয়ে চুটিয়ে সময়
কাটান। কারো কাটে নানা
রোগ শোকের সঙ্গে যুদ্ধ করে। কিন্তু শেখ
হাসিনা তার আশ্চর্য ব্যতিক্রম।
এই বয়সেও তিনি প্রচন্ড ব্যস্ত।
কর্মচাঞ্চলে ভরপুর এক উজ্জীবিত মানুষ।
এখনও আমাদের চেয়ে তিনি বেশি
কাজ করেন। নিজ যোগ্যতা, দক্ষতায়
এবং মেধায় তিনি নিজেকে অনন্য
উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রনায়ক
থেকে হয়েছেন বিশ্বনেতা। দলে এবং দেশে
তার কোন বিকল্প নেই।
শেখ হাসিনার বিকল্প একমাত্র শেখ হাসিনাই।
বিএনপির
নেতৃত্বে বিরোধী দল গুলো এখন
এক দফা আন্দোলন করছে।
এক দফার মূল দাবী
হলো ‘শেখ হাসিনার অধীনে
কোন নির্বাচন নয়।‘ বিএনপি নেতারা
ইদানিং সারাক্ষণ শেখ হাসিনার সমালোচনায়
মুখর থাকেন। সব আক্রমনের কেন্দ্রবিন্দুতেই
তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা বিদেশে বসে
বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারের দোকান খুলে বসে নিয়মিত
দূর্গন্ধযুক্ত কদর্য নর্দমার মতো বমি উগলাচ্ছেন,
তাদেরও প্রধান লক্ষ্য বস্তু এখন ‘শেখ হাসিনা’। শেখ হাসিনাকে
সরানোই তাদের জীবনের যেন একমাত্র আরাধ্য।
কিন্তু শেখ হাসিনাকে সরিয়ে
কাকে আনতে চান তারা?
নির্বাচিত না অনির্বাচিত সরকার
প্রধান? ধরা যাক, বিএনপির
কথাই ঠিক। তারা দেশে
একটি শান্তিপূর্ণ, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তারা এটাও
বিশ্বাস করে, ‘নিরপেক্ষ এবং অবাধ’ নির্বাচন
হলে, বিএনপি জিতবেই জিতবে। খুব ভালো কথা।
বিএনপি যদি নির্বাচনে বিপুলভাবে
জয়ী হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী
কে হবেন? আমি না, বিভিন্ন
দেশের রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিকরাও বিএনপি
নেতাদের হরহামেশাই এই প্রশ্ন করেন।
এর জবাবে বিএনপি মহাসচিব এবং অন্যান্য নেতারা
যে জবাব দেন, তা
রীতিমতো কৌতুক। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল
ইসলাম আলমগীর, কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারেও
এর উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি
ক্ষমতায় এলে বেগম জিয়াই
প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার অবর্তমানে তারেক
জিয়া হবেন সরকার প্রধান।‘
কি সাংঘাতিক কথা। বেগম জিয়া
দুটি মামলায় সাজা পেয়েছেন। একটি
মামলায় হাইকোর্টে তার সাজা বহাল
আছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী
হওয়া তো দুরের কথা,
সংসদ সদস্য হতে পারবেন না।
তাকে বিএনপি মহাসচিব কিভাবে প্রধানমন্ত্রী বানাবেন বুঝলাম না। একই বাস্তবতা
লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার বেলাতেও। এমনকি আইন ও সংবিধান
পাল্টালেও আগামী সরকার প্রধান হওয়া তাদের পক্ষে
সম্ভব না। মির্জা ফখরুল
এসব জানেন না, এমনটি নয়।
জেনে শুনেই এই অসত্য উচ্চারণ
তিনি করছেন। কারণ জনগণকে, বিশেষ
করে দলীয় নেতা কর্মীদের
উজ্জীবিত রাখা। কর্মীরা যেন হতাশ না
হয়ে যান, এজন্যই এধরনের
বক্তব্য। কারণ, বিএনপি মহাসচিব ভালো করেই জানেন,
শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে তিনি (মির্জা ফখরুল) জনগণের কাছে তো নয়ই,
তার নিজের দলেও কাছেও গ্রহণযোগ্য
নন। বেগম জিয়ার দন্ডের
কথা যদি বাদও দেই,
তারপর তিনি কি শেখ
হাসিনার বিকল্প? বিএনপি নেতারাই বলছেন, বেগম জিয়া গুরুতর
অসুস্থ। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
তাহলে কোনটা সত্য? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক কঠিন
দায়িত্ব। শেখ হাসিনা যেভাবে
দিনরাত একাকার করে এই দায়িত্ব
পালন করছেন। বেগম জিয়া কি
অসুস্থ শরীরে তার সিকি পরিমান
দায়িত্ব পালন করতে পারবেন?
বেগম জিয়া তাই কোন
ভাবেই শেখ হাসিনার বিকল্প
নন।
তারেক
জিয়াকে নিয়ে যে আবেগ,
উত্তাপ, তা শুধু বিএনপির
তরুণ কর্মীদের মধ্যে। সাধারণ মানুষ তারেক জিয়াকে রাজনীতিবীদ বলে মনে করে
না। একজন দূর্নীতিবাজ, দূর্বৃত্ত
মনে করে। তারেক জিয়া
যদি কোনদিন দূর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে দেশের
কি হাল হবে তা
সহজেই অনুমান করা যায়। ২০০১
থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত
সময়ে ছায়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে
তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, দূর্নীতি কাকে বলে, কত
প্রকার কি কি। সেই
সময়ে হাওয়া ভবনের লুণ্ঠন কাহিনী আরব্য রজনীকেও হার মানায়। কাজেই
তারেক জিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প ভাবা এক ধরনের
গর্হিত অপরাধ।
বিএনপি
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাধায়ক সরকার চায়। বিএনপির অনেক
নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবে তা
পরের বিষয়, আগে একজন তত্ত্বাধায়ক
সরকার প্রধানের কথা ভাবুন। চোখ
বন্ধ করে দেখুন তো
শেখ হাসিনার কোন বিকল্প খুঁজে
পান কি না? গত
১৫ বছরে শেখ হাসিনা
নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায়
নিয়ে গেছেন। একাই দেশ সামলাচ্ছেন।
আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার তিনি। সব কিছুর দিকে
তার দৃষ্টি। এদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন তিনি তিল তিল
করে। সব কিছু উপেক্ষা
করে। এই মুহুর্তে দেশে
তার কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশকে তিনি যে সম্ভাবনার
সোনালী বন্দরে নিয়ে গেছেন যেখান
থেকে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি
কি এই মুহুর্তে বাংলাদেশে
কেউ আছেন? গত ১৫ বছর
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক
ভালো কাজ যেমন আছে,
তেমনি এই সরকারের আছে
অনেক দূর্বলতা এবং সমালোচনাও। গত
৩/৪ বছরে এই
সমালোচনার ক্ষেত্রগুলো বেড়েছে। অর্থপাচার, খেলাপী ঋণ, দূর্নীতি সংক্রামক
ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পরেছে
সমাজের সর্বত্র। কিছু মন্ত্রী অযোগ্যতা
এবং ব্যর্থতায় মানুষ অসন্তুষ্ট হতাশ। সর্বত্র আমলাতন্ত্রে দৌরাত্মে মানুষ অস্থির। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষ আর সহ্য করতে
পারছে না। এতো কিছুর
পরও মানুষ যে আশা হারায়নি।
এর একটি কারণ হলো
শেখ হাসিনা। দেশের মানুষ তার উপর আস্থাশীল।
জনগণ শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস
করে। নিশ্চয়ই তিনি সংকট উত্তরণে
সাহসী পদক্ষেপ নেবেন, এমনটা মনে করেন দেশের
বেশির ভাগ মানুষ। দেশের
সিংহভাগ জনগণের কাছে শেখ হাসিনার
কোন বিকল্প নেই।
আওয়ামী
লীগ সরকারকে নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো
বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
অস্বস্তি এখন কোন নতুন
বিষয় নয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র,
সুশাসন, মানবাধিকার ইস্যুতে তাদের রয়েছে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু
একটি বিষয়ে এসে তারা আটকে
যায়। শেখ হাসিনার বিকল্প
কে? শেখ হাসিনাকে বাদ
দিলে কে হাল ধরবে
এই দেশের। শেখ হাসিনা বিহীন
বাংলাদেশ কি আরেকটি আফগানিস্তান
হবে না? আমার তো
মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে
যদি শেখ হাসিনার বিকল্প
কেউ থাকতো, তাহলে তারা এতোদিনে পাকিস্তানের
মতো কোন ঘটনা ঘটিয়ে
ফেলতো। তাই, দেশ পরিচালনা
শেখ হাসিনা অবিসংবিদিত নেতা। শেখ হাসিনার পর
কে? এই প্রশ্নের উত্তর
নেই কারো কাছে।
রাষ্ট্রে
সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বিকল্প
যেমন কেউ নেই, তেমনি
আওয়ামী লীগেও শেখ হাসিনার বাইরে
কোন নেতা নেই। আওয়ামী
লীগ আরো বেশী শেখ
হাসিনা নির্ভর। কিংবা বলা যায় পুরোপুরি
শেখ হাসিনা নির্ভর। আমার তো মনে
হয় শেখ হাসিনা ছাড়া
আওয়ামী লীগ বিভ্রান্ত, মুমুর্ষ
এবং প্রায় বিকলাঙ্গ। আওয়ামী লীগের কর্মীরা একমাত্র শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস
করেন, অন্য নেতাদের উপর
তাদের আস্থা নেই। অন্যান্য নেতারা,
প্রেসিডিয়াম সদস্য বলি আর কেন্দ্রীয়
নেতৃত্ব বলি, নিজেরা গৎবাঁধা
বক্তৃতা দেয়া ছাড়া আর
কোন কাজ করতে পারেন
না। একটি সিদ্ধান্তের জন্য
তারা তাকিয়ে থাকেন শেখ হাসিনার দিকে।
রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারনের যোগ্যতাও
নেই বেশির ভাগ নেতার। শেখ
হাসিনা যেন আওয়ামী লীগকে
এক সূত্রে গেঁথে রেখেছেন। তিনি না থাকলে
এই দলটি ৭৫ এর
পরবর্তী অবস্থায় মতো অবস্থায় চলে
যাবে। ইদানিং প্রায় আওয়ামী লীগের মধ্যে শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার
নিয়ে আলোচনা শুনি। শেখ হাসিনার পর
দলের হাল কে ধরবেন,
তা এখনই ঠিক করা
উচিত এমন মত অনেকের।
শেখ হাসিনা ৭৭ বছরে পা
রাখলেন। আগামী কাউন্সিলে
হয়তো তিনি দলের দায়িত্ব
ছাড়ার ঘোষণা দেবেন, এমন শংকা অনেকের।
তখন কে হাল ধরবেন
আওয়ামী লীগের? শেখ রেহানা, সজীব
ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ
পুতুল নাকি রিদওয়ান মুজিব
সিদ্দিকী ববি? কে ভালো
হবে, এ নিয়ে প্রায়ই
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আড্ডায় নানা আলোচনা হয়।
শেখ হাসিনা কেন আওয়ামী লীগের
পরবর্তী নেতা এখনই নির্ধারণ
করছেন না, এনিয়ে কারো
কারো উৎকণ্ঠা কানে আসে। এই
সব প্রশ্নের উত্তর দুভাবে দেয়া যায়। প্রথমত,
বয়স প্রসঙ্গ। শেখ হাসিনা এখন
৭৭। এই বয়সে তিনি
যে পরিশ্রম করেন, তা কজন তরুণ-যুবক করতে পারেন?
এই নভেম্বরে জো বাইডেন ৮১
বছর পূর্ণ করবেন। দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থাৎ ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট
নির্বাচন করার ঘোষণা মার্কিন
প্রেসিডেন্ট দিয়েছেন। কোথায় তার অবসরের কথা
তো কেউ বলেন না।
৮২ বছর বয়সেও মন
মোহন সিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী
ছিলেন। তার ক্লান্তি কিংবা
বার্ধক্য নিয়ে তো কোন
প্রশ্ন তোলা হয়নি। কিছু
কিছু মানুষের জীবন হয় কর্মমুখরতায়
ভরপুর। আমৃত্যু তিনি কাজ করে
যান। শেখ হাসিনা তেমনি
একজন। তার রাজনীতি থেকে
কিংবা সরকার প্রধানের পদ থেকে তার
অবসরের ভাবনা অবান্তর। এ সিদ্ধান্তটা একান্তই
শেখ হাসিনার। তার প্রতিটি মুহুর্ত
জনগণের কল্যাণে নিবেদিত। তাই এখনই তার
অবসরের চিন্তাটা না করাই শ্রেয়।
এবার
আসা যাক আওয়ামী লীগের
উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক
রাজনৈতিক দল। এই দলটির
নেতৃত্ব কর্মীদের অভিপ্রায় থেকে উৎসারিত। আওয়ামী
লীগ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক
ইতিহাসে উত্তরাধিকারের রাজনীতি করেনি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা
ভাসানী থেকে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে
এসেছেন নিজ যোগ্যতায়। কর্মীদের
উপর নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়নি। শেখ
হাসিনাও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসেছেন দলের অস্তীত্বের প্রয়োজনে।
দল বাঁচানোর আর কোন বিকল্প
ছিলো না জন্যই শেখ
হাসিনাকে দলের সভাপতি করা
হয়েছিল। একথা ঠিক, জাতির
পিতার কন্যা জন্যই তিনি কর্মীদের ভালোবাসা
পেয়েছেন। দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে
পেরেছেন। কিন্তু গত ৪৩ বছরে
আওয়ামী লীগকে তিনি আজকের জায়গায়
নিয়ে এসেছেন নিজ যোগ্যতায়, পরিশ্রম
এবং প্রচন্ড ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে। যতো দিন তিনি
কর্মক্ষম আছেন, ততোদিন আওয়ামী লীগে তার বিকল্প
কেউ হবে না। শেখ
হাসিনার পর আওয়ামী লীগের
নেতৃত্ব আসবে কর্মীদের স্বত:ফূর্ত আকাঙ্খা থেকে। কর্মীরাই পছন্দ করবেন, কে হবে আওয়ামী
লীগের নেতা। উপর থেকে চাপিয়ে
দেয়া নেতৃত্ব যে গ্রহণযোগ্য হয়না,
ভারতের কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী তার সবচেয়ে বড়
প্রমাণ। তাই শেখ হাসিনার
পর কে? এই প্রশ্নটা
এখন বড্ড অসময়ের প্রশ্ন।
এই রাষ্ট্র এবং জনগণকে শেখ
হাসিনার এখনও অনেক কিছুই
দেয়ার বাকী আছে।
সৈয়দ
বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
সচিবালয় প্রশাসন নির্বাচন ভিসা নিষেধাজ্ঞা জনপ্রতিনিধি সরকার
মন্তব্য করুন
৭৭ বছরেও আপনি
ক্লান্তিহীন। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরা। এখনও আপনার উদ্যম, উদ্দীপনা, দিনরাত কাজ করে
যাওয়া-সবাইকে অবাক করে, বিস্মিত করে। কান পাতলেই শুনি, লোকজন বলে, ‘একজন মানুষ কিভাবে
এতা পরিশ্রম করতে পারে।’ কিভাবে সম্ভব একজন মানুষের পক্ষে এভাবে
অবিরাম ছুটে চলা? আমি জানি স্বপ্ন আপনাকে ঘুমুতে দেয় না। স্বপ্ন পূরণের তাগিদেই আপনি
কাজ করে যান সারাক্ষণ। আপনার স্বপ্ন, সোনার বাংলা গড়া। জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের
স্বপ্ন দেখেছিলেন। ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত, স্বনির্ভর এক সাম্যের বাংলাদেশ। যে দেশে কেউ
না খেয়ে থাকবে না, কেউ থাকবে না ঘরহীন। এমন একটি স্বপ্নপূরণ অভিযাত্রা আপনার জন্য সহজ
ছিলো না। নানা প্রতিকূলতা জয় করেই আজ আপনি বাংলাদেশকে এনেছেন এই জায়গায়। ঘরে বাইরে
আপনাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে কুৎসা, মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার। বার বার
আপনার জীবননাশের হুমকি এসেছে। ৭৫ এর পর থেকে যে লড়াই শুরু হয়েছে, সেই লড়াইটা এখনও চলছে।
লড়াই করতে করতে আপনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে আপনিই এখন বাংলাদেশ। ‘বাংলাদেশ’মুখ
থুবড়ে পরবে আপনাকে ছাড়া। বাংলাদেশ অস্তীত্বের সংকটে পরবে আপনার দিক নির্দেশন ব্যতিরেকে।
আপনাকে ছাড়া বাংলাদেশ পথ হারাবে।
৭৫ এ সুদূর
জার্মানীতে বসে আপনি শুনেছেন, আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। এ প্রবল শোকের স্রোতের
উল্টো পথে সাঁতরিয়ে আপনি আজ অমরত্বের দ্বারপ্রান্তে। ১৯৮১ তে আপনি যখন দেশে ফেরেন,
তখন আপনার শত্রুরা ছিলো ভয়ংকর। ক্ষমতাবান। আপনার জীবন ছিলো হুমকির মুখে। কিন্তু ৭৫
এর ১৫ আগস্ট আপনার ‘মৃত্যু ভয়’এর মৃত্যু ঘটিয়েছে। নিজের জীবনটাই সবচেয়ে
তুচ্ছ আপনার কাছে। ১৯৮১ তে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর একের পর এক যুদ্ধ করতে হয়েছে আপনাকে।
কখনো ঘরে, কখনো বাইরে। সামরিক স্বৈরশাসকের ভ্রু কুটি, ষড়যন্ত্র আপনি নির্ভয়ে মোকাবেলা
করেছেন। দলের ভেতর ষড়যন্ত্রকারীরা ছিলো ওত পেতে। তারা আপনাকে ‘একান্ত অনুগত’করতে
চেয়েছিল। আপনাকে বিভ্রান্ত করেছিল। কিন্তু এইসব ছদ্মবেশী প্রতিপক্ষরা কিংবা খুনী মোশতাকের
অপচ্ছায়ারা আপনাকে পরাস্ত করতে পারেনি। ৮২ থেকে টানা নয় বছর আপনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম
করেছেন। মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। আপনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারের
পতন ঘটে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথে আবার যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ।
কিন্তু আবার ষড়যন্ত্র ঘরে-বাইরে। ৯১ এর নির্বাচনে আপনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়
আসতে পারেনি। অদ্ভুত রহস্যের এক নির্বাচন আপনার দল আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেও
সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। সে সময় আপনার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল অনেকে।
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ‘এক চাচা’যাকে জাতির পিতা রাজনীতিতে এনেছিলেন।
তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে ‘গণফোরাম’নামে এক নতুন দোকান খোলেন। কিন্তু আপনি
হতাশ হননি। পথ হারাননি। লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে এগিয়ে
নিয়ে গেছেন। ৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর পর আপনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে
আওয়ামী লীগ। শুরু হয় উন্নয়নের অভিযাত্রা। আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতানার ধারায় হাটতে থাকে
বাংলাদেশ। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি করে আপনি প্রমাণ করেন আপনার
দক্ষতা, মেধা এবং যোগ্যতা। পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে এক মানবিক বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার
রূপকল্প গ্রহণ করেন আপনি। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি বাড়ি একটি
খামার, আশ্রয়নের মতো বেশ কিছু অনবদ্য উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করেন আপনি। কিন্তু বাংলাদেশের
এই এগিয়ে চলা অনেকে চায়নি। ৭১ এবং ৭৫ এর শত্রুরা এক হয়। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। ২০০১
এর ১ অক্টোবরের নির্বাচন ছিলো সেই ষড়যন্ত্রের বাস্তব রূপায়ন। আবার শুরু হয় অন্ধকার
যাত্রা। এক দিকে হাওয়া ভবনের লুণ্ঠন অন্যদিকে জঙ্গীবাদের উত্থান। একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের
দিকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু আপনি লড়াকু যোদ্ধা। বীর। অমিত সাহসী এক মানুষ আপনি
লড়াই অব্যাহত রাখেন। চক্রান্ত হয় নতুন করে। আসে এক-এগারো। এবার আপনাকে রাজনীতি থেকে
মাইনাস করার খেলা শুরু হয়। দলের ভেতর হেভীওয়েট নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতায় আপনি অবাক হননি।
বিচলিতও হননি। কারণ আপনি জানেন, সত্যের জয় অনিবার্য। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আপনি একক
নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তারপর গত ১০ বছর বাংলাদেশের ইতিহাস গৌরবের। মর্যাদা পুন:উদ্ধারের।
বিশ্বকে চমকে দেয়ার। আধুনিক বাংলাদেশের আপনিই নির্মাতা। কিন্তু এখনও ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি।
শকুন এবং হায়নারা আবার মাঠে নেমেছে। নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র চলছে। এখন ষড়যন্ত্রের ব্যাপ্তি
দেশ ছেড়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পরেছে। কিন্তু আমি জানি আপনি জয়ী হবেন। এই যুদ্ধে আপনার জয়ের
বিকল্প নেই। আপনি অপরাজিতা প্রিয় আপা। জন্মদিনের শুভ কামনা।
সৈয়দ বোরহান
কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ বিএনপি
মন্তব্য করুন
একজন বিদেশীর সাথে কথা হচ্ছিল কদিন আগে। ঢাকার এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ী চালিয়ে তিনি মুগ্ধতার কথা বলেছিলেন। কুড়ি বছর আগে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন এই উন্নয়নকর্মী। কুড়ি বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া দৃশ্যপট দেখে তিনি উল্লাসিত, আপ্লুত। একটি দেশ কিভাবে এতো কম সময়ে এভাবে উন্নতি করতে পারে? প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তর দিলেন।
বুধবার সচিবালয়।। একজন গুরুত্বপূর্ণ সচিবের কাছে গেলেন একজন জনপ্রতিনিধি। সংসদ সদস্য তার নির্বাচনী এলাকার একটি কাজ সংক্রান্ত ফাইল সচিবের টেবিলে আটকে আছে বলে জানালেন এবং দ্রুত ফাইলটা নিষ্পত্তি করার জন্য অনুরোধ জানালেন। সচিব তার পূর্ব পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠও বটে। কিন্তু এবার তিনি ভিন্ন অবয়বে দেখা দিলেন। সচিব জনপ্রতিনিধিকে বললেন, ‘ফাইল তার নিয়মেই যাবে। এটার জন্য আমাকে তদবির করে লাভ নেই। এখন অনেক ঝামেলায় আছি। দেশে কি হচ্ছে আমরা বুঝি না। এ ধরনের তদবির এখন আর গ্রহণ করতে পারছি না। দুঃখিত।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাস সময় রয়েছে। নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা আশাবাদী। তারা বলছেন, নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা করা হবে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। আর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বড় ধরনের চমক দেবে। কি সেই চমক তা নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে।