জাতি হিসেবে বাঙালি বিভক্ত। নানা জনের নানা মত। দুজন বাঙালি এক হলে ঝগড়া করে। কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি। কেউ বলে দেশ ভালো চলছে, কেউ বলে দেশের অবস্থা ভয়াবহ। এ রকম এক বিভক্ত জাতিকে ঐক্যের সুতোয় বাঁধে যে কটি উপলক্ষ তার মধ্যে ক্রিকেট একটি। ক্রিকেট আমাদের সব বিভেদের রেখা উপড়ে ফেলে। গোটা জাতিকে এক আত্মায় পরিণত করে। ক্রিকেট আমাদের হাসায়, কাঁদায়। যে মানুষটির খেলাধুলা নিয়ে তীব্র অনীহা, তিনিও বাংলাদেশের ক্রিকেট হলে উৎসাহী হন। একবারের জন্য হলেও টেলিভিশনে চোখ রাখেন কিংবা বেতারে কান পাতেন। বাংলাদেশ যে ক্রিকেটে এগিয়েছে তার অন্যতম কারণ এ দেশের দর্শক। বাংলাদেশ যখন টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা পেল তখন যেসব কারণ বাংলাদেশের পক্ষে দেখানো হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো দর্শক। দর্শক এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় এ দেশের ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়েছে। এ দেশের ক্রিকেট অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের জনগণ ক্রিকেটের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়েছে। রাস্তায় বেরিয়েছে আনন্দ মিছিল। আবার খারাপ খেললে কেঁদেছে। খেলোয়াড়দের সমালোচনা করেছে। দর্শকদের ভালোবাসাই আমাদের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় শক্তি, সেই ভালোবাসা আমাদের অন্যতম দুর্বলতাও বটে। খেলায় হার-জিত থাকবেই। একদিন দল ভালো করবে, আরেকদিন খারাপ করবে। ভালো খেললে যেমন প্রশংসা পাওয়া যায়, তেমন খারাপ খেললে গালিও শুনতে হয়। বাংলাদেশের মতো আবেগপ্রবণ দেশে দুটোর মাত্রাই সীমা অতিক্রম করে। একটি জয় সব সমালোচনা ধুয়ে দেয়। এভাবেই অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু এবার টি-২০ বিশ্বকাপ যেন সেই আদলে নয়। এখানে যেন বাংলাদেশের হারগুলো মনে হয়েছে অনাকাঙ্খিত। বাংলাদেশ দলকে মনে হয়েছে ছন্নছাড়া, বোর্ডকে মনে হয়েছে দায়িত্বহীন এবং কোচিং স্টাফদের অর্বাচীন লেগেছে। এর আগেও বাংলাদেশ বহুবার হেরেছে। বিশেষ করে টি-২০ ফরম্যাটে বাংলাদেশ কখনই খুব ভালো দল নয়। এর আগে টি-২০ বিশ্বকাপের মূল পর্বে বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র একটি ম্যাচ। কাজেই বাংলাদেশ সেমিফাইনালে খেলবে বলে যারা হাঁকডাক করেছিলেন তারা যে যুক্তিহীন অতিরঞ্জন করেছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ফলাফল নিয়ে আমার তেমন কোনো বক্তব্যও নেই। কিন্তু খেলায় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের যে শরীরী ভাষা তা ছিল সম্পূর্ণ অখেলোয়াড়সুলভ। তারা খেলাটা উপভোগ করতে পারেননি। মনে হয়েছে দলে কোনো সমন্বয় নেই। একজন আরেকজনকে চেনেন না। কখনো কখনো মনে হয়েছে খেলা শেষ হলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। হাসি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ছেলেরা এবং ক্রিকেট বোর্ডই যেন পরস্পর প্রতিপক্ষ হিসেবে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। প্রথম রাউন্ডের প্রথম খেলায় বাংলাদেশ যখন স্কটল্যান্ডের সঙ্গে হারল তখনই বোর্ড সভাপতি হুঙ্কার দিলেন। ভাবখানা দেখে মনে হলো এবার বাগে পেয়েছি। ক্রিকেটারদের ধুয়ে দিলেন। মনে হলো স্কটল্যান্ডের কাছে হারার জন্যই তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। আবার ওমানের সঙ্গে জয়ের পর পাল্টা আক্রমণ করলেন অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ। একটি জাতীয় দলে এ ধরনের প্রকাশ্য গৃহদাহ নজিরবিহীন। আমাদের দেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে কিছু অযোগ্য, দায়িত্বহীন মানুষ বসে আছেন। শুধু বসে নেই, এরা যেন পাথরের মূর্তি। এদের সরানোর কোনো উপায় নেই। আমৃত্যু এরা একটা পদ আঁকড়ে থাকেন। তেমনি একজন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। কোন যোগ্যতায় তিনি বছরের পর বছর ক্রিকেট বোর্ড শাসন করছেন সে প্রশ্নের উত্তর আমি অন্তত খুঁজে পাই না। তবে নাজমুল হাসান পাপনের একটা অদ্ভুত গুণ আছে। বাংলাদেশ ভালো খেললে সব সাফল্য তিনি শুষে নেন। ভাবখানা এমন বাংলাদেশ জিতেছে তাঁর জন্যই। এটা হতেই পারে। বিসিবির সভাপতি হিসেবে ক্রিকেটের অভিভাবক তিনি। দল ভালো করলে সাফল্য তো তাঁর পকেটে ঢুকবেই। নাজমুল হাসান সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হন। প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন। ভারিক্কি ভঙ্গিতে চামচাদের স্তুতিতে গদগদ করেন। আবার বাংলাদেশ হেরে গেলে তিনি যেন হাঁস হয়ে যান। ব্যর্থতার এক চিমটি দায় নিতে রাজি নন। তখন তিনি খেলোয়াড়দের ওপর চড়াও হন। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় তিনি যেন পাড়ার ‘বড় ভাই’। ক্রিকেটের কিছুই বোঝেন না, কিন্তু মাতব্বরি করেন ষোল আনা। পাড়ার ছেলেরা হারলে বড় ভাই পোলাপানকে রিমান্ডে নেন। খিস্তি করেন। কাউকে কাউকে কান ধরে উঠবোস করান। বেশি খারাপ খেলে যারা তাদের ওপর এক ঘা বসিয়ে দেন। পাপনও তেমনি, বাংলাদেশ হারলেই খেলোয়াড়দের ওপর এমনভাবে চড়াও হন যেন ক্রিকেটাররা অপরাধী, আসামি। পাপনতন্ত্রের মূল কথা হলো ‘সাফল্য যা আমার, ব্যর্থতা ক্রিকেটারদের’। তাঁর কোনো জবাবদিহি নেই। তিনি সর্বেসর্বা। আবার আমার মাঝেমধ্যে পাপনকে বোর্ডের সভাপতি নয়, হেড কোচ মনে হয়। কোন খেলোয়াড় খেলবেন না খেলবেন এ সম্পর্কে গণমাধ্যমে অকপটে বলেন। কোন খেলোয়াড় ওপেনিং করবেন, কে বোলিং করবেন এ নিয়ে বিসিবি সভাপতির বক্তব্য প্রায়ই শালীনতার সীমা অতিক্রম করে। বিশ্বকাপেই দেখলাম এমন ঘটনা। প্রথম খেলায় বাংলাদেশের পরাজয়ের পর দ্বিতীয় খেলা ওমানের বিরুদ্ধে। ব্যাটিং অর্ডারে একেবারে ওলটপালট ঘটানো হলো। দেশের সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিককে নামানো হলো ৭ নম্বরে। কেন এটা হলো? খুঁজতে গিয়ে দেখলাম এখানেও নাকি বোর্ড সভাপতির ভূমিকা ছিল। আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পক্ষে কোনো অজুহাত দাঁড় করছি না। এবার তারা আসলেই খারাপ খেলেছেন। কিন্তু এ খারাপ খেলায় বোর্ডের কি কোনো দায় নেই? আবার খেলোয়াড়দের সমালোচনার জবাব দিতে হয় মাঠে। প্রেস কনফারেন্সে নয়। বিসিবি সভাপতি যেমন ক্রিকেটারদের সাইজ করার সুযোগ খোঁজেন, তেমনি এবার বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও যেন বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজতেই ব্যস্ত ছিলেন। ওমানের সঙ্গে জয়ের পর রিয়াদ সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। এমনকি মুশফিকের ‘আয়নাতত্ত্ব’ও এ দেশের ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেছে। বাংলাদেশ যেন বিশ্বকাপ খেলতে যায়নি, বোর্ড বনাম ক্রিকেটারদের লড়াই করতে গেছে।
আমি ক্রিকেটবোদ্ধা নই। একজন দর্শক মাত্র। দর্শক হিসেবে আমি বুঝি ক্রিকেট হলো মূলত মাইন্ড গেইম। এটা যতটা না শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক। এটা মনঃসংযোগের খেলা। মাঠের বাইরে বোর্ড আর ক্রিকেটারদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের ফল আমরা তো হাতেনাতেই দেখলাম। লিটন দাস যেভাবে একের পর এক ক্যাচ ফেলে দিলেন তাতে মনে হয়েছে তিনি বোধহয় বল দেখেননি, বিসিবির সভাপতিকে দেখছেন। তাই ভয়ে সরে গেছেন। রিয়াদ যেন কিছু একটা করে সভাপতিকে এক হাত দেখিয়ে দেওয়ার জন্যই মাঠে নেমেছিলেন। এজন্য সাকিব-মুস্তাফিজকে বাদ দিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজেই বল করতে শুরু করলেন। রিয়াদ ভালো খেলোয়াড় সন্দেহ নেই। কিন্তু তার কিছু কিছু আচরণ বালখিল্যের পর্যায়ে পড়ে। জিম্বাবুয়ে সফরের মাঝপথে অবসরের ঘোষণা দিয়ে রিয়াদ তার ওপর অবিচারের ঝাল মিটিয়েছিলেন। এটা কোনো ক্রীড়াবিদের কাজ হতে পারে না। প্রশ্ন হলো, এ রকম এক অবুঝ আবেগীর হাতে কেন দলের নেতৃত্ব তুলে দিল বোর্ড? বোর্ডের সভাপতি তাকে পছন্দ করেন না এটা বোঝাই যায়। সেই অপছন্দের ব্যক্তির হাতেই কীভাবে দলের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয়? ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা এবার সদলবলে গেলেন সংযুক্ত আরব আমিরাত। অথচ সাইফুদ্দিন আর সাকিব ইনজুরিতে পড়লে দেখা গেল ১৩ জনের বাংলাদেশ দল। বোর্ডের ‘বিচক্ষণতা’র এর চেয়ে আর কী উদাহরণ দেওয়া যায়।
এবার বিশ্বকাপে আমাদের দল, কোচিং স্টাফ ও বোর্ডের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ক্রিকেটের অন্তিমযাত্রা শুরু হলো। ক্রিকেটের বারোটা কি বাজতে চলেছে? কেনিয়ার কথা মনে আছে? আকরাম খানের সেই অনবদ্য ইনিংসের মাধ্যমে আমরা কেনিয়াকে হারিয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম। সেই কেনিয়ার ক্রিকেটের আজ করুণ অবস্থা। বলা হয়, কেনিয়ার ক্রিকেট এখন মৃত। এর কারণ কেনিয়ার ক্রিকেটে রাজনীতি, দলাদলি। নতুন খেলোয়াড় না আসা। একই অবস্থা জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের। আমার শঙ্কা, বাংলাদেশের ক্রিকেটও কি কেনিয়া, জিম্বাবুয়ের পথে হাঁটছে?
একটা সময় বাংলাদেশের ফুটবল নিয়েও মাতামাতি ছিল বাঁধনহারা। সালাউদ্দিন, অমলেশ, চুন্নু, টুটুল একেকজন তারকা। মালদ্বীপকে বাংলাদেশ হাসতে হাসতে ৭ গোলে হারাত। সেই বাংলাদেশের ফুটবল এখন মৃত। মাঠে দর্শক যায় না। মালদ্বীপও বাংলাদেশকে বলে-কয়ে হারায়। ফুটবল নিয়ে এখন তরুণদের আবেগ নেই। নতুন খেলোয়াড় আসছে না। ফুটবলে স্পন্সর নেই। অথচ একসময় বাংলাদেশে ফুটবলাররাই ছিলেন সবচেয়ে বড় তারকা। দর্শক মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার ফলে ফুটবলও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন বাংলাদেশে ক্রিকেটাররাই সবচেয়ে বড় তারকা। কয়েকদিন খেললেই হলো, ব্যস। বিজ্ঞাপনের মডেলের জন্য প্রস্তাব আসতে থাকে হু হু করে। কদিন আগে অফিসে খেলা দেখছিলাম। বাংলাদেশের টপটপ উইকেট পড়ছেন আর সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে উপস্থিত হচ্ছেন তারকা ক্রিকেটাররা। মুশফিক-রিয়াদ ‘আকাশ’-এর মডেল। সাকিব তো বুস্ট থেকে এয়ারকুলার, চাটনি থেকে সেভেন আপ- সবকিছুতেই আছেন। একজন সহকর্মী বলে উঠলেন, এরা প্র্যাকটিস করে কখন? সারা দিন তো মডেলিং করেন। ক্রিকেটাররা জনপ্রিয়। তারা পণ্যের প্রসারে ব্যবহৃত হতেই পারেন। আয়-রোজগারও করতে পারেন। আপত্তি নেই। কিন্তু এটা করতে গিয়ে যদি খেলাটাই গুরুত্বহীন হয়ে যায় তাহলে তো পরিণতি ফুটবলের মতোই হবে। এবার বাংলাদেশের দর্শক প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছেন। অনেক দর্শক খেলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের শেষ দুটি খেলায় (দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া) টিভি দর্শক কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
এ দেশের মানুষ প্রচন্ড আবেগপ্রবণ। জাতি যা চায় তার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে। যা চায় না তা প্রতিরোধ করার জন্যও অবলীলায় প্রাণ উৎসর্গ করতে পারে। এ জাতি ভালোবাসলে সবকিছু উজাড় করে দেয়। আর একবার মুখ ঘোরালে ফিরেও তাকায় না। আমাদের ক্রিকেট থেকে দর্শক মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন এবারের বিশ্বকাপে। একবার যদি মানুষ ক্রিকেটবিমুখ হয় তাহলে তাকে ফেরানো অনেক কঠিন হবে। আর দর্শক যদি খেলা না দেখেন তাহলে এত স্পন্সর, টাকাকড়ি কিছুই থাকবে না। আমাদের ক্রিকেটের অন্দরমহলে এখন খেলার উত্তাপের চেয়ে টাকার উত্তাপ অনেক বেশি। বোর্ডের কর্তারা তাদের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে ব্যাংকে কত শত কোটি টাকা আছে তার ফিরিস্তি দেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড নাকি বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রিকেট বোর্ড এমন দাবিও করেন বোর্ডের কর্তারা। অন্য খেলোয়াড়দের তুলনায় আমাদের ক্রিকেটাররাও অর্থনৈতিকভাবে বেশ মজবুত। ক্রিকেট বোর্ড কিংবা ক্রিকেটাররা ধনী হওয়া দোষের নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দর্শক আছে বলেই টাকা-পয়সার বাড়বাড়ন্ত আমাদের ক্রিকেটে। তাই দর্শক যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণই ক্রিকেটের সুদিন থাকবে। দর্শক না থাকলে ক্রিকেটের অবস্থাও ফুটবলের মতো হতে সময় নেবে না। আমাদের দর্শক ফুটবলের বিশ্বকাপ দেখে, রাত জেগে ইউরোপের বিভিন্ন খেলা দেখে, ভোর রাতে আধোঘুমে কোপা আমেরিকার খেলা দেখে। মেসি, রোনালদো, নেইমারদের চেনে না এমন একজনও খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই ফুটবল-পাগল দর্শক কেন বাংলাদেশের খেলা দেখে না? আমাদের ক্রিকেট বোর্ড, খেলোয়াড়দের এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে। এমন দিন যদি আসে এ দেশের দর্শক ভারত-পাকিস্তানের খেলা দেখছে, অ্যাসেজ দেখছে, বাংলাদেশের খেলা দেখছে না- তাহলে সেজন্য কাকে দায়ী করবেন? বাংলাদেশের দর্শক ভারত-পাকিস্তানের দর্শকের মতো উন্মাদ নয়। তারা বাংলাদেশ দলের সীমাবদ্ধতা জানে। বাংলাদেশ এর আগেও অনেক খারাপ খেলেছে। দর্শক মন খারাপ করেছে। আবার ঠিক হয়ে গেছে। এ মন খারাপ অনেকটা গরিবের গাড়ি কেনার স্বপ্নভঙ্গের মতো। কিন্তু এবার ব্যাপারটা তেমন নয়। আমি জানি না, অন্যরা আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না, এবার দর্শক প্রতারিত হয়েছেন। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশে জিম্বাবুয়ে এলো, অস্ট্রেলিয়া এলো, নিউজিল্যান্ড এলো। বাংলাদেশ এমন পিচ বানাল সেখানে একমাত্র বাংলাদেশই জিততে পারে। ক্রিকেট-কর্তাদের জন্য এ ‘জয়’ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জয় দেখিয়ে বিসিবিতে পাপন-রাজত্ব নিরঙ্কুশ করা হলো। আর সাধারণ মানুষকে বোঝানো হলো এবার টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কিছু একটা করে দেখাবে। তখন যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাদের ক্রিকেটজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো। যে দেশের উদ্বোধনী জুটি নেই, ফিনিশার নেই, হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান নেই সে দেশ টি-২০তে সেমিফাইনালে যাবে? অথচ বোর্ডের নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করার জন্য এ রকম একটি প্রতারণা করা হলো জনগণের সঙ্গে। এর পরের ঘটনা তো সবাই জানেন।
ক্রিকেট বোর্ড করা হয় ক্রিকেটের কল্যাণের জন্য। কিন্তু আমাদের ক্রিকেট বোর্ড যেন পুনর্বাসন কেন্দ্র। এরা ক্রিকেটকে কিছু দিতে পারে না, বোর্ডের পরিচয় দিয়ে সমাজে পরিচিত হয়। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন সবচেয়ে অসুখী পরিবার। এখানে ছেলেরা ম্যাচে নামছে যেন দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। কোচরা যেন ভিনগ্রহের মানুষ। বাংলাদেশকে কখনো একটা ঐক্যবদ্ধ দল মনে হয়নি। বিশ্বকাপের লজ্জার পর বোর্ড যথারীতি তদন্ত করবে। রিয়াদ হয়তো ছাঁটাই হবেন। নানা রকম বাণী দেবেন বোর্ড সভাপতি। তারপর আসবে পাকিস্তান। আবার ‘বিশ্বমানের পিচ’ তৈরি করে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করা হবে। বলা হবে, আমাদের ক্রিকেট সঠিক পথে। এই যে আবার ফর্মে ফিরেছেন টাইগাররা। এ তো খেলা নয় যেন প্রতারণা। রাজনীতি যখন নষ্ট হয় তখন বলা হয় রাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিক্স’ ঢুকে গেছে। এখন ‘পলিটিক্স’ আরও বড় পরিসরে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার হয়। বলা হয় প্রশাসনে ‘পলিটিক্স’, সাহিত্যে ‘পলিটিক্স’, সব দিকে ‘পলিটিক্স’। সে রকম এখন ক্রিকেটেও যেন পলিটিক্স ঢুকে গেছে। রাজনীতিবিদ বোর্ড সভাপতি খেলা নিয়ে জনগণের সঙ্গে নির্মম প্রতারণা করছেন। ক্রিকেট আমাদের ভালোবাসা। ভালোবাসার সঙ্গে প্রতারণা করলে ঘৃণা, উপেক্ষা তৈরি হয়। ক্রিকেট নিয়ে এ ভয়ঙ্কর প্রতারণার খেলা বন্ধ না হলে আমাদের ক্রিকেটের বারোটা বাজতে সময় লাগবে না।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশ টেলিভিশন আমার পরিচয়। আমি মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে। ১৯৯৬ সালে এই টেলিভিশনে আমি নিউজ রিপোর্টিং শুরু করি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠান চালু হয়। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনধর্মী এই অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবার দুই গুগ পরেও এখনও মানুষ ঐ অনুষ্ঠানকে মনে রেখেছে। আমার সাংবাদিকতা জীবনে পূর্ণতার নাম ‘পরিপ্রেক্ষিত’। পরিপ্রেক্ষিত আমাকে তারকা খ্যাতি দিয়েছে। একারণেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছে আমি সব সময় ঋণী। বিটিভি আমার আবেগের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা, আমার সত্তার অংশ। সেই বিটিভি যখন পুড়ছিল তখন আমি আবেগ সামাল দিতে পারিনি। ৭১ এর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী, রাজাকারাও বিটিভিতে আগুন দেয়নি। প্রায় ২৫ ঘণ্টা বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ ছিলো। এখনও রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি পৈশাচিকতার চিহ্ন বহন করে আছে। শুধু বিটিভি কেন? গত বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাংলাদেশ জুড়ে টার্গেট নাশকতা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে লুট হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। মেট্রোরেল আমাদের গর্বের পরিবহণ ব্যবস্থা। অল্প সময়ের মধ্যে এই গণ পরিবহনটি আমাদের সবার প্রিয় বাহনে পরিণত হয়েছে। এবার হায়নাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলো মেট্রোরেল। তিন দফায় হামলা হয়েছে মেট্রোরেলের উপর। মেট্রোরেলের উপর কোন সাধারণ নাগরিক হামলা করতে পারে, আমি বিশ্বাস করি না। একমাত্র যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা যাদের জন অসহ্য তারাই এমন ন্যাক্কারজনক কাণ্ড করতে পারে। কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ সেতু ভবনে, দুর্যোগ ভবনে কিংবা অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় এভাবে হামলা করতে পারে না। গত বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোন আন্দোলন না, শ্রেফ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই আন্দোলন কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে কোনো ছাত্র আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন। উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নব্য রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির নতুন প্রজন্ম এই অপকর্ম করেছে। ৭১ এর স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিতরা তাদের প্রতিশোধ গ্রহণের মিশনে নেমেছিলো। এজন্যই তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করেছে। বাংলাদেশ এরকম ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন, কোভিড হাসপাতালের মতো জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়নি। যেসব স্থাপনা স্বৈরাচার বা তার দোসরদের নিয়ন্ত্রিত কেবল সেই সব প্রতিষ্ঠানের উপর হামরা চালানো হয়েছিল। কর্নেল মালেক, ব্যারিস্টার হাসনাত, আদেলের মতো স্বৈরাচারের দোসরদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছিল ৯০ এর আন্দোলনে। এটি ছিলো সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনেও ভাঙ্গচুর, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ঐসব কোন ঘটনার সঙ্গেই গত ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের তাণ্ডবের তুলনা করা যায় না। এই দুই দিন হয়েছে রীতিমতো গুপ্ত হামলা, পরিকল্পিত নাশকতা এবং উন্নয়নের চিহ্ন মুছে ফেলার বীভৎস জিঘাংসা। এটি ছিলো ৭১ এর পরাজিত শক্তির প্রতিহিংসার প্রকাশ।
কোটা আন্দোলন নিয়ে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল তা ছিলো যৌক্তিক এবং শান্তিপূর্ণ। শুরুতেই সরকার এই আন্দোলনকে সমঝোতার পথে নিয়ে যেতে পারতো। সরকারের একটি মহলের অতিরিক্ত অহংকার, কোন কিছুকে পাত্তা না দেয়ার মানসিকতার কারণে এই আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে সব কোটা বিলোপ করে। দ্রুত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ঐ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সরকারের ঐ সিদ্ধান্ত ছিলো সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু তারপরও শিক্ষার্থীরা ঐ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। গত ৬ বছর কোটা ছাড়াই সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এনিয়ে কোন আপত্তি ওঠেনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরা পরিপত্র বাতিল এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনঃবহাল চেয়ে রিট পিটিশন দাখিল করে। আইন মন্ত্রণালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের তখনই উচিত ছিলো এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। এই রিটের বিরুদ্ধে শক্ত আইনি লড়াই করা। কিন্তু এনিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ছিলো নির্লিপ্ত। কোটা নিয়ে সরকারি পরিপত্রটি যখন হাইকোর্ট বাতিল করে দেয় তখন শিক্ষার্থীরা নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। এসময়ও ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হয় আইন মন্ত্রণালয়। বিষয়টি যখন আপিল বিভাগে আসে তখন সঙ্গত কারণেই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেনি। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের ভিত্তিতে লিভ টু আপিল করার নির্দেশনা দেয় আপিল বিভাগ। এসময় যদি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করতো, তাহলে হাইকোর্টের রায় স্থিতাবস্থায় নেয়ার জন্য আপিল বিভাগকে অনুরোধ জানাতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। আপিল বিভাগ যখন হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে তখন আন্দোলন গতি পায়। এসময় শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করায় একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ খুব দরকার ছিলো। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভরপুর আওয়ামী লীগ আসন্ন ধেয়ে আসা সংকটের গুরুত্ব অনুভব করতে পারেনি। এসময় পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে সরকারকে একটি সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর ঐ আগাম সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি ক্ষমতাসীন সরকার। এই কোটা আন্দোলন যে বহুদূর গড়াতে পারে সে সম্পর্কেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছিলো। কোটা আন্দোলনের পরিধি যখন বিস্তৃত হতে শুর করে তখন মাঠে নামে বিএনপি-জামায়াত। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ছাত্রদল এবং ছাত্র শিবির। ঢাকায় গোপনে জড়ো করা হয় হাজার হাজার কর্মী। উত্তপ্ত কোটা আন্দোলনে ভড় করে সরকার পতন আন্দোলন শুরু করে বিরোধী দল।
কোটা আন্দোলনের উৎপত্তি এবং বিকাশ গবেষণা করলে দেখা যায় এই আন্দোলনটি আসলে স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের গর্ভজাত। ১৯৯১ সালে ছাত্র শিবির ‘ছাত্র সমাজের দাবি-দাওয়া’ শীর্ষক ২০ দফা দাবি নামায় কোটা সংস্কারের কথা প্রথম উল্লেখ করে। ২০০১ সালে ছাত্র শিবির সব কোটা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং মুক্তিযুদ্ধের কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারক লিপি প্রদান করে। শুরু থেকেই কর্মী হিসেবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চালিকা শক্তি ছিলো শিবির। আর ছাত্র শিবিরের মাধ্যমেই এই আন্দোলনের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। ১৪ জুলাই গণ ভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য বিকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয় ছাত্র শিবির। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করা। কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে সরকার পতনের আন্দোলনকে বেগবান করার এক নীল নকশা বেশ আগে থেকেই বাস্তবায়নের চেষ্টায় ছিলো বিএনপি-জামায়াত। ১৪ জুলাই রাত থেকে সেই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেও স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্তবীজ ধ্বংস করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। এরা সংগঠিত হয়েছে। সরকারকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এতো বড় সংকটে আগে পরেনি।
স্বাধীনতা বিরোধীরা ১৮ ও ১৯ জুলাই আরেকবার জানিয়ে দিলো তারা উন্নয়ন বিরোধী। বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চায় তারা। আর একারণেই সামনের দিনগুলোতে মুক্ত বুদ্ধি ও প্রগতির চর্চার বিকাশ ঘটাতে হবে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে। একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে এর চেয়েও বড় সংকটে পরতে হতে পারে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটি। বাংলাদেশ মুখোমুখি হতে পারে এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতিতে।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
সহিংসতা হায়না রুখতে হবে বিটিভিতে আগুন জ্বালাও পোড়াও সন্ত্রাস
মন্তব্য করুন
অবশেষে
কারফিউ জারি করা হলো।
আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামানো হলো
সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবারের পর শুক্রবার ঢাকা
সহ সারাদেশে যে তান্ডব হয়েছে
তার প্রেক্ষিতে সরকারের সামনে কোন বিকল্প ছিলো
না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা
বিরোধী জামায়াত-শিবির এই আন্দোলন
ছিনতাই করে। যেভাবে সরকারী
স্থাপনা গুলো আক্রমণ করা
হয়েছে, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে তা
মধ্য যুগীয় পৈশাচিকতা। যারা বাংলাদেশের অস্তীত্ব
বিশ্বাস করেনা, এদেশের অগ্রযাত্রায় যারা ঈর্ষান্বিত, এটি
তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। এটা
কোন আন্দোলন না রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ। এটি কঠোর ভাবে
দমন করতেই হবে। কিন্তু পরিস্থিতি
এমনটি হবার কথা ছিলো
না। কেন এমন সংকটময়
পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো?
কেন
টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ
এরকম একটি জটিল সংকটের
মুখোমুখি। বর্তমান পরিস্থিতি ২০১৩ সালে নির্দলীয়
নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের
আন্দোলন, ২০১৪ সালের আগুন
সন্ত্রাস অথবা গত বছরের
বিরোধীদলের এক দফা আন্দোলনের
চেয়েও ভয়াবহ। এমনকি-২০১৮ সালের কোটা
আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চেয়েও
এবারের আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও অনেক বেশী।
বৃহস্পতিবার থেকে এটি আসলে
বাংলাদেশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। মেট্রোরেলে হামলা,
এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েতে হামলা, বিটিভিতে আগুন ইত্যাদি সবই
৭১ এর বর্বরতার সাথে
তুলনীয়। সরকারি স্থপনা এবং উন্নয়নের স্মারক
অবকাঠামো গুলোতে আগুন লাগানো হয়েছে।
এসব কোন ঘটনার পেছনেই
শিক্ষার্থীরা ছিলো না। সন্ত্রাসী
ভাড়া করে দেশে একটি
অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এই
আন্দোলন স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা শহরে বিভিন্ন
জেলা থেকে প্রায় ৫
লাখ শিবির ছাত্রদল, যুবদলের কর্মীরা এলো। সরকারের বিভিন্ন
সংস্থা কি করলো? এরকম
একটি পরিস্থিতি সৃষ্টিতে তাই ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতাও
কম নয়। আওয়ামী লীগের
বোঝা উচিত ছিলো যেকোন
আন্দোলন খারাপ দিকে মোড় নিতে
লাগে এক মুহূর্তে। আওয়ামী
লীগ তার জন্মের পর
থেকে আজ পর্যন্ত রাজপথে
যত আন্দোলনে সফলতা অর্জন করেছে তার সবগুলোতে অগ্রভাগে
ছিলো শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু টানা ক্ষমতায় থাকার
ফলে অতি আত্ম বিশ্বাস,
অতি অহংকারের কারণে আওয়ামী লীগ সবকিছুকে তুচ্ছ
করেছে। সবকিছুকে উপেক্ষা করার এক সংস্কৃতি
তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীদের
মধ্যে। আওয়ামী লীগের এমন এক হাইব্রীড
প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা
মিছিল করেনি, আন্দোলন করেনি, পুলিশের মার খায়নি তারা
পরিপাটি বাবু। এরা জনবিচ্ছিন্ন। রাজনীতি
মানে এদের কাছে নিজেদের
আখের গোছানো। সবচেয়ে
খারাপ যে প্রবণতাটি তৈরি
হয়েছে পুরো আওয়ামী লীগে
তাহলো শেখ হাসিনার দিকে
তাকিয়ে থাকা। তিনি সবকিছু করবেন
এমন একটি আশায় আওয়ামী
লীগের নেতারা যথেচ্ছাচার করেন। কেউ অনৈতিক সুবিধা
আদায় করেন, কেউ দুর্নীতি করেন,
কেউ লুটপাট করেন, কেউ নিজের আখের
গোছাতে ব্যস্ত থাকেন। ইদানিং আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ
ভাবতে শুরু করে তারা
অক্ষয়, অবিনশ্বর। চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে। কিন্তু এই আন্দোলন ক্ষমতাসীনদের
একটি কঠিন সংকেত দিলো।
এই আন্দোলনের ধাক্কায় আওয়ামী লীগ কি তার
ভগ্ন দশা দেখতে পেরেছে?
আওয়ামী লীগ কি সতর্ক
বার্তাটা বুঝতে পেরেছে?
কোটা
সংস্কার আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগ
যে সতর্ক বার্তা পেল তার মধ্যে
অন্যতম হলো দ্রুত সরকারকে
আমলা নির্ভরতা থেকে সরে আসতে
হবে। এই সংকটে আমলারা
ছিলেন নির্লিপ্ত, নিরাপদ দূরত্বে। হঠাৎ আমলা বাবুরা
কেতা দূরস্থ নিরপেক্ষ হয়ে গেছেন। আওয়ামী
লীগের চেয়ে বড় আওয়ামী
লীগ হয়ে ওঠা আমলারা
রাজনৈতিক সরকারের পাশে থাকেনি। কোন
সহযোগিতাও করেনি। আমলাদের সুবিধাবাদী চেহারা দেখা যাচ্ছে উৎকটভাবে।
সংকটে ভোল পাল্টাতে এদের
যে এক মুহূর্ত সময়
লাগেনি। শুধু আমলা কেন
আওয়ামী লীগের ১৫ বছর শাসনামলে
সুবিধাভোগী অনেকেই ভোল পাল্টে ফেলেছেন
মুহূর্তেই। শুধু
বড় আমলারা নন জেলা উপজেলায়
ছোট বাচ্চা আমলারও অনেকে নিরপেক্ষ মুখোশ পরেছেন।
এক শিক্ষক দেখলাম ফেসবুকে বলেছেন, তিনি নাকি ছাত্রলীগের
কাউকে পাঠদান করাবেন না। ভালো কথা।
তার ঠিকুজী ঘাটতে গিয়ে দেখলাম, আওয়ামী
লীগ আমলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া এই শিক্ষিকের চৌদ্দ
গোষ্ঠী বিএনপি করে। দুর্নীতির মাধ্যমে
এভাবেই ‘রাজাকার’ আর বিএনপিকে লালন
করেছে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ। শো
বিজের যে সব তারকারা
মন্ত্রী এমপিদের গা ঘেঁষে সেলফি
তুলেছেন, তারা এখন ফেসবুকে
লম্বা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কোটা সংস্কারে বিপ্লব
দেখছেন। সরকারকে নসিহত দিচ্ছে। গত ১৫ বছরে
যেসব রাজাকারের বাচ্চা, সুবিধাবাদী মতলববাজরা সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন এখন তারা জাতির
বিবেক বনে গেছেন। কোটা
আন্দোলন রাজাকার পুনঃউত্থানের আন্দোলনে রূপ নেয়। এতে
রাজাকারের বংশ এবং মনস্তাত্বিক
রাজাকাররাও যুক্ত হন। শিক্ষার্থীরা যে
অরাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তা স্বাধীনতা বিরোধী
আন্দোলনে রূপ নেয়।
কোটা
নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটিতেই শুরু
থেকে আমলাদের একটি বিতর্কিত ভূমিকা
ছিলো। ভুল পরামর্শ দিয়েছিলো।
বিশেষ করে ২০১৮ সালে
এক সাথে সব কোটা
বাতিল করে দেয়াটা ছিলো
সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি। সেই সময় আমলারাই
সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘ মাথা ব্যাথায় মাথা
কেটে ফেলে’ সমস্যার সমাধানের জন্য। আর সেকারণেই সমস্ত
কোটা বাতিল হয়েছিলো। তখন আমলারা কেন
কমিশন গঠনের সুপারিশ করেনি? আমলাতান্ত্রিক পরামর্শে প্রস্তুতকৃত পরিপত্রটি নিয়ে রিট পিটিশনটি
ছিলো একটি যৌক্তিক আবেদন।
কারণ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরা না করলেও এই
রিট পিটিশন হয়তো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, নারীরা বা পিছিয়ে পরা
জনগোষ্ঠী করতেই পারতো। এখন শিক্ষার্থীরা সব
কোটা বাতিলের কথা বলছে না।
সংস্কারের দাবি করেছে। আমলারা
এভাবেই সরকারকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করছে, ভুল পরামর্শ দিচ্ছে।
বিশেষ করে পেনশন স্কিম
নিয়ে সংকট আমলাদের সৃষ্টি।
এই সংকট আওয়ামী লীগকে
জানিয়ে দিলো সরকার পরিচালনায়
রাজনীতিবিদদের ড্রাইভিং সীটে বসতে হবে।
আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতায় হোঁচট খেতে হবে।
কোটা
সংস্কার আন্দোলনের থেকে আরেকটি যে
সতর্ক বার্তাটি হলো, ছাত্রলীগকে এখনই
থামাতে হবে। ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি
নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছিলো নানা
কথাবার্তা। ছাত্রলীগের সীমাহীন ঔদ্ধত্য বিভিন্ন জায়গায় তাদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিটি বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য ইত্যাদি
নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা।
বিভিন্ন স্থানে তাদের অপকর্মের ফিরিস্তি নিয়ে বিস্তর চর্চা
হয়েছে। কিন্তু তারপরও ছাত্রলীগকে সরকার সামাল দেয়নি। আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ছাত্রলীগ।
এবার কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগের
ছেলেরা যেভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিটুনি খেয়েছে তা নজীরবিহীন। ২০০১
সালে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হল
দখল করে ছাত্রদলও ছাত্রলীগকে
এভাবে পেটানোর সাহস পায়নি। ছাত্রলীগ
তার ইতিহাসে এরকম লজ্জা জনক
অবস্থানে কখনো পড়েছে কিনা
আমার জানা নেই। আর
এটির কারণ হলো
ছাত্রলীগ সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক ধারণা। সহজ সরল ভাষায়
বললে বলা যায়, শিক্ষার্থীদের
মধ্যে ছাত্রলীগ সম্বন্ধে একটি ঘৃণা তৈরি
হয়েছে। আর এই ঘৃণা
বোধ থেকেই শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে প্রতিহত করেছে এবং বিভিন্ন শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে
দিয়েছে। এটি অন্যায্য, এটি
অন্যায়। বিভিন্ন ছাত্রলীগের নেতার সাথে যে বর্বরোচিত
আচরণ করা হয়েছে আমি
তার সমালোচনা করছি। কিন্তু এটাও সত্যি এটি
একদিনে তৈরি হয়নি। এই
ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যদি ছাত্রলীগে শুদ্ধি অভিযান করে, ছাত্রলীগকে ঢেলে
সাজানোর উদ্যোগ নেয় সেটি হবে
সবচেয়ে ভালো কাজ। এই
আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হয়তো একটি
নতুন পরিশুদ্ধ ছাত্রলীগের নবযাত্রা শুরু করতে পারবে।
এঘটনার আরেকটি দিক হলো ছাত্রলীগের
ভেতর অনুপ্রবেশকারী এবং হাইব্রিডরা। যারা
সুযোগ সন্ধানী, সুযোগ পেলেই যারা দল ত্যাগ
করে, মতলববাজি করে। আন্দোলনের মাঝপথে
অনেক ছাত্রলীগ পদত্যাগ করার ঘটনা নজিরবিহীন।
ছাত্রলীগের যে আদর্শের চর্চা
হয় না। এঘটনাগুলো তার
প্রমাণ। ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানোর বার্তা
দিলো এই সংকট।
কোটা
সংস্কার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ভঙ্গুর সাংগঠনিক অবস্থা ফুটে উঠেছে। আওয়ামী
লীগ যে পুলিশ এবং
প্রশাসন ছাড়া অক্ষম, রাজপথে
দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখে না কোটা
সংস্কার আন্দোলনে তা দগ্ধ ঘাঁ
এর মতো করে ফুটে
উঠেছে। আওয়ামী লীগের এরকম ভগ্ন দশা
আগে কখনো ছিলো কিনা
আমার জানা নেই। কোটা
আন্দোলনে যখন জামায়াত-শিবির-ছাত্রদল রাজপথে বেরিয়ে এসেছে তখন আওয়ামী লীগের
সুবিধাবাদী মতলববাজরা সটকে পড়েছে। কিছু
নেতা-কর্মী রাস্তায় গিয়ে ছাত্র শিবির
আর ছাত্র দলের হাতে মার
খেয়েছে আর কেউ কেউ
পালিয়ে গেছে। ঢাকা মহানগরীতে আওয়ামী
লীগের কিন্তু অযোগ্য, অর্থলোভী নেতা ছাড়া যে
আর কিছু নেই তা
প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকার রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করার মতো নেতা-কর্মীর সংকট এবার সংকটে
দৃশ্যমান। নির্বাচনের আগে থেকেই আওয়ামী
লীগে বিভক্তি ছিলো। টানা ক্ষমতায় থাকার
কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
আওয়ামী লীগের নেতারাও স্বীকার করেছেন যে, আওয়ামী লীগের
ভেতর কোন্দল থামেনি। নিজেরা নিজেরা কোন্দল করা আওয়ামী লীগের
যে একটি নিয়মিত ব্যাপার
হয়ে দাড়িয়েছে। এর ফলাফল কি
হতে পারে কোটা সংস্কার
আন্দোলনে ক্ষমতাসীনদের বেহাল দশা তার একটি
উদহারণ মাত্র। দলকে কোন্দল মুক্ত
করে ত্যাগী পরীক্ষিতদের রাজপথে লড়াই করতে পারে
এমন কর্মীদের সামনে না আনলে সামনে
দলটির সংকট আরো বাড়বে।
কোটা
সংস্কার আন্দোলনের আরেকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়েছে।
বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে আওয়ামী
লীগ। ৭৫ বছর পার
করা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির পাশে কেউ নেই।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্ক নেই। যেসমস্ত টেলিভিশন,
সংবাদ পত্র, মিডিয়া প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে চাটুকারিতায় মুখরিত হন তারাই সরকারের
বিরুদ্ধে সানাই বাজিয়েছে। শো বিজের সুন্দরীরা
হঠাৎ কোটার জন্য হাহাকার করছেন।
যেসমস্ত লেখক, বুদ্ধিজীবীরা এটা-সেটা পাওয়ার
আশায় সরকারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দেন-দরবার করেন
তারা নিরপেক্ষ হয়ে গেছেন। যেসমস্ত
আমলারা আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় আওয়ামী
লীগ হয়ে গিয়েছিলেন তারা
একেবারে নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে পাথরের মূর্তির
রূপ ধারণ করেছেন। নিরপেক্ষ
হয়ে ঘটনা যাচাই বাছাই
না করেই সরকারকে আসামীর
কাঠগড়ায় দাঢ় করিয়েছে। সবকিছু
মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে
সবার অবস্থান ছিলো অনেকটাই গা
বাঁচিয়ে চলার মতো। পুলিশ,
প্রশাসন কেউই সরকারের জন্য
উজাড় করে দিয়ে দায়িত্ব
পালন করেনি। আওয়ামী লীগের আদর্শিক জোট সঙ্গীরা দূরে
থেকে তামাশা দেখছে। শুক্রবার রাতে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে
১৪ দলের নেতাদের
নিয়ে বৈঠক করেন। তার
আগে অভিমান দূরে রেখে ১৪
দলের নেতাদের সক্রিয়
দেখা যায়নি। এতো একা কবে
ছিলো আওয়ামী লীগ? বন্ধুহীন আওয়ামী
লীগকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির ঐক্যে নেতৃত্ব দিতে হবে আওয়ামী
লীগকেই।
ছাত্র শিবির এই আন্দোলনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলো। এই আন্দোলনটি আসলে ছাত্র শিবিরের গর্ভজাত একটি সন্তান । আর সেকারণেই কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বিরোধী দলকে যতোই অবজ্ঞা করা হোক, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হোক বিশেষ করে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এখনো শক্তিশালী । যেকোন সময় তারা ডাল পালা মেলতে পারে। বাংলাদেশে ৭৫’র পর থেকে রাজাকারের যে রক্তবীজ রোপিত হয়েছে তা এখন মহীরুহের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পরেছে। এবং এদের প্রতিহত করার জন্যই যে সাংস্কৃতিক চেতনা এবং মনোজাগতিক উৎকর্ষতা অর্জন করানো দরকার ছিলো তা করতে পারেনি টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগে সংস্কৃতির চর্চা নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুখে বলে জনবিরক্তির কারণ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রস্ফুটিত করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অঙ্গনে যে মেধা ও মননে আবহ তৈরি করা দরকার সেটি করতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। হেফাজতের পরামর্শে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন, মুক্ত চিন্তাকে বাঁধা দানের প্রবণতার ফলে ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়েছে। আর একারণেই রাজাকারের বংশধরদের উত্থান ঘটেছে। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এখন সারাদেশে জাল বিস্তার করেছে। বিএনপিকে নিয়ে যে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য আওয়ামী লীগের নেতারা করেছে এই ঘটনায় তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন আওয়ামী লীগকে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা আওয়ামী লীগের জন্য একটি সতর্ক বার্তা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি এই সতর্ক বার্তা অনুধাবন করতে পারে তাহলেই তাদের মঙ্গল।
সৈয়দ
বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
১৭ জুলাই থেকে দেশে যা হয়েছে তা কোনো আন্দোলন না। এ ঘটনাকে এক কথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমি মনে করি, এটি উন্নয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ধ্বংসস্তূপে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পিত সন্ত্রাস। কোনো শিক্ষার্থী তো নয়ই, ন্যূনতম বিবেকবান মানুষের পক্ষে এ ধরনের বীভৎসতা ঘটানো সম্ভব নয়। যারা এটা করেছে তাদের লক্ষ্য একটাই- বাংলাদেশকে ধ্বংস করা। প্রশ্ন হলো, কারা এটা করতে চায়? এটি কি শুধু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, জঙ্গি এবং বিএনপির নাশকতা? আমি অন্তত তা মনে করি না। বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল-ছাত্রশিবির, জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অবশ্যই এই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু হুট করে তারা এত ক্ষমতাবান কীভাবে হলো? কোথায় এত টাকা-পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র পেল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে নির্মোহভাবে। আর সে কারণেই এ আন্দোলনের শুরু থেকে এর গতি প্রবাহ এবং সময়কাল বিশ্লেষণ জরুরি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে কোটাবিরোধী প্রচারণার উৎসকাল নব্বই দশক। ’৯০-এ এরশাদের পতনের পর দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে সহযোগিতা করে জামায়াত। এ সময় যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযম প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু করে। জামায়াত মজলিসে শূরার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী এবং ’৭১-এর নরঘাতক গোলাম আযমকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের আমির ঘোষণা করে। ওই মজলিসে শূরায় আরেকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’সহ অযৌক্তিক সব কোটা বাতিল করে মেধাভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব নেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে। এই ২০ দফার মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ দাবিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গত ৩২ বছর ‘কোটা সংস্কার’ নিয়ে কাজ করছে ছাত্রশিবির। ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জামায়াত যখন লণ্ডভণ্ড, তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীরা আরও গভীরভাবে কাজ শুরু করে। বিশেষ করে, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ ছাত্রশিবির এবং জামায়াতকে নতুন করে পরিকল্পনা সাজানোর পথ দেখায়। ছাত্রশিবির তার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়। আধুনিক জীবনাচার, তরুণদের আগ্রহগুলো রপ্ত করানো হয়। দাড়ি, টুপি ছেড়ে আধুনিক বেশভূষায় অভ্যস্ত হয় শিবির। দ্রুতই তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশে যেতে শুরু করে। মেধাবী, জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল তরুণদের মধ্যে কোটা নিয়ে অসাম্য তুলে ধরতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে কোটা সংস্কার শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার নিয়ে প্রথম ছাত্র বিস্ফোরণ হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দ্রুত পদক্ষেপ নেন। আন্দোলন থামাতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়। সরকারের ওই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। সুস্পষ্টভাবেই এ সিদ্ধান্ত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসময় আমলারা ‘মাথা ব্যথায় মাথা কেটে ফেলা’র সহজ সমাধান দিয়েছিল। আমলাতান্ত্রিক সমাধানের এটাই হলো সবচেয়ে বড় ব্যাধি। আমলারা একটি সমস্যা ধামাচাপা দিতে আরেকটি সমস্যা সৃষ্টি করেন। ২০১৮ সালে যদি কোটা নিয়ে আন্দোলনকারী এবং এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি স্থায়ী সমাধান করা হতো তাহলে হয়তো বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। যাই হোক, ২০১৮ সালের ওই সরকারি পরিপত্রের পর কোটা আন্দোলন বন্ধ হয়। ছয় বছর দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগ হয়েছে কোনো রকম কোটা ছাড়াই। বছর তিনেক পর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পক্ষ থেকে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের দাবিতে হাই কোর্টে একটি রিট পিটিশন করা হয়। এই রিট পিটিশন এত দূর গড়ালো কেন? ওই রিট পিটিশনের বিরুদ্ধে আইন মন্ত্রণালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস কি তখন এখনকার মতো অবস্থান নিয়েছিল? না নেয়নি। এমনকি, হাই কোর্টের রায়ের পরও আইন মন্ত্রণালয় এবং অ্যাটর্নি জেনারেল যদি দ্রুত আপিল বিভাগে গিয়ে হাই কোর্টের রায় স্থগিত চাইতেন, তাহলেও আন্দোলন এত দূর গড়াতো না। ধাপে ধাপে ছিল উপেক্ষা এবং উদাসীনতা। সবাই যেন পরিস্থিতিকে ভয়াবহ হতে সহায়তা করেছেন। অথবা পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধিই করতে পারেননি। ২০১৮ সালের আন্দোলনের তীব্রতা বুঝতেই পারেননি ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। হাই কোর্টের রায়ের পরই কোটা আন্দোলন সংগঠিত হতে শুরু করে। বিক্ষিপ্তভাবে যখন আন্দোলন দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু হয়, তখনই সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার সুযোগ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের কিছু নেতার দম্ভ, দায়িত্বহীনতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। টানা চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে কিছু জনবিচ্ছিন্নতার মারাত্মক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। সবকিছুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, আত্মতুষ্টি, অহংকার দলের কিছু নেতাকে মোটামুটি ‘মানসিক প্রতিবন্ধীতে’ পরিণত করেছে। এসব নেতা মনে করেন, সবকিছু করবেন প্রধানমন্ত্রী। কিছু বাঁচাল নেতার কথাবার্তা জনবিরক্তি থেকে জনক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নেতা মনে করেন তারা অমর, অবিনশ্বর। এরা আওয়ামী লীগ সংগঠনের যেমন বারোটা বাজিয়েছেন, তেমনি দেশকে ফেলেছেন সংকটে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, কোটা আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে তার আগেই প্রধানমন্ত্রী শুরু করেন দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা, অর্থপাচার এবং কিছু ব্যক্তির সীমাহীন দুর্নীতি এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের কারণে অর্থনৈতিক সংকট গভীর হতে থাকে। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান একটি সাহসী ও সময়োপযোগী উদ্যোগ। এ সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তির লুটপাটের খবর বেরোতে থাকে গণমাধ্যমে। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের ‘আলাদিনের চেরাগ’ কাহিনি গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করে। সরকারের বিশ্বস্ত এবং ঘনিষ্ঠ হিসেবে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেনজীর। এসব পদে থেকে তিনি রীতিমতো লুণ্ঠন করেছেন। আদালতের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিপুল সম্পদ জব্দ করে। কিন্তু সরকারের ভিতর থাকা বেনজীরের দুর্নীতির দোসরদের সহযোগিতায় বেনজীর দেশত্যাগ করেন। বেনজীরের পর তোলপাড় শুরু হয় এনবিআরের সদস্য মতিউরকে নিয়ে। ১৫ লাখ টাকায় ছাগল কেনার কাণ্ডে বেরিয়ে আসে মতিউরের রত্ন ভাণ্ডারের খবর। মতিউরের পরিবারের হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য গোটা দেশে রীতিমতো ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। এরপর থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে নানা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কেচ্ছাকাহিনি। দুর্নীতি দমন কমিশন একের পর এক সম্পত্তি জব্দ শুরু করে। দুর্নীতিবাজদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আসতে থাকে। কিন্তু বেনজীরের মতো মতিউরও ‘অদৃশ্য মানব’ হয়ে যান। দেশ ছাড়েন মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী সবাইকে ম্যানেজ করে বহাল তবিয়তে আছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর যুদ্ধে সরকারের মধ্যেই যেন দুটি পক্ষ। এক পক্ষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন অনুযায়ী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আরেক পক্ষ দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে তাদের পালাতে সহযোগিতা করে। দুর্নীতি নিয়ে সরকারের ভিতর চলছে দ্বৈতদ্বন্দ্ব। এর মধ্যেই চীন থেকে দেশে ফিরে দুর্নীতি নিয়ে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি’র ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। গত ১৪ জুলাই চীন সফরের ওপর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, ‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ এ সময় শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের জানান চাঞ্চল্যকর তথ্য। বলেন, ‘আমার পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক।’ পরে জানা যায়, ওই পিয়ন হলেন জাহাঙ্গীর। নোয়াখালীর চাটখিল থেকে হতদরিদ্র অবস্থায় ঢাকায় আসেন। শেখ হাসিনার ফাই ফরমায়েশ খাটতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাহাঙ্গীর হয়ে যান প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী, এমপি এমনকি আমলারাও জাহাঙ্গীরকে সমীহ করতেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানার পর গত বছরই তাকে বাদ দেন। নিষিদ্ধ করেন গণভবনে। কিন্তু তারপরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময়ে তাঁর পিয়নের ৪০০ কোটি টাকার তথ্য জাতিকে জানান, যখন পিএসসির এক গাড়িচালকের শত কোটি টাকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তুলকালাম চলছে। বছরের পর বছর ওই ড্রাইভার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আবেদ আলী এবং জাহাঙ্গীর যেন দুর্নীতির বৃত্ত পূরণ করেন। প্রমাণ হয়ে যায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ড্রাইভার-পিয়ন পর্যন্ত দুর্নীতির ক্যান্সারে আক্রান্ত। পরিস্থিতি এমন যে, সরকারের মাথাটি কেবল ঠিক আছে। যাকে দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। আর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতির ক্যান্সার। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে, ‘এসব দুর্নীতিবাজকে গ্রেপ্তার করলে সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয় না। আমি এ ধরনের দুর্নীতির তথ্য জাতিকে জানাতে ভয় পাই না।’ আমার বিবেচনায় ওই সংবাদ সম্মেলনে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্ট একটি বার্তা দিয়েছিলেন। এর ফলে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরা এবং সরকারের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা সহযোগীরা বুঝেছে পরিস্থিতি ভালো নয়। বাঁচার উপায় হিসেবে কোটা আন্দোলন এবং বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের ওপর তারা ভর করে।
প্রধানমন্ত্রীকে ওই (১৪ জুলাই) সংবাদ সম্মেলনে কোটা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলো, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের চেয়ে চাটুকারিতাই বেশি হয়। অনেকে সাংবাদিকতা ভুলে আওয়ামী লীগের কর্মীর মতো মন্তব্য করেন, পরামর্শ দেন। ‘কোটা’ নিয়ে যে দুটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, তা ছিল বর্ণনাধর্মী, মন্তব্যসূচক। রাজাকারের নাতি-পুতি আর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতি সমান যোগ্যতাসম্পন্ন হলে কাকে চাকরি দেবেন?-এটা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। সংবিধান অনুযায়ী চাকরি দেওয়ার এখতিয়ার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের। এরকম মতলবী প্রশ্নেরও বিচক্ষণ উত্তর প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার কন্যা। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার সন্তান। কাজেই তিনি তো বলবেনই মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিই এক্ষেত্রে চাকরি পাবে। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা কখনো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলেননি। কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত হয়ে গেল। তিলকে তাল বানানো হলো। রাতের মধ্যে অদৃশ্য ইশারায় মিছিল বের করল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো। এই আন্দোলন যেন ‘রিমোট কন্ট্রোল’ চালিত আন্দোলন। এক ইশারায় নাচন শুরু হলো সর্বত্র। এ পরিস্থিতির মধ্যেই ক্যাম্পাসগুলোতে ঢুকে পড়লো ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদলের সশস্ত্র ক্যাডাররা। তাদের লক্ষ্য কোটা সংস্কার নয়, আবাসিক হল দখল। ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলেরা’ বুঝতেই পারেনি কী হচ্ছে। বেধড়ক মার খেল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কহীন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। এরপর সারা দেশে শুরু হলো তাণ্ডব।
গত রবিবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। জাতীয় সংকট নিরসনে আপিল বিভাগের এই অসাধারণ এবং সাহসী ভূমিকা বাংলাদেশের আইনের শাসনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে আপিল বিভাগ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংকটের সমাধান করেছে। কোটা সংস্কার নিয়ে যারা আন্দোলন করেছেন তাদের এ রায়ের বিরোধিতা করার কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু আমার মনে হয় না, এত দ্রুত এই আন্দোলন থেমে যাবে। সংকট থেকে সরকার হয়তো বেরিয়ে আসবে, তবে সময় লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সরকারের দুর্বলতাগুলো উন্মোচিত হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে অনেকে সুযোগ নেবে। নানা ইস্যুতে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করবে। ভাঙা বেড়ার সন্ধান পেলে যেমন ‘শিয়াল’ বারবার বাড়িতে হানা দেয়, তেমনি দুর্বৃত্তরা সুযোগ খুঁজবে।
প্রশ্ন হলো, সরকার তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবে কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের আগে খুঁজে বের করতে হবে, এই বিপুল সন্ত্রাসী ও সহিংসতার মূল কারিগর কারা? নেপথ্যের ‘গডফাদার’ কে? এই অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যের নীলনকশা কার? এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল কোটা আন্দোলন থেকেই। কিন্তু মেট্রোরেলে হামলা, বিটিভি ভবনে হামলা, সেতু ভবন, দুর্যোগ ভবনে অগ্নিসংযোগের ঘটনার চিত্রনাট্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের রচিত নয়। এ ধরনের তৎপরতা চালানোর জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ এবং পেশাদারিত্ব লাগে। কাজেই ১৮ থেকে ২০ জুলাই সারা দেশে যে তাণ্ডব হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়। এটা পেশাদার সন্ত্রাসীদের পরিকল্পিত অপকর্ম।
আওয়ামী লীগ এ ঘটনার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেছে। বিএনপির একাধিক শীর্ষনেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এসব ভাঙচুরের সঙ্গে গত ২৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ হাসপাতালে অগ্নিসংযোগের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। বিএনপি এবং জামায়াতের কয়েক লাখ কর্মী কোটা আন্দোলনের ফায়দা লুটতে ঢাকায় ঢুকে ছিল। তারা আন্দোলন বেগবান করেছে। সহিংসতার মাধ্যমে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছে। গুজব ছড়িয়েছে। পুলিশের ওপর ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা চড়াও হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এ পরিকল্পনা ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের পক্ষে প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। নাশকতা পরিচালিত হয়েছে প্রশিক্ষিত কমাণ্ডের মাধ্যমে। এমন এক বা একাধিক ব্যক্তি এ সন্ত্রাসী পরিকল্পনায় জড়িত যিনি পুলিশের দুর্বলতা জানেন, পুলিশের কৌশল সম্পর্কে অবহিত। ঢাকা শহরের স্পর্শকাতর পয়েন্টগুলো তার নখদর্পণে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সম্পর্কে যিনি প্রচুর জ্ঞান রাখেন। সন্ত্রাসী তাণ্ডবের ভিডিও ফুটেজগুলো খুঁটিয়ে দেখলে প্রমাণ মিলবে অনেক কিছুরই। যেমন বিটিভিতে যখন আক্রমণ হয়েছে তখন দেখা যাচ্ছে, রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে লড়াই করছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং ভাড়াটে বাহিনী। এদের মধ্যে থেকে প্রশিক্ষিত কিছু তরুণ পুলিশের ফাঁক গলে বিটিভিতে ঢুকে পড়ে এবং হামলা চালায়। একই ঘটনা লক্ষ্য করেছি সেতু ভবন এবং দুর্যোগ ভবনেও। এরা কারা? এখানেই আমি এই নারকীয় তাণ্ডবের সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাই। এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দুর্নীতিবাজ সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ। তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। কিন্তু দেশের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। তার সাঙ্গপাঙ্গ আছে সর্বত্র। বেনজীর এক সময় ঢাকার পুলিশ কমিশনার ছিলেন। র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন, পুলিশ প্রধান ছিলেন। পুলিশ বাহিনীর ভিতর তার নিজস্ব লোকজন এখনো আছে। তার চেয়েও বড় কথা তিনি পুলিশের দুর্বলতা জানেন, জানেন কীভাবে তাদের চাপে ফেলা যায়। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকাটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে জঙ্গি দমন করতে গিয়ে তিনি অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছেন। অনেককে বাঁচিয়েছেন। কাউকে কাউকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই নেটওয়ার্ক তার অজানা নয়। সরকারকে উৎখাত করতে পারলে তার ‘দুর্নীতি’ নিয়ে চর্চা হবে না। তিনি নিরাপদ হয়ে যাবেন। এ ভাবনা থেকে এ আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা কি সরকার উড়িয়ে দিতে পারবে? বেনজীর আহমেদের যেসব ঘটনা ও অপকর্মের কাহিনি সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত হয়েছে তাতে নিঃসন্দেহে তাকে ‘গডফাদার’ বলা যায়। এ নারকীয়তার গডফাদার বেনজীরসহ দুর্নীতিবাজরা নয় তা কে হলফ করে বলতে পারবে?
এ তাণ্ডবে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত এত টাকা খরচ করবে তা আমি বিশ্বাস করি না। এরকম অর্থ খরচ করতে পারলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেই তারা করত। এ রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসে এ সময় আলোচিত দুর্নীতিবাজ বেনজীর, মতি, জাহাঙ্গীরের বিনিয়োগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।
নরসিংদী কারাগারে হামলা হয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান কে? প্রত্যেকটি ঘটনার যোগসূত্র খুঁজতে হবে, সমীকরণ মেলাতে হবে। শুধু ‘বিএনপি-জামায়াতের কাজ’ বলে সকাল-সন্ধ্যা কাকের মতো চিৎকার করলে আসল শত্রুকে চিহ্নিত করা যাবে না। ভবিষ্যতে আবার সরকার উৎখাতের চেষ্টা হবে আরও ভয়ংকরভাবে। তাই এখনই সাবধান। আসল শত্রু চিহ্নিত করতে হবে সবার আগে।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
১৬ জুলাই আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি দিন। ২০০৭ সালের এই দিনে মিথ্যা-ভিত্তিহীন মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ধানমন্ডির ‘সুধা সদন’ থেকে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ বাস্তবায়নের জন্য এবং গণতন্ত্রকে চিরস্থায়ীভাবে বিদায় দেয়ার জন্যই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ এবং মইন-উ আহমেদের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশকে ঘিরে একটি নতুন নীল নক্সা প্রণয়ন করেছিলেন। গণতন্ত্রহীন করে রাখতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে। আর সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের আগে পরিকল্পিত আওয়ামী লীগের ভেতরে সৃষ্টি করা হয়েছিলো অন্তঃকলহ এবং বিভক্তি। আওয়ামী লীগের ভেতর সংস্কারপন্থী নামে একটি নতুন গোষ্ঠী সৃষ্টি করা হয়। যারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার জন্য প্রথম ভূমিকা পালন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তারা বুঝে হোক, না বুঝে হোক অগণতান্ত্রিক এবং সুশীলদের খপ্পরে পরেছিলেন। আর একারণেই এক এগারোর সময়ে তারা একের পর এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন শেখ হাসিনার প্রতিটি কাজে। আওয়ামী লীগের এই বিভক্তির সুযোগেই শেখ হাসিনাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছিলো তৎকালীন সরকারের পক্ষে। আওয়ামী লীগ সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্থ হয় ঘরের শত্রুদের কারণে। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট যেমন আওয়ামী লীগের আসল ক্ষতি করেছিল মোশতাক চক্র, ঠিক তেমনি ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগের সর্বনাশের চেষ্টা করে সংস্কারবাদীরা। বাইরের শত্রু নয় ঘরের শত্রুরাই আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর। ১৬ জুলাই তার আরেকটি প্রমাণ।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাইয়ের আগে অনেক নাটকীয়তা হয়েছিলো। বিশেষ করে ১১ জানুয়ারি তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে যখন ড. ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় তখন তারা দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্টু, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। তৎকালীন সংবিধানে তত্বাবধায়ক সরকারের কাজের পরিধি ছিলো খুবই সীমিত। তাদের একমাত্র দায়িত্ব ছিলো একটি অবাধ, সুষ্টু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। কিন্তু ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্বাবধায়ক সরকার এসে রুটিন দায়িত্বের বাইরে রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক বিষয়ের ওপর হস্তক্ষেপ শুরু করেন। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে তারা শুরু করেন দুর্নীতি বিরোধী শুদ্ধি অভিযান, যৌথ অভিযানের মতো চটকদার কর্মসূচী। আর এসব অভিযানের নামে তারা রাজনীতিবিদদের চরিত্র হরণের খেলায় মেতে ওঠেন। আর তাদের এই কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য ছিলো দীর্ঘস্থায়ীভাবে বাংলাদেশে একটি অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়েই শেখ হাসিনাকে সেই সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। শুধু শেখ হাসিনাই নয় পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়াকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। কিন্তু শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার ছিলো বিরাজনীতিকরণের টার্নিং পয়েন্ট।
আজ ১৭ বছর পরে এসে আমরা যদি পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখব, ১৬ জুলাই ছিলো আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি কঠিন দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে যেমনভাবে আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিলো। ঠিক তেমনি ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে আওয়ামী লীগকে পঙ্গু করার চেষ্টা হয়।
১৫ আগস্টের সঙ্গে ১৬ জুলাইয়ের মৌলিক পার্থক্য হলো, ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছিলো আর ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু দু’টি ঘটনার মধ্যে অদ্ভুত মিল। দুই ট্রাজেডিতে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছিলো আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই। আরও মিল হলো যারা সুসময়ে চাটুকার ছিলেন, যারা সুসময়ে আওয়ামী লীগ প্রধানের চারপাশে ঘুরঘুর করতেন, মধু খেয়েছেন তারাই দুঃসময়ে বিশ্বাসঘাতকে পরিণত হয়েছিলেন। এটা আওয়ামী লীগের রাজনীতির একটি বড় শিক্ষা।
১৫ আগস্টে খুনী মোশতাক যেমন বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলো তেমনি ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সংস্কারপন্থিরা শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের পর নির্লিপ্ত ছিলো। সুসময়ের সুবিধাভোগী চাটুকাররা দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ায়নি। দুঃসময়ে যারা পাশে দাঁড়িয়েছিলো তারাই হলো আওয়ামী লীগের সত্যিকারের কাণ্ডারি। প্রয়াত জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, বেগম মতিয়া চৌধুরী, এডভোকেট সাহারা খাতুন এবং তৃণমূলের নিবেদিত প্রাণ নেতা-কর্মীরাই দুঃসময়ের কাণ্ডারি হয়েছিলেন।
এটা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সব রাজনৈতিক দলের জন্যই একটি বড় শিক্ষা। ১৬ জুলাই আমাদের যে শিক্ষাটি দেয় তা হলো সুসময়ে যারা চারপাশে থাকে তাদের মধ্যে একটি বড় অংশই চাটুকার, মতলববাজ। দুঃসময়ে এদের খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিলো। এসময় যাদের দুর্দন্ত প্রভার ছিলো, তারা ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনার জন্য রাজপথে নামেনি। তারা অনেকেই আত্মতুষ্টিতে ভুগেছিলেন। অনেকেই নেতৃত্ব দখলের খোয়াব দেখেছেন। অনেকে বাঁচতে পালিয়েছেন। যাদের কোন চাওয়া পাওয়া নেই। যারা চিরকাল শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে, তারাই সেদিন শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছে।
আওয়ামী লীগের সব সংকটেই এই তৃণমূল এবং আদর্শবানরাই সামনে এসেছে, রুখে দাঁড়িয়েছে, দলকে রক্ষা করেছে। তবে একটি বিষয় এখন উদ্বেগের, আতংকের। আওয়ামী লীগের তৃণমূলকেই এখন রক্তশূণ্য করা হচ্ছে। আদর্শবান নেতাদের দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তৃণমূলের মধ্যেও ঢুকে পরছে হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী। তৃণমূলেও কমিটিগুলোতে বাণিজ্য হচ্ছে কোটি টাকার। আর এই বাণিজ্যের কারণে সত্যিকারের ত্যাগী, আদর্শবাদীরা নিষ্ক্রিয়, নির্লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার একটি দুঃসময় এলে আওয়ামী লীগকে রক্ষা করবে কে? সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার যোদ্ধা
মন্তব্য করুন
গত সপ্তাহের প্রায় পুরোটা জুড়ে সারা দেশে যে তাণ্ডব হয়েছে তা অবিশ্বাস্য, অনভিপ্রেত এবং দুর্ভাগ্যজনক। এই তাণ্ডবকে একমাত্র একাত্তরের নৃশংসতার সাথেই তুলনা করা যায়। বেছে বেছে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে হামলা করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন স্মারক চিহ্ন। বিটিভি, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো নির্মাণগুলোতে বেছে বেছে হামলা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জানিয়েছেন যে, ‘যারা নাশকতার সাথে জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’ তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন যে, তাদেরকে খুঁজে বের করা হবে এবং আইনের আওতায় নেয়া হবে। প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিরাও একই রকম বক্তব্য দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশন আমার পরিচয়। আমি মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে। ১৯৯৬ সালে এই টেলিভিশনে আমি নিউজ রিপোর্টিং শুরু করি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠান চালু হয়। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনধর্মী এই অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবার দুই গুগ পরেও এখনও মানুষ ঐ অনুষ্ঠানকে মনে রেখেছে। আমার সাংবাদিকতা জীবনে পূর্ণতার নাম ‘পরিপ্রেক্ষিত’। পরিপ্রেক্ষিত আমাকে তারকা খ্যাতি দিয়েছে। একারণেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের কাছে আমি সব সময় ঋণী। বিটিভি আমার আবেগের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা, আমার সত্তার অংশ। সেই বিটিভি যখন পুড়ছিল তখন আমি আবেগ সামাল দিতে পারিনি। ৭১ এর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী, রাজাকারাও বিটিভিতে আগুন দেয়নি। প্রায় ২৫ ঘণ্টা বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ ছিলো। এখনও রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি পৈশাচিকতার চিহ্ন বহন করে আছে। শুধু বিটিভি কেন? গত বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাংলাদেশ জুড়ে টার্গেট নাশকতা হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে লুট হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। মেট্রোরেল আমাদের গর্বের পরিবহণ ব্যবস্থা। অল্প সময়ের মধ্যে এই গণ পরিবহনটি আমাদের সবার প্রিয় বাহনে পরিণত হয়েছে। এবার হায়নাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিলো মেট্রোরেল। তিন দফায় হামলা হয়েছে মেট্রোরেলের উপর। মেট্রোরেলের উপর কোন সাধারণ নাগরিক হামলা করতে পারে, আমি বিশ্বাস করি না। একমাত্র যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা যাদের জন অসহ্য তারাই এমন ন্যাক্কারজনক কাণ্ড করতে পারে। কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ সেতু ভবনে, দুর্যোগ ভবনে কিংবা অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় এভাবে হামলা করতে পারে না। গত বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাংলাদেশে যা হয়েছে তা কোন আন্দোলন না, শ্রেফ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই আন্দোলন কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে কোনো ছাত্র আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন। উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নব্য রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির নতুন প্রজন্ম এই অপকর্ম করেছে। ৭১ এর স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিতরা তাদের প্রতিশোধ গ্রহণের মিশনে নেমেছিলো। এজন্যই তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করেছে। বাংলাদেশ এরকম ভয়ংকর সময়ের মুখোমুখি আগে কখনও হয়নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন, কোভিড হাসপাতালের মতো জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়নি। যেসব স্থাপনা স্বৈরাচার বা তার দোসরদের নিয়ন্ত্রিত কেবল সেই সব প্রতিষ্ঠানের উপর হামরা চালানো হয়েছিল। কর্নেল মালেক, ব্যারিস্টার হাসনাত, আদেলের মতো স্বৈরাচারের দোসরদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছিল ৯০ এর আন্দোলনে। এটি ছিলো সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনেও ভাঙ্গচুর, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ঐসব কোন ঘটনার সঙ্গেই গত ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের তাণ্ডবের তুলনা করা যায় না। এই দুই দিন হয়েছে রীতিমতো গুপ্ত হামলা, পরিকল্পিত নাশকতা এবং উন্নয়নের চিহ্ন মুছে ফেলার বীভৎস জিঘাংসা। এটি ছিলো ৭১ এর পরাজিত শক্তির প্রতিহিংসার প্রকাশ।
অবশেষে কারফিউ জারি করা হলো। আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামানো হলো সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবারের পর শুক্রবার ঢাকা সহ সারাদেশে যে তান্ডব হয়েছে তার প্রেক্ষিতে সরকারের সামনে কোন বিকল্প ছিলো না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির এই আন্দোলন ছিনতাই করে। যেভাবে সরকারী স্থাপনা গুলো আক্রমণ করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে তা মধ্য যুগীয় পৈশাচিকতা। যারা বাংলাদেশের অস্তীত্ব বিশ্বাস করেনা, এদেশের অগ্রযাত্রায় যারা ঈর্ষান্বিত, এটি তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। এটা কোন আন্দোলন না রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটি কঠোর ভাবে দমন করতেই হবে। কিন্তু পরিস্থিতি এমনটি হবার কথা ছিলো না। কেন এমন সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো?
১৭ জুলাই থেকে দেশে যা হয়েছে তা কোনো আন্দোলন না। এ ঘটনাকে এক কথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমি মনে করি, এটি উন্নয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ধ্বংসস্তূপে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পিত সন্ত্রাস। কোনো শিক্ষার্থী তো নয়ই, ন্যূনতম বিবেকবান মানুষের পক্ষে এ ধরনের বীভৎসতা ঘটানো সম্ভব নয়। যারা এটা করেছে তাদের লক্ষ্য একটাই- বাংলাদেশকে ধ্বংস করা। প্রশ্ন হলো, কারা এটা করতে চায়? এটি কি শুধু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, জঙ্গি এবং বিএনপির নাশকতা? আমি অন্তত তা মনে করি না। বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল-ছাত্রশিবির, জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অবশ্যই এই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু হুট করে তারা এত ক্ষমতাবান কীভাবে হলো? কোথায় এত টাকা-পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র পেল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে নির্মোহভাবে। আর সে কারণেই এ আন্দোলনের শুরু থেকে এর গতি প্রবাহ এবং সময়কাল বিশ্লেষণ জরুরি।
১৬ জুলাই আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি দিন। ২০০৭ সালের এই দিনে মিথ্যা-ভিত্তিহীন মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ধানমন্ডির ‘সুধা সদন’ থেকে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ বাস্তবায়নের জন্য এবং গণতন্ত্রকে চিরস্থায়ীভাবে বিদায় দেয়ার জন্যই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ এবং মইন-উ আহমেদের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশকে ঘিরে একটি নতুন নীল নক্সা প্রণয়ন করেছিলেন। গণতন্ত্রহীন করে রাখতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে। আর সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়।