নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:০১ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১
জীবন-স্মৃতির ধূসর পান্ডুলিপির গায়ে ধীরে ধীরে অলক্ষে জমে উঠবে ধূলোর আস্তরণ। ক্রমেই অস্পষ্ট ঝাপসা হয়ে আসবে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অগনিত দৃশ্যপট। অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে সমস্ত পদচিহ্নের রেখা। প্রকৃতির এমন নিষ্ঠুর ও নৈর্ব্যাক্তিক শাসনের বাইরে গিয়ে জগতের একটি সৃষ্টিরও অবাধে বিচরণের কোন অবকাশ নেই। এ রীতি স্বাভাবিক, সতত-সত্য এবং চিরন্তন। কাজেই কিছু লিখে রাখা মানে কেবল ঘটনার নিরেট কোন বর্ণনা নয় বরং `সময়`কে ইতিহাসের ক্ষুদ্র অনুসঙ্গ রূপে আবদ্ধ করে রাখা। কারণ শেষ পর্যন্ত সময়ই হয়ে থাকে মুখ্য বিচারক।
১. মানুষটি মেজাজী ছিলেন। অনেকটা মরুভূমির বালির মতন। অল্পরোদে উত্তপ্ত এবং দ্রুত শীতল। ছিলেন একজন আগাগোড়া খাঁটি বাঙালি। তাঁর সাদাসিধে জীবনাচার, অপরিপাটি নিঃসংকোচ, নিঃসংশয় গতিবিধি সাধারণ মানুষের কাছেও প্রিয় এবং গ্রহনযোগ্য ছিল। সততা, আন্তরিকতা, দেশপ্রেমবোধ ও কঠোর পরিশ্রমের শেষ ফলাফলের বিচারে যে কোন ব্যক্তিই যে তাঁর নিজের কাঙ্ক্ষিত স্থানে বা আসনে উপবিষ্ট হতে সক্ষম হতে পারেন একজন প্রয়াত জননেতা এড.ছায়েদুল হক তার প্রকৃষ্ঠ প্রমান। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার দাবী, আন্দোলন-সংগ্রাম ও ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়েই উঠে আসা মানুষ তিনি। ষাটের দশকের শুরুর দিকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এলাকা থেকে পাঁচবার জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। শেষ জীবনে এসে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর বেশ ক`বার ভেবেছি মানুষটির সান্নিধ্যে থেকে সরকারি দায়িত্ব পালন করার সময় তাঁর মনোজগতের ভেতরে প্রবেশ করার যে যৎকিঞ্চিত সুযোগ আমার হয়েছিল তার খানিকটা বলে রাখলে মন্দ কী!
২. নির্বাচনী এলাকায় বিশেষ কোন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন বা জনসম্পৃক্ত কাজের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সবসময় তিনি জেলাপ্রশাসক হিসেবে আমাকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করতেন। এখন সময় হবে না, ঢাকা বা চট্টগ্রামে আমার মিটিং আছে ইত্যাদি বলে চেষ্টা করলেও তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। তিনি বলতেন, আপনি যেদিন সময় দিবেন সেদিনই অনুষ্ঠান হবে। অর্থাৎ এর দায় আমার কাঁধে এসে গেল। অনুষ্ঠানে যথারীতি উপস্থিত হওয়া চাই। তিনি ঢাকা থেকে সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে হাজির হন। আমিও যথাসময়ে থাকার চেষ্টা করি। একদিন দুপুরে আমি নাসিরনগর জেলাপরিষদ বাংলোয় পৌঁছে দেখি তিনি আমার অপেক্ষায় লোকজন নিয়ে অপেক্ষমান। দোতলায় গিয়ে সালাম দিতেই বললেন চলুন, মানুষগুলো হয়তো রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বলি ঠিকই, আজকে অনেক গরম পড়েছে। তাঁর পরনে কোট প্যান্ট। স্যুটের মতন বেশ মানানসই। দ্রুত নিচে নেমে তিনি তাঁর গাড়িতে আমি আমার। গ্রামের আঁকাবাকা পথে প্রায় আধাঘন্টা পরে অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছি। গাড়ি থেকে নেমে সোজা ওনার অনুগমন করছি। হঠাৎ চোখে পড়ে, তাঁর পায়ে ডাকবাংলোর বাথরুমের স্পঞ্জের পুরনো সেন্ডেল জোড়া । আমি এগিয়ে গিয়ে কানের কাছে বলি আপনার জুতাে কোথায়? তিনি অবলীলায় বলে উঠলেন, "তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে বাংলোয় ফেলে চলে আসছি। অসুবিধা নেই ডিসি সাহেব। এটা আমার গ্রাম, আমার মানুষজন, খালি পা থাকলেই বা কী"? সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা কর্মসূচিতে অংশ নিলেন এ সেন্ডেলজোড়া পরেই।
৩. আমাকে একবার প্রসঙ্গক্রমে বললেন, আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুভাই আপনাকে খুব স্নেহ করেন। জানেন, ছাত্র জীবন থেকে তিনি আমারও নেতা। আমার বিয়েরও সবকিছু তাঁর হাত দিয়ে। জানেন তো, তিনি কিন্তু জন্মগ্রহন করেছেন আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কাজেই স্কুল,কলেজ থেকেই আমাকে চিনতেন, আদর করতেন। তবে রাজনীতি জিনিসটা অনেক জটিল এবং কারও কারও ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যেরও কারণ। শুধু নির্বাচনের কারণে ওনার সাথে আমার জীবনে দুয়েক বার মনোমালিন্য হয়েছে। তবে তিনি সবকিছু জাতীয় নেতার দৃষ্টিতে বিবেচনা করেছেন। আমার কোন ক্লেদ বা অনুযোগ নেই। তিনি আমার আশৈশব নমস্য ব্যক্তিত্ব।
৪. দুর্যোগ ব্যবস্হাপনা অধিদপ্তরের আওতায় নির্মিত কোন একটা স্হাপনা উদ্বোধনের নিমিত্ত তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকার দূরবর্তী প্রান্তের ইউনিয়ন ধরমন্ডলে যাবেন। বর্ষাকাল। বাহন নৌকা। সফরসঙ্গীরা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মী। এড. ইকবাল আহমেদসহ আরও দু`জন। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সোজাসুজি নাসিরনগর সদর ছাড়িয়ে ফান্দাক পৌঁছে যাই। সেদিনও এম.পি মহোদয় প্রস্তুত ছিলেন। স্হলভাগ থেকে ধরমন্ডল ৮/৯ কিঃ মিঃ হবে। নৌকায় আমরা চারজন। যাত্রালগ্নেই তিনি বললেন, ডিসি সাহেবকে হাওরের বোয়াল মাছ খাওয়াতে হবে। একটু এগিয়েই বিস্তীর্ণ হাওরের দিগন্ত উন্মোচিত গাঢ় সবুজের হাতছানি। নানা গল্পকথার ঝাঁপি খোলে দেয়া হল। অতীত স্মৃতি রোমন্থন এ অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রাম, বর্ষা,বন্যা, খরা, দুর্যোগ দুঃসময়ের ইতিকথার যেন শেষ নেই। নৌকা চলছে হেলেদুলে। বর্ষার রাড়ন্ত জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা আমন ধানের সবুজ ডগায় মাঝে মধ্যে হাত বুলিয়ে আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমার শৈশবের সোনালি দিনে। ভাবছিলাম, আমি আমাদের ধান ক্ষেতে বাবা- চাচাদের সাথে সেই নৌকায় যেন আছি। একই দৃশ্য একই চোখে ছেলেবেলায় আমি দেখেছিলাম আমার গ্রামের সামনের হাওরে। এখন এ ধান কেউ বুনে না পরিমাণে কম ফলন বলে এর কোন কদর নেই মূল্য নেই। বলা যায় স্রেফ মানুষের হাত দিয়েই এমন প্রকৃতির দান ফসল অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। আমরা যথাসময়ে পৌঁছে যাই। অনুষ্ঠানস্হলও পূর্ণতা পেয়েছিল স্হানীয় একদল সরল জনতার উপস্থিতিতে। ফিতা-কাটা, আলোচনা, বক্তব্য পর্বের সমাপ্তিতে খোলা হাওয়ায় বেশ স্বস্তিবোধ হচ্ছিল। মধ্যান্হভোজের সাজানো টেবিল। আয়োজনও নজরকাড়া। বোয়াল মাছের বাঁকা লেজ দেখে আমি বললাম একি, এম.পি মহোদয় নৌকায় বসে কেবল একবার বললেন, তাতেই হয়ে গেল। তিনি মুচকি হাসলেন, তাঁর দু`চোখের আলোয় তৃপ্তির রেখা।
৫. তিনি তখন পূর্ণমন্ত্রী। আমি বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব। পদোন্নতি পরবর্তী সৌজন্য সাক্ষাৎ বৈ অন্য কিছু কারণ নয়। তিনি সভায় আছেন জেনে বেলা দুটোর পরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে হাজির হলাম। মিডিয়া তথা সাংবাদিকসহ বেশ ক`জন অতিথি নিয়ে কথা বলছেন। আমার দিকে তাকিয়েই- আজ আলোচনা এখানেই শেষ। আমাদের ডিসি সাহেব আসছেন। ওনার সাথে জরুরি আলাপ আছে। উপস্হিত দুয়েক জন বোধকরি ভাবছিলেন, এ লোকটা এতোদিনে ডিসি হলেন মাত্র ? যাক্ বলতে বলতে খাবার টেবিলে বসেই আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি বললাম, স্যার আমি লাঞ্চ করেই এসেছি। তিনি খাচ্ছেন আর কথা বলছেন। আমি চা পান করছি। সেদিন এমনকি আমার পারিবারিক খোঁজ-খবরও নিলেন। লক্ষ্য করছিলাম তিনি আগের মতনই কাঁচা লবন বেশি করে খাচ্ছেন। আমি বললাম, এতে ক্ষতি আছে স্যার। তিনি নিরুদ্বেগে বললেন, দীর্ঘদিনের অভ্যেস তো, আর কত ক্ষতিকর হবে? যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাত্মা গান্ধীকে বলেছিলেন, "তেলেভাজা লুচিতে বিষ আছে বটে তবে এর অ্যাকশন খুব স্লো কারণ গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমি তা খাচ্ছি"।
বছর চার আগে বিজয় দিবসের আনন্দঘন ১৬ ডিসেম্বর তারিখেই চলে গেলেন তিনি। আর কখনো ফিরে না আসার অচেনা ভুবনের বাসিন্দা এখন তিনি।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৮:১৫ এএম, ১৬ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৮:১২ এএম, ১৬ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৮:০৭ এএম, ১৬ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতে বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক অভাবনীয়, অনন্য এবং যুগান্তকারী একটি মডেল। শিশু স্বাস্থ্য, মাতৃ স্বাস্থ্য এবং কিশোরীদের স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। নবজাতকের মৃত্যু, মাতৃ মৃত্যু কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনুসরণ শুরু করেছে। গত বছর ১৭ মে কমিউনিটি ক্লিনিক ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিসিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়। ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ সারা বিশ্বের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রত্যাশী জনগণের জন্য ‘আলোক বর্তিকা’।
আজকে আমরা ১৭ মে নিয়ে কথা বলছি। যেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। আবার গত বছর এই দিনে তাঁর চিন্তা প্রসূত কমিউনিটি ক্লিনিককে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজকে আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, উন্নয়নশীল বাংলাদেশের কথা বলছি, যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি, একদিন উন্নত বাংলাদেশ হব বলে স্বপ্ন দেখছি এই সবকিছু শেখ হাসিনার স্বপ্ন, শেখ হাসিনার ইনিশিয়েটিভ। বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৭৮১ সালে পলাশি যুদ্ধে ইতিহাসের ঘৃণিত সেনাপতি মির্জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজ উদ্দৌলার বিদায়ের মধ্য দিয়ে ২০০ বছরের গোলামী আমাদের ললাটে এসেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও বাঙালী এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা পায়নি। যার পটভূমিতে বীরদর্পে আবির্ভূত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ থেকে ৭৫’ বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে স্বাধীনতার লাল পতাকা উড়েছিল বাঙালী আশায় বুক বেধেছিল।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিয়োগান্তের ঘটনায় জাতি ছিল দিক নির্দেশনাহীন। নারকীয় এই ঘটনায় জনগণ হয়ে পড়েন দিশেহারা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করার কোন শক্তি সাহস ছিল না। দলের অনেক বড় বড় নেতাও ছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ধানমন্ডির ৩২ বাড়ি ছিল কবরের নীরবতা। সমগ্র জাতি তখন অন্ধকারে। সামরিক বুটে পিষ্ঠ গণতন্ত্র। নির্বাসনে সংবিধান আর মানুষের মৌলিক অধিকার। বাক স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না। এমনকি বঙ্গবন্ধু নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের মৌলিক চরিত্রকেই বদলে ফেলা হয়। বিশেষ করে পাকিস্তানি ধারায় সামরিক শাসনের সংস্কৃতির প্রবর্তন ঘটে দেশে। সাম্প্রদায়িকতা ফিরে আসে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে। একের পর এক স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা ঘটতে থাকে দেশে। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। ঠিক এমন প্রতিকূল সময় ১৯৮১ সালের ১৭ মে সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তস্নাত মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন বাঙালির মুক্তির মহানায়কের যোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা।