আজ (২২ অক্টোবর) রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ৬৯ তম
প্রয়াণ দিবস। ১৯৫৪ সালের এই দিনে পরাবাস্তববাদী কবি কোলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা
যান।
‘শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন
হেমন্ত আসেনি মাঠে, হলুদ পাতায় ভরে গেছে হৃদয়ের বন’
কবিতায় এমন ভাষা, রূপ-রস-গন্ধ জীবনানন্দ ছাড়া আর কে প্রকাশ
করতে পারেন? কবির জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে। তবে তাদের আদি নিবাস ছিল
বিক্রমপুরের গাওপাড়া প্রামে। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান; তার
ডাকনাম ছিল মিলু। তার ভাই অশোকানন্দ দাশ এবং বোন সুচরিতা দাশ। বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন
শিক্ষক ও সমাজসেবক। তাঁর পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে
নিবাস স্থানান্তরিত করেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে
দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন
এবং তাঁর মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন।
কবির মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহস্থ, কিন্তু তিনিও
কবিতা লিখতেন। তাঁর সুপরিচিত কবিতা “আদর্শ ছেলে’’-
'আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে'-
আজও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশুশ্রেণীর পাঠ্য। বলা হয়ে থাকে,
মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন জীবনানন্দ। যৌবনের
প্রারম্ভেই জীবনানন্দের কবিপ্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। অধ্যাপনায় ছিল জীবনানন্দের
কর্মজীবনের সূচনা ও সমাপ্তি। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি
কলেজে টিউটর হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। তারপরেই ১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ
“ঝরা পালক” প্রকাশিত হয়। সেসময় থেকেই তিনি তাঁর পারিবারিক উপাধি ‘দাশগুপ্তের’ পরিবর্তে
কেবল ‘দাশ’ লিখতে শুরু করেন।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে তিনি ইংরেজিতে
অনার্সসহ বিএ পাশ করেন। ওই বছরেই ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম কবিতা
ছাপা হয়। কবিতাটির নাম ছিল ‘বর্ষ আবাহন’। তিনি বাংলার রূপমুগ্ধতায় এই ভূ-খণ্ডকে দেখেছেন
রূপসী বাংলা রূপে। দেশের বৈচিত্র্যে প্রাণিত হয়ে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। যা আমাদের দেশ
ও সাহিত্যকে আসীন করেছে অনন্য উচ্চতায়। পরবর্তীতে ১৯২১ সালে কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ
থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেন। অতঃপর যুক্ত হন শিক্ষকতায়। ভারত ভাগের কিছুদিন আগে
স্থায়ী হন কলকাতায়।
১৯২৮ সালে সরস্বতী পূজা নিয়ে গোলযোগ শুরু হলে অন্যান্য
কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে তাকেও ছাঁটাই করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। জীবনের শেষভাগে কিছুদিনের
জন্য কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকা ‘স্বরাজ’-এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনায় নিযুক্ত ছিলেন।
একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন।
স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন। ১৯৫৪ সালে
অকাল মৃত্যুর সময় তিনি হাওড়া গার্লস কলেজ কর্মরত ছিলেন। দুই দফা দীর্ঘ বেকার জীবনে
তিনি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন এবং প্রধানত গৃহশিক্ষকতা করে
সংসার চালিয়েছেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ের চেষ্টাও করেছিলেন বছরখানেক। দারিদ্র্য এবং অনটন
ছিল তার কর্মজীবনের ছায়াসঙ্গী।
জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতাকে ঋদ্ধ করেছেন পরম যত্নে। তার
কবিতাজুড়ে বাংলার প্রকৃতি, নারী, প্রেম আর একাকিত্ব এসেছে ঘুরেফিরে। কবিতার বালিশে
মাথা রেখে শুনেছেন বিপন্ন মানুষের দীর্ঘশ্বাস। যেখানে প্রেম পরিগণিত হয়েছে নিরাক দুপুর
কিংবা মৃতপ্রায় হলুদ ঘাসের মতো।
জীবনানন্দ দাশ তার সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলেছেন বিপন্ন মানবতার
ছবি। আধুনিক নগরজীবনের অবক্ষয়, হতাশা, নিঃসঙ্গতা, সংশয়বোধ উদ্ভাসিত তার লেখনি সত্তায়।
ঘুরেফিরে এসেছে পরাবাস্তবতা। তার ভাবনার জগৎ জীবনের চেয়ে অধিকতর। বাংলার রূপ দেখে
পৃথিবীর ঐশ্বর্য খোঁজার ইচ্ছে জাগেনি তাই।
১৯৫২ সালে তাঁর জনপ্রিয় কবিতার বই বনলতা সেন সিগনেট প্রেস
কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের
শ্রেষ্ঠ কবিতা। ইংরেজি ছাড়াও ফরাসিসহ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে।
তাঁর মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় অজস্র গল্প ও উপন্যাস। এগুলোর প্রথম সংকলন জীবনানন্দ
দাশের গল্প (১৯৭২)। বেশ কিছুকাল পর প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯)।
পরবর্তীকালে আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী প্রকাশ করেন ১৯৮৬ সালে।
১০১টি চিঠির সংকলন জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র প্রকাশিত হয় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে।
এর আগে, ১৯৫২ সালে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন পরিবর্ধিত
সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায়
পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ
কবিতা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করে।
কবির মা কুসুমকুমারী দেবী হয়তো পুত্রের মধ্যে তার স্বপ্ন
জাগরণের আলো দেখেছিলেন। তাই তো লিখেছিলেন “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড়
হয়ে কাজে বড় হবে।“
কবিও যেমন বলে গিয়েছেন, “এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়
নাকো আর।“ ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় চিরন্তন এ কবির।
নিজের লেখা কবিতার মতোই হারিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু বেঁচে আছেন অনবদ্য কবিতায়।
মন্তব্য করুন
একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক মারা গেছেন। তিনি দীর্ঘদিন হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন।
বুধবার (২৪ জুলাই) দিবাগত রাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে তার মরদেহ রাজধানীর ভাটারার বাসায় আনা হবে। এরপর জানাজা শেষে নেয়া হবে চট্টগ্রামে। সেখানেই তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
ড. মাহবুবুল হক প্রবন্ধে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া গবেষণায় অবদান রাখায় ২০১৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
ড. মাহবুবুল হক ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর ফরিদপুরের মধুখালিতে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর বেড়ে ওঠেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান), ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯৭ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন।
তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে: বাংলা বানানের নিয়ম, রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্র ভাবনা, ইতিহাস ও সাহিত্য, সংস্কৃতি ও লোক সংস্কৃতি এবং বাংলার লোক সাহিত্য: সমাজ ও সংস্কৃতি প্রভৃতি।
মন্তব্য করুন
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ছোটকাগজ সম্পাদনায় বিশেষ অবদান রাখায় চলনবিল সাহিত্য পুরস্কার পেলেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ছোটকাগজ ‘হৃদয়ে চলনথ এর সম্পাদক কবি হাদিউল হৃদয়। হাদিউল হৃদয় তাড়াশ প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দৈনিক কালবেলা পত্রিকার তাড়াশ উপজেলা প্রতিনিধি।
শুক্রবার (১২ জুলাই') সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরীর হল রুমে আনুষ্ঠানিকভাবে কবি কণ্ঠে কবিতা সংগঠন থেকে প্রধান অতিথি তাড়াশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. মনিরুজ্জামান মনি এ পুরস্কার স্মারক ও সনদপত্র তুলে দেন।
সাবিনা ইয়াসমিন বিনুর সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন মল্লিকী। আলোচনা সভায় সংগঠনের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক রাজুর সভাপতিত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন, তাড়াশ পৌরসভার কাউন্সিলর রোখসানা খাতুন রুপা, পাবলিক লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক মোজ্জামেল হক মাসুদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক হোসনেয়ারা নাসরিন দোলন, যুগ্ম সম্পাদক লুৎফর রহমান, উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা সোহাগ, প্রভাষক আব্দুল কাদের, প্রভাষক আব্দুল মতিন প্রমূখ।
উল্লেখ্য, হাদিউল হৃদয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র তাড়াশ উপজেলার তালম ইউনিয়নের পল্লীর নিভূত অজোপাড়া পাড়িল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত্ব মুসলিম পরিবারে জন্ম। তিনি একজন সাংবাদিক ও সাহিত্য কর্মী। মূলতঃ কবিতা দিয়ে শুরু করলেও প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য ও ছড়া লিখেন। তার লেখা লিটলম্যাগ ও দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। তার সম্পাদনা হৃদয়ে চলন ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১২টি সংখ্যা প্রকাশ হয়েছে। সম্পাদনার স্বীকৃতিস্বরূপ এর আগেও বিভিন্ন সংগঠন থেকে পেয়েছেন সম্মাননা ও পুরস্কার।'
মন্তব্য করুন