নিতুর সাথে প্রথম দেখা কলেজের নবীন বরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। নজরুল গীতি গাইছিল সে।
'শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে।'
অপূর্ব সেই কণ্ঠ। প্রথম দেখায় প্রেম বলে যে একটা ব্যাপার সত্যিই আছে, এটা নিতুর সাথে দেখা না হলে হয়তো কখনোই জানা হতো না জাহিদের। ঠিক যেন একটা পুতুল। সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। গান গাইছে। বিশেষ করে গানের ওই লাইনগুলো, 'ঝড়িবে পূবালী বায় গহন দূর বনে, রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।' ঠিক যেন জাহিদের মনের কথাগুলোই লিখেছে কাজী নজরুল, আর গাইছে নিতু।
সেই দিন থেকেই জাহিদের মাথা খারাপের মতো অবস্থা হলো। এই মেয়েকে তার চাই-ই চাই।
মনে প্রেম প্রেম ভাব এলেই তো হলো না, কথাটা নিতুকে তো জানাতে হবে।সেই উপায় নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। খুবই আদরের। তার উপরে সুন্দরী।বাসা থেকে কলেজ, সার্বক্ষণিক মায়ের সাথেই দেখা যায় তাকে।ক্লাসেও যে কথা বলবে সেই উপায়ও নেই।জাহিদ এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আর নিতু মানবিক বিভাগের।জাহিদ একবার ভেবেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে মানবিক বিভাগের ক্লাসে ঢুকে যাবে কি না।কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা মাথা থেকে বাদ দিতে হলো।ধরা পড়লে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হবে। ভাইস প্রিন্সিপাল জয়নাল স্যার বাবার পরিচিত।নির্ঘাত বাবাকে ফোন দিয়ে বসবেন।এমনিতেই লেখাপড়ার অবস্থা ভালো না, এর মধ্যে বাবাকে খবর দিলে কেয়ামত নেমে আসবে।
মন খারাপের এমন দিনে হুট করেই সমাধান নিয়ে হাজির হলো বন্ধু শ্যামল। সে বলল, 'তুই এক কাজ কর, গানের ক্লাসে ভর্তি হয়ে যা।'
'গান! আমি?'
'হ্যাঁ, তুই। তোর গানের গলা ভালো।নিতু যেখানে গান শেখে, ওস্তাদ আকমল আলী মৃধার ওখানে ভর্তি হয়ে যা।মন দিয়ে গানটা রপ্ত কর, তাহলে নিতুর সাথে ডুয়েট গাইতে পারবি।আর সেই অযুহাতে কাছাকাছি আসার সুযোগ পাবি।এটা ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় দেখি না।তাছাড়া ওর এএসপি বাবা যদি জানতে পারে, তোর খবর আছে।'
কথাটা মনে ধরলো জাহিদের।কী দরকার পুলিশ ক্ষেপিয়ে? এএসপি সাহেবকে এড়িয়ে প্রেম জমাতে হলে ওস্তাদ আকমল আলী মৃধার ওখানে নজরুল গীতি শেখা ছাড়া আপাতত উপায় নেই।
নজরুল গীতির কল্যাণে জাহিদের কপাল খুলে গেল। টুকটাক কথা শুরু হলো।কবি নজরুলকে নিয়ে নিতুর পাশাপাশি তার মায়েরও অনেক আগ্রহ।সুযোগটা লুফে নিলো সে। কবি নজরুলকে নিয়ে যেখানে যত লেখা পায়, সব পড়ে।আর সেই গল্প দিয়ে নিতু এবং তার মাকে মুগ্ধ করে।নিতুর চেয়ে তার মা রেহানা বেগম মুগ্ধ হয় বেশি। ছেলেটা মেধাবী। প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকান তিনি। মুগ্ধতার পাশাপাশি বিস্মিত হয় আরও একজন।ওস্তাদ আকমল আলী মৃধা।এত বছর নজরুল গীতি শেখাচ্ছেন, কিন্তু এতটা আগ্রহ নিয়ে শিখতে কাউকে দেখেননি আগে। এই ছেলে অনেকদূর যাবে।নিজের ভেতরের সবটুকু জ্ঞান উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করেন না তিনি।
কবি নজরুলকে নিয়ে পড়তে পড়তে জাহিদের একরকম নেশার মতো হয়ে যায়।বিচিত্র এই কবি জীবন। ছেলেবেলা থেকেই সংগ্রামের, দ্রোহের, প্রেমের।বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ জন্ম নেয়া মানুষটা ছেলেবেলা থেকেই লড়েছেন দারিদ্রের সঙ্গে। নজরুলের বড় আরও তিন ভাই ছিল কিন্তু তারা জন্মের কিছুদিন পরপরই মারা যায় ।সন্তান হওয়ার পরপরই অন্যান্য ছেলেরা মারা যাওয়ায় নজরুলের দাদি তার নাম রেখেছিল দুখু মিয়া। এই দুখু মিয়াই একদিন মহাকবিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, কী লিখেননি তিনি? নিজেই লিখতেন গান, দিতেন সেইসব গানের সুর এবং সেই সাথে গাইতেনও।এছাড়াও সাংবাদিক হিসেবে ধরেছিলেন কলম এবং রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য করেছিলেন নানা আন্দোলন।ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কারণে কাজী নজরুল ইসলামকে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
এরইমধ্যে নিতুদের বাসায় যাওয়া-আসা শুরু হয়েছে জাহিদের। পুলিশ কোয়ার্টার।নজরুলবিষয়ক আড্ডার পরে শুরু হয় গান। জাহিদের কণ্ঠ দারুণ।দরদ দিয়ে নজরুল গীতি গায়। আশেপাশের অনেকেই শুনতে আসে।যেন তার কণ্ঠের জন্যই কবি নজরুল গানগুলো লিখেছেন।মায়ের পাশাপাশি নিতুও যে ধীরে ধীরে তার ভক্ত হয়ে উঠছে সেটা জাহিদের বুঝতে কষ্ট হয় না।একদিন সে বলে, জাহিদ ভাই 'আলগা করো গো খোপার বাঁধন' এই গানটা করেন তো! ওওই দিনগুলো খুবই আনন্দে যায় জাহিদের। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।
এভাবেই একসময় হুট করে এইচএসসি পরীক্ষার সময় চলে এলো।কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে জাহিদ গাইলো 'আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি তারে আমি আপনায়।'
নিতুকেও গাইতে হলো, 'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।'
দুজনই নিজেদের কণ্ঠের মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো সবার মাঝে।
সেটাই ছিল জাহিদের সাথে নিতুর শেষ দেখা। নিতুর বাবার সরকারি চাকরি।বদলি হয়েছিল অন্য জেলায়। পরীক্ষা দিয়েই তারা চলে যায় দিনাজপুর।জাহিদ থেকে গেল, কুমিল্লায়। একা।
বাইশ বছর পর...
জাতীয় শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অতিথি বিচারক হিসেবে এসেছেন স্বনামধন্যনজরুল গীতি গায়ক জাহিদ হাসান। চিরকুমার মানুষটার অনেক ব্যস্ততা।দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই মানুষটাকে অনুষ্ঠানে আনতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আয়োজকদের।স্বয়ং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ফোন করে শিডিউল নিয়েছেন।সেরা দশজনের গান শুনবেন তিনি। এখান থেকেই নির্বাচিত করবেন সেরা গায়ক।
বেশ কিছু গান হয়ে যাওয়ার পরে, হঠাৎ একটা কণ্ঠে চমকে উঠলেন জাহিদ হাসান।বাচ্চা একটা মেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে, 'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।'
একী! এ তো সেই কণ্ঠ! এত বছর পরেও সেই কণ্ঠ চিনতে ভুল হয় না জাহিদের।মেয়েটা নিশ্চয়ই তার মায়ের কণ্ঠ পেয়েছে। তার চোখ দুটো দর্শক সাড়িতে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। দেখা হলে শুধু একটিবার জিজ্ঞেস করবে, ‘কেমন আছো নিতু? আসলেই তোমাকে ভুলতে দাওনি।'
নিতুকে দেখা যাচ্ছে না। তবুও তিনি খুঁজে যাচ্ছেন।পেছনে ভেসে আসছে নজরুলের গান।
'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।'
[তৌফিক মিথুন : কথাসাহিত্যিক ও কবি]
মন্তব্য করুন
একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক মারা গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন।
বুধবার (২৪ জুলাই) দিবাগত রাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে তার মরদেহ রাজধানীর ভাটারার বাসায় আনা হবে। এরপর জানাজা শেষে নেয়া হবে চট্টগ্রামে। সেখানেই তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
ড. মাহবুবুল হক প্রবন্ধে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া গবেষণায় অবদান রাখায় ২০১৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
ড. মাহবুবুল হক ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর ফরিদপুরের মধুখালিতে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর বেড়ে ওঠেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান), ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯৭ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন।
তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে: বাংলা বানানের নিয়ম, রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্র ভাবনা, ইতিহাস ও সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লোক সংস্কৃতি এবং বাংলার লোক সাহিত্য: সমাজ ও সংস্কৃতি প্রভৃতি।
মন্তব্য করুন
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ছোটকাগজ সম্পাদনায় বিশেষ অবদান রাখায় চলনবিল সাহিত্য পুরস্কার পেলেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ছোটকাগজ ‘হৃদয়ে চলনথ এর সম্পাদক কবি হাদিউল হৃদয়। হাদিউল হৃদয় তাড়াশ প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দৈনিক কালবেলা পত্রিকার তাড়াশ উপজেলা প্রতিনিধি।
শুক্রবার (১২ জুলাই') সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরীর হল রুমে আনুষ্ঠানিকভাবে কবি কণ্ঠে কবিতা সংগঠন থেকে প্রধান অতিথি তাড়াশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. মনিরুজ্জামান মনি এ পুরস্কার স্মারক ও সনদপত্র তুলে দেন।
সাবিনা ইয়াসমিন বিনুর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন মল্লিকী। আলোচনা সভায় সংগঠনের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক রাজুর সভাপতিত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন, তাড়াশ পৌরসভার কাউন্সিলর রোখসানা খাতুন রুপা, পাবলিক লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক মোজ্জামেল হক মাসুদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক হোসনেয়ারা নাসরিন দোলন, যুগ্ম সম্পাদক লুৎফর রহমান, উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা সোহাগ, প্রভাষক আব্দুল কাদের, প্রভাষক আব্দুল মতিন প্রমূখ।
উল্লেখ্য, হাদিউল হৃদয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র তাড়াশ উপজেলার তালম ইউনিয়নের পল্লীর নিভূত অজোপাড়া পাড়িল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত্ব মুসলিম পরিবারে জন্ম। তিনি একজন সাংবাদিক ও সাহিত্য কর্মী। মূলতঃ কবিতা দিয়ে শুরু করলেও প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য ও ছড়া লিখেন। তার লেখা লিটলম্যাগ ও দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। তার সম্পাদনা হৃদয়ে চলন ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১২টি সংখ্যা প্রকাশ হয়েছে। সম্পাদনার স্বীকৃতিস্বরূপ এর আগেও বিভিন্ন সংগঠন থেকে পেয়েছেন সম্মাননা ও পুরস্কার।'
মন্তব্য করুন