নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ১৩ নভেম্বর, ২০২১
`লালসালু`কে একটি ছোট্ট পরিসরে রচিত উপন্যাসই বলা যায়। অর্থাৎ কম পৃষ্ঠার বই। এই যেমন- একশো পৃষ্ঠা বা একটু বেশি হবে। তাতে কী হবে! ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হবার পর থেকে কেবল আলোচনায় শীর্ষে নয় একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে এটি । ইংরেজি, উর্দু, ফরাসি প্রভৃতি ভাষায় বিভিন্ন নামকরণে প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজিতে Tree without roots ফরাসিতে Larbre Sans racines ইত্যাদি। ফরাসি অনুবাদটি করেছিলেন লেখকের স্ত্রী অ্যান-মারি-থিবো। উল্লেখ্য, লেখক পৃথিবীর নানাদেশ ভ্রমণ করে ফরাসি দেশেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করেছিলেন।
২) উপন্যাস বা গল্পের ভলিউম দিয়ে এর প্রকৃত গুরুত্ব বিচার্য নয়। বহুভাষাবিদ পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী বলতেন," সাহিত্যকর্ম সংখ্যার হিসাবে নয় উৎকর্ষতার বিষয়ই মূল বিচার্য "। এখানে বলা যায়, এক`শ পৃষ্ঠারও কমের উপন্যাস বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এর `The old man and the sea` ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরষ্কার জিতে নেয় এবং আজ অবধি বিশ্বসাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠ্য। এ প্রজন্ম- সময়ের সেরা হুমায়ুন আহমেদ এর `গৌরীপুর জংশন`ও একশো পৃষ্ঠার কম অথচ এযাবৎ ছয় সাতটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এমন অসংখ্য নজির আমাদের হাতেই আছে।
৩) আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তকের এক কোণায় আলাদা হয়ে পড়ে থাকা কথাসাহিত্যিক, গল্পকার, নাট্যকার,ঔপন্যাসিক,কবি, সম্পাদক,কূটনীতিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আমাদের প্রজন্মই বা কতটুকু জানি? বাংলাসাহিত্যে অস্তিত্ববাদের পরিচায়ক এবং সাহিত্যের ভেতর দিয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অগ্রদূত ছিলেন বীর চট্টলার মাটিতে জন্ম নেয়া মৃত্যুঞ্জয়ী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। জীবদ্দশায় বিচিত্রসব কাজে জড়িয়ে ছিলেন। সাহিত্যাঙ্গনে লেখালেখি খুব বেশি তা নয়। `লালসালু` ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়ে লেখা। যদিও শুর করেছিলেন ১৯৪৫-৪৬ সাল থেকেই। একটি তুলসীগাছের কাহিনী, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো, কয়েকটি নাটক ও গল্প এ-ই। অবশ্য, গল্প রচনা দিয়েই তিনি সাহিত্যে প্রবেশ করেন। স্বল্পায়ুস্কালে তিনি নানাস্থানে সরকারি চাকরি করেছেন, Daily Statesman পত্রিকায় সাব-এডিটর হয়েছেন, প্রেস পাবলিশার্স হয়েছেন। উল্লেখ করা যায়, `লালসালু` উপন্যাসটি তাঁর নিজের পাবলিশার্স হাউস `কমরেড` থেকে নিজেই প্রকাশ করেছিলেন।প্রথমবার মাত্র দুশো কপি ছাপা হয়েছিল। লালসালু`র প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।
৪) উপন্যাসের শুরুটা বেশ নাটকীয়। "শস্যহীন জনবহুল এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোঁয়াটে আকাশকে পর্যন্ত যেন সদা সন্ত্রস্ত করে রাখে। ঘরে কিছু নেই। ভাগাভাগি লুটালুটি আর স্থান বিশেষে খুনাখুনি করে সর্বচেষ্ঠার শেষ"। তৎকালীন সমাজ সংস্কৃতির নানা অসঙ্গতিপূর্ণ চিত্র- কল্পের অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে এ উপন্যাস জুড়ে। "ধর্মের চেয়ে টুপি বেশি, শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি "। লেখকের উক্তিটি প্রায় আশি বছর পরেও নিত্যই চোখের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় এর ব্যতিক্রম নেই বলা যায়। উপন্যাসের মূল চরিত্র খালেক বেপারী, মজিদ আর তার দুই স্ত্রী রহিমা ও কিশোরী জমিলা। গারো পাহাড় থেকে মজিদের আগমন ঘটে মহব্বতনগর গ্রামে। সেখানকার বিচিত্র ঘটনাবলীর বর্ণনা উপন্যাসের পরতে পরতে সৃষ্টি করে দারুণ নাটকীয় আবহ। নিজের অবস্থান ও অস্তিত্বের লক্ষেই মজিদ মহব্বতনগরের মানুষের ধর্মাচারের দুর্বলতায় অনবরত আঘাত হানতে থাকে। ধর্মীয় আচার ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রায় ছিন্নমূল মানুষগুলোকে টার্গেট করে মজিদ। সে একই গ্রামের বিত্তশালী জোতদার খালেক বেপারীকে কূট-কৌশলে শুরুতেই হাত করে ফেলার চেষ্টা করে এবং সে এক পর্যায়ে কামিয়াব হয়। মজিদ তার কথার সম্মোহনী ও চাতুর্যের দ্বারা গ্রামের নিরীহ মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। একটি জীর্ণ-শীর্ণ পুরনো কবরকে পীরের মাজার বলে চালিয়ে দিয়ে সে নিজের পায়ের নিচের মাটিকে শক্ত করতে সামর্থবান হয়ে উঠে। মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে আর্থিক সুবিধাও গ্রহণ করে। সে প্রথমে এক বিধবা যুবতীকে বিয়ে করে। পর্দা করার নামে তাকে প্রায় বন্দী জীবনে রাখে। তাকে হাসতে বারণ, কাঁদতে বারণ, তার কোন স্বাধীনতা নেই। শালিসি, বিচার-আচার করে ধীরে ধীরে মজিদ মহব্বতনগর গ্রামের কর্তা বা প্রভুতে পরিণত হয়। এখানে লেখকের উক্তি, " মাতব্বর না হলে শাস্তিবিধান হয় না, বিচার চলে না। রায় অবশ্য মজিদই দেয়, কিন্তু মাতব্বরের মুখ দিয়ে বেরুলে ভালো দেখায় "।
৫) লালসালু উপন্যাসের নায়ক মজিদ ভণ্ডামি ও লাম্পট্যের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। একদিকে মিথ্যাবাদী, ধর্ম ব্যবসায়ী, সুবিধালোভী মজিদ অন্য দিকে প্রভাবশালী ধনী খালেক বেপারী দু`জনই শাসক এবং শোষক। তবে তাদের কৌশল পৃথক ও ভিন্ন। লেখক বলেন, "একজনের আছে পীরের মাজার আরেক জনের জোতজমি প্রতিপত্তি। অবস্থান না হলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক "। মজিদের ভণ্ডামি ও কপটতা তরুণী বধু জমিলার কাছে ধরা খায়। জমিলা তাকে কিছু মনেই করে না। এখানে সে হেরে যায়। কারণ জমিলার এসব সস্তা নছিহত শোনা বা মেনে চলার বয়সই হয়নি। সত্যিকার অর্থে এ গল্পকথায় চল্লিশের দশকের সমাজ ব্যবস্থা বা গ্রামীণ জনপদের বাস্তব চিত্র ফোটে উঠলেও এর পরিধি ও ব্যাপ্তিতে নিঃসন্দেহে কালোওীর্ণ। কেননা গ্রামের হতদরিদ্র, শিক্ষার আলো বঞ্চিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে লালসালু এক মাইলফলক হয়ে আছে।
৬) অনেকের মন্তব্য এমন যে, বাংলাসাহিত্যের দু`জন সুদর্শন পুরুষ হলেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। দু`জনই ইংরেজি চর্চায় সিরিয়াসলি মনোনিবেশ করেছিলেন। এবং ইংরেজিতে রচনা করেও শেষাবধি মাতৃভাষায় বিখ্যাত হয়েছেন। দু`জনই ফ্রান্সে অর্থাৎ ফরাসি দেশে বসবাস করেছেন এবং ফরাসিকে জীবনসঙ্গী করেছেন। উভয়ই অকাল প্রয়াত হয়েছেন। দু`জনই সমান বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২- ১৯৭১) উভয় প্রতিভাবান মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। তবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ স্বদেশে ফিরে আসেননি বরং বাংলাদেশের মুক্তি - যুদ্ধকালীন সময়ে ১০ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখে প্যারিসেই তাঁর জীবনাবসান হয়।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
সীতাকুণ্ড ট্রাজেডির পরদিন সন্ধ্যায় ফেসবুকে আমি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। '২৫ জুন পর্যন্ত হরতাল বা নাশকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না!' দেশের সমসাময়িক রাজনীতির ধারা হিসাব করলে এমন সম্ভাবনা আসলেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। তারপর কি হলো? ৫ জুন পাবনার বেড়ার কিউলিন ইন্ডাস্ট্রি। ৬ জুন রাজধানীর বছিলার জুতার কারখানা। ১০ জুন রাজধানীর নর্দ্দা এলাকায়...
অনেকেই বলেছিলেন- সম্ভব না। ভাঙা শব্দ দুটি জোড়া লাগিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা আজ জাতির সামনে উপস্থিত। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যার জন্যে অধীর আকুল আগ্রহে গোটা জাতি। বহুল প্রতীক্ষা, কাঙ্ক্ষিত, অনেক সাধনার পরে- ঠিক কোন বিশেষণে জাতির এই মাহেন্দ্রক্ষণটিকে উপস্থাপন করা সম্ভব বুঝতে পারছি না। নিজস্ব অর্থায়নে...
পদ্মা যেন প্রায় সমুদ্র। একেবারে ছোটবেলায় তো আর সমুদ্র দেখিনি। গোপালগঞ্জে দাদার বাড়ি যাওয়ার সময় পাড়ি দিতে হতো পদ্মা নদী। পাড়ি দিয়ে চলে যেতাম, কিন্তু মনের মধ্যে প্রবল হয়ে জেগে থাকত তার অক্ষয় রূপ। কারণ গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে পদ্মা পার হওয়াটাই যেন আসল ঘটনা। স্মৃতি থেকে অন্য সবকিছু মুছে গেলেও পদ্মাকে মুছে দেয় সাধ্য কার! তার সে কী বিশালতা...