হঠাৎ
আপনার মনে হতে পারে, আপনি এখন কোন সময়ে? টাইম মেশিন কি আপনাকে ২০০৩ সালে নিয়ে গেল?
কিংবা ২০০৫ অথবা ২০০৬ সালে? লাগামহীন লোডশেডিং। ডলার সংকট। জ্বালানি সংকটে শিল্পকারখানা
মুখ থুবড়ে পড়ছে। পণ্যবাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির দুর্নীতির
তান্ডব। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা মানুষ। এরকম একটি পরিস্থিতি পার করে এসেছি
আমরা দেড় যুগ আগে। এরপর এক ঘুরে দাঁড়ানোর বাংলাদেশের গল্প। শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের
সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের এগিয়ে চলা সারা
বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন রূপকথাকেও হার মানিয়েছে। উন্নয়ন মানে শুধু
সেতু, কালভার্ট, রাস্তাঘাট আর বড় বড় অট্টালিকা নয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে বহুমাত্রিক।
গ্রাম থেকে শহর। সর্বত্র বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে
অন্য প্রান্তে উন্নয়নের কী বিপুল বৈচিত্র্য। আশ্রয়ণ। কমিউনিটি ক্লিনিক। কৃষিবিপ্লব।
ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জাগরণ। গ্রামগঞ্জে তারুণ্যের স্বাবলম্বী হওয়ার উৎসব। নানা খামারে
শিক্ষিত তরুণদের সৃষ্টিসুখের উল্লাস। কর্মসংস্থানে নারীজাগরণের সাফল্য। পদ্মা সেতু,
মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। উন্নয়নের কী অপূর্ব মূর্ছনা। রংধনুর
সাত রঙের মতো বৈচিত্র্যময় গত এক যুগের উন্নয়ন। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো,
যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি। সব ক্ষেত্রে এমন ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন বিশ্বের খুব কম দেশেই
হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নগুলো একটি আরেকটির পরিপূরক এবং সহায়ক। তথ্যপ্রযুক্তি কৃষিকে
দিয়েছে শক্তি। যোগাযোগ রপ্তানি বাণিজ্যে গতি বাড়িয়েছে। এভাবেই উন্নয়নের গন্তব্য প্রতিটি
শাখা-প্রশাখা বিকশিত হয়েছে গত এক দশকে। এসব উন্নয়নের গন্তব্য হলো বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর
স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণ। সেই স্বপ্নযাত্রার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ
উদযাপন করে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দারিদ্র্যের শৃঙ্খল
থেকে মুক্তি ঘটে বাংলাদেশের। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ
ঘটে প্রিয় মাতৃভূমির। ’৭১-এর তলাবিহীন ঝুড়ি ঠিক ৫০ বছর পর বিশ্বে সাফল্যের রোল মডেলে
পরিণত হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ব্যর্থতা, অনুজ্জ্বল, করুণার পাত্র বাংলাদেশ মাত্র এক যুগে
বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এ দেশের মানুষ স্বপ্ন
দেখা শেখে। ‘অসম্ভব’কে হাতের মুঠোয় আনা রপ্ত করে। আর এ অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার রূপকার
একজনই- শেখ হাসিনা। এ অর্জন এসেছে একজন মানুষের চিন্তা, দর্শন, নীতিনিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার
কারণেই। তিনি হলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বাঙালি জাতির ইতিহাস হলো ট্র্যাজেডিপূর্ণ। একটি
অর্জনের তৃপ্তি উপভোগ করার আগেই আরেকটি ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হয় বাঙালি জাতি। এ জাতি
যখনই একটু ভালো থাকে, তখনই সর্বনাশের ঝড় সব লন্ডভন্ড করে দেয়। আবার সেই অশুভ মেঘের
ঘনঘটা। এর প্রধান কারণ বৈশ্বিক পরিস্থিতি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কিন্তু এর পাশাপাশি
কিছু অর্বাচীন আবর্জনার ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে সুবিধাবাদী
চাটুকার চক্র ক্ষমতার কেন্দ্রে ভিড়তে থাকে। আস্তে আস্তে অযোগ্য, অর্বাচীনরা দন্ডমুন্ডের
কর্তা বনে যান। জীবনে আন্দোলন করেননি। দলের জন্য ন্যূনতম অবদান নেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শচর্চার
বালাই নেই- এমন কিছু ব্যক্তি আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি হয়ে
গেছেন। এরা এসব উন্নয়নের অর্থ বোঝেন না। এরা আওয়ামী লীগের ত্যাগের ইতিহাস জানেন না।
এরা শুধু জানেন নিজের আখের গোছাতে। এদের কারণে ১৩ বছরের সব অর্জন এখন ম্লান হতে বসেছে।
এদের প্রধান কাজ হলো দুর্নীতি, লুটপাট এবং জনগণকে খেপিয়ে তোলা। এই যেমন রবিবার (২৩
অক্টোবর) একটি অনুষ্ঠানে হাজির হন এ দেশের অন্যতম ভাগ্যবান ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। বাংলাদেশ চেম্বার
অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত ‘শিল্পে জ্বালানি সংকট সমাধান শীর্ষক’ আলোচনা অনুষ্ঠানে
ভুক্তভোগী শিল্পোদ্যোক্তারা তাঁকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিছুটা
আশার বাণী শোনার আশায়। এ সংকটে সরকার পাশে আছে এরকম কিছু উপদেষ্টা বলবেন, এ প্রত্যাশায়।
কোথায় আশ্বাস, কোথায় পাশে থাকার অঙ্গীকার - উপদেষ্টা জানিয়ে দিলেন, ‘বিদ্যুৎ ব্যবহারে
আমাদের সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার
বন্ধ করে দিতে হবে। আমাদের রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। আমাদের হাতে টাকা নেই। সামনে কী
হবে এখনই বলা যাচ্ছে না।’ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা
এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলতে পারেন! তৌফিক-ই-ইলাহী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে
অবদানের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতকে আজকে এ ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে
নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যতম দায়ী ব্যক্তি হলেন তিনি। তাঁর প্রতিটি পরিকল্পনা এবং চিন্তাভাবনার
মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ বা লালসা আছে কি না সে প্রসঙ্গে আমি যাব না। কিন্তু বাংলাদেশের
নাগরিক হিসেবে কিছু মৌলিক প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। ক্যাপাসিটি চার্জ বা
বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া বাবদ এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার দায় জনগণ কেন নেবে?
আবার এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনেকটিরই উৎপাদন সক্ষমতা পর্যন্ত নেই। ওপেক, ওপেক প্লাস
দেশগুলো থেকে তেল ও গ্যাস কেনার বড় ও স্থায়ী সরবরাহ চুক্তি নেই কেন? মোট আমদানির ৫০
শতাংশ স্পট মার্কেট থেকে কেনার কমিশন-বান্ধব সিদ্ধান্তটি কার স্বার্থে? কাতার ও ওমানের
মতো দেশ বড় গ্যাস সরবরাহ চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তখন সরকার তা গ্রহণ করেনি।
অথচ এখন ওই দুটি দেশ থেকে গ্যাস পেতে কূটনৈতিক চ্যানেলে আবেদন করেছে। কিন্তু ইতোমধ্যে
তারা ইউরোপে গ্যাস বিক্রি শুরু করেছে। এর দায় কার?
অবশ্য
জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্যের পরদিনই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন,
‘জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত। এরকম কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেয়নি।’ তাতে
কী? বাংলাদেশ এখন সব সম্ভবের দেশ। এই উপদেষ্টাই জুনে বলেছিলেন, ‘সামনে লোডশেডিং করতে
হবে।’ ১৯ জুলাই সরকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করে। অবশ্য এর কয়েক দিন
আগেই ঢাকার বাইরে লোডশেডিং শুরু হয়। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বললেন, লোডশেডিং হবে দিনে।
এক ঘণ্টা। এখন ঢাকা শহরেই পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বললেন,
সেপ্টেম্বরের মধ্যে লোডশেডিং কমে আসবে। অক্টোবরে বললেন, শীতের আগে বিদ্যুৎ সংকট কমার
সম্ভাবনা নেই। আল্লাহ ভরসা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে প্রকাশ্য দিবালোকে বাবার
কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল শিশু নওরীন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে সময় বলেছিলেন,
‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন।’ এখন আমাদের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের
দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন প্রকৃতির ওপর!
জ্বালানি
উপদেষ্টা এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী দুজনই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজন যখন
আরেকজনের বক্তব্য এভাবে খন্ডন করেন, তখন সরকারের অস্থিরতা এবং সমন্বয়হীনতার প্রকাশ
ঘটে। এরকম ঘটনা এটাই প্রথম না, কিছুদিন ধরে মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বেড়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত নিয়ে একটা মন্তব্য করলেন। ব্যস, দু-তিন জন মন্ত্রী পাল্টা বক্তব্য
দিলেন। এক মন্ত্রী তো বলেই ফেললেন, ‘তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগের কেউ নন।’ এমনকি
বিএনপির চট্টগ্রামে জনসভায় কত লোক এ নিয়ে দুই হেভিওয়েট মন্ত্রী পরস্পরবিরোধী বক্তব্য
দিলেন। পরে একজন ‘থুক্কু’ বলে উল্টো সুরে কথাও বললেন। মন্ত্রীরা নিজ মন্ত্রণালয়ের চেয়ে
অন্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারেও আগ্রহী। যেমন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বুধবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
নিয়ে নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন, ‘দেশের বাজারে সরকার জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়নি। নিজ
থেকে দাম বেড়েছে।’ কী অদ্ভুত ব্যাখ্যা। গাছ যেমন আপনাআপনি বড় হয়। কলি থেকে যেমন ফুল
হয়, ফল হয়। তেমনি দ্রব্যমূল্য এক জীব। যার দাম আপনি আপনি বেড়ে যায়। বাজার তদারকি কি
তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ? এভাবেই চলছে মন্ত্রিসভা। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়
থাকা প্রধানমন্ত্রী দুটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথমটি, প্রতি মেয়াদে মন্ত্রিসভায়
বড় চমক। দ্বিতীয়টি, সরকার ও দলকে আলাদা রাখার চেষ্টা। আওয়ামী লীগের নতুনদের জন্য এটা
ছিল একটা বিরাট সুযোগ। প্রথম দফায় (২০০৯-২০১৩) বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল
ইসলাম এবং আবুল মাল আবদুল মুহিত পরে ওবায়দুল কাদের এবং জাহাঙ্গীর কবির নানক (প্রতিমন্ত্রী)
ছাড়া কোনো হেভিওয়েট নেতা মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। তা ছাড়া তখন আওয়ামী লীগের হাতে ছিল
প্রচুর সময়। জনগণ নতুনদের সময় নিয়ে পরখ করতে চেয়েছে। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সংকটে প্রধানমন্ত্রী
তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুর মতো জাতীয় নেতাদের
ডেকে নেন। সে সময় নানা মান-অভিমানে কেউ মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি। কিন্তু ২০১৪-এর নির্বাচনের
আগে শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার একটি রাজনৈতিক ইমেজ দেন। একটি প্রাজ্ঞ মন্ত্রিসভা ৫ জানুয়ারির
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ নির্বাচন পাড়ি দিতে শেখ হাসিনাকে কিছুটা হলেও সাহায্য করেন। অভিমান
ভেঙে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন যোগ দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থের
চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ২০১৪-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী
তাঁর ‘এ’ টিমকে সামনে নিয়ে আসেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আমার বিবেচনায় এটি ছিল অন্যতম সেরা
মন্ত্রিসভা। ২০১৮-এর নির্বাচনের পর বর্তমান মন্ত্রিসভার অবয়ব দেখে অনেকে থমকে গিয়েছিলেন।
ওই নির্বাচনের মাধ্যমেই আসলে আওয়ামী লীগের অর্জন বিনাশের ষড়যন্ত্র শুরু করেন একশ্রেণির
আমলা। ২০১৮-এর পর যাঁরা মন্ত্রী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে দু-এক জন ব্যতিক্রম বাদ দিলে সবাই
অনুজ্জ্বল। সংকট মোকাবিলায় নিষ্ক্রিয়। দায়িত্ব নিতে অপারগ। আমি মনে করি, আমলারা তাদের
কর্তৃত্ব পুরোপুরি কুক্ষিগত করতেই এরকম একটি মন্ত্রিসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীকে রাজি
করিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এ মন্ত্রিসভার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক নিরীক্ষা করেছিলেন।
কিন্তু এ পরীক্ষায় অধিকাংশই অনুত্তীর্ণ। ভূমিমন্ত্রী যেমন প্রমাণ করেছেন দক্ষতা, যোগ্যতা
ও মেধা নিয়ে একটি মন্ত্রণালয়কে নিষ্কলুষ, দুর্নীতিমুক্ত করা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
যেমন পরিমিত, মার্জিত শব্দচয়নের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু এদের সংখ্যা খুবই কম।
এ মন্ত্রিসভার এক বেদনাদায়ক রূপ হলো, বেশির ভাগ মন্ত্রীর রাজনীতির শিকড় নেই। উড়ে এসে
জুড়ে বসা মন্ত্রীদের কর্কশ কণ্ঠ ক্রমে কান ঝালাপালা করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কাঁপানো, জাকসুর সাবেক ভিপি, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীমের কপালে জুটেছে
সিকি মন্ত্রিত্ব। আমার বিবেচনায়, এখন যে মন্ত্রিসভা সেটা আওয়ামী লীগের ‘সি’ টিমও না।
এদের প্রায় অর্ধেক পাড়ার আওয়ামী লীগের নেতাও ছিলেন না। কর্মীদের সঙ্গে সংশ্রবহীন কিছু
ব্যবসায়ী এবং শিশুতোষ ইচড়ে পাকা অর্বাচীন মন্ত্রিত্বকে যেন একটা প্রহসনে পরিণত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী একটি মহৎ এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে এই ঝুঁকিপূর্ণ নিরীক্ষা করেছেন।
কিন্তু মন্ত্রিত্ব কোনো চাকরি না। এটি কোনো লটারির টিকিটও না। মন্ত্রিত্ব একটি দায়িত্ব।
দেশসেবার এক কঠিনতম পরীক্ষা। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মন্ত্রিত্ব
কোনো উদ্যাপনের বিষয় নয়। প্রতি মুহূর্তে জনগণের সামনে নিজেকে পরীক্ষায় অবতীর্ণ করা।’
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি হলো এক চরম বাস্তবতা। জনগণ, সংসদ এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে
প্রতিনিয়ত একজন মন্ত্রীকে পরীক্ষা দিতে হয়। আর এ পরীক্ষায় ফেল করলে তাকে সরে যেতে হয়।
অথবা সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৭৫-এর জঘন্যতম হত্যাকান্ডের পর থেকে মন্ত্রিত্ব হয়ে
ওঠে কোটিপতি ক্লাবে যোগ দেওয়ার সুযোগ। টাকা বানানোর মেশিন। জবাবদিহি না থাকার কারণে
ব্যর্থতার দায়ে মন্ত্রীরা যেমন নিজেরা সরে যান না। তেমনি তাদেরও সরিয়ে দেওয়ার নজির
বিরল হয়ে উঠছে। ব্যর্থদের সরিয়ে যোগ্যদের সামনে আনলে জনগণ আশ্বস্ত হয়। সরকারি কর্মচারীরা
কাজে গতি পায়। এটাই বাস্তবতা। ভারতে নরেন্দ্র মোদি কভিড বিপর্যয় কাটাতে মন্ত্রিসভায়
বড় বদল করেছেন। সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে এনেছেন। ব্রিটেনে দুই মাসে দুজন প্রধানমন্ত্রী
হলেন। কিন্তু বাংলাদেশে একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে, মন্ত্রির ব্যর্থতা স্বীকার
করা মানেই সরকার ব্যর্থ প্রমাণ হওয়া। বিরোধী দলের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরকম অসংখ্য ঝাড়ফুঁক তত্ত্ব বাতিল করেছেন। এতে তাঁর ইমেজ বেড়েছে।
আওয়ামী লীগে প্রবীণ, পরিণত, নবীন মিলিয়ে এরকম এক শ নিবেদিতপ্রাণ আছেন, যাঁরা মন্ত্রী
হলে ‘অর্জন ধ্বংসের’ এ তৎপরতা বন্ধ করতে পারেন। তাঁদের কাজ একটাই- শেখ হাসিনার নির্দেশ
অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। শেখ হাসিনার দেওয়া দায়িত্ব জীবন বাজি রেখে সম্পন্ন করবেন।
এমন নেতার অভাব নেই। আওয়ামী লীগে, ১৪ দলে। এমন অনেক নেতা আছেন যাঁরা মন্ত্রী হলে জনগণ
হাততালি দেবে। উচ্ছ্বাস করবে। আশায় বুক বাঁধবে। এখন এক সংকটকাল। এ সংকটকালে অর্বাচীন,
আবর্জনাদের হাত থেকে সরকারকে মুক্ত করতে হবে। দেশকে রক্ষা করতে হবে। যেসব অযোগ্য মুখে
বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা বলে ফেনা তোলে আর কাজ করে উল্টো, সেসব চাটুকারকে চিহ্নিত করে
বিদায় করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য করে ফুলে-ফেঁপে উঠে যারা মন্ত্রণালয়কে আরেকটি ব্যবসা
কেন্দ্র বানিয়েছে, তাদের প্রতিহত করার এখনই সময়। দুষ্ট, দুর্বৃত্ত, চাটুকারদের সংখ্যা
কম। হাতে গোনা। কিন্তু প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় এরা সংঘবদ্ধ। এরাই সরকারপ্রধানের চারপাশে
ঘুরঘুর করে। এরা সুযোগ বুঝে পালাবে।
’৭৫-এর
যে পরিবারগুলো সর্বস্ব হারিয়েছে, যে তরুণ-কিশোররা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য যৌবন উৎসর্গ
করেছেন, ১৯৮২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা রাজপথে লড়াই করেছেন, মেধা-মননের
চর্চা করেছেন, ১৯৯১ থেকে যাঁরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য
সংগ্রাম করেছেন জীবন বাজি রেখে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের দানবীয় তান্ডবে যাঁরা বুক
পেতে রুখে দাঁড়িয়েছেন, এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যাঁরা দল ও নেতার আদর্শের প্রশ্নে
অটল ছিলেন, যাঁরা জনগণকে ভালোবাসেন, জনগণের জন্যই যাঁদের ধ্যানজ্ঞান এমন ত্যাগী, আদর্শবান
নেতার সংখ্যা আওয়ামী লীগে অনেক। এঁরা নিভৃতে কাঁদেন। দেয়ালে মাথা কুটে হাহাকার করেন।
এঁরা অপেক্ষায় আছেন। এখনো এই ত্যাগী-পরীক্ষিত কর্মীরা আশা করেন শেখ হাসিনা এসব আগাছা
বিদায় করবেন। অর্বাচীনদের সরিয়ে দেবেন। যোগ্যদের সামনে আনার এখনই সময়। এখন আসল খেলা।
মাঠে ‘এ’ টিম নামাতেই হবে।
লোডশেডিং ডলার সঙ্কট জ্বালানি যুদ্ধ নির্বাচন মন্দা
মন্তব্য করুন
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।
গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। তার আগে একটা রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে ২ হাজার ৬০০ কাউন্সিলরের মধ্যে দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি পেয়েছে ১ হাজার ৬১টি পদ। অন্যদিকে ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ৫০৪টি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়ে দলগতভাবে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। নির্বাচনে দ্বিতীয় হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। ৪০ বছরের ইতিহাসে এটি কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা যে ভীষণ নড়বড়ে, তা এই নির্বাচনেই প্রমাণ হয়েছে। নির্বাচনের পর পার্লামেন্ট নির্বাচনে কনজারভেটিভদের ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা না বলা গেলেও কনজারভেটিভ পার্টি যে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, সেটি হলফ করে বলা যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ বছর নভেম্বরে। এই নির্বাচনে জো বাইডেনের অবস্থা তথৈবচ। জো বাইডেনকে কোনো জনমত জরিপেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। আইনি মারপ্যাঁচ, যৌন কেলেঙ্কারি ডেমোক্রেটদের নানামুখী বাধা ইত্যাদি নানা সংকট থেকে মুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আবার প্রার্থী হওয়া ট্রাম্পের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না সেটি যেমন প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো যে, জো বাইডেন এই নির্বাচনে কি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ এবং ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে জ্ঞান দেয়, মানবাধিকার চর্চার জন্য শাসন করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এখন মানবাধিকার সংকটে। গাজায় ইসরায়েলের তাণ্ডবের প্রতিবাদে মার্কিন তারুণ্যের গণবিস্ফোরণ পুরো বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এই গণবিস্ফোরণকে ঠেকাতে যেভাবে জো বাইডেন সরকার দমন নীতি গ্রহণ করেছে, তা তাকে সবচেয়ে কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে গেছে। জনগণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশ্বাস করছে না, জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তিনি এখন তলানিতে অবস্থান করছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিজয়ী হয়েছিলেন অনেক লড়াই করে। বিজয়ের পর জনগণ তার পক্ষে কতটুকু আছে বা জনগণের মনোভাব কী, তা যাচাইয়ের একটি উপায় ছিল গত মার্চের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দলের শোচনীয় ভরাডুবি ঘটেছে। তিনি বড় শহরগুলোতে মেয়র পদে যাদের প্রার্থী দিয়েছিলেন, তারা ধরাশায়ী হয়েছেন বিরোধী পক্ষের কাছে।
সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর অবস্থা ভালো না। নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের মুখে। জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক স্থানেই বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছে নাগরিকরা। এর একটি বড় কারণ হলো, মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। এরকম বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশে এখন পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচন চলছে। প্রথম ধাপের উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত ৮ মে (বুধবার)। এ উপজেলা নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে চেয়েছে; কিন্তু সে উদ্যোগও সফল হয়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রথম ধাপে ৩৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এটি সর্বনিম্ন ভোটের রেকর্ড। এটি নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতে যেমন ক্ষমতাসীন দল চ্যালেঞ্জের মুখে, পুনরায় তাদের ক্ষমতায় আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি তেমনটি নয়।
বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে কেউ ক্ষমতাসীন দলের বিপর্যয়ের কথা কল্পনাও করেনি। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল তারা কেউই ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেনি বা ক্ষমতায় আসার মতো জনপ্রিয়তা, নেতৃত্ব বা সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের ছিল না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল অবধারিত। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে যারা দলের মনোনয়ন পাননি সে বিদ্রোহী প্রার্থীদের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৮ জন স্বতন্ত্র বিজয়ী হয়ে নির্বাচনের মান বাঁচিয়েছে। নির্বাচনকে ‘জীবন’ দিয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। উপজেলাতেও তাই আওয়ামী লীগ একই কৌশল গ্রহণ করেছে। উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা ছিল দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করলে বিএনপির জন্য নির্বাচনে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে—এমন গুঞ্জনও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি পুরোনো পথে হেঁটেছে। তারা উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শতাধিক বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনে তাদের ৭ জন বিজয়ী হয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। তবে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিকূল রাজনীতির পরিবেশে নির্বাচন করে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা যায় না। তার পরও যে উপজেলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে বিএনপি নেতারা অংশগ্রহণ করেছে সেজন্য তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ সুস্থ রাজনীতির জন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার পরও উপজেলা নির্বাচন গণতন্ত্রের সংকটের বার্তা। নির্বাচন নিয়ে জনগণের অনীহা ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তির। আওয়ামী লীগের সামনে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নেই। আওয়ামী লীগের এমন কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই যারা জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তা ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের তীব্র সংকট চলছে। কদিন আগেই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে হটিয়ে তারা ক্ষমতা নিতে চায়, তাদের নেতা কে?’ এই নেতৃত্বের সংকটই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, নেতৃত্ব সংকটের কারণেই বিএনপি নির্বাচনবিমুখ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে এখন ‘স্বেচ্ছা বন্দি’। তিনি ফিরোজায় বাসভবনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি নির্বাচনের অযোগ্য। অন্যদিকে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ একাধিক মামলায় দণ্ডিত। তার দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এ কারণে বিএনপি এখন নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। বিএনপির লক্ষ্য সুস্পষ্ট। তারা নির্বাচন থেকে দূরে থেকে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলতে চায়। গণতন্ত্রে সংকট দেখা দিলে তৃতীয় কোনো পক্ষের ক্ষমতায় আসার পথ উন্মুক্ত হবে।
তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতায় এলে বিএনপি তার রাজনৈতিক পুনর্গঠন নতুন করে শুরু করতে পারবে। অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে তারেক জিয়া দেশে ফেরা, খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফের বিষয়গুলো তারা ফয়সালা করতে চায়। এজন্য নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক রীতিতে ক্ষমতায় আসা নয়; বরং একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এ কারণেই তারা যতটা না জনমুখী কর্মসূচি পালন করে তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ধর্ণা দেয়, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশগুলোকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা বিএনপির রাজনীতির প্রধান কৌশল। ফলে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের খুশি বা আত্মতুষ্টির কারণ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪২ শতাংশ। এ নিয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় এবং সন্দেহ রয়েছে। তার পরও একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতিকে সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে ভোটার উপস্থিতি কম হবে—এটাই স্বাভাবিক বিষয়। বিএনপি অংশগ্রহণ না করার পরও যে একতরফা নির্বাচন হয়নি, বিশেষ করে ২০১৪-এর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসতে পেরেছে, সেটি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের বড় অর্জন। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন জনগণ আরও ভোটবিমুখ। এটি আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই অশনিসংকেত। গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভোটাররা যদি গণতন্ত্রের প্রতি অনাগ্রহী হন, ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে না যান, ভোটাররা যদি তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখান তাহলে গণতন্ত্র সংকটে পড়বেই। আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বে আওয়ামী লীগ। এ কারণে অন্য দেশগুলোতে যখন ক্ষমতাসীনরা ভোটে জিতবে কি জিতবে না সেই অনিশ্চয়তায়, সেখানে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে আমি মনে করি। নির্বাচনে পরাজয়ের শঙ্কার চেয়ে গণতন্ত্রের মৃত্যুর শঙ্কা বেশি ভয়াবহ।
উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে অতীতে দেখা গেছে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকে জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহী হয়। এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক হয় এবং একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এবার উপজেলা নির্বাচনে সেটি হয়নি। কেন হয়নি তার কারণ আওয়ামী লীগকে খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ সমর্থক আছে। তারাও কেন ভোট দিতে যাচ্ছেন না? এর উত্তর খুঁজতে হবে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটিকে। দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করেও আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারেনি। এই না পারার কারণ হলো আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতা লোভ, বাড়াবাড়ি এবং এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনা। তারা দমন করার চেষ্টা করেছে পেশি শক্তি প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করেছে। সাধারণ মানুষ সব জানে, সব বোঝে। তারা এসব ঝুট-ঝামেলার মধ্যে যেতে চায়নি। সে কারণেই তারা ভোট থেকে আগ্রহ ফিরিয়ে নিয়েছে। অনেক জায়গায় নির্বাচনের ফল ছিল পূর্ব অনুমিত। তারা জানত যে, এমপির ভাই দাঁড়িয়েছে, এমপির ছেলে দাঁড়িয়েছে কাজেই তাদের বিজয় ঠেকাবে কে। এই বোধটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগকে এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না বটে, তবে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না, তা হলফ করে কে বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে আবার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকে তিনি এই ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। অতিডান এবং অতিবামরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করেছে বলে তিনি নেতাদের সতর্ক করেছেন।
আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের কাছেই আওয়ামী লীগ বারবার পরাজিত হয়েছে, হয়েছে বিপর্যস্ত। আর এই ষড়যন্ত্র শুধু বাইরে থেকে হয়নি, দলের ভেতর থেকেও হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর একটাই উপায়, তা হলো গণতন্ত্রকে মুক্ত স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে দেওয়া, জনগণকে উৎসাহিত করা, ভোটকেন্দ্রে যাতে ভোটাররা যান, তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন সে পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া। উপজেলা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি দলের নেতাকর্মীদের ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য প্রচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেখ হাসিনা মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করার জন্য যে নির্দেশ দেন, তা কেউ মানেনি। যারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তারাও ষড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংকটে। বিরোধী দলহীন গণতন্ত্র মুণ্ডুহীন দেহ। সরকারের কোনো জবাবদিহি থাকে না। এতে ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের দূরত্ব তৈরি হয়। এভাবেই পল্লবিত হয় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। অবৈধ ও অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হয়। তেমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছেই যেতে হবে।
লেখক:
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল:
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ডোনাল্ড লু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে
জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে
দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির
স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি
অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই
মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা
ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী
লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে
বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার
মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী
লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে
না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে
প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে
সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।
আরও পড়ুন: আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার
কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার
সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ
করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া
অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা
কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি
নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের
সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি
একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত,
ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক
কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত।
ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি
অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম
হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয়
কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত
মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল।
কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর
বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়
কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে
আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর
সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান
ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও
আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন
নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা
হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে।
এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন
না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের
বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে
পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল।
যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক
দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই
অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি
২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ
ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির
কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা
তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের
শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান।
চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়,
তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি
নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল
দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই।
দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই।
সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ
হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির
চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান
একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই
কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র
ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে
বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।
শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।
দেশের মানুষের এমনিতেই নাভিশ্বাস অবস্থা। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ সংকটে চেয়েও বড় অস্থিরতা হলো জিনিস পত্রের দাম। অস্থির সময়ে মানুষের জন্য বিনোদনের কোন খোরাক নেই। তবে প্রধান নির্বাচন কাজী হাবিবুল আউয়াল মানুষের জন্য অস্বস্তির তাপদাহে এক পশলা বৃষ্টির মতো, বিনোদনের খোরাক যোগালেন। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ১৩৯ টি উপজেলার নির্বাচনের পর সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘ধান কাটার কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে আসেননি।’ নিষ্প্রাণ উপজেলা নির্বাচনে সিইসির বক্তব্যই একমাত্র চমক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আবার বাংলাদেশ সফরে আসছেন। নানা কারণে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে অত্যন্ত আলোচিত একটি নাম। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে তাঁর তৎপরতা বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি একাধিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাঁর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং বেশ কিছু কথাবার্তা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।