ইনসাইড থট

ছুটির দিনে বই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ১৩ নভেম্বর, ২০২১


Thumbnail

`লালসালু`কে একটি ছোট্ট পরিসরে রচিত উপন্যাসই বলা যায়। অর্থাৎ কম পৃষ্ঠার বই। এই যেমন- একশো পৃষ্ঠা বা একটু বেশি হবে। তাতে কী হবে! ১৯৪৮ সালে  প্রকাশিত হবার পর থেকে কেবল আলোচনায় শীর্ষে নয় একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে এটি । ইংরেজি, উর্দু, ফরাসি প্রভৃতি ভাষায় বিভিন্ন নামকরণে প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজিতে Tree without roots ফরাসিতে Larbre Sans racines ইত্যাদি। ফরাসি অনুবাদটি করেছিলেন লেখকের স্ত্রী অ্যান-মারি-থিবো। উল্লেখ্য, লেখক পৃথিবীর নানাদেশ ভ্রমণ করে ফরাসি দেশেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করেছিলেন।

২) উপন্যাস বা গল্পের ভলিউম দিয়ে এর প্রকৃত গুরুত্ব বিচার্য নয়। বহুভাষাবিদ পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী বলতেন," সাহিত্যকর্ম সংখ্যার হিসাবে নয় উৎকর্ষতার বিষয়ই মূল বিচার্য "। এখানে বলা যায়, এক`শ পৃষ্ঠারও কমের উপন্যাস বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এর `The old man and the sea` ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরষ্কার জিতে নেয় এবং আজ অবধি বিশ্বসাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠ্য। এ প্রজন্ম- সময়ের সেরা হুমায়ুন আহমেদ এর `গৌরীপুর জংশন`ও একশো পৃষ্ঠার কম অথচ এযাবৎ ছয় সাতটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এমন অসংখ্য নজির আমাদের হাতেই আছে।

৩)  আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তকের এক কোণায় আলাদা হয়ে পড়ে থাকা কথাসাহিত্যিক, গল্পকার, নাট্যকার,ঔপন্যাসিক,কবি, সম্পাদক,কূটনীতিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আমাদের প্রজন্মই বা কতটুকু জানি? বাংলাসাহিত্যে অস্তিত্ববাদের পরিচায়ক এবং সাহিত্যের ভেতর দিয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অগ্রদূত ছিলেন বীর চট্টলার মাটিতে জন্ম নেয়া মৃত্যুঞ্জয়ী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। জীবদ্দশায় বিচিত্রসব কাজে জড়িয়ে ছিলেন। সাহিত্যাঙ্গনে লেখালেখি খুব বেশি তা নয়। `লালসালু` ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়ে লেখা। যদিও শুর করেছিলেন ১৯৪৫-৪৬ সাল থেকেই। একটি তুলসীগাছের কাহিনী, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো, কয়েকটি নাটক ও গল্প এ-ই। অবশ্য, গল্প রচনা দিয়েই তিনি সাহিত্যে প্রবেশ করেন। স্বল্পায়ুস্কালে তিনি নানাস্থানে সরকারি চাকরি করেছেন, Daily Statesman পত্রিকায় সাব-এডিটর হয়েছেন, প্রেস পাবলিশার্স হয়েছেন। উল্লেখ করা যায়, `লালসালু` উপন্যাসটি তাঁর নিজের পাবলিশার্স হাউস `কমরেড` থেকে নিজেই প্রকাশ করেছিলেন।প্রথমবার মাত্র দুশো কপি ছাপা হয়েছিল। লালসালু`র প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।

৪) উপন্যাসের শুরুটা বেশ নাটকীয়। "শস্যহীন জনবহুল এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোঁয়াটে আকাশকে পর্যন্ত যেন সদা সন্ত্রস্ত করে রাখে। ঘরে কিছু নেই। ভাগাভাগি লুটালুটি আর স্থান বিশেষে খুনাখুনি করে সর্বচেষ্ঠার শেষ"। তৎকালীন সমাজ সংস্কৃতির নানা অসঙ্গতিপূর্ণ চিত্র- কল্পের অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে এ উপন্যাস জুড়ে। "ধর্মের চেয়ে টুপি বেশি, শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি "। লেখকের উক্তিটি প্রায় আশি বছর পরেও নিত্যই চোখের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় এর ব্যতিক্রম নেই বলা যায়। উপন্যাসের মূল চরিত্র খালেক বেপারী, মজিদ আর তার দুই স্ত্রী রহিমা ও কিশোরী জমিলা। গারো পাহাড় থেকে মজিদের আগমন ঘটে মহব্বতনগর গ্রামে। সেখানকার বিচিত্র ঘটনাবলীর বর্ণনা উপন্যাসের পরতে পরতে সৃষ্টি করে দারুণ নাটকীয় আবহ। নিজের অবস্থান ও অস্তিত্বের লক্ষেই মজিদ মহব্বতনগরের মানুষের ধর্মাচারের দুর্বলতায় অনবরত আঘাত হানতে থাকে। ধর্মীয় আচার ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রায় ছিন্নমূল মানুষগুলোকে টার্গেট করে মজিদ। সে একই গ্রামের বিত্তশালী জোতদার খালেক বেপারীকে কূট-কৌশলে শুরুতেই হাত করে ফেলার চেষ্টা করে এবং সে এক পর্যায়ে কামিয়াব হয়। মজিদ তার কথার সম্মোহনী ও চাতুর্যের দ্বারা গ্রামের নিরীহ মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। একটি জীর্ণ-শীর্ণ পুরনো কবরকে পীরের মাজার বলে চালিয়ে দিয়ে সে নিজের পায়ের নিচের মাটিকে শক্ত করতে সামর্থবান হয়ে উঠে। মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে আর্থিক সুবিধাও গ্রহণ করে। সে প্রথমে এক বিধবা যুবতীকে বিয়ে করে। পর্দা করার নামে তাকে প্রায় বন্দী জীবনে রাখে। তাকে হাসতে বারণ, কাঁদতে বারণ, তার কোন স্বাধীনতা নেই। শালিসি, বিচার-আচার করে ধীরে ধীরে মজিদ মহব্বতনগর গ্রামের কর্তা বা প্রভুতে পরিণত হয়। এখানে লেখকের উক্তি, " মাতব্বর না হলে শাস্তিবিধান হয় না, বিচার চলে না। রায় অবশ্য মজিদই দেয়, কিন্তু মাতব্বরের মুখ দিয়ে বেরুলে ভালো দেখায় "।

৫) লালসালু উপন্যাসের নায়ক মজিদ  ভণ্ডামি ও লাম্পট্যের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। একদিকে মিথ্যাবাদী, ধর্ম ব্যবসায়ী, সুবিধালোভী মজিদ অন্য দিকে প্রভাবশালী ধনী খালেক বেপারী দু`জনই শাসক এবং শোষক। তবে তাদের কৌশল পৃথক ও ভিন্ন। লেখক বলেন, "একজনের আছে পীরের মাজার আরেক জনের জোতজমি প্রতিপত্তি। অবস্থান না হলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক "। মজিদের ভণ্ডামি ও কপটতা তরুণী বধু জমিলার কাছে ধরা খায়। জমিলা তাকে কিছু মনেই করে না। এখানে সে হেরে যায়। কারণ জমিলার এসব সস্তা নছিহত শোনা বা মেনে চলার বয়সই হয়নি। সত্যিকার অর্থে এ গল্পকথায় চল্লিশের দশকের সমাজ ব্যবস্থা বা গ্রামীণ জনপদের বাস্তব চিত্র ফোটে উঠলেও এর পরিধি ও ব্যাপ্তিতে নিঃসন্দেহে কালোওীর্ণ। কেননা গ্রামের হতদরিদ্র, শিক্ষার আলো বঞ্চিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে  সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে লালসালু এক মাইলফলক হয়ে আছে।

৬) অনেকের মন্তব্য এমন যে, বাংলাসাহিত্যের দু`জন সুদর্শন পুরুষ হলেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। দু`জনই ইংরেজি চর্চায় সিরিয়াসলি মনোনিবেশ করেছিলেন। এবং ইংরেজিতে রচনা করেও শেষাবধি মাতৃভাষায় বিখ্যাত হয়েছেন। দু`জনই ফ্রান্সে অর্থাৎ ফরাসি দেশে বসবাস করেছেন এবং ফরাসিকে জীবনসঙ্গী করেছেন। উভয়ই অকাল প্রয়াত হয়েছেন। দু`জনই সমান বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২- ১৯৭১) উভয় প্রতিভাবান মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। তবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ স্বদেশে ফিরে আসেননি বরং বাংলাদেশের মুক্তি - যুদ্ধকালীন সময়ে ১০ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখে প্যারিসেই তাঁর জীবনাবসান হয়।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বাংলাদেশকে চাপে রাখতে আমেরিকার নতুন কৌশল


Thumbnail

যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখা কবিতার জন্য বেঁচে থাকবেন। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২২ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার রিপোর্টে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পর্কে মূল্যায়ন প্রতিবেদন করলেন। এই প্রতিবেদন দেখে আমার মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি কবিতার লাইন মনে পড়ল। 
“এতক্ষণে –অরিন্দম কহিলা বিষাদে
শুনেছি, রাক্ষসপতি, মেঘের গর্জনে;…”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেভাবেই ২০১৮ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে এবং গোয়েবলসের তত্ব অনুযায়ী মিথ্যাকে বারবার সত্যি বলে উপস্থাপন করছে, যাতে করে সেটি সত্য বলেই প্রতিষ্ঠিত হয়। 

২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আমি দেশেই ছিলাম। কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোটে হয়ত কিছু গণ্ডগোল হতেই পারে। কিন্তু এটিই সত্য যে, বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, প্রার্থী দিয়েছে এবং তারা বিপুলভাবে পরাজিত হয়েছে। 

২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হবার পর তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান এবং অনেক মার্কিন কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফরেও আসেন। এতদিন এ বিষয়ে কেউ কথা বললেন না। কিন্তু এখন হঠাৎ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তাদের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে তারা যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সস্তা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এখানে লবিস্টের মাধ্যমে কোন লেনদেন হয়েছে। আমাদের দেশে যেটি ঘুষ, আমেরিকায় সেটি লবিস্ট। মূলত শব্দ আলাদা কিন্তু কাজ একই। সুতরাং এটি বাংলাদেশকে চাপে রাখার জন্য আমেরিকার একটি কৌশল বলেই আমার মনে হয়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন রাষ্ট্র প্রধান। বঙ্গবন্ধু যে রকম বাংলাদেশের জন্য মাথানত করেননি, বঙ্গবন্ধুর কন্যাও কোথাও মাথানত করবেন না।

রাজনীতি করতে হয় নীতি এবং আদর্শ রেখে। যারা নীতি এবং আদর্শ রেখে রাজনীতি করে, তাদের নীতি এবং আদর্শ অনন্তকাল মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকে। ঠিক এ কারণেই আওয়ামী লীগ এখনও টিকে আছে। নীতি এবং আদর্শ আছে বলেই বঙ্গবন্ধুর গড়া সংগঠন ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এখনও টিকে আছে। দার্শনিক শেখ হাসিনাও নীতি এবং আদর্শের জায়গায় অনড়। তাই তার ভয়ের কিছু নেই। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সিএনএন’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে অনেক প্রশ্ন এসেছে এবং তিনি খুব স্পষ্টভাবে সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। কোন প্রশ্নই তিনি পাশকাটিয়ে যেতে চাননি যা অনেক রাজনীতিবিদই করে থাকেন। 

সুতরাং, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এটি একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। কিন্তু এই কাচা ষড়যন্ত্র করে কোন লাভ হবে না। কারণ জনগণ এত বোকা না। তারা এসব ষড়যন্ত্র ঠিকই বোঝেন। আমেরিকার এমন কাঁচা ষড়যন্ত্রের দুই পয়সারও দাম নেই। এসব ষড়যন্ত্র করে তারা শেখ হাসিনার কিছুই করতে পারবে না। আমি তাদেরকে বলব যে, অযথা টাকা নষ্ট না করে বরং আপনাদের দেশে যারা খেতে পারে না, চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ যাদের নেই তাদের পেছনে খরচ করুন। তাতে আপনাদের দেশের মানুষই উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ   আমেরিকা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র এবং চাপমুক্ত শেখ হাসিনা


Thumbnail

দেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। গত ১৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশকে একটি মহল অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। তবে তিনি বলেছেন, এমন কোনো চাপ নেই যা শেখ হাসিনাকে দিতে পারে। নির্ভার এবং আত্মবিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী। তার এ আত্মবিশ্বাসী মনোভাবই জাতিকে স্বস্তি দেয়। সাহস দেয়। আওয়ামী লীগ সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন। ঐতিহাসিকভাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ গঠন করলেও আমরা এখন যে আওয়ামী লীগ দেখি সেই আওয়ামী লীগের সত্যিকারের প্রাণভোমরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি ডাকসাইটে আওয়ামী লীগের নেতারাও তাকে ছয় দফা দেওয়ার পর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপরও তিনি আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেছিলেন এবং সেই সুসংগঠিত আওয়ামী লীগ দ্বারাই তিনি দেশকে স্বাধীন করেছেন। কোনো চাপের কাছে জাতির পিতা নতি স্বীকার করেননি। শেখ হাসিনাও সে রকম ভয়হীন একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক। একজন বিশ্বনেতা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি আজকের জায়গায় এসেছেন। প্রতিকূলতাকে জয় করেই তিনি সাফল্যের শিখরে।

সাম্প্রতিককালে অনেক বুদ্ধিজীবী এখন শেখ হাসিনাকে খাটো করার চেষ্টা করছেন। তাদেরই একজন খালেদা জিয়ার রাজনীতির ব্যাপারে লিখেছেন- খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসাটা এমন ছিল না যে ‘এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম’। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন যে, খালেদা জিয়া যে দলে এলেন সেই দল তো ক্যান্টনমেন্টে জন্মগ্রহণ করা দল। সেই সঙ্গে তিনি তুলনা করেছেন যে, শেখ হাসিনা দেশের বাইরে থাকতেই ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ তাকে সভানেত্রী নির্বাচিত করেছিলেন। তিনি এখানে উদাহরণ দিয়েছেন যে, শেখ হাসিনা ‘এলাম দেখলাম এবং জয় করলাম’- এর মতো ১৯৮১ সালে রাজনীতিতে এসেছেন।

শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আসাটা ‘এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম’-এর মতো কখনোই ছিল না। স্কুলজীবনেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ১৯৬২-তে স্কুলের ছাত্রী হয়েও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে তাঁর নেতৃত্বে মিছিল গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, স্কুলের ছাত্রী হিসেবে সরাসরি তখনকার একটি রাজনৈতিক সভায় যোগ দেওয়া শুধু তাঁর সাহসিকতাই নয়, তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতারও পরিচয় বহন করে। সেই সময়ের কথা চিন্তা করলে এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। সুতরাং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৮১ সালে নয় বরং ১৯৬২ সালে। তাঁর পিতা শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়েছেন। তাঁর কন্যা হিসেবে স্বাভবিকভাবেই তাঁর পিতার কাছ থেকে রাজনীতি শিখেছেন। ইচ্ছা না থাকলেও শিখেছেন। কারণ পরিবেশটাই ছিল একটি রাজনীতির কারখানা। তার মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবও ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতিক-সচেতন। যখন মেয়েদের মধ্যে ছাত্রলীগ ছিল না বললেই চলে তখন শেখ হাসিনা গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে (বর্তমানে বদরুননেসা সরকারি মহিলা কলেজ) অধ্যয়নকালে ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে কলেজ ইউনিয়নের সহসভাপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। আমি তখন মেডিকেলে পড়ি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। এ নির্বাচনে দাঁড়ালে শেখ হাসিনা শুধু হারবেনই না কতটা খারাপভাবে হারবেন সেটি নিয়ে আমি তখন ভীষণ চিন্তিত। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি মানতে নারাজ। আমাকে জেদ না দেখালেও তাঁর কথায় বুঝতে পারলাম তিনি ভীষণ জেদি। তিনি বললেন, আমি নির্বাচনে দাঁড়াব এবং জয়ী হব। আপনারা যদি আমাকে নির্বাচনে পোস্টার লাগানো থেকে শুরু করে কোনো সহায়তা করতে পারেন তাহলে ভালো, না পারলে করবেন না। তখন তো মোনায়েম খানের কঠিন যুগ এবং তার পিতা তখন ছয় দফা দিয়েছেন। তারপরও তিনি সহসভাপতি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। ইতোমধ্যে মোনায়েম খান পাবলিকলি বললেন যে, শেখ মুজিবের মেয়ে যদি নির্বাচনে বিজয়ী হয় তাহলে এটা ছয় দফার জন্য ম্যান্ডেট হয়ে যাবে। এ অবস্থার মধ্যেই তিনি নির্বাচন করলেন। তখনকার সময়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা একে অপরের ভাই-বোনের মতোই ছিল এবং আমি একজন ছাত্রলীগকর্মী হিসেবে আরেকজন ছাত্রলীগকর্মীকে যতটুকু পেরেছি সহায়তা করেছি। কিন্তু যখন নির্বাচন শেষ হয়ে গেল এবং নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হবে তখন আমি এবং আমার সঙ্গে দুই ছাত্রলীগের বড় ভাই মাঠে বসে বাদাম খাচ্ছি আর ভাবছি বেশি খারাপভাবে যেন শেখ হাসিনা না হারে। এর মাঝে খবর এলো শেখ হাসিনা নির্বাচনে জিতে গেছেন। আমি প্রথমে এটাকে বিশ্বাস করিনি। পরে আরেকটু খোঁজ নিয়ে দেখলাম এটা সত্য ঘটনা। তার আরও কিছু পরে জানা গেল তিনি শতকরা ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। শেখ হাসিনার তখন থেকেই যে অরগানাইজিং ক্যাপাসিটি এবং নির্বাচনে যে তিনি এভাবে জিততে পারেন এটা আমাদের কারও চিন্তায়ও ছিল না।

বঙ্গবন্ধু যখন কঠিন সময়ে জেলে তখন গুরুত্বপূর্ণ যেসব বার্তা সেগুলো অনেক সময় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব দিতেন। তাকে জেলে যেতে না দিলে গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবরগুলো দলের জন্য শেখ হাসিনাই বহন করতেন এবং সেই খবরগুলো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তখনকার সরকার বা তার এজেন্টরা যদি জানতে পারত তাহলে শেখ হাসিনাকে হত্যাই করে ফেলত। কিন্তু সেই সময়ও তিনি সাহস দেখিয়েছেন যেটি একটি রাজনীতিবিদের জন্য থাকা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কঠিন সময়ে সাহস যারা দেখাতে পারে না তারা রাজনীতিবিদ হতে পারে না। তার প্রমাণ হয়েছে ১৯৭৫-এ, এক-এগারোতে এবং আরও অনেক কঠিন কঠিন সময়ে। সেই সময় শেখ হাসিনা তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং রাজনৈতিক সাহস দেখিয়েছেন।

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সভাপতি হন এবং দলকে সুসংগঠিত করে ২১ বছর পরে প্রতিবিপ্লবীদের প্রতিহত করে আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনেন। প্রতিবিপ্লবীদের প্রতিহত করে ক্ষমতায় আসার ইতিহাস সমগ্র বিশ্বে খুব কমই আছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন শেখ হাসিনা। সুতরাং শেখ হাসিনাকে যদি কেউ ‘এলাম দেখলাম জয় করলাম’ মনে করে পত্রিকায় লেখা ছাপায় তাহলে তারা হচ্ছেন সত্যিকার অর্থে টাকার জন্য নিজেকে বিক্রি করা ব্যক্তি।

শেখ হাসিনার উত্তরণ এবং বিকাশ কোনো ম্যাজিক নয়। বরং সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা এবং আদর্শের জন্যই তিনি সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আজকের জায়গায় এসেছেন। নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র অতীতেও হয়েছে। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রে লাভ হয়নি। আগামী নির্বাচন নিয়েও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল নানা খেলা খেলছে। ড. ইউনূসও মাঠে নেমেছে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এসব চাপকে জয় করেই গণতন্ত্র রক্ষা করবেন শেখ হাসিনা।


লেখক : সাবেক উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, বিএমআরসি।

ইমেইল : modasseraliey@gmail.com


নির্বাচন   ষড়যন্ত্র   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

যাঁর আলোয় আলোকিত বাংলাদেশ


Thumbnail

নিপীড়িত, নিষ্পেষিত আর অধিকার বঞ্চিত বাঙালিকে নির্মম শাসন- শোষণ, অমানবিক নির্যাতন,সর্বোপরি দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে যিনি মুক্ত করেছিলেন, তিনিই বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের এই সুজলা - সুফলা, শস্য - শ্যামলা স্বাধীন দেশটি তাঁরই স্বপ্নের ফসল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের আজকের দিনে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে  জন্মগ্রহণ করেন।আজ জাতির পিতার  ১০৩ তম জন্মবার্ষিকী।  তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন। মাতা সায়েরা খাতুন। এই দম্পতির চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী;তার ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।

টুঙ্গিপাড়া নামক  অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া শেখ পরিবারের সেই ছোট্ট খোকাই হয়ে উঠেছেন একটি জাতির মুক্তির মহানায়ক।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ইতিহাস। ২৩ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম ও দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের সোনালি অর্জন স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ডানাতে  ভর করেই বাঙালি বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের জন্মভূমিকে জায়গা করে দিয়েছে। পরাধীনতার এই শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার অদম্য সাহস জুগিয়েছিলেন জাতির পিতা।  রাজনৈতিক জীবনের প্রথম লগ্ন থেকেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন দেশের জন্য। দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়াই ছিল তার প্রধান ব্রত। তাঁর এই দেশপ্রেম তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত করে বিশ্বব্যাপী। ৫৫ বছরের সংগ্রামী জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। যা তাঁর জীবনের সিকিভাগ। জেল-জুলুমের অমানবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এবং ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে তিনি পরিণত হন জাতির জনক ও বিশ্ব নেতৃত্বে।জাতির পিতার সমগ্র শৈশব পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেছেন এ বাংলার জল, কাদা আর পানিতে।মানুষের অত্যন্ত কাছাকাছি থেকেছেন সেই শিশুকাল থেকেই।শৈশব থেকেই তিনি মানুষের হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।যার প্রতিফলন আমরা তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ্য করি।   শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু উপাধি পান। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বলেন, '... জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি ... আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ।'৭১- এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁরঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিকে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন - "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম;এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম"। বঙ্গবন্ধুর ঐ ডাকে বাংলার আপামর জনতা মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুত হয়েছিল।তাঁরই প্রেরণায় এবং বজ্রকণ্ঠে অনুপ্রাণিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালি আমজনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।  ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাগরে উদিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য। কয়েক লক্ষ মা-বোনের লুণ্ঠিত সম্ভ্রম ও কোলশূন্য আর্তনাদে বিষাদময় আকাশে-বাতাসে উড্ডীন হয় স্বাধীন সোনার বাংলার লাল সবুজের পতাকা।

পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি মুক্তি লাভ করল। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার তাদের কারাগারে রাখতে পারল না। বন্দিজীবন থেকে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্যই হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। পাকি সরকারের বন্দিশালা থেকে সদ্য মুক্ত হওয়ার পর সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন-  " আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ! তখন বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, "আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শস্য- শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব"।

বঙ্গবন্ধু সারাটি জীবন দেশের  মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের তাগিদে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি মনে - প্রাণে চেয়েছিলেন এদেশের খেটে খাওয়া,মেহনতি  মানুষ যেন সুখে থাকে, পেটে অন্ন থাকে, হাতে পয়সা থাকে। এককথায় বাঙালির জীবন যেন হাসি- খুশিতে ভরপুর থাকে। বঙ্গবন্ধু এমন একজন স্বাপ্নিক সত্ত্বা যিনি স্বপ্ন দেখতেন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নিজস্ব অর্জন দিয়ে সাফল্য লাভ করবে। এমনকি পৃথিবীর বুকে নিজস্ব - অর্জন, সম্পদ,কৃতিত্ব দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। জাতির পিতা শোষণহীন- বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তিনি প্রতিনিয়ত ভাবতেন বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে। দারিদ্র্যের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে, বেকারত্ব ঘুঁচে যাবে,সমূলে উৎপাটন হবে  দুর্নীতির বিষদাঁত।সদ্য স্বাধীন দেশকে সোনার বাংলায় পরিনত করতে স্বপ্ন দেখেছেন।উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠন করতে বহুমুখী পরিকল্পনাও করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু চিরকাল মানুষকে  যোগ্য  সম্মান ও মর্যাদা দেয়ার কথা অকপটে বলে গেছেন। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাইতো বলেছেন, "এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে,পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো আত্মা তৃপ্তি পাবে। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা খুব জরুরি "।শেখ মুজিবুর রহমান আপাদমস্তক একজন সত্যিকারের বীর বাঙালি। তিনি চেয়েছিলেন সম্মানের সঙ্গেই  বাঙালি জাতি বেঁচে থাকবে। বাংলার  মানুষ প্রতিনিয়ত  বিভিন্ন ভাবে প্রাপ্ত সম্মান ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে  অফিস,আদালতসহ সরকারি - বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টরে। সাধারণ জনগণ সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন  কর্মচারীর কাছে ইদানিং যেভাবে অপদস্থ হচ্ছে সেটা জাতির পিতাও  পছন্দ করতেন না।তাঁর এই উক্তিতে বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। " সরকারি কর্মচারীদের অনুরোধ করে বলেন, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন"।

বঙ্গবন্ধু বাংলার সাধরণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখলে কখনো স্বাভাবিক থাকতেন না। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর,চোরাকারবারীদের কারণে বাংলার সহজ সরল মানুষগুলো যখন দুর্ভোগ পোহায় তখন অভিভাবক হয়ে এটা মানতে পারতেন না। তাই তো তিনি বলেছিলেন, " দীর্ঘ ৩ বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি,আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরে নাহি শুনে  ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না। বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই"।বঙ্গবন্ধু এমনই ছিলেন, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর মন হু হু কাঁদত।বঙ্গবন্ধু মনে-প্রাণে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি বলেছিলেন, " আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।জনগণের ভোটে জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ চালায়, এর মধ্যে কারও কোনো হাত থাকা উচিত নয়"।

যুগে যুগে ধর্ম নিয়ে বহুদেশে হানাহানি,সংঘাত,রক্তপাত এমনকি জীবনও দিতে হয়েছে মানুষকে। জাতির জনক সবসময় একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন। " আমার রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। মানে ধর্মহীনতা নয়।মুসলমান তার ধর্ম- কর্ম করবে, হিন্দু তার ধর্ম- কর্ম পালন করবে বুদ্ধিস্ট তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টান তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ধর্মের নামে আর ব্যবসা করা যাবে না"।বাঙালি এই কথায় বঙ্গবন্ধুর চোখে  ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্নই দেখতে পেয়েছিল।  বাংলা,বাংলার ইতিহাস ও শেখ মুজিবুর রহমান তিনটি অবিচ্ছিন্ন সত্ত্বা। একটি ছাড়া অন্যটি যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি একটি ছাড়া অন্যটি ব্যাখ্যা করা যায় না।অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু কখনো সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেন নি।বঙ্গবন্ধু যে সবসময়ে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন, তা ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানি শাসকদের মদতে পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়।সেই দাঙ্গাতে হিন্দু পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় আমরা পাই । এই যে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা এগুলো অসাম্প্রদায়িকতার চমৎকার উদাহরণ। বাংলার কৃষক,মজুর আজ বেশি লাঞ্চিত ও অবহেলিত। একশ্রেণির মুনাফালোভী, কালোবাজারী স্বার্থান্বেষী মহলের ন্যায্য মূল্য না দেয়া নামক  বিষাক্ত ছোবলে অতিষ্ঠ আমার কৃষক ভাইয়েরা। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা সেদিনই হবে  যেদিন থেকে বাংলার কৃষক ভাইয়েরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবে। মনে রাখতে হবে কৃষক বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। কৃষকই দেশের আসল নায়ক। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের মুখের অন্ন জোগায়। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো। তাই তিনি সার্বিক কৃষিখাতকে বেশি গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।

নারীর প্রতি যথাযথ আস্থা ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে তিনি অধিক জোর দিয়েছিলেন। পুরুষের সফলতা বা কোন অর্জনে কোন না কোন নারীর ভূমিকা থাকেই।একজন পুরুষের জীবনে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের দিকে দৃষ্টপাত করলেই সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। বঙ্গবন্ধু পুরুষদের উদ্দ্যেশে তাই বলেছেন, " পুরুষ ভাইরা আমার যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে "।শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। শিক্ষার মাধ্যমেই সত্যিকার উন্নতি সম্ভব।  এই মহান নেতা দেশের মানুষকে  সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে,উন্নত রাষ্ট্রে পরিনত করার স্বপ্ন দেখতেন।নকল করে শিক্ষিত না হয়ে, বরং প্রকৃৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেছেন। তাই ছাত্রদের এবং অভিভাবকদের উদ্দ্যেশে তিনি বলেছেন,  " ছাত্র ভাইয়েরা লেখাপড়া করেন। আপনাদের লজ্জা না হলেও আমার মাঝে মধ্যে লজ্জা হয় যখন নকলের কথা শুনি"।অভিভাবকদের উদ্দ্যেশে বলেন, " আমি খবর পাই বাপ- মা নকল নিয়া ছেলেদের - মেয়েদের এগিয়ে দিয়ে আসে। কত বড় জাতি! উঁহু!  জাতি কত নিচু হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু নকল মুক্ত শিক্ষার স্বপ্ন দেখতেন।বঙ্গবন্ধুর দেশে কোন বেকার থাকুক এটা  তিনি কোনভাবেই মানতে পারতেন না। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে যুবক ভাইদের মুক্ত করার চেষ্টা উনি প্রতিনিয়ত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, "এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়"। বাংলার যুবকরা বেকারত্বের হিংস্র থাবায় নিঃশেষ হোক এমনটা জাতির পিতা কখনো চাননি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বদা  দুর্নীতি, চুরি, লুটপাট, অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন।দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন।

বঙ্গবন্ধু তাই বলেছিলেন, "এখনো কিছু সংখ্যক লোক এত রক্ত যাওয়ার পরেও যে সম্পদ আমি ভিক্ষা করে আনি, বাংলার গরিবকে দিয়ে পাঠাই, তার থেকে কিছু অংশ চুরি করে খায়।... এই চোরের দলকে বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে "। অত্যন্ত  দুঃখজনক এই যে, চুরি ও  দুর্নীতিমুক্ত দেশ আজও আমরা পাইনি। চুরি, দুর্নীতি নামক অপছায়া আজও বাংলার মাটিতে  জিইয়ে আছে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে তরুণ বাঙালি। অন্যায়ের কাছে তিনি কোনোদিন মাথা নত করেননি। শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তিনি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি উৎখাত করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন একাধিক বক্তৃতায়।সামাজিক বৈষম্য কমাতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার নির্মূল করতে। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে স্বীকার করতেন তিনি একজন বাঙালি, তার ভাষা বাংলা এবং দেশ বাংলাদেশ'।

৭৫- এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতিকে পরিবার পরিজনসহ হত্যা করা হয়।জাতির পিতার হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ঘাতকদের দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন ঘাতক বিভিন্ন দেশে পলাতক আছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে আত্মগোপন করা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি আবদুল মাজেদকে ঢাকার মিরপুর থেকে আটক এবং তার ফাঁসি কার্যকর মুজিববর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। তিনি আজ জীবিত থাকলে হয়তো খুবই খুশি হতেন।

জাতির পিতার অসামান্য আত্মত্যাগ আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা দেখেছি আলোর মুখ।মূলত তাঁরই আলোয় আলোকিত বাংলাদেশ।

"তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি মহৎ/তাই তব জীবনের রথ /পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার /বারম্বার/তাই/চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই "।- (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

তিনি নেই ঠিকই কিন্তু তাঁর আদর্শ,তাঁর চেতনা,তাঁর মহৎ কীর্তি, তাঁর স্বপ্ন বুকে ধারণ করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে,  পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছেন।হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করেছিলেন।বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নাই। পিতা মুজিবের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলা দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, দারিদ্র্যতা দূর করেছেন।তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল। শেখ হাসিনা সন্ত্রাস এবং জঙ্গি দমনেও সফল। এছাড়া মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে,২০২১ সালের ডেল্টা প্ল্যানের মত মেগা প্ল্যান হাতে নিয়েছে। পদ্মা সেতু,মেট্রোরেল, বঙঙ্গবন্ধু টানেল,এলিভেটেড এক্সপ্রেস,৪ লেনের মহাসড়ক  সর্বোপরি জাতির পিতার প্রদর্শিত পথেই এগিয়ে যাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ।

"সাবাস বাংলাদেশ / এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে-পুড়ে ছারখার /তবু মাথা নোয়াবার নয় "।- (সুকান্ত ভট্টাচার্য)।

জাতির পিতার বাংলাদেশ কারো কাছে মাথা নোয়ায়নি আর নোয়াবেও না।

 আজকের তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের কাণ্ডারি হয়ে যে যার অবস্থান থেকে দেশের অগ্রযাত্রায় কাজ করবে। তাই আজ আমরা যারা নতুন প্রজন্ম আছি, তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর অদম্য সাহস ও প্রজ্ঞায় অনুপ্রাণিত হয়ে হাজারো বঙ্গবন্ধু হয়ে বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবো।আমরা যেন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে জাতিকে উপহার দিতে পারি অর্থনৈতিক মুক্তি, দিতে পারি মানবিক মূল্যবোধের প্রকৃত স্বাধীনতা, নির্মূল করতে পারি জঙ্গিবাদ আর দূর করতে পারি হানাহানি।একই সঙ্গে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তাঁর সুযোগ্য কন্যাকে সহায়তা করবো।জাতির পিতা জন্মদিনে এই হোক প্রত্যয় এই হোক অঙ্গীকার।

মো.আহসান হাবিব

তরুণ কলামিস্ট, সদস্য
বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম
সাবেক শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

১৭ মার্চ: বাঙা‌লি জাতি ও ইতিহাসের কালজয়ী এক মহাপুরুষের আনন্দ আগমণ


Thumbnail

এমন মহাপুরুষ একটি যুগে, একটি কালে, একটি দেশে, একটি জাতির পথ প্রদর্শক রূপে , সর্বোপরি পৃথিবীর ইতিহাসের আলোকিত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে একজনই আসেন।

“ইতিহাসের মহানায়ক “ হওয়ার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ সর্বকালের , সব যুগে জন্ম গ্রহন করেন না  । যুগ যুগান্তরের পরিক্রমায় হাতে গোনা দু-একজন মানুষই শুধু  “ইতিহাসের মহানায়ক “ হতে উঠতে পারেন । ইতিহাস তার আপন গতিতেই সৃষ্টি করে মহানায়কের ।আর সেই মহানায়কই হয়ে উঠেন তার কালের প্রধান কারিগর ও স্হপতি । বঙ্গবন্ধু ছিলেন তেমনই একজন কালজয়ী মহাপুরুষ । যিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন । আবার সেই স্বপ্নের “ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন । বাঙালির মহান মু‌ক্তিদাতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, কালজয়ী মহাপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত ৮টার দিকে মা সায়েরা খাতুনের কোল আলোকিত করে আসেন এই মহাপুরুষ। কোমল অথচ তেজস্বী বাংলা মায়ের মতোই তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ, ১৭ মার্চ বাঙা‌লির এক অপার আন‌ন্দের দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মের সাথে সাথে বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্মের সূচনা হয়েছিল সেই দিনই।

বাঙালির অধিকার-স্বাধীনতা-মুক্তির লড়াইয়ে আত্মপ্রাণ নিবেদিত এবং আত্মত্যাগী-অক্লান্ত-অকুতোভয় তিনিই এই বাংলায় একজন। তিনি বাঙালি জাতির জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছেন, তাঁর জাদুতে বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছিল ঐশ্বরিক শক্তি, তাঁর প্রচেষ্টাতেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল অবস্থান।

মহৎপ্রাণ মহাপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ব্রত ছিল দুঃখিনী বাংলার মুখে হাসি ফোটানো, বাংলার মানুষের যোগ্য সম্মান-প্রাপ্য অধিকার আদায়, তাতে নিজের লাভ বা কারো ক্ষতির চিন্তাও তার চেতনায় ছিল না কখনো।  যতদিন পৃথিবীর নশ্বর বুকে ছিলেন তিনি ততদিন বাঙালি অবাঙালি সর্বোপরি সমগ্র মানবজাতির শুভকামনা নিয়ে দাপিয়ে-কাঁপিয়ে ছিলেন জগৎময়।

আজ জাতি আনন্দ-‌বেদনায় উদযাপন কর‌ছে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপ‌তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্ম‌দিন। ১৯৯৭ সাল থেকে তাঁর জন্মদিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

১৯৩৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলাএ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সামনে সাহসী উপস্থাপনায় সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের ন্যায্য দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দি‌য়ে যি‌নি কি‌শোর ছাত্রনেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন । ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষে অজস্র সহায়হীন  মানুষেরপ্রাণ বাঁচা‌ন তিনি । ১৯৪৬ এর দাঙ্গা প্রতিরোধে অগ্রণী যে কণ্ঠস্বর, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার প্রতিটি মানুষের প্রতিটি মুখের বুলিতে নতুন করে জন্ম নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু । ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৩ অবহেলিত বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের একুশ দফায় থেকে স্বাধীনতার সূর্য হয়ে তিনি জন্মেছেন । ‘৫৮, '৬৬, '৬৯, '৭০, '৭১ এই যে ধারাবা‌হিক সংগ্রা‌মের ইতিহাসে বাংলার মানুষের স্বাধীনতা-স্বাধিকারে বেঁচে থাকার প্রতিদি‌নের অনুপ্রেরণা হ‌য়ে মিশে আছেন তিনি ।

১৯৭১ সাল। স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশ। ৭ মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।অসহযোগ আন্দোলন চলমান। ১৯৭১-এর ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমন্ডির বাসভবনে সাংবাদিকরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছিল । তাঁর কণ্ঠ বেদনার্ত হয় একপর্যায়ে। তিনি বলেন, "আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন।অন্যের খেয়ালে যে-কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু ।"

নিজের জন্মদিন নিয়ে কোনোদিন আলাদা করে ভাবার কোনো প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর মনে এক ভাবনা, মানবতার কল্যাণ কামনা । তাঁর জন্মদিনে তাঁর কাছ থে‌কে মানবতার সেবা ও জয়গান আমাদের প্রাপ্তি। শৈশবে রাস্তার পাশে শীতে কাতর হওয়া বৃদ্ধের গায়ে  নিজের চাদর জড়িয়ে দিয়ে, দুর্দশা পীড়িত মানুষের মনে সাহস যোগাতেন তিনি। ১৯৩৭ সালে  মুষ্টিভিক্ষা করে 'মুসলিম সেবা সমিতি'র মাধ্যমে গ‌রিব ছাত্র-ছাত্রী‌দের পা‌শে দাঁড়ান তিনি । জন্মদিনে এক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, "আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড়ো ও পবিত্র কামনা কী ?  উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার দ্বিধাহীন উত্তর, "জনগণের সার্বিক মুক্তি।"  প্রতিটি মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়, মুক্তির প্রতিটি নিঃশ্বাসে জন্মে থাকেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।

এক জনসভায় বক্তৃতা কালে তিনি বলেছিলেন, "একজন মানুষ আর কী চাইতে পারে- আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে এক নজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে ।" অবহেলিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত, অত্যাচারিত প্রতিটি মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা । সেটি প্রতিফলিত হয়েছে, তাঁর প্রতিটি কর্মে এবং চিন্তায়।


তিনি শুধুই যে বাঙালির জন্য ভাবতেন তা নয় । তার চিন্তা-চেতনা-বোধ ছিল বিশ্বজনীন । ইনিই তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। খুব সাধারণ ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। ধানমন্ডিতে যখন প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় তখন ভালো একটি প্লট নেয়ার জন্য সবার শত অনুরোধ সত্ত্বেও বলেছিলেন, "আগে সবাইকে দাও, তারপর যদি থাকে তখন দেখা যাবে।" আবার বঙ্গবন্ধুই  ১৯৭৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বক্তৃতায় বলেছিলেন, "বিশ্ব আজ দু'ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে ।"

বঙ্গবন্ধু এমন বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন যার হৃদয়তলে আমরা দাঁড়াতে পারি, কিন্তু সমকক্ষ হতে পারি না কেউ। ইতিহাসে অনেক নন্দিত নেতার নাম আছে, কেউ কি আছেন মানব কল্যাণে এত বিস্তৃতভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই অমর অবিসংবাদিত সেই সংগ্রামী নেতা যিনি বলেন, 'একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি ।একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায় । এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা - অক্ষয় ভালোবাসা- যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে ।'

১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক পত্রিকা শেখ মুজিবুর রহমানকে “রাজনীতির কবি” বলে আখ্যায়িত করে লিখেছিলেন, “তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন, সমাবেশে এবং আবেগময় বাগ্মিতায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে তাঁদের সম্মোহিত করে রাখতে পারেন । তিনি রাজনীতির কবি।” পুরোবিশ্ব তাঁর মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেছে । বিশ্বব্যাপী তাঁর মানবতার জয়গান শোনা যায়।

কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বকে হিমালয় পর্বতমালার সাথে তুলনা করে বলেন, ' আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ । বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব । ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়াজ। আই হ্যাভ হ্যাড দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ ।' 

২০০৪ সালের বিবিসি বাংলা সারা বিশ্বে জরিপ চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত করে । ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে কূটনীতিকেরা তাকে ‘ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড' আখ্যা দেয় ।

বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাবেক মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বলেছিলেন -‘শেখ মুজিব ছিলেন একজন শান্তির মানুষ, একজন স্বাধীনতার মানুষ এবং একজন বিশ্বমানব। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু (বাংলাদেশের বন্ধু) নন, তিনি বিশ্ববন্ধুও (বিশ্ববন্ধু)।’

বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও ক্যুরি শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। যারা হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তারা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে । কিন্তু চক্রান্তকারীরা জানে না, বঙ্গবন্ধু কখনো মরেন না । সেদিন বঙ্গবন্ধুর শরীর থেকে যে রক্ত ওরা ঝরিয়েছে সেই রক্তেই আবার নতুন করে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। হন্তারকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের দেহ থেকে রক্ত গ‌ড়ি‌য়ে গ‌ড়ি‌য়ে বাংলার অবারিত প্রকৃ‌তি, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি শ্বাসে-প্রশ্বাসে আরও বেশি করে জে‌গে উ‌ঠেছেন তিনি ।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে, প্রকৃত দেশপ্রেম নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে আমাদের সকলকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে । সেটাই হবে জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ওসম্মান প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ উপায় । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো মৃত্যু নেই, তিনি শুধুই জন্ম নেন,  ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ থেকে আজকের ১৭ই মার্চ পর্যন্ত তিনি আছেন এবং থাকবেন ততদিন পর্যন্ত যতদিন পৃথিবীতে শুভ কর্ম ও চিন্তার জন্ম থাকবে । মানু‌ষের মঙ্গল ও শুভচিন্তার কুঁড়িতে তাঁর অবস্থান । কুঁড়ি প্রস্ফুটিত মানবতার ফুলে মর্ত্যে সর্বক্ষণ হেসে থাকেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে তিনি প্রতিটি শুদ্ধচর্চায় বেঁচে থাকবেন অন্ততকাল।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন যেমন দেখেছিলেন তেমনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ার প্রচেষ্টায় তিনিই ছিলেন সদাসচেষ্ট। ১৯৭১সালে পাকিস্তানি জান্তার ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা বাংলাকে '৭২থেকে '৭৫ এর প্রতিটি দিনের পরিশ্রমে নতুন জীবন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এখনও পর্যন্ত তার সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, পৃথিবীর ইতিহাস যত দিন থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একইভাবে প্রজ্জ্বলিত হবেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে, প্রতিটি মুক্তিকামী, শান্তিকামী, মানবতাবাদীর হৃদয়ে । বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন চিরকাল বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে- পথ দেখাবে । বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতাও ভালোবাসায় বাংলাদেশের ইতিহাস বিনির্মাণের কালজয়ী এ মহাপুরুষকে চিরকাল স্মরণ করবে ।

আজকের এই ১০৩তম জন্মদি‌নে গভীর শ্রদ্ধা জানাই কালজয়ী মহাপুরুষ বাঙা‌লির মু‌ক্তির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।


লেখক : মাহবুবউল আলম হানিফ
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক,
বাংলা‌দেশ আওয়ামী লীগ।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

সুভাষ সিংহ রায়ের ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’

প্রকাশ: ১০:২১ এএম, ১৬ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

বঙ্গবন্ধু গবেষক হিসেবে ২০২৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ সুভাষ সিংহ রায় (জন্ম ১৯৬৬-)লিখেছেন বহুল আলোচিত বিষয় ‘বাকশাল’ নিয়ে ‘‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’’ শিরোনামে ২৪০ পৃষ্ঠার একটি নতুন বই।আমরা যারা বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেখ হাসিনা সম্পর্কে তাঁর গবেষণা কাজের সঙ্গে পরিচিত তারা এক কথায় বলতে পারি তিনি যথার্থভাবেই একজন একাডেমিশিয়ান।সুভাষ সিংহ রায় যখন কথা বলেন তখন যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত যথাস্থানে, যথা প্রয়োজনে ব্যবহার করেন।তাঁর ব্যক্তিগত বিশাল গ্রন্থাগারে অসংখ্য বই রয়েছে।জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে কোনো বিষয়ে রেফারেন্স দিয়ে কথা বলতে শুনবেন শ্রোতৃমণ্ডলী কিংবা পাঠকসমাজ তাঁর লেখায় ব্যবহার করতে দেখবেন নতুন প্রকাশিত বিখ্যাত বইয়ের উদ্ধৃতি নির্দ্বিধায়, অবলীলায়। স্মৃতিশক্তির প্রখরতায় তিনি মেধা ও মননের অনন্য পরিব্রাজক।লেখাবাহুল্য, তিনি আপদমস্তক প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার অধিকারী একজন লেখক।সমাজ ও মানুষকে তিনি বিশ্লেষণ করেন পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে।

ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী কর্মী ও নেতা সুভাষ সিংহ রায় সমকাল সচেতন এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইতিহাসের গতিমুখ সম্পর্কে  সত্যান্বেষী। এজন্য বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তা, তাঁর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন ও শাসনকাল এবং দেশ-জাতি নিয়ে তাঁর ভাবনা-বিশ্বাস সম্পর্কিত রচনা, বক্তব্য-ভাষণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রন্থসমূহ নিবিড়ভাবে পাঠ করে সাধারণ পাঠকের জন্য নিজের লেখনি দাঁড় করিয়েছেন তিনি। ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’গ্রন্থটি পাঠ করলে সুভাষ সিংহের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার পরিধি মাপা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কেবল এ গ্রন্থটি নয় তাঁর  প্রকাশিত ২৫টি গ্রন্থের মধ্যে আরো রয়েছে- ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু পরিবার’, ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা’, ‘বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িকতা’, ‘পাঠক বঙ্গবন্ধু লেখক বঙ্গবন্ধু’ প্রভৃতি। এছাড়া তিনি শেখ হাসিনাকে নিয়ে সর্বাধিক গ্রন্থের রচয়িতাও।‘‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’’-এর ফ্ল্যাপে বইটির পরিচয় রয়েছে এভাবে-‘স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি হয়েছিল, ‘‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে।” যার ফলে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বহু লালিত স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ কর্মসূচির মাধ্যমে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত কার্যকরী মাধ্যম ছিল জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি মাত্র রাজনৈতিক দল ‘বাকশাল’। জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে তখনকার বিশ্ব বাস্তবতায় একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক কর্মসূচিকে ঈপ্সিত লক্ষাভিমুখী দক্ষভাবে পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ‘‘উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে সব দলের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করেন বঙ্গবন্ধু।’’ বাকশালের মূল লক্ষ্য ছিল একটি শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও শোষিতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা; যা ছিল জনগণের যুগ যুগের লালিত স্বপ্নের মহত্তম আকাঙ্ক্ষার গৌরবময় বহিঃপ্রকাশ। বাকশাল কর্মসূচিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এক. রাজনৈতিক, দুই. আর্থ-সামাজিক, তিন. প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা- এই বইটিতে যার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠনের পূর্বে ও পরে পার্লামেন্ট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা এবং গণভবনে জেলা গভর্নর ও বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই ভাষণগুলোর সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ এবং এতে নিহিত বাকশাল কর্মসূচির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে বইটিতে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থবাদীরা পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, যাতে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে দেশ অগ্রসর হতে না পারে। এই বইটিতে ইতিহাসের সেই অধ্যায়কেই পাঠকের নিকট তুলে ধরা হয়েছে, যা পনেরোই আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার ভেতর দিয়ে পরিসমাপ্ত হয়েছে।’

আলোচ্য গ্রন্থের প্রতিপাদ্য অনুধাবনের জন্য গ্রন্থ-পরিচিতির এই অংশটি পাঠকদের জন্য সহায়ক। প্রকৃতপক্ষে সুভাষ সিংহ রায় বাকশাল কি এই পরিচয় দিয়ে শুরু করে বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্য, বাকশালের ধারাসমূহ, সংবিধানের ধারা, কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রভৃতির অনুপুঙ্খ বিবরণ উপস্থাপন করেছেন।লেখকের ভাষ্য-‘তারিখটা ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। বেশ কিছুদিন ধরেই জল্পনা-কল্পনা চলছিল, দেশে একটা পরিবর্তন আসন্ন। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল ও কার্যনির্বাহী পরিষদের যৌথসভায় জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনীয় যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সার্বিকভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর অর্পণ করা হয়। নয়া ব্যবস্থার রূপকাঠামো কী হবে তা পরিষ্কার উল্লেখ না করেও আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিয়ে আসছিলেন। সন্দেহবাদীদের সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সত্যিই এলো প্রতীক্ষিত সেই দিন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্ট ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা। তিনি বললেন, জনাব স্পীকার, আজ আমাদের শাসনতন্ত্রের কিছু অংশ সংশোধন করতে হলো। আপনার মনে আছে, যখন শাসনতন্ত্র পাস করা হয়, তখন আমি এ হাউজের পক্ষ থেকে বলেছিলাম, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যদি দরকার হয়, তবে এই সংবিধানেরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হবে।’ (পৃ ৫৭)

অন্যত্র- ‘সংসদের চৌহদ্দির মধ্যেই নয়, নেতা এলেন এবার জনতার মাঝে, সরাসরি কথা বলতে। ১৯৭৫, ২৬ মার্চ, স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখানে সেদিন মানুষের ঢল নেমেছিল। জীবনের শেষ জনসভায় ভাষণ দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অগ্নিঝড়া সেই কণ্ঠস্বর শেষবারের মতো মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন জাগ্রত করেছিল। তিনি বললেন। মানুষ শুনলেন।’ (পৃ ৭৪)

অন্যদিকে ‘‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল’’ গ্রন্থে পর্যায়ক্রমে আছে, পার্লামেন্টে ভাষণ : বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক, দ্বিতীয় অধ্যায় হলো-সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণ, তৃতীয় অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন। ‘বঙ্গভবনে বাকশাল প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে বিশদ আলোচনা। একদলীয় ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ ও দেশ-বিদেশে অভিনন্দিত করার বিবরণের ঘটনাপঞ্জি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বিস্তৃত পরিসরে।

বঙ্গবন্ধু গবেষক সুভাষ সিংহ রায়ের লেখনির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সহজ গদ্যে সংহত কথন। ‘কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বঙ্গবন্ধু’ অংশে তিনি দেখিয়েছেন ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির ওপর।তাই সেই কমিটির সদস্যদের নিয়ে বসেছিলেন চেয়ারম্যান শেখ মুজিব। কর্মসূচি ব্যাখ্যা করার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন করে দিয়েছিলেন তাদের দায়িত্ব সম্পর্কেও।বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার ভাষণের মাঝে ছিল দ্বিতীয় বিপ্লব পরিচালনার কর্মসূচি, যার চুম্বক অংশ নিম্নরূপ- ‘১. নতুন পদ্ধতি। ৬০ জেলার প্রত্যেকক জেলায় একজন করে গভর্নর থাকবে; ২. স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। এখানে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, ‘‘সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুভাবে বসবাস করা আমাদের কর্তব্য। কোনো যুদ্ধজোটে আমাদের যোগদান করার কথা চিন্তা করাও জঘন্য পাপ। কারণ আমাদের বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য সাহায্য করা দরকার।”৩. একতা মঙ্গলের পথ; ৪.  আত্মসমালোচনা চাই- আত্মসমালোচনা না থাকলে আত্মশুদ্ধি করা যায় না; ৫. ডেডিকেটেট ওয়ার্কার চাই; ৬. নতুন করে গড়তে হবে- সমবায় পদ্ধতি চালু; ৭. ১০০ বিঘার বেশি জমি থাকবে না; ৮. অর্থনৈতিক অগ্রগতি- সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চাই; ৯. শোষণহীন সমাজ গঠনের পথ; ১০. দুর্নীতিমুক্ত দেশ।’(পৃ ১০৬)

লেখক জানিয়েছেন, একটা গণতান্ত্রিক প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল দ্বিতীয় বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে সারাদেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। নিযুক্ত হন ৬১ জন গভর্নর।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন