এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমঝোতার পাঁচ প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ২৩ জানুয়ারী, ২০২৪


Thumbnail

নির্বাচন হয়ে গেছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ উজ্জীবিত, বিএনপি হতাশ। আর হতাশ বিএনপি হতাশা কাটানোর জন্য এখন নতুন করে দলকে সংগঠিত করা, নেতাকর্মীদের হতাশা দূর করা এবং দল পুনর্গঠনের বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। আর এই লক্ষ্যেই বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করে, প্রকাশ্যে না হলেও অঘোষিতভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। অবশ্য পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকরাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক বোঝাপড়া এবং সমঝোতার পরামর্শ দিয়েছে। এই সমঝোতার মাধ্যমে একটি সহনীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা এবং গণতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বিএনপিকে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। 

বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক সমঝোতা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এবং গণতন্ত্রের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো দূর করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সমঝোতার ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয় মুখ্য হয়ে উঠেছে। 

যে পাঁচটি বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা হতে পারে তা হল;

১. বিএনপি ৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে প্রত্যক্ষ ভাবে মেনে নেবে: নির্বাচন বিরোধী তারা কথাবার্তা বলবে কিন্তু এই নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি বা সরকারকে অগ্রাহ্য করা ইত্যাদি করবে না। বরং তারা সরকারের সাথে দর কষাকষি করবে বিভিন্ন বিষয়ে।

২. বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরকে মুক্তি দেওয়া: বিএনপি সহ বিরোধী দলের যে সমস্ত নেতাকর্মীদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদেরকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধাপে ধাপে মুক্ত করা হবে এবং এই সমস্ত নেতাকর্মীদের মামলাগুলো থেকে যেন তারা জামিন পায় সে ব্যাপারে সরকার সহানুভূতিশীল আচরণ করবে। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মামলাগুলো এখন আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এগুলো থেকে তারা জামিন পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

৩. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো বন্ধ করা: বিএনপি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অপপ্রচার, মিথ্যাচার এবং কুৎসা ছড়াচ্ছে সেগুলো থেকে সরে আসবে এবং সেগুলো বন্ধ করবে। 

৪. শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি: বিএনপি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবে এবং অন্যদিকে সেই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাধা দেবে না। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি যদি শান্তিপূর্ণ কোন আন্দোলনের কর্মসূচি করতে চায় সেই কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হবে না।

৫. জামায়াত এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি থেকে দূরে থাকা: বিএনপি যে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করেছে সেখানে তারা সরে আসবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারার প্রক্রিয়া গড়ে তুলবে। এ কারণে তারা জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আবার বন্ধ করবে।

এই পাঁচটি সমঝোতার বিষয় নিয়ে তারা এখন একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। কূটনৈতিক মহল এ নিয়ে দেন দরবার করছে এবং দুই পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে বলে জানা গেছে।

বিএনপি   আওয়ামী লীগ   রাজনৈতিক সমঝোতা   রাজনীতির খবর  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘টেকা দেন দুবাই যামু’

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২০ মে, ২০২৪


Thumbnail

আমাদের ছোটবেলার ঈদে অন্যতম আনন্দের উৎস ছিল আমজাদ হোসেনের নাটক। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম আমজাদ হোসেনের ঈদের নাটক দেখার জন্য। এই নাটকে জব্বর আলীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন আমজাদ হোসেন। একেক ঈদে জব্বর আলীর দুর্নীতির একেকটি চিত্র উঠে আসত হাস্যরসের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিটি নাটকে একটি বক্তব্য থাকত; যে বক্তব্যটি সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষণীয়। আমজাদ হোসেনের ঈদের নাটকগুলোর মধ্যে একটি ছিল আদম ব্যবসা নিয়ে। আদম পাচার এবং আদম ব্যবসায়ের আড়ালে যেভাবে মানুষকে হয়রানি এবং প্রতারণা করা হতো, তার চিত্র ফুটে উঠেছিল। সে নাটকে ফরিদ আলীর একটি উক্তি বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে ছিল ওই সংলাপটি। সংলাপটিতে ফরিদ আলী বলছিলেন, ‘টেকা দেন দুবাই যামু।’ বৃহস্পতিবার দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে দুবাইয়ে ধনকুবেরদের সম্পদের পাহাড় প্রতিবেদনটি দেখে আমজাদ হোসেনের ‘টেকা দেন দুবাই যামু’ কথাটি স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল। তখন অর্থ উপার্জনের জন্য সর্বস্ব বিক্রি করে মানুষ দুবাই যেতে চাইত। এতে দেশের উপকার হতো। এখন অর্থ পাচারের জন্য দেশকে কেউ কেউ দুবাইয়ে ঠিকানা করছে। আগে দুবাই যেতে জমি বিক্রি করে নিঃস্ব হতো একটি পরিবার। এখনকার ফরিদ আলীরা টাকা নিয়ে ব্যাংক খালি করছে। নিঃস্ব হচ্ছে দেশ। আগে দুবাই ছিল টাকা আনার জায়গা। এখন টাকা রাখার ‘নিরাপদ’ স্থান। এখন শুধু জীবিকার সন্ধানে এ দেশের মানুষ দুবাই যান না। কষ্ট করে শুধু রেমিট্যান্স পাঠান না। লুটেরা, অর্থ পাচারকারীদের ঠিকানা ইদানীং দুবাই। দুবাইয়ে এখন বিনিয়োগ করেছেন বিশ্বের ধনকুবেররা। এই চিত্রটি ফুটে উঠেছে ‘দুবাই আনলকড’ নামে বৈশ্বিক অনুসন্ধানে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে এখন আকাশচুম্বী ঐশ্বর্য, আকাশচুম্বী বিলাসিতা এবং এক রকম প্রাচুর্যে ভরপুর জীবনযাপন। একসময় এটি ছিল ধু-ধু মরুভূমি। সেই অবস্থা থেকে এটি এখন বিশ্বের আধুনিকতম শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরেকটি বড় সুবিধা হলো, এখানে অবৈধ অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হয় না। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার মানুষ বিপুল পরিমাণ সম্পদ দুবাইয়ে রাখতে চাইছেন। গোপন সম্পদের আড়ত হয়েছে দুবাই। ব্যাংকের মাধ্যমে কিংবা ব্যক্তিগত বিমানে ভরে অর্থ নিয়ে যাওয়া যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এই সুযোগে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা ব্যক্তি, অর্থ পাচারকারী এবং অপরাধীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। আর এই অধিকাংশ সম্পদই অবৈধ। জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত গোপন সম্পদ। ‘দুবাই আনলকড’ নামে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি ৫৮টি দেশের ৭৪টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ছয় মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রস্তুত করেছেন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন, রিপোর্টিং,’ (ওসিসিআরপি) ও নরওয়ে সংবাদমাধ্যম ই-২৪-এর নেতৃত্বে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

এই প্রতিবেদনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী লুণ্ঠনের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে এ প্রতিবেদনে। বিভিন্ন দেশ থেকে ধনকুবেররা কীভাবে গোপনে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তার চিত্র ফুটে উঠেছে ‘দুবাই আনলকড’-এ। দুবাইয়ে সরকারি ভূমি দপ্তরসহ অন্যান্য রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ফাঁস হওয়া তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুবাইয়ে বিদেশিদের মালিকানায় থাকা সম্পদের পরিমাণ ১৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিদেশিদের সম্পদের মালিকানার তালিকায় শীর্ষে আছে ভারতীয়রা। ২৯ হাজার ৭০০ ভারতীয় নাগরিকের ৩৫ হাজার সম্পদের মালিকানা রয়েছে দুবাইয়ে। ভারতীয়দের এসব সম্পত্তির মোট মূল্য ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। ভারতের পর এই তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান। দুবাইয়ে ১৭ হাজার পাকিস্তানি নাগরিকের ২৩ হাজার সম্পদের মালিকানা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পাকিস্তানের ইংরেজি ভাষার ‘দৈনিক ডন’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুবাইয়ে ১৭ হাজার পাকিস্তানি সম্পদের মালিক। তবে তথ্য-উপাত্ত ও সূত্র ব্যবহার করে এই সংখ্যা ২২ হাজারের মতো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা ছাড়াও শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার এবং আমলারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অভিজাত এলাকায় বিপুল সম্পদের মালিক। পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া প্রায় একটি রাষ্ট্র। ভয়াবহ অর্থকষ্টে দেশটির জনগণ দিশেহারা। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণহীন। রিজার্ভ শূন্য। ঋণ নিয়ে কোনোরকমে দেশটি চলছে। বিভিন্ন ঋণের দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে যার কাছে পারছে তার কাছেই হাত পাতছে দেশটি। পাকিস্তানের শোচনীয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ যে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার, তা সবারই জানা। এই প্রতিবেদন তা আরেকবার প্রমাণ করল। জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে যারা বিদেশে পাঠিয়েছে, তারাই পাকিস্তানের মসনদে।

বাংলাদেশিদেরও সম্পদ কম নয় দুবাইয়ে। ওসিসিআরপির তথ্য বলছে, এই শহরে গোপন সম্পদ গড়েছেন অন্তত ৩৯৪ জন বাংলাদেশি। এসব বাংলাদেশির মালিকানায় রয়েছে ৬৪১টি সম্পদ। বাংলাদেশিদের মালিকানায় থাকা এসব সম্পদের মোট মূল্য ২২ কোটি ৫৩ লাখ ডলারেরও বেশি, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। আমার ধারণা, দুবাইয়ে এর চেয়েও দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। অনেকে বেনামে, কেউ কেউ কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ সরিয়ে এখন দুবাইয়ে রাখছেন। শুধু দুবাই কেন? ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্যাক্স অবজারভেটরি গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অব অফশোর ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের প্রায় ৫ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের অফশোর সম্পদ আছে। এটি বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার এশিয়ার কর স্বর্গ দেশগুলোতে, বাকিটা ইউরোপ, আমেরিকায়। ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে কর স্বর্গ বলে পরিণত দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে। সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী এখানকার ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে বাংলাদেশিদের সম্পদ ও মালিকানার তথ্য সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি এসব কোনো প্রতিবেদনে। তাদের পরিচয় গোপন করা হলেও আমরা তাদের চিনি। কারা ব্যাংকের টাকা লুট করে দুবাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, আমাদের অজানা নয়। কোন দুর্নীতিবাজরা বিদেশে দুর্নীতির টাকা গচ্ছিত রেখেছে, সে চর্চা এখন সর্বত্রই হয়। তাদের কারণেই যে অর্থনীতির সংকট, তা কে না জানে? বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন আশঙ্কাজনক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। অথচ পাচারকৃত অর্থ যোগ করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকত ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এক ধাপে ডলারের মূল্য ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। ডলার নিয়ে এখন হাহাকার। ডলারের অভাবে আমদানি করা যাচ্ছে না অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। রপ্তানিতেও শুভঙ্করের ফাঁকি। রপ্তানি আয়ের টাকা কাগজে আছে, ব্যাংকে নেই। ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সে উদ্যোগও এখন হালে পানি পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, আর্থিক সংকটে ধুঁকছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকে সুদসীমা উঠিয়ে দেওয়ার পর এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। ভুল নীতি এবং ভুল পরিকল্পনার কারণে মুদ্রাস্ফীতি এখন ১০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস উঠেছে। এসব কিছুর প্রধান কারণ হিসেবে আমি মনে করি, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার এবং দুর্নীতি। এই তিনটি বিষয়ে যদি সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তা হলে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে তোলা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে যাবে। যেভাবে পাকিস্তানের অর্থনীতি ডুবেছে, সেভাবে কি বাংলাদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানোর ষড়যন্ত্র চলছে? এখন পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি এবং অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। বিপুল বিস্ময়কর উন্নয়নকে ম্লান করে দিয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু লুটেরা দুর্বৃত্ত।

গত তিন-চার বছরে অর্থ পাচারের নতুন ঠিকানা হয়েছে দুবাই। আগে যারা বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করেছেন, তাদের মূল ঠিকানা ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড। অনেকে এসব দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে সেই দেশে শীর্ষ ধনীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। তারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন দুবাইয়ের প্রতি অর্থ পাচারকারীদের আগ্রহ বেড়েছে। এর কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে বেশ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এ কারণেই সেসব দেশে নতুন করে অর্থ পাচার কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা সুইস ব্যাংকে যেসব অর্থ পাচারকারী অর্থ পাচার করেছে তাদের তথ্য জানি না। এ তথ্যগুলো সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের অবস্থান গ্রহণ করেছে, সে সম্পর্কেও আমরা অন্ধকারে রয়েছি। আমরা জানি না যে, ‘ট্যাক্স হেভেন’ বলে পরিচিত দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে যারা কোম্পানি খুলে অর্থ পাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ওসিসিআরপি এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেই তথ্যের তদন্ত হয়নি। আমরা এটাও জানি না যে, বাংলাদেশের যেসব ব্যবসায়ী রপ্তানির নামে ‘ওভার ইনভয়েসিং’-এর মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে। আমরা জানি না কানাডার বেগমপাড়ায় যাদের বাড়িঘর আছে তাদের তালিকা কার কাছে। এই তালিকা প্রকাশের জন্য কয়েক বছর ধরেই হৈচৈ হয়েছে, আলোচনা হয়েছে; কিন্তু তালিকা আলোর মুখ দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় যারা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তারা কারা?

অর্থ পাচার রোধে সরকারের গ্রহণ করা ব্যবস্থাগুলো কতটুকু বাস্তবে রূপ নিয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সরকার অর্থ পাচার রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পেরেছে কি না, তা নিয়েও অনেকের মধ্যে সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে। গত বছর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকটের কারণে অর্থ পাচারকারীদের থেকে অর্থ ফেরত নেওয়ার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সরকার। বিদেশ থেকে অর্থ নিয়ে এলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না—এমন দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরও অর্থ পাচারকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি। একটি ডলারও পাচারকারীরা দেশে ফিরিয়ে আনেনি। কানাডা, যুক্তরাজ্য, আমেরিকার কথা বাদই দিলাম; মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ করা বাঙালির সংখ্যা হাজারের ওপর। সিঙ্গাপুরে অলিগলিতে বাঙালিদের বিভিন্ন সম্পদ পাওয়া যায়। অর্থ পাচার যদি বন্ধ না হয়, তা হলে অর্থনৈতিক সংকট কাটানো যাবে না। দুর্নীতি যদি বন্ধ না করা যায়, তা হলে অর্থনীতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। আমরা যদি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে না পারি, তা হলে অর্থনীতির ধ্বংস ঠেকানো অসম্ভব। দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং লুণ্ঠনে পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা ছিলেন, তারা যেভাবে দুর্নীতি করে দেশকে ফোকলা বানিয়েছেন, বাংলাদেশ তার থেকে অনেক পেছনে। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে, যেভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে বাংলাদেশ পাকিস্তান হতে বাধ্য। আমরা কি বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চাই? যারা বাংলাদেশ চায়নি তারাই অর্থনীতির বারোটা বাজাচ্ছে। আমজাদ হোসেনের ফরিদ আলী ‘টেকা’ নিয়ে বিদেশ যেতে চেয়েছিল। নিজের ভাগ্য গড়তে চেয়েছিল। সেখান থেকে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠানোর স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু এখনকার নব্য ফরিদ আলীরা ব্যাংক খালি করে, জনগণের সম্পদ লুট করে দুবাই যাচ্ছে। এই ফরিদ আলীদের রুখতে হবে। তাদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে অর্থনীতি, বাংলাদেশকে।


লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

সবকিছু ঠিক আছে?

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১৭ মে, ২০২৪


Thumbnail

১৭ মে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালিত হলো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করলাম। যে যেভাবে পেরেছে ১৭ মে তে নিজেদেরকে জানান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সংবাদপত্রগুলো ভরে গেছে শেখ হাসিনার স্তুতিতে। শেখ হাসিনাকে নিয়ে বন্দনা কতটা আসল, কতটা চাটুকারিতা তা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। ১৭ মে ১৯৮১ তে যখন তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তখন সাধারণ মানুষের ভালবাসা আবেগ ছিলো হৃদয় নিংড়ানো, পুরোটাই নিখাঁদ। ৪৩ বছর পর এই উচ্ছ্বাস কি তেমনি অকৃত্রিম? 

১৭ মে নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঘুরে দাঁড়াবার দিন। আমি মনে করি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, ১৭ মে বাংলাদেশের জনগণের জন্যও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এরপর ৪৩ বছর পেরিয়ে গেছে। ৪৩ বছর বাঙালীর যে সংগ্রাম বা অর্জন তার সবকিছুর মূলে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তিল তিল করে সংগ্রাম করেছেন এবং বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করেছেন। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণের পথে তিনি এখন প্রায় গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু এই ৪৩ বছর পেরিয়ে এখন যখন আমরা আজকে বাংলাদেশের দিকে তাকাবো, তখন একটি প্রশ্ন সামনে আসে। সবকিছু কি ঠিক আছে? দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিতে সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছে? অর্থনীতির চেহারা ক্রমশঃ বিবর্ণ, মলিন হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। আওয়ামী লীগের মধ্যে সবকিছু উপেক্ষা এবং অবজ্ঞা করার প্রবণতা বাড়ছে। কোন সমস্যাকেই অনেকে পাত্তা দিতে রাজী নন। কেউ যদি সমস্যা উপলব্ধি না করে তাহলে সমাধান করবে কিভাবে?

১৯৮১ সালের ১৭ মে যখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসেছিলেন জাতির পিতার রক্তে ভেজা মাটিতে। সেসময় বাংলাদেশ কেমন ছিল? বাংলাদেশ ছিল ক্ষুধা-দারিদ্রে নিষ্পেষিত গণতন্ত্রহীন একটি দেশ। যেদেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ছিলো না, সাংবিধানিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছিল, বিচারের নামে হতো প্রহসন, মানবাধিকার ছিলো ভুলুণ্ঠিত। অভাব,দারিদ্র, বিদেশের উপর নির্ভরতা সবকিছুর মিলিয়ে বাংলাদেশ ছিলো যেন এক স্বপ্নহীন রাষ্ট্র। সে ধ্বংস স্তূপেই এসে শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৮১ থেকে ২০২৪, শেখ হাসিনার এই ৪৩ বছরের জীবনকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগ, তার সংগ্রামের জীবন। দ্বিতীয় ভাগ, অর্জনের। এই ৪৩ বছরে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন এবং এক সাহসী নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে জয় করেছেন। শেখ হাসিনা যখন এসেছিলেন তখন ঘরে বাইরে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। একদিকে, সামরিক শাসকরা তাকে বাঁধা দিতে চেয়েছিল, তার রাজনৈতিক অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তিনি যাতে দেশে না আসেন সে চেষ্টা করা হয়েছিল। দেশে আসার পর এমন এক পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছিল যেন তিনি রাজনীতি করতে না পারেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সে ভয়ের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করেননি। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অকুতোভয় সৈনিকের মতো তিনি লড়াই করেছেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় দলেও ছিলো এক বৈরী পরিস্থিতি। কোন্দলে বিভক্ত দলটিতে ৭৫ এর খুনীদের দোসরদের পুনর্বাসিত করা হয়েছিলো। ৩৩ বছর বয়সী বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে পুতুল বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল অনেকে। ঘরে বাইরে লড়াই করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে।

লক্ষণীয় ব্যাপার যে, ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সংগ্রামে যেমন স্বৈরাচার, ধর্মান্ধ মৌলবাদ এবং স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি তার বিরুদ্ধে ছিল। ঠিক তেমনিভাবে দলের ভেতরে ছিল কুচক্রী মহল, ছিলো ষড়যন্ত্রকারী। সেই ষড়যন্ত্রকারীরা শেখ হাসিনার অভিযাত্রার পথে কাঁটা বিছিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। আবার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, মানুষের নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামেও দলের ভিতর থেকে তিনি সহযোগিতা পেয়েছেন খুবই কম। দলের ভেতর অনেকেই সেসময় নব্য মোশতাকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগে পরিণত হবে- এমন কথা বলতেন দলটির ডাক সাইট নেতারা। ২০০৭ সাল থেকে ২০০৮ সাল এই দুই বছর শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্রের মধ্যেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ নেতাদের দায় চোখ এড়াবে না। তারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার জন্য যে ঘৃণ্য  খেলায় অংশীদার হয়েছিলেন। ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই তাকে দল আগলে রাখতে হয়েছে। এসময় আওয়ামী লীগইে শেখ হাসিনার সমালোচকের অভাব ছিলোনা। সেই সমালোচনার জবাব দিয়েই তিনি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেঁটেছেন। এখন তার সমালোচকরাই সবচেয়ে বড় চাটুকার। শেখ হাসিনার সংগ্রামের অধ্যায়ের যোদ্ধারা এখন কোণঠাসা। অর্জনের সময় অতিথি পাখিদের দাপট দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাদের দাপটে দুঃসময়ের সঙ্গীরা কোণঠাসা। এরাই চারপাশে এমন স্তুতির রঙ্গীন ফানুস সাজিয়েছেন যে বাস্তব অবস্থাই আড়াল হয়ে গেছে। এটাই হলো ভয়ের কারণ। আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলকে তিনি ৪৩ বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ৭৫ বছর বয়সী উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দলটি ৭৫’র আগস্টের শোকাবহ ঘটনার পর তাঁর হাতেই পুনর্জন্ম লাভ করে, বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন আরও ৫ বছরের জন্য জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছে। শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিকে পরাজিত করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এখন একমাত্র তারকা হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছেন। রাজনীতিতে তার কোন প্রতিপক্ষ নেই। তিনি দেশ পরিচালনায় একজন প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ এবং একজন বিশ্ব নেতার সমতুল্য, সেটি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা অস্বস্তি, কোথায় যেন একটা আতঙ্ক, কোথায় যেন একটা প্রশ্ন। সবকিছু কি ঠিক আছে? দেশ কি সঠিক পথে?

চতুর্থ মেয়াদে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আসাটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এসময় এক প্রচন্ড প্রতিপক্ষ এবং নানা রকম প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক মহল এ নির্বাচন বাতিলের এক নীল নকশা রচনা করেছিলো। নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিলো। বাংলাদেশের গণতন্ত্র থাকবে কিনা তা নিয়ে এক শংকা তৈরী হয়েছিলো। এই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সাহসের সাথে তিনি পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। অনেকে কল্পনাও করতে পারেননি যে, এইভাবে বিরোধী দল ছাড়া একটি নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে এবং নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্বস্তির হাওয়া বইবে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন একটি ম্যাজিক।

নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। নতুন সরকার চার মাস সময় পার করেছে। আন্তর্জাতিক চাপ নেই। রাজনীতির প্রতিপক্ষরা সরকারকে চোখ রাঙ্গাতে পারছে না। আওয়ামী লীগ অনেকটাই দুশ্চিন্তা মুক্ত। কিন্তু এক অজানা আশঙ্কা ভর করেছে। অর্থনীতিতে অস্থিরতা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রতিনিয়ত কমছে, নানামুখী সংকটে অর্থনীতি আজ মুখ থুবড়ে পরার উপক্রম। সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে নেই। জিনিস পত্রের দাম উর্ধ্বমুখী, বিদ্যুৎ সংকট বেড়েছে, ডলারের দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়ার ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চারিদিকে ফিসফাঁস। ব্যাংকে টাকা নেই, ঋণ খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে। অর্থ পাচারকারীরা বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে সরকার কিভাবে এগুবে? অর্থনীতির সংকট কিভাবে সরকার কাটিয়ে উঠবে সেটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ সরকারের ভেতর কিছু ব্যক্তি সমস্যাকে আমলে নিতে রাজী নন। যুক্তিহীন ভাবে তারা বলছে, শেখ হাসিনা সব ম্যানেজ করবে। অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাবে। কিভাবে?-এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। অর্থনৈতিক সংকট যদি প্রবল হয় তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতির এই দৈন্য চেহারা হবার কথা ছিলো না। সঠিক পরিকল্পনা এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলাদের নির্বোধ নিরীক্ষার কারণে অর্থনীতিতে বর্তমান সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি গ্রহণ করলেও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কঠোর হতে পারেনি। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীদের বিরুদ্ধেও অসহায় সরকার। কেন পারছে না আওয়ামী লীগ? যারা অর্থ পাচার করছে, যারা দুর্নীতিবাজ, ঋণ খেলাপী তারা ক্ষমতার চারপাশে রয়েছে এমন আলোচনা বিভিন্ন সময় শোনা যায়। আমলাতন্ত্রের উপর অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকার। আমলারা এখন সবকিছুর কর্তা। নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আমলারা। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অর্থনীতির অবস্থা খারাপের দিকে এমনটি মনে করেন সরকারের অনেকেই। কিন্তু তারপরও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের আমলাতান্ত্রিক বটিকার বাইরে সরকার কোন সমাধান বের করতে পারেনি। 

সাংগঠনিকভাবেও আওয়ামী লীগের মধ্যে নানারকম অস্থিরতা। দলের ভেতর চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে গেছে। স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রের কথা শুনছেন না। উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যা হচ্ছে সেটা আওয়ামী লীগের জন্য লজ্জার। সারাদেশে আওয়ামী লীগের সংগঠনের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। গ্রুপিং, কোন্দল এখন আওয়ামী লীগের স্বাভাবিক চিত্র। অনেকেই বলবেন, আওয়ামী লীগের মতো একটা বড় দল টানা ক্ষমতায় আছে তাই বিভক্তি থাকতেই পারে। এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই বিভক্তি যখন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে শেখায়, এই বিভক্তি যখন দলের স্বার্থের পরিপন্থী অবস্থান নেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে, তখন তা উদ্বেগের কারণই বটে। আওয়ামী লীগ এখন সাংগঠনিকভাবে অগোছালো, নানারকম সংকটে জর্জরিত। ক্ষমতায় আছে জন্য এ সংকটগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে না। কিন্তু দলের জন্য যারা নিবেদিত প্রাণ, তারা জানেন সংকট কোথায় এবং কতটা গভীর। কোন্দল ঠেকাতে, শৃঙ্খলা ফেরাতে দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতারা নিষ্ক্রিয়। তাহলে এতো নেতার কাজ কি? আওয়ামী লীগ এবং সরকারে সবাই তাকিয়ে থাকেন শেখ হাসিনার দিকে। কেউ কোন সিদ্ধান্ত নেন না।

১৭ মে যখন শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন তখন এক প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাকে লড়াই করতে হয়েছে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ ছিলো। এক বিরূপ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। এখন দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর অভাব নেই। হাটে, মাঠে, ঘাটে আওয়ামী লীগে সয়লাব। বর্ষার বৃষ্টিতে যেমন খাল-বিলে মাছে টইটুম্বুর থাকে দেশ এখন আওয়ামী লীগ দিয়ে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। কে আসল, কে নকল তা বোঝা ভার। আর একারণেই প্রশ্ন উঠেছে, যারা সর্বনাশা খেলায় মেতেছেন, যাদের ভুল পরামর্শে অর্থনীতির বারোটা বাজছে, যাদের কারণে আওয়ামী লীগের ভেতর কোন্দল বেড়ে যাচ্ছে, যাদের কারণে দ্রব্যমূল্যের বাজারে অস্থিরতা। তারা সরকারের চারপাশেই আছেন। তারা কি সরকারের শুভাকাঙ্খী নাকি ষড়যন্ত্রকারী? আওয়ামী লীগ যখন বিপদে পড়বে তখন এদের চেহারাটা কেমন হবে? আর আওয়ামী লীগের জন্য এখন খুবই আয়েশি সময়। আওয়ামী লীগ এক আত্মতুষ্টির আতিশায্যে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, আলোর পরেই অন্ধকার। তাই চাটুকার, সুবিধাবাদী, এবং সুযোগ সন্ধানীদের কাছ থেকে আওয়ামী লীগকে মুক্ত করতে হবে। দেশের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধির চেষ্টা করতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে আওয়ামী লীগকে। সরকার যদি জনবান্ধব না হয়, মানুষের জীবনে যদি সরকার স্বস্তি আনতে না পারে তাহলে জনগণও মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। ১৭ মে থেকে আওয়ামী লীগকে সেই শিক্ষাই নিতে হবে। জনগণই ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে সমর্থন দিয়ে তাকে রাজনীতির উচ্চ শিখরে আসীন করেছে। জনগণের ভালোবাসাতেই তিনি প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন। জনগণই তার প্রধান শক্তি। কাজেই জনগণের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা আওয়ামী লীগের প্রধান কাজ। সবকিছু ঠিক আছে, বলে বাস্তবতাকে আড়াল করলে ক্ষতি হবে আওয়ামী লীগেরই। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

এই সব সুশীলদের এখন কী হবে?

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ১৫ মে, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশে সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি আছেন যাদেরকে মনে করা হয় তারা মার্কিনপন্থী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে তারা গর্ব অনুভব করেন। কথায় কথায় মার্কিন দূতাবাসে যান। সেখানে প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, নৈশভোজে মিলিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বলে তারা তার চেয়ে তিন ধাপ গলা উঁচিয়ে কথা বলেন। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের কোন ভালবাসা নেই, প্রেম নেই, আগ্রহ নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং নীতি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য। এই সমস্ত সুশীলদেরকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোফোন। 

গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই ধরনের সুশীলের প্রভাব প্রতিপত্তি বাংলাদেশে ব্যাপক লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফোরামে তারা যেন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি, তখন এই সমস্ত সুশীলরা বাহবা দিয়েছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত সঠিক বলেই বিভিন্ন টকশোতে, বিভিন্ন লেখালেখিতে বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সময়ও সুশীলদের দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলতে। এতে যে দেশের ক্ষতি সেটি অনুভব করার সামর্থ্য তাদের নেই। আবার ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করল তখন এই সমস্ত সুশীলরা ভিসা নীতি নিয়ে যেন মার্কিন কূটনীতিকের ভূমিকা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যখনই কোনো প্রতিনিধিরা আসতেন তখন এই সমস্ত সুশীলদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করতেন এবং এতেই বাজারে তাদের কদর বাড়ত। বিভিন্নভাবে তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতেন। আর এই সমস্ত সুশীলদের খুঁটির জোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কথাটা সর্বত্র চাউর ছিল। কিন্তু সেই সুশীলরাই এখন অপাংক্তেয় হয়ে গেলেন। তারা এখন হতাশার সাগরে নিমজ্জিত। 

ডোনাল্ড লুর সফরে এবার চায়ের দাওয়াত পাননি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। ডোনাল্ড লুর সঙ্গে তাদের দেখা সাক্ষাৎও হয়নি। এ নিয়ে তাদের ভীষণ মন খারাপ। বিশেষ করে হেফাজতের তাণ্ডবের সময়ে যিনি হেফাজতের কর্মীদের মৃত্যু আবিষ্কার করেছিলেন, মানবাধিকারের নামে যিনি সরকারবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত সেই আদিলুর রহমান খান প্রতিবারই মার্কিন দূতাবাসে দাওয়াত পেতেন। কিন্তু এবার তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এই বিতর্কিত তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত। 

জিল্লুর রহমান তৃতীয় মাত্রা উপস্থাপক। পিটার হাস রাষ্ট্রদূত হওয়ার পরপরই লাইমলাইটে আসেন জিল্লুর রহমান। তার সঙ্গে পিটার হাসের সখ্যতার কথা তিনি নিজেই বিভিন্ন জায়গায় বলে বেরিয়েছেন। ডোনাল্ড লু যখন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তখন ডোনাল্ড লুর সঙ্গে তিনি এক সাক্ষাৎকারেও আয়োজন করেছিলেন। একদা খুনি রশিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া এই বিতর্কিত উপস্থাপক মার্কিন অর্থায়নে এবং মার্কিন আর্থিক সহায়তায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। কিন্তু এবার তিনিও অপাংক্তেয় ছিলেন। 

স্বাধীনতাবিরোধীর সন্তান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের প্রধান কাজ হল সরকারকে নানাভাবে সমালোচনা করা। সরকারের লক্ষ্য ত্রুটি বিচ্যুতি বের করাই যেন তাঁর একমাত্র মিশন। সেই রিজওয়ানা হাসানকেও এবার দাওয়াত দেয়নি মার্কিন দূতাবাস। আর এই সমস্ত ব্যক্তিদেরকে দাওয়াত না দেওয়া ফলে প্রশ্ন উঠেছে। 

তবে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক দম নিজস্ব ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত বদিউল আলম মজুমদারের অনুপস্থিতি। বদিউল আলম মজুমদার প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তাকে মনে করা হত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে মূখপাত্র। এমন কী মার্সিয়া বার্নিকাটকে বিদায়ের আগে তাঁর বাসায় নৈশ্যভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই বদিউল আলম মজুমদারের মার্কিন দূতাবাসে চায়ের দাওয়াত না পাওয়াটা বিস্ময়কর। প্রশ্ন হচ্ছে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি নিয়ে যে সব সুশীলরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদলেহন করেছেন তাদের এখন কী হবে?

সুশীল   ডোনাল্ড লু   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান   বদিউল আলম মজুমদার   আদিলুর রহমান খান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ক্ষমতাসীনদের চীন সফর: নজর রাখছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ১৫ মে, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগ এবং তার আদর্শিক জোট ১৪ দলের নেতাদের চীন সফরে হিড়িক পড়েছে। আওয়ামী লীগ এবং তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর এই চীন সফরকে ঘিরে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলাপ আলোচনা। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই ১৪ দল এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের চীন সফরের ব্যাপারে দৃষ্টি রাখছেন। তবে তারা এই বিষয় নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না। বিষয়টি তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় হিসেবেই মনে করছেন। 

রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ এখন চীন সফর করছেন। রাশেদ খান মেনন ছাড়াও আওয়ামী লীগের শরিক এই জোটের অন্যান্য নেতারাও এই সফরে রয়েছেন। চীনপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত দিলীপ বড়ুয়া, শিরীন আখতার সহ শরিকদের প্রায় সবাই এই সফরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আর এই সফরের পরপরই আওয়ামী লীগের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের একটি ৫০ সদস্যের বিশাল দল যাচ্ছে চীন সফরে। সেই সফরে নেতৃত্ব দেবেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনের এমপি তানভীর শাকিল জয়। এর পরপরই কাজী জাফরউল্লাহ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল চীন সফরে যাবেন। 

পরপর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চীন সফর নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে নানারকম প্রশ্ন উঠেছে। আর এই ব্যাপারে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র দৃষ্টি রাখছে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।

হঠাৎ করে আওয়ামী লীগে চীন সফরের হিড়িক কেন এই নিয়ে নানামূখী আলোচনা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলছেন, এটি হঠাৎ করেই নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন সময়ে ভারত সফরও করেন। ভারতেও বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের আলাপ আলোচনার জন্য মতবিনিময় করা হয়। ভারতীয় প্রতিনিধিদলও বাংলাদেশে আসেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধি দল নিয়মিতভাবে যায়। কিন্তু এবার চীনের সফরগুলো সব পাশাপাশি সময় এসেছে। আমন্ত্রণ গুলো কাছাকাছি সময়ে এসেছে। এই জন্য বিষয়টিকে বড় করে দেখা হচ্ছে৷ এটি আসলে একটি রুটিন কাজ। 

আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আর এই রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণেই আওয়ামী লীগকে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তবে কূটনৈতিক মহল মনে করছেন, চীনের আগ্রহেই এই সফরগুলো হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বলয়ে চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হিসেবে এই সফরকে দেখছেন অনেকে। 

তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নিকটতম বন্ধু হল প্রতিবেশী ভারত। চীন তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পার্টনার। আর এই কারণেই আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, ভারতের সাথে তাদের এক ধরনের রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের বন্ধন রয়েছে, যা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের অর্থনৈতিক বলয় বিস্তার এবং আওয়ামী লীগ এবং শরিকদের নেতৃবৃন্দের চীন সফর নিয়ে ভারত কোন মন্তব্য না করলেও বিষয়টি নিয়ে তারা দৃষ্টি রাখছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় কুমার ভার্মা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বস্ত্র এবং পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গেও এক সপ্তাহের মধ্যে সাক্ষাৎ করেছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ যেন চীনমুখী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে না পরে সে বিষয়ে  ভারতের নজর আছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয় নিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে বলেও জানা গেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ   চীন সফর   ভারত   যুক্তরাষ্ট্র  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

বিশ্বজুড়ে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অস্বস্তি, বাংলাদেশে?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।

গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। তার আগে একটা রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে ২ হাজার ৬০০ কাউন্সিলরের মধ্যে দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি পেয়েছে ১ হাজার ৬১টি পদ। অন্যদিকে ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ৫০৪টি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়ে দলগতভাবে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। নির্বাচনে দ্বিতীয় হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। ৪০ বছরের ইতিহাসে এটি কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা যে ভীষণ নড়বড়ে, তা এই নির্বাচনেই প্রমাণ হয়েছে। নির্বাচনের পর পার্লামেন্ট নির্বাচনে কনজারভেটিভদের ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা না বলা গেলেও কনজারভেটিভ পার্টি যে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, সেটি হলফ করে বলা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ বছর নভেম্বরে। এই নির্বাচনে জো বাইডেনের অবস্থা তথৈবচ। জো বাইডেনকে কোনো জনমত জরিপেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। আইনি মারপ্যাঁচ, যৌন কেলেঙ্কারি ডেমোক্রেটদের নানামুখী বাধা ইত্যাদি নানা সংকট থেকে মুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আবার প্রার্থী হওয়া ট্রাম্পের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না সেটি যেমন প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো যে, জো বাইডেন এই নির্বাচনে কি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ এবং ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে জ্ঞান দেয়, মানবাধিকার চর্চার জন্য শাসন করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এখন মানবাধিকার সংকটে। গাজায় ইসরায়েলের তাণ্ডবের প্রতিবাদে মার্কিন তারুণ্যের গণবিস্ফোরণ পুরো বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এই গণবিস্ফোরণকে ঠেকাতে যেভাবে জো বাইডেন সরকার দমন নীতি গ্রহণ করেছে, তা তাকে সবচেয়ে কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে গেছে। জনগণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশ্বাস করছে না, জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তিনি এখন তলানিতে অবস্থান করছেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিজয়ী হয়েছিলেন অনেক লড়াই করে। বিজয়ের পর জনগণ তার পক্ষে কতটুকু আছে বা জনগণের মনোভাব কী, তা যাচাইয়ের একটি উপায় ছিল গত মার্চের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দলের শোচনীয় ভরাডুবি ঘটেছে। তিনি বড় শহরগুলোতে মেয়র পদে যাদের প্রার্থী দিয়েছিলেন, তারা ধরাশায়ী হয়েছেন বিরোধী পক্ষের কাছে।

সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর অবস্থা ভালো না। নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের মুখে। জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক স্থানেই বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছে নাগরিকরা। এর একটি বড় কারণ হলো, মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। এরকম বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশে এখন পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচন চলছে। প্রথম ধাপের উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত ৮ মে (বুধবার)। এ উপজেলা নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে চেয়েছে; কিন্তু সে উদ্যোগও সফল হয়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রথম ধাপে ৩৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এটি সর্বনিম্ন ভোটের রেকর্ড। এটি নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতে যেমন ক্ষমতাসীন দল চ্যালেঞ্জের মুখে, পুনরায় তাদের ক্ষমতায় আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি তেমনটি নয়।

বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে কেউ ক্ষমতাসীন দলের বিপর্যয়ের কথা কল্পনাও করেনি। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল তারা কেউই ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেনি বা ক্ষমতায় আসার মতো জনপ্রিয়তা, নেতৃত্ব বা সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের ছিল না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল অবধারিত। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে যারা দলের মনোনয়ন পাননি সে বিদ্রোহী প্রার্থীদের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৮ জন স্বতন্ত্র বিজয়ী হয়ে নির্বাচনের মান বাঁচিয়েছে। নির্বাচনকে ‘জীবন’ দিয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। উপজেলাতেও তাই আওয়ামী লীগ একই কৌশল গ্রহণ করেছে। উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা ছিল দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করলে বিএনপির জন্য নির্বাচনে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে—এমন গুঞ্জনও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি পুরোনো পথে হেঁটেছে। তারা উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শতাধিক বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।

প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনে তাদের ৭ জন বিজয়ী হয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। তবে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিকূল রাজনীতির পরিবেশে নির্বাচন করে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা যায় না। তার পরও যে উপজেলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে বিএনপি নেতারা অংশগ্রহণ করেছে সেজন্য তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ সুস্থ রাজনীতির জন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার পরও উপজেলা নির্বাচন গণতন্ত্রের সংকটের বার্তা। নির্বাচন নিয়ে জনগণের অনীহা ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তির। আওয়ামী লীগের সামনে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নেই। আওয়ামী লীগের এমন কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই যারা জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তা ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের তীব্র সংকট চলছে। কদিন আগেই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে হটিয়ে তারা ক্ষমতা নিতে চায়, তাদের নেতা কে?’ এই নেতৃত্বের সংকটই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, নেতৃত্ব সংকটের কারণেই বিএনপি নির্বাচনবিমুখ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে এখন ‘স্বেচ্ছা বন্দি’। তিনি ফিরোজায় বাসভবনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি নির্বাচনের অযোগ্য। অন্যদিকে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ একাধিক মামলায় দণ্ডিত। তার দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এ কারণে বিএনপি এখন নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। বিএনপির লক্ষ্য সুস্পষ্ট। তারা নির্বাচন থেকে দূরে থেকে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলতে চায়। গণতন্ত্রে সংকট দেখা দিলে তৃতীয় কোনো পক্ষের ক্ষমতায় আসার পথ উন্মুক্ত হবে।

তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতায় এলে বিএনপি তার রাজনৈতিক পুনর্গঠন নতুন করে শুরু করতে পারবে। অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে তারেক জিয়া দেশে ফেরা, খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফের বিষয়গুলো তারা ফয়সালা করতে চায়। এজন্য নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক রীতিতে ক্ষমতায় আসা নয়; বরং একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এ কারণেই তারা যতটা না জনমুখী কর্মসূচি পালন করে তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ধর্ণা দেয়, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশগুলোকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা বিএনপির রাজনীতির প্রধান কৌশল। ফলে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের খুশি বা আত্মতুষ্টির কারণ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪২ শতাংশ। এ নিয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় এবং সন্দেহ রয়েছে। তার পরও একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতিকে সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে ভোটার উপস্থিতি কম হবে—এটাই স্বাভাবিক বিষয়। বিএনপি অংশগ্রহণ না করার পরও যে একতরফা নির্বাচন হয়নি, বিশেষ করে ২০১৪-এর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসতে পেরেছে, সেটি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের বড় অর্জন। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন জনগণ আরও ভোটবিমুখ। এটি আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই অশনিসংকেত। গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভোটাররা যদি গণতন্ত্রের প্রতি অনাগ্রহী হন, ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে না যান, ভোটাররা যদি তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখান তাহলে গণতন্ত্র সংকটে পড়বেই। আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বে আওয়ামী লীগ। এ কারণে অন্য দেশগুলোতে যখন ক্ষমতাসীনরা ভোটে জিতবে কি জিতবে না সেই অনিশ্চয়তায়, সেখানে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে আমি মনে করি। নির্বাচনে পরাজয়ের শঙ্কার চেয়ে গণতন্ত্রের মৃত্যুর শঙ্কা বেশি ভয়াবহ।

উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে অতীতে দেখা গেছে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকে জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহী হয়। এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক হয় এবং একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এবার উপজেলা নির্বাচনে সেটি হয়নি। কেন হয়নি তার কারণ আওয়ামী লীগকে খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ সমর্থক আছে। তারাও কেন ভোট দিতে যাচ্ছেন না? এর উত্তর খুঁজতে হবে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটিকে। দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করেও আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারেনি। এই না পারার কারণ হলো আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতা লোভ, বাড়াবাড়ি এবং এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনা। তারা দমন করার চেষ্টা করেছে পেশি শক্তি প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করেছে। সাধারণ মানুষ সব জানে, সব বোঝে। তারা এসব ঝুট-ঝামেলার মধ্যে যেতে চায়নি। সে কারণেই তারা ভোট থেকে আগ্রহ ফিরিয়ে নিয়েছে। অনেক জায়গায় নির্বাচনের ফল ছিল পূর্ব অনুমিত। তারা জানত যে, এমপির ভাই দাঁড়িয়েছে, এমপির ছেলে দাঁড়িয়েছে কাজেই তাদের বিজয় ঠেকাবে কে। এই বোধটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগকে এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না বটে, তবে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না, তা হলফ করে কে বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে আবার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকে তিনি এই ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। অতিডান এবং অতিবামরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করেছে বলে তিনি নেতাদের সতর্ক করেছেন। 

আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের কাছেই আওয়ামী লীগ বারবার পরাজিত হয়েছে, হয়েছে বিপর্যস্ত। আর এই ষড়যন্ত্র শুধু বাইরে থেকে হয়নি, দলের ভেতর থেকেও হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর একটাই উপায়, তা হলো গণতন্ত্রকে মুক্ত স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে দেওয়া, জনগণকে উৎসাহিত করা, ভোটকেন্দ্রে যাতে ভোটাররা যান, তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন সে পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া। উপজেলা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি দলের নেতাকর্মীদের ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য প্রচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেখ হাসিনা মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করার জন্য যে নির্দেশ দেন, তা কেউ মানেনি। যারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তারাও ষড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংকটে। বিরোধী দলহীন গণতন্ত্র মুণ্ডুহীন দেহ। সরকারের কোনো জবাবদিহি থাকে না। এতে ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের দূরত্ব তৈরি হয়। এভাবেই পল্লবিত হয় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। অবৈধ ও অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হয়। তেমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছেই যেতে হবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিশ্ব   নির্বাচন   বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন