বাংলাদেশের
সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। বিএনপির হাতেগোনা কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েক মাস
আগেই। বিরোধী দল বলতে জাতীয়
পার্টি। আশার কথা, সম্প্রতি
জাতীয় পার্টি সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে সংসদে
ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। যার
একঝলক দেখা গেল ২৬
জুন সোমবার জাতীয় সংসদে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে এক ছোট
ঝড় বয়ে গেল সংসদে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ হলো আলোচনার
প্রাণকেন্দ্র। এখানে যত বিতর্ক হবে,
যত সরকারের সমালোচনা হবে, ততই গণতন্ত্র
সংহত হবে। বিরোধী দলের
সমালোচনার ভিত্তিতে সরকার নিজেদের পরিবর্তন করবে, সংশোধন করবে। এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের
সৌন্দর্য। সংসদীয় গণতন্ত্র একটি প্রাণবন্ত শাসন
পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সংসদের
আস্থাভাজন নেতা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে
শপথ গ্রহণ করেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী
মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রীদের
স্থায়িত্ব নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের
ওপর। সংসদীয় ব্যবস্থায় মন্ত্রীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা নির্বাহী বিভাগ
এবং জনপ্রতিনিধিদের যোগসূত্র। একদিকে যেমন তাদের কাজকর্মের
জন্য নির্বাহী প্রধানের (প্রধানমন্ত্রী) কাছে জবাবদিহি করতে
হয়; অন্যদিকে মন্ত্রীরা সংসদেও জবাবদিহি করেন। একজন মন্ত্রী যদি
যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ
হন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ করতে
নির্দেশ দিতে পারেন। সংসদীয়
গণতন্ত্রের সব দেশেই এটা
হরহামেশাই ঘটে থাকে। বাংলাদেশেও
বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্য, তথ্য ও সম্প্রচার
প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে
প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিতর্কিত একটি অডিও ক্লিপ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে, এক বিব্রতকর পরিস্থিতি
তৈরি হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর
নির্দেশে মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়ান
ডা. মুরাদ। ডা. মুরাদের ব্যাপার
ছাড়া মন্ত্রিসভার রদবদল এবং অযোগ্য মন্ত্রীদের
বাদ দেওয়ার ব্যাপারে এবার প্রধানমন্ত্রী অনেক
রক্ষণশীল। তিনি মন্ত্রীদের সুযোগ
দিতে চান। তারা যেন
নিজেদের ভুল শুধরে নেন,
তার অপেক্ষা করেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে
মন্ত্রীদের ব্যর্থতা জাতির জীবনে দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভাগ্য হিসেবেই আসে। যে দুর্ভাগ্য
এখন জাতিকে বহন করতে হচ্ছে।
জাতির পিতার নির্দেশে ১৯৭৪ সালে মন্ত্রিসভা
থেকে পদত্যাগ করেছিলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তার আগে মিজানুর
রহমান চৌধুরীর মতো নেতাও এক
বিতর্কে জড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পদত্যাগ করেন। ’৭৫-এর পর
থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ছিল না। কখনো
সামরিক শাসন, কখনো স্বৈরশাসন ছিল।
মন্ত্রীরা ছিলেন একনায়কের পদলেহী ক্রীতদাস। ’৯১-এ দেশের
প্রথমবারের মতো নির্দলীয় নিরপেক্ষ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। বিএনপি নাটকীয়ভাবে
ক্ষমতায় আসে। দেশে আবার
সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু হয়। বেগম
জিয়ার শাসনামলের শেষভাগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে মন্ত্রিত্ব হারান
তৎকালীন সময়ে বিএনপির প্রভাবশালী
নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। ’৯৬ সালে দীর্ঘ
২১ বছর পর ক্ষমতায়
আসে আওয়ামী লীগ। ’৯৬ থেকে ২০০১
সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার
মন্ত্রিসভা রদবদল করেন। একাধিক মন্ত্রীকে অপসারণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া
হয়েছিল মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামকে।
পরে তিনি পদত্যাগ করেন।
পাসপোর্ট বিতর্কের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে
পদত্যাগ করেছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন।
সেই মন্ত্রিসভায় ছিলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম
তাজউদ্দীন আহমদের ছোট ভাই খান
আফসার উদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনিও পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদত্যাগ আসলে বরখাস্ত। প্রধানমন্ত্রী
নানা কারণেই একজন মন্ত্রীকে পদত্যাগের
পরামর্শ বা নির্দেশ দিতে
পারেন। তিনি যদি মনে
করেন, ওই মন্ত্রী বিতর্কিত,
অযোগ্য কিংবা দায়িত্ব পালনে অক্ষম, সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী
তাকে সরিয়ে দিতেই পারেন। দেশে দেশে হরহামেশাই
এটা হয়। তবে আত্মমর্যাদাবান,
বোধবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদরা অনেক সময় নিজেই
পদত্যাগ করেন। একজন মন্ত্রী যদি
মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে যে দায়িত্ব
দিয়েছেন, তা তিনি যথাযথভাবে
পালন করতে পারছেন না,
যদি মনে করেন তিনি
ব্যর্থ, প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতিদান দিতে পারছেন না,
তাহলে সরকারকে বিতর্কিত করার আগে নিজেই
পদত্যাগ করেন। এতে দল, সরকার
যেমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে না, তেমনি
মন্ত্রী নিজেও সম্মানিত হন। তার ইমেজ
বাড়ে। মন্ত্রীর আত্মোপলব্ধির জন্য সাধারণ মানুষ
তাকে সাধুবাদ দেয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের
সব দেশে এরকম ঘটনা
হরহামেশাই ঘটছে। দায়িত্ববান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিবিদদের জন্য এটি এক
সুবর্ণ সুযোগ। এর মাধ্যমে তারা
জনগণের কাছে নতুন ইমেজে
আবির্ভূত হন। স্বেচ্ছায় সরে
দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে বড় নজির হলেন,
ভারতের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।
ভারতের স্বাধীনতার পর নেহরুর ঘনিষ্ঠ
এ মেধাবী রাজনীতিবিদ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী মন্ত্রী
হিসেবেই তিনি পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু ১৯৫১ সালে ভারতে
এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটে।
এ দুর্ঘটনার জন্য কোনোভাবেই শাস্ত্রী
দায়ী ছিলেন না। কিন্তু দুর্ঘটনার
পরপরই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে পদত্যাগপত্র পেশ
করেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী।
পদত্যাগপত্রে শাস্ত্রী লিখেছিলেন—‘রেলমন্ত্রী হিসেবে আমি রেলের অভিভাবক।
একজন অভিভাবক কোনোভাবেই এ দুর্ঘটনার দায়
এড়াতে পারি না।’ তার
এ পদত্যাগের ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী নেহরু।
পার্লামেন্টে শাস্ত্রীর ‘সাহসী’ সিদ্ধান্তকে গণতন্ত্রের এক ‘ঐতিহাসিক মাইলফলক’
হিসেবে চিহ্নিত করেন। ভারতীয় জনগণের কাছে এ সিদ্ধান্তের
পর দেবতায় পরিণত হন শাস্ত্রী। ভারতের
গণতন্ত্র যাদের হাত ধরে আজ
এ জায়গায় এসেছে, তাদের মধ্যে শাস্ত্রী অন্যতম। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এরকম নজির মাত্র
একটিই। ’৯১ সালে বিএনপি
সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন শিল্পপতি জহির উদ্দিন খান।
বিএনপি শাসনামলে (১৯৯৩-৯৪) তীব্র
সার সংকট দেখা দেয়।
সারের দাবিতে কৃষকরা বিক্ষোভ শুরু করেন। কোথাও
কোথাও কৃষকদের ওপর গুলি চালানো
হয়। সারের দাবিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন বহু কৃষক।
দেশে সার উৎপাদন এবং
ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের।
এ ব্যর্থতার দায়িত্ব অস্বীকার করেননি জহির উদ্দিন খান।
তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এ পদত্যাগে তিনি
সম্মানিত হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এখনো একজন
ব্যতিক্রমী সজ্জন রাজনীতিবিদ হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, জহির উদ্দিন
খানের দেখানো পথ অনুসরণ করেননি
আমাদের রাজনীতিবিদরা। বাংলাদেশে মন্ত্রী হওয়াটা অধিকাংশের কাছে ‘আলাদিনের চেরাগ’ পাওয়ার মতো। খুব কম
ব্যক্তিই আছেন, যারা ভাবেন মন্ত্রী
হয়েছি, দেশের জন্য কিছু করি।
এমন কিছু করি যেন
দেশের মানুষ আজীবন আমাকে স্মরণ করে। বরং মন্ত্রিত্বকে
অনেকে মনে করেন লটারির
টিকিট, আখের গোছানোর শেষ
সুযোগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে
বিপুল জয় পায় আওয়ামী
লীগ। এক-এগারোর ক্ষত
বুকে ধারণ করে মন্ত্রিসভা
গঠনে চমক দেখান শেখ
হাসিনা। আনকোরা, নবীনদের প্রাধান্য দিয়ে সাজান মন্ত্রিসভা।
২০০৯ সালের মন্ত্রিসভায় সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু এক
ধরনের চেষ্টা ছিল ভালো কিছু
করার। প্রধানমন্ত্রীও এ সময় মন্ত্রীদের
কাজকর্মে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। দ্রব্যমূল্য
নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে
পরিবর্তন আনেন। কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে
সরিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন জাতীয় পার্টির
জি এম কাদেরকে। পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় থেকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে
নিয়ে এসে ড. হাছান
মাহমুদকে কাজ করার সুযোগ
করে দেন। ২০১৪-এর
নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের
মন্ত্রিসভায় ফিরে আসেন হেভিওয়েটরা।
২০১৮-এর নির্বাচনের পর
প্রধানমন্ত্রী আবার মন্ত্রিসভার আমূল
পরিবর্তন করেন। প্রত্যাশা ছিল নতুনরা সবকিছু
উজাড় করে কাজ করবেন।
নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করবেন। কেউ কেউ যে
করেননি তা নয়। গত
সাড়ে চার বছরে ভূমি
মন্ত্রণালয়ে অসাধারণ কাজ হয়েছে। একটি
দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়ের ইমেজ ভেঙে এ
মন্ত্রণালয় একটি জনবান্ধব মন্ত্রণালয়
হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সড়ক যোগাযোগে বাংলাদেশ
বদলে গেছে। পদ্মা সেতু আমাদের অহংকার।
মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল বাংলাদেশের উন্নয়নের একেকটি বিজ্ঞাপন। তথ্য ও সম্প্রচার
মন্ত্রণালয় কিছু যুগান্তকারী নীতি
ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিবন্ধন
এ সরকারের একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের
মন্ত্রীর হাত ধরে এক
নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ অসাধ্য সাধন করেছে। প্রশ্নপত্র
ফাঁসের বিভীষিকা থেকে জাতিকে মুক্তি
দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একরম সাফল্যগাথা কম
না। কিন্তু এসব সাফল্যের গল্প
বিবর্ণ, ফ্যাকাশে হয়ে গেছে দ্রব্যমূল্যের
অসহনীয় পরিস্থিতির কারণে। উন্নয়নের অহংকারে কলঙ্কের কালিমা লেপে দিয়েছে লোডশেডিং।
স্বাস্থ্য খাতের নৈরাজ্য সরকারের অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। হাতেগোনা পাঁচ-ছয়জন মন্ত্রীর
অযোগ্যতা, ব্যর্থতা এবং দায়িত্বহীনতা গোটা
সরকারের সব অর্জন আজ
কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। অথচ
এরা নির্বিকার। এরা যে সরকারের
কত বড় দায়, কত
ভারী বোঝা, তা অনুধাবনেরও বোধশক্তিটুকু
নেই অর্বাচীন মন্ত্রী মহোদয়দের। তাদের যে ন্যূনতম বিবেকবুদ্ধি
লোপ পেয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া
গেল ২৬ জুন সংসদে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর সিন্ডিকেট নিয়ে
সমালোচনার জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী যে জবাব দিলেন,
তাতে আমি বিস্ময়ে হতবাক।
তিনি বললেন, ‘বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো
একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা
করে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে জেল-জরিমানা
করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ক্রাইসিস
আরও বেড়ে যাবে।’ কী
আশ্চর্য কথা। তার মানে
মন্ত্রী সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়। ওইসব
মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ীর কাছে
মন্ত্রী আত্মসমর্পণ করেছেন। এই যদি হয়
পরিস্থিতি, তাহলে মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার নৈতিক অধিকার কি তিনি রাখেন?
সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন কোনো
কোনো সংসদ সদস্য। কিন্তু
মন্ত্রী বিষয়টি তামাশা মনে করেছেন বলেই
মনে হলো। পদত্যাগের দাবিকে
নিম্নমানের রসিকতা দিয়ে উড়িয়ে দিলেন।
মন্ত্রী কি জানেন, বাজার
পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। সাধারণ
মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ
হয়ে উঠেছে? আর পদত্যাগের জন্য
তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন কেন? তিনি নিজে
কেন স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়ে সরকারকে
সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা
করেন না। মন্ত্রী বলছেন,
তার রাজনৈতিক জীবন ৫২ বছরের।
তাহলে জনগণের ভাষা কি তিনি
বুঝতে অক্ষম? বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে আর লেখার
রুচি হয় না। তিনি
কী বলেন আর কী
করেন, সেটা তিনিই হয়তো
ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু
তার কারণে এ সরকার জনগণের
কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। জাতীয় সংসদে যেদিন তিনি দাঁড়িয়ে বলছিলেন,
‘সাত দিনের মধ্যে আমরা আবার নিরবচ্ছিন্ন
বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছি’—ঠিক সেদিন সারা
দেশের বিভিন্ন জেলায় চার থেকে ছয়
ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎ বিভাগ এখন আবহাওয়ার ওপর
নির্ভরশীল। বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমে।
বিদ্যুতের চাহিদা হ্রাস পায়। লোডশেডিং কমে
যায়। এ নিয়ে বিদ্যুৎ
প্রতিমন্ত্রী সাফল্যের ঢেকুর তোলেন। কী বিচিত্র। একটি
বেসরকারি হাসপাতালে এক প্রসূতি মায়ের
‘হত্যাকাণ্ড’ প্রমাণ করল স্বাস্থ্য খাতও
এখন বেসরকারি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। করোনা
মোকাবিলায় সীমাহীন ব্যর্থতার পরও এ মন্ত্রী
বহাল তবিয়তে ছিলেন, আছেন। সংসদে দেখলাম, অর্থমন্ত্রী একটা আইন কমিটিতে
পাঠানো প্রস্তাব উত্থাপন করতে গিয়েই গলদগর্ম।
একজন হুইপ এসে তাকে
পড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অর্থমন্ত্রী অসুস্থ। তার প্রতি আমাদের
সমবেদনা আছে শতভাগ। কিন্তু
তিনি কেন প্রধানমন্ত্রীকে বলেন
না, ‘আমি পারছি না।
আমার জন্য আপনার সরকার
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমি সরে যাই।’
মন্ত্রিত্বে কী মধু আমি
জানি না। একজন মন্ত্রী
হলে তিনি কিছুতেই চেয়ার
ছাড়তে চান না। চেয়ার
পরিত্যাগ যেন মৃত্যুর চেয়েও
কষ্টদায়ক। অথচ তারা পদত্যাগ
করলে দেশ বাঁচে, জনগণ
হাঁফ ছাড়ে, সরকার স্বস্তি পায়। সবচেয়ে বড়
কথা, ব্যর্থতার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যিনি পদত্যাগ
করেন, তাকেও জনগণ সম্মান দেয়।
আমাদের ব্যর্থ মন্ত্রীরা কি নিজেদের আত্মসম্মানটুকুও
রক্ষা করতে ভুলে গেছেন?
লেখক:
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আমাদের ছোটবেলার ঈদে অন্যতম আনন্দের উৎস ছিল আমজাদ হোসেনের নাটক। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম আমজাদ হোসেনের ঈদের নাটক দেখার জন্য। এই নাটকে জব্বর আলীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন আমজাদ হোসেন। একেক ঈদে জব্বর আলীর দুর্নীতির একেকটি চিত্র উঠে আসত হাস্যরসের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিটি নাটকে একটি বক্তব্য থাকত; যে বক্তব্যটি সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষণীয়। আমজাদ হোসেনের ঈদের নাটকগুলোর মধ্যে একটি ছিল আদম ব্যবসা নিয়ে। আদম পাচার এবং আদম ব্যবসায়ের আড়ালে যেভাবে মানুষকে হয়রানি এবং প্রতারণা করা হতো, তার চিত্র ফুটে উঠেছিল। সে নাটকে ফরিদ আলীর একটি উক্তি বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে ছিল ওই সংলাপটি। সংলাপটিতে ফরিদ আলী বলছিলেন, ‘টেকা দেন দুবাই যামু।’ বৃহস্পতিবার দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে দুবাইয়ে ধনকুবেরদের সম্পদের পাহাড় প্রতিবেদনটি দেখে আমজাদ হোসেনের ‘টেকা দেন দুবাই যামু’ কথাটি স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল। তখন অর্থ উপার্জনের জন্য সর্বস্ব বিক্রি করে মানুষ দুবাই যেতে চাইত। এতে দেশের উপকার হতো। এখন অর্থ পাচারের জন্য দেশকে কেউ কেউ দুবাইয়ে ঠিকানা করছে। আগে দুবাই যেতে জমি বিক্রি করে নিঃস্ব হতো একটি পরিবার। এখনকার ফরিদ আলীরা টাকা নিয়ে ব্যাংক খালি করছে। নিঃস্ব হচ্ছে দেশ। আগে দুবাই ছিল টাকা আনার জায়গা। এখন টাকা রাখার ‘নিরাপদ’ স্থান। এখন শুধু জীবিকার সন্ধানে এ দেশের মানুষ দুবাই যান না। কষ্ট করে শুধু রেমিট্যান্স পাঠান না। লুটেরা, অর্থ পাচারকারীদের ঠিকানা ইদানীং দুবাই। দুবাইয়ে এখন বিনিয়োগ করেছেন বিশ্বের ধনকুবেররা। এই চিত্রটি ফুটে উঠেছে ‘দুবাই আনলকড’ নামে বৈশ্বিক অনুসন্ধানে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে এখন আকাশচুম্বী ঐশ্বর্য, আকাশচুম্বী বিলাসিতা এবং এক রকম প্রাচুর্যে ভরপুর জীবনযাপন। একসময় এটি ছিল ধু-ধু মরুভূমি। সেই অবস্থা থেকে এটি এখন বিশ্বের আধুনিকতম শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরেকটি বড় সুবিধা হলো, এখানে অবৈধ অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হয় না। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষ বিপুল পরিমাণ সম্পদ দুবাইয়ে রাখতে চাইছেন। গোপন সম্পদের আড়ত হয়েছে দুবাই। ব্যাংকের মাধ্যমে কিংবা ব্যক্তিগত বিমানে ভরে অর্থ নিয়ে যাওয়া যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এই সুযোগে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা ব্যক্তি, অর্থ পাচারকারী এবং অপরাধীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আর এই অধিকাংশ সম্পদই অবৈধ। জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত গোপন সম্পদ। ‘দুবাই আনলকড’ নামে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি ৫৮টি দেশের ৭৪টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ছয় মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রস্তুত করেছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন, রিপোর্টিং,’ (ওসিসিআরপি) ও নরওয়ে সংবাদমাধ্যম ই-২৪-এর নেতৃত্বে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী লুণ্ঠনের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে এ প্রতিবেদনে। বিভিন্ন দেশ থেকে ধনকুবেররা কীভাবে গোপনে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তার চিত্র ফুটে উঠেছে ‘দুবাই আনলকড’-এ। দুবাইয়ে সরকারি ভূমি দপ্তরসহ অন্যান্য রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ফাঁস হওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুবাইয়ে বিদেশিদের মালিকানায় থাকা সম্পদের পরিমাণ ১৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিদেশিদের সম্পদের মালিকানার তালিকায় শীর্ষে আছে ভারতীয়রা। ২৯ হাজার ৭০০ ভারতীয় নাগরিকের ৩৫ হাজার সম্পদের মালিকানা রয়েছে দুবাইয়ে। ভারতীয়দের এসব সম্পত্তির মোট মূল্য ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। ভারতের পর এই তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান। দুবাইয়ে ১৭ হাজার পাকিস্তানি নাগরিকের ২৩ হাজার সম্পদের মালিকানা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তানের ইংরেজি ভাষার ‘দৈনিক ডন’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুবাইয়ে ১৭ হাজার পাকিস্তানি সম্পদের মালিক। তবে তথ্য-উপাত্ত ও সূত্র ব্যবহার করে এই সংখ্যা ২২ হাজারের মতো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা ছাড়াও শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার এবং আমলারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অভিজাত এলাকায় বিপুল সম্পদের মালিক। পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া প্রায় একটি রাষ্ট্র। ভয়াবহ অর্থকষ্টে দেশটির জনগণ দিশেহারা। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণহীন। রিজার্ভ শূন্য। ঋণ নিয়ে কোনোরকমে দেশটি চলছে। বিভিন্ন ঋণের দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে যার কাছে পারছে তার কাছেই হাত পাতছে দেশটি। পাকিস্তানের শোচনীয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ যে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার, তা সবারই জানা। এই প্রতিবেদন তা আরেকবার প্রমাণ করল। জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে যারা বিদেশে পাঠিয়েছে, তারাই পাকিস্তানের মসনদে।
বাংলাদেশিদেরও সম্পদ কম নয় দুবাইয়ে। ওসিসিআরপির তথ্য বলছে, এই শহরে গোপন সম্পদ গড়েছেন অন্তত ৩৯৪ জন বাংলাদেশি। এসব বাংলাদেশির মালিকানায় রয়েছে ৬৪১টি সম্পদ। বাংলাদেশিদের মালিকানায় থাকা এসব সম্পদের মোট মূল্য ২২ কোটি ৫৩ লাখ ডলারেরও বেশি, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। আমার ধারণা, দুবাইয়ে এর চেয়েও দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। অনেকে বেনামে, কেউ কেউ কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ সরিয়ে এখন দুবাইয়ে রাখছেন। শুধু দুবাই কেন? ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্যাক্স অবজারভেটরি গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অব অফশোর ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের প্রায় ৫ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের অফশোর সম্পদ আছে। এটি বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার এশিয়ার কর স্বর্গ দেশগুলোতে, বাকিটা ইউরোপ, আমেরিকায়। ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে কর স্বর্গ বলে পরিণত দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে। সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী এখানকার ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে বাংলাদেশিদের সম্পদ ও মালিকানার তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি এসব কোনো প্রতিবেদনে। তাদের পরিচয় গোপন করা হলেও আমরা তাদের চিনি। কারা ব্যাংকের টাকা লুট করে দুবাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, আমাদের অজানা নয়। কোন দুর্নীতিবাজরা বিদেশে দুর্নীতির টাকা গচ্ছিত রেখেছে, সে চর্চা এখন সর্বত্রই হয়। তাদের কারণেই যে অর্থনীতির সংকট, তা কে না জানে? বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন আশঙ্কাজনক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। অথচ পাচারকৃত অর্থ যোগ করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকত ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এক ধাপে ডলারের মূল্য ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। ডলার নিয়ে এখন হাহাকার। ডলারের অভাবে আমদানি করা যাচ্ছে না অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। রপ্তানিতেও শুভঙ্করের ফাঁকি। রপ্তানি আয়ের টাকা কাগজে আছে, ব্যাংকে নেই। ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সে উদ্যোগও এখন হালে পানি পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, আর্থিক সংকটে ধুঁকছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকে সুদসীমা উঠিয়ে দেওয়ার পর এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। ভুল নীতি এবং ভুল পরিকল্পনার কারণে মুদ্রাস্ফীতি এখন ১০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে। এসব কিছুর প্রধান কারণ হিসেবে আমি মনে করি, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার এবং দুর্নীতি। এই তিনটি বিষয়ে যদি সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তা হলে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে তোলা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে যাবে। যেভাবে পাকিস্তানের অর্থনীতি ডুবেছে, সেভাবে কি বাংলাদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানোর ষড়যন্ত্র চলছে? এখন পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি এবং অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। বিপুল বিস্ময়কর উন্নয়নকে ম্লান করে দিয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু লুটেরা দুর্বৃত্ত।
গত তিন-চার বছরে অর্থ পাচারের নতুন ঠিকানা হয়েছে দুবাই। আগে যারা বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করেছেন, তাদের মূল ঠিকানা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড। অনেকে এসব দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে সেই দেশে শীর্ষ ধনীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। তারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন দুবাইয়ের প্রতি অর্থ পাচারকারীদের আগ্রহ বেড়েছে। এর কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে বেশ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ কারণেই সেসব দেশে নতুন করে অর্থ পাচার কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা সুইস ব্যাংকে যেসব অর্থ পাচারকারী অর্থ পাচার করেছে তাদের তথ্য জানি না। এ তথ্যগুলো সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের অবস্থান গ্রহণ করেছে, সে সম্পর্কেও আমরা অন্ধকারে রয়েছি। আমরা জানি না যে, ‘ট্যাক্স হেভেন’ বলে পরিচিত দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে যারা কোম্পানি খুলে অর্থ পাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ওসিসিআরপি এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেই তথ্যের তদন্ত হয়নি। আমরা এটাও জানি না যে, বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ী রপ্তানির নামে ‘ওভার ইনভয়েসিং’-এর মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা জানি না কানাডার বেগমপাড়ায় যাদের বাড়িঘর আছে তাদের তালিকা কার কাছে। এই তালিকা প্রকাশের জন্য কয়েক বছর ধরেই হৈচৈ হয়েছে, আলোচনা হয়েছে; কিন্তু তালিকা আলোর মুখ দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় যারা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তারা কারা?
অর্থ পাচার রোধে সরকারের গ্রহণ করা ব্যবস্থাগুলো কতটুকু বাস্তবে রূপ নিয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সরকার অর্থ পাচার রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পেরেছে কি না, তা নিয়েও অনেকের মধ্যে সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে। গত বছর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকটের কারণে অর্থ পাচারকারীদের থেকে অর্থ ফেরত নেওয়ার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সরকার। বিদেশ থেকে অর্থ নিয়ে এলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না—এমন দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরও অর্থ পাচারকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। একটি ডলারও পাচারকারীরা দেশে ফিরিয়ে আনেনি। কানাডা, যুক্তরাজ্য, আমেরিকার কথা বাদই দিলাম; মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ করা বাঙালির সংখ্যা হাজারের ওপর। সিঙ্গাপুরে অলিগলিতে বাঙালিদের বিভিন্ন সম্পদ পাওয়া যায়। অর্থ পাচার যদি বন্ধ না হয়, তা হলে অর্থনৈতিক সংকট কাটানো যাবে না। দুর্নীতি যদি বন্ধ না করা যায়, তা হলে অর্থনীতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। আমরা যদি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে না পারি, তা হলে অর্থনীতির ধ্বংস ঠেকানো অসম্ভব। দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং লুণ্ঠনে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা ছিলেন, তারা যেভাবে দুর্নীতি করে দেশকে ফোকলা বানিয়েছেন, বাংলাদেশ তার থেকে অনেক পেছনে। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে, যেভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে বাংলাদেশ পাকিস্তান হতে বাধ্য। আমরা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চাই? যারা বাংলাদেশ চায়নি তারাই অর্থনীতির বারোটা বাজাচ্ছে। আমজাদ হোসেনের ফরিদ আলী ‘টেকা’ নিয়ে বিদেশ যেতে চেয়েছিল। নিজের ভাগ্য গড়তে চেয়েছিল। সেখান থেকে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠানোর স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু এখনকার নব্য ফরিদ আলীরা ব্যাংক খালি করে, জনগণের সম্পদ লুট করে দুবাই যাচ্ছে। এই ফরিদ আলীদের রুখতে হবে। তাদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে অর্থনীতি, বাংলাদেশকে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
সুশীল ডোনাল্ড লু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বদিউল আলম মজুমদার আদিলুর রহমান খান
মন্তব্য করুন
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চীন সফর ভারত যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য করুন
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।
গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। তার আগে একটা রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে ২ হাজার ৬০০ কাউন্সিলরের মধ্যে দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি পেয়েছে ১ হাজার ৬১টি পদ। অন্যদিকে ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ৫০৪টি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়ে দলগতভাবে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। নির্বাচনে দ্বিতীয় হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। ৪০ বছরের ইতিহাসে এটি কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা যে ভীষণ নড়বড়ে, তা এই নির্বাচনেই প্রমাণ হয়েছে। নির্বাচনের পর পার্লামেন্ট নির্বাচনে কনজারভেটিভদের ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা না বলা গেলেও কনজারভেটিভ পার্টি যে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, সেটি হলফ করে বলা যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ বছর নভেম্বরে। এই নির্বাচনে জো বাইডেনের অবস্থা তথৈবচ। জো বাইডেনকে কোনো জনমত জরিপেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। আইনি মারপ্যাঁচ, যৌন কেলেঙ্কারি ডেমোক্রেটদের নানামুখী বাধা ইত্যাদি নানা সংকট থেকে মুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আবার প্রার্থী হওয়া ট্রাম্পের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না সেটি যেমন প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো যে, জো বাইডেন এই নির্বাচনে কি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ এবং ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে জ্ঞান দেয়, মানবাধিকার চর্চার জন্য শাসন করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এখন মানবাধিকার সংকটে। গাজায় ইসরায়েলের তাণ্ডবের প্রতিবাদে মার্কিন তারুণ্যের গণবিস্ফোরণ পুরো বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এই গণবিস্ফোরণকে ঠেকাতে যেভাবে জো বাইডেন সরকার দমন নীতি গ্রহণ করেছে, তা তাকে সবচেয়ে কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে গেছে। জনগণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশ্বাস করছে না, জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তিনি এখন তলানিতে অবস্থান করছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিজয়ী হয়েছিলেন অনেক লড়াই করে। বিজয়ের পর জনগণ তার পক্ষে কতটুকু আছে বা জনগণের মনোভাব কী, তা যাচাইয়ের একটি উপায় ছিল গত মার্চের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দলের শোচনীয় ভরাডুবি ঘটেছে। তিনি বড় শহরগুলোতে মেয়র পদে যাদের প্রার্থী দিয়েছিলেন, তারা ধরাশায়ী হয়েছেন বিরোধী পক্ষের কাছে।
সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর অবস্থা ভালো না। নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের মুখে। জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক স্থানেই বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছে নাগরিকরা। এর একটি বড় কারণ হলো, মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। এরকম বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশে এখন পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচন চলছে। প্রথম ধাপের উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত ৮ মে (বুধবার)। এ উপজেলা নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে চেয়েছে; কিন্তু সে উদ্যোগও সফল হয়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রথম ধাপে ৩৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এটি সর্বনিম্ন ভোটের রেকর্ড। এটি নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতে যেমন ক্ষমতাসীন দল চ্যালেঞ্জের মুখে, পুনরায় তাদের ক্ষমতায় আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি তেমনটি নয়।
বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে কেউ ক্ষমতাসীন দলের বিপর্যয়ের কথা কল্পনাও করেনি। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল তারা কেউই ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেনি বা ক্ষমতায় আসার মতো জনপ্রিয়তা, নেতৃত্ব বা সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের ছিল না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল অবধারিত। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে যারা দলের মনোনয়ন পাননি সে বিদ্রোহী প্রার্থীদের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৮ জন স্বতন্ত্র বিজয়ী হয়ে নির্বাচনের মান বাঁচিয়েছে। নির্বাচনকে ‘জীবন’ দিয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। উপজেলাতেও তাই আওয়ামী লীগ একই কৌশল গ্রহণ করেছে। উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা ছিল দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করলে বিএনপির জন্য নির্বাচনে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে—এমন গুঞ্জনও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি পুরোনো পথে হেঁটেছে। তারা উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শতাধিক বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনে তাদের ৭ জন বিজয়ী হয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। তবে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিকূল রাজনীতির পরিবেশে নির্বাচন করে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা যায় না। তার পরও যে উপজেলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে বিএনপি নেতারা অংশগ্রহণ করেছে সেজন্য তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ সুস্থ রাজনীতির জন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার পরও উপজেলা নির্বাচন গণতন্ত্রের সংকটের বার্তা। নির্বাচন নিয়ে জনগণের অনীহা ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তির। আওয়ামী লীগের সামনে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নেই। আওয়ামী লীগের এমন কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই যারা জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তা ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের তীব্র সংকট চলছে। কদিন আগেই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে হটিয়ে তারা ক্ষমতা নিতে চায়, তাদের নেতা কে?’ এই নেতৃত্বের সংকটই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, নেতৃত্ব সংকটের কারণেই বিএনপি নির্বাচনবিমুখ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে এখন ‘স্বেচ্ছা বন্দি’। তিনি ফিরোজায় বাসভবনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি নির্বাচনের অযোগ্য। অন্যদিকে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ একাধিক মামলায় দণ্ডিত। তার দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এ কারণে বিএনপি এখন নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। বিএনপির লক্ষ্য সুস্পষ্ট। তারা নির্বাচন থেকে দূরে থেকে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলতে চায়। গণতন্ত্রে সংকট দেখা দিলে তৃতীয় কোনো পক্ষের ক্ষমতায় আসার পথ উন্মুক্ত হবে।
তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতায় এলে বিএনপি তার রাজনৈতিক পুনর্গঠন নতুন করে শুরু করতে পারবে। অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে তারেক জিয়া দেশে ফেরা, খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফের বিষয়গুলো তারা ফয়সালা করতে চায়। এজন্য নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক রীতিতে ক্ষমতায় আসা নয়; বরং একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এ কারণেই তারা যতটা না জনমুখী কর্মসূচি পালন করে তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ধর্ণা দেয়, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশগুলোকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা বিএনপির রাজনীতির প্রধান কৌশল। ফলে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের খুশি বা আত্মতুষ্টির কারণ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪২ শতাংশ। এ নিয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় এবং সন্দেহ রয়েছে। তার পরও একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতিকে সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে ভোটার উপস্থিতি কম হবে—এটাই স্বাভাবিক বিষয়। বিএনপি অংশগ্রহণ না করার পরও যে একতরফা নির্বাচন হয়নি, বিশেষ করে ২০১৪-এর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসতে পেরেছে, সেটি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের বড় অর্জন। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন জনগণ আরও ভোটবিমুখ। এটি আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই অশনিসংকেত। গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভোটাররা যদি গণতন্ত্রের প্রতি অনাগ্রহী হন, ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে না যান, ভোটাররা যদি তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখান তাহলে গণতন্ত্র সংকটে পড়বেই। আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বে আওয়ামী লীগ। এ কারণে অন্য দেশগুলোতে যখন ক্ষমতাসীনরা ভোটে জিতবে কি জিতবে না সেই অনিশ্চয়তায়, সেখানে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে আমি মনে করি। নির্বাচনে পরাজয়ের শঙ্কার চেয়ে গণতন্ত্রের মৃত্যুর শঙ্কা বেশি ভয়াবহ।
উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে অতীতে দেখা গেছে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকে জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহী হয়। এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক হয় এবং একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এবার উপজেলা নির্বাচনে সেটি হয়নি। কেন হয়নি তার কারণ আওয়ামী লীগকে খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ সমর্থক আছে। তারাও কেন ভোট দিতে যাচ্ছেন না? এর উত্তর খুঁজতে হবে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটিকে। দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করেও আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারেনি। এই না পারার কারণ হলো আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতা লোভ, বাড়াবাড়ি এবং এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনা। তারা দমন করার চেষ্টা করেছে পেশি শক্তি প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করেছে। সাধারণ মানুষ সব জানে, সব বোঝে। তারা এসব ঝুট-ঝামেলার মধ্যে যেতে চায়নি। সে কারণেই তারা ভোট থেকে আগ্রহ ফিরিয়ে নিয়েছে। অনেক জায়গায় নির্বাচনের ফল ছিল পূর্ব অনুমিত। তারা জানত যে, এমপির ভাই দাঁড়িয়েছে, এমপির ছেলে দাঁড়িয়েছে কাজেই তাদের বিজয় ঠেকাবে কে। এই বোধটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগকে এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না বটে, তবে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না, তা হলফ করে কে বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে আবার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকে তিনি এই ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। অতিডান এবং অতিবামরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করেছে বলে তিনি নেতাদের সতর্ক করেছেন।
আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের কাছেই আওয়ামী লীগ বারবার পরাজিত হয়েছে, হয়েছে বিপর্যস্ত। আর এই ষড়যন্ত্র শুধু বাইরে থেকে হয়নি, দলের ভেতর থেকেও হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর একটাই উপায়, তা হলো গণতন্ত্রকে মুক্ত স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে দেওয়া, জনগণকে উৎসাহিত করা, ভোটকেন্দ্রে যাতে ভোটাররা যান, তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন সে পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া। উপজেলা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি দলের নেতাকর্মীদের ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য প্রচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেখ হাসিনা মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করার জন্য যে নির্দেশ দেন, তা কেউ মানেনি। যারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তারাও ষড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংকটে। বিরোধী দলহীন গণতন্ত্র মুণ্ডুহীন দেহ। সরকারের কোনো জবাবদিহি থাকে না। এতে ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের দূরত্ব তৈরি হয়। এভাবেই পল্লবিত হয় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। অবৈধ ও অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হয়। তেমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছেই যেতে হবে।
লেখক:
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল:
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আমাদের ছোটবেলার ঈদে অন্যতম আনন্দের উৎস ছিল আমজাদ হোসেনের নাটক। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম আমজাদ হোসেনের ঈদের নাটক দেখার জন্য। এই নাটকে জব্বর আলীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন আমজাদ হোসেন। একেক ঈদে জব্বর আলীর দুর্নীতির একেকটি চিত্র উঠে আসত হাস্যরসের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিটি নাটকে একটি বক্তব্য থাকত; যে বক্তব্যটি সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষণীয়।
১৭ মে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালিত হলো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করলাম। যে যেভাবে পেরেছে ১৭ মে তে নিজেদেরকে জানান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সংবাদপত্রগুলো ভরে গেছে শেখ হাসিনার স্তুতিতে। শেখ হাসিনাকে নিয়ে বন্দনা কতটা আসল, কতটা চাটুকারিতা তা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। ১৭ মে ১৯৮১ তে যখন তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তখন সাধারণ মানুষের ভালবাসা আবেগ ছিলো হৃদয় নিংড়ানো, পুরোটাই নিখাঁদ। ৪৩ বছর পর এই উচ্ছ্বাস কি তেমনি অকৃত্রিম?
বাংলাদেশে সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি আছেন যাদেরকে মনে করা হয় তারা মার্কিনপন্থী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে তারা গর্ব অনুভব করেন। কথায় কথায় মার্কিন দূতাবাসে যান। সেখানে প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, নৈশভোজে মিলিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বলে তারা তার চেয়ে তিন ধাপ গলা উঁচিয়ে কথা বলেন। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের কোন ভালবাসা নেই, প্রেম নেই, আগ্রহ নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং নীতি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য। এই সমস্ত সুশীলদেরকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোফোন।
আওয়ামী লীগ এবং তার আদর্শিক জোট ১৪ দলের নেতাদের চীন সফরে হিড়িক পড়েছে। আওয়ামী লীগ এবং তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর এই চীন সফরকে ঘিরে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলাপ আলোচনা। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই ১৪ দল এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের চীন সফরের ব্যাপারে দৃষ্টি রাখছেন। তবে তারা এই বিষয় নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না। বিষয়টি তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় হিসেবেই মনে করছেন।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।