গবেষণা
জালিয়াতি, গবেষণা চুরি, গবেষণা নকল, প্লাগিয়ারিজম এবং চন্দ্ররেণুবিদ্যা নিয়ে সম্প্রতিকালে ব্যাপক আড়োলন সৃষ্টি হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। এসব শব্দ/প্রত্যয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা পেরিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী -অভিভাবক -শিক্ষকের আলোচনায় স্থান পেয়েছে। আমরা জেনেছি, বরেণ্য অধ্যাপক জাফর ইকবালের রচনায় ও সম্পাদনায় প্রকাশিত
৭ম শ্রেণীর বিজ্ঞান বইতে দুটি অনুচ্ছেদ পাওয়া গেছে যা নকল। ওই দুটি অনুচ্ছেদ
কোনো প্রকার স্বীকৃতি ছাড়া রচয়িতা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে নিয়ে লেখায় সংযুক্ত করেছেন। বিষয়টি
জনাব নাদিম মাহমুদ প্রথমআলো পত্রিকায় উপস্থাপন করেছেন। এবং
পরবর্তীতে ৭১ চ্যানেলে বিশদ
আলোচনা হয়েছে।এবং কোনো প্রকার রাখঢাক
না করে অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্বীকার করেছেন যে প্লাগিয়ারিজম হয়েছে।
এবং এই ঘটনায় তিনি
বিব্রত ও লজ্জিত।
প্রতীয়মান
হয়, এই ঘটনার পর
সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নড়েচড়ে বসেছে। অতীতে
গবেষণা জালিয়াতির বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমের নজর কেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
যখন জাল তথ্য দিয়ে পিএইচডি নেন তখন সংবাদ মাধ্যমে সাড়া পড়ে। এর
পর নজরে আসে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সামিয়া রহমানের বিষয়। যদিও তিনি আদালত থেকে অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। অন্যদিকে ৯৮
% গবেষণা চুরির বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অত্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। তারই
সূত্র ধরে বাংলাদেশ হাই কোর্ট বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে দায়িত্ব দেয় একটি নীতিমালা প্রবর্তনের জন্য।
বিগত
২২ জানুয়ারী ২০২৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একাডেমিক কাউন্সিলের বিবেচনার জন্য একটি নীতিমালা উপস্থাপন করে। সংবাদ
মাধ্যমগুলো সেখান থেকে নীতিমালার বিভিন্ন দিক নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। সেই
সূত্র ধরে আমি অনুসন্ধান করে নীতিমালার একটি কপি হাতে পাই। এবং
ওই কপিটি হাতে পেয়ে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই ৩ এর ধারা
a পড়ে। সেখানে
বলা হয়েছে-3(a)The rule shall
come into force from the date of approval by the syndicate of the university
and shall not have any retrospective effect. অর্থাৎ,
এই আইন প্রবর্তনের তারিখ থেকে কার্যকর হবে এবং আইনটির ভূতাপেক্ষ
কার্যকর বলে গণ্য হবে না। নিয়মটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট কর্তৃক অনুমোদনের তারিখ থেকে কার্যকর হবে এবং এর কোনো পূর্ববর্তী
প্রয়োগ থাকবে
না। এবং দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছে, আইনটি
ইংরেজিতে লেখা আছে -The Rule shall be
applied to address any offence /misconduct of plagiarism committed or reported
from the date of its commencement at the university. অনুবাদ করলে
এর অর্থ দাঁড়ায় -বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি( আইনটি ) শুরু হওয়ার তারিখ থেকে সংঘটিত বা রিপোর্ট করা
চুরির যে কোনো অপরাধ/অসদাচরণ মোকাবেলার জন্য নিয়মটি প্রয়োগ করা হবে। এভাবে যদি আইনটির অর্থ করা হয় তবে কি
এই আইনটিপাশের পূর্বে যে সব জালিয়াতির
ঘটনা ঘটেছে এবং সে সম্পর্কে অভিযোগ
দেয়া হয়েছে সেগুলোকে কি আমলে নেয়া
হবে না এই আইনের
আওতায় ? পাঠকদের মনে প্রশ্ন জেগেছে :যদি তাই হয় তবে কি
যিনি চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি কি ছাড়া পেয়ে
যাবেন ?
বর্তমান
নিয়ম অনুসারে একজন গবেষক তার গবেষণাপত্রে এই মর্মে ঘোষণা
দেন যে তিনি যা
লিখেছেন তা মৌলিক।
তিন আরও ঘোষণা দেন যে, তিনি এই লেখা অন্য
কোথায় কোনো ডির্গ্রীর জন্য উপস্থাপন করেননি। এবং
গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক অনুরূপভাবে সমর্থন করে কতৃপক্ষকে আশ্বস্থ করেন যে গবেষকের লেখা
মৌলিক। এসবের
মাধ্যমে গবেষণায় শুদ্ধাচার (integrity ) নীতি বাস্তবায়ন করা হয়। এবং
এই শপথ যদি কোনো গবেষক ভঙ্গ
করেন সেজন্য এই ধরণের কাজকে
একাডেমিক মিসকন্ডাক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বিষয়টি
নৈতিক স্খলন হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
গবেষণায়
চুরি একটি মারাত্মক অপরাধ একারণে যে, তিনি কেবল অন্যের লেখা বা উপাত্ত নিয়ে
নিজের দাবি করেছেন এমনটি নয় বরং তিনি
দেশ , জাতি, সংশ্লিষ্ট বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যক্তিবর্গ, এবং মানবতার সঙ্গে প্রতারণা করছেন। এখানে
তিনি সকলের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করছেন। একজন
তত্ত্বাবধায়ক/ প্রবন্ধের ক্ষেত্রে একজন রিভিউয়ার সকল শব্দের উৎস সম্পর্কে নাও জানতে পারেন।তিনি ওই গবেষককে বিশ্বাস
করেন।এবং এই বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা
সকলকেই মানসিকভাবে আঘাত করে। এবং
মানসিক এই যন্ত্রনা একজন
তত্ত্বাবধায়ক / রিভিউয়ারকে শারীরিকভাবে অসুস্থ করে।এছাড়া যেহেতু গবেষককে ডিগ্রী দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সামনে উপস্থাপন করা হয় এবং তারা
সংশ্লিষ্ট তত্তাবদায়ককে বিশ্বাস করেন।একপর্যায়ে একাডেমিক কাউন্সিল , উপাচার্য একটি মানসিক যন্ত্রণার শিকার হন। এভাবে অন্যের ক্ষতি করা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
আমরা
জানি এই ধরণের অপরাধীকে
শাস্তি দেয়ার বিধান প্রচলিত আছে। যেমন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৯৮% গবেষণা জালিয়াতির অভিযোগ আমলে নিয়ে একজন শিক্ষককে শাস্তি দিয়েছে। অন্যদিকে
আরেকটি অভিযোগ আমলে নিয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষককে শাস্তি দিয়েছে। সেই সঙ্গে অপরাধ বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক শাস্তি পেয়েছেন। তবে
আদালত থেকে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অব্যহতি পেয়েছেন। নিউজ বাংলা
সংবাদ পোর্টাল থেকে জানা যায় সহযোগী
অধ্যাপক জনাব আবুল কালাম লুৎফুল কবীর এর বিরুদ্ধে
পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভের (থিসিস) ৯৮ শতাংশই নকলের
অভিযোগ উঠেছিল । তার অভিসন্দর্ভের
নাম ছিল ‘টিউবার কিউলোসিস অ্যান্ড এইচআইভি কো-রিলেশন অ্যান্ড
কো-ইনফেকশন ইন বাংলাদেশ: অ্যান
এক্সপ্লোরেশন অব দিয়ার ইমপ্যাক্টস
অন পাবলিক হেলথ (মনিরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ৩১ আগস্ট, ২০২২
১১:৫৭)’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই গবেষককে শাস্তি দিয়েছে। এর
আগে সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের এবং কলা অনুষদের একজন শিক্ষক শাস্তি পেয়েছেন । সুতরাং, বিদ্যমান
আইনটি শাস্তির বিধানকে স্পষ্ট করেছে। তাই
মনে প্রশ্ন জাগে:এই আইনটি অতীতে
সংঘটিত ঘটনার বিচার করতে ব্যবহার করা যাবে নাকেন ?এভাবে যদি শাস্তির বিধান প্রণয়ন করা হয় তবে, অনেক
অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাবেন।
এখানে
আইনের "প্রিন্সিপাল অফ নন রেট্রোএক্টিভিটি"
কার্যকারী হতে পারেনা বলে প্রতীয়মান হয়। "প্রিন্সিপাল অফ নন রেট্রোএক্টিভিটি"
একটি অতি বিতর্কিত আইন/নীতি । এই
আইন দিয়ে পরিবেশের ক্ষতিকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দায় এড়াতে চেষ্টা করে। আমরা
জানি, কিভাবে মাগুরছড়ার পরিবেশে বিনষ্টকারী অক্সিডেন্টাল ও সেভরণকে বিচারের
আওতায় আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক
পরিমণ্ডলে "প্রিন্সিপাল অফ নন রেট্রোএক্টিভিটি"
এখন অচল। সুতরাং,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি নিয়ম করে যে, এই আইনটি রেট্রোস্পেক্টিভ
নয় তাহলে এই মুহূর্তে যেসব
অভিযোগ আছে সেগুলোর কি বিচার হবে
না ?
গবেষণা
চুরি করে যেসব শিক্ষক পদোন্নতি নিয়েছেন তারা নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন। একজন
ছাত্র তার টাকা নেই বলে কনভোকেশনে আসতে পারেনি। আমাদের
জানামতে,আর একজন শিক্ষক
গবেষণা চুরি করে পদোন্নতি নিয়ে বিগত ছয় মাস কমপক্ষে
১০ হাজার টাকা বেতন অতিরিক্ত নিচ্ছেন !এভাবে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আগামী ৩০ বছরে ( পেনশন
সহ ) প্রায় ৫০ থেকে ৬০
লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করবেন- তার কি বৈধতা পাবে
?
তার
বিচার কি হবে না
? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি এই বিচার
করবে না ? আইনটি পাঠ করে আমাদের মনে এসব প্রশ্ন মনে জেগেছে। গবেষণা চুরি করে পদোন্নতি নেওয়া রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ চুরি এবং তার বিচার না করা চুরিকে
বৈধতা দেওয়া। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আছে ভিক্ষুক, গরীব চাষী, ভূমিহীন, গৃহহীন, অসহায় বিধবা, পাথর ভাঙা শিশুর কষ্ট, খেটে খাওয়া মজুরের পানি করা রক্ত-ঘাম।
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় যে আইন প্রস্তাব
করেছে তার ৫.২ ধারার
a এবং b তে বলা হয়েছে
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভান্ডারে রক্ষিত অপ্রকাশিত থিসিস বা অনুরূপ কর্ম
চন্দ্র রেণু বিদ্যা (চোর্য বৃত্তির )র অভিযোগ আনা
যাবে না বা আওতা
মুক্ত থাকবে। এখানে
আরও বলা হয়েছে,ভান্ডারে রক্ষিত সবওইথিসিস থেকে যেসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোও আওতা মুক্ত থাকবে। এর অর্থ দাঁড়ায় জাহাঙ্গীরনগর
বা অক্সফর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী করে আসা একজন
শিক্ষক গবেষণা জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী করে যিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছেন এমন একজন শিক্ষককের বিচার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
করতে পারবে না। এবং
এই ধারাগুলো কি বর্তমানে যাদের
বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদেরকে অব্যহতি দিচ্ছে ? তাহলে কি তারা আগামী
২০ থেকে ৩৫ বছর রাষ্ট্রীয়
কোষাগার থেকে অবৈধভাবে বেতন নিতে পারবে ? এভাবেই কি রাষ্ট্রীয় কোষাগার
থেকে ভিক্ষুক,
গরীব চাষী, ভূমিহীন, গৃহহীন, অসহায় বিধবা, পাথর ভাঙা শিশুর কষ্ট, খেটে খাওয়া মজুরের পানি করা রক্ত-ঘাম থেকে অর্জিত টাকা লুটপাট চলবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতির বিবেক বলা হয়। এবং সেজন্য একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে গর্ব বোধ করি। সুতরাং, জাগরণের প্রত্যাশায় জাতি অপেক্ষায়। আশা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওই অভিযোগুলোর বিচার করবে এবং আগামীতে যদি কোনো গবেষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তবে তার তদন্ত করে ন্যায় বিচার করবে। প্রস্তাবিত আইনটির উপরোক্ত ধারাগুলো বাদে পুরো আইনটি অনেক ভালো একটি আইন। সেজন্য সকলে প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। আশা করি আইনটি পাশের আগে উত্থাপিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে জাতির বাতিঘর বিতাড়িত হবে দুর্বৃত্ত। জাতি হাসবে ন্যায় বিচারের আলোতে আলোকিত বিশ্ববিদ্যালয় পেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমাদের অনুরোধ আপনারা উত্থাপিত বিষয়গুলোকে বিবেচনা নেবেন যাতে আমরা আগামীতে লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পাই।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৩:৩৫ পিএম, ০৩ জুন, ২০২৩
মন্তব্য করুন
তখন ছিল স্বৈরাচারী জিয়ার শাসন আমল। আমি তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। আমরা কলেজের অধ্যক্ষের অনৈতিক আচরণের কারনে তার অপসারণের জন্য ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলাম। এক কলেজ ছাত্রের পরিবারের একজন সদস্য কলেজের অধ্যক্ষের বাসায় ফোন করে (যেহেতু হোস্টেলে কোনো টেলিফোনের সুবিধা ছিল না) তাকে অনুরোধ করে ছাত্রটিকে তার বাবার মৃত্যুর খবর জানাতে এবং তাকে অবিলম্বে বাড়িতে আসতে বলার অনুরোধ করার জন্য। অধ্যক্ষ গভীর রাতে তাকে ফোন করে বিরক্ত করার জন্য সেই পরিবারের লোকটির সাথে খুব খারাপ আচরণ করেন এবং তিনি ছাত্রকে কিছু জানাননি। ছাত্রটি কয়েকদিন পরে তার বাবার মৃত্যুর খবরের তথ্য পায় এবং তার বাবাকে শেষ বারের মত বিদায় জানাতে সময় মত বাড়ি যেতে পারেনি। ধর্মঘট চলতে থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রী আমাদের তার সাথ আলোচনা করার জন্য ঢাকায় আসতে বলেন। আমি প্রতিনিধিদলের একজন ছিলাম। ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং ডাঃ মতিন উপমন্ত্রী ছিলেন। সচিবালয়ে আমরা মন্ত্রীর সাথে আলোচনা করার সময় আমাদের দাবি সম্পর্কে মন্ত্রীকে অবহিত করি। মন্ত্রী আমাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনেন এবং আমাদের দাবিতে প্রায় একমত হন এবং আমাদের বললেন স্বাস্থ্য সচিবের সাথে দেখা করতে। এরপর আমরা স্বাস্থ্য সচিবের দপ্তরে যাই। অফিসের বাইরে আনেক সময় অপেক্ষা করার পর সচিব আমাদের ভিতরে ডাকলেন। তিনি আমাদের বসতে বললেন এবং ইংরেজিতে বললেন, "হ্যাঁ, তরুণরা, আমি তোমাদের জন্য কি করতে পারি (Young men what can I do for you all)"? আমরা তাকে মন্ত্রীর সাথে আমাদের আলোচনার বিষয়ে অবহিত করি এবং আমাদের চাহিদার তালিকা তাকে দেই। সচিব তখন জিজ্ঞাসা করলেন, “মন্ত্রী কি এ বিষয়ে তার মতামতের কোনো কাগজে স্বাক্ষর করেছেন?”। আমাদের কাছে এমন কোনো কাগজ ছিল না। তারপর সেক্রেটারি শান্তভাবে আমাদের মুখে উপর তার বুড়ো আঙুল নাড়তে নাড়তে বললেন: “তরুণরা, তোমরা তোমাদের কলেজে ফিরে যাও, লেখা পড়া করো, কারণ আমি কোনো স্বাক্ষরিত কাগজ ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেব না”। ওখানেই আমাদের আলোচনার সমাপ্তি এবং তিনি আমাদেরকে তার অফিস ছেড়ে যেতে বললেন। আমরা বুঝতে পারলাম রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রীরা অনেক কিছু বলতে পারেন বা একমত হতে পারেন তবে কেবল প্রশাসনই তা বাস্তবে কার্যকর করতে পরেন। হাড়ে হাড়ে বুঝলাম, রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রীদের কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। আমি এখন তাই লক্ষ্য করছি, প্রধানমন্ত্রী দেশ বা জনগণের স্বার্থে অনেক ভালো কিছু করার নির্দেশ দেন, কিন্তু প্রশাসন বা আমলারা হয় প্রক্রিয়াটি নানাভাবে বিলম্বিত করে বা অনুসরণ করে না। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে একা সময়মতো তার নির্দেশাবলীর তত্ত্বাবধান বা পর্যবেক্ষণ করা মানবিকভাবে সম্ভব নয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশে তাই হচ্ছে। অন্য কথায় সহজ ভাবে বলা যায় সত্যিকার অর্থে আমলারাই দেশ চালান। আমরা স্বাধীনতার পর আরো দেখেছি তিন তিনবার বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে।
আমার নিবন্ধের আসল বিষয়ে ফিরে আসা যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা আর প্রশাসনিক ক্যাডার, ব্যবসায়ী মালিক (বা তাদের পরিবারের সদস্যদের) যারা আগামী নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার সাহস করবে বা করবে তাদের ভিসা প্রদান বা অস্বীকার করার জন্য কিছু ধারা আরোপ করেছে বা হুমকি দিয়েছে। বিশ্বের একটি সার্বভৌম ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে আমেরিকার অধিকার আছে তারা কাকে ভিসা দিতে চায় বা না দিতে চায়। এতে কারো কোনো আপত্তি নেই বরং আমেরিকার এই শুভ ইচ্ছাকে স্বাগত জানানো উচিত। কিন্তু তবুও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে কূটনৈতিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে তারা ক্রমাগত উচ্চস্বরে কথা বলে আসছে। তারা নির্বাচন কমিশনেও গেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে তার সফরের সময় বারবার বলেছেন যে তিনি নিশ্চিত করবেন ২০২৩/২৪ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং তিনি ভোটের মাধ্যমে জনগণ যেন তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে তা নিশ্চিত করবেন। তাহলে নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? কেন হঠাৎ করে বাংলাদেশ? বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য কেন এটি প্রযোজ্য করা নয়? মিশরের সামরিক শাসক দ্বারা নির্বাচনের সময়ের আগে তো আমরা সেই হুমকি দেখিনি? ১৯৭৫ সালের “হা” “না” নির্বাচন বা পরবর্তী নির্বাচনের আগে কেন তা আরোপ করা হলো না? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, আমেরিকা বিশ্বাস করে যে গত দুটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, সেজন্য তারা এই হুমকি দিয়ে আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে? সত্যিই কি তাই??!! এর মানে কি বাংলাদেশের নাগরিকদের নিজেদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্যদের নির্দেশ বা হুমকির প্রয়োজন? নির্বাচনের সুষ্ঠুতা পর্যবেক্ষণে নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাতে কোন বাঁধা নেই, তবে কেন ভিসাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একটি সার্বভৌম দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে? আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং এখনও অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল তাই আমরা কি আজ এই হুমকির সম্মুখীন? আমরা একবার ঔপনিবেশিক ক্ষমতার অধীনে ছিলাম প্রতিবারই কি আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে?
বাংলাদেশের কত শতাংশ এবং কাদের আমেরিকার ভিসা প্রয়োজন? সর্বোচ্চ ১-২% বাংলাদেশিদের? তাদের মধ্যে কত শতাংশ রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের কর্মকর্তা বা ব্যবসার মালিক? আমরা জানি অনেক উচ্চ বর্তমান বা অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় বিভিন্ন নিরাপত্তার কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়িক ব্যক্তিদের বাড়ি, গ্রিন কার্ড, বিশাল ব্যাংক আমানত আমেরিকায় আছে এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা সেখানে শিক্ষার জন্য যান বা সেখানে বসবাস করছেন। বা যারা বাংলাদেশে ব্যবসা করেন কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বার বার যান বা থাকেন এবং সেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা করেন। ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুদান প্রদান করে। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের ভবিষ্যতের জন্য আরও প্রশিক্ষণের জন্য সেখানে যেতে চান। আমেরিকান ভিসা এই লোকদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যারা আসলে দেশ চালান বা জাতীয় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তা বজায় রাখেন। বা রাজনৈতিক এজেন্ডায় প্রভাব বিস্তার করেন। অনেক শাসক বা প্রাক্তন রাজনীতিবিদদেরও একই কারণে আমেরিকান ভিসা প্রয়োজন। ভিসা বিধিনিষেধের এই অস্ত্রের কারণে এই দলগুলো সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন। অন্যান্য অনেক বাংলাদেশিরা সেখানে উন্নত জীবন ও আয়ের জন্য আছেন। তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত নন এবং তাদের এই হুমকির ভয় পাওয়ার কারণ নেই। অন্যদিকে ৯৬-৯৪% বাংলাদেশি মানুষ আমেরিকান ভিসা নিয়ে চিন্তা করেন না বা তাদের ভিসার অনুরোধ করার কোনো কারণ নেই (অনেকে এখনও উন্নত জীবন, শিক্ষা বা অর্থনৈতিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান এবং তাদের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা নেই)। তাই আমরা বলতে পারি ভিসার হুমকির কারণে ওই গুটি কিছু স্বার্থান্বেষী লোক আমেরিকার হুকুম মানতে এমনকি বাংলাদেশের স্বার্থ ও তার ভাবমূর্তি বলিদান দিতেও যা কিছু করা তাই করবে। সংবিধান অনুযায়ী এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে ২০০১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমরা ২০০১ সালের সেই নির্বাচনের কথা ভুলে যাইনি। আরেকটা বিষয়, কাউকে ভিসা প্রত্যাখ্যান করার কারণগুলি প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয় না, তাই আমরা কখনও জানবো না কাকে এবং কী কারণে ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হবে। তাই এই ভিসার হুমকিকে যদি অস্ত্র হিসেবে না দেখা হয়, একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা বলা না হয় , আমি জানি না এটি অন্যথায় কীভাবে দেখা যেতে পারে!! গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য সৎ ইচ্ছা আর একটি সৎ প্রচেষ্টা??!! অতীত ইতিহাস বিশ্লেষণ করে, আমরা দীর্ঘ দীর্ঘ সময়, ঘন্টার পর ঘন্টা তা নিয়ে কথা বলতে পারি!!
কিন্তু আমি লজ্জিত বোধ করি রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়া এই ভিসা বিধিনিষেধ নিয়ে নানা ভাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার এবং সম্মানকে ক্ষুণ্ন করছে দেখে। ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতা বা বর্তমান সরকারকে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কিছু রাজনীতিবিদ, মিডিয়া এবং ব্যক্তিত্ব এই হুমকি উল্লসিতভাবে প্রচার করছেন। কিছু আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে ছুটে যেতে দেখে আমিও লজ্জিত হয়েছি, কারণ তাদের জানা ছিল সেখানে নাস্তা বা রাতের খাবার বা গল্প করার জন্য ডাকা হয়নি, ভিসার সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করার বা হুমকির কথা বলার জন্য তাদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ চালান না, তিনি তার নিজ দেশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই সম্পূর্ণ সম্মানের সাথে রাষ্ট্রদূতের উচিত ছিল নিজে বা তার প্রতিনিধির প্রতিটি দলের সদর দফতরে ব্যাখ্যার জন্য যাওয়া। আমি একজন আওয়ামী লীগ সদস্য যিনি বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন তাকে একটি টিভি টকশোতে বলতে শুনেছি, তিনি বললেন তিনি সেখানে গিয়েছিলেন কারণ তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বলে (যেন সাংস্কৃতিকভাবে আমরা কোনও আমন্ত্রণ অস্বীকার করার মত অভদ্র জাতী না)? বন্ধুত্বপূর্ণ ডিনারের জন্য? তিনি ভালো ভাবেই জানতেন কি আলোচনা করা হবে, তবুও কেন গেলেন সেখানে? মার্কিন রাষ্ট্রদূত গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে। এটাই নিয়ম, যদি আমরা সত্যিই আমাদের নিজেদেরকে বিশ্বাস করি এবং সামান্যতম আত্মসম্মানবোধ করি। আমিও আরো অবাক হই ভিসার হুমকি নিয়ে এত কথা বলা শুনে বা তোলপার দেখে? আমরা যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবকিছু করি তাহলে আমাদের কেন মাথা ঘামাতে হবে। আমরা কি ভয় পাচ্ছি যে কেউ শাসন/শাসক পরিবর্তনের হুমকি দিচ্ছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সুবিধার জন্য তারা যা করতে চায় তাকে তা করতে দিন। আসুন আমরা আমাদের বিষয়গুলি নিজেরাই মোকাবেলা করার সাহস করি।
আমি জানি বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েকটি ধনী দেশের ভালো ইচ্ছার উপর নির্ভর করে কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমাদের নতজানু হয়ে ভিক্ষা করতে হবে। স্বাধীনতার জন্য হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবন দিয়েছিল, হাজার হাজার নাড়ীর লজ্জা হরন করা হয়েছিল। আমরা সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছি স্বাধীনতার অর্জন করে, বুক উচু করে এবং সম্মানের সাথে বাঁচার জন্য। তাই বাংলাদেশকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সার্বভৌম এবং সম্মানিত করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। আজ কেন আমরা দেখতে পাচ্ছি শক্তিশালী দেশগুলো, যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলেছিল বা ক্ষুধা, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বলেছিল তারা আজ বাংলাদেশে আসছে, বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছে, সমর্থনের পাশাপাশি হুমকি প্রদান করছে, বাংলাদেশকে তাদের নিজ নিজ ক্ষমতার বৃত্তে আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে? কারন আজ বাংলাদেশ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে ভূ-রাজনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে।? তাই তারা কি ভাবছে, প্রধানমন্ত্রী খুব স্বাধীনচেতা হয়ে গেছেন, অন্যের দ্বারা অযথা হস্তক্ষেপ এবং আধিপত্যের বিরুধে হুমকি বা বাধা হয়ে দাডিয়েছে? প্রধানমন্ত্রী একা বাংলাদেশ কে আরো এগিয়ে নিতে পারবেন না, তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে তার সম্মানিত দলীয় সদস্য, নেতা ও আমলাদের প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের। আসুন আত্মসম্মান বজায় রাখি এবং আমাদের নিজেদের শক্তিতে বিশ্বাস রাখি, আমেরিকান ভিসা পাই বা না পাই।
আমি স্বীকার করি অনেকেই বলবেন বিদেশে বসবাস করে অনেক কিছু বলা যায় কিন্তু ঘরে বসে তা সব সময় সহজ নয়। আমি শ্রদ্ধার সাথে বলতে চাই আমি আপনার সাথে শতভাগে একমত।
Prof Dr Quazi Monirul Islam, MBBS, MPH, FRCOG
Epidemiology Department, Prince of Songkla University, Hat Yai, Thailand
Senior Specialist, International Centre for Migration, Health and Development
Former Senior Specialist (Maternal and Newborn), Liverpool School of Tropical Medicine, UK
Former WHO Director and Country Representative to Thailand and Namibia
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আমেরিকা আমার 'খুউব' পছন্দের দেশ। পছন্দের অন্যতম কারণ হলো, সে দেশের পররাষ্ট্র অনুষদের কর্মকান্ড। দেশটি তাদের নাগরিকদের খুব ভালোবাসে। তাদের নিরাপত্তায় সর্বদা উদ্বিগ্ন। নাগরিক বিদেশে গেলে সে দেশে কোথায় যাবে না যাবে, কোথায় নিরাপদ, কোথায় ঝুঁকিপূর্ণ, কেমন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তার একটি দিক নির্দেশনা সময়ে সময়ে দিয়ে থাকে। এমন নির্দেশনা সরকার তাদের নাগরিকদের দিলে সে নাগরিকের গর্ববোধ করা উচিত। সে জন্যই দেশটিকে 'খুউব' পছন্দ করি।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস গত ২১ মে সে দেশের নাগরিকদের জন্য একটি ভ্রমণ সতর্কবার্তা জারি করেছে। সতর্কবার্তার নাম দিয়েছে ‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’। বার্তায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক সভা সমাবেশ বাড়তে পারে। বিক্ষোভ হতে পারে। বিক্ষোভের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। সে দেশের নাগরিকদের বড় সমাবেশ ও বিক্ষোভের স্থানগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পরিকল্পনা পর্যালোচনা করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’টি যখন দেয়া হয়, তখন দেশের রাজনীতির আকাশে সংঘাত, সহিংসতা বা বিক্ষোভের কোন ঘনঘটা ছিল না। কিন্তু তার দুদিন পর রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে যে তুলকালাম ঘটে গেল তাতে অনুমেয় যে দূতাবাস একেবারে মোক্ষম সময়ে সতর্ক বার্তা জারি করেছে। তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতার তারিফ করতে হয়। দেশটির জনগণের প্রতি তাদের সরকার যে মায়া মমতা ও উদ্বিগ্নতা, সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা, সেটি আজকের বিষয়বস্তু নয়। কোন দেশে এ ধরণের বা এর চেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি হলে আমাদের দূতাবাসগুলোর ভূমিকা বা নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। প্রায় সোয়া কোটি দেশি রেমিটেন্স যোদ্ধা রয়েছে বিদেশে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী যাচ্ছে বিদেশ ভ্রমণে। প্রতিনিয়ত সংঘাত, সহিংসতা, বিক্ষোভ চলছে দেশে দেশে। কখনো শুনি না যে দেশি দূতাবাস গুলো এ ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো এ ব্যাপারে সর্বদাই নিষ্ক্রিয়।
ফিরে যাই মার্কিন মুলুকে। সেখানে বন্দুক সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত ৩২ বছরে দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১ লাখের বেশি মানুষ। ২০২১ সালে বন্দুকের গুলিতে মারা গেছে প্রায় ৪৯ হাজার, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সার্বোচ্চ। আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে ৫২টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ৯৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে, আহত ২০৫। গত ফেব্রুয়ারিতে সেদেশে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি, নিহত ৪৬, আহত ১৫০। গত মার্চে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি, নিহত ৫৬, আহত ১৩৬। গত এপ্রিলে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৫৬টি। এসব ঘটনায় নিহত ৬২, আহত ২৪৪। এপ্রিলের শেষ দিনে ১১টি ঘটনা ঘটেছে। ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’ নামের একটি গবেষণা সংস্থার ওয়েবসাইটে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত 'গান পলিসি' নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে বাংলাদেশে বন্দুক হামলায় মারা যায় দেড় হাজার জন। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে মারা যায় সাড়ে ২৮ হাজার জন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা বাংলাদেশের দ্বিগুন। জনসংখ্যা অনুপাতে সেদেশে বন্দুক হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে দশগুণ বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে এসব বন্দুক হামলার সংঘাতের ঘটনাস্থল সর্বত্র। শপিংমল, পার্ক, স্কুল, হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার, রেল স্টেশন, ব্যাংক থেকে শুরু করে জন্মদিনের অনুষ্ঠান, মেমোরিয়াল ডে’র অনুষ্ঠানস্থল, স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান যেখানে প্রতিনিয়ত বন্দুক হামলা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বাংলাদেশী বাস করে, বেড়াতে যায়, কাজে যায়, সভা-সেমিনারে যায়। আমেরিকার ভিসা দপ্তরের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশী নন ইমিগ্রান্ট ভিসা পেয়েছে। তার মানে, গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশী যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যায়। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার বাংলাদেশি ছাত্র ছাত্রী সেখানে পড়াশুনা করে । এসব প্রবাসী বাংলাদেশী ছাত্র বা টুরিস্টদের প্রতি বাংলাদেশী দূতাবাসের কি কোন দয়া মায়া নেই ? উদ্বিগ্নতা নেই ? তারাও তো পারে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান বন্দুক হামলার প্রেক্ষিতে সময়ে সময়ে আমাদেরকে সতর্কবার্তা দিতে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশী দূতাবাস যুগ যুগ ধরে এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে যাচ্ছে। নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক সংকেত দিচ্ছে না। শপিংমল, রেল স্টেশন, ব্যাংক, হাসপাতাল, স্কুল, পার্ক ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থান এড়িয়ে চলার বা সাবধানে চলার পরামর্শ দিচ্ছে না। কিন্তু কেন ? দেশের নাগরিকদের প্রতি তাদের কি কোন দায়িত্ববোধ নেই?
এ বি এম কামরুল হাসান
প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা আর প্রশাসনিক ক্যাডার, ব্যবসায়ী মালিক (বা তাদের পরিবারের সদস্যদের) যারা আগামী নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার সাহস করবে বা করবে তাদের ভিসা প্রদান বা অস্বীকার করার জন্য কিছু ধারা আরোপ করেছে বা হুমকি দিয়েছে। বিশ্বের একটি সার্বভৌম ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে আমেরিকার অধিকার আছে তারা কাকে ভিসা দিতে চায় বা না দিতে চায়। এতে কারো কোনো আপত্তি নেই বরং আমেরিকার এই শুভ ইচ্ছাকে স্বাগত জানানো উচিত। কিন্তু তবুও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে কূটনৈতিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে তারা ক্রমাগত উচ্চস্বরে কথা বলে আসছে। তারা নির্বাচন কমিশনেও গেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে তার সফরের সময় বারবার বলেছেন যে তিনি নিশ্চিত করবেন ২০২৩/২৪ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং তিনি ভোটের মাধ্যমে জনগণ যেন তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে তা নিশ্চিত করবেন। তাহলে নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো?
" মনোযোগ বলতে নির্দিষ্ট একটা বিষয়কে ফোকাস করাকে বুঝায় না, একই সাথে এটা অসংখ্য প্রতিযোগী তথ্য এবং উদ্দীপককে অগ্রাহ্য করাকেও বুঝায়। যা এ মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক নয় সেটাকে এড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রতি আকর্ষিত হওয়াই মনোযোগ ( Kendra Cherry, 2022)। কোন পণ্যকে ভোক্তা কিভাবে মূল্যায়ন করবে সেটা অনেকাংশেই তাঁর প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করে। মনোযোগ হচ্ছে প্রত্যক্ষনের একটি পূর্বশর্ত। কোন নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রীয় সমূহকে নিবদ্ধ করার নামই হলো মনোযোগ। যে মানসিক ক্রিয়ার মাধ্যমে একাধিক বিষয় থেকে চেতনাকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে একটি বিশেষ বিষয়ে চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করা হয় তাকে মনোযোগ বলে।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস গত ২১ মে সে দেশের নাগরিকদের জন্য একটি ভ্রমণ সতর্কবার্তা জারি করেছে। সতর্কবার্তার নাম দিয়েছে ‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’। বার্তায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক সভা সমাবেশ বাড়তে পারে। বিক্ষোভ হতে পারে। বিক্ষোভের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। সে দেশের নাগরিকদের বড় সমাবেশ ও বিক্ষোভের স্থানগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পরিকল্পনা পর্যালোচনা করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
আমেরিকার South Asia Perspectives পত্রিকায় ২৮ মে(২০২৩) প্রকাশিত মিথ্যাচারে পূর্ণ Jon Danilowicz এর U.S. Visa Policy: What Next? শিরোনামে লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লে দেখা যাবে এক সময়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এই সাবেক কর্মকর্তা কী কৌশলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মনগড়া তথ্য দিয়ে বিরোধী শিবিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।তিনি যেভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো তুলে ধরেছেন এবং বিএনপি-জামায়াতের অপতৎপরতাকে এড়িয়ে গেছেন তা সৎ লেখকের কাজ নয়। তিনি যেন কোনো লবিস্ট কর্তৃক নিযুক্ত লেখক। যার নুন খান তার গুণগান করেন। এ ধারার জন ড্যানিলভিচ মার্কা লেখক ও বক্তারা পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্রের কথা ব্যক্ত করার পরিবর্তে মিথ্যাভাষণে সরকার বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। এদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।