ইনসাইড থট

সৃজনশীল শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫:১৭ পিএম, ১৯ জুলাই, ২০১৭


Thumbnail


আমাদের শিক্ষা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলেই আলোচনা করতে হয় তপোবনের শিক্ষার কথা। বর্তমানে আমাদের  বিদ্যালয়গুলোর ক্লাস শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে, কিন্তু একদিন আমাদের গুরু মহাশয়ের আশ্রমে পাঠ শুরুর আগে গুরু শিষ্য সমবেত কণ্ঠে উচ্চারণ করতেন বৃহদারণ্যক উপনিষদের সেই অবিনাশী উজ্জ্বল উচ্চারণ-

অসৎ হতে আমাকে সৎপথে নিয়ে যাও
অন্ধকার থেকে আমাকে আলোকে নিয়ে যাও
মৃত্যু থেকে আমাকে অমৃতলোকে নিয়ে যাও।

ক্লাসে গুরু মহাশয় প্রতিদিন বলতেন, মানুষ অমৃত্যস্যঃ পুত্রঃ, আত্ননং বৃদ্ধি, ভূমাকে জানো। প্রতিদিনের তুচ্ছতা , গ্লানি, ও হীনমন্যতা এবং ক্ষুদ্রত্ব, সংকীর্ণতা , অসত্য ও মিথ্যাকে পরিহার করে সত্যানুসন্ধানী হও, সূর্যসনাথ হও। আকাশ থেকে গ্রহ , নক্ষত্র ও প্রকৃতি থেকে নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর ও বৃক্ষ থেকে শিক্ষা লাভ কর।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব কারণ সে সৃজনশীল। বাবুই পাখি আর মাকড়া শুধু বাসা ও জাল বুনতেই জানে কিন্তু মানুষ প্রতি পদে পদে নতুনকে সৃষ্টি করে চলে কারণ মানুষ সৃজনশীল।মানুষের মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ যারা পথ নির্মাতা ও পথ প্রদর্শক। মানুষ অশ্রান্ত যাত্রা করেছে শুধু অন্ন বস্ত্রের জন্য নয়- আপনার সমস্ত শক্তি সাধনা ও সৃজনশীলতা দিয়ে মানবলোকে মহামানবের প্রতিষ্ঠার জন্য।

আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের একটি সৃজনশীল শিক্ষানীতি হবে এবং আমাদের সন্তানেরাও সৃজনশীল হবে এবং তারা দেশ মাটি ও মানুষের একাত্মতায় সম্পৃক্ত হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা যেন একটি টবের পরগাছা হয়ে উঠছে। দেশের মাটির গভীরে তারা শিকর প্রোথিত করতে পারছে না। যাদের সামনে কোনো জানা পথ নেই; আশা , উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নেই। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, লক্ষ্যহীন শিক্ষা মানুষকেও লক্ষ্যহীন করে তোলে।

অধিতবিদ্যাকে সে আত্মস্থ করতে পারেনা। শিক্ষা ব্যবস্থার পরান্নভোজী ছাত্রদের সামনে থাকে তৈরি করা নোট, গাইড ও কোচিং সেন্টার। তাঁকে কোনো চর্চা করতে হয় না এবং পরীক্ষার পড়া তৈরি করার জন্য তাকে কোনো চেষ্টা করতে হয় না। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি নেই বলেই শিক্ষার্থীরা অধিত বিদ্যাকে আত্মস্থ করতে পারেনা। এই মুখস্থ বিদ্যাকে রবীন্দ্রনাথ চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন, ‘মুখস্থ করিয়া পাশ করাইতো চৌর্যবৃত্তি। পরীক্ষাশালায় যে গোপনে বই লইয়া যায় তার চেয়েও মগজের ভেতর যে মুখস্থ বিদ্যা লুকিয়ে রাখে সে বেশি অপরাধী।’

একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে , তৈরি করা নোট, গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের সাহায্যে ফটোকপি এবং ব্যবসায়িক ও যান্ত্রিক শিক্ষার বৃত্তে বন্দী শিক্ষার্থীরা দিন দিন বাংলা ভাষার ওপর দখল হারিয়ে ফেলছে। তাদের বক্তব্য, চিন্তাকে তারা লেখ্য ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম হয়ে যাচ্ছে। ছাত্র শিক্ষকদের যে আত্মিক সম্পর্ক ও ভাবের আদান প্রদান তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অর্থের বিনিময়ে অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে। নোট দেওয়ার ফলে যে বাণিজ্যিক প্রথা গড়ে ওঠে এর মধ্য দিয়ে আত্মিক সম্বন্ধ না থাকারই কথা।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়নি। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। তবে এর দায়-দায়িত্ব অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এমন এক ধরনের সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে যেন তারা প্রাইভেট টিউটর, কোচিং সেন্টার ও গাইড বই নির্ভর না হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থী অধিত বিষয়কে আত্মস্থ করবে, চর্চা করবে এবং বিশ্লেষণ করবে। তারা প্রতিভার বিকাশ ঘটাবে, অনুসন্ধিৎসু হবে, গবেষণা  করবে এবং আবিষ্কারক হবে। ভাষার ওপর এবং তা প্রকাশের ওপর তাদের দখল থাকবে।

সৃজনশীল শিক্ষা ও শিক্ষকতা যে একটি নবযুগ ও নবজাগরণ সৃষ্টি করতে পারে এর প্রমাণ হিন্দু কলেজ, ডিরোজিও এবং ইয়াংবেঙ্গল গোষ্ঠী। তারা বঙ্গীয় রেনেসাঁ ও নব্য বাংলার অগ্রদূত স্রষ্টা। একমাত্র সৃজনশীল শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।

ছাত্রছাত্রীরা কেবল সৃজনশীল হবে শুধু এমন নয়। শিক্ষকদেরও সৃজনশীল হতে হবে। কারণ মহৎ শিক্ষক ছাড়া একটি জাতি বড় হতে পারেনা। জরাজীর্ণ এই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির বিকাশ ছাড়া এদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প পথ নেই। আমাদের রয়েছে ভাষা আন্দোলন, ও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব যা আমাদের সৃজনশীল জাতি গঠনের প্রেরণা।

ড. সফিউদ্দিন আহমেদ
সাবেক অধ্যাপক
শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সভাপতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী




মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

পার্বত্য এলাকায় শান্তিচুক্তির প্রভাব

প্রকাশ: ১২:০৩ পিএম, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব বিশ্ববাসীর কাছে একটি বিরল ঘটনা।জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তির অন্বেষায়’ প্রবন্ধে ১৯৯৮ সালে লিখেছেন, ‘পাহাড়ে বসবাসকারী কি পাহাড়ি কি বাঙালি সকলেই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। শান্তি স্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে।... শিক্ষায় স্বাস্থ্যকর্মে উন্নত সমাজ গড়তে পারলেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন হবে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে শান্তির পক্ষে। সকলেই শান্তি চায়।’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র-১, পৃ ২৩৯) শান্তির এই প্রত্যয়কে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধারণ করে শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। সেসময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ওই এলাকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য অন্যান্য স্থান থেকে মানুষ স্থানান্তর করেন। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছিল অগ্রহণযোগ্য। তৎকালীন সরকারি প্রশাসন সমতল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নদীভাঙ্গা ভূমিহীন, দিনমজুর, অসহায় দুস্থ পরিবারগুলোকে এনে সরকারি খাস ভূমিতে পুনর্বাসন করে। এই পুনর্বাসনের কয়েক বছর যেতে না যেতেই শান্তিবাহিনী নামক উপজাতীয় গেরিলারা সরকারের উপর প্রতিশোধ নিতে পুনর্বাসিত বাঙালিদের উপর হামলা চালায়। বাঙালি হত্যা ও নিপীড়ন মাত্রা অতিক্রম করে। সুরক্ষিত ওই অঞ্চলে ভারতের জঙ্গিরা সহায়তা করত শান্তিবাহিনীদের। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের জড়িত হওয়াটা ছিল ব্যয়বহুল। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়েছে দৃঢ়চিত্তে। ১৯৯৭ সালের আগে ৬ জন তরুণ অফিসার, ১ মেজর, ৩ ক্যাপ্টেন ও ২ লেফটেন্যান্টসহ ৩১২ জন সৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক হাজার কিলোমিটার রাস্তার অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত। নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশ-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক বান্দরবানের নীলগিরিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব স্পটে ছুটে যান তার পুরো অবদানটাই সেনাবাহিনীর। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ও রাস্তা নির্মাণ না করা হলে রাত্রিযাপন করে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা দূরের কথা, সেখানে কেউ যাওয়ার কল্পনাও করতেন না। বর্তমানে অপহরণ একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভারতের সঙ্গে পুনরায় সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাপ্তি ঘটে।    

শান্তি চুক্তি ২৭ বছরে পদাপর্ণ করেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি-পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালি ও সরকারি বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৬ বছর আগে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিষিদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। দুই দশক স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চাকা বন্ধ ছিল। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় পার্বত্য এলাকা তার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পায়; সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণে শেখ হাসিনার ইউনেস্কো পুরস্কার প্রাপ্তি ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি। চুক্তির পর পুরো পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৬ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সফলভাবে পরিচালনার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা লক্ষ করা যায়। তবে শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। একসময় শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাঁর সরকার। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষ আজ জানতে পেরেছে শান্তি, গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা ও অবদানের কথা। ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থানের কথা স্মরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে। শান্তি ও উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে তুলে ধরার মধ্যে আমাদের নেতৃত্বের সাফল্য গুরুত্বের সঙ্গে যুদ্ধ সংকটের মধ্যেও উপস্থাপিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের মিডিয়াতে। অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে গত কয়েক বছর জাতিসংঘের অধিবেশনগুলোতে। সেখানে স্বল্পোন্নত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। এজন্য দারিদ্র্য বিমোচনে উন্নত বিশ্বের আর্থিক প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশ্বশান্তির জন্য এখন প্রয়োজন অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভবিষ্যৎ-প্রসারী ও প্রজ্ঞাময় কর্মসূচি প্রণয়ন যা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎসরূপে গণ্য হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার পক্ষ থেকে প্রায় বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার ৩ বছর ৮ মাস ক্ষমতায় থাকাকালে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন; আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন; ভারত থেকে জুম্ম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি ও ভূমি টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার পর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে একটানা সাড়ে ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার কালে জুম চাষ, মাধ্যমিক শিক্ষা, জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান, মহাজনী কারবার ও পর্যটন- এ পাঁচটি বিষয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়েছে। সন্তু লারমার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এসব হস্তান্তরকরণ যথাযথভাবে হয়নি, আংশিক বা ত্রুটিপূর্ণভাবে হয়েছে। এমনকি রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্যবাসীর মতামত ও স্বার্থকে পদদলিত করে। এছাড়া তিনি তিন জেলায় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ভূমি আগ্রাসনের অভিযোগ তুলেছিলেন। সেখানকার উপজাতি নারীদের উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছিলেন। 

লেখাবাহুল্য, ২০১৩ সালে সন্তু লারমা এক সংবাদ সম্মেলন করে পার্বত্য এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। যদিও সেই বিরোধিতা টেকেনি। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে রাজধানীর এক হোটেলে ওই বছর ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছিলেন, ‘পার্বত্যবাসী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। এগুলো বহিরাগত অনুপ্রবেশের দ্বারে পরিণত হবে। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যন্ত এসব প্রকল্প স্থগিত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’ উপরন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের অধিকসংখ্যক কোটা সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

তাঁর কথার সূত্র ধরে বলা দরকার, পার্বত্য এলাকার বেশির ভাগ উপজাতি জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধা গ্রহণ করে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, অনেক সরকারি অফিসে উচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। এ কারণে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমতলবাসীদের তরফ থেকে এই কোটা সুবিধা বাতিলের কিংবা কমানোর যে দাবি উঠেছিল তা অযৌক্তিক নয়। ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি সফরের সময় জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ঘোষণা দেন। তারপর থেকেই এর পক্ষে-বিপক্ষে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। অথচ পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ‘সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, অনুন্নত সম্প্রদায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ ’৭২-এর সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতিদের অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ধর্মীয় ও নৃ-জাতিসত্তাগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান এবং তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দৃঢ়ভাবে সমুন্নত থাকবে। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির অবশিষ্ট অঙ্গীকার ও ধারাসমূহ বাস্তবায়িত করা হবে। পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হবে এবং তিন পার্বত্য জেলার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখা, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করে তোলা হবে। এই তিন জেলায় পর্যটন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’ 

অর্থাৎ বর্তমান সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবেই সন্তু লারমাসহ সব ক্ষুদ্রজাতি জনগোষ্ঠীর জানমাল ও সম্পদ সুরক্ষার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। গত মহাজোট সরকারের শাসনামলে তিন পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যে দুর্গম এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল সে স্থানগুলো তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনা হয়েছে। যেখানে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও বাজারের সংকট ছিল সেসব জায়গা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা হলো স্থানীয় ক্ষুদ্রজাতি জনগোষ্ঠী কর্তৃক সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার বাস্তবতা। সেখানে রয়েছে শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফের ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসী’ কার্যকলাপ। তাদের চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যদিও একই অভিযোগ রয়েছে সন্তু লারমার ‘জেএসএস’-এর বিরুদ্ধেও। গোপন সূত্রে সংবাদ পাওয়া গেছে, কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) তাদের কৃষিভিত্তিক খামারের প্রজেক্ট এই উভয় গ্রুপের টানাটানিতে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। সেবামূলক প্রকল্পটিতে বরাদ্দ করা বিদেশি সাহায্যের টাকাও ফেরত গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালির সম্প্রীতি রক্ষার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, ২৬ বছর আগের (১৯৯৭) ২ ডিসেম্বর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষর করেন। ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের দ্বার উন্মুক্ত হলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংগঠন ও দেশী-বিদেশী এনজিও তাদের সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। তবে চুক্তি অনুযায়ী গঠিত ‘হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’ ও ‘রিজিওনাল কাউন্সিলে’র চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে মূলত জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতারা নির্বাচিত না হয়েও সম্মান, সম্পদ ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয় যা ‘শান্তিচুক্তি’ বিরোধী উপজাতীয় নেতৃত্বস্থানীয়দের অন্তর্জ্বালা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই কারণে আঞ্চলিক উপজাতীয় রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়ে পড়ে এবং ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের প্রায় এক বছরের মাথায় ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে পার্বত্য রাজনীতিতে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ২২ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রণীত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭’ (কনভেনশন নম্বর ১০৭)-এ অনুস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের এ সংস্থা আবার সংশোধিত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৮৯’ (কনভেনশন নম্বর ১৬৯) গ্রহণ করেছে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল জাতীয় পর্যায়ে উপজাতিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। এখানে ট্রাইবাল বা সেমিট্রাইবাল বলতে ওই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ট্রাইবাল বৈশিষ্ট্য হারানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এখনো জাতীয় জনসমষ্টির সঙ্গে একীভূত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি অধিবাসীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অবশ্য কয়েকটি মৌলবাদ সমর্থিত পত্রিকা পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরে অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকে ইউপিডিএফের সদস্যদের অস্ত্রসহ আটকের সংবাদ ছাপানো হয়েছে। পার্বত্যচুক্তি বিরোধী ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে’র (ইউপিডিএফ) সদস্যদের এ ধরনের তৎপরতা এখনও বহাল রয়েছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। প্রকাশ্যে তারা বর্তমান সরকারের চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ও নিন্দা প্রকাশ করে। এছাড়া জনসংহতি সমিতির সঙ্গে রয়েছে তাদের দ্বন্দ্ব। পরস্পর পরস্পরের কর্মী হত্যাকাণ্ডের বিবাদেও জড়িত। অন্যদিকে প্রতি বছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয়(সন্তু) লারমা পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুসারে উপজাতিদের অধিকার সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহলের দাবি থেকে স্পষ্ট যে চুক্তিটির গুরুত্ব এখন অপরিসীম। কয়েক বছর আগে সুশীল নেতারা বলেছেন, ‘দেশের সব নাগরিক সমানভাবে নাগরিক অধিকার পাচ্ছে না- এটা বাস্তবতা।’ আমাদের মতে, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সবাইকে সমান সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। সমতলের মানুষ যে সুযোগ পাচ্ছে, সেই সমান সুযোগ পাহাড়ের মানুষ পাবে না। সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো অবশ্যই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ। বিশেষ অঞ্চল বলেই দেশের মধ্যে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে। একজন প্রতিমন্ত্রী সেখানকার সকল বিষয় দেখভাল করার জন্য নিয়োজিত রয়েছেন। ১৪৫টির বেশি এনজিও পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের যাবতীয় উন্নয়নের জন্য নিরলস কাজ করছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে কেবল শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই।  রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের উন্নয়নের জন্য বছর বছর মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। তবে সরকারের গৃহীত প্রকল্পের শতকরা ৯০ভাগ উপজাতীয়রা এবং ১০ভাগ বাঙালিরা অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ সিংহভাগ ব্যয় হয় উপজাতিদের উন্নয়নের জন্য। এক্ষেত্রে আমাদের অভিমত হলো, উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয়দের উন্নয়ন ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য বজায় না থাকলে তা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে। মূলধারার রাজনীতি চালু থাকলে সেখানকার সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয় সর্বাগ্রে প্রাধান্য পেত। এজন্য পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রমে সর্বদা একটা বৈষম্য দেখা যায় বলেই মাঝেমধ্যে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ লেগে যায়। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য দিক হলো-শান্তিচুক্তির পর আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্পও বৃদ্ধি করেনি। বর্তমানেও চলমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশবাহিনী যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। বরং চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করতে ইউপিডিএফ ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ড ও সশস্ত্র সংঘাত সৃষ্টি করে থাকে। আবার তাদের রুখতে অন্যেরা অস্ত্র ধরেছে। অথচ ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গেরিলা যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। একসময় বিভিন্ন দলের ভেতর কোন্দল এবং বিশৃংখলা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নেওয়ায় চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমানে সেই পরিস্থিতিও পাল্টে গেছে। কিন্তু তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন ও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিকে সামনে রেখে সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের জীবনে অভ্যস্ত বিচিত্র দলের কর্মীরা অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে মাঝে-মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠছে। সরকারের দ্রুত ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যার এখন পর্যন্ত সমাধান হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পাহাড়ি বাঙালিদের প্রতি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বা উপজাতিরা সদয় দৃষ্টি দেবে- এ প্রত্যাশাও রয়েছে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষের জনশক্তির।  

উল্লেখ্য, শান্তি চুক্তির গুরুত্ব দেখা যায় তুলনামূলক উন্নয়ন চিত্রে। পাহাড়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অধিকাংশই স্থানীয় উপজাতিদের কল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে। চাকমা উপজাতির জন্য মোট প্রকল্প ১৮৬ টি(৪৫%),  অন্যান্য উপজাতিগুলোর জন্য মোট প্রকল্প ১৯৪টি(৪৬%)। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য মোট প্রকল্প ৩৮০টি(৯১%)। পক্ষান্তরে  বাঙালিদের জন্য মোট  প্রকল্প ৩৬ টি (৯%)। পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ মোট সদস্য সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে ১২টি অ-উপজাতির জন্য রাখা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদটি সবসময়ের জন্য উপজাতি গোত্রের জন্য সংরক্ষিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জন্য দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং কিছু বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ২১৭টি ভর্তি কোটা ছিল।অবশ্য কোটা বাতিল হলেও শেখ হাসিনা জানিয়েছেন যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিশেষ বিবেচনায় দেখা হবে। 

মূলত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন ছিল। এ কারণে শেখ হাসিনার নানান ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তিও ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনন্য স্বীকৃতি। তবে শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। অর্থাৎ পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ।

(লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)


পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ডামি বনাম দামি প্রার্থী


Thumbnail

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দল মনোনীত প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য কোন দলের প্রার্থী মাঠে না থাকলে দলের আসল বা দামি প্রার্থী যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত না হতে পারে সে জন্যই এ নির্দেশ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। গত ২৬ নভেম্বর তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মত বিনিময়কালে এ সব তথ্য দেন তিনি। সেই থেকে দেশের রাজনীতিতে ডামি ও দামি প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ জোরে সোরে।

 

দামি প্রার্থী হল দল মনোনীত আসল প্রার্থী। কিন্তু ডামি প্রার্থী কে হবেন? ডামি মানে কি? এ সব নিয়ে ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যার যেন অন্ত নেই। অক্সফোর্ড অভিধান বলছে, ডামি মানে মানুষের একটি মডেল বা প্রতিরূপ। এক্ষেত্রে মানুষ হচ্ছে, প্রার্থী যিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অপর কথায়, ডামি হচ্ছে বাস্তব বা স্বাভাবিকের বিকল্প হিসাবে সাদৃশ্য একটি প্রতিরূপ । ডামি মানে নকল, জাল। সাধারণত সস্তা উপকরণ দিয়ে তৈরি। যেমন, বাড়ির ডামি শাটার। যেগুলো আসলে ভিনাইল দিয়ে তৈরি এবং শুধুমাত্র সাজসজ্জার জন্য। কেমব্রিজ অভিধানও অনুরূপ বলছে। তারা বলছে, ডামি হচ্ছে, মানুষের একটি বড় মডেল। বিশেষত একটি দোকানে কাপড় দেখাতে যা ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কাপড়ের দোকানে যে পুতুলগুলোর গায়ে জামা কাপড় পরানো থাকে সেটাই ডামি। সোজা বাংলায়, ডামি হচ্ছে একটি মূর্তি বা পুতুল, কৃত্তিম বা সাজানো জিনিস, সাক্ষী গোপাল ধরণের। কোন ব্যক্তি বা বস্তুর নকল যা আসল ব্যক্তি বা বস্তুর উপস্থিতির উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে।

 

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, একজন ডামি প্রার্থী হলেন একজন প্রার্থী যিনি সাধারণত কোন উদ্দেশ্য বা জয়ের বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা ছাড়াই নির্বাচনে দাঁড়ান। নানা কারণে বিভিন্ন দেশে ডামি প্রার্থী দেয়ার নজির রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য এবং কোন নির্দিষ্ট  প্রার্থীর ভোট কমানোর জন্য  ডামি প্রার্থী মাঠে নামাতে পারে। ২০১৪ সালের ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনে, চান্দু লাল সাহু নামে সাতজন এবং চান্দু রাম সাহু নামে আরও চারজন প্রার্থী ছিলেন। ভারতীয় জনতা পার্টির চান্দু লাল সাহু মাত্র ১২১৭ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন। ডামি প্রার্থীরা তার জন্য নির্ধারিত ভোটে ভাগ বসান । তাদের মধ্যে একজন 'সাহু' নির্বাচনী এলাকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। এর পর থেকে ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের ছবি সহ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালু করে। বিখ্যাত মার্কিন অভিনেতা এডি মারফির সিনেমা 'দ্য ডিস্টিংগুইশড জেন্টলম্যান' নির্বাচন প্রার্থীর নাম বিভ্রাটের উপর কিছুটা ভিত্তি করে তৈরি হয়।

বিজ্ঞাপন বা প্রচারণার অর্থায়নের সীমা অতিক্রম করতে একজন আসল বা দামি প্রার্থী একজন ডামি প্রার্থীকে ব্যবহার করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে আসল বা দামি প্রার্থীরা তাদের ভোটের খরচ বিতরণের জন্য একাধিক ডামি প্রার্থী কে মাঠে নামানোর ঘটনা ঘটেছে। খরচ দামি  প্রার্থীর প্রচারে পরিচালিত হয়, তবে ডামি প্রার্থীদের নামে নির্বাচন কমিশনকে দেখানো হয়।

১৯৮২ সালের গ্লাসগো হিলহেড উপনির্বাচনে, রায় হ্যারল্ড জেনকিন্স নামে একজন প্রার্থী ছিলেন। ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য একজন ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করে "রয় হ্যারল্ড জেনকিন্স" রাখেন। এবং তাকে ডামি প্রার্থী করা হয়। সে নির্বাচনে 'রায়' হ্যারল্ড জেনকিন্স ১০১০৬ ভোটে পেয়ে বিজয়ী হন। ডামি প্রার্থী 'রয়' হ্যারল্ড জেনকিন্স ২৮২ ভোট পান।  


আবার ফিরে আসি ডামির অর্থ নিয়ে। ব্রিটানিয়া অভিধান আরেকধাপ এগিয়ে বলছে, ডামি মানে স্টুপিড বা বোকা। সপ্তাহখানেক আগে যাঁরা নিজেদেরকে দামী প্রার্থী মনে করতেন, তাঁরা এখন নিজেদেরকে ডামি বানিয়ে স্টুপিড বা বোকা হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেয়া এই ইংরেজি শব্দকে তাঁরা অপব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদেরকে বোকার জাতে সামিল করছেন। দলের মধ্যে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করছেন। দলে সংকট তৈরি করছেন । ডামি এবং দামি প্রার্থীর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। গন্ডগোল পাকিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আর ডামি প্রার্থীর মধ্যে।

 

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বিষয়টি একটু পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, ডামি প্রার্থী জেতার প্রার্থী নয়। এটা বলা হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে নির্বাচন না হয় সেজন্য। আর স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাখ্যা অন্য জিনিস। নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করতে অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনেছিলেন তারা কোনো অবস্থাতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না। কেউ করলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।

 

দলের যে সকল বিদ্রোহী নিজেকে ডামি প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দিচ্ছেন, তাঁরা দলীয় প্রধানের নির্দেশকে তোয়াক্কা করছেন না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দল মনোনীত প্রত্যেক প্রার্থীকে একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু এসব স্বঘোষিত ডামি 'দল ঘোষিত মনোনীত প্রার্থীদের' মনোনীত নন। দলের মনোনয়নধারী প্রার্থীর কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছেন না। নিজেদেরকে ডামি হিসাবে সাফাই গাইলেও তাঁরা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। বস্তুত তাঁরা ইতিমধ্যেই দলের নির্দেশ অমান্য করেছেন। প্রকারান্তরে নিজেদেরকে তাঁরা ইতিমধ্যেই বিদ্রোহী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন।

 

ডামি ও বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে ইতিমধ্যে মাঠে পর্যায়ে অন্তদ্বন্দ ও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকা দলটিতে কোন্দল শুরু হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই সেটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সেটি অব্যাহত থাকলে ভোটের ময়দানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ভোটাররা ভোট কেন্দ্র বিমুখ হয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় কৌশল ব্যর্থ হবার আশংকা রয়েছে।

দলটির প্রথম সারির নেতারা ইতিমধ্যে আশ্বস্ত করেছেন যে, মনোনীত প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার নির্দেশ- একটি দলীয় নির্বাচনী কৌশল। পরিস্থিতি বুঝে কৌশল পরিবর্তিত হতে পারে। সবখানেই ডামি প্রার্থী থাকবে না। বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থীদের মাঠে ছাড়ার নির্দেশ আসবে যে কোন সময়। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ আসবে। তবে সেটা যত দ্রুত আসবে, ততই মঙ্গল দলীয় প্রার্থীদের জন্য, ভোটের মাঠের জন্য, ভোটারদের জন্য, ভোটের জন্য।


নির্বাচন   ডামি প্রার্থী   জাতীয় সংসদ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘আসিফ নজরুল একজন কাঁচা মানের বুদ্ধিজীবী’


Thumbnail

এদেশে বিএনপি বুদ্ধিজীবীদের প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে বেশ পছন্দ করি। দুটি কারণে আমি তাকে পছন্দ করি। একটি কারণ হচ্ছে তার ব্যবহার খুবই ভাল। বয়সের বিবেচনায় আমার ছোট বলে তিনি যেভাবে কথাবার্তা বলেন তাতে আমার মনে হয় যে একজন ছোট ভাই আমার সাথে কথা বলছে। আরেকটি কারণে তাকে পছন্দ করি। সেটা হল তিনি তার লেখাতে কোন রাখঢাক করেন না। তিনি যেটা বিশ্বাস করেন সেটাই করেন এবং তিনি যে বিএনপির একজন খাঁটি বুদ্ধিজীবী নেতা এটা বোঝা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অধ্যাপনা সেটা পরিচয়ের কারণে। তার আসল কাজ হচ্ছে বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসাবে কাজ করা। কিন্তু তাকে এতদিন যে ধরনের বুদ্ধিজীবী করেন করেছিলাম সেটা ভুল ছিল। এখন মনে হচ্ছে তিনি একজন খুব কাঁচা মানের বুদ্ধিজীবী।

তিনি এক ফেসবুক পোস্ট লিখেছেন যে, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে হচ্ছে না। তার কারণ হিসেবে তিনি উপস্থাপন করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন হচ্ছে। এজন্য এটা নির্বাচন না। কিন্তু জাতীয় পার্টি এতদিন ধরে বিরোধী দলে থাকল সেটা নিয়ে আসিফ নজরুল কোন লেখা লিখলেন না। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে সর্বজন গৃহীত হয়েছে। এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠে নাই আন্তর্জাতিক মহলে। 

এদিকে এবার শুধু আওয়ামী লীগ একা না, বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচন করছে। এর বাইরে ১৪ দল সহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে আছে তাহলে এরা কোথায় গেল। এখানে তো শুধু আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের নির্বাচন হচ্ছে না।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা নাই’


Thumbnail

আমি গত তিন বছর ধরে বাংলা ইনসাইডার এবং অল্প কিছু লেখা বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছি। এর মূল সুর একটিই। আর তা হল বাংলাদেশে নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে এবং সংবিধান অনুযায়ী হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এবং যার ভোট তিনিই দেবেন। এর মূল কারণও ছিল একটিই। বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তিনি এ দেশের মানুষের ভোটের এবং ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং তার হাত ধরে মানুষের ভোটের অধিকার থাকবে না সম্ভব না। আমি এটাও বলেছিলাম যে বিএনপি কোনো না কোনোভাবে অবশ্যই নির্বাচনে থাকবে এবং নির্বাচন খুব কঠিন নির্বাচন হবে। এবং আওয়ামী লীগের নেতারা যেন শুধুমাত্র নমিনেশন পাওয়ার জন্য দৌঁড়োদৌঁড়ি না করে বরং জনগণের ভিতরে তিনটি কাজ করবেন। এটা বারবার লিখেছি আবারও বলছি। সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে তাদের জনগণকে বারবার জানানো যে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্যই কি করছেন? 

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ২০০১ সালে বিএনপি এসে বাংলাদেশের ওপরে কি অত্যাচার করেছিল সাধারণ মানুষের ওপরে। এবং তৃতীয়টি হচ্ছে যে যদি আবার দার্শনিক নায়ক জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন তাহলে দেশ স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে কি বোঝায় সেটা প্রতিটি জনগণই বুঝতে পারবে। এটি আমার মূল সুর ছিল। এর ভেতর আমি এটাও বলেছিলাম যে এবার মোটামুটি ভাবে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে। 

জাতীয় পার্টির প্রধান হওয়ার পর জিএম কাদের প্রচেষ্টা চালালেন যে জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায় না রেখে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা অবতীর্ণ করার। এটা আমার মতে খুব ভালো প্রচেষ্টা। কিন্তু কথায় আছে না স্মার্ট হওয়া ভাল, কিন্তু ওভারস্মার্ট হওয়া ভালো না। তিনি (জিএম কাদের) করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে গেলেন যে মনে করলেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বোধহয় জাতীয় পার্টির ওপর নির্ভর করেই এদেশে গণতন্ত্র রক্ষা করবে অথবা ক্ষমতায় আসবে। এটা যে কত বড় ভুল এখন তারা বোধহয় বোঝা শুরু করেছে। বাস্তব অবস্থাটা হচ্ছে এখন নির্বাচনে বিএনপি প্রক্সির মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন লোক বিভিন্ন দল করে আসবে নির্বাচন। নির্বাচনও কঠিন হবে এবং আমার মতে কমপক্ষে ৩০ জন যে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেট তারা নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসবে। এখন সেই জায়গায় জাতীয় পার্টি যে তাদের ফরম বিক্রি করছে, যা বিশ্বের ইতিহাসে নাই। আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব কি করব না কিন্তু ফরম বিক্রি করে যে টাকাটা নিচ্ছি সেটা কিসের জন্য? এটা তো কোন রাজনীতির পরিভাষায় তা পড়ে না। তার মানে কি তার নির্বাচনে আসবেন? 

এখন জিএম কাদেররা বুঝে ফেলেছেন যে নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ হয় তাহলে জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা নাই। এবার বিরোধী দল হয়তো অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ পাবে। কারণ জাতীয় পার্টি তো আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া আসনগুলো জয়ী হয়ে আসে। কিন্তু এবার এসব কিছু হবে না। কারণ রওশন এরশাদ আলাদা হয়ে গেছে। তিনিও হয়তো শেষ নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারবেন না। জাতীয় পার্টিও হয়তো এবার মুসলিম লীগের মতো হবে। এবার অন্য নতুন কোন দল আসবে। আর সেটা হওয়ার উচিত বলে আমি মনে করি। নেত্রী সব সময় বলেন যে, একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। এই মুহূর্তে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল না পেলেও আগামীতে হয়তো পাবো। কারণ বিরোধী দল হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা যথেষ্ট বিগ্ক এবং তারা সংসদ সজীব রাখতে সক্ষম হবে বলে আমার মনে হয়। তবে সুযোগ হারাবে জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টি। তারা বিরোধী দল থেকে এখন তিন নম্বর দলে চলে যাবে। বিরোধী দলে আমরা হয়তো এবার নতুন দলকে দেখব। সব সময় নির্বাচন এলে জাতীয় পার্টি যেন একটা খেলা জমিয়ে ফেলে। কিন্তু একই নিয়ম যে সবসময় চলে না এই উপলদ্ধি জাতীয় পার্টি করতে পারেনি। কথায় আছে ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয় কিন্তু একইভাবে পুনরাবৃত্তি হয় না।




মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবের দিন

প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ২১ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবের দিন। দিনটিতে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করা হয় এভাবে- ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করার জন্য দরকার একটি সুপ্রশিক্ষিত, সুশৃঙ্খল ও দক্ষ সশস্ত্র বাহিনী। তিনি ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল এক সরকারি আদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংগঠনিক কাঠামো ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস’ ভেঙে স্বতন্ত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গড়ার নির্দেশ দেন এবং দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দক্ষ ও চৌকশ সশস্ত্র বাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেন। জাতির পিতার পরিকল্পনায় স্বাধীনতার পরপরই ঢাকায় ৪৬ পদাতিক বিগ্রেড, যশোরে ৫৫ পদাতিক বিগ্রেড এবং কুমিল্লায় ৪৪ পদাতিক বিগ্রেড প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। তাছাড়াও, তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিটি আর্মস ও সার্ভিসের গোড়াপত্তন হয় এবং শতাধিক ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকায় দেশের প্রথম অফিসার প্রশিক্ষণ একাডেমি চালুর ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সেনাবাহিনীর ০৮ জন এবং বিমান বাহিনীর ০১ জন অফিসারকে ভারত পাঠানো হয় নতুন ক্যাডেট নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের হাতেই গড়ে ওঠে ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড (আইএসএসবি)। ১৯৭৩ সালের ২৯ নভেম্বর কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি। দেশে নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠার জন্যে বঙ্গবন্ধু মূলত স্বাধীনতার পূর্বেই ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে এ ভূখণ্ডে নৌবাহিনী সদর দপ্তর স্থাপনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে নৌবাহিনীর ভিত রচনা করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জাতির পিতা প্রায় শূন্য থেকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেন। একটি দক্ষ,শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি তিনটি নৌবাহিনী ঘাঁটি- বানৌজা হাজী মহসিন, বানৌজা ঈসা খান ও বানৌজা তিতুমীর স্থাপন করেন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক প্রয়াসে সংগ্রহ করা হয় ০৫ টি আধুনিক রণতরী এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে প্রদান করা হয় নেভাল এনসাইন। দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে মহান এ রাষ্ট্রনায়ক ১৯৭৪ সালে প্রণয়ন করেন ‘বাংলাদেশ টেরিটোরিয়াল ওয়াটার'স এন্ড মেরিটাইম জোনস এ্যাক্ট’। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও সামরিক কৌশলগত দিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিধি ও সম্ভাবনার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল একটি আধুনিক, শক্তিশালী ও পেশাদার বিমান বাহিনী গঠনের। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে স্বাধীনতার পরপরই বিমান বাহিনীতে সংযোজিত হয় তৎকালীন অত্যাধুনিক মিগ-২১ সুপারসনিক যুদ্ধবিমান, এএন-২৪ বিমান ও এএন-২৬ পরিবহন বিমান, এমআই -৮ হেলিকপ্টার ও এয়ার ডিফেন্স রাডার। বঙ্গবন্ধু উন্নত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৯৭৪ সালে ‘প্রতিরক্ষা নীতি’ প্রণয়ন করেন।

বঙ্গবন্ধুর অবদানের সূত্র ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিবসটি উপলক্ষ্যে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেছেন-‘জাতির পিতা স্বাধীনতার পর একটি আধুনিক ও চৌকস সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। সেনাবাহিনীর জন্য তিনি মিলিটারি একাডেমি, কম্বাইন্ড আর্মড স্কুল ও প্রতিটি কোরের জন্য ট্রেনিং স্কুলসহ আরও অনেক সামরিক প্রতিষ্ঠান এবং ইউনিট গঠন করেন। তিনি চট্টগ্রামে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি ঈশা খাঁ উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৎকালীন যুগোশ্লাভিয়া থেকে নৌবাহিনীর জন্য দু'টি জাহাজ সংগ্রহ করা হয়। বিমান বাহিনীর জন্য তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সুপারসনিক মিগ-২১ জঙ্গি বিমানসহ হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান ও রাডার সংগ্রহ করেন।বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীকে দেশে ও বিদেশে উন্নততর প্রশিক্ষণ প্রদানসহ আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করছি। জাতির পিতার নির্দেশে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপযোগী ১৯৭৪ সালে প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিমালার আলোকে ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় তিন বাহিনীর পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের কার্যক্রমসমূহ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী দুর্যোগ মোকাবেলা, অবকাঠামো নির্মাণ, আর্ত মানবতার সেবা, বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা এবং বিভিন্ন জাতি গঠন মূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন। এভাবে সশস্ত্রবাহিনী আজ জাতির আস্থার প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। আমি আশা করি, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশপ্রেম, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম হবো, ইনশাল্লাহ।’

প্রকৃতপক্ষে দেশের যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীর অবদান মূল্যায়ন করলে এই দিবসটির গুরুত্ব  উপলব্ধি করা সম্ভব। উপরন্তু গত সাড়ে ১৪ বছরে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন ও তাদের কার্যক্রমের সাফল্য গাথা বিশ্লেষণ করলেও স্পষ্ট হবে এই দিবসটি উদযাপনের তাৎপর্য। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূচনা করে। ৮০র দশকের মাঝামাঝি থেকে সম্মিলিতভাবে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর আগে ২৫ মার্চ সেনা, ১০ ডিসেম্বর নৌ এবং বিমান বাহিনী ২৮ সেপ্টেম্বর আলাদাভাবে দিবসসমূহ পালন করা হতো। পরে ২১ নভেম্বরের তাৎপর্য সমুন্নত রাখতে সম্মিলিত দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের পিছনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর অবদানকে সাধারণ জনতার আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করে দেখা হয় এ দিবসটিতে।

 ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলার জবাবে অস্ত্র তুলে নেয় বিপ্লবী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, আনসার এবং অন্যান্য সদস্যরা। পরবর্তীতে এগিয়ে আসে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মরত বাঙালি নাবিক ও নৌ অফিসার, সেনা ও বিমান কর্মকর্তারা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সর্বস্তরের মুক্তি পাগল হাজার হাজার যুবক। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ধারণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানি শাসকদের স্বপ্ন নস্যাৎ ও তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় একটি সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর। মুজিব নগরে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার কর্নেল এমএজি ওসমানীকে (পরবর্তীতে জেনারেল) মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিয়োগ করে। তার ওপর মুক্তিবাহিনীকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকগণ দ্রুত নিজেদের সুসংগঠিত করে পাল্টা আক্রমণ করে। সারাদেশকে বিভক্ত করা হয় ১১টি সেক্টরে যার নেতৃত্ব প্রদান করা হয় একেকজন সুশিক্ষিত পেশাদার সেনা কর্মকর্তাদের। আট মাস পর ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর চূড়ান্তভাবে সম্মিলিত আক্রমণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সেদিন স্থল, নৌ ও আকাশ পথে কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে চালানো হয় ত্রিমুখী আক্রমণ। উন্মুক্ত হয় বিজয়ের পথ। এই আক্রমণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফলতা লাভ করে জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে। তারা বাধ্য হয় পশ্চাদপসারণে। সুশিক্ষিত একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে সূচিত হয় মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের ইতিহাস। তারপর মিত্র বাহিনীর সহযোগে ঘোষিত হয় সার্বিক যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয়। প্রকৃতপক্ষে এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর অবলুপ্ত হয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনবাহিনীর পৃথক পৃথক সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগসমূহের সর্বাধিনায়কতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে এবং আইনের দ্বারা তার প্রয়োগ নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন সংকটে-বিপদে সশস্ত্র বাহিনী এদেশের মানুষের পাশে থেকেছে সবসময়।ঝড়-তুফান-বন্যা তো আছেই, এর উপর বৈশ্বিক পরিস্থিতির উত্তাপও এসে লাগে- আর তখন আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেন।এজন্য শেখ হাসিনা সরকারও তাদের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ।

শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৪ বছরে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে আন্তরিক কর্মযজ্ঞ দেখা গিয়েছে। ইতোপূর্বে ১৯৯৬ সালে এই আওয়ামী লীগ সরকারই তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এপিসি বা Armoured Personnel Carrier, MIG-২৯ যুদ্ধ বিমান, অত্যাধুনিক Class-4 ফ্রিগেট ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে। পেশাদারিত্ব বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ওয়ার কলেজ, আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ, BIPSOT বা Peace Keeping ইন্সটিটিউট, BUP বা Science & Technology ইন্সটিটিউট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জনবল বাড়ানোর জন্য একটি কম্পোজিট ব্রিগেড, একটি পদাতিক ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস ব্রিগেড ও বেশ কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের ব্যাটলিয়ানসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর নতুন Armoured Personnel Carrier কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন সিস্টেমকে ডিজিটালাইজড করতে এবং তথ্য -প্রযুক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে ফোর্সেস গোল-২০৩০ এর আওতায় সেনাবাহিনীতে একাধিক পদাতিক ডিভিশন, বিগ্রেড এবং আর্মি ওয়ার গেম সেন্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রতিটি কোর ও সার্ভিসে সংযোজিত হয়েছে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি। বাংলাদেশ নৌবাহিনী আজ একটি পেশাদার ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এ বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে আধুনিক সারফেস ফ্লিট, সাবমেরিন, নেভাল অ্যাভিয়েশন, নৌ কমান্ডো সোয়াডস এবং বৃদ্ধি পেয়েছে নৌঘাঁটি ও অবকাঠামোগত সুবিধা। বিমান বাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে একাধিক বিমান ঘাঁটি, ইউনিট, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান, পরিবহন বিমান, হেলিকপ্টার, রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুগোপযোগী সামরিক সরঞ্জাম। সশস্ত্র বাহিনীতে প্রশিক্ষণের মান যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আন্তর্জাতিকমানের উচ্চ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান।

সেনাবাহিনীতে চতুর্থ প্রজন্মের ট্যাংক-এমবিটি ২০০০, অত্যাধুনিক রাডার, সেল্ফ প্রপেলড গান এবং নতুন হেলিকপ্টার সংযোজন করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নকল্পে আওয়ামী লীগ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে ঋণ চুক্তি অনুযায়ী সমরাস্ত্র ক্রয় করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বৈশ্বিক মানে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে জুলাই ২০১৩ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে মেডিকেল কোরে মহিলা সৈনিক ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। সাংগঠনিক এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সিলেটে একটি পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে রূপান্তর করে একটি ম্যাকানাইজড পদাতিক ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

জাতিসংঘ সনদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা এবং সপ্তম অধ্যায়ে শান্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সংঘর্ষে লিপ্ত দুপক্ষের সম্মতি এবং মতৈক্যের উপর ভিত্তি করে শুরু হয়। শান্তিরক্ষা বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ কর্তৃক অনুমোদিত একটি শান্তি চুক্তি বা শান্তি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়। এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৬৮টি মিশনের মধ্যে ৫৪টিতে ১,১৮,৯৮৫ জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে এদেশের সেনাবাহিনীর ১৫ জন সদস্য জাতিসংঘের পতাকাতলে একত্রিত হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী শান্তি মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবাদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কঙ্গো, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা/রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্ততান, কসোভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর প্রভৃতি স্থানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নাম। মূলত বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কারণ বিশ্বে সকল প্রান্তের দুর্গত, নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এ শান্তিরক্ষীদের হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছে।

আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সৎ, যোগ্য ও দক্ষ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন থাকবে, যা আজ বাস্তবে প্রতিফলিত। দেশের শান্তি -শৃঙ্খলা রক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জাতি গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিশ্ব শান্তিরক্ষায় আজ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর রয়েছে অসামান্য অবদান। বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং কর্মদক্ষতার পরিচিতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। আসলে দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালোবাসা- এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর দেশপ্রেম। আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিন বাহিনীর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনার আধুনিকায়ন করে যেতে হবে। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী চ্যালেঞ্জ নিয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে। এই ধারা অব্যাহত রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমুন্নতি বিধান এবং সর্বোপরি দুর্যোগ মোকাবেলায় ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ উদযাপনের গুরুত্ব অপরিসীম।


(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)


সশস্ত্র বাহিনী দিবস  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন