লিট ইনসাইড

তবু আমারে দেবনা ভুলিতে

প্রকাশ: ০৮:১৯ এএম, ২৬ মে, ২০২৩


Thumbnail

নিতুর সাথে প্রথম দেখা কলেজের নবীন বরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। নজরুল গীতি গাইছিল সে।

'শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে।'

অপূর্ব সেই কণ্ঠ। প্রথম দেখায় প্রেম বলে যে একটা ব্যাপার সত্যিই আছে, এটা নিতুর সাথে দেখা না হলে হয়তো কখনোই জানা হতো না জাহিদের। ঠিক যেন একটা পুতুল। সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। গান গাইছে। বিশেষ করে গানের ওই লাইনগুলো, 'ঝড়িবে পূবালী বায় গহন দূর বনে, রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।' ঠিক যেন  জাহিদের মনের কথাগুলোই লিখেছে কাজী নজরুল, আর গাইছে নিতু।

সেই দিন থেকেই জাহিদের মাথা খারাপের মতো অবস্থা হলো। এই মেয়েকে তার চাই-ই চাই। 

মনে প্রেম প্রেম ভাব এলেই তো হলো না, কথাটা নিতুকে তো জানাতে হবে।সেই উপায় নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। খুবই আদরের। তার উপরে সুন্দরী।বাসা থেকে কলেজ, সার্বক্ষণিক মায়ের সাথেই দেখা যায় তাকে।ক্লাসেও যে কথা বলবে সেই উপায়ও নেই।জাহিদ এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আর নিতু মানবিক বিভাগের।জাহিদ একবার ভেবেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে মানবিক বিভাগের ক্লাসে ঢুকে যাবে কি না।কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা মাথা থেকে বাদ দিতে হলো।ধরা পড়লে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হবে। ভাইস প্রিন্সিপাল জয়নাল স্যার বাবার পরিচিত।নির্ঘাত বাবাকে ফোন দিয়ে বসবেন।এমনিতেই লেখাপড়ার অবস্থা ভালো না, এর মধ্যে বাবাকে খবর দিলে কেয়ামত নেমে আসবে।

মন খারাপের এমন দিনে হুট করেই সমাধান নিয়ে হাজির হলো বন্ধু শ্যামল। সে বলল, 'তুই এক কাজ কর, গানের ক্লাসে ভর্তি হয়ে যা।'

'গান! আমি?'

'হ্যাঁ, তুই। তোর গানের গলা ভালো।নিতু যেখানে গান শেখে, ওস্তাদ আকমল আলী মৃধার ওখানে ভর্তি হয়ে যা।মন দিয়ে গানটা রপ্ত কর, তাহলে নিতুর সাথে ডুয়েট গাইতে পারবি।আর সেই অযুহাতে কাছাকাছি আসার সুযোগ পাবি।এটা ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় দেখি না।তাছাড়া ওর এএসপি বাবা যদি জানতে পারে, তোর খবর আছে।'

কথাটা মনে ধরলো জাহিদের।কী দরকার পুলিশ ক্ষেপিয়ে? এএসপি সাহেবকে এড়িয়ে প্রেম জমাতে হলে ওস্তাদ আকমল আলী মৃধার ওখানে নজরুল গীতি শেখা ছাড়া আপাতত উপায় নেই।

নজরুল গীতির কল্যাণে জাহিদের কপাল খুলে গেল। টুকটাক কথা শুরু হলো।কবি নজরুলকে নিয়ে নিতুর পাশাপাশি তার মায়েরও অনেক আগ্রহ।সুযোগটা লুফে নিলো সে। কবি নজরুলকে নিয়ে যেখানে যত লেখা পায়, সব পড়ে।আর সেই গল্প দিয়ে নিতু এবং তার মাকে মুগ্ধ করে।নিতুর চেয়ে তার মা রেহানা বেগম মুগ্ধ হয় বেশি। ছেলেটা মেধাবী। প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে তাকান তিনি। মুগ্ধতার পাশাপাশি বিস্মিত হয় আরও একজন।ওস্তাদ আকমল আলী মৃধা।এত বছর নজরুল গীতি শেখাচ্ছেন, কিন্তু এতটা আগ্রহ নিয়ে শিখতে কাউকে দেখেননি আগে। এই ছেলে অনেকদূর যাবে।নিজের ভেতরের সবটুকু জ্ঞান উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করেন না তিনি।

কবি নজরুলকে নিয়ে পড়তে পড়তে জাহিদের একরকম নেশার মতো হয়ে যায়।বিচিত্র এই কবি জীবন। ছেলেবেলা থেকেই সংগ্রামের, দ্রোহের, প্রেমের।বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ জন্ম নেয়া মানুষটা ছেলেবেলা থেকেই লড়েছেন দারিদ্রের সঙ্গে। নজরুলের বড় আরও তিন ভাই ছিল কিন্তু তারা জন্মের কিছুদিন পরপরই মারা যায় ।সন্তান হওয়ার পরপরই অন্যান্য ছেলেরা মারা যাওয়ায় নজরুলের দাদি তার নাম রেখেছিল দুখু মিয়া। এই দুখু মিয়াই একদিন মহাকবিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, কী লিখেননি তিনি? নিজেই লিখতেন গান, দিতেন সেইসব গানের সুর এবং সেই সাথে গাইতেনও।এছাড়াও সাংবাদিক হিসেবে ধরেছিলেন কলম এবং রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য করেছিলেন নানা আন্দোলন।ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কারণে কাজী নজরুল ইসলামকে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

এরইমধ্যে নিতুদের বাসায় যাওয়া-আসা শুরু হয়েছে জাহিদের। পুলিশ কোয়ার্টার।নজরুলবিষয়ক আড্ডার পরে শুরু হয় গান। জাহিদের কণ্ঠ দারুণ।দরদ দিয়ে নজরুল গীতি গায়। আশেপাশের অনেকেই শুনতে আসে।যেন তার কণ্ঠের জন্যই কবি নজরুল গানগুলো লিখেছেন।মায়ের পাশাপাশি নিতুও যে ধীরে ধীরে তার ভক্ত হয়ে উঠছে সেটা জাহিদের বুঝতে কষ্ট হয় না।একদিন সে বলে, জাহিদ ভাই 'আলগা করো গো খোপার বাঁধন' এই গানটা করেন তো! ওওই দিনগুলো খুবই আনন্দে যায় জাহিদের। অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।

এভাবেই একসময় হুট করে এইচএসসি পরীক্ষার সময় চলে এলো।কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে জাহিদ গাইলো 'আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি তারে আমি আপনায়।'

নিতুকেও গাইতে হলো, 'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।'

দুজনই নিজেদের কণ্ঠের মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো সবার মাঝে।

সেটাই ছিল জাহিদের সাথে নিতুর শেষ দেখা। নিতুর বাবার সরকারি চাকরি।বদলি হয়েছিল অন্য জেলায়। পরীক্ষা দিয়েই তারা চলে যায় দিনাজপুর।জাহিদ থেকে গেল, কুমিল্লায়। একা।

বাইশ বছর পর...

জাতীয় শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অতিথি বিচারক হিসেবে এসেছেন স্বনামধন্যনজরুল গীতি গায়ক জাহিদ হাসান। চিরকুমার মানুষটার অনেক ব্যস্ততা।দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এই মানুষটাকে অনুষ্ঠানে আনতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আয়োজকদের।স্বয়ং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ফোন করে শিডিউল নিয়েছেন।সেরা দশজনের গান শুনবেন তিনি। এখান থেকেই নির্বাচিত করবেন সেরা গায়ক।

বেশ কিছু গান হয়ে যাওয়ার পরে, হঠাৎ একটা কণ্ঠে চমকে উঠলেন জাহিদ হাসান।বাচ্চা একটা মেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে,  'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।'

একী! এ তো সেই কণ্ঠ!  এত বছর পরেও সেই কণ্ঠ চিনতে ভুল হয় না জাহিদের।মেয়েটা নিশ্চয়ই তার মায়ের কণ্ঠ পেয়েছে। তার চোখ দুটো দর্শক সাড়িতে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। দেখা হলে শুধু একটিবার জিজ্ঞেস করবে, ‘কেমন আছো নিতু? আসলেই তোমাকে ভুলতে দাওনি।'

নিতুকে দেখা যাচ্ছে না। তবুও তিনি খুঁজে যাচ্ছেন।পেছনে ভেসে আসছে নজরুলের গান।

'আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।' 

[তৌফিক মিথুন : কথাসাহিত্যিক ও কবি]



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

বন্ধুত্ব

প্রকাশ: ০৮:৩৯ পিএম, ২৬ মে, ২০২৩


Thumbnail

নীলা মধ্যবয়সী একজন নারী। সকাল থেকে রাত কাটে সংসারের চার দেয়ালের মাঝে। খুব সকালে উঠে ছেলে আর বরের জন্য নাস্তা বানায়। টেবিলে সাজিয়ে তারপর ওদের ডাকে। ওরা যে যার মতো উঠে খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। খাবার টেবিলে ছেলে ফোন নিয়ে থাকে। বরেরও তাড়া থাকে। টুকটাক দু’একটা কথা ছাড়া তেমন কোনো কথাই হয় না কারও সাথে। কারও কোনো সময় নেই নীলাকে দেবার। যে যার মতো খুব ব্যস্ত। রোজ কত কথা জমে থাকে নীলার মনে! একাকিত্বটা দিন দিন নীলাকে বড় বিমর্ষ করে তুলছে।

নীলার শরীরটা কিছুদিন ধরে বেশ খারাপ। হাসবেন্ড আসিফকে বলল, ‘আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি এসো ডাক্তারের কাছে যাব।’ আসিফ বলল, ‘সম্ভব নয়। একা চলে যেও। তুমি তো আর বাচ্চা নও যে সঙ্গে আমাকে যেতে হবে।’ কথাটা শুনে নীলার খুব মন খারাপ হলো। বয়স হয়েছে বলেই কি বরের সাথে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে না! বিকেলে সে একাই চলে গেল ডাক্তারের কাছে। ফেরার সময় হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাঁটছিল ও। হঠাৎ পাশের একটা রুম থেকে কারও প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পেল। ওর এত খারাপ লাগছিল যে, ও রুমে উঁকি দিল। দরজা খোলাই ছিল। দেখে ডাক্তার নার্স সবাই একজন মহিলাকে চেপে ধরে আছে। কিন্তু সে স্যালাইন হাতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আর চিৎকার করছে। দেখে নীলার এত কষ্ট লাগছে! কি কষ্ট পাচ্ছে মানুষটা! নার্স একটা ইনজেকশন পুশ করল। ধীরে ধীরে মহিলাটি শান্ত হলো। নীলা এবার ভালো করে মহিলার মুখটি দেখতে পেল। চেনা চেনা লাগছে। এবার ভালো করে দেখে। আরে! এত ওর কলেজ জীবনের বান্ধবী রুবি। কিন্তু একি অবস্থা ওর! কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি আজ এরকম হয়ে গেছে কিভাবে! শুকিয়ে কংকাল। সেই রূপ কোথায় ওর! বেশ কিছু বছরের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন হয়ে যায় মানুষের! তাছাড়া ওর কি হয়েছে যে এত কষ্ট পাচ্ছে! এসব ভাবতে ভাবতেই নীলা রুবির কাছে গেল। রুবি এখন অনেক শান্ত। ‘চিনতে পারছিস?’ নীলা জিজ্ঞাসা করল। 

রুবি কিছুক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ে। নীলা গিয়ে রুবিকে জড়িয়ে ধরল। অনেকক্ষণ দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। তারপর কথা বলতে বলতে নীলা জানতে পারে রুবির ক্যান্সার। তাও শেষ পর্যায়ে। নীলা এ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। এত বছর পর প্রিয় বান্ধবীকে খুঁজে পেলো, তাও এই অবস্থায়! নীলার খুব কষ্ট হচ্ছিল। 

কলেজে ওরা তিনজন ছিল কাছের বন্ধু। ওরা দু'জন। আরেকজন অরুনিমা। একদিন একে অপরকে দেখতে না পেলে যেন জীবন চলত না ওদের। সমস্ত কলেজ জানত ওরা থ্রি জুয়েলস। সব জায়গায় ওরা একসাথে যেত। ক্যাফে, লাইব্রেরি, আইসক্রিম খেতে যাওয়া। কিংবা মার্কেটে যাওয়া। সবাই বলত এমন বন্ধুত্ব খুব কমই হয়। কিছুদিন পর ওদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে ভর্তি হয়। তখন থেকেই শুরু হয় রুবি আর নীলার মধ্যে সমস্যা। রুবি হঠাৎ করেই কেমন নীলাকে এড়িয়ে চলে। নীলা অবাক হয়। কষ্ট পায়। কিন্তু কেন রুবি এমন করছে সেটা ও বুঝতে পারে না। যদিও রুবি তা মুখে প্রকাশ করত না। 

নতুন ছেলেটার নাম অর্ণব । রাস্তায় একদিন কিছু বাজে ছেলেরা নীলাকে টিজ করছিল। অর্ণব সেটা দেখতে পেয়ে ছেলেগুলোকে শায়েস্তা করে। সেটা দেখে নীলার অর্ণবকে খুব ভালো লেগে যায়। ধীরে ধীরে ও অনুভব করে যে ও অর্ণবকে ভালোবাসে। এদিকে রুবি যে অর্ণবকে ভালোবাসে এ কথা সে বুঝতে পারেনি। নীলা খুব ভালো ছবি আঁকত। ও অর্ণবের একটা ছবি এঁকেছে। ভেবেছে আজ সে অর্ণবকে ছবিটি দিয়ে ওর মনের কথা বলবে। কিন্তু গিয়ে দেখে অর্ণব আর রুবি খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসে কথা বলছে। নীলার আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না রুবি কেন ওকে এড়িয়ে চলে। রুবি জানত নীলা অর্ণবকে ভালোবাসে। তাই ও নীলাকে এড়িয়ে চলত। 

কলেজ জীবন শেষে তিন বান্ধবী একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। তারপর যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। কারও সাথে আর কারও যোগাযোগ থাকে না। নীলা রুবির পাশে বসে পুরনো কথাগুলো ভাবছিল। কিন্তু রুবিকে সে এভাবে দেখবে এটা সে ভুলেও ভাবতে পারেনি। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। নীলা জিজ্ঞেস করল অর্ণব কোথায়? রুবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানাল অর্ণবের সাথে ওর বিয়ে হয়নি ভুল বোঝাবুঝির কারণে। পরে রুবি আর বিয়ে করেনি। অর্ণব কোথায় সে জানে না। কিন্তু ওর শেষ ইচ্ছে অরুনিমা আর অর্ণবের সাথে দেখা করা। রুবি অনেক খুঁজেছে ওদের, পায়নি। নীলা যেন চেষ্টা করে ওদের খুঁজে বের করতে। মৃত্যুর আগে অন্তত একবার তাদের দেখতে চায় সে। নীলা কথা দেয় রুবিকে ওদের খুঁজে বের করবে। রুবি নীলার হাত ধরে শুয়ে আছে। দু'জনের চোখই ভেজা। রুবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নীলা বাসায় ফিরল। আজ ওর মন অনেক খারাপ রুবির জন্য। আজ আর সময়মত সংসারের সব কাজ নিখুঁতভাবে করার দিকে মন নেই ওর। 

নীলা ওর পুরনো ডায়েরিটা বের করে সব বন্ধুদের ফোন দেয়। কিন্তু কাউকেই আর আগের নম্বরে পাওয়া যায় না। ফেসবুক সার্চ করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে একজনের মাধ্যমে অরুনিমাকে খুঁজে পায়। কিন্তু অর্ণবকে খুঁজে পায় না কিছুতেই। এদিকে রুবির শেষ ইচ্ছে ওকে পূরণ করতেই হবে। 

নীলার স্বামী আসিফ অফিস থেকে এসে দেখে নীলা চুপচাপ বসে আছে। ইদানিং দেখে নীলা কেমন আনমনা থাকে। সংসারের প্রতি কোনো মন নেই। অন্যসময় হলে এ সময় সে আসিফের জন্য কফি নিয়ে আসত। কিন্তু এখন আর সেটা করে না। হঠাৎ নীলা বলল, "তোমার এক বন্ধু আছে না পুলিশের বড়ো কর্মকর্তা? "
‘হ্যাঁ। কেন?’
‘আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?’ 
‘তোমার আবার কী কাজ?’ আসিফ অবাক হয়। 
‘আমার একজন বন্ধুকে খুঁজে বের করতে হবে।’ 
‘মানে?’ 
আসিফ অবাক হলো। ‘কি বলছ এসব? বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পুলিশের সাহায্য লাগবে? সে কি ক্রিমিনাল? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

নীলা রুবির শেষ ইচ্ছের কথা শোনালো আসিফকে। আসিফ বলল, ‘ফেসবুকে খুঁজে বের করো।’ ‘খুঁজেছি। পাইনি। কি নামে আছে। সেটা তো জানি না। আসল নামে আর ছবিতে পাইনি।’ আসিফ বলল, ‘আচ্ছা দেখি রাকিবের সাথে কথা বলে। বাসায় আসতে বলবো। তুমিই কথা বলে নিও।’

এখন প্রতিদিন নীলা রুবিকে দেখতে যায়। এটা-সেটা রান্না করে নিয়ে যায়। যদিও রুবি কিছুই খেতে পারে না। ওরা বসে বসে কলেজ জীবনে ওদের ছবিগুলো দেখে। কখনো হাসে। কখনো কাঁদে। 

নীলা অরুনিমার ঠিকানা নিয়ে একদিন গিয়ে দেখে একি অবস্থা ওর! এত ধনী লোকের স্ত্রীর আজ এই অবস্থা! বাসার সবকিছুতে দারিদ্র্যের ছাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখতে না রাখতেই ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বর ধনী ব্যবসায়ী। তারপর আর পড়াশোনা করেনি ও। ওর বিয়েতে শেষবারের মতো সবার সাথে দেখা হয়েছিল নীলার। তারপর যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর কারও সাথে কারও যোগাযোগ হয়নি। 

নীলাকে দেখে অরুনিমা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বছর চারেক আগে অরুনিমার স্বামী মারা যায়। অনেক দেনা ছিল ওর বরের। সেসব শোধ করতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় ওদের। অরুনিমা যেহেতু বেশি পড়াশোনা করেনি তাই ভালো কোনো চাকরি পায়নি। কোনোরকমে একটা চাকরি করে মেয়েকে নিয়ে চলছে। 

নীলার সব শুনে মন খারাপ হলো। নীলা ওকে রুবির কথা বলল। অরুনিমারও রুবির কথা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে। দু'জনে মিলে রুবিকে দেখতে গেল। রুবি অরুনিমাকে দেখে খুব খুশি হলো। এখন ওরা তিনজন মিলে গল্প করে। সময় কাটায়। তিনজনেরই ভালো লাগে। নীলা ওর একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছে। অরুনিমা অভাবের ভারে নুয়ে পড়ে বেঁচে থাকার আনন্দ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছিল। সেও এখন বন্ধুদের খুঁজে পেয়ে একটু ভালো আছে। রুবিও যে ক'টা দিন বেঁচে আছে ওদের সাথে আনন্দে সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু ওরা কিছুতেই অর্ণবকে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে রুবির শেষ ইচ্ছে বলে কথা। একদিন অরুনিমা আর রুবি একটা কফিশপে বসে কফি খাচ্ছিল। সেখানে গিয়ে অর্ণবের মতো একটা ছেলেকে দেখতে পায়। কিন্তু ছেলেটা বয়সে অনেক ছোটো। অর্ণব কি করে হবে ওরা ভাবে। ছেলেটা বন্ধুদের সাথে আডডা দিচ্ছে। নীলা ছেলেটার সাথে একটু আলাদা করে কথা বলতে চাইল। ও ছেলেটার সাথে কথা বলে জানতে পারে ওর বাবাই ওদের বন্ধু অর্ণব। ওরা ছেলেটার কাছে ওর বাবার ফোন নম্বর চায়। বাসায় ফিরে নীলা অর্ণবকে ফোন দেয়। 
‘হ্যালো, আমি নীলা। চিনতে পারছো?’
অর্ণব কিছুটা সময় নেয় চিনতে। রুবির কথা শোনে। 

পরেরদিন ওরা সবাই যায় রুবিকে দেখতে হাসপাতালে। রুবি অর্ণবকে দেখে চিনতে পারে। রুবি কাঁদছে। হয়ত পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছে। নীলা আর অরুনিমা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ওদেরকে একা ছেড়ে দেয়। কত কথা জমে আছে ওদের।  

নীলা বাড়ি ফিরে অর্ণবের ছবিটি বের করে দেখে, যেটা সে অর্ণবের জন্য এঁকেছিল। এতদিন সে ছবিটি যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। আজ সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিলো। এর কিছুদিন পর রুবি মারা গেল। মৃত্যুর সময় সে একটা চিঠি লিখে গেছে নীলার কাছে। নীলা সেই চিঠিটা অরুনিমা আর অর্ণবকে পড়ে শোনাচ্ছে। 

‘নীলা, তোর হয়তো আমার ওপর রাগ, দুঃখ, অভিমান ছিল। সে জন্যই বোধহয় অর্ণবের সাথে আমার ভাগ্য জুড়েনি। সারাজীবন আমি সুখী হতে পারিনি। জীবনের শেষ সময়গুলোতে সেই তুই আবার আমাকে একটু সুখ দিলি। সবাইকে আবার এক করলি। এভাবে সবাই এক থাকিস। সুখে-দুঃখে বাকি জীবন কেউ কাউকে ছেড়ে যাসনে। একে অপরের পাশে থাকিস। তবেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।’ চিঠিটা পড়ে সবার চোখ ভিজে উঠেছে। 


মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

চলচ্চিত্রে কাজী নজরুল ইসলামের সাংগীতিক কর্ম

প্রকাশ: ১২:২৬ পিএম, ২৬ মে, ২০২৩


Thumbnail

চলচ্চিত্রে কাজী নজরুল ইসলামের সাংগীতিক কর্ম

‘পঞ্চগীতি  কবি’দের সর্বশেষ উত্তরসূরি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) এবং অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) প্রবর্তিত সাংগীতিক বৈশিষ্ট্যের ধারাকে পরিহার করে বাংলা সংগীতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করেন নজরুল ইসলাম। বৈশিষ্ট্যে, বৈচিত্র্যে ও সাংগীতিক ঐশ্বর্য গুণে কাজী নজরুল ইসলামের গান আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠল ‘নজরুল-সংগীত’। সকল শ্রেণির মানুষের জন্য তিনি গান রচনা করেছেন। নজরুল-সংগীতশিল্পী খালিদ হোসেন-এর মতে: সঙ্গীত সৃষ্টির বিভিন্ন মুখিতায় নজরুল অনন্য,তাঁর রচিত গজল, খেয়াল অঙ্গের গান, রাগপ্রধান, ঠুমরী, হোরী, কাজরী, ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, কাব্যসঙ্গীত, হাসিরগান, দেশাত্মবোধক, ইসলামীগান, হাম্দ, নাত, মর্সিয়া, মুসলিম জাগরণী গান, পল্লীসঙ্গীত, ভাটিয়ালী, ঋতুসঙ্গীত, বৃন্দগান, গণসঙ্গীত- যেমন শ্রমিকের গান, কৃষকের গান, ধীবরের গান, ছাদপেটার গান, লেটোগান, ছাত্রদলের গান, নারী জাগরণী গান, শিশুতোষ গান, নৃত্যসঙ্গীত প্রভৃতি প্রায় ৩৫/৪০ ধরনের গানে বাংলা সঙ্গীত ঐশ্বর্য মণ্ডিত হয়েছে।

সাহিত্য ছাড়াও সংগীতের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তাঁর পদচারণা ঘটেনি। সার্থক ইসলামি সংগীত রচয়িতা রূপে তাঁর গান মানুষের অন্তরকে ছুঁয়ে যায়। ইসলামি গানগুলি পরিবেশনায় রমজান মাস যেন আরও সার্থক হয়ে ওঠে। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ [ইদ]’ গানটি শুনলেই যেন মনে হয় সত্যিই খুশির ইদ এসেছে। আবার ভক্তিমূলক, কীর্তন, শ্যামা, ভজন গানগুলোর বাণী ও সুরের যে মাধুর্যতা তাতে এমন সৃষ্টি দ্বিতীয় কারো নেই বললেও অত্যুক্তি হয়না।

নিজের সৃষ্টি সংগীত সম্পর্কে নজরুল ইসলাম তাঁর বিশ্বাসের কথা ও ব্যক্ত করেছেন। তাঁর ভাষায়: ‘কবিতার জগতে আমি কিছু দিতে পেরেছি কিনা জানিনা। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস গানের জগতে আমি কিছু দিয়ে যেতে পেরেছি। ’কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অসামান্য সংগীত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন অসংখ্য গান রচনার মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ সংগীতকার। হয়তো এবিবেচনায় নজরুলের সান্নিধ্য-ধন্য শিল্পী সুকুমার মিত্র নজরুল গীতি আলোচনা গ্রন্থে ‘কাজীন জরুল ও তার রাগরাগিণী’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন: ‘কবিন জরুল ইসলাম বাংলা সঙ্গীত জগতের একজন পূর্ণ সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গানগুলি শুধু যে দূর্লভ [দুর্লভ] স্বীকৃতি লাভকরেছে তাই-ই নয়, আজ তার নতুন করে মূল্যায়নের সময় এসেছে।’

কাজী নজরুল ইসলাম যতগুলো পর্যায়ের গান রচনা করেছেন তন্মধ্যে চলচ্চিত্রের গান নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে। এমন কি চলচ্চিত্রে যোগদান প্রসঙ্গেও দু’চারজন নজরুল গবেষক ব্যতীত কেউই বিশদ আলোচনা করেননি। অথচ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত কাজী নজরুল ইসলামের গানের সংখ্যা নিতান্তই কম নয়। বরং অনেক পর্যায়ের গান অপেক্ষা সংখ্যায় ও বেশি। শুধু সংখ্যায় নয় এর মানও উঁচু মার্গের। এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের সহযোগী সংগীত শিল্পী মনোরঞ্জনসেন-এর ‘বাংলার সঙ্গীতে নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক নিবন্ধের কথা উল্লেখযোগ্য। উক্ত নিবন্ধে তিনি বলেন ‘এক কথায় নজরুল ঐ যুগে তাঁর সৃষ্ট সঙ্গীত বাংলা গীতি ধারায়দু’কূল প্লাবিত করেন। একা জসম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র বিপুলসৃষ্টিরাশির ফলে নয়। অফুরান বৈচিত্র্য ও স্বকীয় উৎকর্ষ তাই [উৎকৃষ্টতাই] ছিল মূলগুণ।’

কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। তাঁর বিচরণের ক্ষেত্র ও ছিল বিচিত্র। এমনি এক টিবিচরণক্ষেত্র হলো চলচ্চিত্র। মূলত সংগীতের প্রয়োজনেই তাঁর চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। তিনি প্রথম ১৯৩১সালে ‘সুরভাণ্ডারি’ হিসাবে ‘ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানি’তে যোগদান করেন। ‘সুরভাণ্ডারি’র কাজ ছিল চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের কণ্ঠস্বর পরীক্ষা করা। এই সম্পর্কে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক বঙ্গবাণীতে প্রকাশিত সংবাদটি হলো:

ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড বাঙ্গালা গানের টকি নির্মাণ করিতেছেন। প্রসিদ্ধ কবি ও সংগীত কারন জরুলকে সুরভাণ্ডারী নিযুক্ত করিয়াছেন। তাহাদের এ মনোনয়ন যথার্থ হইয়াছে, কারণ অধুনা বাঙ্গালার তরুণ কবিদের মধ্যে নজরুল ইসলাম রচয়িতা ও সুরকার হিসেবে শ্রেষ্ঠ। বর্তমানে কিছু কাল ম্যাডান কোম্পানি নট-নটীদের সুরপরীক্ষার জন্য কেবল গান, আবৃত্তির সবাক চিত্রই নির্মাণ করিবেন, পরে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবির তাহারা সবাক করিয়া তুলিবেন বলিয়া শুনাযাইতেছে।

উক্ত সময়েই (১৯৩১খ্রিষ্টাব্দে) ‘ম্যাডান থিয়েটার্সকোম্পানি’ ৩০-৪০টিস্বল্প দৈর্ঘ্য খণ্ড  চিত্র নির্মাণ  করে। এ সকল খণ্ড চিত্রে কাজী নজরুল ইসলামের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির কথা জানা যায়। এ প্রসঙ্গে আশোক কুমার মিত্র লিখেছেন:

১৯৩১খ্রিস্টাব্দে অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক সাফল্য লইয়া যখন সবাক চিত্র সর্বপ্রথম কলকাতার চিত্রগৃহে আত্নপ্রকাশ করে এবং যখন কেবলমাত্র সংক্ষিপ্ত নমুনামূলক বাংলা চিত্র ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড কর্তৃক পরিবেশিত হয়, তখনই আমরা দেখিয়াছি সবাক চিত্রের মাধ্যমে কাজী নজরুলকে বলিতে শুনিয়াছি তাহার উদাত্ত কণ্ঠের আবৃত্তি :

সাম্যের গান গাই

আমার চক্ষে পুরুষ ও নারী

কোন ভেদাভেদ নাই।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ‘ম্যাডান থিয়েটার্স’-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘পায়োনিয়ার ফিল্মস কোম্পানি’-এর চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে নজরুল ইসলাম যোগদান করেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৩৪ সালে ধ্রুব নামে মুক্তি প্রাপ্ত চলচ্চিত্রে কাজী নজরুলের অবদান ছিল বহুমাত্রিক। এ প্রসঙ্গে অতনুচক্রবর্তীর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:

বাংলা গানের ধারাবাহিকতায় পথিকৃত কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মেধা বিনিয়োগ করেছিলেন সিনেমার গানে, নির্মাণেও । ১৯৩৪ সালের নববর্ষের দিনে, ক্রাউন সিনেমার রূপালি [রুপালি] পর্দায় দর্শক কাজী নজরুলকে একই সঙ্গে গান গেয়ে অভিনয় করতে দেখেছিল। ছবিটির নাম ‘ধ্রুব’, ভূমিকাটি ছিল নারদের। ছবিটি যুগ্মভাবে পরিচালনা করেছিলেন নজরুল ইসলাম এবং সত্যেন্দ্রনাথ।

ধ্রুব চলচ্চিত্রে ১৮ টি গান ব্যবহৃত হয়। সবগুলি গানের সুরকার এবং ১৭ টি গানের গীতিকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এছাড়া পরিচালক, সংগীত পরিচালকসহ ‘নারদ’ চরিত্রে অভিনয় করে ৪টি গানে কণ্ঠও প্রদান করেন তিনি। তাই বলা যায়, বিরল প্রতিভার অধিকারী এই সংগীতজ্ঞ চলচ্চিত্রে ছিলেন সর্বত্র ও অত্যাবশ্যকীয়।ধ্রুবচলচ্চিত্রের গানগুলো হলো: ‘অবিরত বাদর বরষিছে ঝর ঝর’; ‘কাঁদিসনে আর কাঁদিসনে’; ‘আমি রাজার কুমার’; ‘গহন বনে শ্রীহরি নামের’; ‘চমকেচ পলা মেঘে মগন গগন’; ‘জয় পীতা ম্বরশ্যাম সুন্দর’; ‘জাগো ব্যথার ঠাকুর’; ‘দাও দেখা দাও দেখা’; ‘ধুলার ঠাকুর ধুলার ঠাকুর’; ‘নাচো বন মালী কর তালি দিয়া’; ‘ফিরে আয় ওরে ফিরে আয়’; ‘ফুটিল মান সমাধবী কুঞ্জে’; ‘মধুর ছন্দে নাচে আনন্দে’; ‘শিশু নটবর নেচে নেচে যায়’; ‘হৃদি পদ্মে চরণ রাখো’; ‘হরি নামের সুধায়’; ‘হেদুখ-হরণ ভক্তের শরণ’; ‘আয়রে আয় হরিবলে’ (এই গানটি গিরিশ চন্দ্র ঘোষ রচিত)।

চলচ্চিত্রের কাহিনি অনুযায়ী গান রচনা যেমন কঠিন কাজ তেমনি গানের বাণী অনুযায়ী সুর রচনা ও সহজসাধ্য নয়। কাজী নজরুল ইসলাম এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে। এ বিষয়ে নজরুলের স্নেহধন্য শিল্পী কাননদেবী বলেন:

ছবির গান ও সুর বাঁধার সময় ও দেখেছি কত প্রচণ্ড আনন্দের মধ্যে কি প্রবলভাবেই না কবি বেঁচে উঠতেন, যখন একটা গানের কথা ও সুর ঠিক তাঁর মনের মত হয়ে উঠতেন। মানুষ কোন প্রিয় খাদ্য যেমন রসিয়ে রসিয়ে আস্বাদ করে কাজী সাহেব যেন তেমনি করেই নিজের গানকে আস্বাদ করতেন।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘কালীফিল্মস’-এর প্রযোজনায় মুক্তি প্রাপ্ত পাতাল পুরীচলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ তাঁর চলচ্চিত্র জগতে নজরুল গ্রন্থে লিখেছেন:

১৯৩৫সালের ২৩মার্চ কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে যখন কালীফিল্ম সপ্রযোজিত প্রিয় নাথ গাঙ্গুলী পরিচালিত ‘পাতালপুরী’ মুক্তিপায়, তখন দর্শকরা দুই সাহিত্যিক বন্ধুর সম্মিলিত মেধার সঙ্গে পরিচিত হয়। এঁদের একজন কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, আরেকজন এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, অভিনেতা কাজী নজরুল ইসলাম। এ ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে কয়লাখনির শ্রমিক নারী পুরুষদের নিয়ে। নজরুল ছবির কাহিনির মূল ‘থিম’ অনুযায়ী সঙ্গীত সৃষ্টির জন্য বর্ধমানের কয়লাখনি অঞ্চলে ও গিয়েছিলেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য। এ ছবিতে তিনি ‘ঝুমুর’ নামে নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন।

পাতালপুরী চলচ্চিত্রে দায়িত্ব পালনের পারিশ্রমিক হিসেবে নজরুল ইসলাম পেয়েছিলেন মাত্র ৫০টাকা। পাতালপুরী  চলচ্চিত্রের গানগুলো হলো: ‘আঁধার ঘরের আলো’; ‘এলো খোঁপায় পরিয়েদে’; ‘তাল পুকুরে তুলছিলসে’; ‘দুখের সাথি গেলি চলে’; ‘ধীরে চল্চরণটলমল’; ‘ফুলফুটেছে কয়লাফেলা’; ‘ওশিকারি মারিসনা তুই’; ‘বন কত দূরেসই’ (এই গানটি শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় রচিত)।  

কাহিনির প্রয়োজনে গানের বাণী রচনার পাশাপাশি সুর রচনার জন্য কবি নজরুল কতটা যত্নবান থাকতেন সে-সম্পর্কে শিল্পী কাননদেবী জানিয়েছেন তাঁর ‘কবি প্রণাম’ প্রবন্ধে। কাননদেবী লিখেছেন:

আমাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বলতেন, ‘ডাগর চোখে দেখছ কি? আমি হলাম ঘটক, জানো? এক দেশে থাকে সুর, অন্যদেশে কথা। এই দুই দেশের এই বরকনেকে এক করতে হবে। কিন্তু দুটির জাত আলাদা হলে চলবে না, তাহলেই বেবনতি। বুঝলে কিছু?’

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘দেবদত্ত ফিল্মস’-এর প্রযোজনায় মুক্তিপায় চলচ্চিত্র গ্রহেরফের। এইচলচ্চিত্র সম্পর্কে নজরুল গবেষক আসাদুল হক তাঁর নজরুল সংগীত গ্রন্থে লিখেছেন: ‘এই ছায়াছবিতে কাজী নজরুল ইসলাম ৬ টি গানে সুরারোপ করেন এবং সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।’

১৯৩৮খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি লাভ করে ছায়াছবি বিদ্যাপতি। বিদ্যাপতি ‘অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন’-এর পরিবেশনায় ‘চিত্রা’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিলাভ করে। এই চলচ্চিত্রের কাহিনি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত নাটক ‘বিদ্যাপতি’ অবলম্বনে রচিত। বিদ্যাপতি চলচ্চিত্রে নজরুল ইসলামের একটি গান ও সুর ব্যবহৃত হয়েছে। গানটি হলো: ‘রাই বিনোদিনী দোলো’।একই বছরে বিদ্যাপতি চলচ্চিত্র হিন্দি ভাষায় ও মুক্তি পায়।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘দেবদত্ত ফিল্মস’-এর প্রযোজনায় মুক্তি পায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্র গোরা। এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। গোরা চলচ্চিত্রের ৫টি গানের মধ্যে ৩টি রবীন্দ্রসংগীত, ১টিনজরুল-সংগীত ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখিত১টি গান ব্যবহৃত হয়। এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের একটি ঘটনার উল্লেখ করা আবশ্যক। এ থেকে নজরুলের সাংগীতিক জ্ঞানের স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ঘটনাটি নিতাই ঘটকের স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায় নিম্নরূপে:

দেবদত্ত ফিল্মস রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’র চিত্ররূপ তুললেন। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তখন বিশ্ব ভারতীয় সঙ্গীত বিভাগীয় বোর্ড থেকে রেকর্ড বা ফিল্মের গানগুলির জন্য অনুমতি নিতে হতো। কবি নজরুল বিনা অনুমতিতেই কিন্তু ‘গোরা’র গান করেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল অন্তত পক্ষে তিনি যেখানে সঙ্গীত পরিচালক বিশ্বভারতীর বোর্ড সেখানে কোন রকম আপত্তি তুলবেন না, কিন্তু ছবিটির মুক্তির জনীর২/১দিন পূর্বে ‘ট্রেডশো’রদিন বিশ্বভারতীর পর্যবেক্ষক এসে কবির গাওয়ানো গানগুলির ত্রুটি ধরলেন এবং ছবির মুক্তি বন্ধ করলেন। প্রডিউসারের মাথায় হাত। কবি সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়ীতে করে ‘গোরা’ ফিল্মটির কপি, একটি ছোট প্রজেকশনমেশিন, সঙ্গে দেবদত্ত ফিল্মস এর প্রোপ্রাইটার ও তখনকার তাঁর সহকারী মানুগাঙ্গুলীকে নিয়ে সোজা শান্তিনিকেতন চলে গেলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে। বিশ্ব কবি তো তাঁকে দেখে প্রথমে অবাক হয়ে পরমুহুর্তে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।

কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বললেন, ‘এসেছোই যখন কয়েকদিন আমার কাছে থেকে যাও’।নজরুল বললেন, ‘সেতো আমার সৌভাগ্য কিন্তু এখন যে এক ভীষণ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে আপনার কাছে ছুটে এসেছি’। তারপর তিনি ছবি সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার বললেন। বিশ্বভারতীর বোর্ডের অনুমোদন না পাওয়ার কথাও আনলেন। শুনে বিশ্বকবি বেশ অসন্তুষ্ট স্বরে অভিমত প্রকাশকরলেন ‘কীকাণ্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে...? তোমার চেয়েও আমার গান কী তারা বেশি বুঝবে? আমারগানের মর্যাদাকী ওরা বেশি দিতে পারবে? কবি নজরুল বললেন, ‘কিন্তু লিখিত অনুমতি না পেলে সামনের ঘোষিত তারিখে ছবিটির মুক্তি দেওয়া যাবেনা। আপনি দয়া করে আজ একসময় ছবিটি দেখুন; আমি প্রজেক্টর ফিল্ম সঙ্গে করে এনেছি। তারপর অনুমতি পত্রে একটা সই করে দিন।’ বিশ্ব কবি বললেন ‘ছবি দেখাতে চাও সকলকেই দেখাও, সবাই আনন্দ পাবে। আপাতত দাও কিসে সই করতে হবে।’ এই বলে কবির হাত থেকে আগের থেকেই লিখে রাখা অনুমতিপত্র নিয়ে তাতে সইও তারিখ দিয়ে দিলেন। নির্দিষ্ট দিনেই ছবিটি মুক্তি পেল।

এ ঘটনা হতে ধারণা করা যায়; নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার গভীরতা সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও অবগত ছিলেন। গোরা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত নজরুল-সংগীতটি হলো: ‘ঊষা এলচুপিচুপি’।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি লাভ করে সাপুড়ে চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও কাহিনিকার কাজী নজরুল ইসলাম। সাপুড়ে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ৮টি গানের মধ্যে ৭টির গীতিকার ও সুর কারছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সাপুড়ে চলচ্চিত্রের গানগুলো হলো: ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’; ‘কথা কইবেনা বউ’; ‘কলার মান্দা সবা নিয়ে দাওগো’; ‘পিছল পথে কুড়িয়ে পেলাম’; ‘ফুটফুটে ঐ চাঁদ হাসেরে’; ‘দেখিলো তোর হাত দেখি’; ‘হলুদ গাঁদার ফুল রাঙাপলাশ ফুল’; ‘আমার এই পাত্রখানি ভরেনা সুধায় জানি’ (এই গানটি অজয়ভট্টাচার্য রচিত)।

সাপুড়ে চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এমন একজন শিল্পী কাননদেবী। তিনি তাঁর ‘কবি প্রণাম’ প্রবন্ধে লিখেছেন:

আমি তরা গরাগিনী কিছু বুঝতাম না। কিন্তু লক্ষ্য না করে উপায় ছিলনা কি সীমাহীন ব্যাকুলতায় তিনি কথার ভাবের সঙ্গে মেলাবার জন্য হার্মোনিয়াম তোলপাড় করে সুর খুঁজে বেড়াতেন।ঠিক যেন রাগের মর্ম থেকে কথার উপযুক্ত দোসর অন্বেষণ।

এই চলচ্চিত্রের ‘আকাশে হেলান দিয়ে’ গানটি শেখার সময় নজরুল ইসলাম তাকে গানের বাণীর সাথে সুরের সাযুজ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন নানাভাবে। কাননদেবীর ভাষায়:

শেখাতে শেখাতে বলতেন, মনে মনে ছবি এঁকে নাও নীল আকাশ দিগন্তে ছড়িয়ে আছে। তার কোন সীমানেই, দুদিকে ছড়ানোই তছড়ানোই। পাহাড় যেন নিশ্চিন্ত মনে তার ইগায়ে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আকাশের উদারতার বুকে এই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোনোটা প্রকাশ করতে হলে সুরের মধ্যেও একটা আয়েশ আনতে হবে। তাই একটু ভাটিয়ালীর ভাব দিয়েছি। আবার ঐ পাহাড় ফেটে যে ঝর্ণা বেরিয়ে আসছে তার চঞ্চল আনন্দকে কেমন করে ফোটাবে? সেখানে সাদামাটা সুর চলবে না। একটু গীটকি রীতানের ছোঁয়াচাই । তাইবো-ও-ও-অইবলেছুটলো ঝর্ণার [ঝরনার] আত্মহারা আনন্দে। এমনই করে তিনি এই মেলানোর আনন্দ আমাদের হৃদয়েও যেন ছড়িয়ে দিতেন।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ‘রূপবাণী’ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিলাভ করে ছায়াছবিনন্দিনী। এই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ৯টি গানের মধ্যে একটি গানের গীতিকার ও সুরকার কাজী নজরুলইসলাম। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী শচীনদেববর্মণ। শচীনদেব বর্মণ তাঁর ‘কাজীদা’ প্রবন্ধে লিখেছেন:

তাঁর যে কখানা গান আমি রেকর্ড করেছি; তার প্রত্যেকটিতেই কাজীদার [...] স্পর্শে আমার গান সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছে। তাঁর গান গেয়ে যে আনন্দ ও তৃপ্তি পেয়েছি তা আমার মনে সর্বদাই গেঁথে আছে ও থাকবে। তাঁর গান গেয়ে আমি ধন্য হয়েছি।

নন্দিনী চলচ্চিত্রের গানটি হলো: ‘চোখ গেল চোখ গেল’। ‘পদ্মার ঢেউরে’ গানটি এই চলচ্চিত্রের জন্য রেকর্ড করা হলেও পরবর্তীপর্যায়ে ব্যবহৃত হয়নি।

১৯৪২খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিলাভ করে চৌরঙ্গী চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ৯টি গানের মধ্যে ৮টি গানের গীতিকার ও সুরকার কাজী নজরুল ইসলাম। চৌরঙ্গী চলচ্চিত্রের গানগুলো হলো: ‘ওগো বৈশাখী ঝড়’; ‘ঘুম পাড়ানী মাসিপিসি’; ‘ঘরছাড়া ছেলে’; ‘চৌরঙ্গী চৌরঙ্গী’; ‘প্রেম আর ফুলের’; ‘রুম্ম্ঝুম্ঝু ম্রুম্ম্ঝুম্’; ‘জহরত পান্না হীরার বৃষ্টি’; ‘সারাদিন পিটিকার দালানের ছাদ’; ‘আরতি প্রদীপজ্বালি’ (এই গানটি নবেন্দু সুন্দর রচিত)। চৌরঙ্গী চলচ্চিত্রটি পরবর্তীসময়ে হিন্দি ভাষায় ও নির্মিত হয়।

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘নিউথিয়েটার্স’-এর প্রযোজনায় মুক্তি পায় ছায়াছবি দিকশূল। এই চলচ্চিত্রে নজরুল ইসলামের ২টি গান ব্যবহৃত হয়। গান দুটি হলো: ‘ঝুমকোল তার জোনাকী’ এবং ‘ফুরাবেনা এই মালা গাঁথা’।

১৯৪৫খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পায় ছায়াছবি অভিনয় নয়। এই চলচ্চিত্রে নজরুল ইসলামের একটি গান ব্যবহৃত হয়। গানটি হলো: ‘ও শাপলা ফুল নেবনা বাবলা ফুলএনেদে’।

কাজী নজরুল ইসলাম সম্পৃক্ত মোট চলচ্চিত্রের সংখ্যা কত তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ অনেক চলচ্চিত্রে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা শোনা গেলেও তথ্য-প্রমাণের অভাবে এখন পর্যন্ত সেগুলি উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ তাঁর চলচ্চিত্র জগতে নজরুল গ্রন্থের ভূমিকায় নজরুল সম্পৃক্ত নিম্নোক্ত চলচ্চিত্র সমূহ উল্লেখ করেছেন:

(১) নারী (২) ধূপছায়া (৩) প্রহলাদ (৪) বিষ্ণুমায়া (৫) ধ্রুব (৬) পাতালপুরী (৭) গ্রহেরফের (৮) বিদ্যাপতি (বাংলা) (৯) বিদ্যাপতি (হিন্দি) (১০) গোরা (১১) সাপুড়ে (বাংলা) (১২) সাপেরা (হিন্দি) (১৩) নন্দিনী (১৪) চৌরঙ্গী (বাংলা) (১৫) চৌরঙ্গী (হিন্দি) (১৬) দিকশূল (১৭) অভিনয়নয় (১৮) বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (প্রামাণ্য চিত্র) (১৯) বিদ্রোহী কবি (প্রামাণ্য চিত্র) (২০) কবি নজরুল (প্রামাণ্য চিত্র) (২১) কাজী নজরুল ইসলাম (প্রামাণ্য চিত্র)।

গণযোগাযোগের শক্তিশালী এই মাধ্যমটির উন্নতিকল্পে নজরুল ইসলামের পরিকল্পনার কথা জানা যায়। তিনি শেরে বাংলা একে ফজলুলহক’সহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করেছিলেন বিটি পিকচার্স অর্থাৎ ‘বেঙ্গল টাইগার পিকচার্স’। ‘১৯৪১সালের ১৩সেপ্টেম্বর ওস্তাদ মুহম্মদ হোসেন খসরুর কলকাতাস্থ বাসায় এই কোম্পানির প্রথম সভাহয়।দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় ওই বছরের ১৯নভেম্বর আব্বাস উদ্দিন আহমদের আবাসস্থল স্যাভয়ে। ওখানে কাজী নজরুলকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিতহয়। কোম্পানির পরবর্তী সভায় সভাপতিত্ব করেন কাজী নজরুল ইসলাম।’ এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘মদিনা’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করার কথা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি।কারণ তার পূর্বেই ১৯৪২সালের ৯জুলাই কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে বিটিপি কচার্স-এর কর্মকাণ্ড আর অগ্রসর হয়নি।

পঞ্চগীতি কবিদের মধ্যে একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর বহু গান ও সুর বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে ও হবে। যেমন কলকাতার চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৪৯); শ্রীশ্রী তার কেশ্বর (১৯৫৮); দাদা ঠাকুর (১৯৬২); হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (১৯৬২); বারবধূ (১৯৭৮); দেবদাস (১৯৭৯) প্রভৃতি চলচ্চিত্রে কাজী নজরুল ইসলামের গান ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ওস্বাধীন বাংলাদেশে নির্মিত নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭); আমির সওদাগর ও ভেলুয়াসুন্দরী (১৯৭০); জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০); বধূবিদায় (১৯৭৮); লাইলী মজনু (১৯৮৩); রাজ লক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৮৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্রে নজরুল-সংগীত ব্যবহৃত হয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলামের কাহিনি নিয়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশে। তন্মধ্যে সুখদুঃখ (১৯৭১); মায়ার বাঁধন (১৯৭৬); জিনের বাদশা (১৯৯০); মেহেরনেগার (২০০৫); রাক্ষুসী(২০০৬) উল্লেখযোগ্য। কাজী নজরুল ইসলামের এই অবদান চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। চলচ্চিত্রে তাঁর অসামান্য অবদান এখনও পরিপূর্ণভাবে উদ্ঘাটিত হয়নি । তাই নজরুল গবেষকদের উচিত বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে অনুদ্ঘাটিত চলচ্চিত্রসমূহ উদ্ঘাটন করে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিপূর্ণরূপে কাজী নজরুল ইসলামকে উপস্থাপন করা।

লেখক, ড. পরিতোষ কুমার মণ্ডল



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

জন্মজয়ন্তীর শ্রদ্ধাঞ্জলি: মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াইয়ে নজরুল যুগিয়ে যাবে নিরন্তর প্রেরণা

প্রকাশ: ০৯:৫৯ এএম, ২৬ মে, ২০২৩


Thumbnail

ভারত বিভাগের নামে বাংলা নামের ভূখণ্ডটি খণ্ডিত হয়েছে সেই ১৯৪৭ সালে। এর একাংশ পশ্চিম বঙ্গ পড়েছে ভারতে। পূর্ববঙ্গ পরিণত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গ বাঙালি জাতির স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, হয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের ঘটনা ছিল বেদনাদায়ক। যদিও খোলা চোখে এটিকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনিবার্য ফল হিসেবেই মনে হয়, তবে এর সাথে জড়িয়ে ছিল অর্থনীতিও। বিবেকবান চিন্তাশীল কোনো বাঙালি এ বিভাজনকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন:

‘তেলে রশি ভাঙল বলে,

খুকুর ’পরে রাগ করো,

তোমরা যেসব ধেড়ে খোকা

বাঙলা ভেঙে ভাগ করো!’

নজরুল কে নিয়ে লেখা, কথাবার্তা, বিচার বিশ্লেষণ তথা নজরুল সৃষ্টির ভেতরে যাওয়ার প্রয়াস সাহিত্য নজরুলের আবির্ভাবের পরথেকেই শুরু হয়েছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এর কারণ এক কথায় নজরুল-সৃষ্টি যেমন কালোত্তীর্ণ, তেমন কালের চাহিদাকে পুরো মাত্রায় ধরতে পেরেছিল। গোপাল হালদার যথার্থই বলেছেন, নজরুল ‘এ লিভিং লিঙ্ক’। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকলেও বেশিরভাগ বাঙালির বাস দুটি আলাদা রাষ্ট্রে-স্বাধীন বাংলাদেশে আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। এই বাঙালিদের মধ্যে যোগাযোগের অনিবার্য ও মজবুত সেতু নজরুল। একই সাথে দুই বাংলার সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির সবচেয়ে বড় হাতিয়ারও তিনি। কাজী নজরুল ইসলামের ভাবনা ছিল সব বাঙালিকে নিয়েই এবং সামগ্রিক। সাম্প্রদায়িকতার দিনে, যুদ্ধের দিনে, দ্বিজাতিতত্ত্বের দিনে নজরুল যেভাবে বাংলার জয়গান করে গেছেন বাংলা সাহিত্যে এর তুলনা বিরল। তাই খণ্ডিত নয়, সমগ্র নজরুলকে নিয়েই আমাদের সামনের দিকে যেতে হবে, আমাদের মঙ্গলের স্বার্থেই।

আবার এই বাঙালিদের মধ্যে অধিকাংশ হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের হলেও, আছে অন্যান্য নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষও। এদের সবার মধ্যে সম্প্রীতির যে অনবদ্য বন্ধন, সেটার অনেকটাই রচনা করেছেন নজরুল এবং চেতনার প্রহরী হিসেবে তা সবসময়ই রক্ষা করে যাবে নজরুলের সৃষ্টি সম্ভার।

নজরুল গবেষক বাঁধন সেন গুপ্ত যথার্থই বলেছেন,

‘নজরুলের সারা জীবনটাই অসাম্প্রদায়িক চেতনার উদাহরণ’।

অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে প্রবলভাবে আস্থাশীল ছিলেন তিনি। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছেন,

‘সুন্দরে রধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যেকূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ (প্রতিভাষণ: নজরুল১৯২৯)

এটা বলা যায়, সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্ম, দর্শন কিংবা জীবনচর্চাও চর্যায় তিনি স্থির থাকতে পারেন নি ঠিকই ; কিন্তু সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। আর এই আস্থাই তাঁকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে, করেছে বাংলা ও বাঙালির কবি তথা বিশ্বমানবতার কবি। তাই তো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামে এবং পরমতসহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠাও ধর্মীয় সম্প্রীতি সাধনায় তাঁর কবিতা ও গান বাঙালিকে যুগিয়ে যাবে নিরন্তর প্রেরণা।

ধর্মীয় গণ্ডির সংকীর্ণ সীমানা পেরিয়ে মানুষের জয়গান কবীর, নানক, চণ্ডিদাস, লালনসাঁই, রবীন্দ্রনাথ, রশিদ উদ্দীন, জালাল খাঁ সহ অনেকেই করেছেন। সবার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রেখে এমন প্রশ্ন তো করাই যায় যে, নজরুলের মতোজীবনে-চিন্তনে-মননে অমন গভীরভাবে কেউ কি আর নাড়া দিতে পেরেছেন? পেরেছেন কি কেউ নজরুলের মতো সাম্প্রদায়িকতার ভেদ বুদ্ধির বিরুদ্ধে এমন করে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করতে?-

‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ করছে জুয়া

ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া...

জানিস নাকি ধর্ম সেযে বর্ম সম সহনশীল

তাই কি ভাই ভাঙতে পারেছোঁ ওয়া ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল?

যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত

আজনা হয় কাল ভাঙবে সেতো।

যাকনা সেজাত জাহান্নামেরই বেমানুষ নাই পরোয়া।’

কিংবা

‘মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি

টিকি দাড়ি নিয়ে আজও বেঁচে আছি

বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি  

এবার সব্য সাচী

যাহোক একটা তুলে দাও হাতে একবার মরে বাঁচি।’

নজরুল দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছিলেন হিন্দু-মুসলিমে বিভাজিত সে সময়কার ভারতীয় সমাজে। নজরুল বিষয়ে সকল মহলে শুরু হয়েছিল ব্যাপক আলোচনা। তবে আলোচনা শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বিরুদ্ধাচারণ ও হয়েছে প্রচুর। মুসলিম হওয়ার কারণে হিন্দুদের একটা শ্রেণি নজরুলকে বিজাতি মনে করত। ঠিক একই ভাবে এক শ্রেণির মুসলমান নজরুলকে বিজাতি ঘোষণা করেছিল। নজরুলের ‘আমারকৈফিয়ৎ’ কবিতা পড়লে সহজেই বোঝা যায়, ওই সমাজের মুসলিমদের একটা শ্রেণি নজরুলকে ‘কাফের’ আখ্যা দিতে দ্বিধা করেনি।নজরুল ‘আমার কৈফিয়ৎ’এলি খেছিলেন-

‘মৌ-লোভীযতমৌলবীআর ‘মোল্লারাক’নহাতনেড়ে,

দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবেদাও পাজিটার জাত মেরে!’

বাংলা সাহিত্যে আর কোনো সাহিত্যিক কে নিয়ে এত সমালোচনা-বিরূপ আলোচনা হয়নি কখনও। বিশেষ করে কট্টরপন্থী মুসলমানদের মধ্যে নজরুল সম্পর্কে সবচেয়ে বড় অভিযোগের কারণ ছিল নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত। একটা সময়ে পূর্ব বঙ্গের বেতারে ও নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত সম্প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

এছাড়াও ভারত ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী নজরুলকে বাংলার প্রথম সফল পাকিস্তানি কবি রূপে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা তৈরি করে। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা ইকবালের সঙ্গে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যাপিত হয় ‘ইকবাল-নজরুল দিবস’।

এর পাশাপাশি শুরু হয় নজরুল সাহিত্যের ‘পাকিস্তানি করণের’ কাজ। নজরুল কাব্যের ‘পাকিস্তানি সংস্করণ’ প্রকাশের প্রস্তাবও করা হয়। বলা হয়, প্রয়োজনে বর্জন করতে হবে ‘নজরুল-কাব্যের অবাঞ্ছিত অংশ সমূহ’। ১৯৫০-এর আশ্বিন মাসে মওলানা আতাহার আলি ‘নওবাহার’ পত্রিকায় লিখলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করি নজরুলের যেসব কবিতায়... কুফর কালাম আছে তাহা যেন বাজেয়াপ্ত করিয়া আমাদিগকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করেন।’ আর তার পরের মাসেই, এক সময়ে কবির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় গোলাম মোস্তাফা ‘নওবাহার’ পত্রিকায় লিখে ফেললেন ‘নজরুল-কাব্যের অবাঞ্ছিত অংশ’ নামে একলেখা। পথও বাতলে দিলেন, ‘নজরুল কাব্যের পাকিস্তান সংস্করণ প্রকাশ করিবার যে প্রস্তাব আমরা করিয়াছি’ সেখানে ‘এখন প্রয়োজন ছাঁটাই করার। কোন পুস্তকে কোন অংশ বর্জনীয়, তাহাই আমাদিগকে বিচার করিতে হইবে।’ স্পষ্টত জানালেন, ‘ইসলাম এবং পাকিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা এই ছাঁটাই করিতেছি-কাব্য বা সাহিত্যের দিক দিয়া নয়।’

এইসব হতে থাকলো সেই নজরুল কেনিয়ে, যিনি লিখেছেন,

গাহি সাম্যের গান-

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সববাধা-ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।

গাহি সাম্যের গান!

কে তুমি? পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?

কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে’ যাও, বল আরো।...

মিথ্যা শুনিনি ভাই,

এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

(‘সাম্যবাদী’, সাম্যবাদী)

কিংবা

মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান।

মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥...

এক সে দেশের মাটিতে পাই

কেউ গোরে কেউ শ্মশানে ঠাঁই,

মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান॥

(সুর-সাকী গ্রন্থের ১৮ সংখ্যক গানে)

উচ্চ কণ্ঠের বীন্দ্রনাথ যেমন ঘোষণা করেছেন মানব ধর্মের কথা, তেমনি অভিন্ন চেতনায় নজরুলের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে ‘মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি।স্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে আমি দেখেছি। এই ধূলি মাখা, অসহায়, দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে।’ এই মানবতাবাদী চেতনাই কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কেন্দ্রীয় সুর। সুস্পষ্ট মানববন্দনা সমকালেরসাহিত্য ধারায়ন জরুলকে স্বকীয় মাত্রায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।

বাঁধনসেন গুপ্ত খুব চমৎকার করে বলেছেন,

‘বিশ্বমানবতার কবি নজরুল এদেশে জন্মেছেন বলে যেমন এপার বাংলার নন, তেমনি সেখানে যে-ভূমিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি, শুধু সেখানকারও নন। তিনি সমগ্র মানবজাতির আত্মীয়, আপনজন। কোনো সংকীর্ণতার তিনি শিকার ছিলেন না। তাই তাঁর চর্চা ও অনুসন্ধান সর্বত্র ইহওয়া উচিত। ভালোবাসার তালিকায় কম-বেশিরহিসাব-নিকাশ নাইবা রইল! বরং চলুক নিরন্তর ভাব বিনিময় আর কবির বিষয়ে নিত্য নব পারস্পরিক সাফল্য ও জিজ্ঞাসার অন্তহীন ভাবনা বিনিময়। অভিমান বা অভিযোগ সেই ভালোবাসার কাননে নেহায়েতই অনুপ্রবেশকারী মাত্র।’ 

১৯২৯-এর ১৫ ডিসেম্বর মাত্র ৩০ বছর বয়সে নজরুলকে বাংলার সারস্বত সমাজ কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক সংবর্ধনা দেয়। এই বিরল সম্মান রবীন্দ্রনাথ ওই বয়সে তো নয়ই, পরেও পাননি। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্ররায়ের সভাপতিত্বে এই সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখেন সুভাষ চন্দ্র বসু। অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন এস ওয়াজেদ আলী। তাতে বলা হয়,

‘তোমার অসাধারণ প্রতিভার অপূর্ব অবদানে বা ঙালিকে চির ঋণী করিয়াছ তুমি। আজ তাহাদের কৃতজ্ঞতা সিক্ত সশ্রদ্ধ অভিনন্দন গ্রহণ কর।’

সেখানে আরও বলা হয়, ‘বাঙালির ক্ষীণ কণ্ঠে তুমি তেজ দিয়াছ’।

সংবর্ধনা সভায় সুভাষ চন্দ্র বসু বলেন,

‘আমরা যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে, আমরা যখন কারাগারে যাব তখন ও তার গান গাইব।’

তিনি আরও বলেন,

‘বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয়না’।

সভাপতির ভাষণে প্রফুল্লচন্দ্র রায় ফরাসি বিপ্লবের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, সে-সময়ের প্রত্যেক মানুষ অতি মানুষে পরিণত হয়েছিল। তিনি মনে করেন,

‘আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশ ধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে’।

এই সংবর্ধনার উত্তরেন জরুল বলেছিলেন,

‘আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেদিনই করেছেন যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে।’

সেই ভাষণে তিনি আরও বলেছিলেন, নিন্দা ও প্রশংসার পরস্পরবিরোধ ভারসাম্যে তিনি ‘ঠিক’ থেকে গেছেন এবং তাঁকে ‘এতটুকু টলতে হয়নি’। ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে জন্মগ্রহণ’ করে তিনি তাকে যে সার্থক করতে চেয়েছেন তা একবিংশ শতাব্দীর উত্তর প্রজন্মের জন্য ও অনুসরণযোগ্য। যে-কুল, যে-সমাজ, যে-ধর্মে তিনি জন্মগ্রহণ করে থাকুন, তাকে ছাড়িয়ে ওঠার মধ্যেই তাঁর কবি সত্তা ও পরিচয়ের সার্থকতা। শুধু সুন্দরকেই যে তিনি দেখেছেন তা নয়, ক্ষুধা দীর্ণ মূর্তিকে ও তিনি দেখেছেন। তাই আজও যেমন, ভাবী কালের দিনগুলোতেও নজরুল জীবন্ত সংযোগ হয়ে থেকে যাবে।

অন্নদাশঙ্কও রায় ১৯৪৯-এ লিখেছিলেন, ‘ভুল হয়েগেছে বিল কুল/ আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে ভাগ হয়নিকো নজরুল’, অন্য অনুষঙ্গে গভীর বেদনায় সেই তিনি ইছিয়াত্তরসা লেলিখলেন, ‘কেউ জানল না ইতিহাসের ফের/ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/এতকাল পরে ধর্মের নামে/ভাগ হয়ে গেল নজরুল।’ সেই ভাগা ভাগির প্রক্রিয়া থেকে এখনও মুক্ত নয় নজরুল। এর কারণ স্পষ্ট। নজরুল যদি তাঁর পুরো স্বরূপে সাধারণ্যে গ্রহণীয় হয়ে যান, তাহলে রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে যারা ‘ব্যবসা’ জাঁকিয়ে বসেছেন এবং বেশ ‘করে’ই খাচ্ছেন, তারা এটি আর চালিয়ে যেতে পারবেন না। তাই নজরুলের সামগ্রিক সৃষ্টিকে সামনে নিয়ে আসতে হবে নজরুলকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই এবং অখণ্ড নজরুলকে সাধারণ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আরও বেশি করে কাজ করার মধ্য দিয়েই বানচাল করে দিতে হবে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিরবি-নজরুলিকরণের সমস্ত প্রক্রিয়া। 

লেখক: স্বপন পাল, প্রাবন্ধিক ও গবেষক



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

ভূমির ছবি

প্রকাশ: ০১:০৩ পিএম, ২০ মে, ২০২৩


Thumbnail

কী ভীষণ উজ্জ্বল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখে এলাম,

যতবার দেখি উচ্ছ্বসিত আবেগে জ্ঞান বুদ্ধি কথা শূন্যে হারাই ,

স্মৃতির পরতে পরতে লেপ্টে এ ভূমির ছবিতে অনির্বার লুটোপুটি খাই ,

রোদ্দুর ছুঁয়ে বৃষ্টি শিশির ছুঁয়ে তোমার ছবি আঁকি,

সবচেয়ে উঁচুতে উদ্ধত ওড়ে সে ছবি ।

 

বাংলার বনভূমি ছায়াময় চিরহরিৎ তুমি হে বঙ্গকন্যা,

প্রান্তিক দুঃখী মানুষদের নিয়েই তোমার যত ভাবনা।

শ্যামলিমার আকুলতায়

কতশত তোমার ভুলভাল ছবি আঁকি,

তবু সবচেয়ে উঁচুতে উদ্ধত ওড়ে সে ছবি

আকাশ জুড়ে-বৈশ্বিক স্বীকৃতি, বাতাস জুড়ে বিস্তৃতি

চাঁদের আলোয় করে খেলা, রুপোর আলোয় গড়ে বেলা।

ছবির প্রতিটি কোনাকাঞ্চিতে আনন্দ মেলা,

কোন জ্যামিতিক মাপজোক নেই সে ছবিতে,

তবুও আমি এঁকেই চলি যতবার তোমায় দেখি,

উজ্জল সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি,

সবচেয়ে উঁচুতে উদ্ধত ওড়ে সে ছবি।

জনমনগণনন্দিত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা - তোমারই ছবি আঁকি এ ভূমিতে,

আমার বুক ভরা ভালোবাসার সব তুলিতে।


লেখক: শাহানা পারভীন 



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

আজ পঁচিশে বৈশাখ, কবিগুরুর ১৬২তম জন্মবার্ষিকী

প্রকাশ: ০৮:৩০ এএম, ০৮ মে, ২০২৩


Thumbnail

‘হে নূতন,/ দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।/ তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন/’— নিজের জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখকে এভাবেই ডাক দিয়েছিলেন কবিগুরু। মহাকালের বিস্তীর্ণ পটভূমিতে এক ব্যতিক্রমী রবির কিরণে উজ্জ্বল এই পঁচিশে বৈশাখ। ১৮৬১ সালের এদিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। পঁচিশে বৈশাখ আজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মবার্ষিকী। দিবসটি উদ্যাপনে ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংস্থার পক্ষ থেকে আজ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির চেতনা ও মননের প্রধান প্রতিভূ। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তিনি সগৌরবে বিচরণ করেছেন এবং রেখেছেন স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত অবদান। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্ববাদ, বৌদ্ধধর্মের অহিংস ও ইসলাম ধর্মের সুফিবাদ এবং বাংলার বাউলদের ভাববাদী চেতনার সমন্বয় সাধন করে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেন। বিশ্বে জঙ্গিবাদ, উগ্রতা, জাতীয়তাবোধের সংকীর্ণতা, শ্রেণিবৈষম্য, জাতিতে জাতিতে ও ধর্মে ধর্মে হানাহানি প্রতিরোধে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল কর্ম আজও মানবজাতিকে আলোর পথ দেখায়। তিনি তত্কালীন পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন সমাজসংস্কারক হিসেবে। তার জমিদারির সময় দরিদ্র প্রজাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, সমবায়নীতি ও কল্যাণবৃত্তি চালু এবং ক্ষুদ্রঋণের প্রচলন পরবর্তীকালে গ্রামীণ উন্নয়নে একটি মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির চেতনা ও মননের প্রধান প্রতিনিধি। তার জীবনাদর্শ ও সৃষ্টিকর্ম শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে চিরদিন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করবে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছিল প্রেরণার বিশেষ উৎস। শাশ্বত বাংলার মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা অর্থাৎ সকল অনুভব বিশ্বস্ততার সঙ্গে উঠে এসেছে রবীন্দ্রসাহিত্যে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছাতেই রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাদের জাতীয় সংগীত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংকট উত্তরণে প্রেরণা নিতেন রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। তিনি প্রধানত কবি। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। বাঙালি সমাজে তার রচিত সংগীতের জনপ্রিয়তা এত বছর পরেও তুলনাহীনভাবে বাড়ছে। তিনি ২ হাজার গান রচনা করেন। অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেন। তার সমগ্র গান ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে রয়েছে। কবির লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় সংগীতটিও কবির লেখা। জীবিতকালে তার প্রকাশিত মৌলিক কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে ৫২টি, উপন্যাস ১৩, ছোটগল্পের বই ৯৫টি, প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ ৩৬টি, নাটকের বই ৩৮টি। কবির মৃত্যুর পর বিশ্বভারতী থেকে ৩৬ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া ১৯ খণ্ডের রয়েছে ‘রবীন্দ্র চিঠিপত্র’। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কবির আঁকা চিত্রকর্মের সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৭৪টি চিত্রকর্ম শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। কবির প্রথম চিত্র প্রদর্শনী দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়।

রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে যত কর্মসূচি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এবার রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত নওগাঁর পতিসরে। এ ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহ্জাদপুর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে। এ উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবির চিত্রশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। বাংলা একাডেমিও  আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন