এডিটর’স মাইন্ড

রংপুরের ‘লজ্জা’ এবং নতুন বছরের শঙ্কা

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২


Thumbnail

টানাপোড়েন এবং শঙ্কার মধ্যে বিদায় নিচ্ছে ২০২২। কাল ২০২৩-কে বরণ করে নেবে বিশ্ব। নানা কারণেই ২০২৩ সাল শুরুর আগেই আলোচনায়। জাতিসংঘ ২০২৩-কে একটি দুর্যোগপূর্ণ বছর হিসেবে ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘ ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষ এবং অর্থনৈতিক মহামন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে। জাতিসংঘের ঘোষণার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, আগামী বছর বিশ্ব এক কঠিন সময় পার করবে। বাংলাদেশেও শঙ্কার সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে। প্রবল ঝড় শুরুর আগে যেমন আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। বাংলাদেশের অবস্থা এখন অনেকটা তেমনি। একটা গুমোট পরিবেশ অর্থনীতিতে এবং রাজনীতিতে। প্রধানমন্ত্রী কয়েক মাস আগে থেকেই ২০২৩-এর প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশবাসীকে। অর্থনীতিতে তেমন কোনো সুখবর নেই। রাজনীতিতেও অস্থিরতার পদধ্বনি। এরকম শঙ্কার মধ্যেই ২০২৩-কে বরণ করে নিতে প্রস্তুত বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব। একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ২০২৪-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। এমনটি বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোরের জনসভা থেকে ভোট চাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। নির্বাচনের জন্য দলকে প্রস্তুত করার উদ্যোগও তিনি গ্রহণ করেছেন। নির্বাচন প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগ জাতীয় কাউন্সিলের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলেছে গত ২৪ ডিসেম্বর। চমকহীন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে পুরনো নেতৃত্বের প্রতিই আস্থা পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। নেতৃত্বের পরিবর্তন করে শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। প্রায় পরিবর্তনহীন নতুন নেতৃত্ব বিরোধী আন্দোলন এবং নির্বাচন কীভাবে সামাল দেবে, সেটাই সামনে দেখার বিষয়। তবে ২০১৮-এর নির্বাচনেঅলৌকিকবিজয়ের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। সেই ধারা ২০২২-এর শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অতি আত্মবিশ্বাসের কারণেই ২০১৯ সালের মন্ত্রিসভায় ১৪ দল বা মহাজোটের কাউকে নেয়নি আওয়ামী লীগ। মহাজোট নেই, ১৪ দলও এখন কেবল কাগজ-কলমে জীবিত। বাস্তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক জোট আইসিইউতে। নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। ১৪ দলকে চাঙা করার কোনো উদ্যোগও দেখা যায় না, বরং আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এদের এতিম, উদ্বাস্তু মনে করেন। ভাবখানা এমন, একটু ত্রাণ পেলেই এরা আবার কাছে আসবে। এবার কাউন্সিলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাস দেখা গেল। কারণেই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন করেনি। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতার সঙ্গে কথা বললে, তাদের বেশ হালকা এবং চিন্তাহীন মনে হয়। তারা মনে করেন, ২০১৪ কিংবা ২০১৮-এর মতো আবার আওয়ামী লীগ জয় পাবে। টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা। বিএনপি নির্বাচনে আসুক না আসুক, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কেউ ঠেকাতে পারবে না, এমন একটি বদ্ধমূল ধারণা আওয়ামী লীগের ডাকসাইটের নেতাদের মধ্যে। বিরোধী দলকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নেতিবাচক মনোভাবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তৃণমূলের ত্যাগী পরীক্ষিতদের পাত্তা না দেওয়ার এক উদাসীনতা আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে দৃশ্যমান। শুধু উদাসীনতা নয়, বিরোধী মতকে শায়েস্তা করার এক উগ্র মানসিকতাও আওয়ামী লীগের পাতিনেতাদের পর্যন্ত পেয়ে বসেছে। একজন প্রবীণ নাগরিক কদিন আগে সরকারবিরোধী এক লিফলেট বিলি করছিলেন। হঠাৎ আওয়ামী লীগের এক পাতিনেতা তাকে চড় মেরে বসলেন। ধরনের অযাচিত মাস্তানি আওয়ামী লীগের আদর্শ নয়। কিন্তু পাতিনেতার ওই চড়কাণ্ডের প্রতিবাদ করেননি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা। আওয়ামী লীগের অনেকের মধ্য থেকেবিনয়উবে গেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতা চিরস্থায়ী। কেউ কোনো দিন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না। কীভাবে আওয়ামী লীগ চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসবে? এরকম প্রশ্ন করলে আওয়ামী লীগের শতভাগ নেতা একটাই উত্তর দেনশেখ হাসিনা কিছু একটা করবেন।আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা গত ১৪ বছরের উন্নয়ন জনগণের সামনে ঠিকঠাক মতো বলতে পারেন না। খুব কমসংখ্যক নেতাই শেখ হাসিনার মতো বিনয়ী। জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার তাগিদও নেই বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ নেতার মধ্যে। জনগণ তো দূরের কথা, দলের তৃণমূলের কর্র্মীদের এখন ঝামেলা মনে করেন নেতারা। দেখা-সাক্ষাৎ তো দূরের কথা, গ্রামের একজন কর্মীর ফোনটা পর্যন্ত ধরেন না অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। এসব এলিট নেতা মনে করেন, শেখ হাসিনা একাই সব দুর্যোগ সামাল দেবেন। একাই আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনবেন। এই চিন্তা তাদের মগজে প্রোথিত হয়েছে ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচনের পর। কিন্তু শেখ হাসিনা যদি একাই সব করবেন, তাহলে এত মন্ত্রী, এত নেতা, এত সংসদ সদস্যের কাজ কী? দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কজন মন্ত্রী, নেতা কী করছেন? শেখ হাসিনা ছাড়া জনগণের কাছে আস্থাভাজন আর কজন আছেন? প্রশ্নগুলো আগামী বছর সামনে আসবেই। প্রশ্নের মুখোমুখি আওয়ামী লীগকে হতেই হবে। না হলে আওয়ামী লীগকে ২০২৩ সালে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। রংপুরে ২৭ ডিসেম্বর যেলজ্জাআওয়ামী লীগ পেয়েছে, সামনে তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া চতুর্থ হয়েছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নয়, ইসলামী আন্দোলন।৭৯ সালে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগও রংপুরে এমন দুর্দশার মধ্যে পড়েনি।৭৯ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এরকম বাজে ফলাফল করেনি। সামরিক একনায়ক জিয়ার ইচ্ছাপূরণের ওই নির্বাচনে বৃহত্তর রংপুর জেলায় আসন ছিল মোট ২৩টি। ব্যাপক কারচুপির পরও আওয়ামী লীগকে ৪টি আসনে পরাজিত করতে পারেনি সামরিক স্বৈরাচার জিয়া। বাকি ১৯টি আসনেও আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় হয়েছিল। এরশাদ ক্ষমতায় এসে মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করেন। ১৯টি জেলা বেড়ে ৬৪টি হয়। ১৯৮৬ সালের মে এরশাদের অধীনে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে রংপুরে আসন ছিল ৬টি। ব্যাপক কারচুপি করেও এরশাদের জাতীয় পার্টি ৩টি আসনে আওয়ামী লীগের কাছে হেরে যায়। রংপুর- আসনে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনিসুল হক চৌধুরী। রংপুর- আসনে শাহ আবদুর রাজ্জাক এবং রংপুর- আসনে এইচ এন আশিকুর রহমান।৭৫-পরবর্তী রাজনীতিতে রংপুর ছিল আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর শ্বশুরবাড়ি হওয়ার কারণে দলটির প্রতি আলাদা আবেগ এবং ভালোবাসা কাজ করে রংপুরবাসীর।৯০- এরশাদের পতন এবং তাকে গ্রেফতারের পর রংপুরের রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে যায়। যুক্তিকে ছাপিয়ে আবেগ প্রবল হয়ে ওঠে।রংপুরের ছাওয়ালকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে লাঙ্গল প্রতীকে ভোট দেন রংপুরবাসী। সেই থেকে রংপুর এরশাদের ঘাঁটি। জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। কিন্তু রংপুরে জাতীয় পার্টির পর আওয়ামী লীগ শক্তিশালী। রংপুরের একটি আসন থেকে (পীরগঞ্জ) স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী নির্বাচিত। অন্য একটি আসন থেকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংসদ সদস্য হয়েছেন। গত ১৪ বছরে রংপুরে যে উন্নয়ন হয়েছে এরশাদের বছরে তার সিকি পরিমাণও হয়নি। রংপুরে দুই হেভিওয়েট নেতা সংগঠন গড়ে তুলতে পারেননি। চাটুকার, তোষামোদকারী এবং সুযোগসন্ধানীরা সংগঠনকে কুরে কুরে খেয়েছে। নতুন নেতৃত্ব বিকশিত হয়নি। তার ফল রংপুরের লজ্জা। সিটি নির্বাচনে চতুর্থ হওয়া। আমি জানি, সব কিছুকে অবজ্ঞা করা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলবেন, এতে কী আসে যায়। এই নির্বাচন তো আমরা জাতীয় পার্টিকেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। রংপুর সিটি নির্বাচন প্রমাণ করেছে, সরকার অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে আন্তরিক। ইত্যাদি নানা কথার মারপ্যাঁচে আসল সমস্যা আড়ালের চেষ্টা করা হবে। কিন্তু রংপুরের ফলাফল নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। কেন টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি রংপুরে জামানত হারাল। লজ্জায় ডুবল। রংপুরের ভরাডুবির সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য ময়নাতদন্ত যদি আওয়ামী লীগ না করে তাহলে ২০২৩ সালে তাদের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে। রংপুরের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। মিলন এবং ডালিয়ার ভোট যোগ করলে রংপুরে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় হয়েছে। (৫৬ হাজার ভোট) কাজেই আওয়ামী লীগ বিভক্ত ছিল জন্যই এই ভরাডুবি। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই বিভক্তি কি কেবল রংপুরে? না, এই বিভক্তি সারা দেশে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে সারা দেশে আওয়ামী লীগের বিভক্তির প্রকাশ্য ভয়ংকর রূপ দেখেছেন দেশবাসী। আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। ঘাতক। মন্ত্রী এবং এমপিরামাই ম্যানকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। আবার কোথাও অযোগ্য বিতর্কিত প্রার্থী মনোনয়নের প্রতিবাদে তৃণমূলের ত্যাগী নেতাই প্রাণের প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন। বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। আওয়ামী লীগের বিগত কমিটি এই বিদ্রোহ দমনে সীমাহীন ব্যর্থতা এবং অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছিল, যারা নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হবে তাদের ক্ষমা নেই। আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। কিন্তু কাউন্সিলের আগেই তাদেরসাধারণ ক্ষমাঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ দলের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কোনো অপরাধ না- এই বার্তাটা তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। যে কারণেই মিলন রংপুরে দাঁড়িয়েছেন। নিশ্চয়ই দলে তার গডফাদার আছে। বিভক্ত এই আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে কী করবে? রংপুরের নির্বাচনের পর এই প্রশ্ন সামনে এসেছে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এবার কাউন্সিলের আগে উৎসাহী ছিলেন। আশাবাদী ছিলেন। তারা মনে করেছিলেন, নতুন নেতৃত্ব আসবে। তৃণমূলের সমস্যা সংকটের বিষয়গুলো বলার একটা জায়গা হবে। হাইব্রিড এবং অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে চিড়েচ্যাপ্টা সত্যিকারের আওয়ামী লীগ তাদের দুঃখগুলো বলার একটা জায়গা পাবে। কিন্তু পুরনো নেতৃত্ব কেন্দ্রে যেমন পুনর্বহাল হয়েছে, তেমনি অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড, আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত রাজাকারদের সঙ্গে ত্যাগী, পরীক্ষিত, দুঃসময়ের লড়াকুদের বিরোধকেও অব্যাহত রাখা হয়েছে কাউন্সিলে। আগামী এক বছর এই বিরোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে? আওয়ামী লীগের কজন নেতা খবর রাখেন৭৫-এর প্রতিবাদ যোদ্ধারা অনেকেই নীরবে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্যাতিত অনেক আওয়ামী লীগ কর্মী এখনো হতাশায় কাঁদেন। যে জামায়াত-শিবির তাদের ঘর পুড়িয়েছিল, তারাই এখন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। এক-এগারোর সংস্কারপন্থি নেতা যখন প্রেসিডিয়ামে পুনর্বাসিত হন। তখন তাকে ধাওয়া দেওয়া কর্মীরা পালাবে কোথায়? এই কাউন্সিল আওয়ামী লীগে সংক্রমিত অন্তঃকোন্দল ব্যাধি সরানোর পথ খুঁজতে পারেনি। বরং ক্ষতকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। আগামীতে এর জন্য আওয়ামী লীগকেই মাশুল দিতে হবে।

রংপুরের নির্বাচন আরেকটি বিষয়কে সামনে এনেছে। যে কোনো নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা জরুরি। হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়াকে যখন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, তখনই অনেকে বলেছেন আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে রংপুর সিটি করপোরেশন উপহার দেওয়ার জন্যই এমন প্রার্থী দিয়েছে। ২০১৮-এর নির্বাচনের পর প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করা শুরু হয়। যাকে খুশি মনোনয়ন দিলেই হলো। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো, ওই প্রার্থী বিনা ভোটে অথবা জোর করে জিতে আসবেন। এমন একটা প্রবণতা আওয়ামী লীগের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু নতুন নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধা উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চমকে দেয়। উপনির্বাচন বাতিল করে কমিশন। এটি ছিল নির্বাচন কমিশনে সুস্পষ্ট বার্তা। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি না সেটি পরের বিষয়। কিন্তু ২০২৪-এর নির্বাচন যে১৪ বা১৮-এর নির্বাচনের মতো হবে না সেই সংকেতটি কিন্তু আউয়াল কমিশন দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভালো করেই জানেন, কোন এমপির কী অবস্থা। কোনো এমপির ভোট চাইতেও এলাকায় যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই, এটা সবাই জানে। কোন সংসদ সদস্য নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন, টেন্ডার বাণিজ্য করেছেন, সে খবর এখন গোপন নেই। তাই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আত্মতুষ্টিতে ভোগা আওয়ামী লীগ এখন পরিবর্তনবিমুখ। ২০১৯ সালের মন্ত্রিসভায় বড় পরিবর্তন হয়নি। এই মন্ত্রিসভায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে সীমাহীন অযোগ্যতার অভিযোগ সর্বজনবিদিত। এই মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্যের দুর্নীতির ফিরিস্তি আরব্য রজনীর গল্পের মতোই অন্তঃহীন। তবুও তারা মন্ত্রিত্ব হারাননি। কারণ আওয়ামী লীগ ঝুঁকি নেয়নি। বিরোধীদের সমালোচনার সুযোগ করে দিতে চায়নি। কাউন্সিলের আগে জেলা পর্যায়ের সম্মেলনগুলোতে আওয়ামী লীগ ছিল পরিবর্তনবিমুখ। কাউন্সিলেও আওয়ামী লীগ পরিবর্তনের দরজা বন্ধ রেখেছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ পরিবর্তনকে স্বাগত না জানায় তাহলে বড় ঝুঁকিতে পড়বে।

রংপুরের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, সঠিক প্রার্থী না হলে কর্মীরাও তার পেছনে দাঁড়াবে না। নতুন বছরে আগামী নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই ক্ষমতাসীন দলের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগ কীভাবে মোকাবিলা করবে। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক না করুক, আওয়ামী লীগকে একটি কঠিনতম নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থাকে, তাহলে বুঝতে হবে বিএনপি একা নয়, বিএনপির পেছনে রয়েছে কিছু পশ্চিমা দেশ, সুশীল সমাজ এবং প্রভাবশালী গণমাধ্যম। বিএনপি যদি নির্বাচন না করে তাহলে ২০১৪-এর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবার নির্বাচিত হওয়ার স্বপ্ন যারা দেখছেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ২০২৩ সাল হবে স্কুইড গেমের বছর। মরো অথবা মারো। কাজেই বিএনপিকে উপেক্ষা করা, যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার প্রবণতাগুলো কমাতে হবে। প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই। ইতিহাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি একইভাবে হয় না। বাংলাদেশে আর কখনো ২০১৪-এর মতো নির্বাচন হবে না।

শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে, তাহলেও কঠিন লড়াই করতে হবে আওয়ামী লীগকে। ২০২৪-এর নির্বাচন ২০১৮-এর মতো হবে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশন কী করতে পারে, তা তো গাইবান্ধায় তারা দেখিয়েছেন। আর অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পরিণতি রংপুরের মতো হওয়াটাও অসম্ভব নয়।

আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছে। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশকে পাল্টে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এই তো বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) মেট্রোরেলের স্বপ্নের যাত্রা শুরু হলো। ২০০৮ সালে কে ভেবেছিল বাংলাদেশে মেট্রোরেল হবে, পদ্মা সেতু হবে, কর্ণফুলী টানেল হবে। এই উন্নয়নের রূপকার শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের স্বপ্নের সীমাকে অবারিত করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি শেখ হাসিনার প্রতি ন্যায়বিচার করেছে? আওয়ামী লীগের শুধু নয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদের নাম শেখ হাসিনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা দায়িত্বহীনতা, অযোগ্যর কারণে এই সম্পদকে আমরা অবহেলায় নষ্ট করছি। আওয়ামী লীগের একটি অংশ যেন শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত করার মিশনে নেমেছে। এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড। শেখ হাসিনার কারণেই আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায়। তাই শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করতে হবে। তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁর নির্দেশগুলো পালন করতে হবে। ২০২৩ সালে বর্তমান সরকার, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগকে হাঁটতে হবে কাঁটা বিছানো পথে। অহংকার আত্মতুষ্টি আর প্রতিপক্ষকে অবজ্ঞা করার পরিণাম কী হয় তা অতীতে আওয়ামী লীগের চেয়ে কেউ ভালোভাবে দেখেনি। ২০২২- রংপুরে সেই সতর্কবার্তাই পেল আওয়ামী লীগ।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

সবকিছু ঠিক আছে?

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১৭ মে, ২০২৪


Thumbnail

১৭ মে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালিত হলো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করলাম। যে যেভাবে পেরেছে ১৭ মে তে নিজেদেরকে জানান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সংবাদপত্রগুলো ভরে গেছে শেখ হাসিনার স্তুতিতে। শেখ হাসিনাকে নিয়ে বন্দনা কতটা আসল, কতটা চাটুকারিতা তা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। ১৭ মে ১৯৮১ তে যখন তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তখন সাধারণ মানুষের ভালবাসা আবেগ ছিলো হৃদয় নিংড়ানো, পুরোটাই নিখাঁদ। ৪৩ বছর পর এই উচ্ছ্বাস কি তেমনি অকৃত্রিম? 

১৭ মে নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঘুরে দাঁড়াবার দিন। আমি মনে করি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, ১৭ মে বাংলাদেশের জনগণের জন্যও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এরপর ৪৩ বছর পেরিয়ে গেছে। ৪৩ বছর বাঙালীর যে সংগ্রাম বা অর্জন তার সবকিছুর মূলে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তিল তিল করে সংগ্রাম করেছেন এবং বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করেছেন। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের পথে তিনি এখন প্রায় গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু এই ৪৩ বছর পেরিয়ে এখন যখন আমরা আজকে বাংলাদেশের দিকে তাকাবো, তখন একটি প্রশ্ন সামনে আসে। সবকিছু কি ঠিক আছে? দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিতে সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছে? অর্থনীতির চেহারা ক্রমশঃ বিবর্ণ, মলিন হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। আওয়ামী লীগের মধ্যে সবকিছু উপেক্ষা এবং অবজ্ঞা করার প্রবণতা বাড়ছে। কোন সমস্যাকেই অনেকে পাত্তা দিতে রাজী নন। কেউ যদি সমস্যা উপলব্ধি না করে তাহলে সমাধান করবে কিভাবে?

১৯৮১ সালের ১৭ মে যখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসেছিলেন জাতির পিতার রক্তে ভেজা মাটিতে। সেসময় বাংলাদেশ কেমন ছিল? বাংলাদেশ ছিল ক্ষুধা-দারিদ্রে নিষ্পেষিত গণতন্ত্রহীন একটি দেশ। যেদেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ছিলো না, সাংবিধানিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছিল, বিচারের নামে হতো প্রহসন, মানবাধিকার ছিলো ভুলুণ্ঠিত। অভাব,দারিদ্র, বিদেশের উপর নির্ভরতা সবকিছুর মিলিয়ে বাংলাদেশ ছিলো যেন এক স্বপ্নহীন রাষ্ট্র। সে ধ্বংস স্তূপেই এসে শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৮১ থেকে ২০২৪, শেখ হাসিনার এই ৪৩ বছরের জীবনকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগ, তার সংগ্রামের জীবন। দ্বিতীয় ভাগ, অর্জনের। এই ৪৩ বছরে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন এবং এক সাহসী নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে জয় করেছেন। শেখ হাসিনা যখন এসেছিলেন তখন ঘরে বাইরে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। একদিকে, সামরিক শাসকরা তাকে বাঁধা দিতে চেয়েছিল, তার রাজনৈতিক অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তিনি যাতে দেশে না আসেন সে চেষ্টা করা হয়েছিল। দেশে আসার পর এমন এক পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছিল যেন তিনি রাজনীতি করতে না পারেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সে ভয়ের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেননি। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অকুতোভয় সৈনিকের মতো তিনি লড়াই করেছেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় দলেও ছিলো এক বৈরী পরিস্থিতি। কোন্দলে বিভক্ত দলটিতে ৭৫ এর খুনীদের দোসরদের পুনর্বাসিত করা হয়েছিলো। ৩৩ বছর বয়সী বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে পুতুল বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল অনেকে। ঘরে বাইরে লড়াই করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে।

লক্ষণীয় ব্যাপার যে, ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সংগ্রামে যেমন স্বৈরাচার, ধর্মান্ধ মৌলবাদ এবং স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি তার বিরুদ্ধে ছিল। ঠিক তেমনিভাবে দলের ভেতরে ছিল কুচক্রী মহল, ছিলো ষড়যন্ত্রকারী। সেই ষড়যন্ত্রকারীরা শেখ হাসিনার অভিযাত্রার পথে কাঁটা বিছিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। আবার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, মানুষের নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামেও দলের ভিতর থেকে তিনি সহযোগিতা পেয়েছেন খুবই কম। দলের ভেতর অনেকেই সেসময় নব্য মোশতাকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগে পরিণত হবে- এমন কথা বলতেন দলটির ডাক সাইট নেতারা। ২০০৭ সাল থেকে ২০০৮ সাল এই দুই বছর শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্রের মধ্যেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ নেতাদের দায় চোখ এড়াবে না। তারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার জন্য যে ঘৃণ্য  খেলায় অংশীদার হয়েছিলেন। ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই তাকে দল আগলে রাখতে হয়েছে। এসময় আওয়ামী লীগইে শেখ হাসিনার সমালোচকের অভাব ছিলোনা। সেই সমালোচনার জবাব দিয়েই তিনি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেঁটেছেন। এখন তার সমালোচকরাই সবচেয়ে বড় চাটুকার। শেখ হাসিনার সংগ্রামের অধ্যায়ের যোদ্ধারা এখন কোণঠাসা। অর্জনের সময় অতিথি পাখিদের দাপট দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের দাপটে দুঃসময়ের সঙ্গীরা কোণঠাসা। এরাই চারপাশে এমন স্তুতির রঙ্গীন ফানুস সাজিয়েছেন যে বাস্তব অবস্থাই আড়াল হয়ে গেছে। এটাই হলো ভয়ের কারণ। আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলকে তিনি ৪৩ বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ৭৫ বছর বয়সী উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দলটি ৭৫’র আগস্টের শোকাবহ ঘটনার পর তাঁর হাতেই পুনর্জন্ম লাভ করে, বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন আরও ৫ বছরের জন্য জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছে। শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিকে পরাজিত করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এখন একমাত্র তারকা হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছেন। রাজনীতিতে তার কোন প্রতিপক্ষ নেই। তিনি দেশ পরিচালনায় একজন প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ এবং একজন বিশ্ব নেতার সমতুল্য, সেটি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা অস্বস্তি, কোথায় যেন একটা আতঙ্ক, কোথায় যেন একটা প্রশ্ন। সবকিছু কি ঠিক আছে? দেশ কি সঠিক পথে?

চতুর্থ মেয়াদে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসাটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এসময় এক প্রচন্ড প্রতিপক্ষ এবং নানা রকম প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক মহল এ নির্বাচন বাতিলের এক নীল নকশা রচনা করেছিলো। নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিলো। বাংলাদেশের গণতন্ত্র থাকবে কিনা তা নিয়ে এক শংকা তৈরী হয়েছিলো। এই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সাহসের সাথে তিনি পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। অনেকে কল্পনাও করতে পারেননি যে, এইভাবে বিরোধী দল ছাড়া একটি নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে এবং নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্বস্তির হাওয়া বইবে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন একটি ম্যাজিক।

নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। নতুন সরকার চার মাস সময় পার করেছে। আন্তর্জাতিক চাপ নেই। রাজনীতির প্রতিপক্ষরা সরকারকে চোখ রাঙ্গাতে পারছে না। আওয়ামী লীগ অনেকটাই দুশ্চিন্তা মুক্ত। কিন্তু এক অজানা আশঙ্কা ভর করেছে। অর্থনীতিতে অস্থিরতা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রতিনিয়ত কমছে, নানামুখী সংকটে অর্থনীতি আজ মুখ থুবড়ে পরার উপক্রম। সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে নেই। জিনিস পত্রের দাম উর্ধ্বমুখী, বিদ্যুৎ সংকট বেড়েছে, ডলারের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চারিদিকে ফিসফাঁস। ব্যাংকে টাকা নেই, ঋণ খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে। অর্থ পাচারকারীরা বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে সরকার কিভাবে এগুবে? অর্থনীতির সংকট কিভাবে সরকার কাটিয়ে উঠবে সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ সরকারের ভেতর কিছু ব্যক্তি সমস্যাকে আমলে নিতে রাজী নন। যুক্তিহীন ভাবে তারা বলছে, শেখ হাসিনা সব ম্যানেজ করবে। অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাবে। কিভাবে?-এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। অর্থনৈতিক সংকট যদি প্রবল হয় তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতির এই দৈন্য চেহারা হবার কথা ছিলো না। সঠিক পরিকল্পনা এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলাদের নির্বোধ নিরীক্ষার কারণে অর্থনীতিতে বর্তমান সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি গ্রহণ করলেও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কঠোর হতে পারেনি। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীদের বিরুদ্ধেও অসহায় সরকার। কেন পারছে না আওয়ামী লীগ? যারা অর্থ পাচার করছে, যারা দুর্নীতিবাজ, ঋণ খেলাপী তারা ক্ষমতার চারপাশে রয়েছে এমন আলোচনা বিভিন্ন সময় শোনা যায়। আমলাতন্ত্রের উপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। আমলারা এখন সবকিছুর কর্তা। নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আমলারা। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অর্থনীতির অবস্থা খারাপের দিকে এমনটি মনে করেন সরকারের অনেকেই। কিন্তু তারপরও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আমলাতান্ত্রিক বটিকার বাইরে সরকার কোন সমাধান বের করতে পারেনি। 

সাংগঠনিকভাবেও আওয়ামী লীগের মধ্যে নানারকম অস্থিরতা। দলের ভেতর চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে গেছে। স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রের কথা শুনছেন না। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যা হচ্ছে সেটা আওয়ামী লীগের জন্য লজ্জার। সারাদেশে আওয়ামী লীগের সংগঠনের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। গ্রুপিং, কোন্দল এখন আওয়ামী লীগের স্বাভাবিক চিত্র। অনেকেই বলবেন, আওয়ামী লীগের মতো একটা বড় দল টানা ক্ষমতায় আছে তাই বিভক্তি থাকতেই পারে। এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই বিভক্তি যখন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে শেখায়, এই বিভক্তি যখন দলের স্বার্থের পরিপন্থী অবস্থান নেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে, তখন তা উদ্বেগের কারণই বটে। আওয়ামী লীগ এখন সাংগঠনিকভাবে অগোছালো, নানারকম সংকটে জর্জরিত। ক্ষমতায় আছে জন্য এ সংকটগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে না। কিন্তু দলের জন্য যারা নিবেদিত প্রাণ, তারা জানেন সংকট কোথায় এবং কতটা গভীর। কোন্দল ঠেকাতে, শৃঙ্খলা ফেরাতে দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতারা নিষ্ক্রিয়। তাহলে এতো নেতার কাজ কি? আওয়ামী লীগ এবং সরকারে সবাই তাকিয়ে থাকেন শেখ হাসিনার দিকে। কেউ কোন সিদ্ধান্ত নেন না।

১৭ মে যখন শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন তখন এক প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাকে লড়াই করতে হয়েছে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ ছিলো। এক বিরূপ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। এখন দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর অভাব নেই। হাটে, মাঠে, ঘাটে আওয়ামী লীগে সয়লাব। বর্ষার বৃষ্টিতে যেমন খাল-বিলে মাছে টইটুম্বুর থাকে দেশ এখন আওয়ামী লীগ দিয়ে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। কে আসল, কে নকল তা বোঝা ভার। আর একারণেই প্রশ্ন উঠেছে, যারা সর্বনাশা খেলায় মেতেছেন, যাদের ভুল পরামর্শে অর্থনীতির বারোটা বাজছে, যাদের কারণে আওয়ামী লীগের ভেতর কোন্দল বেড়ে যাচ্ছে, যাদের কারণে দ্রব্যমূল্যের বাজারে অস্থিরতা। তারা সরকারের চারপাশেই আছেন। তারা কি সরকারের শুভাকাঙ্খী নাকি ষড়যন্ত্রকারী? আওয়ামী লীগ যখন বিপদে পড়বে তখন এদের চেহারাটা কেমন হবে? আর আওয়ামী লীগের জন্য এখন খুবই আয়েশি সময়। আওয়ামী লীগ এক আত্মতুষ্টির আতিশায্যে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, আলোর পরেই অন্ধকার। তাই চাটুকার, সুবিধাবাদী, এবং সুযোগ সন্ধানীদের কাছ থেকে আওয়ামী লীগকে মুক্ত করতে হবে। দেশের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধির চেষ্টা করতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে আওয়ামী লীগকে। সরকার যদি জনবান্ধব না হয়, মানুষের জীবনে যদি সরকার স্বস্তি আনতে না পারে তাহলে জনগণও মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। ১৭ মে থেকে আওয়ামী লীগকে সেই শিক্ষাই নিতে হবে। জনগণই ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে সমর্থন দিয়ে তাকে রাজনীতির উচ্চ শিখরে আসীন করেছে। জনগণের ভালোবাসাতেই তিনি প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন। জনগণই তার প্রধান শক্তি। কাজেই জনগণের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগের প্রধান কাজ। সবকিছু ঠিক আছে, বলে বাস্তবতাকে আড়াল করলে ক্ষতি হবে আওয়ামী লীগেরই। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

এই সব সুশীলদের এখন কী হবে?

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ১৫ মে, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশে সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি আছেন যাদেরকে মনে করা হয় তারা মার্কিনপন্থী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে তারা গর্ব অনুভব করেন। কথায় কথায় মার্কিন দূতাবাসে যান। সেখানে প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, নৈশভোজে মিলিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বলে তারা তার চেয়ে তিন ধাপ গলা উঁচিয়ে কথা বলেন। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের কোন ভালবাসা নেই, প্রেম নেই, আগ্রহ নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং নীতি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য। এই সমস্ত সুশীলদেরকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোফোন। 

গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই ধরনের সুশীলের প্রভাব প্রতিপত্তি বাংলাদেশে ব্যাপক লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফোরামে তারা যেন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি, তখন এই সমস্ত সুশীলরা বাহবা দিয়েছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত সঠিক বলেই বিভিন্ন টকশোতে, বিভিন্ন লেখালেখিতে বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সময়ও সুশীলদের দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলতে। এতে যে দেশের ক্ষতি সেটি অনুভব করার সামর্থ্য তাদের নেই। আবার ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করল তখন এই সমস্ত সুশীলরা ভিসা নীতি নিয়ে যেন মার্কিন কূটনীতিকের ভূমিকা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যখনই কোনো প্রতিনিধিরা আসতেন তখন এই সমস্ত সুশীলদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করতেন এবং এতেই বাজারে তাদের কদর বাড়ত। বিভিন্নভাবে তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতেন। আর এই সমস্ত সুশীলদের খুঁটির জোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কথাটা সর্বত্র চাউর ছিল। কিন্তু সেই সুশীলরাই এখন অপাংক্তেয় হয়ে গেলেন। তারা এখন হতাশার সাগরে নিমজ্জিত। 

ডোনাল্ড লুর সফরে এবার চায়ের দাওয়াত পাননি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। ডোনাল্ড লুর সঙ্গে তাদের দেখা সাক্ষাৎও হয়নি। এ নিয়ে তাদের ভীষণ মন খারাপ। বিশেষ করে হেফাজতের তাণ্ডবের সময়ে যিনি হেফাজতের কর্মীদের মৃত্যু আবিষ্কার করেছিলেন, মানবাধিকারের নামে যিনি সরকারবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত সেই আদিলুর রহমান খান প্রতিবারই মার্কিন দূতাবাসে দাওয়াত পেতেন। কিন্তু এবার তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এই বিতর্কিত তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত। 

জিল্লুর রহমান তৃতীয় মাত্রা উপস্থাপক। পিটার হাস রাষ্ট্রদূত হওয়ার পরপরই লাইমলাইটে আসেন জিল্লুর রহমান। তার সঙ্গে পিটার হাসের সখ্যতার কথা তিনি নিজেই বিভিন্ন জায়গায় বলে বেরিয়েছেন। ডোনাল্ড লু যখন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তখন ডোনাল্ড লুর সঙ্গে তিনি এক সাক্ষাৎকারেও আয়োজন করেছিলেন। একদা খুনি রশিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া এই বিতর্কিত উপস্থাপক মার্কিন অর্থায়নে এবং মার্কিন আর্থিক সহায়তায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। কিন্তু এবার তিনিও অপাংক্তেয় ছিলেন। 

স্বাধীনতাবিরোধীর সন্তান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের প্রধান কাজ হল সরকারকে নানাভাবে সমালোচনা করা। সরকারের লক্ষ্য ত্রুটি বিচ্যুতি বের করাই যেন তাঁর একমাত্র মিশন। সেই রিজওয়ানা হাসানকেও এবার দাওয়াত দেয়নি মার্কিন দূতাবাস। আর এই সমস্ত ব্যক্তিদেরকে দাওয়াত না দেওয়া ফলে প্রশ্ন উঠেছে। 

তবে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক দম নিজস্ব ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত বদিউল আলম মজুমদারের অনুপস্থিতি। বদিউল আলম মজুমদার প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তাকে মনে করা হত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে মূখপাত্র। এমন কী মার্সিয়া বার্নিকাটকে বিদায়ের আগে তাঁর বাসায় নৈশ্যভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই বদিউল আলম মজুমদারের মার্কিন দূতাবাসে চায়ের দাওয়াত না পাওয়াটা বিস্ময়কর। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি নিয়ে যে সব সুশীলরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদলেহন করেছেন তাদের এখন কী হবে?

সুশীল   ডোনাল্ড লু   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান   বদিউল আলম মজুমদার   আদিলুর রহমান খান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ক্ষমতাসীনদের চীন সফর: নজর রাখছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ১৫ মে, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগ এবং তার আদর্শিক জোট ১৪ দলের নেতাদের চীন সফরে হিড়িক পড়েছে। আওয়ামী লীগ এবং তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর এই চীন সফরকে ঘিরে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলাপ আলোচনা। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই ১৪ দল এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের চীন সফরের ব্যাপারে দৃষ্টি রাখছেন। তবে তারা এই বিষয় নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না। বিষয়টি তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় হিসেবেই মনে করছেন। 

রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ এখন চীন সফর করছেন। রাশেদ খান মেনন ছাড়াও আওয়ামী লীগের শরিক এই জোটের অন্যান্য নেতারাও এই সফরে রয়েছেন। চীনপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত দিলীপ বড়ুয়া, শিরীন আখতার সহ শরিকদের প্রায় সবাই এই সফরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আর এই সফরের পরপরই আওয়ামী লীগের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের একটি ৫০ সদস্যের বিশাল দল যাচ্ছে চীন সফরে। সেই সফরে নেতৃত্ব দেবেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনের এমপি তানভীর শাকিল জয়। এর পরপরই কাজী জাফরউল্লাহ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল চীন সফরে যাবেন। 

পরপর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চীন সফর নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে নানারকম প্রশ্ন উঠেছে। আর এই ব্যাপারে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র দৃষ্টি রাখছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।

হঠাৎ করে আওয়ামী লীগে চীন সফরের হিড়িক কেন এই নিয়ে নানামূখী আলোচনা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলছেন, এটি হঠাৎ করেই নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন সময়ে ভারত সফরও করেন। ভারতেও বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের আলাপ আলোচনার জন্য মতবিনিময় করা হয়। ভারতীয় প্রতিনিধিদলও বাংলাদেশে আসেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধি দল নিয়মিতভাবে যায়। কিন্তু এবার চীনের সফরগুলো সব পাশাপাশি সময় এসেছে। আমন্ত্রণ গুলো কাছাকাছি সময়ে এসেছে। এই জন্য বিষয়টিকে বড় করে দেখা হচ্ছে৷ এটি আসলে একটি রুটিন কাজ। 

আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আর এই রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণেই আওয়ামী লীগকে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তবে কূটনৈতিক মহল মনে করছেন, চীনের আগ্রহেই এই সফরগুলো হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বলয়ে চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হিসেবে এই সফরকে দেখছেন অনেকে। 

তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নিকটতম বন্ধু হল প্রতিবেশী ভারত। চীন তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পার্টনার। আর এই কারণেই আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, ভারতের সাথে তাদের এক ধরনের রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের বন্ধন রয়েছে, যা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের অর্থনৈতিক বলয় বিস্তার এবং আওয়ামী লীগ এবং শরিকদের নেতৃবৃন্দের চীন সফর নিয়ে ভারত কোন মন্তব্য না করলেও বিষয়টি নিয়ে তারা দৃষ্টি রাখছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় কুমার ভার্মা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বস্ত্র এবং পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গেও এক সপ্তাহের মধ্যে সাক্ষাৎ করেছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ যেন চীনমুখী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে না পরে সে বিষয়ে  ভারতের নজর আছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয় নিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে বলেও জানা গেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ   চীন সফর   ভারত   যুক্তরাষ্ট্র  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

বিশ্বজুড়ে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অস্বস্তি, বাংলাদেশে?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।

গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। তার আগে একটা রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে ২ হাজার ৬০০ কাউন্সিলরের মধ্যে দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি পেয়েছে ১ হাজার ৬১টি পদ। অন্যদিকে ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ৫০৪টি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়ে দলগতভাবে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। নির্বাচনে দ্বিতীয় হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। ৪০ বছরের ইতিহাসে এটি কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা যে ভীষণ নড়বড়ে, তা এই নির্বাচনেই প্রমাণ হয়েছে। নির্বাচনের পর পার্লামেন্ট নির্বাচনে কনজারভেটিভদের ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা না বলা গেলেও কনজারভেটিভ পার্টি যে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, সেটি হলফ করে বলা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ বছর নভেম্বরে। এই নির্বাচনে জো বাইডেনের অবস্থা তথৈবচ। জো বাইডেনকে কোনো জনমত জরিপেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। আইনি মারপ্যাঁচ, যৌন কেলেঙ্কারি ডেমোক্রেটদের নানামুখী বাধা ইত্যাদি নানা সংকট থেকে মুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আবার প্রার্থী হওয়া ট্রাম্পের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না সেটি যেমন প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো যে, জো বাইডেন এই নির্বাচনে কি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ এবং ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে জ্ঞান দেয়, মানবাধিকার চর্চার জন্য শাসন করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এখন মানবাধিকার সংকটে। গাজায় ইসরায়েলের তাণ্ডবের প্রতিবাদে মার্কিন তারুণ্যের গণবিস্ফোরণ পুরো বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এই গণবিস্ফোরণকে ঠেকাতে যেভাবে জো বাইডেন সরকার দমন নীতি গ্রহণ করেছে, তা তাকে সবচেয়ে কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে গেছে। জনগণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশ্বাস করছে না, জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তিনি এখন তলানিতে অবস্থান করছেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিজয়ী হয়েছিলেন অনেক লড়াই করে। বিজয়ের পর জনগণ তার পক্ষে কতটুকু আছে বা জনগণের মনোভাব কী, তা যাচাইয়ের একটি উপায় ছিল গত মার্চের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দলের শোচনীয় ভরাডুবি ঘটেছে। তিনি বড় শহরগুলোতে মেয়র পদে যাদের প্রার্থী দিয়েছিলেন, তারা ধরাশায়ী হয়েছেন বিরোধী পক্ষের কাছে।

সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর অবস্থা ভালো না। নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের মুখে। জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক স্থানেই বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছে নাগরিকরা। এর একটি বড় কারণ হলো, মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। এরকম বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশে এখন পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচন চলছে। প্রথম ধাপের উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত ৮ মে (বুধবার)। এ উপজেলা নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে চেয়েছে; কিন্তু সে উদ্যোগও সফল হয়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রথম ধাপে ৩৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এটি সর্বনিম্ন ভোটের রেকর্ড। এটি নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতে যেমন ক্ষমতাসীন দল চ্যালেঞ্জের মুখে, পুনরায় তাদের ক্ষমতায় আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি তেমনটি নয়।

বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে কেউ ক্ষমতাসীন দলের বিপর্যয়ের কথা কল্পনাও করেনি। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল তারা কেউই ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেনি বা ক্ষমতায় আসার মতো জনপ্রিয়তা, নেতৃত্ব বা সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের ছিল না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল অবধারিত। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে যারা দলের মনোনয়ন পাননি সে বিদ্রোহী প্রার্থীদের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৮ জন স্বতন্ত্র বিজয়ী হয়ে নির্বাচনের মান বাঁচিয়েছে। নির্বাচনকে ‘জীবন’ দিয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। উপজেলাতেও তাই আওয়ামী লীগ একই কৌশল গ্রহণ করেছে। উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা ছিল দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করলে বিএনপির জন্য নির্বাচনে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে—এমন গুঞ্জনও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি পুরোনো পথে হেঁটেছে। তারা উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শতাধিক বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।

প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনে তাদের ৭ জন বিজয়ী হয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। তবে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিকূল রাজনীতির পরিবেশে নির্বাচন করে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা যায় না। তার পরও যে উপজেলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে বিএনপি নেতারা অংশগ্রহণ করেছে সেজন্য তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ সুস্থ রাজনীতির জন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার পরও উপজেলা নির্বাচন গণতন্ত্রের সংকটের বার্তা। নির্বাচন নিয়ে জনগণের অনীহা ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তির। আওয়ামী লীগের সামনে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নেই। আওয়ামী লীগের এমন কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই যারা জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তা ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের তীব্র সংকট চলছে। কদিন আগেই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে হটিয়ে তারা ক্ষমতা নিতে চায়, তাদের নেতা কে?’ এই নেতৃত্বের সংকটই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, নেতৃত্ব সংকটের কারণেই বিএনপি নির্বাচনবিমুখ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে এখন ‘স্বেচ্ছা বন্দি’। তিনি ফিরোজায় বাসভবনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি নির্বাচনের অযোগ্য। অন্যদিকে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ একাধিক মামলায় দণ্ডিত। তার দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এ কারণে বিএনপি এখন নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। বিএনপির লক্ষ্য সুস্পষ্ট। তারা নির্বাচন থেকে দূরে থেকে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলতে চায়। গণতন্ত্রে সংকট দেখা দিলে তৃতীয় কোনো পক্ষের ক্ষমতায় আসার পথ উন্মুক্ত হবে।

তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতায় এলে বিএনপি তার রাজনৈতিক পুনর্গঠন নতুন করে শুরু করতে পারবে। অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে তারেক জিয়া দেশে ফেরা, খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফের বিষয়গুলো তারা ফয়সালা করতে চায়। এজন্য নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক রীতিতে ক্ষমতায় আসা নয়; বরং একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এ কারণেই তারা যতটা না জনমুখী কর্মসূচি পালন করে তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ধর্ণা দেয়, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশগুলোকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা বিএনপির রাজনীতির প্রধান কৌশল। ফলে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের খুশি বা আত্মতুষ্টির কারণ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪২ শতাংশ। এ নিয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় এবং সন্দেহ রয়েছে। তার পরও একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতিকে সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে ভোটার উপস্থিতি কম হবে—এটাই স্বাভাবিক বিষয়। বিএনপি অংশগ্রহণ না করার পরও যে একতরফা নির্বাচন হয়নি, বিশেষ করে ২০১৪-এর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসতে পেরেছে, সেটি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের বড় অর্জন। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন জনগণ আরও ভোটবিমুখ। এটি আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই অশনিসংকেত। গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভোটাররা যদি গণতন্ত্রের প্রতি অনাগ্রহী হন, ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে না যান, ভোটাররা যদি তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখান তাহলে গণতন্ত্র সংকটে পড়বেই। আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বে আওয়ামী লীগ। এ কারণে অন্য দেশগুলোতে যখন ক্ষমতাসীনরা ভোটে জিতবে কি জিতবে না সেই অনিশ্চয়তায়, সেখানে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে আমি মনে করি। নির্বাচনে পরাজয়ের শঙ্কার চেয়ে গণতন্ত্রের মৃত্যুর শঙ্কা বেশি ভয়াবহ।

উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে অতীতে দেখা গেছে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকে জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহী হয়। এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক হয় এবং একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এবার উপজেলা নির্বাচনে সেটি হয়নি। কেন হয়নি তার কারণ আওয়ামী লীগকে খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ সমর্থক আছে। তারাও কেন ভোট দিতে যাচ্ছেন না? এর উত্তর খুঁজতে হবে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটিকে। দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করেও আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারেনি। এই না পারার কারণ হলো আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতা লোভ, বাড়াবাড়ি এবং এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনা। তারা দমন করার চেষ্টা করেছে পেশি শক্তি প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করেছে। সাধারণ মানুষ সব জানে, সব বোঝে। তারা এসব ঝুট-ঝামেলার মধ্যে যেতে চায়নি। সে কারণেই তারা ভোট থেকে আগ্রহ ফিরিয়ে নিয়েছে। অনেক জায়গায় নির্বাচনের ফল ছিল পূর্ব অনুমিত। তারা জানত যে, এমপির ভাই দাঁড়িয়েছে, এমপির ছেলে দাঁড়িয়েছে কাজেই তাদের বিজয় ঠেকাবে কে। এই বোধটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগকে এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না বটে, তবে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না, তা হলফ করে কে বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে আবার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকে তিনি এই ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। অতিডান এবং অতিবামরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করেছে বলে তিনি নেতাদের সতর্ক করেছেন। 

আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের কাছেই আওয়ামী লীগ বারবার পরাজিত হয়েছে, হয়েছে বিপর্যস্ত। আর এই ষড়যন্ত্র শুধু বাইরে থেকে হয়নি, দলের ভেতর থেকেও হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর একটাই উপায়, তা হলো গণতন্ত্রকে মুক্ত স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে দেওয়া, জনগণকে উৎসাহিত করা, ভোটকেন্দ্রে যাতে ভোটাররা যান, তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন সে পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া। উপজেলা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি দলের নেতাকর্মীদের ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য প্রচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেখ হাসিনা মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করার জন্য যে নির্দেশ দেন, তা কেউ মানেনি। যারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তারাও ষড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংকটে। বিরোধী দলহীন গণতন্ত্র মুণ্ডুহীন দেহ। সরকারের কোনো জবাবদিহি থাকে না। এতে ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের দূরত্ব তৈরি হয়। এভাবেই পল্লবিত হয় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। অবৈধ ও অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হয়। তেমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছেই যেতে হবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিশ্ব   নির্বাচন   বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

মামা-ভাগ্নের নির্বাচনে ধান কাটার উৎসব

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১০ মে, ২০২৪


Thumbnail

দেশের মানুষের এমনিতেই নাভিশ্বাস অবস্থা। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ সংকটে চেয়েও বড় অস্থিরতা হলো জিনিস পত্রের দাম। অস্থির সময়ে মানুষের জন্য বিনোদনের কোন খোরাক নেই। তবে প্রধান নির্বাচন কাজী হাবিবুল আউয়াল মানুষের জন্য অস্বস্তির তাপদাহে এক পশলা বৃষ্টির মতো, বিনোদনের খোরাক যোগালেন। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ১৩৯ টি উপজেলার নির্বাচনের পর সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘ধান কাটার কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে আসেননি।’ নিষ্প্রাণ উপজেলা নির্বাচনে সিইসির বক্তব্যই একমাত্র চমক। 

উপজেলা নির্বাচন উত্তেজনাহীন হয়েছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। আগে উপজেলা নির্বাচনগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা ছিলো, স্থানীয় জনগণের মাঝে নানারকম হিসেব-নিকেশ এবং মেরুকরণ হতো। এবার তেমনটি হয়নি। সবাই জানে কেন উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিলো। প্রতিপক্ষহীন খেলা কখনও উত্তেজনাপূর্ণ হয় না। দর্শকদের আগ্রহও থাকেনা। বিরোধীদল হীন নির্বাচনও ভোটারদের জাগাতে পারেনা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেই নানারকম বেসামাল কথা-বার্তা বলতে হয়। কাজী হাবিবুল আউয়াল এতোদিন অনেকটাই সংযত ছিলেন। কিন্তু এখন তার সংযমের বাঁধ সম্ভবত ভেঙ্গে গেছে। উপজেলা নির্বাচন যখন হচ্ছিল তখন কত নির্বাচনী এলাকায় ধান কাটা চলছিল সে হিসেব কি কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছে আছে? তিনি কি জানেন, ধান কাটার জন্য কতজন কৃষক নিয়োজিত থাকেন? 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ শুমারীতে সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা কত সে হিসেবটা নিশ্চয়ই সিইসির জেনে নেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু ধান কাটার উৎসব হোক বা আম পাড়ার উৎসবই হোক, বাস্তবতা হলো উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ ছিলো না। তার প্রধান কারণ হলো, এ নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ অংশগ্রহণ করেনি। বিরোধী পক্ষ ছাড়া নির্বাচন যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না সেটি বারবার প্রমাণিত, আর এটিই বাস্তবতা। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত এই নির্বাচনেও যেন একাধিক আওয়ামী লীগের প্রার্থী দাঁড়াতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর সেই সুযোগ নিয়ে এবার নির্বাচনের উৎসব হয়েছে ‘মামা-ভাগ্নের নির্বাচন’। 

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার কথাই ধরা যাক। এখানে নির্বাচন হয়েছে প্রথম ধাপে। এই উপজেলার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী এবং কবির হাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার শিউলির ছেলে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরী। সাবাব চৌধুরী নির্বাচনে আনারস প্রতীক নিয়ে ৩৭,৬৪৮ ভোট পেয়েছেন। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বর্তমান চেয়ারম্যান দোয়াত-কলম প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনাম সেলিম পেয়েছেন ৩৬,৯৪৫ ভোট। ৭০৩ ভোটের ব্যবধানে মামাকে হারিয়ে দিয়েছেন ভাগ্নে। স্থানীয় রাজনীতিতে অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনাম সেলিমকে মামা ডাকতেন সাবাব। ‘মামা-ভাগ্নে নির্বাচনে’ ভাগ্নে জিতেছে, মামা হয়েছে কুপোকাত। এভাবে সারাদেশেই উপজেলা নির্বাচন এখন মামা-ভাগ্নের নির্বাচন। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল এমপি-মন্ত্রীরা যাতে আত্মীয় স্বজনদেন প্রার্থী না করে। ধারণা করা হয়েছিল যে, একরামুল করিম চৌধুরীদের মত ব্যক্তিদেরকে নিশানা করেই আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। 

প্রধানমন্ত্রী গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, একই পরিবারের সবাই যদি সবকিছু দখল করে তাহলে কর্মীরা কি করবে। নোয়াখালীতে তাই ঘটেছে। নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী, কবিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী আর ছেলে হলেন সুবর্ণচর উপজেলার চেয়ারম্যান। ফলে নোয়াখালীতে একরামুল করিম চৌধুরীর রাজত্ব এখন ঠেকায় কে। শুধু যে নোয়াখালীতে এমন ঘটনা ঘটেছে তা নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেই এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের লড়াই হয়েছে। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাদের কুপোকাত করে দিয়েছে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। আওয়ামী লীগের এই প্রীতি ম্যাচে ৩৬ শতাংশ ভোট তো অনেক বেশী।  

একটি নির্বাচনে সাধারণ মানুষ বা ভোটাররা কেন ভোট দেবেন? সাধারণত মানুষের সামনে যখন অনেকগুলো বিকল্প থাকবে তখন মানুষ ভোটের মাধ্যমে একটি বিকল্প পছন্দ করে নেবেন। নানা মত, নানা পথের যে বৈচিত্র্য, সেই বৈচিত্র্যই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। যদি সকল রাজনৈতিক দল একই মতামত প্রকাশ করে, অভিন্ন চিন্তাভাবনার অনুসারী হয় এবং ক্ষমতাই যদি তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্র হয়না, তাতে মানুষেরও আগ্রহ থাকেনা। বিরোধী দল লাগাতারভাবে নির্বাচন বর্জনের ফলে এরকম একটি পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে। বিএনপি কেন উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলো সেটি একটি বড় প্রশ্ন। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি থেকে যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘণ করে অংশগ্রহণ করেছেন তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু দলের বিদ্রোহীরা বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়েই নির্বাচন করেছেন। প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দেখা গেছে যে ৭ টি উপজেলায় বহিষ্কৃতরা বিজয়ী হয়েছেন। যদি বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে এ বিধি নিষেধ আরোপ না করতো তাহলে নির্বাচনগুলো আরো উৎসবমুখর হতো এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়তো। সবচেয়ে বড় কথা হতো ভোটারদের সামনে ভালো মন্দ বাছাই করার সুযোগ তৈরি হতো। যেসমস্ত উপজেলাগুলোতে বিএনপির প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছেন সেই উপজেলাগুলোতে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি ছিলো। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে চিংড়ি মাছ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম। এখানে ভোটের হার অন্যান্য উপজেলাগুলোর চেয়ে তুলনামূলক বেশি। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, যখন একটি বিরোধী পক্ষ নির্বাচনে থাকে তখন সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ে। দুপক্ষের প্রচারণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী একটি আবেগ বা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন নির্বাচনটি শুধু হয়ে যায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিষয় বা প্রীতি ম্যাচের মত, নির্বাচন যখন মামা-ভাগ্নের লড়াইয়ে পরিণত হয় তখন মানুষ নিজেকে অধিকারহীন ভাবে, মানুষ ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নির্বাচনের ফলাফল তার জীবন এবং ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আনবে না, এরকম একটি বোধ তাদের মধ্যে প্রোথিত হয়। আর এরকম একটি পরিস্থিতির কারণেই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ  কমে যাচ্ছে। 

এজন্য দায়ী কে? ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন নাকি বিরোধী রাজনৈতিক দল? ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশ যাতে ভোটের মাধ্যমে হয় সেটির জন্য একটি অনুকূল আবহ সৃষ্টি করা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখা, প্রশাসন যেন নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে তা নিশ্চিত করা। অবাধ ও সুষ্ঠু উপজেলা নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের এ ব্যাপারে কোন ঘাটতি ছিলোনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে চেয়েছেন উপজেলা নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। তবে ভালো উদ্যোগ ভন্ডুল করতে আওয়ামী লীগে অতি উৎসাহীদের অভাব নেই। আওয়ামী লীগের ভেতর যারা ‘জমিদারতন্ত্র’ কায়েম করতে চায়, এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, নির্বাচনী এলাকায় জনগণকে পায়ের নীচে রেখে লুটপাটের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পুরোপুরি বিপক্ষে। নির্বাচন মানেই তাদের কাছে গদী দখল, একারণেই তারা ‘মাই ম্যান’-দেরকে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী করেছে, অনেকে ‘মাই ম্যান’দেরকে ভরসা করতে পারেনি। তারা আত্মীয় স্বজনদেরকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করে এলাকা দখল এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মিশনে নেমেছে। যদিও আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয় স্বজনদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলো, কিন্তু আওয়ামী লীগের এই নির্দেশনা মাঠে বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ মন্ত্রী-এমপিরা এখন এতই ক্ষমতাধর হয়ে গেছেন যে, তারা দলের নির্দেশনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন। যদি শেষ পর্যন্ত উপজেলাগুলোতে আত্মীয় স্বজনদের প্রার্থীতা না দিতেন তাহলে উপজেলা নির্বাচনটি আরো প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর হতো বলেই আমি মনে করি। কারণ এর ফলে অন্য প্রার্থীরা সমান সুযোগ পেতেন, ভোটারদের কাছে যেতেন। যেসস্ত নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রী-এমপিদের নিজস্ব ব্যক্তি এবং আত্মীয় স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন সেসমস্ত নির্বাচনী এলাকাগুলোতে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা হয়েছে, প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হয়েছে, ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। ফলে ভোটাররা কুণ্ঠিত হয়েছেন। এতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলেছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইলেও মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শুভ চিন্তাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে কিছু লোভী, অপরিণামদর্শী মন্ত্রী-এমপি এবং প্রভাবশালী নেতা। 

নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে যে আন্তরিক, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং গঠনমূলক নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটা চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু  মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশন শুধুমাত্র রেফারি মাত্র। নির্বাচনের আসল খেলোয়াড় হলো ভোটার রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে না পারে, প্রার্থীরা যদি জনগণকে ভোটকেন্দ্রে না নিয়ে যেতে পারে তাহলে শুধু নির্বাচন কমিশনের একা কিছু করার নেই। নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের তদারকি করতে পারে মাত্র। 

এবার বিরোধী দলের দায়িত্ব কতটুকু তা একটু খতিয়ে দেখা যাক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি দল বা ক্ষমতাসীন দলের যতটুকু দায়িত্ব ঠিক ততটুকু দায়িত্ব বিরোধী দলেরও। আধুনিক গণতন্ত্রে মনে করা হয় ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব অনেক বেশী। কারণ সরকারের ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়া, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা সামনে নিয়ে এনে, সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করাই বিরোধী দলের প্রধান কাজ। আর একারণেই আধুনিক গণতন্ত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ‘ছায়া সরকার’ গঠন করে। এই ছায়া সরকারের মাধ্যমেই তারা সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে এবং জনগণের কাছে তা তুলে ধরে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। কিন্তু আমাদের বিরোধী দলগুলো কি করছে? সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি এখন আস্তে আস্তে অস্তিত্বের সংকটে বিলীন প্রায়। এই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে জাগরণ তৈরি করার কোন চেষ্টা তারা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। উপজেলা ব্যবস্থাটি জাতীয় পার্টির সৃষ্টি। এই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির আলাদা আবেগ থাকার কথা ছিল। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে শুধু ম্রিয়মানই দেখা যায়নি, জাতীয় পার্টির অনীহা ছিলো চোখে পড়ার মতো। 

বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন না করে যত না ভুল করেছে তার চেয়ে বেশি ভুল করেছে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে। কারণ এ নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলকে সংগঠিত করার সুযোগ ছিল বিএনপির সামনে। বিএনপি তাদের নেতা-কর্মীদের হতাশা কাটিয়ে  তোলার জন্য উপজেলা নির্বাচনকে ব্যবহার করতে পারতো। আর উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি যদি দলগতভাবে অংশগ্রহণ করতো তাহলে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের জন্য তারা একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারতো। কিন্তু বিএনপি সে পথে হাটেনি। এটি কি বিএনপির রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নাকি ইচ্ছে করেই এটি করেনি? আমার বিবেচনায় এটি বিএনপি ইচ্ছে করেই নির্বাচন বর্জনের পথে হেটেছে। এটি তাদের কৌশলগত অবস্থান। কারণ বিএনপি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাঁধাগ্রস্থ করতে চায়। গণতন্ত্রকে ধ্বংসের বড় উপায় হলো নির্বাচন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলা। ভোটারদের অনাগ্রহী করা এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে জনগণের মধ্যে অনীহা সৃষ্টি। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি নিবিড়ভাবে সে কাজটি করে যাচ্ছে। আর সেকারণেই আস্তে আস্তে নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন মামা-ভাগ্নের নির্বাচনে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। উপজেলা নির্বাচন তার সর্বশেষ প্রমাণ। আর নির্বাচন গুরুত্বহীন হলেই অগণতান্ত্রিক শাক্তি সুযোগ পায়। অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণের পায়তারা করে। বিএনপি হয়তো গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এরকম একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই তৃতীয় পক্ষের হয়ে কাজ করছে। সব নির্বাচনকে তারা তামাশা বানানোর চেষ্টা করছে। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন