ইনসাইড থট

শেখ রাসেল: অকালে ঝরা এক লালগোলাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২:১৫ পিএম, ১২ নভেম্বর, ২০২১


Thumbnail

‘আমি মায়ের কাছে যাব’। শেখ রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর মায়ের লাশ দেখে অশ্রু সিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন- ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রতুষ্যে হায়েনারুপী বিপদগামী একদল সেনা কর্মকর্তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শিশু শেখ রাসেলকেও হত্যা করে। হত্যার পূর্বে খুনীরা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত কর্মচারী আব্দুর রহমান রমাসহ শেখ রাসেলকে আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছিলেন, বাঁচার জন্য আকুলভাবে কাকুতি-মিনতি করছিলেন, কিন্তু পাষন্ড খুনীরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।

পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারে একজন নতুন অতিথির আবির্ভাব হয়। শেখ ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিবের কোলে হেমন্তের প্রহরে ভূমিষ্ঠ হয় ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান, আনন্দে উদ্ভাসিত পুরো শেখ পরিবার, খ্যাতিমান ব্রিটিশ লেখক ও দার্শনিক, নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে ছোট্ট শিশুটির নাম রাখা হয় রাসেল আর শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় তাঁর নাম হলো শেখ রাসেল। ১৮ অক্টোবর ২০২১, সরকারি উদ্যেগে প্রথমবারের মত ‘শেখ রাসেল দিবস’ উদযাপন করা হয় তাঁর আদর্শ, মানবিক গুণাবলি, মূল্যবোধ, আবেগ ও ভালোবাসা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য। দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ শেখ রাসেল, দীপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্ববিশ্বাস’ এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করাই ছিল উদ্দেশ্য।

শিশু শেখ রাসেলের গন্ডি ছিল বাবা মা, অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম মুজিব। একই সাথে তাঁর সময় কাটাতো দুইবোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং দুইভাই শেখ জামাল ও শেখ কামালের সাথে। সেই আদরের শিশুটির জীবন খুব ছোট পরিক্রমার মধ্যে বেড়ে উঠছিলো। যে রাসেল ছোটবেলা থেকে খেলার সাথীদের নিয়ে প্যারেড করতো, স্বপ্ন দেখতো সে বড় ভাই শেখ জামালের মতো সেনা অফিসার হবে। আজ বেঁচে থাকলে হয়তো সে সেনাবাহিনীর বড় অফিসার হতো। বেঁচে থাকলে আজ ৮ নভেম্বর ২০২১ তাঁর বয়স ৫৭ পেরিয়ে আরো ২০ দিন হতো। কিন্তু সে চিরদিন ১১ বছরের শিশু শেখ রাসেল হয়েই বেঁচে থাকবেন ইতিহাসের পাতায় ।

১৯৭২ সালে জাপানী চলচ্চিত্রকার Nagisa Oshima নির্মিত `Rahman, Father of Bengal` স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে জাপানি সাংবাদিক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় প্রশ্ন করেছিলেন-, ‘লক্ষ করছি একটি ছোট্ট ছেলে সবসময় আপনার চারপাশে ঘুরঘুর করে। ছেলেটি কে? কেন তিনি সবসময় আপনার চারপাশে থাকে?’

উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-,‘ছেলেটির বাবা সবসময়ই কারাগারে থাকতো। ফলে সে তার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি তার বাবা, তাই সবসময় তাকে কাছে রাখি।’

শেখ রাসেল, এক অনন্ত বেদনার কাব্য আলেখ্য। জেলজীবনে বঙ্গবন্ধুর দৈনন্দিন স্মৃতিকথা ‘কারাগারের রোজনামচা’  গ্রন্থেও তাকে নিয়ে লেখা আছে অনেক দুঃখগাঁথা। ১৯৬৬ সালের ৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-, ‘বাচ্চারা দেখতে চায় কোথায় থাকি আমি। বললাম, বড় হও, মানুষ হও, দেখতে পারবা।’ মায়ের কোলে চড়ে মাত্র দেড় বছর বয়সে বাবাকে একনজর দেখার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার যেতো শেখ রাসেল। তার কাছে জেলখানাটি ছিল আব্বার বাড়ি। ১৫ দিন পরপর বেগম মুজিব তার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে তাদেও আব্বার বাড়ি অর্থাৎ জেলখানায় যেতেন। শেখ রাসেল বাবাকে রেখে আসতে চাইতো না। কিন্তু একবুক ব্যথা নিয়ে প্রতিবার তাকে ফিওে আসতে হতো, বাবা থেকে যেতেন তার বাড়িতে। একটি শিশু ও একটি পরিবারের ক্ষেত্রে এই গল্পগুলো অনেক কঠিন। এটি একটি পরিবারের হাসি কান্না, সুখ-দুঃখ এবং সেই পরিবারের মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, প্রথমবারের মতো মুক্ত জীবনের স্বাদ পেলো শিশু শেখ রাসেল। ভর্তি হলো ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। কচিকাঁচার দলের সঙ্গে ছিল তার অবাধ মেলামেশা। সুস¤পর্ক ছিল শিক্ষক থেকে গৃহকর্মী, সবার সঙ্গে। জাতির পিতার সন্তান হিসেবে তার মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। স্কুলের গেট থেকে খানিকটা দুরে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে স্কুলে প্রবেশ করতেন যেন অন্য সতীর্থরা কষ্ট না পায়। বাড়ি থেকে দেওয়া টিফিন ভাগ করে খেতেন বন্ধুদের সঙ্গে।

শেখ রাসেলের জীবনকাল স্বল্প কিন্তু ঘটনাবহুল ও উদ্দীপনাময়। এ সময়ে তিনি কিছু লিখে যাননি বা বলে যাননি। কিন্তু তার দৈনন্দিন কর্মকান্ড ও আচার-আচরণ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বিশেষ করে শিশুদের। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে তিনি কোনো সুবিধা নেননি বা প্রকাশ করেননি। এ ব্যাপারে তাঁর প্রিয় ‘হাসু আপা’ অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক স্মৃতিচারণে তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া তাঁর গৃহশিক্ষক গীতালি দাশগুপ্তাও অনেক স্মৃতি রোমন্থন করেছেন।

২০১৯ সালে শেখ রাসেলের জন্মদিনের আলোচনা সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বন্দিখানায় থাকা অবস্থায় যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই যুদ্ধের সময় যখন আক্রমণ হতো, রাসেল পকেটে সব সময় একটু তুলা রাখতো। নিজের কানে দেওয়ার পাশাপাশি ছোট্ট জয়ের কানেও তুলা দিয়ে দিতো, যেন ওই আওয়াজে জয়ের কোনও ক্ষতি না হয়। রাসেল জয়ের প্রতি খুব খেয়াল রাখতো । সব সময়ই তার সেদিকে বিশেষ নজর ছিল।’ অপর এক আলোচনায় রাসেলের জীবনের ইচ্ছে এবং তার কোমল হৃদয়ের চাওয়া নিয়ে বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাসেলের খুব শখ ছিল সে বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে এবং সেভাবে কিন্তু সে নিজেকে তৈরি করতো। ছোট ছোট গরিব শিশুর প্রতি তার দরদ ছিল, যখন সে গ্রামে যেতো, গ্রামের অনেক শিশুকে সে জোগাড় করতো। সে কাঠের বন্দুক বানাতো। শিশুদের জন্য মাকে বলতো কাপড় কিনে দিতে হবে। মা ঠিকই কিনে দিতেন। বাচ্চাদের সে প্যারেড করাতো।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তি জীবনের অজানা-অদেখা গল্প নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘হাসিনা: অ্যা ডটারস টেল’-এ ছোট্ট রাসেল সম্পর্কে বলেছেন-, ‘রাসেল হওয়ার পরে আমরা ভাইবোনেরা খুব খুশি হই। যেন খেলার পুতুল পেলাম হাতে। ও খুব আদরের ছিল আমাদের। একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলতো। ওইটুকু একটা মানুষ, খুব স্ট্রং পার্সোনালিটি।’ শেখ হাসিনা রচিত আমাদের ছোট রাসেল সোনা বইয়ে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘আমাদের পাঁচ-ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রাসেল। ছোট্ট রাসেল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। মা রাসেলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সংসারের কাজ করতেন, স্কুল বন্ধ থাকলে তার পাশে শুয়ে আমি বই পড়তাম। আমার চুলের বেণি ধরে খেলতে খুব পছন্দ করতো ও। আমার লম্বা চুলের বেণিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতাম। ও হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হাসতো । কারণ, নাড়াচাড়ায় মুখে চুল লাগতো তাতে খুব মজা পেতো।’

অন্যদিকে শেখ রাসেলের গৃহশিক্ষক গীতালি দাশগুপ্তা তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন-, ‘পড়ানোর জন্য একটু নিরিবিলি জায়গা পাওয়া সহজ ছিল না। তদুপরি রাসেল ছিল দূরন্ত। পড়ানো শুরুর মাস খানেক পর শেখ হাসিনা একটি শাড়ি গৃহশিক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘রাসেলকে টানা এক মাস পড়াতে পারার জন্য এই নাও উপহার। এর আগে কোনো শিক্ষক এক মাস টেকে নাই।’

গীতালি দাশগুপ্তা বলেন, ‘একবার শেখ জামালের ঘরে পড়াচ্ছি। গৌতম বুদ্ধের একটি পিতলের মূর্তি দেখিয়ে তাঁর জীবনের নানা ঘটনা বলি। মহাপুরুষদের জীবনী খুব উৎসাহ নিয়ে শুনত। পরদিন পড়াতে গেলে বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, ‘মাস্টর, এত বড় সর্বনাশ করলি।’ স্বাভাবকিভাবেই শিক্ষক উদ্বিগ্ন হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছেলেকে কোনো ভুল শিক্ষা দিয়েছে কী? বঙ্গবন্ধু তাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, তুই গৌতম বুদ্ধের জীবন কাহিনী রাসেলকে বলেছিস? ও গত রাতে একটা পর্যন্ত জেগেছিল। আমি কাজ শেষে ঘুমাতে গেলে বুদ্ধদেব সম্পর্কে আরও জানতে চায়।’ এমন অদম্য কৌতূহল ছিল শেখ রাসেলের।

১৯৭২ সালের জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। সেখানে অস্ত্রোপচারের সময় পরিবারের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সুস্থ হলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বাজারে আসা নতুন সিনথেটিক শাড়ি কিনলে রাসেল বায়না ধরে তার শিক্ষকের জন্যও একটা কিনতে হবে। দুই বোন শাড়ি নিয়ে ফিরলে রাসেলের মনে হয় যে, তাঁর শিক্ষকের জন্য কেনা শাড়িটির চেয়ে দুই আপার শাড়ি সুন্দর। এ নিয়ে অভিমান করে, কান্নায় বুক ভাসায়। শিক্ষক শাড়ি পেয়ে খুব খুশি হয়েছে এটা জানানোর পরই কেবল রাসেলের মন ভাল হয়। শিক্ষকের প্রতি তার এই অগার শ্রদ্ধা ও  ভালোবাসা নতুন প্রজন্মের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।

শেখ রাসেলের হাসু আপু ১৫ আগস্টের ভয়াবহ কালরাতের মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই সুদূর জার্মানে স্বামীগৃহে চলে যান, সাথে আরেক বোন শেখ রেহানাও। হাসু আপু জার্মান যাওয়ার সময়, ‘আমি হাসু আপুর সাথে যাবো, দেনা আপুর সাথে যাবো’ বলে খুব কেঁদেছিল রাসেল। শেখ রেহানাকে ‘দেনা আপু’ বলে ডাকতেন শেখ রাসেল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও সেই হাসু আপুর কাছে যাওয়ার জন্যেই আকুতি-মিনতি করেছিল, মায়ের পর হাসু আপুকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করেছিলেন তিনি।

শেখ রাসেল দিবস ২০২১ উদযাপন উপলক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘শেখ রাসেল এর হাসু আপু স্বামীর কর্মস্থল জার্মানে গিয়ে ছোট ভাই রাসেলের পছন্দের খেলনা কিনেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজও ঐসকল খেলা সামগ্রী আগলে রেখেছেন।’

বাঙালি জাতির জাগরণকালে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে জন্মেছিল যে শিশু, জান্তাদের দানবীয় ষড়যন্ত্র তাকে নিয়ে গেছে ইতিহাসের ভাগ্যহত নক্ষত্রদের কাতারে। সেই দেবশিশুর নাম শেখ রাসেল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। বন্দি পিতার দীর্ঘ জেলজীবনের সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে মায়ের কোলে চড়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়মিত যেতো ছোট রাসেল। কিন্তু বেগম ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিবকে গোয়েন্দারা কোলের শিশু রাসেলকে নিয়ে জেরা করতেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেচ্ছা বিরুক্তি ও প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘বাপের পিছনে গোয়েন্দা লেগেছিল ২৮ বছর বয়সে, আর ছেলের পেছনে লাগলো দেড় বছর বয়সেই?`

ছোট্ট রাসেলের আর বড় হওয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে, বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মাত্র দশ বছর দশ মাস বয়সের এক নি¯পাপ শিশু, কী দোষ ছিল রাসেলের! সেই বিভিষীকাময় রাতে, ঘাতকরা যখন বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিলো, প্রাণে বাঁচার জন্য মিনতি জানিয়েছিল ছোট্ট রাসেল। মায়ের কাছে যাবে বলে যার আকুতি, গলা শুকিয়ে যাওয়া কান্না যার চোখেমুখে ছিল, ভয়ে থরথর করে যে কাঁপছিল তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে নরপিশাচদের একজন। বাঁচতে দিল না রাসেলকে, সীমারদের মনে বিন্দুমাত্র দয়ামায়া ছিল না।

সকলের এতো আদরের ছোট্ট শেখ রাসেল ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতের শেষ প্রহরে আতঙ্কিত হয়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকলে নরপিশাচরা, মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলে, গৃহকর্মী আব্দুর রহমান রমার হাত থেকে হেঁচকা টান দিয়ে শেখ রাসেলকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর মৃত্যু পর্যন্ত পরবর্তি সময়টুকু তাঁর কেমন কেটেছিল, কতটুকু মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক হয়েছিল তা ঐ ঘাতকেরাই জানে। তবে মনের চোখ দিয়ে যদি দেখি বা অনুমান করি তবে হয়তো এভাবে বলা যায়-, ‘মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার পথে রাসেল দেখলো সিঁড়িতেই পড়ে আছে তাঁর পিতার লাশ । হতভম্ব সে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এ কি করে হয়? স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বাঙালি জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ পরে আছে সিঁড়িতে? কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই হায়েনারা তাঁকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেল মায়ের কাছে। মায়ের লাশ দেখে, মায়ের নিথর বুকে আছড়ে পড়ে মা, মা বলে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে আর্তনাদ করেছিল সে। না, মায়ের কোন সাড়া শব্দ নেই। মা তাঁকে বুকে জড়িয়ে আদর করে বলেনি, ‘ভয় নাই বাবা। কিচ্ছু হবে না। আমিতো আছি তোমার কাছে’। মা-বাবার পর ঐ ছোট্ট শিশু দেখলো তাঁর বড় ও মেঝ ভাই ও ভাবীদের লাশ।’

আমরা পরিবারের একজন নিকটাত্মীয়র মৃত্যুতে ভেঙ্গে পরি, চাপা ব্যথা অনুভব করি, সেই ব্যথা প্রশমনে আর্তনাদ করি, নীরবে অশ্রু ত্যাগ করি। তাহলে শিশু শেখ রাসেল অল্পক্ষণের মধ্যে বাবা-মা সহ নিজ পরিবারের এতজন সদস্যের মৃত্যু এবং তাঁদের সারিসারি লাশ দেখে কী অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছেন? হয়তো ভেবেছেন, হাসু আপু, দেনা আপুর সাথে জার্মানি বেড়াতে গেলেই ভালো হতো। হয়তো ভেবেছেন, হাসু আপু আমাকে নিয়ে গেল না কেন? এমনি অবস্থায়ই হঠাৎ গর্জে উঠে ঘাতকের আগ্নেয়াস্ত্র, ঝাঁঝড়া হয়ে যায় শেখ রাসেলের বুক, ঘাতক বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সাঙ্গ করে দেয় তাঁর জীবন প্রদীপ ।

 

স্বল্প ফুটেই সুরভী ছড়াতে শুরু করেছিল যে ফুল, সেটি অকালে ঝরে যাওয়ার শোকে আজও প্রতি ভোরে বাঙলার মাঠে-ঘাটে অজস্র বকুল ফুটে, ঝরে শেফালী-হাসনাহেনা। ঝরা বকুলের প্রতিবিম্বে বাংলার প্রতিটি শিশুর প্রাঞ্জল হাসির শব্দ ভেসে ওঠে- ভেসে ওঠে রাসেলের মায়াবী মুখখানি, শিশুদের ভেজা কপোল ছুঁয়ে নামে রাসেলের চোখের পানি। এ পানিতে পবিত্র হয়ে বর্তমান প্রজন্ম শহীদ শেখ রাসেলের আদর্শ, মানবিক গুণাবলী, মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করবে, ব্যক্তি জীবনে বয়ে আনবে ইতিবাচক পরিবর্তন সেই প্রত্যাশা সকলের।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতের শেষ প্রহরে শেখ রাসেল আতঙ্কিত হয়ে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করেছিল, সে দৃশ্য কল্পনায় আমার নিবেদন নিচের কাব্য-কথা।

আমি মায়ের কাছে যাবো

তোমরা আমাকে মেরো না

আমি মায়ের কাছে যাবো

তোমরা আমার দুবাহু ছাড়ো

আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।

আমি ভোরের শিশির হবো

আগুনমুখার শুভ্র ঢেউ হবো

ধানের কচি ডগার বিন্দু হবো

স্নেহসুধায় বাংলাদেশকে ভরিয়ে দেবো।

তোমরা আমাকে মেরো না

আমি বন্ধুদের কাছে যাবো

নাড়ার আগুনে ছোলা পুড়িয়ে

বাংলার মাঠে বসে খাবো।

আজান দিয়েছে, ভোর হয়েছে

পড়াশোনার টাইম হয়েছে, স্কুলেতে যাবো

তোমরা আমাকে মেরো না

আমি আমার মায়ের কাছে যাবো।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ডা. এস এ মালেকও মুক্তিযোদ্ধা নন!


Thumbnail

১.

দেশে আসব শোনার পর থেকেই আব্বার একটাই প্রশ্ন, খুলনায় কবে আসব? খুলনায় গেলে প্রতিবার দু-তিনদিনের বেশি থাকা হয় না। এবার যাবার আগেই আব্বা বলেছেন, খুলনায় আমি যেন পাঁচ দিন থাকি। মা মারা যাবার পরে আমার প্রতি আব্বার নির্ভরতাটা অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আব্বা অনেকটা শিশুর মত হয়ে গেছেন। গতবার দেশে দিয়ে প্রথম দিকে আমি মূলত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনীগ্রন্থ লেখার কাজ করেছি। স্বভাবতই অধিকাংশ সময় লেখার কাজেই ব্যস্ত থাকতাম। এর মধ্যে ঠিক করলাম সাতই ডিসেম্বর সকালে খুলনা যাব। এখন পদ্মা সেতু হয়েছে। ঢাকা এয়ারপোর্টে গিয়ে বিমানে করে যশোরে পৌছে সেখান থেকে খুলনা যাওয়া বা মাওয়া হয়ে ফেরিতে চড়ে পদ্মা নদী পার হবার হ্যাপা নাই। ঢাকা থেকে যে কোন একটা ভাল কোচে উঠলেই চার-সাড়ে চার ঘন্টায় খুলনার বাসায়। ছয় ডিসেম্বর সারা দিন জুড়ে মাঝেমধ্যেই আব্বার ফোন, কাল কখন রওয়ানা দেব? 

২.

ছয় ডিসেম্বর রাত বারোটার দিকে লেখক-রাজনীতিবিদ রুদ্র সাইফুলের ফোন, মালেক চাচা আর নেই। আমি যেন খবরটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌছে দেই। আমার একটু খটকা লাগল। আগের দিনই স্যারের ছেলে, বন্ধু ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ডা. মামুনের সাথে কথা হল। মামুন বললো, ‘আব্বার অবস্থা এখন একটু ভালর দিকে।’ আর পরেরদিনই স্যার নেই! ডা. মালেক স্যারের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে আমি তখনি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং আরো দুজনকে জানালাম, যাতে তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই খবরটা পৌছে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বিপ্লব বড়ুয়া এসএমএস করে জানায়, তারাও খবরটা জেনেছেন। 

৩.

সাত ডিসেম্বর সকালে খুলনা যাওয়া হল না। বরং ডা. এস এ মালেক স্যারের জানাযায় অংশগ্রহণ করতে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গেলাম। আমাদের নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ভাই, ভিসি শারফুদ্দিন আহমেদ ভাই, ডা. রোকেয়া সুলতানা আপা, রুদ্র সাইফুলসহ বঙ্গবন্ধু পরিষদের অনেক নেতাকেই দেখলাম। মামুন তসবীহ হাতে দোয়া পড়ছে। ওর শোকাচ্ছন্ন মুখটা দেখে আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। আমার বন্ধুদের মধ্যে যে কজন সাহসী মানুষ রয়েছে, মামুন তাদের মধ্যে অন্যতম। ওকে আমি কখনো এতটা বিমর্ষ অবস্থায় দেখি নি। শেষদিনগুলোতে ও যেভাবে স্যারের যত্ন নিয়েছে, তা রীতিমত অবিশ্বাস্য! স্যারের কোভিড হলে সকল স্বাস্থ্য বিধি- নিষেধ ভেঙ্গে যেভাবে সে স্যারের সাথে সারাক্ষণ হাসপাতালে পড়ে থাকতো, তা দেখার মত ছিল। ওই বয়সে কোভিডাক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে বেঁচে বাসায় ফেরার সংখ্যাটা হাতে গোনা ছিল, তারপরও সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আল্লাহ সেবার স্যারকে সুস্থ করে বাসায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্যারের চিকিৎসার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকা থেকে মনোক্লোনাল এন্টিবডি ইঞ্জেকশন আনিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোভিড হলে এই ইঞ্জেকশন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছিল।

৪.

বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জানাযা শেষে শ্বেতশুভ্র কাফনে মোড়া মালেক চাচার মৃতদেহটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হল। এখান থেকে স্যারকে কলাবাগানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। কলাবাগান মাঠে বাদ জোহর দ্বিতীয় জানাযা শেষে স্যারের শেষ ইচ্ছানুযায়ী মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হবে।

খুলনা থেকে আব্বা ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি কখন রওয়ানা দেব। মালেক স্যারের মৃত্যুর কথা শুনে আব্বা চুপ করে গেলেন। ব্যক্তিগতভাবে আব্বা মালেক স্যারের খুব ভক্ত ছিলেন। আব্বা বঙ্গবন্ধু পরিষদের খুলনা বাংলাদেশ ব্যাংক শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। সেইসব দিনগুলোতে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর নাম বলার লোক খুব কমই পাওয়া যেতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে ছাত্রজীবন থেকেই আব্বার পরিচয়। বঙ্গবন্ধু খুলনায় গেলে প্রতিবারই আব্বা দেখা করতেন। পাকিস্তান আমলে একবার বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সফরে খুলনা গেলে সদ্য চাকুরিতে যোগ দেওয়া আব্বা বেতনের জমানো টাকা থেকে আড়াইশো টাকা খামে ভরে বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়েছিলেন। সেই গল্প আব্বার মুখে অনেকবার শুনেছি। এই গল্পটা বলার সময় আব্বার চোখ-মুখ কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।

বন্ধু মামুন আগে থেকেই জানত আজ আমার খুলনা যাবার কথা। ব্যক্তিগত শোকের মুহূর্তেও ও আমাকে বললো, তোর থাকতে হবে না, তুই এখনি খুলনা যা। চাচাকে বেশি করে সময় দিস।

৫.

মালেক চাচাকে আমি খুব কাছ থেকে পেয়েছি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে। তিনি স্বাচিপের অনুষ্ঠানগুলোতে প্রায়শই প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতেন। তিনি আমার করা পোস্টারের শ্লোগানগুলো খুব পছন্দ করতেন। তখন জালাল ভাইয়ের নির্দেশে কেন্দ্রীয় স্বাচিপের সব অনুষ্ঠান আমি সঞ্চালনা করতাম। মামুনের কাছে স্যার আমার সঞ্চালনারও খুব প্রশংসা করতেন।

কোভিড মহামারী চলাকালিন মালেক স্যার বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের অনেকগুলো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছেন। প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর দেওয়া সময়ে যোগ দিতেন এবং পুরো অনুষ্ঠানের বক্তৃতা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তাঁর বক্তৃতাগুলো একদিকে ছিল স্মৃতিতে ভরপুর, আরেকদিকে গভীর চিন্তাভাবনা প্রসূত। এই বয়সেও কথা বলার সময় তাঁর ভেতরে তারুণ্যের উদ্দীপনা এসে ভর করত। তিনি নিয়মিত রাজনৈতিক জার্নাল প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেবার কথা বলতেন। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণপূর্বক একটি সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। সেই সাথে তিনি নিয়মিত পত্রিকায় লিখতেন। তার লেখা শক্তিশালী কলামগুলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের রাজনীতিতে নেতা-কর্মীদের মনে সাহস যোগাতো।

ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার জীবনী লিখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরবর্তীতে ডা. এস এ মালেকের প্রতিবাদী ভূমিকার কথা জেনে বিস্মিত হয়েছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তিনি আরো অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সাথে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জীবন ধারণের জন্য কোলকাতায় অবস্থানকালিন তিনি ডা. বোস নামে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে প্রাক্টিসও করতেন। তিনি তখন দিল্লীতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। মাঝেমধ্যেই তিনি দিল্লী গিয়ে নেত্রীর সাথে দেখা করতেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন খবর দিতেন। পচাত্তর পরবর্তী তাঁর এই সাহসী ভূমিকা জননেত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করেন। 

৫.

ডা. এস এ মালেক স্যারের মৃত্যুর পরে অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের পক্ষ থেকে আমরা কয়েকজন মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করতে গিয়েছিলাম। যাবার আগে আমি আর অস্ট্রেলিয়া যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান শামীম শাহবাগের একটা ফুলের দোকানে গেলাম। দোকানে কর্মরত লোকটা ফুলের মালা বানাতে বানাতে জিজ্ঞেস করলেন, কার জন্য এই পুষ্পাঞ্জলি? বললাম, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদ্য প্রয়াত সভাপতি ডা. এস এ মালেকের জন্য। স্যারের নাম শোনার সাথে সাথে ভদ্রলোক একের পর এক স্যার সম্পর্কে বলে গেলেন। এবং পরম মমতায় মালার কাঠামোতে নানা বর্ণের গোলাপ বসাতে লাগলেন। আমরা যার অর্ডার দিয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি ফুল দিয়ে তিনি মালাটা তৈরি করে দিলেন। তারপর লেখার জন্য যত্ন করে কাগজ ও সাইন পেন এনে দিলেন। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, সাধারণ মানুষের কতটা ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় স্যারের বসবাস ছিল।

আমরা মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পৌছাতে মীরপুর থেকে এসে যোগ দিল অস্ট্রেলিয়া যুবলীগের আরেক নেতা বীর খান। নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান বাতিল করে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের তৎকালিন আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ মুনীর হোসেন ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক, লেখিকা আইভি রহমান। আসার সময় মামুনকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।

মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেবার জন্য আলাদাভাবে স্থান সংরক্ষিত করা আছে। আমরা এতক্ষণ এখানেই অপেক্ষা করছিলাম। সবাই এলে সেদিকে পা বাড়াতেই মামুন বললো, আব্বাকে সংরক্ষিত স্থানে কবর দেওয়া হয়নি। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মানে? কী বলিস তুই? মামুন আরো সংকুচিত হয়ে বললো, ‘আব্বার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নাই, তাই সংরক্ষিত স্থানে কবর দেওয়া যায়নি।’

সবাই মিলে অনেকখানি হেঁটে ভেতরের দিকে আমজনতার মাঝে চিরনিদ্রায় শুয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর, সাবেক এমপি, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদ্য প্রয়াত সভাপতি, বিশিষ্ট চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী ডা. এস এ মালেকের সমাধির সামনে এসে দাঁড়ালাম। চাচার আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে আমরা পবিত্র কোরান থেকে সুরা পাঠ করলাম ও মুনীর ভাইয়ের নেতৃত্বে আল্লাহর কাছে হাত তুলে মোনাজাত করলাম। মালেক চাচা হলেন সেই বিরল প্রজন্মের একজন, যারা গর্বভরে বলতেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি, কোন সার্টিফিকেট বা স্বীকৃতির জন্য নয়। মালেক চাচা হয়তো স্বীকৃতি চাননি, কিন্তু আমাদের কি কোন দায়িত্ব ছিল না। আমার সাধ্য থাকলে আমি চাচার কবরটা স্থানান্তরিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে নিয়ে যেতাম। শুনেছি, এই ঘটনা শুনে মাননীয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীও ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

মালেক চাচার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে এসে চোখে জল আর বুকে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।


লেখক: আবুল হাসনাৎ মিল্টন


ডা. এস এ মালেক   মুক্তিযোদ্ধা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘সকল ষড়যন্ত্র অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে’


Thumbnail

বিএনপি সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন বৈধতা পাওয়ার পরই তিনি অস্ত্রধারী পাশে বসিয়ে নির্বাচনী এলাকায় সমাবেশ করেছেন, যা নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে শোকজও করা হয়েছে।

এ বিষয়টি নিয়ে সাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত, নির্বাচন যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে বিষয়ে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের জোড়ালো পদক্ষেপ নেওয়া বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। একই সঙ্গে তিনি নির্বাচনকেন্দ্রীক সকল ষড়যন্ত্র অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। শাহজাহান ওমরের পাশে বিএনপি নেতার অস্ত্রকান্ড নিয়ে বাংলা ইনসাইডারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ডা. মোদাচ্ছের আলী তার মনোভাব ব্যাক্ত করে বিস্তারিত আলাপ করেছেন।

এ সময় তিনি বলেছেন, ‘আমি পত্র-পত্রিকায় দেখতে পেলাম যে, সদ্য বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী শাহাজাহান ওমর সাহেব নমিনেশন পেপার (মনোনয়ন পত্র) জমা দেন তখন এক অস্ত্রধারী তার সঙ্গে ছিল, যা পরবর্তীতে গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি হচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এবং দেশে যেন গণতন্ত্র স্থায়ীত্ব লাভ করে, সংবিধান অনুযায়ী যেন পাঁচবছর পর পর নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচন যেন সঠিকভাবে হয়। যেমন, ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালে নির্বাচনের (ভোটের) দিন ঠিক করা হয়েছে, সেই প্রসেস চলছে। কিছু লোক এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। যেন দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যেমন, একটি গ্রুপ ২০১৪, ২০১৮ প্রত্যেকটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে এবং এ ব্যাপারে তারা অনেকটাই সফলকাম হয়েছে।’ 

ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘এবারও দেখা যাচ্ছে, এই যে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে অস্ত্রধারী যে সমাবেশ হয়েছে তা সব জায়গায় প্রচার হবে, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও। তাহলে, এই শাহজাহান ওমর যাকে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতিক দিল, সে আওয়ামী লীগে যোগদানই করেছে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। এখন আওয়ামী লীগের মতো এতো পুরোনো দল, যে দলে এরকম প্রশ্নবিদ্ধ লোক প্রবেশ করছে সেটা যদি আওয়ামী লীগ না দেখে, তাহলে তারা কিভাবে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবে? সেটাই বুঝতে আমি অক্ষম।’ 

তিনি মনে করেন, ‘নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করছে। তারা ইতোমধ্যে যারা নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা আনছে। অস্ত্রধারী নিয়ে সমাবেশ করায় তাকেও আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এবং প্রয়োজনে রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা উচিৎ, কেন সে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সমাবেশস্থলে গেলো? সে কি অস্ত্র নিয়ে সমাবেশ করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এই কাজ করেছে? নাকি, শাহজাহান ওমর নিজেই এখানে জড়িত।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, আওয়ামী যাকে নৌকা প্রতিক দিয়েছে, যে বিএনপি নেতাকে সে (শাহজাহান ওমর) নিজেই এর সাথে জড়িত। তাই না হলে, উপজেলা পর্যায়ের যে বিএনপির সভাপতি সমাবেশে অস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হতে পারে না। সুতরাং, নির্বাচন কমিশনের উচিৎ হবে কোন দিকে না তাকিয়ে, কি প্রতিক তাতেও কিছু যায় আসে না, অবিলম্বে আমাদের রক্ষা করার জন্য, ১৭ কোটি মানুষকে রক্ষা করা জন্য, গণতন্ত্র রক্ষা করা জন্য, সংবিধান রক্ষা করা জন্য, নির্বাচন রক্ষা করার জন্য কঠিনতম পন্থা অবলম্বন করা উচিৎ। আমি সঠিক আইন জানি না। আমার ধারণা হচ্ছে, নির্বাচনের সময়, এমনকি যদি লাইসেন্স করা অস্ত্রও কেউ প্রদর্শন করে তার জন্য মামলা হয়। এখানেও অন্তত দুই-তিনটা মামলা হওয়া উচিৎ। তিনি কিভাবে অস্ত্র দেখালেন, যে কারণে সাধারণ মানুষ ভয় পায়? কিভাবে তিনি নৌকার মনোনিত প্রার্থী পাশে দাড়িয়ে অস্ত্র প্রদর্শন করলেন, তা নিয়েও মামলা হয়। এবং, আরও কি কি নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে; আমার নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন থাকবে, তাদের যে ব্যাকবোন (মেরুদণ্ড) আছে, তারা যে দন্তবিহীন ব্যাঘ্র না, সেটা তাদের প্রমান করতে হবে। না হলে, আমরা সাধারণ জনগণ হিসেবে কিভাবে তাদের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবো? সে জন্য আমার মনে হয় এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।’

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্ট ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বলা হয়, ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এটিই ষড়যন্ত্র। এই সকল ষড়যন্ত্র অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং আইনের মাধ্যমেই বন্ধ করতে হবে। এই জন্য সবার প্রতি আমার আবেদন, আইন নিজস্ব গতিতে চলুক। আর আওয়ামী লীগ যে ষড়যন্ত্রের কথা বলে, তারা ষড়যন্ত্র থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করবে। তারাই যদি আবার ষড়যন্ত্রের জন্ম দেয়, তাহলে আমরা যাবো কোথায়?


ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী   আওয়ামী লীগ   শাহাজাহান ওমর  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘আসিফ নজরুল একজন কাঁচা মানের বুদ্ধিজীবী’


Thumbnail

এদেশে বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের প্রধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে বেশ পছন্দ করি। দুটি কারণে আমি তাকে পছন্দ করি।

একটি কারণ হচ্ছে তার ব্যবহার খুবই ভাল। বয়সের বিবেচনায় আমার ছোট বলে তিনি যেভাবে কথাবার্তা বলেন তাতে আমার মনে হয় যে একজন ছোট ভাই আমার সাথে কথা বলছে। আরেকটি কারণে তাকে পছন্দ করি। সেটা হল তিনি তার লেখাতে কোন রাখঢাক করেন না। তিনি যেটা বিশ্বাস করেন সেটাই করেন এবং তিনি যে বিএনপির একজন খাঁটি বুদ্ধিজীবী নেতা এটা বোঝা যায়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অধ্যাপনা সেটা কেবল পরিচয়ের কারণে। তার আসল কাজ হচ্ছে বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসাবে কাজ করা।

বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার কাজ মূলত ২টি। প্রথমত বিএনপিকে কি করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া এবং দ্বিতীয়ত বিএনপিকে কিভাবে উপরে তোলা যায় এবং আওয়ামী লীগকে কিভাবে নিচে নামানো যায় সেটি জনগনকে প্রচার করা। কিন্তু সম্প্রতি তার একটি ফেসবুক পোস্ট আমার নজরে আসে এবং তাতে তার সম্বন্ধে আমার যে ধারনা ছিল সেটি সেটু ভুল প্রমাণিত হল। তাকে একজন বড় মাপের বুদ্ধিজীবী মনে করলেও এখন মনে হচ্চে তিনি একজন কাঁচা মানে বুদ্ধিজীবী। ফেসবুক পোস্ট আসিফ নজরুল লিখেছেন, ৭ জানুয়ারি দেশে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। এটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে তার ডামি প্রার্থী বা অনুগত দলগুলোর প্রার্থীদের নির্বাচন। কাজেই এটিকে নির্বাচন না বলে একদলীয় নির্বাচন বলা যেতে পারে।

কিন্তু জাতীয় পার্টি এতদিন ধরে বিরোধী দলে থাকলো সেটি নিয়ে আসিফ নজরুল কোন লেখা লিখলেন না। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে সর্বজন গৃহীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এটি নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এছাড়া শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির অনেক নেতাও নির্বাচন করছে এবং এর বাইরে ১৪ দল সহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে আসছে। এখানে শুধু আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের নির্বাচন হচ্ছে এমনটি ভাবার কোন কারন নেই।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র। কারন তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনেই ছিল। আমি দুইবার নির্বাচিত সিনেট সদস্য ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ডিন ছিলাম। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার নারীর সম্পর্ক। সেই বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি খুবই মর্মাহত যে, এখন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাড়াটিয়াদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়? যারা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে কথা বলবে? এদের মত শিক্ষকদের জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বে লিডিং ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে থাকতে পারে না। এদের দ্বারা যারা ভবিষ্যতে শিক্ষিত হবে তারা আসলে কি শিখবে? তারাতো আরও নিন্মগামী হবে। এসব শিক্ষকরা টাকার জন্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও লেকচার দেন। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু টাকার বিনিময়ে একজন শিক্ষক কোন রাজনৈতিক দলের ভাড়া খাটবেন এটা মানা যায় না। আমি নিজেও জীবনে অনেকটা সময় শিক্ষকতা করেছি। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়েছি এবং আমি নিজেও একজন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি। কিন্তু তারা এত তারাতারি কিভাবে পচে গেলেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আসিফ নজরুলের মত এমন বেশকিছু বুদ্ধিজীবী যাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষক রয়েছে, কিছু মিডিয়ার পণ্ডিত আছেন এবং অন্য পেশার অনেকে আছেন যারা বিদেশিদের টাকায়, লন্ডনের টাকায় তাদের বুদ্ধি বিক্রি করছেন। আমার মতে ওনাদের মধ্যে এবং টাকার জন্য যারা অন্যের বিছানায় যায়, তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বরং যারা বুদ্ধি বিক্রি করে তারা আরও নিকৃষ্ট এ কারনে যে তারা দেশের মানুষের সাথে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাথে প্রতারণা করছে। তারা দেশকে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যতই আন্তর্জাতিক চাপ আসুক না কেন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে। অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে। নির্বাচনকে যারা বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করবে এবং নির্বাচন নিয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়াবে তারা দেশের শত্রু, জনগনের শত্রু এবং গণতন্ত্রের শত্রু। 


বুদ্ধিজীবী   আসিফ নজরুল  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

কিসিঞ্জারহীন পৃথিবী ও শতবর্ষী বাংলাদেশের স্বপ্ন


Thumbnail

কিসিঞ্জার কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’-র এই বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সত্যিই ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন কিসিঞ্জারের চোখে তা আর ধরা পড়েনি! ৯৬ বছর বয়সী কিসিঞ্জার ২০১৯ সালের নভেম্বরে চীন সফর করেন কারণ তখনও তাঁর আরাধ্য চীন-মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়ন। অথচ এই এশিয়ারই আর এক দেশ কিসিঞ্জারের শত বাধা সত্ত্বেও যখন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তখন থেকেই বাংলাদেশ তাঁর ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ আর কৌতুকের বিষয় ছিল। এদের কুশিলবী ষড়যন্ত্রের কৌশলে বাংলাদেশ তার জাতির পিতাকে হারায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট। বিস্ময়ের কোন কারণ ছিল না যখন ১৬ অগাস্ট সকালে কিসিঞ্জার তার দপ্তরে বসে খুবই নির্লিপ্ত কণ্ঠে তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন, “বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাপ শুরু কর, কী হয়েছে সেখানে”?

২০১৬ সাল থেকে আমি, শহীদ সন্তান তৌহিদ রেজা নুর ও সাংবাদিক ফারজানা রূপা আমাদের দীর্ঘ পরিকল্পনা অনুসরণ করে কিসিঞ্জারের সাথে দেখা করার চেষ্টা করছিলাম; আমি তাঁর অফিসের সাথে বেশ কিছু ই-মেইল যোগাযোগ করেছি। তাঁর নির্বাহী সহকারী কুর্টনি গ্লিক আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কিসিঞ্জার দেখা করতে রাজি হয়েছেন কিন্তু আমাদের প্রথমে প্রশ্ন শেয়ার করতে হবে। এই বিষয়ে আমরা গ্যারি বাসের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিলাম যিনি প্রিন্সটনের একজন অধ্যাপক The Blood Telegram: Nixon, Kissinger, and a Forgotten Genocideবইয়ের লেখক। অবশেষে আমাদের প্রশ্ন ছিল একটি লাইন- ‘ডক্টর কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত কিনা’। যদিও আমাদের বলা হয়েছিল যে তিনি আমাদের সাথে দেখা করতে পারেন কিন্তু তাঁর ব্যস্ততার অজুহাতে সেই প্রশ্নের উত্তর নিতে সাক্ষাৎ আর হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ এখন চলে গেছে।

একবার নাটকীয়ভাবে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল তাঁর সচিবের সদয় সহযোগিতায়। কুর্টনি গ্লিক আমাকে জানিয়েছিলেন যে আমি দেখা করতে পারি কিন্তু সেই পরিবেশে আমার সেই বিশেষ প্রশ্ন করা উচিত হবে না। আমি দেখা করার এই সুযোগটি ব্যবহার করতে রাজি হ এবং জানতে পারি যে ৯ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের কেন্ট মেমোরিয়াল লাইব্রেরীর রিডিং রুমে “Kissinger on Kissinger: Reflections on Diplomacy, Grand Strategy and Leadership”- বইয়ে স্বাক্ষর দিতে কিসিঞ্জার ঘন্টা দেড়-দুই অবস্থান করবেন। তাঁর সচিবের কাছ থেকে এই সংবাদ ও ঠিকানা পেয়ে আমি আমার গবেষণা কর্মস্থল ওয়াহোর কলম্বাস থেকে সেখানে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলাম। আমার উদ্দেশ্য স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি এসে ও বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে তাঁর কাছ থেকে বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু মতামত সংগ্রহ করা। এই সাক্ষাতে কিসিঞ্জার আমার প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে কৌশিক বসুর লেখা পড়েছি কিনা জানতে চান ও সেদিন ব্যস্ততার অজুহাতে পরে আবার যোগাযোগ করতে বলেন।

এই কূট-কৌশলী উত্তরের মধ্যে সেই দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে কিসিঞ্জারের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও তাঁর সাথে আমার সাক্ষাতের মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি ও আরও সাক্ষাতের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল কিন্তু আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের অগ্রগতির সব খবর তিনি রাখতন। আমি অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর বাংলাদেশ বিষয়ে রচনা-মন্তব্য ও বিশ্লেষণের সাথে পরিচিত ছিলাম ফলে ১৯৭১ সালে আমাদের আশা আকাঙ্খার প্রতিরোধক ও ’৭৫-এর ঘটনাবলীর জন্যে অভিযুক্ত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ক্রীড়ণক এইসব কূটনীতিকদের বিদ্রূপ অতিক্রম করে বাংলাদেশ কেমন করে এই অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের দেশ হলো তা আমাদের ভালো করে অনুধাবন করা দরকার বলে মনে করছি।

সেই অনুধাবনের পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দিকে। আমরা সকলেই জানি ১৯৭১ সালে গোপনে চীন সফর করে কিসিঞ্জার চীনের সাথে নিক্সন সরকার তথা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ শুরু করেন যা তাঁর কূটনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা বাহুল্য চীনের সাথে সেই সম্পর্কের নানারকম টানাপোড়েনে হোয়াইট হাউস তাঁকেই সবার আগে স্মরণ করেএমন কি ৯৬ বছর বয়সে চীন সফর করে চীনা প্রেসিডেন্টের এই ঐতিহাসিক মন্তব্যও কিসিঞ্জার অর্জন করেন, Xi appreciated the sincere feelings and positive efforts Kissinger devoted to promoting the development of Sino-U.S. relations over the decades, saying that Kissinger will be remembered for his important contributions in history” (জিনহুয়া, ২২ নভেম্বর ২০১৯)।

বাংলাদেশের ইতিহাসও কিসিঞ্জারকে স্মরণ করবে তাঁর হঠকারী ভূমিকার জন্যে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে চীনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এমনকি জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ না পেতেও ভূমিকা রেখেছে। সেসব ভূমিকাই পোক্ত হয়েছিল ’৭১ সালে কিসিঞ্জারের চীন সফরের মধ্য দিয়ে কারণ পাকিস্তান তখন চীন বলয়ের মধ্যে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিল। এই দুই পরাশক্তির সন্ধির উদ্দেশ্য মূলত ছিল ভারত-রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের শক্তি জোরদার করা কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাদের সকল শক্তি সমাবেশ প্রক্রিয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত রূপ লাভ করে নতুন মানচিত্র অর্জন করে, চীন-মার্কিন-পাকিস্তানী আঁতাত তা ভুলে গেছে বা সে শক্তি ইতিহাস হয়ে গেছে মনে করা আমাদের কিছুতেই উচিত হবে না।

ফলে আজ যে উন্নয়ন কাঠামোয় বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সেই চ্যালেঞ্জকেই মোকাবেলা করতে হবে যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭১ সালে নানারকম আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক কূটকৌশলের রাজনীতির মাধ্যমে। যারা দেখছেন বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি উর্ধমুখী, তাদের চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক কেমন করে একে থামিয়ে দেয়া যায় বা শ্লথ করা যায়। একই কাজ তারা করেছিল ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে। ফলে এখন সে ষড়যন্ত্র থেমে গেছে এটা ভাবা কিছুতেই উচিত নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত এই সবই একই সূত্রে গাঁথা। গত এক দশকে নানারকম পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে এই সরকারের অগ্রগতি ও তাঁর নেতৃত্বের সাফল্যকে ম্লান করে দেবার জন্যে। কিন্তু কিছুই যখন সফল হয়নি তখন আমাদেরও আত্মপ্রসাদের সুযোগ নেই, বাংলাদেশের যুগান্তরের ইতিহাস বলে তাকে চিরকাল বাধা অতিক্রম করেই এগুতে হয়েছে।

এখন আমাদের প্রজন্মান্তর বিকাশের কৌশল ঠিক করে নেয়া দরকার। আমরা যারা জীবনের ছয় দশক পার হয়ে এসেছি তখন আমাদের পেছনে রয়েছে কুড়ি থেকে ষাট বয়সের চার চারটি দশকের প্রজন্ম। যদি মনে মনে ভাবি কী রেখে যাচ্ছি তখন নিজের অবদান অতি সামান্য হলেও আমাদের সামগ্রিক অবদান মোটেই সামান্য নয়। কিন্তু আজ যে কুড়ি বছর বয়সী তাঁর যখন চল্লিশ বছর পরে ষাট হবে তখন তাঁর নিজের ও সামগ্রিক অর্জন সে কী দেখবে? সে পথ কি আমরা তৈরি করে রেখে যাচ্ছি যে পথ পাড়ি দিয়ে সে স্বাধীনতার শতবর্ষে পা দেবে?

আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে, এসবের মান তখন কী দাঁড়াবে? আমাদের প্রশাসন কেমন হবে? আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা, ইতিহাস অনুশীলন ও নেতৃত্বদানের কৌশল কতোটা মানবিক হবে? আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালী, পরিবেশ-প্রতিবেশের সুরক্ষা ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কতোটা আধুনিক হয়েছে? বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার এই বাংলাদেশ তখন ইতিহাসের যে প্রান্তে পৌঁছে যাবে তাঁর সংস্কৃতি কতোটা নদী-মাতৃক থাকবে? কৌশিক বসু লিখেছেন, “To what does Bangladesh owe its quiet transformation? As with all large-scale historical phenomena, there can be no certain answers, only clues” – (Why Is Bangladesh Booming? Project syndicate প্রকাশনা, ২৩ এপ্রিল ২০১৮)

সে সুত্রগুলো নিয়ে একদিন অবশ্যই গবেষণা হবে, উত্তরও খুঁজে নেয়া হবে, কিন্তু আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ পেয়েছি, আজ আমরা যারা শেখ হাসিনাকে দেখতে পাই – তাঁদের কেউই হয়তো শতবর্ষের বাংলাদেশে থাকবো না, কিন্তু আমরা তো স্বপ্ন দেখতেই পারি সেই বাংলাদেশ, যে ইতিহাস অর্থনীতির সকল সূত্র প্রমাণ করে বিশ্ব-জগতে নতুন এক মানবিক ইতিহাস তৈরি করেছে, সকল মুক্তিকামী দেশ ও সেসব দেশের মানুষ বাংলাদেশকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে।                        

রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প

ই-মেইলঃ rezasalimag@gmail.com


কিসিঞ্জারহীন পৃথিবী   বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

পার্বত্য এলাকায় শান্তিচুক্তির প্রভাব

প্রকাশ: ১২:০৩ পিএম, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব বিশ্ববাসীর কাছে একটি বিরল ঘটনা।জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তির অন্বেষায়’ প্রবন্ধে ১৯৯৮ সালে লিখেছেন, ‘পাহাড়ে বসবাসকারী কি পাহাড়ি কি বাঙালি সকলেই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। শান্তি স্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে।... শিক্ষায় স্বাস্থ্যকর্মে উন্নত সমাজ গড়তে পারলেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন হবে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে শান্তির পক্ষে। সকলেই শান্তি চায়।’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র-১, পৃ ২৩৯) শান্তির এই প্রত্যয়কে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধারণ করে শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। সেসময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ওই এলাকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য অন্যান্য স্থান থেকে মানুষ স্থানান্তর করেন। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছিল অগ্রহণযোগ্য। তৎকালীন সরকারি প্রশাসন সমতল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নদীভাঙ্গা ভূমিহীন, দিনমজুর, অসহায় দুস্থ পরিবারগুলোকে এনে সরকারি খাস ভূমিতে পুনর্বাসন করে। এই পুনর্বাসনের কয়েক বছর যেতে না যেতেই শান্তিবাহিনী নামক উপজাতীয় গেরিলারা সরকারের উপর প্রতিশোধ নিতে পুনর্বাসিত বাঙালিদের উপর হামলা চালায়। বাঙালি হত্যা ও নিপীড়ন মাত্রা অতিক্রম করে। সুরক্ষিত ওই অঞ্চলে ভারতের জঙ্গিরা সহায়তা করত শান্তিবাহিনীদের। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের জড়িত হওয়াটা ছিল ব্যয়বহুল। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়েছে দৃঢ়চিত্তে। ১৯৯৭ সালের আগে ৬ জন তরুণ অফিসার, ১ মেজর, ৩ ক্যাপ্টেন ও ২ লেফটেন্যান্টসহ ৩১২ জন সৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক হাজার কিলোমিটার রাস্তার অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত। নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশ-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক বান্দরবানের নীলগিরিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব স্পটে ছুটে যান তার পুরো অবদানটাই সেনাবাহিনীর। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ও রাস্তা নির্মাণ না করা হলে রাত্রিযাপন করে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা দূরের কথা, সেখানে কেউ যাওয়ার কল্পনাও করতেন না। বর্তমানে অপহরণ একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভারতের সঙ্গে পুনরায় সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাপ্তি ঘটে।    

শান্তি চুক্তি ২৭ বছরে পদাপর্ণ করেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি-পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালি ও সরকারি বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৬ বছর আগে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিষিদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। দুই দশক স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চাকা বন্ধ ছিল। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় পার্বত্য এলাকা তার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পায়; সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণে শেখ হাসিনার ইউনেস্কো পুরস্কার প্রাপ্তি ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি। চুক্তির পর পুরো পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৬ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সফলভাবে পরিচালনার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা লক্ষ করা যায়। তবে শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। একসময় শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাঁর সরকার। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষ আজ জানতে পেরেছে শান্তি, গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা ও অবদানের কথা। ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থানের কথা স্মরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে। শান্তি ও উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে তুলে ধরার মধ্যে আমাদের নেতৃত্বের সাফল্য গুরুত্বের সঙ্গে যুদ্ধ সংকটের মধ্যেও উপস্থাপিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের মিডিয়াতে। অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে গত কয়েক বছর জাতিসংঘের অধিবেশনগুলোতে। সেখানে স্বল্পোন্নত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। এজন্য দারিদ্র্য বিমোচনে উন্নত বিশ্বের আর্থিক প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশ্বশান্তির জন্য এখন প্রয়োজন অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভবিষ্যৎ-প্রসারী ও প্রজ্ঞাময় কর্মসূচি প্রণয়ন যা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎসরূপে গণ্য হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার পক্ষ থেকে প্রায় বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার ৩ বছর ৮ মাস ক্ষমতায় থাকাকালে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন; আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন; ভারত থেকে জুম্ম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি ও ভূমি টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার পর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে একটানা সাড়ে ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার কালে জুম চাষ, মাধ্যমিক শিক্ষা, জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান, মহাজনী কারবার ও পর্যটন- এ পাঁচটি বিষয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়েছে। সন্তু লারমার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এসব হস্তান্তরকরণ যথাযথভাবে হয়নি, আংশিক বা ত্রুটিপূর্ণভাবে হয়েছে। এমনকি রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্যবাসীর মতামত ও স্বার্থকে পদদলিত করে। এছাড়া তিনি তিন জেলায় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ভূমি আগ্রাসনের অভিযোগ তুলেছিলেন। সেখানকার উপজাতি নারীদের উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছিলেন। 

লেখাবাহুল্য, ২০১৩ সালে সন্তু লারমা এক সংবাদ সম্মেলন করে পার্বত্য এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। যদিও সেই বিরোধিতা টেকেনি। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে রাজধানীর এক হোটেলে ওই বছর ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছিলেন, ‘পার্বত্যবাসী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। এগুলো বহিরাগত অনুপ্রবেশের দ্বারে পরিণত হবে। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যন্ত এসব প্রকল্প স্থগিত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’ উপরন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের অধিকসংখ্যক কোটা সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

তাঁর কথার সূত্র ধরে বলা দরকার, পার্বত্য এলাকার বেশির ভাগ উপজাতি জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধা গ্রহণ করে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, অনেক সরকারি অফিসে উচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। এ কারণে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমতলবাসীদের তরফ থেকে এই কোটা সুবিধা বাতিলের কিংবা কমানোর যে দাবি উঠেছিল তা অযৌক্তিক নয়। ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি সফরের সময় জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ঘোষণা দেন। তারপর থেকেই এর পক্ষে-বিপক্ষে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। অথচ পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ‘সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, অনুন্নত সম্প্রদায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ ’৭২-এর সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতিদের অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ধর্মীয় ও নৃ-জাতিসত্তাগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান এবং তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দৃঢ়ভাবে সমুন্নত থাকবে। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির অবশিষ্ট অঙ্গীকার ও ধারাসমূহ বাস্তবায়িত করা হবে। পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হবে এবং তিন পার্বত্য জেলার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখা, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করে তোলা হবে। এই তিন জেলায় পর্যটন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’ 

অর্থাৎ বর্তমান সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবেই সন্তু লারমাসহ সব ক্ষুদ্রজাতি জনগোষ্ঠীর জানমাল ও সম্পদ সুরক্ষার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। গত মহাজোট সরকারের শাসনামলে তিন পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যে দুর্গম এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল সে স্থানগুলো তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনা হয়েছে। যেখানে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও বাজারের সংকট ছিল সেসব জায়গা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা হলো স্থানীয় ক্ষুদ্রজাতি জনগোষ্ঠী কর্তৃক সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার বাস্তবতা। সেখানে রয়েছে শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফের ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসী’ কার্যকলাপ। তাদের চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যদিও একই অভিযোগ রয়েছে সন্তু লারমার ‘জেএসএস’-এর বিরুদ্ধেও। গোপন সূত্রে সংবাদ পাওয়া গেছে, কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) তাদের কৃষিভিত্তিক খামারের প্রজেক্ট এই উভয় গ্রুপের টানাটানিতে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। সেবামূলক প্রকল্পটিতে বরাদ্দ করা বিদেশি সাহায্যের টাকাও ফেরত গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালির সম্প্রীতি রক্ষার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, ২৬ বছর আগের (১৯৯৭) ২ ডিসেম্বর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষর করেন। ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের দ্বার উন্মুক্ত হলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংগঠন ও দেশী-বিদেশী এনজিও তাদের সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। তবে চুক্তি অনুযায়ী গঠিত ‘হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’ ও ‘রিজিওনাল কাউন্সিলে’র চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে মূলত জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতারা নির্বাচিত না হয়েও সম্মান, সম্পদ ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয় যা ‘শান্তিচুক্তি’ বিরোধী উপজাতীয় নেতৃত্বস্থানীয়দের অন্তর্জ্বালা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই কারণে আঞ্চলিক উপজাতীয় রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়ে পড়ে এবং ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের প্রায় এক বছরের মাথায় ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে পার্বত্য রাজনীতিতে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ২২ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রণীত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭’ (কনভেনশন নম্বর ১০৭)-এ অনুস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের এ সংস্থা আবার সংশোধিত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৮৯’ (কনভেনশন নম্বর ১৬৯) গ্রহণ করেছে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল জাতীয় পর্যায়ে উপজাতিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। এখানে ট্রাইবাল বা সেমিট্রাইবাল বলতে ওই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ট্রাইবাল বৈশিষ্ট্য হারানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এখনো জাতীয় জনসমষ্টির সঙ্গে একীভূত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি অধিবাসীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অবশ্য কয়েকটি মৌলবাদ সমর্থিত পত্রিকা পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরে অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকে ইউপিডিএফের সদস্যদের অস্ত্রসহ আটকের সংবাদ ছাপানো হয়েছে। পার্বত্যচুক্তি বিরোধী ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে’র (ইউপিডিএফ) সদস্যদের এ ধরনের তৎপরতা এখনও বহাল রয়েছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। প্রকাশ্যে তারা বর্তমান সরকারের চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ও নিন্দা প্রকাশ করে। এছাড়া জনসংহতি সমিতির সঙ্গে রয়েছে তাদের দ্বন্দ্ব। পরস্পর পরস্পরের কর্মী হত্যাকাণ্ডের বিবাদেও জড়িত। অন্যদিকে প্রতি বছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয়(সন্তু) লারমা পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুসারে উপজাতিদের অধিকার সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহলের দাবি থেকে স্পষ্ট যে চুক্তিটির গুরুত্ব এখন অপরিসীম। কয়েক বছর আগে সুশীল নেতারা বলেছেন, ‘দেশের সব নাগরিক সমানভাবে নাগরিক অধিকার পাচ্ছে না- এটা বাস্তবতা।’ আমাদের মতে, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সবাইকে সমান সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। সমতলের মানুষ যে সুযোগ পাচ্ছে, সেই সমান সুযোগ পাহাড়ের মানুষ পাবে না। সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো অবশ্যই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ। বিশেষ অঞ্চল বলেই দেশের মধ্যে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে। একজন প্রতিমন্ত্রী সেখানকার সকল বিষয় দেখভাল করার জন্য নিয়োজিত রয়েছেন। ১৪৫টির বেশি এনজিও পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের যাবতীয় উন্নয়নের জন্য নিরলস কাজ করছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে কেবল শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই।  রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের উন্নয়নের জন্য বছর বছর মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। তবে সরকারের গৃহীত প্রকল্পের শতকরা ৯০ভাগ উপজাতীয়রা এবং ১০ভাগ বাঙালিরা অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ সিংহভাগ ব্যয় হয় উপজাতিদের উন্নয়নের জন্য। এক্ষেত্রে আমাদের অভিমত হলো, উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয়দের উন্নয়ন ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য বজায় না থাকলে তা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে। মূলধারার রাজনীতি চালু থাকলে সেখানকার সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয় সর্বাগ্রে প্রাধান্য পেত। এজন্য পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রমে সর্বদা একটা বৈষম্য দেখা যায় বলেই মাঝেমধ্যে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ লেগে যায়। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য দিক হলো-শান্তিচুক্তির পর আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্পও বৃদ্ধি করেনি। বর্তমানেও চলমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশবাহিনী যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। বরং চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করতে ইউপিডিএফ ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ড ও সশস্ত্র সংঘাত সৃষ্টি করে থাকে। আবার তাদের রুখতে অন্যেরা অস্ত্র ধরেছে। অথচ ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গেরিলা যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। একসময় বিভিন্ন দলের ভেতর কোন্দল এবং বিশৃংখলা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নেওয়ায় চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমানে সেই পরিস্থিতিও পাল্টে গেছে। কিন্তু তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন ও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিকে সামনে রেখে সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের জীবনে অভ্যস্ত বিচিত্র দলের কর্মীরা অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে মাঝে-মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠছে। সরকারের দ্রুত ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যার এখন পর্যন্ত সমাধান হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পাহাড়ি বাঙালিদের প্রতি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বা উপজাতিরা সদয় দৃষ্টি দেবে- এ প্রত্যাশাও রয়েছে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষের জনশক্তির।  

উল্লেখ্য, শান্তি চুক্তির গুরুত্ব দেখা যায় তুলনামূলক উন্নয়ন চিত্রে। পাহাড়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অধিকাংশই স্থানীয় উপজাতিদের কল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে। চাকমা উপজাতির জন্য মোট প্রকল্প ১৮৬ টি(৪৫%),  অন্যান্য উপজাতিগুলোর জন্য মোট প্রকল্প ১৯৪টি(৪৬%)। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য মোট প্রকল্প ৩৮০টি(৯১%)। পক্ষান্তরে  বাঙালিদের জন্য মোট  প্রকল্প ৩৬ টি (৯%)। পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ মোট সদস্য সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে ১২টি অ-উপজাতির জন্য রাখা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদটি সবসময়ের জন্য উপজাতি গোত্রের জন্য সংরক্ষিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জন্য দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং কিছু বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ২১৭টি ভর্তি কোটা ছিল।অবশ্য কোটা বাতিল হলেও শেখ হাসিনা জানিয়েছেন যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিশেষ বিবেচনায় দেখা হবে। 

মূলত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন ছিল। এ কারণে শেখ হাসিনার নানান ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তিও ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনন্য স্বীকৃতি। তবে শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। অর্থাৎ পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ।

(লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)


পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন