নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ০১ অগাস্ট, ২০২১
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যে কয়জন নবীন কবির দীপ্ত আবির্ভাব হয়, কবি মোহন রায়হান তাদের অন্যতম। বাংলাদেশের কবিতার ধারায় কবি মোহন রায়হান এক তেজী কণ্ঠস্বর। ১৯৭১-এর রণাঙ্গন থেকে উঠে আসা দ্রোহ, প্রেম, স্বাধীনতা, সাম্য ও বিপ্লবের কবি মোহন রায়হান কবিতাকে কেবল শিল্প ভাবেন না বরং কবিতা তাঁর কাছে সমাজ বদলের শাণিত হাতিয়ার। জীবন ও কবিতায় সমান লড়াকু কবি মোহন রায়হান। কবি মোহন রায়হান আমাদের দেশের এক কিংবদন্তি পুরুষ। তাঁর জীবন ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঘাত-প্রতিঘাত ও উত্থান-পতনের জটিল আবর্তনের খতিয়ান। রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সাহিত্য আন্দোলনের ইতিহাসে কবি মোহন রায়হান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
কবি মোহন রায়হান ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিঁনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর বাবা মরহুম ফরহাদ হোসেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিক, সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের খোকশাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের অত্যন্ত জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন। তিঁনি একটানা ৩০ বছর চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে খোকশাবাড়ি হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবয়ড়া গোয়েন বাঁধ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সিরাজগঞ্জের কওমী জুট মিলস লি. প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা। কবি মোহন রায়হানের মা মরহুমা মাহমুদা খাতুন ছিলেন আজীবন সমাজ হিতৈষিনী।
কবি মোহন রায়হান স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও কবিতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিঁনি বাংলাদেশের একজন অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় কবিতা পরিষদের দুই বারের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ রাইটারস্ ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, স্ফুলিঙ্গ সাংস্কৃতিক সংসদ, সৃজন, আবৃত্তি সংসদ, বাংলাদেশ লেখক শিবির, প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি, অরণি সাংস্কৃতিক সংসদ, তাহের সংসদ, রাখাল, লেখক ইউনিয়ন, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটিসহ অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনায় দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্র-পত্রিকাগুলোর মধ্যে ঢেউ, সূর্য সৈকত, স্ফুলিঙ্গ, সমকণ্ঠ, জনান্তিক, অরণি, সাহস, দুর্বিনীত এই মাটি জ্বলে প্রতিরোধে, লাল তোমার পতাকা, ইশতেহার, বিদ্রোহের পংক্তিমালা উল্লেখযোগ্য। তিঁনি সাপ্তাহিক দিকচিহ্ন, কবিতাপত্র দিকচিহ্ন এবং সাওল সময় পত্রিকার সম্পাদক।
তিঁনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাহিত্য সম্পাদক ও জাতীয় সমাজতান্ত্রীক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দেন কবি মোহন রায়হান। তিঁনি ছিলেন সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দেশ-কাঁপানো সাহসী ছাত্রনেতা। আশির দশকে স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের সূচনাকারী ১৪টি ছাত্র সংগঠন নিয়ে যে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়, তিঁনি তার কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ১৯৮৩ সালেরৈ ১১ জানুয়ারি ছাত্র-বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে প্রথম সামরিক শাসন ভঙ্গ করে ১০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মিছিল নিয়ে শিক্ষাভবন ঘেরাও করেন। এ অভিযোগে তাঁকে চোখ-হাত বেঁধে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী তুলে নিয়ে ২১ দিন গুম করে রেখে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে পঙ্গু করে দেয়। পরে ভারতের চেন্নাইয়ে অপারেশন করায়ে তিঁনি চলাচলে সক্ষমতা লাভ করেন।
এই কবি সম্পর্কে কবি শামসুর রাহমান বলেছেন- ‘বাংলাদেশের প্রতিবাদী কবিতার ধারা যে ক’জন কবির অবদানে বেগবান হয়ে উঠেছে, মোহন রায়হান নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। এ তেজী তরুণ কবি কবিতাকে ব্যবহার করেন সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে। তাই তাঁর কবিতা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মতো ঝলছে ওঠে, নতুন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে।’
সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন- ‘কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই বিক্রি হয়েছেন। মোহনকে আমি জানি, চিনি এবং বিশ্বাস করি সে তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম।’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন- ‘মোহন জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছে, নির্যাতনও সহ্য করেছে কিন্তু কখনও নিজের স্থিরবিন্দু থেকে সরে যায় নি। তার কবিতার মধ্যে রয়েছে আগুন, যা অনেককে উদ্দীপ্ত করে। কবিতার আন্দোলনের সঙ্গে সে জড়িত। বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাঁর আদর্শ। আমি দেখেছি, পশ্চিম বাংলাতেও সে বেশ জনপ্রিয়। অনেক তরুণ-তরুণী তার কবিতা আবৃত্তি করে।’
কবীর চৌধুরী বলেছেন- ‘মোহন রায়হান সমাজ-পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই পরিবর্তনের জন্য সে মার্ক্সীয় বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতার দর্শনে আস্থাশীল। এবং সে একজন নিষ্ঠাবান কবি। তাঁর জীবন ও কবিতা একসূত্রে গাঁথা। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে এই ধারার একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। মোহন রায়হান তাঁর স্বকীয়তা নিয়ে ওই ধারার একজন উল্লেখযোগ্য কবি। বিপ্লব ও বিদ্রোহ মোহনের কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও তাঁর কবিতা একমুখী নয়। বেশকিছু প্রেমের কবিতা আছে তাঁর। ওই কবিতাগুলি কখনো গাঢ় আবেগে উত্তাল, কখনও স্নিগ্ধ মাধুর্যে কোমল। কখনও কখনও তিনি ছন্দ নিয়ে খেলা করেছেন, কখনও ভাষা নিয়ে।’
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন- ‘মোহন তাঁর লেখা একটি কবিতায় মাইকেল মধুসূদন ও নজরুল ইসলামকে স্মরণ করেছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। ওই দুই কবির মতোই সেও বিদ্রোহী, বলা যায় বিপ্লবী। তুলনার প্রশ্ন অবান্তর কিন্তু তাঁর কবিতায় মাইকেল মধুসূদনের উপস্থিতিটাই বিশেষভাবে গ্রাহ্য। মাইকেলের মতোই সে প্রথাবিরোধী এবং মনে-প্রাণে বাঙালি-পরিস্থিতি যাকে বিপরীত দিকে ঠেলতে চায় কিন্তু নিজ ভূমির প্রতি ভালবাসায় সে অনড়।’
কামাল লোহানী বলেছেন- ‘মোহন বিমোহিত করেছিল রাজপথকে একদিন, যখন রাজনীতির লোকযাত্রা খানিকটা উঁকি দিয়েছিল প্রিয় স্বদেশে, তখন তারুণ্যের রক্তিম উদ্ভাস তাঁকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। মোহন রায়হানকে আমি সংগঠক হিসেবে চিনেছিলাম। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাঁর দক্ষ সাংগঠনিক ভূমিকা নজর কেড়েছিল পূর্বসুরিদেরও। যমুনার কুলে বাস করে নিত্যই ভাঙন রোধ করেছে যে শক্তি পাঁজরের সংঘবদ্ধ বুকটা দিয়ে সেই এক তরুণের আবেগতাড়িত অথচ রাজনীতির আদর্শনিষ্ঠ রুদ্র শব্দাবলী শুনেছিলাম একদিন।’
বেলাল চৌধুরী বলেছেন- ‘মানবীয় ও অতিমানবীয় গুণাবলি থেকে শুরু করে দর্শনকাণ্ডের প্রায় সকল বিষয়ই কবিতার প্রাথমিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। আর কবিতার নতুন আগমন তো আরো রহস্যময়-আবিষ্কার প্রবণতাই কবির কলমের চলমানতা বা গতিপ্রবাহ। আরো জটিলতর হয়ে উঠেছে সমকালীন বিশ্ব কবিতা-সেখানেও মোহন রায়হান নিঃসন্দেহে একজন একাই একশোর মতো কবি। মোহন পাঠে এটাই আমার সিদ্ধান্ত।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন- ‘জন্মান্ধ উৎসাহ ওর রক্তগত। ওর ক্রোধ আর দ্রোহের উৎস প্রেম। একটা সুখী ও মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন ওকে উজ্জীবিত করে, তার বিপর্যয় ওর ভেতর ক্রোধ জাগায়। এজন্যেই ওর সারাজীবনের পদচারণা ভালবাসা থেকে বীর রসে, বীর রস থেকে রুদ্রে। ওর প্রধান পরিচিতি উচ্চকণ্ঠ কবিতায়, হয়ত ওর সচেতন অবচেতন আকুতিও তাই। কিন্তু ওর নিবিড় ও নিম্নকণ্ঠ কবিতার সিদ্ধিও যে বেশ গভীর তা অনেকেরই চোখে পড়ে না। ওর প্রেমের কবিতা, স্বপ্নের কবিতা পাঠকের বেঁচে থাকার ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। ওর ভয়-ধরানো আশাবাদ ও নৈরাশ্য, দুর্ধর্ষ ক্রোধ ও নিষ্ক্রিয়তা, পেলব প্রেম আর মানবতার স্বপ্ন সব নিয়ে ওকে শুভেচ্ছা।’
আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেছেন- ‘মোহন রায়হানের কবিতা মানুষের পোড় খাওয়া জীবনে এক অনির্বচনীয় স্বাদ বহন করে আনে। তাঁর কবিতার ভেতরে স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতার এক অপূর্ব মিশেল আমি লক্ষ করেছি। যে স্বদেশের প্রতি তাঁর বেদনাময় অর্ঘ কবিতার ছত্রে ছত্রে, সে অর্ঘ কত সহজেই বিশ্বের ভৌগোলিকতার ভেতরে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলে। মাটি, মানুষ, সমাজ, প্রেম এবং প্রকৃতির রসায়ন হচ্ছে মোহনের কবিতা।’
সেলিনা হোসেন বলেছেন-‘মোহনের কবিতায় সাহস ও স্নিগ্ধতা একই সঙ্গে বয়ে যায়। প্রতিবাদ ও ভালবাসা একইসঙ্গে বয়ে রয়। জীবনের এপিঠ-ওপিঠ মোহন খুব কাছ থেকে দেখেন। দেখেন অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে। মোহন ঘুরে ঘুরে জীবনের অন্বেষনে ফিরে ফিরে দেখেন নতুন দরোজা। খোলা দরোজায় ঢুকে যায় আলো-বাতাস, ঢুকে যায় আগুন।’
হায়াৎ মামুদ বলেছেন- ‘মোহন রায়হানের কবিতা অনাগত ভবিষ্যতেও ক্রমাগত কুসুম ফোটাতে থাকবে। এটাই আমার বিশ্বাস। কারণ, তাঁর কবিতার উৎসবিন্দু বাংলাদেশের মাটিতে আরও দীর্ঘকাল শোণিতসিক্ত থেকে যাবে, শুকোবে না।’
কবি সাযযাদ কাদির বলেছেন- ‘নতুন ইতিহাসের বুকে এ রকম এক নতুন জন্মের ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ মোহনের। তারপর নতুন রণাঙ্গনের অঙ্গীকার তাঁকে নিয়ে যায় বীরের রক্ত আর মায়ের অশ্রুর কাছে-তাঁর পরিচয় হয়ে ওঠে আন্দোলন সংগ্রাম যুদ্ধ বিপ্লবের এক সোচ্চার অনুষঙ্গ; কত নামের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাঁর নাম-শহীদ মনিরুজ্জামান তারা, কমরেড শহীদ সিরাজ শিকদার, কর্নেল আবু তাহের, মার্কস, লেনিন, মাওসেতুং, থালমান, গ্রামসি, লুকসেমবার্গ, হো চি মিন, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, চে গুয়েভারা, হোকাকু, শাহজাহান সিরাজ, ইলা মিত্র, বেনজামিন মলয়েজ, রউফুন বসুনিয়া, কফিল, উইনি, ডা. মিলন, অনুপ চেটিয়া, মধু দা, নূর হোসেন ... আরও কত নাম। আমি এই মোহনকে চিনি-সে কোনো ব্যক্তি নয়, এক শক্তি।’
মফিদুল হক বলেছেন- ‘মোহন রায়হানকে দেখে আমার মনে হতো অগাস্তঁ ব্লাঙ্কির কথা। কার্ল মার্কসের একটি রচনা ছিল ‘ব্লাঙ্কি দ্যা ইনসারেকশনিস্ট’। রচনার উদ্দিষ্ট সেই মানুষটি যিনি বিপ্লবী গণ-উত্থানের জন্যে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। ব্লাঙ্কির জীবন কেটেছে কারাগারে ও রাজপথে এবং ১৮৭১ সালের পারি কমিউনের তিনি ছিলেন অন্যতম নায়ক। ব্লাঙ্কি সম্পর্কে কার্ল মার্কসের ঐ অভিধা মনে পড়ে যায় মোহন রায়হানকে দেখে-মিছিলে যে যুবক থাকবে সবচেয়ে আগে, পুলিশের সামনে এগিয়ে যাবে নির্দ্বিধায় এবং সংঘাতের জন্যে যেন সব সময়ে মুখিয়ে আছে। আমার মনে হতো এরকম অকুতোভয় তরুণরাই তো পারি কমিউনের যুগ থেকে দেশে দেশে জনগণের বিপ্লবী উত্থানের অগ্রপথিক হয়ে থেকেছে। আগুন জ্বলে উঠতে যে স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন তার যোগানদাতা এঁরা। সেই থেকে আমি মোহন রায়হানকে চিনি। আর সবাই তাঁকে নানাভাবে চেনেন, আমার কাছে এই যুবক তখন থেকেই মোহন দ্যা ইনসারেকশনিস্ট।’
শাহরিয়ার কবির বলেছেন- ‘সত্তরের দশকের এক ব্যতিক্রমী কবি মোহন রায়হান। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা কবিতায় প্রান্তিক মেহনতি মানুষের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-যন্ত্রণা মোহনের কবিতায় যেভাবে বাক্সময় হয়েছে তাঁর সমসাময়িক অন্য কোনো কবির রচনায় আমরা তেমনটি প্রত্যক্ষ করিনি। মোহন আপাদমস্তক একজন রাজনৈতিক কবি-নেরুদা, লোরকা, নাজিম হিকমত, নজরুল, সুভাষ, সুকান্ত আর দীনেশের যোগ্য প্রতিনিধি। মোহনের মতো আর কোনো কবি সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারানির্যাতনের শিকার হননি।’
সলিমুল্লাহ খান বলেছেন- ‘যে কবিতা আমি লিখিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু পারি নাই। একদিন দেখিলাম আমার বন্ধু কবি মোহন রায়হান সেই কবিতা ‘সাহসী মানুষ চাই’ লিখিয়া ফেলিয়াছেন। তাহাকে অভিনন্দন জানানোই আমি আমার কর্তব্য বলিয়া সাব্যস্ত করিলাম। ভর্তি হইলাম তাহার অগুনতি ভক্তদের দলে।’
কামাল চৌধুরী বলেছেন- ‘একজন কবি প্রেমিক না হলে তার পক্ষে দ্রোহী হওয়াও সম্ভব নয়। দ্রোহ এক ধরনের প্রেমেরই নামান্তর। ইতোমধ্যে তাঁর অনেকগুলো গ্রন্থ বেরিয়েছে। লালটুপি মার্কা একটা রাগী চেহারা তাঁর দাঁড়িয়ে গেলেও শুধু দ্রোহী বা বিপ্লবী বললে তার কবিতার যথার্থ মূল্যায়ন হবে না। ভেতরে ভেতরে এক অসাধারণ প্রেমিক লুকিয়ে আছে তাঁর কবিতায়। তাঁর প্রেম, তাঁর ভালবাসা, তাঁর স্বদেশ- সেই সঙ্গে প্রিয় নারীর সান্নিধ্যের কুহকও জড়িয়ে আছে কবিতার পরতে পরতে।’
বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন- ‘সঙ্ঘশক্তির জাগরণ দিয়ে, ঐতিহ্যের শক্তি দিয়ে, লোকজীবনের সাহস দিয়ে মোহন রায়হান নির্মাণ করতে চেয়েছেন একটি নতুন পৃথিবী। কবিতায় এই নতুন পৃথিবীর সন্ধান তাঁর উপনিবেশবাদ-বিরোধী মানসিকতারই আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ। শোষণমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার বাসনায় তাঁর কবিতায় এসে মিশেছে সাম্যবাদী যুবক, গ্রামীণ কালো চাষা, সর্বহারা শ্রমিক। উপনিবেশবাদ-বিরোধী এই বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের কবিতার ধারায় মোহন রায়হানকে এনে দিয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা, প্রাতিস্বিক প্রতিষ্ঠা।’
মন্তব্য করুন
ত্বরিত গতির সুকন্যা
-শাহানা পরভীন
তুমি সিঁদুর রঙে ভিজে, কলেজের সেই র্যাগিং ছলে,
এক পলকে দোওয়াত কালি খুঁজে ফিরে, চটাস করে হারিয়ে দিলে।
আচ্ছা করে রাঙিয়ে দিলে ওদেরই বালতি ভরা রং ঢেলে।
ভুলে ভালে ক্লাস খুঁজে দিনটি হলো কাবার,
চায়ের কাপে ঝড় তুলে, আনন্দে মাতিয়ে সাবার।
প্রতিক্রিয়ার কী দারুণ ত্বরিত কোড তোমার !
বিধাতা দিয়েছেন বঙ্গমাতার গর্ভে, তোমার জন্মকালে।
সেই শিশুকালে মানবতার ত্বরিত গতিতে বলেছিলে-“আব্বা ,
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ,
রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।”
সেই কৈশোরে সাহসিকতার বিদ্যুৎ গতির কোডে বলেছিলে-
“আমি করবো না সই ,
যদি না বাজেট বরাদ্দ পাই ।”
ইটের ‘পরে ইটে শহীদ মিনার গেঁথে,
ঘন্টার পর ঘন্টা বন্দি থেকে,
বুকের পাঁজরে অবিরত সুর তুলে বলেছিলে,
“এই কলেজে শহীদ মিনার চাই।”
তারুণ্যে মা বাবা ভাই সব প্রিয়জনকে হারিয়ে ,
বেদনার আগুনে পুড়ে-
সমস্ত শোককে শক্তি করে,
জন্ম -জন্মভূমি, বাংলা-বাঙালির উন্নয়নের তরে-নিত্য শুভার্থী তুমি।
প্রকাশ্যে সব সত্য জ্বেলে- ভয়হীন,আত্মমর্যাদার সুইফট কোডে -অতন্দ্র প্রহরী তুমি।
পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে-
স্মার্ট সোনার বাংলাদেশ বির্নিমানে-
এই প্রৌঢ়েও-
শত সাধনা- সংগ্রাম -তারুণ্যের সুইফট কোডে,
বাংলাদেশকে নিয়ে আনখমস্তক ছুটে চলো ,
তুমি বাঙালির পরম আপনজনা, মুজিব সুকন্যা,
বিশ্ব সংসারে তুমিই একজনা, শেখ হাসিনা।
১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আজ রোববার (২৭ আগস্ট) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের শোকের মাসের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত।
কাজী
নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক
পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন
একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক,
গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা।
তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি
করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
কবির
মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন
বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবির সমাধিতে পুস্পস্তবক
অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, দোয়া মাহফিল
এবং আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারী
টেলিভিশন চ্যানেল কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে
বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে।
নজরুলের
সৃষ্টিকর্ম প্রসঙ্গে নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ‘নজরুল ইতিহাস ও সময় সচেতন
মানুষ ছিলেন, যার প্রভাব তাঁর
লেখায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ
বিরোধী আন্দোলনের তরঙ্গকে নজরুল তাঁর সাহিত্যে বিপুলভাবে
ধারণ করেছেন। সেই সময়ে ধর্মান্ধ
মুসলমানদের তিনি পুনর্জাগরণের ডাক
দিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তাঁর
ভূমিকা ছিল একজন বলিষ্ঠ
নেতার মতো।’
প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ
ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও
কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।
নজরুলের কবিতা, গান ও সাহিত্য
কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক
চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয়
জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর
কবিতা ও গান মানুষকে
যুগে যুগে শোষণ ও
বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ
দেখিয়ে চলছে।
নজরুল
ছিলেন চির প্রেমের কবি।
তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম
নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী,
কিন্তু তার প্রেমিক রূপটিও
প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই
বলতে পারেন, ‘আমার আপনার চেয়ে
আপন যে জন খুঁজি
তারে আমি আপনায়।’
কাজী
নজরুল ইসলাম ১৩০৬ সালের ১১
জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম
ছিল ‘দুখু মিয়া’।
বাবার নাম কাজী ফকির
আহমেদ ও মা জাহেদা
খাতুন।
স্বাধীনতার
পরপরই কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা
করেন এবং ধানমণ্ডিতে কবির
জন্য একটি বাড়ি প্রদান
করেন।
জাতীয়
কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয়
মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়
দাফন করা হয়। সেখানেই
তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৭:৫৬ এএম, ২০ অগাস্ট, ২০২৩
চলছে শোকাবহ আগস্ট মাস। এ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বই ‘পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি’ এর ধারাবাহিক পর্বের বিংশ পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
ঢাকার একটি রেস্তোরাঁ। চা খেতে বসেছে দু বন্ধু। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলল যে কিছুদিনের মধ্যেই বর্তমান মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিণত করা হবে। পুনর্গঠিত নতুন জেলায় নতুন প্রশাসক হবেন জেলা গভর্নর এবং তাঁর থাকবে নিরঙ্কুশ শাসনক্ষমতা। জেলা গভর্নরকে একমাত্র বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। নতুন জেলা গভর্নররা ক্ষমতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে অগণিত লোককে হত্যা করা হবে এবং বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা কেউ করলে সোজা জেলে ঢুকিয়ে দেবে। সমবায়ের নামে ঘরবাড়ি আর জায়গা-সম্পত্তি কেড়ে নেয়া হবে। বন্ধুর মুখে এই ধরনের কথাবার্তা শোনার পর অপর বন্ধুটি জানায়, সেও এসব কথা আগেই শুনেছে।
আসলে এ ধরনের অপপ্রচার হাবিবুর রহমান গং তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সারা দেশেই ছড়াতে থাকে। সামান্য সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে মিশিয়ে অপপ্রচার চালালে তা সহজেই লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কথাটা মনে রেখেই ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের কাজে নেমেছিল। তারা ভাল করেই জানত একটা সময় পর্যন্ত সাধারণ মানুষ এ ধরনের অপপ্রচারের মুখে মিথ্যাকে সত্য থেকে আলাদা করতে পারে না। আর ক্ষমতার কাছাকাছি যারা থাকে, তারা নিজেরাই যখন ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে তাদের জানা কিছু কিছু সত্য ঘটনার সঙ্গে মিথ্যার রং মিশিয়ে অপপ্রচারে নামে, তখন জন্গণ অনায়াসে বিভ্রান্ত হবে। জেলা গভর্নরসংক্রান্ত প্রসঙ্গের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না।
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে ঔপনিবেশিক আমলের মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে গভর্নর নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তবে এসকল গর্ভনর হবেন জনগণের নির্বাচিত এবং তারা ক্ষমতাকে প্রয়োগ করবেন এমন এক কমিটির মাধ্যমে, যে কমিটিতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজন থাকবে। কমিটির এসকল সদস্য জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকবে। কমিটির এসকল সদস্য জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ইচ্ছেমতো কিছু করার সুযোগ পাবেন না। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় প্রশাসনকে নিয়ে যেতে পারলে দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই তাদের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগের সুরাহা করতে পারবে। জবাবদিহিমূলক বিকেন্দ্রীকরণ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তক করলে জনগণ তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের একটি সুযোগ পাবে। এই নতুন পদ্ধতিতে যেহেতু নিরঙ্কুশভাবে কারো হাতে ক্ষমতা থাকবে না, কাজেই ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ না কারণে ঔপনিবেশিক আমলের মতো শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তারা জনগণের শক্তি আর মালিকসুলভ ব্যবহারের সুযোগ পাবে না। কিন্তু দুভাগ্য যে এ সরল সত্য জনগণকে বোঝানোর মতো লোকের তখন অভাব ছিল।
পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছিল যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ধরা জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছিল। এদিকে সহায়-সম্বলহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছিল। ধনী ও গরিবের মধ্যে বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই সমবায়ের ধারণাকে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপে পরিণত করার চেষ্টা করলেন। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল যারা জমি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সম্পত্তির আরও উন্নতি ও উৎকর্ষসাধন করতে পারবে তেমনি যারা শ্রমিক তারা সম্পত্তির ভাগিদার হওয়ার ফলে নিজেদের শ্রম দিয়ে দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে তুলবে। তাদের অধিকারও নিশ্চিত হবে। এ কারণে সমবায়পদ্ধতি পরিচালনার জন্যে এ ধরনের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যেখানে কারো নিজের ক্ষমতা অন্য কারোর উপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।
বঙ্গবন্ধুর নতুন জেলা প্রশাসন ও সমবায়পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরে ষড়যন্ত্রকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা এতদিন ধরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে এবং অপপ্রচার চালিয়ে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়, যার ফলে তাদের ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে শেষ করবার পূর্বে জনগণ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু তারা হিসেব করে দেখল যে, একবার যদি নতুন পদ্ধতি চালু হয়ে যায় এবং জনগণ যদি বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তা হলে তাঁকে শেষ করে কিছুতেই পার পাওয়া যাবে না। নতুন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রের পক্ষে কাজ করে যাওয়া এক লক্ষ লোককেও রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কাজেই নতুন পদ্ধতির সুফল জনগণের কাছে পৌঁছানোর আগেই যা করার করতে হবে। আসলে ষড়যন্ত্রকারীরা আতঙ্কিত হলেও তা ছিল সাময়িক। তারা কুমিল্লায় বসে নতুন অবস্থার পর্যালোচনা করতে থাকে। তারা খুঁটিনাটি বিষয় পর্যালোচনা করে দেখল যে, তাদের ঘাবড়াবার কিছু নেই। শুধু জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে একের পর এক গুজব সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে বঙ্গবন্ধুকে জনগণের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা সম্ভব হয়। যেহেতু প্রশাসনযন্ত্র থেকে শুরু করে সর্বত্রই ষড়যন্ত্রকারীদের অবাধ গতি কাজটি করা তাদের পক্ষে তাই বেশি কঠিন হওয়ার কথা নয়।
বাস্তবেও ষড়যন্ত্রকারীদের কাজটি বেশি কঠিন হল না। অপপ্রচার বিশেষ করে একের পর এক গুজব এমনভাবে ছড়ানো হতে থাকল যে, জনগণ জেলা গভর্নর ও সমবায়পদ্ধতির আসল উদ্দেশ্যই বুঝতে সক্ষম হল না। গুজবে কান দিয়ে তারা হল বিভ্রান্ত। এ সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর উপর আঘাত হানার জন্যে তাদের সময় নির্দিষ্ট করল। ষড়যন্ত্রকারীরা একটি বিষয়ে নিশ্চিত হল যে, বঙ্গবন্ধুকে শেষ করতে হলে যে করেই হোক কাজটা করতে হবে নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ার আগেই। সময়ের বিষয়টি তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সকল ষড়যন্ত্রকারী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে এবং দেশের পরিস্থিতি সঠিকভাবে আঁচ করেই বঙ্গবন্ধুকে চূড়ান্তভাবে আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। যাদের দায়িত্ব ছিল যড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করা, তাদের অনেকেই ষড়যন্ত্রে শরিক হওয়ার ফলে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগীরা আঘাত সম্পর্কে কিছুই আঁচ করতে পারলেন না।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৯:১২ এএম, ১৯ অগাস্ট, ২০২৩
চলছে
শোকাবহ আগস্ট মাস। এ মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে
হত্যা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ
মোদাচ্ছের আলীর সারা জাগানো বই ‘পিতা, আমরা মুক্ত আকাশ দেখছি’ এর ধারাবাহিক পর্বের
ঊনবিংশ পর্ব পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
ঢাকার মগবাজার এলাকার একটি বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শুরু হয়েছে। এতে অংশ নিয়েছে ৭১-এর ঘাতক আল-বদর, আল-শামসের সদস্যরা। আলোচনার মূল বিষয় হল, কিভাবে বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারকে খতম করা যায়। কেননা, বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় থাকলে এদেশকে কিছুতেই পাকিস্তানের অনুগত রাখা যাবে না। তা ছাড়া ৭১-এর পরাজয়কে আল-বদর, আল-শামসরা কিছুতেই ভুলতে পারেনি।
সভায় বক্তারা যেসকল বক্তব্য প্রদান করে চলল, তাতে স্পষ্ট হল যে, ইতিমধ্যেই তাদের সঙ্গে হাবিবুর রহমান গংদের যোগাযোগ হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান তাদের এই তৎপরতাকে সমর্থন করার জন্যে যা যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই করতে প্রস্তুত। হাবিবুর রহমানদের তরফ থেকে তাদেরকে এই আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের কাজকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। কাজেই হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে বিষয়টি জটিল হওয়াতে তাদের সকলকে বাহ্যিকভাবে আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে যেতে হবে যাতে করে জনগণ কিছুতেই আঁচ করতে না পারে যে ষড়যন্ত্রকারীদের এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রুপের কোনোপ্রকার যোগাযোগ আছে। কাজের সুবিধা এবং জনগণকে সহজে বিভ্রান্ত করার জন্যেই তারা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন মগবাজারের মিটিং-এ ৭১-এর আল-বদর, আল-শামস হিসেবে যারা উপস্থিত হয়েছে, তাদেরকে সাংকেতিক নাম দেয়া হয়েছে মগবাজার গ্রুপ। কাজেই মগবাজার গ্রুপ বললেই বুঝে নিতে হবে, তারা কারা।।
ষড়যন্ত্রকারীদের একটি অঙ্গ হিসেবে মগবাজার গ্রুপ কাজ চালিয়ে গেলেও তাদের আসল নেতা দেশের বাইরে অবস্থান করছিল। এতে তাদের অসুবিধা নয়, বরং সুবিধাই হয়। কেননা, জনগণ থেকে শুরু করে সরকারের অধিকাংশ লোকই বুঝতে পারেনি যে, মগবাজার গ্রুপ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। বরং তাদের ধারণা ছিল যে, দেশের পরিস্থিতি ৭১-এর ঘাতকদের অনকূলে নয়। এ কারণেই তারা নিজেদের গা বাঁচাতে ব্যস্ত। সুতরাং ওদের তরফ থেকে কোনোরকম ক্ষতির আশঙ্কা নেই। অথচ প্রকৃত অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
যা হোক, মগবাজারের সভায় উপস্থিত সদস্যদের আশ্বস্ত করা হয় যে, তাদের নেতা বিদেশে অবস্থান করলেও নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন। দেশের অভ্যন্তরে কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ চালিয়ে যেতে হবে, সে নির্দেশও তিনি বিদেশ থেকে দিয়ে চলেছেন। তারই নির্দেশে মগবাজার গ্রুপ কুমিল্লা গ্রুপ হিসেবে পরিচিত হাবিবুর রহমান। চলেছে এবং নিজেদের শক্তি সম্পর্কে অনেক বেশি আশাবাদী হয়েছে। তারা মনে করে, গং-এর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাটা এখন আর কোনো কঠিন কাজ নয় এবং হত্যাপরবর্তী জামেলাটা সামাল দেয়াও তেমন কঠিন কাজ হবে না।
মগবাজার গ্রুপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তাদের সদস্যরা দেশের যে-কোনো স্থানেই অবস্থান করুক না কেন, তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে হবে। জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের অংশ হিসেবে বেশি করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। এর ধর্মীয় অনুষ্ঠান মগবাজার গ্রুপের সদস্যরা কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করবে। ইয়লামের পবিত্র বাণী-প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে কৌশলে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যেতে হবে। একই লক্ষ্যে দেশের অধিকাংশ মসজিদের সঙ্গে গ্রুপ সদস্যদের সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও মসজিদের মাধ্যমে এদেশের ধর্মভীরু জনগণের যত কাছাকাছি যাওয়া যাবে, অন্য কোনো পন্থায় ততটা কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব নয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও মসজিদের মাধ্যমে লোকজনকে ধীরে ধীরে বোঝাতে হবে, বঙ্গবন্ধু সরকারের এদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশ থেকে ইসলামকে শেষ করে দেয়া। জনগণকে যদি কথাটা ভালভাবে বোঝানো যায়, তা হলে তাদের মধ্যে জেহাদি মনোভাব সৃষ্টি হবে। সাধারণ মানুষকে এভাবে বিভ্রান্ত করা গেলে বঙ্গবন্ধুকে সহজেই জনগণ থেক বিচ্ছিন্ন করা যাবে। জনগণকে আরো বোঝাতে হবে, ভারত থেকে অনেক হিন্দুকে আমদানি করা হয়েছে, যাদের কাজই হচ্ছে দেশ থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করে দেয়া। এসকল হিন্দু বিভিন্নভাবে মুসলমানদের বেশ ধারণ করে তাদের কাজ গোপনে গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মুসলমান পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছে। কাজেই সাচ্চা মুসলমান হিসেবে এদেরকে রুখতে হবে। এটা সকলের জন্যে ফরজ হয়ে গেছে।
তখন ৭১ সালে ট্রেনিংপ্রাপ্ত আল-বদর, আল-শামসের সদস্যরাই সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এমনকি বিভিন্ন উপায়ে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনে ঢুকতে সক্ষম হয় তাদের অনেকেই। এ ছাড়া নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থেই নতুন রাজনৈতিক দল জাসদে ভিড়ে যাওয়া সদস্যরা তো ছিলোই। মগবাজার গ্রুপ এসকল খুনীদেরকেই আবার সংগঠিত করতে থাকে। কারণ তারা জানত, সুসংগঠিত আল-বদর, রাজকাররা আবার মনোবল ফিরে পাবে এবং ৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগও হাতছাড়া করবে না। কথায় আছে, যে বাঘ একবার মানুষের মাংসের স্বাদ পেয়েছে, সে সুযোগ পেলেই মানুষ হত্যা করবে। ৭১-এ যারা একবার নিরীহ জনগণকে হত্যা করে হত্যার স্বাদ পেয়েছে, মা-বোনদের ধর্ষণ করে ধর্ষণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে—সেইসকল সাচ্চা কর্মীদের দিয়ে দুনিয়ার এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করানো যাবে না।
মগবাজারের সভা শেষ হল। যে যার বাড়ির দিকে বেশ সন্তুষ্ট চিত্তেই পা বাড়াল। এতদিন পর কাজের মতো কাজ পেয়ে তারা যেন নিজেদের ধন্য মনে করল। এভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র এগিয়ে চলল।
মন্তব্য করুন
তসলিমা নাসরিন, অনেকেই আছে আপনার পাশে, অনেকেই আপনাকে ভালোও বাসে। এই যে কত ভক্ত অনুরাগী! কাঁটাতারের বেড়াকে ফাঁকি দিয়ে বিশ্বময় ছড়ানো ফেসবুকের বিনাতারের সংযোগে আপনার পাশে দাঁড়িয়েছে। আপনার লেখার প্রশংসা করছে। এই প্রাপ্যটুকুই ক'জনের ভাগ্যে জুটে? আসলে যে জন্য আপনি আফসোস করছেন, সেটা আপনার মনে পড়া অতীত, যেখানে এক সময় বসবাস করেছে আপনার দিন, রাত, সূর্য, চাঁদ আর আকাশ দেখা।
আজ রোববার (২৭ আগস্ট) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালের শোকের মাসের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত।