নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:১৯ এএম, ০১ ডিসেম্বর, ২০২০
মানবসভ্যতাকে আজ যে-কটি রোগ হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে, এইচআইভি/এইডস সেগুলোর মধ্যে একটি। এইডস একাধারে একটি মারণ এবং সংক্রামক ব্যাধি। সারা বিশ্বেই আজ এই রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। এই রোগের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে শরীরের রোগপ্রতিরোধক কোষ যেমন- হেলপারটি সেল, মনোসাইট, ম্যাক্রফেজ, ডেনড্রাইটিক সেল, চর্মের ল্যাঙ্গারহেন্স, মস্তিষ্ক ও গোয়াল সেল ইত্যাদিকে আক্রমণ করে এবং সেগুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। ফলে মানব দেহের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন যে-কোনো সংক্রামক জীবাণু সহজেই এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে। এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার অবস্থাকে এইডস বলে। এই অবস্থায় শরীরে প্রতিরোধ করার মতো কার্যকরী কোষ না থাকায় বিভিন্ন রোগ মারাত্মভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীরে নানা উপসর্গসহ এর বিস্তার ঘটায়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে দেশে দেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। উদ্দেশ্য এই রোগ সম্পর্কে জানা এবং এর প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পৃথিবীতে প্রায় ৪ কোটি মানুষ শরীরে এইডসের জীবাণু বহন করে চলেছেন এবং একে নিয়েই বেঁচে আছেন, কিন্তু তার মধ্যে প্রায় ১ কোটি লোকের কোনো ধারণাই নেই যে, তাঁদের শরীরে এই ঘাতক ভাইরাসটি রয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘সারা বিশ্বের ঐক্য, এইডস প্রতিরোধে সবাই নিব দায়িত্ব (Global Solidarity, Shared Responsibility)
এইডস এর পুরো নাম হচ্ছে একোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েনসি সিনড্রম। যার অর্থ হচ্ছে দুর্বল শারীরিক রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা যা রোগী নিজেই অর্জন করেছে। এইডস রোগটির জীবাণুই হচ্ছে ভাইরাস। এই ভাইরাসের সংক্ষিপ্ত নাম এইচআইভি। যার পুরো নাম হলো হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাস। এই ভাইরাস এক প্রকার জীবাণু যা ব্যাকটেরিয়া থেকেও ছোটো এবং সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা যায় না।
বিশ্ব জুড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে এখনো এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। যন্ত্রণাদায়ক অকাল মৃত্যুই হচ্ছে এ ঘাতক রোগে আক্রান্তদের শেষ পরিণতি। প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে বিশ্ববাসী এ রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কগ্রস্ত। কারো শরীরে এইচআইভি আছে কি-না তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। শুধুমাত্র রক্ত পরীক্ষা করে এ ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এইডসের ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ হওয়ার কত বছর পর এইডস হবে তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। কায়েক মাস কিংবা ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই রোগ দেখা দিতে পারে। তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৭৫ জনের ১০ বছরের মধ্যেই এইডস হয়েছে।
এই নিরব ঘাতকের জন্ম কোথায়, কিভাবে তা নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীদের মধ্যে চলছে বিতর্ক। তবে গবেষণা করে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে যে, পঞ্চাশের দশকে আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র কৃষক শ্রেণির মধ্যে প্রথম এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এরপর ষাট ও সত্তরের দশকে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও কিছু কিছু এইডসের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। কোনো-কোনো গবেষকের মতে মধ্য আফ্রিকার এক প্রকারের সবুজ বানরের দেহে সর্বপ্রথম এইডস বা এইচআইভি ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা যায়।
১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম এ ঘাতক রোগটি শনাক্ত করা হয়। ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু নিউমোনিয়ার রোগী পাওয়া যায় যার কারণ নিউমোসিস্টিস ক্যারিনিয়াই নামক একটি জীবাণু, যার বর্তমান নাম নিউমোসিস্টিস জিরোভেসি। পরে আফ্রিকায় প্রাদুর্ভাব ঘটে ক্যাপোসিস সারকোমা নামক একটি টিউমারের। এ টিউমার থেকেই রোগটি শনাক্ত করা হয়। মারণব্যাধি এইডসের উৎপত্তি ভূমি চিহ্নিত করার দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯২০ এর দশকে কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায় (তৎকালীন লিওপোন্ডভিল) অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারের ফল হিসেবে এইডসের সৃষ্টি হয় বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে। কিনশাসায় লাগামহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত যৌনাভ্যাসই এইডস সৃষ্টির মূল কারণ।
প্রকৃতপক্ষে এইডসের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষণ নেই। দেশ ও স্থানভেদে এইডসের লক্ষণের পার্থক্য দেখা যায়। এইডসের কিছু সাধারণ লক্ষণ যেমন অনেকদিন বা বার বার জ্বর হয় কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, অতিরিক্ত অবসাদ, শরীরের ওজন দ্রুত হ্রাস পাওয়া, লিম্ফগ্রন্থি ফুলে ওঠা, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাড়ের জয়েন্টগুলো ফুলে থাকা, ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া যেমন যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবের প্রদাহ। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ডায়রিয়ার সমস্যা যা স্বাভাবিক চিকিৎসায় কোনোক্রমেই ভালো হয় না, দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা কমে যাওয়া, তীব্র মাথাব্যথা ইত্যাদি। তবে কারও মধ্যে এসব লক্ষণ দেখা দিলেই তার এইডস হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণ দেখা দিলেই বিলম্ব না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
অসচেতনতা, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, সুস্থ জীবনের অনুশীলন না করাটাই এ রোগের প্রধান ঝুঁকি। সুনির্দিষ্টভাবে যেসব উপায়ে এইচআইভি ছড়াতে পারে তা হলো- এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত রোগীর রক্ত বা রক্তজাত পদার্থ অন্য কোনো ব্যক্তির দেহে পরিসঞ্চালন করলে; আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক ব্যবহৃত টুথব্রাশ, সুচ, সিরিঞ্জ, ছুরি, ব্লোড বা ডাক্তারি কাঁচি সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত না করে অন্য কোনো ব্যক্তি ব্যবহার করলে; আক্রান্ত ব্যক্তির অঙ্গ অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে; এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত মায়ের মাধ্যমে (গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে বা সন্তানের মায়ের দুধ পানকালে); অনৈতিক ও অনিরাপদ বা কনডম ছাড়া যৌনমিলন করলে; সমকামী, বহুগামী ব্যক্তি এবং বাণিজ্যিক ও ভাসমান যৌনকর্মীর সঙ্গে অরক্ষিত যৌনমিলনের মাধ্যমে; যুবসমাজের মধ্যে নেশার আধিক্য এবং একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে বার বার মাদকদ্রব্য গ্রহণ; এইচআইভি আক্রান্ত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিবিড় ভৌগোলিক অবস্থান, দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা এবং এভাবেই বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়ায় উপরোক্ত উপায়ে এইচআইভি ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে; শ্রমিক অভিবাসন ও মানব পাচারের ফলে এইডস আক্রান্ত জনগণের দেশে গমনাগমন এ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়; সর্বোপরি এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা ও তথ্যের অভাবে রোগটি ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।
কিছু কিছু বিষয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকে এইডসের বিস্তার নিয়ে। যেসব ক্ষেত্রে এইচআইভি ছড়ানোর সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তা হলো- বায়ু, পানি, খাদ্য, মশা, মাছি বা পোকামাকড়ের কামড়ে; এইডস রোগীর ছোঁয়ায় বা স্পর্শে, হাঁচি, কাশি, থুথু বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে, করমর্দন, একই ঘরে বসবাস, মেলামেশা, চলাফেরা ও খেলাধুলা করলে; আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত পায়খানা, বাথরুম, বেসিন, থালাবাসন, গ্লাস, বিছানা, বালিশ ইত্যাদি ব্যবহার করলে; এইডস রোগীর চিকিৎসায় কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও ঝুঁকিমুক্ত; হাসপাতালে এইডস আক্রান্ত ভর্তি রোগীর আশপাশে অন্য রোগীদের ছড়ানোর ঝুঁকি নেই।
একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে এর থেকে নিস্তার পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। তাই এইচআইভি সংক্রমণের উপায়গুলো জেনে এর প্রতিরোধই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এইডস প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তা হলো- প্রয়োজনে অন্যের রক্ত গ্রহণের আগে রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি আছে কিনা পরীক্ষা করে নেওয়া; অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও অবশ্যই এইচআইভি পরীক্ষা করে নিতে হবে; ইনজেকশন নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবারই নতুন সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার করা এবং অন্যের ব্যবহৃত সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার না করা; অনিরাপদ যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা, যৌন মিলনের সময় অবশ্যই কনডম ব্যবহার করা; এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত মায়ের সন্তান গ্রহণ বা সন্তানকে বুকের দুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া; ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে মেনে চলা; জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিরোধমূলক তথ্য নিয়মিত প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন ও এইডস প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ছাড়িয়ে এশিয়া মহাদেশেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতোমধ্যে নাম লিখিয়েছে বিশ্বের প্রথম বৃহৎ এইডস রোগীর দেশ হিসেবে। প্রথম এইচআইভিতে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশের কম। এ সংখ্যাটি এইচআইভি সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর কারণে এইচআইভির ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে এখন পর্যন্ত ৭ হাজার ৩৭৪ জন শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ১০৫ জন।
বাংলাদেশে ১৯৮৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৭ হাজার ৩৭৪ জন এইচআইভি/এইডস রোগী শনাক্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করেছে ১৭০ জন। দেশের ২৩টি জেলায় এইচআইভি রোগী বেশি শনাক্ত হওয়ায় সেসব এলাকাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে সরকার। বর্তমানে দেশের ২৮টি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১১টি সেবা সেন্টারে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। যার মধ্যে ৪টি সরকারি হাসপাতাল থেকে এইডস আক্রান্ত রোগীদের বিনামূল্যে ঔষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে মাসে একজন এইডস রোগীর পিছনে সরকারের খরচ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
সরকার প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) এইচআইভি/এইডস বিষয়ক লক্ষ্য অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ হতে এইডস রোগটি নির্মূল করার জন্য জাতিসংঘের নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই সরকারের পাশাপাশি আমরা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা এইডস নির্মূল করতে সক্ষম হব।
এই মারণব্যাধি এইডসের হাত থেকে বাচাঁর জন্য সকলকে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করে তুলতে হবে। শুধু অসচেতনতার কারণে আমাদের দেশে এইডসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইডস প্রতিকারের ব্যবস্থা যেহেতু এখনো অজ্ঞাত, সেহেতু প্রতিরোধই হবে এইডস থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ। প্রতিরোধের জন্য সৃষ্টি করতে হবে ব্যাপক গণসচেতনতা। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সবশেষে প্রতিপাদ্যের সুরে বলতে হয়, আসুন ঐক্যের হাত তুলি, এইচআইভি প্রতিরোধ করি। এইচআইভি প্রতিরোধে জানা ও শোনার বিকল্প নেই, একে নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করার জন্য কাজ করতে হবে আমার, আপনার, আমাদের সবার।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১১:১১ পিএম, ০৮ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৪:০০ পিএম, ০৫ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
আজকাল গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগনের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, অনিয়ম, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি নিয়ে প্রায়শঃ খবর প্রকাশিত হতে দেখছি। আমিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কোন কোন গণমাধ্যমের খবরে আমার নামটিও রয়েছে। সে প্রেক্ষিতে এই লেখা। লেখাটির শিরোনাম কি দেব বুঝতে পারছি না। অগত্যা ‘একজন উপাচার্যের কৈফিয়ত’ এই নাম দিয়েই লেখাটি শুরু করলাম।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেয়ার পর পরই ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমার দায়িত্ব পালনের প্রথম দিকে প্রায় এক/দেড় বছর ছিল করোনাকাল। সে সময় আমি ও আমার স্ত্রী দু’জনই দু’বার করোনা আক্রান্ত হয়েছিলাম। করোনাকালে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ন্যয় এই বিশ্ববিদ্যলয়েও কম-বেশী সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও উপাচার্যের অফিস চলতো প্রায় স্বাভাবিক সময়ের মত। এসময়ে আমাদের প্রধান চেষ্টা ছিল অনলাইন এবং পরবর্তীতে অনলাইন-অফলাইন সমন্বিত মোডে কি করে ক্লাস-পরীক্ষা চালু রাখা যায়। আমার একটি তৃপ্তির অনুভূতি যে, তখন থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষনা কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে অব্যহত রয়েছে; নানারকম প্রতিকুলতা সত্বেও ক্লাস-পরীক্ষা একদিনের জন্যও বন্ধ থাকেনি কিম্বা তেমন কোন অস্থিরতাও তৈরী হয়নি।
গত এক/দেড় বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করেছে। এখানে বিশেষ করে কিছু সংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন যাঁরা কম-বেশী সব আমলে উপাচার্যের প্রীতিভাজন হয়ে প্রশাসনকে কব্জায় নিয়ে নিজেদের মত করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে চান। এমনটি না হলে সাধারনতঃ কোন উপাচার্যই তাঁদের মেয়াদ পূর্ণ করতে সক্ষম হন না। জন্মকাল থেকে ১৩ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত এক/দু’জন উপাচার্য কেবল মেয়াদ শেষ করতে পেরেছেন। যাহোক এই শিক্ষকগণের কেউ কেউ সুবিধা করতে না পেরে অন্তত এক-দু’জন শিক্ষক আমাকে এমনও বলেছেন যে, পূর্বে কম-বেশী সকল উপাচার্য তাদের নিয়ে চলেছেন, অথছ আমার সময়ে তিনি/তারা একটু ঝাড়ুদারের দায়িত্বও পাচ্ছেন না। এরপর থেকে দিনে দিনে শুরু হয়েছে অনলাইন ও বিভিন্ন ডিজিটাল প্লাটফর্মে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার আর অপপ্রাচারের প্লাবন। একটি একটি করে তা’ পাঠকের জন্য তুলে ধরতে চাই।
প্রায় দেড় বছর পূর্বে হঠাৎ করে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ভ্যানে মাইক লাগিয়ে আমার কণ্ঠ-সাদৃশ্য বাক্যাংশের একটি অডিও বাজিয়ে কে বা কারা প্রচার করতে থাকে যে, উপাচার্য হিসেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বানিজ্য করছি। মূলত : ঘটনাটি ছিল এমন যে, ওই সময়ে শিক্ষক শুন্য একটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল। সেখানে মাত্র তিনটি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল এবং নিয়োগ পরীক্ষায় দু’জন প্রার্থী উপস্থিত হয়েছিলেন। আমরা প্রার্থী স্বল্পতার জন্য ওই পরীক্ষা বাতিল করে পুনঃবিজ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত নেই। এর কয়েকদিন পর আমি আমার এক ছাত্রকে (যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও বটে) অনুরোধ করি যে, তোমরা ঢাকায় থাকো, আমাদের শিক্ষক দরকার। তুমি আমাদের একটু সাহায্য করো- তোমার বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতজনদের বলো তারা যেন এখানে দরখস্তকরে। উত্তরে সে জানায় যে, স্যার ওখানে কেউ যেতে চায় না। তাছাড়া একটা দরখস্ত করতে গেলে ৫/৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়-তাই কেউ দরখস্ত করতেও উৎসাহি হয় না। আমি তখন জবাবে বলি-ওরা তোমাদেরই বন্ধুবান্ধব, প্রয়োজনে টাকা পয়সা দিয়ে সহায়তা করে তাদের দরখস্তকরতে একটু উদ্বুদ্ধ করো। এই কথোপকথনের ‘টাকা-পয়সা দিয়ে’ এই বাক্যাংশটুকু নিয়ে কিভাবে তারা একটি অডিও বানিয়ে প্রচার আরম্ভ করে যে, উপাচার্য নিয়োগ বানিজ্য করছেন। শুনেছি এভাবে তারা একাধিক অডিও [যা’ শুধুমাত্র একজন অর্থাৎ আমার কন্ঠ সাদৃশ্য এবং তা’ মিথ্যা, বানোয়াট, খÐিত, এক পক্ষীয় (অন্য প্রান্তে কে কি বলছেন তার কোন হদিস নেই) এবং হয়তোবা সুপার এডিটেড] বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে উপাচার্যকে কিভাবে হেনস্থা করে তাদের অপ-ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করানো যায় সে চেষ্টাই তারা অনবরত করে যাচ্ছে।
আমি আমার কণ্ঠ সদৃশ্য আরও একটি অডিও’র বক্তব্য শুনেছি। এটিও ছিল এক পক্ষীয় এবং খÐিত। আমার আলাপন সেখানে পূর্ণাঙ্গ নেই। অপর প্রান্তে কে কথা বলছেন তারও কোন অস্তিত্ব নেই। অডিও’র বিষয়টি হলো-আমি কোন একজনকে বলছি যে, ‘আপনার নির্দিষ্ট প্রার্থীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবেন’ ....................আমি দেখবো। সাধারণত: কোন নিয়োগের আগে অনেকেই অনুরোধ করেন যাতে তার প্রার্থীকে যেন একটা চাকুরী দেয়া হয়। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিগণ অথবা কোন রাজনীতিক/সামাজিক ব্যক্তিত্ব ১টি পদের জন্য কখনও কখনও ৩/৪ জন প্রার্থীর রোল নম্বর পাঠিয়েও এ ধরনের অনুরোধ করেন। ধরা যাক, এদের মধ্যে একজনেরই চাকুরিটি হয়েছে। অধিকাংশ সময়ে সে ফিরে গিয়ে তার জন্য অনুরোধকারীকে সুখবরটি জানায় কি-না তা’ আমার জানা নেই। কিšদ প্রায়শ এমনটি ঘটে যে, বাকী যাদের চাকারী হয় না তারা গিয়ে তাদের স্ব-স্ব নেতা বা অনুরোধককারীকে এই বলে বিষিয়ে তোলে যে, উপাচার্য আপনার অনুরোধের কোন দামই দিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে মন খারাপ করে জনপ্রতিনিধিগণ বা রাজনৈতিক/সামাজিক নেতৃবৃন্দ টেলিফোন করে আমাকে হয়তো বলে থাকেন-আপনি আমার একটা অনুরোধ রাখলেন না। এমতপরিস্থিতিতে আমাকে জবাব দিতে হয় যে, এরপর তাহলে আপনার সুনির্দিষ্ট প্রার্থীকে আমার সাথে দেখা করতে বলবেন ............. আমি দেখবো। এই ‘দেখা করতে বলা’ কি নিয়োগ বানিজ্যের সাথে যায়? এভাবে একটি গোষ্ঠী কেবলই মিথ্যাচার করে উপাচার্য হিসেবে আমাকে নাজেহাল করার অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে আমি নতি স্বীকার করে তাদের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করি। মিথ্যার কাছে নতি স্বীকার করে চেঁচে থাকার ইচ্ছে বা অভিপ্রায় আমার নেই।
আমার বিরুদ্ধে না-কি অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণ কাজে আমি অতিরিক্ত কাজ দেখিয়ে ৬ থেকে ৮ কোটি টাকার বিল বানিয়ে অর্থ-আত্মসাৎ করেছি বা করার চেষ্টা করেছি। রুচিহীন এবং উদ্ভট এসব অভিযোগের জবাব দিতেও আমি ইতস্তবোধ করছি। উল্লেখ্য নির্মাণ কাজের বাস্তব অগ্রগতি পরিমাপ করে ৩/৪ মাস অন্তর পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর বিল ঠিকাদারের প্রদান করা হয়। এই কাজে বিভিন্ন পর্যায়ে সাইট ইঞ্ছিনিয়ার-সহকারী ইঞ্জিনিয়ার-নির্বাহী বা তত্ত¡াবধায়ক ইঞ্জিনিয়ার-প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক প্রমুখ কর্তৃক পরীক্ষিত ও নীরিক্ষিত কাজের পরিমাপ এবং প্রস্তাবিত বিল ঠিক থাকলে তা’ চলে যায় ট্রেজারার মহোদয়ের কাছে। তখন তাঁর নেতৃত্বে গঠিত ভিজিলেন্স টিম সরেজমিনে সাইট পরিদর্শন করে সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে তা’ উপাচার্যের নিকট অনুমোদনের জন্য উপাস্থাপন করা হয়। বর্নিত ক্ষেত্রে আমার নিকট ফেবরিকেটেড ওই বিল অনুমোদনের জন্য কোন ফাইলই উপস্থাপিত হয়নি। বরং ৪/৫ মাস পূর্বে আমার দপ্তরে একটি বেনামী চিঠি আসে যে, নির্মান কাজ বেশী দেখিয়ে আট কোটি টাকার একটি বিল প্র¯দত করে তা’ প্রক্রিয়া করা হয়েছে। এই চিঠির সাথে ফটোকপিকৃত কিছু ডকুমেন্ট ছিল যা’ দেখে অভিযোগের সত্যতা থাকতে পরে বলে আমার কাছে মনে হয়েছিল। আমি তাৎক্ষনিকভাবে এই চিঠির ভিত্তিতে একজন সিন্ডিকেট সদস্যকে আহবায়ক এবং খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। ইতোমধ্যে কমিটি তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছে। পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় তা’ উপস্থাপিত হবে এবং সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে উপচার্য হিসেবে আমি কি দূর্নীতি করেছি আশাকরি পাঠকবর্গ তা’ উপলব্ধি করতে পারছেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে দু’একটি অনলাইন পত্রিকায় নিউজ করানো হচ্ছে যে, প্রকল্প সাইটে মাটির নিচে পাইলিং এর জন্য যে রড ঢোকানো হয়েছে সেখানেও না-কি উপাচার্য হিসেবে আমি দূর্নীতি বা অনিয়ম করেছি। যেকোন নির্মাণে পাইলিংয়ের জন্য মাটির নিচে রড কতটুকু ঢুকাতে হবে তা’ নির্ভর করে সয়েল টেস্ট রিপোর্টের উপর। আমি উপাচার্য হিসেবে যোগদানের বহু পূর্বেপ্রকল্পটি অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সয়েল টেস্ট করে প্রকল্প দলিল প্রনীত ও অনুমোদিত হয়েছিল।
আমার সময়ে এসে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর যখন পাইলিং আরম্ভ হয় তখন সংবাদকর্মীদের মাধ্যামে আমি জানতে পারি যে, প্রকল্প দলিল অনুযায়ী মাটির নিচে যে পর্যন্ত রড ঢোকানোর কথা (ধরা যাক ৫০’) তার চেয়ে কম গভীরতায় রড ঢুকিয়ে পাইলিং এর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আমি সাথে সাথে প্রধান প্রকৌশলীকে বিষয়টি দেখতে বলি এবং ভিজিলেন্স টীম পাঠিয়ে তাদের ব্যবস্থা নিতে বলি। ভিজিলেন্স টীমের সদস্য এবং ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসের কর্মকর্তাগণ আমাকে এসে রিপোর্ট করেন যে, সয়েল টেস্টিং এর ভিত্তিতে যেভাবে পাইলিং এর রড প্রকল্প অনুযায়ী মাটির নিচে ঢোকানোর কথা বাস্তবে তা’ ঢোকানো যাচ্ছে না। রড ঢুকছে তার কম (কম-বেশী ৪০’)। এ পর্যায়ে সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে পুনরায় সয়েল টেস্ট ও তা’ ভেটিং করিয়ে টেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী সেই গভীরতায় রড ঢুকিয়ে পাইলিং এর কাজ করা হয়েছে। এই বিষয়টি প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির (যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, আই এম ই ডি, ইউ জি সি-র প্রতিনিধিগণ থাকেন) সভায় অবহিত করা হয়েছে। এখানে উপাচার্য কিভাবে রড কম গভীরতায় ঢুকিয়ে দূর্নীতি বা অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন সে বিবেচনার ভার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম।
আমি প্রায়শঃ শুনি যে, আমার বিরুদ্ধে না-কি আরও একটি অভিযোগ যে, আমি অবৈধভাবে কর্মকর্তাদের উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদান করেছি। বিষয়টি আমি নিচেয় ব্যাখ্যা করছি। তার আগে বলে রাখা দরকার যে, এটি ডেপুটি এবং এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার পর্যায়ের সকল কর্মকর্তার জন্য একটি আর্থিক সুবিধা প্রদানের বিষয়। এটি প্রদানের ক্ষেত্রে আর্থিক নিয়মের কোন ব্যত্বয় ঘটলে ইউ জি সি অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বছরে একাধিকবার অডিট করেন তারা আপত্তি উত্থাপন করতে পারেন। কিন্তু উপাচার্যের দূর্নীতির উপাদান এখানে কি থাকতে পারে তা’ আমার বোধগম্য নয়।
ঘটনাটি ছিল এমন যে, ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পূর্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি এবং এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে একধাপ উচ্চতর স্কেলে বেতন উন্নীত করে তা’ প্রদান করা হতো। ২০১৫ সালের বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পর এই সুযোগ রহিত করা হয়। আমি ২০২০ সালের শেষ দিকে করোনাকালে যখন এখানে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করি তার কয়েকদিনের মধ্যে ওই পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি অংশ এসে আমার সাথে দেখা করে দাবী জানায় যে, এই স্কেল উন্নীতকরণ ঘটবে উপ-রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রার পর্যায়ের সকল কর্মকর্তার ক্ষেত্রে। কিšদ পূর্বের প্রশাসন ২০১৯ সালে বেছে বেছে তাদের অনুগত কর্মকর্তাদের এই সুযোগ প্রদান করেছেÑ কাজেই অবশিষ্টদেরও এটি দিতে হবে। বিষয়টি নিয়ে ২০২২ সালের দিকে তারা একটি বড় আন্দোলন গড়ে তোলে এবং প্রায় ২ মাস ধরে কর্মবিরতি পালন করে। এক পর্যায়ে গিয়ে এবিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি দেখতে পায় এই সুবিধাটি ২০১৫ সালের পে-স্কেলের সময় রহিত করা হলেও ঢাকাসহ রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীর নগর, মওলানা ভাষানী বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি তখনও চালু রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সুবিধা পূর্বে অলরেডি কর্মকর্তাদের একটি অংশকে দেয়া হয়েছে এবং কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনও এই সুবিধা প্রদান বহাল রয়েছে। এই বিবেচনায় কর্মকর্তাদের আর একটি অংশ যাতে বঞ্চিত না হয় (অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার পরিস্থিতি) সেসব বিবেচনায় নিয়ে কমিটি বঞ্চিতদের জন্য স্কেল উন্নীত করণের সুপারিশ করে। এই সুপারিশ ফিন্যান্স কমিটি এবং সিন্ডিকেটে এই শর্তে অনুমোদন দেয়া হয় যে, এব্যাপারে ভবিষ্যতে কখনও যদি অডিট আপত্তি উত্থাপি হয় তাহলে এই উন্নীতকরণ বাতিল হবে এবং কর্মকর্তাদের দেয়া অর্থ ফেরত দিতে হবে। বিষয়টি সে সময় এভাবে ফয়সালা করা হয়েছে। এখানে উপাচার্য হিসেবে আমার দূর্নীতির জায়গাটি কোথায় তা’ আমার বোধগম্য নয়। আমি মনে করি এটি বড়জোর একটি অডিট আপত্তি/অনাপত্তির বিষয়। ব্যক্তি বা সামস্টিক দূর্নীতির সংগার সাথে এটি যায়-কি?
উপাচার্য হিসেবে আমার বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ সম্পর্কে দু’একটি অনলাইন পত্রিকা এবং নষ্ট-ভ্রষ্ট ওই গোষ্ঠীর প্রচার-প্রপাগাÐা থেকে জেনেছি যে, আমি আমার ঢাকার বাসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় সিকিউরিটি নিয়োগ দিয়েছি। এটি সর্বৈব মিথ্যা রটনা। ঢাকায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রেস্ট হাউজ রয়েছে। সেখানে মাত্র ২ জন কর্মী (একজন কুক, একজন সাধারণ) কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫/২০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা (কখনও কখনও তাদের পরিবার-বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য) ঢাকায় গিয়ে রেস্ট হাউজে অবস্থান করেন। উল্লেখ্য এসময়ে বেশ কয়েকমাস ধরে রেস্ট হাউজ ভবনের সংস্কার কাজ চলছিল। রেস্ট হাউজে ইবি পরিবারের সদস্যগণ দিনে-রাতে (কোন ধরাবাধা সময় নেই) যাতায়াত করেন। তাদের জন্য বার বার গেট খোলা এবং লাগানোর মত কোন জনবলই সেখানে ছিল না। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী স্থায়ী জনবল নিয়োগেরও তেমন কোন সুযোগ ছিল না। সেসময় এস্টেট অফিস থেকে আমাকে জানানো হয় যে, ঢাকা রেস্ট হাউজে কিছু সিকিউরিটি ডেপুট (নিয়োগ নয়) করা দরকার। ইবি ক্যাম্পাসের কয়েকজন আনসার দিয়ে সেটা করা যায় কি-না সে ব্যাপারে এস্টেট অফিস আমাকে অবহিত করে যে, আনসার ডেপুট করা অনেক খরচের ব্যাপার এবং বারো জনের নিচেয় আনসার কর্তৃপক্ষ জনবল দিবে না। বিকল্প হিসেবে স্বল্প সংখ্যক (৫/৬ জন) জনবল বরং সিকিউরিটি সংস্থা থেকে ডেপুট করা যায়। সে অনুযায়ী যথাযথ বিধি বিধান প্রতিপালন করে ফিন্যান্স কমিটি এবং সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিয়ে ঢাকা রেস্ট হাউজের জন্য ছয়জন সিকিউরিটির সেবা হায়ার করা হয়েছে। উপাচার্য হিসেবে প্রায়শ আমাকে শিক্ষা মন্ত্রনালয়, ইউ জি সি, ধর্ম মন্ত্রনালয় (ইসলামী ফাউন্ডেশন), এ ইউ বি-র সভা এবং গুচ্ছের সভাসমূহে যোগাযোগসহ প্রভৃতি কারণে ঢাকায় যেতে হয়। সেকারণে শিফট অনুযায়ী সিকিউরিটি সদস্য যারা রেস্ট হাউজে ডিউটি করে তাদের একজন রেস্ট হাউজে এবং একজনকে উপাচার্যের বাসায় ডিউটি বন্টন করা হয়েছে মাত্র। উপাচার্যের বাসার জন্য কোন সিকিউরিটি সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়নি। উপাচার্যের বাসার জন্য সিকিউরিটি নিয়োগ দেয়া হয়েছে এটাও একটি মিথ্যা প্রচারণা।
প্রকৃতপক্ষ আমি জানিনা উপাচার্য হিসেবে আমার বিরুদ্ধে আর কি কি অভিযোগ রয়েছে? অভিযোগগুলো কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছে? অভিযোগগুলো কারা করেছে তা’ও আমার জানা নেই। যাহোক একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রচার প্রপাগান্ডার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ইউ জি সি-কে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করিয়েছে। কমিটির সদস্যবৃন্দ আমাকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে লিখিত মতামত/বক্তব্য দিতে বলেছিলেন। আমি তাঁদের নিকট লিখিত ভাবে (ডকুমেন্টসহ) আমার বক্তব্য প্রেরণ করেছি।
আশাকরি পাঠকবৃন্দ বিষয়সমূহ অবহিত হয়ে একজন উপাচার্যকে কিভাবে কেবল রসালো, মিথ্যা, বানোয়াট এবং বস্তনিষ্ঠহীন অভিযোগ তুলে তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা’ উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। উপাচার্য এবং ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমি শুধু এতটুকুই বলবোÑআমি কোন দূর্নীতি করে উপাচার্যের এই চেয়ারকে কলুসিত করিনি; আমি স্বার্থান্বেষী নষ্ট-ভ্রষ্ট কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করবো না।
অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম
উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
মন্তব্য করুন
মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার হয়েছে। দেশজুড়ে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
কেউ বলছে, মিল্টন যতটুকু ভাল কাজ করেছে, তাই বা কজন করে। আবার অনেকে বলছে, মিল্টন অনেক
ভয়ঙ্কর কিছু কাজ করেছে। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। আবার কেউবা বলছে, মিডিয়ার
লোকজন সত্য বলছে না। যা বলছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব দেখে শুনে আমরা আম জনতা দিকবিদিকহীন।
দিশা খুঁজে পাই না। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা, তা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছি। সত্য
মিথ্যা খোঁজার দায়িত্ব আম জনতার না। সেসব খুঁজবে আইনের লোকজন। মিল্টন সমাদ্দার এখন
আইনের লোকের হাতে। তাতেই আম জনতার স্বস্তি। এবার নিশ্চয় জনতা জানতে পারবে কে সত্যি
আর কে মিথ্যা। মিল্টন নাকি মিডিয়ার লোকজন?
আইনের লোকজন চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যেন জনতাকে জানিয়ে দেয়, মিল্টন
যা করছে, তা ঠিক করছে, নাকি বেঠিক করছে। যা করছে, তা কি মানবতার পক্ষে নাকি মানবতা
বিরোধী। আসলেই কি কিডনি বা অন্য অঙ্গ বিক্রি
করছে। নাকি সব ভাওতাবাজি। নাকি আয়নাবাজি। মিডিয়া যা লিখছে, তা কি সব ঠিক। নাকি বাড়াবাড়ি। এসব জানার
অধিকার জনতার রয়েছে। আশা করি দ্রুততম সময়ে জনতা তা জানতে পারবে। নাকি সাগর রুনিকে কে
বা কারা হত্যা করেছে, সে প্রশ্নের মত এসব প্রশ্নও আকাশে মিলিয়ে যাবে। নাকি বৈশাখের আগুন ঝরা তেতাল্লিশ উর্ধ
লসিয়াসে উদ্বায়ু হয়ে যাবে। মিল্টন যদি কোন অন্যায় করে থাকে, তার যেন বিচার হয়, শাস্তি
হয়। মিডিয়া যদি অসত্য তথ্য দিয়ে বাড়াবাড়ি করে থাকে, তারও যেন শাস্তি হয়। মিল্টনের গ্রেফতারের
মাধ্যমে এ সব কঠিন প্রশ্নের যেন সহজ উত্তর বেরিয়ে
আসে, এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।
পরিশেষে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে মিনতি, তারা যেন আশ্রমে আশ্রিতদের
আপাতত দেখভাল করেন। তাদের তিনবেলা যেন আহার জোটে। ওষুধ পথ্যের যেন ঘাটতি না হয়। মিলটনকে
বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে যেয়ে আশ্রিতরা যেন অন্ন, বস্ত্র বা চিকিৎসাহীনতায় কষ্ট
না পায়। সবার মনে রাখা প্রয়োজন, আশ্রিতরা তো কোন অন্যায় করেনি। সমাজ সেবা
অধিদপ্তর মিল্টনের অবর্তমানে আশ্রিতদের কদরের কোন কমতি করবে না,
সে প্রত্যাশা সকল আম জনতার।
পাদটীকা: আজকের অনলাইন পত্রিকাসমূহের একটি খবর। দেশের গণমাধ্যমে
ভুয়া খবরের সংখ্যা বেড়েছে ৩ গুণ। ২০২৩ সালে দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে মোট ৪৪টি ঘটনায়
ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর খবর প্রচার হতে দেখা গেছে। তাই সাধু সাবধান।
লেখকঃ প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪
মন্তব্য করুন
আজকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচন যেভাবে হয় তার সামান্যতম কোন ব্যতিক্রম হয়নি। ভোটাররা উৎসাহ নিয়ে ভোট দিয়েছে। কোথাও কোথাও অনেক ভোটার আছেন যারা মনে করেন যে, অমুকে তো অনেকে জনপ্রিয় প্রার্থী, তিনিই বিজয়ী হবেন। আমার ভোট না দিলেও হবে। এ রকম মনোভাব নিয়ে অনেকে ভোট দেয়নি। আর কিছু জায়গা আছে ছোট খাটো মারামারি হয়েছে। যা এদেশের স্থানীয় নির্বাচনের চরিত্র।
মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসের বাড়ি বিনা টাকায় বিক্রি করার জন্য কর্তৃপক্ষ আগ্রহী প্রার্থী পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমার মনে হলো যে, আমাদের একজন ভালো খরিদ্দার আছে এবং তার কাছে এই গোয়েবেলসের বাড়িটি বিক্রি করলে গোয়েবেলসের আদর্শটাও বেঁচে থাকবে এবং কর্তৃপক্ষেরও উপকার হবে। আর এ খরিদ্দার হচ্ছে বিএনপি এবং এবং লন্ডনে পলাতক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া বাড়িটি কিনতে পারেন। তিনি হচ্ছেন গোয়েবেলসের এই বাড়ির যোগ্য ব্যক্তি। কারণ তিনি গোয়েবেলসের ভাবশিষ্য।
আজকাল গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগনের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, অনিয়ম, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি নিয়ে প্রায়শঃ খবর প্রকাশিত হতে দেখছি। আমিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কোন কোন গণমাধ্যমের খবরে আমার নামটিও রয়েছে। সে প্রেক্ষিতে এই লেখা। লেখাটির শিরোনাম কি দেব বুঝতে পারছি না। অগত্যা ‘একজন উপাচার্যের কৈফিয়ত’ এই নাম দিয়েই লেখাটি শুরু করলাম।
মিল্টন সমাদ্দার গ্রেফতার হয়েছে। দেশজুড়ে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছে, মিল্টন যতটুকু ভাল কাজ করেছে, তাই বা কজন করে। আবার অনেকে বলছে, মিল্টন অনেক ভয়ঙ্কর কিছু কাজ করেছে। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। আবার কেউবা বলছে, মিডিয়ার লোকজন সত্য বলছে না। যা বলছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এসব দেখে শুনে আমরা আম জনতা দিকবিদিকহীন। দিশা খুঁজে পাই না। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা, তা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছি। সত্য মিথ্যা খোঁজার দায়িত্ব আম জনতার না। সেসব খুঁজবে আইনের লোকজন। মিল্টন সমাদ্দার এখন আইনের লোকের হাতে। তাতেই আম জনতার স্বস্তি। এবার নিশ্চয় জনতা জানতে পারবে কে সত্যি আর কে মিথ্যা। মিল্টন নাকি মিডিয়ার লোকজন?
প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শুরু হচ্ছে আগামী ৮ মে। নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ সভাপতি দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নির্দেশনা ছিল যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের পরিবারের সদস্য বা নিকটতম আত্মীয় স্বজনেরা প্রার্থী হতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। কোন প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে পারবেন না। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা দলের সাধারণ সম্পাদক বারবার নেতাকর্মীদের এবং মন্ত্রী-এমপিদের বলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য আওয়ামী লীগ সভাপতি দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার এই নির্দেশনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক বারবার বলার পরেও কেউ তা কর্ণপাত করলেন না। অথচ যারা এই নির্দেশনা মানলেন না তাদের অবস্থা এমন যে, যেন তারা শেখ হাসিনার জন্য জীবনও দিতে প্রস্তুত।