ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম দুই ধাপের নির্বাচন ছিল সহিংস, সন্ত্রাসে ভরপুর। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ১৯৮ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। এ নির্বাচনে সহিংসতায় মারা গেছেন ৪০ জনের বেশি। আহত হয়েছেন ৫ হাজারের ওপর। ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে অতীতেও সহিংসতা হয়েছে। তবে এ সহিংসতা ও মৃত্যু কাম্য নয়।’ একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এবার নির্বাচনী সহিংসতা একটু ভিন্ন ধরনের। আগে নির্বাচনে সন্ত্রাস হতো দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহিংসতায় রূপ নিত। কিন্তু এবার নির্বাচনী সহিংসতার প্রায় পুরোটাই আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে। আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগকে খুন করছে, জখম করছে। যারা একসঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন তারা এখন একে অন্যের ঘাতক। আওয়ামী লীগই যেন আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। নিজেরাই নিজেদের সব অর্জন ধ্বংস করছে। আত্মহননের এক ভয়ংকর খেলা চলছে আওয়ামী লীগেই। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের পেছনে ফিরে যেতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ৭২ বছরের পুরনো। এখনো আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সংগঠিত রাজনৈতিক দল। তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনটি বিস্তৃত। এ দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। জাতির পিতার আদর্শের ধারক দল আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য এ দলের নেতা-কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আওয়ামী লীগের চেয়ে জুলুম-নির্যাতন আর কোনো রাজনৈতিক দল সহ্য করেনি। ৭২ বছরে আওয়ামী লীগকে সংগ্রাম করতে হয়েছে ৫০ বছরের বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইতিহাস একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাইরের রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগকে কখনো পরাজিত করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ যতবার হেরেছে প্রতিবার ঘরের শত্রুরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আত্মঘাতী গোল আওয়ামী লীগকে বিপর্যস্ত করেছে। মুসলিম লীগ, আইয়ুব খান, মোনায়েম খান আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে পারেননি। বরং এদের নিষ্পেষণে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু থেকে হয়েছেন জাতির পিতা। জাতির পিতাকে স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদ সর্বহারা, পরাস্ত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে আওয়ামী লীগের ভিতরে। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা প্রায় সবাই ’৭৫-এর পর অবৈধ সরকারের অংশ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়েই তারা বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন শপথ নিতে। আওয়ামী লীগের মোশতাক চক্ররা যদি সেদিন বিশ্বাসঘাতকতা না করত তাহলে আগস্ট ট্র্যাজেডি ঘটত কি না তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ যতবার হোঁচট খেয়েছে, সংকটে পড়েছে প্রতিবার আওয়ামী লীগের একাংশের আত্মঘাতী তৎপরতার জন্য। আওয়ামী লীগ এ অন্তর্ঘাত অস্বীকারও করেনি। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ও নীতিনির্ধারণী সভাগুলোয় আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী তৎপরতার আদ্যোপান্ত পাওয়া যায়। ’৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল হয় ৩ মার্চ ১৯৭৮। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ওই সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী তৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বলা হয়েছিল- ‘জনাব মিজান চৌধুরীদের সংগঠনের বিরুদ্ধে এহেন অপতৎপরতা এই প্রথম নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর আমলে অকাজ-কুকাজের জন্য বহিষ্কৃত জনাব মিজান চৌধুরী ও জনাব মতিউর রহমানের মতো লোকেরা সংগঠনের নেতৃত্ব কুক্ষিগত এবং কবজাভূত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।’ (সূত্র : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল। রচনা, গ্রন্থনা ও সম্পাদনা নূহ উল আলম লেনিন, পৃষ্ঠা ৪৪৭)। আওয়ামী লীগের বিভক্তি এবং হতচ্ছাড়া অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি উপায়ই ছিল তা হলো বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দলের নেতৃত্বে আনা। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের চাপে তা-ই হয়েছিল। দল বাঁচাতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনাকে। ১৯৮১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হন এবং ১৭ মে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকেও দলের ভিতরের আত্মঘাতী তৎপরতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে শুরুতে তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা হয়েছে দলের মধ্যে থেকেই। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সেই আত্মঘাতী তৎপরতার বিবরণও পাওয়া যায়। ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রিপোর্ট পেশ করেন বেগম সাজেদা চৌধুরী। ওই রিপোর্টে তিনি বলেন, ‘কতিপয় ব্যক্তি দলীয় সংকট মোচনের পথে অগ্রসর না হয়ে সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলতে সচেষ্ট হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন, ১৯৪৯-এ আওয়ামী লীগের জন্মের পর হতেই বহুবার বহু নেতা-কর্মীর স্বীয় স্বার্থে ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার মানসে এবং বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও অশুভ শক্তির প্ররোচনায় কেউ কেউ আওয়ামী লীগ সংগঠনকে “ডানপন্থিদের সংগঠন” রূপে আখ্যায়িত করে নিজেদের তথাকথিত অতিবিপ্লবী বাম রাজনীতির ও প্রগতির ধ্বজাধারীর পরিচয় দিয়ে, আবার কেউ কেউ একই অভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগ সংগঠন “বামপন্থিদের সংগঠন” রূপে আখ্যায়িত করে নিজেদের তথাকথিত ওয়েস্টার্ন ডেমোক্র্যাসি, ফ্রি ইকোনমি ও ইসলামের অকৃত্রিম খাদেম পরিচয় দিয়ে দল ত্যাগ করেছেন।’ (সূত্র : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল। পৃষ্ঠা ৪৯৯)।
১৯৮৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ সঠিক না ভুল ছিল তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক অমীমাংসিত। এরশাদের নজিরবিহীন কারচুপি ও ‘মিডিয়া ক্যু’ ওই নির্বাচনের ফল পাল্টে দিয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনে আবদুর রাজ্জাকদের আত্মঘাতী তৎপরতা না হলে ভোটবিপ্লব হতো বাংলাদেশে। একইভাবে ১৯৯১-এর নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপের আত্মঘাতী হয়ে ওঠা ছিল আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। বিদ্রোহী প্রার্থী, অন্তঃকলহ ’৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করেছে সফলভাবে। কিন্তু একসময় দলের ভিতরে কারও কারও অপতৎপরতা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের কারণ উঠে আসে ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দলের সভানেত্রীর ভাষণে। ওই কাউন্সিলে প্রদত্ত ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দলের ভিতরে কোথাও কোথাও কোন্দল ও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ার ঘটনাটিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় কিছুসংখ্যক নিশ্চিত বিজয়ের আসন আমাদের হাতছাড়া হয়েছে।’
২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও আওয়ামী লীগে দেখা যায় আত্মঘাতী তৎপরতা। দলে গণতন্ত্রের জিকির তুলে আওয়ামী লীগ ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এ ষড়যন্ত্র হয়েছিল দলের ভিতরেই।
আওয়ামী লীগ বারবার সংকটে পড়েছে দলের ভিতরের সমস্যার কারণেই। তার পরও দলটি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী সংগঠন এজন্য যে এ ‘আত্মঘাতী’ তৎপরতা প্রতিহত করেছেন কর্মীরা, তৃণমূল। এরাই আওয়ামী লীগের প্রাণ। এরাই ৭২ বছরেও আওয়ামী লীগকে সজীব ও সতেজ রেখেছেন। এদের ঐক্য, স্বার্থহীন ত্যাগ ও নেতৃত্বের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের ফলেই আওয়ামী লীগ আজকের অবস্থায়। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের সেই নিঃস্বার্থ, ত্যাগী তৃণমূলই যেন আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। এটাই হলো ভয়ের কারণ।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিচ্ছে চেয়ারম্যান পদে। শুরু থেকেই এ মনোনয়ন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক। তৃণমূলের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রতিক্রিয়া বেশ স্বচ্ছ। জেলা ও উপজেলা নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রে নাম পাঠান। দলের সভানেত্রীর নেতৃত্বে আছে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড। এ বোর্ড স্থানীয় পর্যায় থেকে পাঠানো একাধিক নামের প্রস্তাব থেকে একজনকে মনোনয়ন দেয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে মনোনয়ন নিয়ে সব সময় বিতর্ক থাকে। এখানে দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক পরিচয় বড় করে দেখা হয়। তাই এসব নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে ভালো হতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যদি দলীয়ভাবে না করা হতো। যে-যার মতো নির্বাচন করত। তা সম্ভব হয়নি। আর সে কারণেই এ নির্বাচনে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত অনেক সতর্কতার সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন এলাকায় কথা বলে দেখেছি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলের একটি বিদ্রোহ হয়েছে। এ বিদ্রোহ মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের বিদ্রোহীরা দাবি করেছেন, স্থানীয় নেতা, এমপি এমনকি কেন্দ্রীয় নেতারা মনোনয়ন-বাণিজ্যে জড়িত। একজন তৃণমূলের নেতা বলেছিলেন, ‘একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া সবাই মনোনয়ন-বাণিজ্যে জড়িত।’ সবাই না হলেও এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যে ব্যাপক মনোনয়ন-বাণিজ্য হয়েছে তা ওপেন সিক্রেট। আওয়ামী লীগের মধ্যেই আলোচনা হয়, চেয়ারম্যান পদে এমপিরা মনোনয়ন বিক্রি করেছেন। সব এমপি যে মনোনয়ন বিক্রি করেছেন তা নয়। অনেক নব্য আওয়ামী লীগার এমপি হয়ে এলাকায় তার ভিত শক্ত করার মিশনে নেমেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের নেতা-কর্মীদের ওএসডি করেছেন। নতুন আওয়ামী লীগ তৈরি করেছেন। এদের ‘এমপি লীগ’ও বলা যায়। এমপি লীগে রাজনীতিবিদ নেই। আছেন ঠিকাদার, গ্রাম্য টাউট, সুবিধাবাদী, মৌলবাদী, ধর্ষক, সন্ত্রাসীরা। এমপি সাহেব ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে এদের মধ্যেই তো কাউকে বাছাই করবেন। এরপর কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। কারও কাজ হয়েছে, কারও হয়নি। যার হয়েছে তিনি তার নতুন আওয়ামী লীগের একান্ত চামচাকে ‘নৌকা’ প্রতীক উপহার দিয়েছেন। তৃণমূলের ত্যাগী প্রার্থীরা হতবাক হয়েছেন। ২০০১-এর পর বিএনপি-জামায়াত তাণ্ডবে এই ব্যক্তি কোথায় ছিলেন? ২০০৭-এর ওয়ান-ইলেভেনে কোথায় ছিলেন? তৃণমূল এটা মেনে নিতে পারেনি। তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। নিজেরা চাঁদা তুলে প্রার্থীর জন্য খরচ করেছেন। নতুন করে সন্ত্রাসী হামলা ও প্রশাসনের অন্যায় আচরণ হজম করেছেন। (সত্যিকারের আওয়ামী লীগ তো এসবে অভ্যস্ত)। তারপর তারা নৌকা প্রতীক পাওয়া নব্য আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দিয়েছেন। কদিন আগে বিজয়ী এক বিদ্রোহী প্রার্থী এবং কয়েকজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এমপি সাহেব যে ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি ছিলেন যুদ্ধাপরাধী সাঈদী মুক্তি পরিষদের অন্যতম নেতা। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর যারা আক্রমণ করেছিল তাদের একজন ছিলেন নৌকা প্রতীক পাওয়া ওই প্রার্থী। তার মনোনয়ন স্থানীয় তৃণমূল মেনে নিতে পারেনি। তাই সম্মিলিতভাবে তারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বেছে নেন একজন প্রবীণ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে। ওই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এ রকম ১৩১টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা প্রতীকের ভরাডুবি হয়েছে। এরা নির্বাচনে দ্বিতীয়, তৃতীয়ও হতে পারেননি। আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে প্রতিহত করেছে। মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এটি ছিল দৃশ্যমান প্রতিবাদ। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ তৃণমূলের প্রকাশ্য বিদ্রোহ।
আবার বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক স্থানে এমপিরা চেষ্টা-তদবির করেও তার পছন্দের প্রার্থীর মনোনয়ন আদায় করতে পারেননি। কেন্দ্রীয় স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত মনোনয়ন বোর্ড দলের পরীক্ষিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দিয়েছে। কিন্তু এমপি সাহেব তা মানবেন কেন? এটা যদি তিনি মানেন তাহলে তার এমপি লীগের কী হবে? দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে তিনি তার ‘একান্ত অনুগত’ ব্যক্তিকে বিদ্রোহী প্রার্থীরূপে দাঁড় করালেন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ম্যানেজ করলেন। তারপর নৌকার প্রার্থীকে দৌড়ের ওপর রাখলেন। টাকা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগকেও বিভক্ত করলেন। অবশেষে এমপির পছন্দের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হলেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হেরে গেলেন। ফলে ইউনিয়ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটেছে। প্রথম দফায় কম থাকলেও দ্বিতীয় দফায় শতকরা ৪২ ভাগ ইউনিয়নে বিদ্রোহী বা আওয়ামীবিরোধীরা জয়ী হয়েছেন। সামনে এ প্রবণতা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
অতীতে আওয়ামী লীগের তৃণমূল ছিল ঐক্যের প্রতীক। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন দলের স্বার্থের বিরুদ্ধে, দলের নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তখন তৃণমূলের ঐক্যই তা প্রতিহত করেছে। তৃণমূলের ঐক্যের ফলেই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা জাতীয় গণদাবি হয়েছে। তৃণমূলের সংগ্রামেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে জাতির পিতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। তৃণমূলের ত্যাগের জন্যই ’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। তৃণমূলের ভালোবাসায় ওয়ান-ইলেভেনের অপশক্তি আওয়ামী লীগের ক্ষতি করতে পারেনি। ২০০৯ সালের কাউন্সিলে উদ্বোধনী ভাষণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের এ শক্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীদের ভয়ভীতি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেদিন যেভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন তাতে বাঙালি জাতি আবারও উপলব্ধি করতে পেরেছে, একমাত্র আওয়ামী লীগই পারে তাদের আশা-আকাঙ্খা ধারণ করতে।... আওয়ামী লীগের যে কোনো সংকটে তৃণমূল নেতা-কর্মীরাই বারবার দলকে টিকিয়ে রেখেছেন।
এবার যেন সেই তৃণমূলকেই আত্মঘাতী বানানো হচ্ছে। তৃণমূল বিভক্ত মানেই আওয়ামী লীগ বিভক্ত। তৃণমূলে হানাহানি মানে আওয়ামী লীগে সংকট। তৃণমূলকে বিভক্ত করে কি আওয়ামী লীগের বারোটা বাজানো হচ্ছে? আওয়ামী লীগই হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের হন্তারক। আওয়ামী লীগের কাছেই হেরে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগে যে আত্মঘাতী তৎপরতা তা আওয়ামী লীগকে আরেকটি সংকটের সামনে দাঁড় করাচ্ছে। আওয়ামী লীগে যেসব স্থানীয় নেতা, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন-বাণিজ্য করছেন তারা কি জানেন আওয়ামী লীগ দুর্বল হলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। আওয়ামী লীগে যারা দলের বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছেন, উসকে দিয়েছেন তারা কি জানেন এ বিভক্তি আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বড় ক্ষতি নয়, এটা দেশেরও ক্ষতি। কারণ আওয়ামী লীগ যখন জয়ী হয় তখন একাই জয়ী হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় তখন গোটা বাংলাদেশ হারে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে
জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে
দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির
স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি
অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই
মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা
ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী
লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে
বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার
মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী
লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে
না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে
প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে
সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।
আরও পড়ুন: আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার
কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার
সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ
করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া
অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা
কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি
নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের
সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি
একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত,
ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক
কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত।
ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি
অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম
হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয়
কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত
মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল।
কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর
বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়
কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে
আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর
সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান
ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও
আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন
নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা
হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে।
এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন
না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের
বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে
পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল।
যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক
দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই
অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি
২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ
ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির
কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা
তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের
শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান।
চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়,
তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি
নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল
দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই।
দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই।
সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ
হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির
চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান
একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই
কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র
ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে
বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।
শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৪ দল আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।