এডিটর’স মাইন্ড

‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!’

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৯ জুলাই, ২০২২


Thumbnail ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!’

আগামীকাল পবিত্র ঈদুল আজহা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর আশা করেছিলাম এবার ঈদ হবে উৎসবমুখর। কিন্তু বেশ কিছু কারণে উৎসব মলিন, বিবর্ণ। হঠাৎ লোডশেডিং যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। গত ১০ বছরে লোডশেডিংয়ের কথা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট জমানায় বিদ্যুৎ মাঝেমধ্যে আসত। বেশির ভাগ সময় দেশ ডুবে থাকত অন্ধকারে। সারা দেশে ১২ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হতো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়। গত ১৩ বছরে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সাফল্যের একটি- বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি। আওয়ামী লীগ কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করেনি, সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় যেখানে দেশের মাত্র ৪০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত, বর্তমানে প্রায় শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে এখন ফ্রিজ, টিভি, এয়ারকুলার আর বিলাসিতা নয়। প্রত্যেক মানুষের জীবনযাপনের অপরিহার্য উপকরণে পরিণত হয়েছে। মানুষ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এ সময় নতুন করে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা মানুষ মেনে নিতে পারছে না। সরকারের পক্ষ থেকে লোডশেডিংয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববাজারে জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে লোডশেডিং মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতে গত ১৩ বছরের সব অর্জন এ কদিনে যেন উবে গেছে। আগে কী ছিল, এ নিয়ে কেউ আলোচনায় আগ্রহী নয়। বর্তমান সংকট নিয়েই জনগণ উদ্বিগ্ন, চিন্তিত, অসন্তুষ্ট। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে শুধু যে বাসাবাড়িতে সমস্যা হচ্ছে, তা নয়। বরং তার চেয়েও বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে শিল্পকারখানা ও কৃষিতে। শিল্পোদ্যোক্তারা গ্যাস পাচ্ছেন না। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষিতে সেচের নিরবচ্ছিন্ন ব্যবস্থা না হলে খাদ্য উৎপাদনে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হবে। শঙ্কার কালো মেঘ যেন পুঞ্জীভূত হচ্ছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংকটের অবয়ব ফুটে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সংকট পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় ভিত্তি হলো প্রবাসী আয়। গত অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায়, প্রবাসী আয় প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে। তবে ঈদের আগে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। ঈদের আগে পাঁচ দিনে ৫ হাজার কোটির বেশি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। কিন্তু এও আশা জাগাতে পারছে না। প্রতিটি ঈদেই প্রবাসী ভাইবোনেরা আত্মীয়-পরিজনের জন্য বাড়তি টাকা পাঠান। এটি ধারাবাহিকভাবে না এলে আমাদের রিজার্ভে চাপ বাড়বে। সরকার নতুন অর্থবছর শুরুই করেছে কৃচ্ছ্র নীতির মাধ্যমে। আগেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। নতুন অর্থবছরে গাড়ি কেনা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানা ব্যয় কাটছাঁট করা হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের যে চাপ বাড়ছে এটা আর কোনো গোপন বিষয় নয়। প্রশ্ন হলো, এ চাপ কত দিন থাকবে? অর্থনৈতিক সংকট আর কত গভীর হবে? করোনা-পরবর্তীতে এমনিতেই স্বল্প আয়ের মানুষ সংকটের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। এখন অর্থনৈতিক সংকট মধ্যবিত্তকেও অন্ধকার টানেলে নিয়ে গেল। আওয়ামী লীগ সরকার যে টানা ১৩ বছর দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে তার বড় কারণ অর্থনীতি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা, নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্কের পরও সাধারণ মানুষ এ সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে। এর বড় কারণ আওয়ামী লীগ সরকার ১৩ বছরে ধারাবাহিকভাবে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে গেছে। দেশে কর্মমুখরতা বেড়েছে। মানুষের আয় বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মানুষের স্বপ্নের সীমাটা আওয়ামী লীগ অনেক বাড়িয়েছে। ফলে এখনকার সংকটটা জনগণকে অস্থির করে তুলেছে। ১০ বছর আগে যে লোকটি মাসে ১০ হাজার টাকা উপার্জন করত এখন তার মাসিক আয় ১ লাখ টাকা। কিন্তু নানা সংকটে তার আয় কমে যখন ৫০ বা ৬০ হাজারে নেমেছে, তখন সে আর চলতে পারছে না। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে লোভ, দুর্নীতি বেড়ে গেছে। যে কোনো উপায়ে ধনী হওয়ার এক উদগ্র ভয়ংকর নেশা কারও কারও মধ্যে ঢুকে গেছে। এরা নানা প্রতারণায় জড়িয়ে সমাজকে আরও অসুস্থ করে তুলছে। অনলাইন কেনাকাটায় দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, পি কে হালদারের হাজার কোটি লোপাটের কাহিনি, বিদেশে অর্থ পাচার, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড়- অসুস্থ সমাজের নোংরা অর্থনীতির চিত্র। সমাজের নীতি-নৈতিকতা পর্যুদস্ত হচ্ছে ভ্রষ্ট উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে। এজন্যই শিক্ষাঙ্গনগুলোয় ভয়ংকর চিত্র। শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো, শিক্ষককে হত্যা- শিক্ষাঙ্গনের দুর্ভাগ্যজনক চেহারাকে উন্মোচন করেছে। এ চিত্র শুধু সবখানে নয়, সর্বত্র। মানুষ আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। ১৩ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার আগে এ রকম সর্বগ্রাসী চাপে পড়েনি। চারপাশ যেন বৈরী হয়ে উঠেছে এ সরকারের জন্য। ১৩ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলতে গেলে একাই তিনি সবকিছু সামাল দিচ্ছেন। বন্যা মোকাবিলা থেকে দুর্নীতি বন্ধ। কৃষির উৎপাদন থেকে শ্রমিকের মজুরি সবকিছুই দেখভাল করতে হচ্ছে তাঁকে। দেশের অবস্থা আজ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া শিশুদের একটা খেলার মাঠও বেদখল হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন তাই এখনো মানুষ কিছুটা হলেও আশাবাদী। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপির ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। তাঁরা কেন দায়িত্বে আছেন সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জনগণ ক্লান্ত।

এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, বিশ্বজুড়েই এখন টালমাটাল অবস্থা। করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে এক অস্থির-অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে গেছে। কোনো দেশই ভালো নেই। যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত বিশ্বে অন্যতম অনিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন সেখানে গুলিতে ঝরছে নিরীহ প্রাণ। বাদ যাচ্ছে না শিশুও। জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে। এত আবেদনহীন প্রেসিডেন্ট কবে যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছে, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। ভারতে চলছে নানামুখী সংকট। রুপির রেকর্ড অবনমন হয়েছে ডলারের বিপরীতে। উগ্র হিন্দুত্ববাদ সেক্যুলার ভারতের চেহারাটা ফ্যাকাসে করে দিয়েছে। নূপুর শর্মা একাই মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছেন। ইউরোপজুড়ে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে ইউরোপ। সত্তরের মহামন্দাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংকট ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা দানা বেঁধে উঠছে। উত্তপ্ত এ বিশ্ব পরিস্থিতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে ভাবে না। বুঝতেও চায় না। তারা চায় সুখে-শান্তিতে থাকতে। আয়-উন্নতি বাড়াতে। চায় সহনীয় দ্রব্যমূল্য। স্বস্তিদায়ক সামাজিক পরিবেশ। সন্তানের নিরাপদ শিক্ষা। দুর্ঘটনামুক্ত যাতায়াত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলে মানুষকে বেশিদিন আশ্বস্ত রাখা যাবে না। এ আওয়ামী লীগ সরকারই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৮-এর বিশ্বমন্দা সামাল দিয়েছে। করোনার বিশ্ব সংকটের মুখেও অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবার পারছে না কেন? এর কারণ মন্ত্রী ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের সীমাহীন অযোগ্যতা এবং দুর্নীতি। আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরতা। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এবং আরও কিছু বাস্তবতা। বিদ্যুৎ সংকটের কথাই যদি আমরা একটু আলোচনা করি তাহলে ব্যর্থতার উৎস খুঁজে পারব। আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে সত্যি কিন্তু জ্বালানি নিরাপত্তার দিকে জোর দেয়নি। তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানে যত মনোযোগী ছিল ততই উপেক্ষিত ছিল স্বাবলম্বী হওয়ার উদ্যোগ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সরকার বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-দর্শন ও আদর্শ বিচ্যুত হয়েছে।

জাতির পিতা ১৯৭৫-এর ৯ আগস্ট বিশ্বখ্যাত শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে তাদের মালিকানাধীন পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র ও তিতাস গ্যাস কোম্পানির শেয়ার ৪.৫০ মিলিয়ন পাউন্ডে কিনে নেন। এটি ছিল বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার এক মাইলফলক। আওয়ামী লীগ সরকার জ্বালানি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর কৌশলের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। গত ১০ বছরে সরকার নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান, বিদ্যমান কূপগুলো আধুনিকায়নে মনোযোগী ছিল না। এলএনজি আমদানির এক জুয়ায় মত্ত ছিল। এটি পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক জোড়াতালি। গ্যাস আমদানিতে কমিশন বাণিজ্যের লোভনীয় হাতছানিও ঝুঁকিপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলারা সরকারকে প্ররোচিত করেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ আমদানি করে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে পারবে না, এটি জাতির পিতা উপলব্ধি করেছিলেন। আমলারা উপেক্ষা করেছেন। আমলাতন্ত্রের একটি প্রবণতা হলো, যে কোনো সমস্যার গভীরে না যাওয়া। তাৎক্ষণিকভাবে সংকটের সমাধান খোঁজা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন পর্যন্ত মানা হয়নি। এখন যখন বিশ্ববাজারে এলএনজির লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তখন আমদানি সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। নির্বাচনের আগে সরকারকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

শুধু বিদ্যুৎ কেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধŸগতির পেছনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা সরকারের অর্জন বিবর্ণ করেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী কখন কী বলেন তা যদি পরে তিনি শুনতেন তাহলে হয়তো নিজেই লজ্জা পেতেন। খুব কম ক্ষেত্রেই মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয় চালাতে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। বরং তাঁরা সব সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ওপর। মন্ত্রীদের কাজ শুধু বক্তৃতা আর ফিতা কাটায় বন্দি হয়ে আছে। টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এবারের মতো এত অনুজ্জ্বল মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগ আগে কখনো গঠন করেনি। মন্ত্রীরা পালাক্রমে বিতর্কিত বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারের রাজনৈতিক চেহারা নেই। আওয়ামী লীগ নেতারাই মনে করেন দেশ আমলারা চালাচ্ছেন। আমলারা ভবিষ্যৎ ভাবেন না। জনপ্রিয়তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। হেভিওয়েট জনপ্রিয় নেতারা সাইডলাইনে বসে তামাশা দেখছেন। নির্বাচন তাঁদের পরিকল্পনায় জায়গা পায় না। তাঁরা আজ এবং বর্তমান নিয়েই শুধু ভাবেন। নিজেদের স্বার্থ তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। আমলাদের হাতে দেশ ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনি করছে। অনেকেই আখের গুছিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়েছেন। ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, পাতিনেতা এমনকি সিকিনেতাও জনগণকে চাকরবাকর ভাবতে শুরু করেছেন। বড় হলে উদার হতে হয়। নত হতে হয়। বিনয়ী হতে হয়। এটা আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ভুলে গেছেন। কোথাও কোথাও এমন উদ্ধত আচরণ করা হচ্ছে যে তাতে সাধারণ মানুষ বিরক্ত, হতাশ। অন্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে সমমনা দলের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ দূরত্ব তৈরি করেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা করার প্রবণতা বেড়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ একলা। দলে নিবেদিতপ্রাণ, ত্যাগীরা কোণঠাসা। কেউ কেউ হতাশ হয়ে দূরে সরে গেছেন। এ অবস্থায় ক্রমে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সামাল দিতে আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই প্রশাসননির্ভর। দুঃসময়ের কর্মীরা কি আবার কোনো সংকটে মাঠে নামবে? কেন নামবে? এসব প্রশ্ন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের সফল কূটনীতি গত তিন বছরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কূটনীতির ভাষার বদলে একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাড়া-মহল্লার আড্ডার ভাষায় বয়ান দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এ রকম একজন ‘আনডিপ্লোম্যাটিক’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী কবে পেয়েছে বাংলাদেশ! যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো আগামী নির্বাচন ঘিরে সরব। ১৪টি দেশের কূটনীতিকরা একযোগে নির্বাচন কমিশনে গেছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচন তাঁরা অংশগ্রহণমূলক চান। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ চান। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচন নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কি বৃহত্তর গণতন্ত্রের পথে এগোবে নাকি কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থার দিকে এগোবে।’ এর বিপরীতে বাংলাদেশের নীতি ও কৌশল ধোঁয়াশে, অস্পষ্ট।

সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনের মাত্র দেড় বছর আগে এক উত্তাল সাগরে আওয়ামী লীগের অভিযাত্রা। সাগর ক্রমে বৈরী হয়ে উঠছে। ১৩ বছরের অর্জন যে এক লহমায় বিলীন হয়ে যায়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ নিয়ে আওয়ামী লীগ গর্ব করত। এখন এ বিদ্যুৎই যেন গলার ফাঁস হয়ে গেছে। ২০০১-২০০৮-এর অবস্থায় আবার ফিরে যাচ্ছি আমরা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে কী ছিল তা এখন বলে লাভ নেই। খাম্বা কাহিনিতেও মানুষ সান্ত¡না খুঁজবে না। আজকের সংকটের সমাধান চায় মানুষ। ১৩ বছরে এ দেশের অর্জন অনেক। অবিশ্বাস্য। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল উন্নয়নের বড় বিজ্ঞাপন হয়ে আছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু এসব অর্জন নিয়ে জনগণ উদ্বেলিত হবে না, যদি লোডশেডিং না থামে। যদি বাজারের আগুন বন্ধ করা না যায়। কিশোর গ্যাংয়ের দাপট না কমে। ক্ষমতাসীনদের অহংকার, দুর্নীতি, টাকা পাচার, সামাজিক অবক্ষয় মানুষকে অস্থির করে তুলছে। বাংলাদেশের জনগণের গোল্ডফিশ মেমোরি। অতীত খুব সহজেই, খুব দ্রুত ভুলে যায়। ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকার বেদনা ভুলে গেছে। তারেক জিয়ার হাওয়া ভবন ভুলে গেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ভুলে গেছে। বাংলা ভাই ভুলে গেছে। ১০ ট্রাক অস্ত্র ভুলে গেছে। পূর্ণিমা-ফাহিমার ধর্ষণ ভুলে গেছে। মসজিদে ঢুকে হত্যা মনে রাখেনি। মনে রাখেনি দেশজুড়ে বিএনপি-জামায়াতের তান্ডব। অতীত নয়, বর্তমান নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। বর্তমান বাস্তবতায়ই মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আওয়ামী লীগ সরকারকেই চলমান সংকটগুলোর সমাধান করতে হবে। আর এ সংকট এখন এ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে, তৃতীয় মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান অবস্থা দেখে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু...’ গানটি মনে পড়ছে খুব বেশি করে। এ গানের একটি পঙ্ক্তি এ রকম ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুঁশিয়ার!’

তবে আমাদের আশা-ভরসার জায়গা একটাই। শেখ হাসিনা। সব সংকট তিনি সমাধান করেন আপন মেধায়, দূরদর্শিতায়। যেখানে ঘোর অনিশ্চয়তার অন্ধকার সেখানে তিনি সম্ভাবনার আলো জ্বালান। বর্তমানে ধেয়ে আশা সমস্যাও তিনি সমাধান করবেন, এখনো দেশবাসী এটা বিশ্বাস করে। এজন্যই ক্ষোভ, দুঃখ-হতাশার পরও জনগণ অপেক্ষা করছে শেখ হাসিনার আরেকটি ম্যাজিকের। শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের একমাত্র কান্ডারি। নিশ্চয়ই তিনি এ সংকটের উত্তাল তরঙ্গ পাড়ি দিয়ে আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দেবেন সুবর্ণ বন্দরে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
Email: poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।

লোডশেডিং   নির্বাচন   বিশ্বজুড়ে   সংকট  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন। যেহেতু কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্যোগকে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই এমন একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা সমীচীন নয়, শোভনও নয়। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি করতে চাই। তুমি যোগাযোগ কর। আমি বঙ্গভবনে যোগাযোগ করলাম। রাষ্ট্রপতি চিকিৎসা শেষে মাত্র যুক্তরাজ্য থেকে ফিরেছেন। একান্ত সচিব বললেন, ‘আমি দেখছি।’ দুদিন পর সময় পাওয়া গেল। আমি এবং সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী গেলাম বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি হবার পর এটা ছিলো আমার তৃতীয় সাক্ষাৎ। তিনবারের কোন বারেই তার আন্তরিকতার ঘাটতি পাইনি। দেশে সর্বোচ্চ পদে যাবার পরও তিনি সেই হাসিখুশী, বন্ধুসুলভ, প্রাণবন্ত, নির্ভেজাল মানুষ। সদ্য চিকিৎসা শেষ করে তিনি দেশে ফিরেছেন। জরুরী রাষ্ট্রীয় কাজ ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কিন্তু আমাদের অনুরোধ তিনি ফেললেন না। সচিবকে ডেকে একটা তারিখ ঠিক করতে বললেন। সেই থেকে এই আয়োজনের ব্যস্ততা। অবশেষে ৩০ এপ্রিল একটা সফল এবং গোছানো অনুষ্ঠান করলো ক্রিয়েটিভ মিডিয়া। অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। রাতের খাবারের পর সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে আধো ঘুমে টেলিভিশন সংবাদ দেখার চেষ্টা করছি। রাত বাজে সাড়ে দশটা। এমন সময় রাষ্ট্রপতির ফোন। আমি বেশ বিস্মিত হয়েই ফোন ধরলাম। রাষ্ট্রপতি বললেন ‘বোরহান খুব সুন্দর অনুষ্ঠান করেছেন। ধন্যবাদ।’ আমি আপ্লুত, হতবিহম্বল। রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘অনুষ্ঠানে আপনাকে খুঁজলাম। পেলাম না। দেখা হলো না, তাই ফোন করলাম।’ আমি জানালাম পর্দার পিছনে থেকে অনুষ্ঠান তদারকি করছিলাম। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি ফোন রাখলেন। দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির বিনয়, উদারতা মুগ্ধ করার মতো। আজকাল এই আচরণ অভাবনীয়। আমার জন্য এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর সম্প্রতি পূর্ণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে বঙ্গভবনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। মোঃ সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি হওয়াটাই ছিলো এক চমক এবং বিস্ময়কর ঘটনা। নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এনিয়ে নানা আলোচনা ছিলো। বিভিন্ন রথী মহারথীদের নাম সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে কোথাও মোঃ সাহাবুদ্দিনের নাম ছিলো না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গুলশানে আমি নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি আমি রাষ্ট্রপতি হবো।’ আমাকে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন এভাবে ‘পরদিন পাবনা যাবো। এজন্য সেলুনে গেছি, চুল কাটাতে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, কি করছি। আমি জবাব দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন আমার ব্যাংকে কোন লোন আছে কিনা, ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ইত্যাদি।’ তিনি বললেন, ‘তখনও আমি ভাবিনি, এরকম কিছু হচ্ছে।’ 

একটা কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্য সেই সময়টা ছিলো কঠিন, অনিশ্চয়তায় ভরা। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানী, বিরোধী দলের আন্দোলন, সুশীলদের চক্রান্ত। সব কিছু মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, সেটিই ছিলো এক বড় প্রশ্ন। এরকম পরিস্থিতি সব সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলের দরজা খুলে দেয়। চক্রান্ত ডাল মেলা মেলে। বাংলাদেশে অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রায়ই বঙ্গভবন হয় ষড়যন্ত্রের আঁতুড় ঘর। ২০০৭ সালের এক এগারো যার সর্বশেষ উদহারণ। সুশীলদের পক্ষ থেকে ‘নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য’ কাউকে রাষ্ট্রপতি করার আহ্বান ছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো চাইছিলো এমন কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে যার মাধ্যমে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেটানো যায়। 

আওয়ামী লীগের জন্য নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিলো অগ্নি পরীক্ষা। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগ যে ভুল করেছিল তার মাশুল চরম ভাবে দিতে হয়েছিল দলটিকে। কে নতুন রাষ্ট্রপতি হবেন, এনিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই ছিলেন অন্ধকারে। এরকম এক সময় আলোচনার বাইরে থাকা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। এটি ছিলো আচমকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আসন্ন চক্রান্ত মোকাবেলার জন্যই বেছে নিয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তিকে যিনি বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ এবং আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তার জীবনে কোন দিন আদর্শচ্যুত হননি। জাতির পিতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রতিবাদ করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারাভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তবে আদর্শের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিলো পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময়। ডাক সাইটে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা চেয়েছিলেন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগকে প্রশ্রয় দিতে। তারা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে কলংকিত করার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানও নন। একজন সদস্য মাত্র। দায়িত্ববানরা যেকোন পরিস্থিতিতেই আদর্শের প্রশ্নে অটল হিমালয়ের মতো দাঁড়াতে পারেন তার প্রমাণ সে সময় রেখেছিলেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। দুদকের কমিশনার থেকে একাই তিনি রুখে দেন ষড়যন্ত্র। কিন্তু এনিয়ে তিনি হৈ চৈ করেননি। আত্ম অহংকারে বেসামালও হননি। আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আমার দায়িত্ব। কোন কিছু প্রাপ্তির জন্য এটি আমি করিনি।’ সারাজীবন এভাবে নীরবে, নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এই মানুষটি। আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়াই। মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কেন্ডিক প্রসাদ ষড়যন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দেন শেখ হাসিনা। যারা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে ন্যূনতম চেনে তারা জানেন, আর যাই হোক নীতির প্রশ্নে তাকে এক চুলও টলানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য প্রয়োজনে তিনি জীবন দেবেন। 

আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনার দূরদর্শী, বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিলো একটি টার্নিং পয়েন্ট। এর মাধ্যমে নির্বাচন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোট হতচকিত হয়ে যায়। দায়িত্ব নিয়ে মোঃ সাহাবুদ্দিন নির্বাচন কেন্ডিক উত্তাপ সামাল দেন ঠান্ডা মাথায়। তার অভিভাবকত্বে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। একবার ভাবুন তো, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময় ভীরু, কাপুরুষদের কেউ যদি রাষ্ট্রপতি হতেন, তাহলে কি এভাবে নির্বিঘ্নে সব কিছু হতো? সংশোধিত শ্রম আইনে স্বাক্ষর না করে তিনি বুঝিয়েছেন বঙ্গভবন দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় কথা মোঃ সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার একজন যোগ্য অভিভাবক হিসেবে একবছরে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ক্ষমতার দম্ভ তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ পদ তার বিনয়, সৌজন্যতাকে ম্লান করতে পারেনি। এখনও তিনি যেন সেই প্রাণখোলা মানুষটি। কিন্তু নীতির প্রশ্নে অটল। ৩০ এপ্রিলের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মহামূল্যবান একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন ‘শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাই হলো ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ।’ এই বার্তাটি তিনি সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান। আমি মনে করি এই নির্দেশনাটি মহামূল্যবান। এটিই এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রধান করণীয়।  

মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি হবার পরও ঠিক আগের মতোই আছেন। জনবিচ্ছিন্ন হননি। নিরাপত্তার শৃংখল থেকেও তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সূতোটা কাটেননি। এই জীবনে তো বহু মানুষ দেখলাম, যারা ক্ষমতা পেলে এমন দম্ভ দেখান যে, মনে হয় সারাজীবন এরকম ক্ষমতাবানই থাকবেন। ক্ষমতাহীন অবস্থায় যারা বুকে টেনে নিতেন, ক্ষমতা পেয়েই তারা অচেনা মানুষ হয়ে যান। এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। যারা অযোগ্য, চাটুকার, মতলববাজ তারাই ক্ষমতা পেয়ে দিশেহারা হন। অতীত ভুলে যান। উপকারীকে এড়িয়ে চলেন। কৃতজ্ঞহীন এক অমানবিক মানুষে পরিণত হন। এদের একজনের গল্প বলি।  

তিনি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে হতাশায় মুষড়ে পরলেন। প্রায় প্রতিদিন আমার অফিসে আসতেন। তার পরিবারের কাছে কিভাবে তিনি ছোট হলেন তার বিবরণ দিতেন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে। দুপুরে আমার অফিসেই খাবার টেবিলে মনোনয়ন না পাওয়ার বেদনায় আক্রোশ ঝাড়তেন মুরগীর রান চিবিয়ে। শেখ হাসিনা তাকে মূল্যায়ন করলো না, এনিয়ে তার কি গোস্বা। কিছুদিনের মধ্যেই খবর এলো তাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হচ্ছে। এক বিকেলে উচ্ছ্বাসিত ভাবে এলেন অফিসে। প্রধানমন্ত্রী তার ফাইল অনুমোদন করেছেন। এখন রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলেই সরকারি আদেশ জারী হবে। রীতিমতো ঘামছেন। রাষ্ট্রপতি তখন যুক্তরাজ্যে। বিভিন্ন জন তাকে নানান তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেন না, ফলে তার অস্থিরতাও কমছে না। তার এই অবস্থা দেখে আমি সরাসরি ফোন করলাম রাষ্ট্রপতিকে। তিনি যুক্তরাজ্যে আছেন জেনেও। তিনি ফোন ধরে বললেন, ‘বোরহান আমি হাসপাতালে, আমার টেস্ট চলছে, জরুরী কিছু? আমি ঐ উপাচার্যের ফাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘আমি একটু আগেই ফাইলে স্বাক্ষর করেছি।’ আমার এই ধৃষ্টতা এবং বাড়াবাড়িতে তিনি এতটুকু বিরক্ত হলেন না। বরং নতুন উপাচার্যকে অভিনন্দন জানালেন। একজন মানুষ কতটা খাটি, নির্ভেজাল এবং আন্তরিক হলে এটা সহ্য করে। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এই বিনয়ের কারণ তিনি আদর্শবান, যোগ্য। আর যে ব্যক্তি এমপি না হতে পেরে উপাচার্য হলেন, তিনি কদিন পর বিরাট মানুষ হয়ে গেলেন। তার কথা বার্তা, আবার আচরণে মুহূর্তে অন্যরকম হয়ে গেল। আমি তার কাছে আবর্জনা হয়ে গেলাম। 

আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ফারুক আমাকে এক বিকেলে ফোন করলেন। অনুরোধ করলেন, ঈদের অনুষ্ঠানে নতুন উপাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়। আমি যেন তাকে বলে দেই। আমি উপাচার্যকে ফোন করলাম। তিনি ফোন ধরলেন না। আগে যিনি দিনে কয়েকবার ফোন করতেন। ফোন না পর্যন্ত বার বার ফোন করেই যেতেন, তিনি আমার ফোন রিসিভ না করাতে আমি এতোটুকু দুঃখিত হইনি। ভাবলাম নিশ্চয়ই ব্যস্ত। উপাচার্য বলে কথা। নিশ্চয়ই ফ্রি হলে ফোন করবেন। কিন্তু তিনি ফোন ব্যাক করলেন না। পরদিন বিকেলে আবার ফারুকের অনুরোধ। এবার আমি ফারুককে রেখেই উপাচার্যকে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে। বললেন, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমি ভীষণ ব্যস্ত।’ আমি একটু বিস্মিত হলাম। ধাতস্থ হয়ে ফারুকের প্রস্তাব বললাম। আমি যেন মহা অন্যায় করেছি। তিনি বললেন, ‘এসব এখন হবে না। আমি ব্যস্ত।’ আরো কিছু কথা শোনার পর আমি বললাম ‘ভাগ্যিস আপনি শুধু উপাচার্য হয়েছেন, মন্ত্রী এমপি হননি।’ কদিন আগে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রে মাষ্টার হেডে প্রধানমন্ত্রীর ছবিই বাদ দিয়েছেন। উপাচার্য হয়েই তিনি নিরপেক্ষ হবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই মাইনাস করলেন? অযোগ্যরা ক্ষমতায় গেলে এভাবেই সম্ভবত বদলে যায়, অহমিকার এক মুখোশ পরে। এই ব্যক্তি একা না। এরকম ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী ক্ষমতা যাদের মাথা খারাপ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। এর কারণ তারা ক্ষমতা লোভী, অযোগ্য। রাষ্ট্রপতি হলেন একজন অসাধারণ সাধারণ মানুষ। ক্ষমতা যার মৌলিকত্ব, অকৃত্রিম আন্তরিকতা কেড়ে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তিনি যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি গত এক বছরে কাজ দিয়েই তা প্রমাণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। 
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কমে গেল কাদেরের দাপট?

প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ০২ মে, ২০২৪


Thumbnail

ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান এমন একজন নেতা যিনি ওবায়দুল কাদেরের এই সিদ্ধান্ত মানেননি। সিদ্ধান্ত না মেনে তিনি ধানমণ্ডি ৩ নম্বর কার্যালয়ে গিয়ে ওবায়দুল কাদেরের তোপের মুখে পড়েন। ওবায়দুল কাদের তাকে বলেন, আপনি তো দলের কোন সিদ্ধান্তই মানেন না। কিন্তু তার পরও শাজাহান খান তার ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে রাখেন এবং দলের তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন আশঙ্কার মধ্যেই তিনি উপজেলা নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগ সভাপতির সংবাদ সম্মেলনের পর দেখা গেল যে, ওবায়দুল কাদের যা বলেছেন এবং আওয়ামী লীগের যে সিদ্ধান্ত তার মধ্যে দুস্তর ফারাক রয়েছে। ওবায়দুল কাদের যেভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন বাস্তবতা তা নয়। ওবায়দুল কাদের যত গর্জেছেন বাস্তবে আওয়ামী লীগ তত বর্ষেনি। আর একারণেই এখন ওবায়দুল কাদেরের কর্তৃত্ব নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।


এমনিতেই আওয়ামী লীগে বেশ কিছুদিন ধরে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির বাইরে অন্য কোন নেতার কথা তৃণমূলের আওয়ামী লীগ বা মাঠ পর্যায়ের নেতারা মোটেও কর্ণপাত করেন না। তাদেরকে খুব একটা আমলে নেন না। তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলে কথা। তিনি দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি। সেই ক্ষমতাবান ব্যক্তি যখন বলছেন, সকলে ধরে নিয়েছিল যে, এটি আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা এবং ওবায়দুল কাদের এটিকে শেখ হাসিনার নির্দেশনা বলেই অভিহিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলার পরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা একরামুল করিম চৌধুরী, শাজাহান খান এবং ড. রাজ্জাকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন এবং তাদের স্বজনদেরকে প্রার্থিতা থেকে সরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই তিনজনের কেউই ওবায়দুল কাদেরের কথায় কর্ণপাত করেননি। 

ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনা অমান্য করে তারা প্রার্থী হওয়ার পর এখন দেখা গেল যে, ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের অবস্থানই এখন আর সঠিক নেই। ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কোন আলোচনাই হয়নি। অথচ ওবায়দুল কাদের একাধিক গণমাধ্যমে বলেছিলেন যে, ৩০ এপ্রিল যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনাই হয়নি। তাহলে কী ওবায়দুল কাদের বাড়িয়ে বলেছেন? 


কেউ কেউ দাবি করেন, যেহেতু একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন সেহেতু ওবায়দুল কাদের বিষয়টিকে বড় করে দেখেছেন এবং তিনি নিজেই উপজেলা নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। কারণ তার নির্বাচনী এলাকায় যদি একরামুল করিমের সন্তানও উপজেলা চেয়ারম্যান হয় তাহলে তার এলাকায় আধিপত্য কমে যাবে। আর একারণেই হয়তো তিনি বিষয়টিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন।

আজ আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্য থেকে স্পষ্টতই মনে হয় যেভাবে আওয়ামী লীগের নেতারা এই বিষয় নিয়ে গর্জে ছিলেন বাস্তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি বিষয়টিকে অতটুকু গুরুত্বতর মনে করেন না। বরং তার প্রধান আগ্রহের ব্যাপার হলো উপজেলা নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। আর এ কারণেই প্রশ্ন উঠেছে তাহলে ওবায়দুল কাদের শেখ হাসিনা সবসময় যা বলেন সেটিরই পুনঃউচ্চারণ করেন এই বক্তব্যটি ঠিক না। শেখ হাসিনা আত্নীয় স্বজনদের ব্যাপারে ওবায়দুল কাদেরের অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি একই রকম বক্তব্য রাখেননি। আর এর ফলে ভবিষ্যতে ওবায়দুল কাদেরের হুশিয়ারি বা নির্দেশনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কতটুকু শুনবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে প্রশ্ন করেছেন তাহলে কী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দাপট কমে গেল?




ওবায়দুল কাদের   আওয়ামী লীগ   সাধারণ সম্পাদক  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন। 

আগামীকাল ৩০ এপ্রিল দলটির কার্যনির্বাহী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এবং এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল ৩০ এপ্রিলের দিকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। ৩০ এপ্রিল কি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ধোঁকা খাবে? যারা ক্ষমতাবান মন্ত্রী-এমপি সংসদ সদস্য তারা তাদের সন্তানদেরকে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী করার ফলে তারা কি শাস্তি পাবেন? নাকি এবারেও তারা পার পেয়ে যাবেন? ৩০ এপ্রিল কি আওয়ামী লীগের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হবে, নাকি ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ আবারো ধোঁকা খাবে। 

আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন, ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের যারা সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছেন, যারা স্বজনপ্রীতি করেছেন, যারা ভাই, ভাতিজা, স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, শ্যালককে প্রার্থী করেছেন তাদেরকে লাল কার্ড দেখানো হবে। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা বলছেন যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেহেতু কঠোর বার্তা দিয়েছেন সেহেতু তার কাছে নিশ্চয়ই ‘ট্রাম্প কার্ড’ আছে। আর এই এই ট্রাম্প কার্ড দেখানো হবে ৩০ এপ্রিল। দলের সিদ্ধান্ত যারা লঙ্ঘন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই এমন কথাও বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। 

আওয়ামী লীগের জন্য ৩০ এপ্রিল দিনটি অত্যন্ত প্রতারণামূলক এবং ধোঁকা খাওয়ার দিন হিসেবেই পরিচিত। ঠিক কুড়ি বছর আগে এই ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ ধোঁকা খেয়েছিলো। তখন পাদপ্রদীপে ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল। ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ৩০ এপ্রিলের আগে প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে আসতেন এবং কিভাবে সরকারের পতন হবে সেবিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিতেন। ৩০ এপ্রিলের আগে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সে কর্মসূচি গুলোর মাধ্যমে সরকার পতনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ৩০ এপ্রিল ম্যাজিক দেখাবেন বলেই বারবার ঘোষণা করছিলেন। তার কাছে ট্রাম্প কার্ড আছে এমন বক্তব্য তিনি রেখেছেন একাধিকবার। কিন্তু ৩০ এপ্রিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কিছুই হয়নি বরং আওয়ামী লীগই অসম্মানিত হয়েছে। 

সাধারণ মানুষের কাছে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি হাস্যকর হয়েছে। ৩০ এপ্রিলের গ্লানি আওয়ামী লীগকে বহুদিন বহন করতে হয়েছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ৩০ এপ্রিল নিয়ে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কম টিটকারি করেনি। আবার একটা ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্য নির্ধারণের দিন। এবারও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই পাদপ্রদীপে। ৩০ এপ্রিল যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে নাকি ৩০ এপ্রিল আবারো আওয়ামী লীগ ধোঁকা খাবে। গত কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগের মধ্যে বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে সবাই নেতা হয়ে গেছেন, কেউ কাউকে মানছেন না। তবে একটা আশার ব্যাপার ছিলো। সকলে মনে করতেন যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি ঐক্যের প্রতীক। তাকে সকলে মানেন এবং তার কথার কেউ অবাধ্য হবেন না। 

২০০৭ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ এবং কোন্দলকে প্রশ্রয় দেয়া হতো একটি চিন্তা থেকেই। সেটি হলো আওয়ামী লীগে যে যত গ্রুপই থাকুক না কেন, যে যত পক্ষই করুক না কেন তারা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে। শেখ হাসিনা যা বলবেন সেটি তারা মানবেন। শেখ হাসিনাই একমাত্র নেতা। আর বিভক্ত বিভিন্ন গ্রুপগুলো তাকিয়ে থাকতো শেখ হাসিনার দিকে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার প্রতি অন্ধ আনুগত্য বা আস্থা স্রেফ কথার কথা। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতারা যেটি বলেন সেটি আসলে বাস্তবে করেন না। শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করেন। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেন। আর এটিই আওয়ামী লীগের জন্য শঙ্কার এবং উদ্বেগের বিষয় বলে আমি মনে করি। কারণ যদি শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকেও নেতারা অমান্য করে তাহলে দলের অস্তিত্বই চ্যালেঞ্জের মুখে পরে। আওয়ামী লীগ আসলে এবার সে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। 

২০১৮ সালের নির্বাচনের পরেই আওয়ামী লীগের ভিতর একটা ‘ফ্রি স্টাইল’ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যে যার মতো, যেমন খুশী বক্তব্য রেখেছিলেন এবং সে বক্তব্যের কোন জবাবদিহিতাও ছিল না। একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও কেন্দ্রীয় সদস্যকে গালাগালি করেছেন, একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি সমালোচনার তীর ছুড়েছেন। এটি আওয়ামী লীগে হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক ব্যাপার। ২০১৮ এর পর স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগ মুখোমুখি হয়েছে, হানাহানি করেছে, একে অন্যকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছে। এঘটনাগুলো যখন নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে তখনও আওয়ামী লীগের নেতারা নির্লিপ্ত ছিলেন। সারাদেশেই আওয়ামী লীগ দুই তিন ভাগে বিভক্ত। এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেছে। দলের পক্ষ থেকে তাদের কারো বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়নি। যার ফলে আওয়ামী লীগের ‘চেইন অব কমান্ড’ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল। 

২০২৪ এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে সিদ্ধান্তটি ছিলো, দলের প্রতীক না পাওয়া ব্যক্তিরা দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারবে। আর এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক করার স্বার্থে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত এখন আওয়ামী লীগের জন্য একটি বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। সারাদেশে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি-কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো এই বিভক্তি এবং কোন্দলগুলো দূর করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বারবার নেতাকর্মীদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা করেও এ ব্যাপারে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে যে, এই কোন্দল এবং বিভক্তি কমেনি। বরং বেড়েছে। এই কোন্দল বিভক্তি থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। দল থেকে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কিন্তু এর ফলে দেখা গেল আরেক সমস্যা। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নিজ নিজ এলাকায় জমিদারতন্ত্র কায়েমের মিশনে নেমে পরলো। তারা তাদের নিজেদের ভাই-ব্রাদার আত্মীয় স্বজনদের প্রার্থী করে এলাকাগুলোতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের মিশনে ঝাপিয়ে পরেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি একারণেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, উপজেলা নির্বাচনে কোন মন্ত্রী এমপি তার আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থী করতে পারবেন না। 

ধারণা করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের প্রতি সকলে সম্মান দেখাবেন। সকলে না দেখাক অন্তত যারা দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র নেতা, যারা মন্ত্রিত্বে আছেন কিংবা তারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন। তারা নিজেদের স্বার্থকে কিছুটা হলেও সংকুচিত করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের ভাই, সন্তান, স্ত্রী, আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থীতা থেকে সরে আসার অনুরোধ প্রত্যাখান করেছেন। তার মানে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে তারা শ্রদ্ধা করেন না, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মানেন না। তারা দলকে বিকশিতও করতে চান না। এধরনের ব্যক্তিরাই যে আওয়ামী লীগে এখন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে সেটি বোঝার জন্য পন্ডিত হবার দরকার নেই। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটি এসেছে, আওয়ামী লীগ এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারী এবং দলের স্বার্থ পরিপন্থি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বারবার বলছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ৩০ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল আসলে কি হবে? ৩০ এপ্রিল কি কুড়ি বছর আগের মতো আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ধোঁকা খাবে? 

২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল যেমন আওয়ামী লীগের অগণিত তৃণমূলের কর্মীরা অন্ধকারে ছিল। কি হবে তারা জানতেন না। তাদের জন্য কোন নির্দেশনা ছিলো না। রাজপথে নামার জন্য তাদেরকে কোন আহ্বান জানানো হয়নি। তারা বুঝতে পারেননি যে, কিভাবে সরকারের পতন ঘটবে এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতের পতন ঘটেনি। ঠিক তেমনি এবারের ৩০ এপ্রিলও আওয়ামী লীগের অগণিত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা অন্ধকারে। তারা জানেন না ওবায়দুল কাদের কি ব্যবস্থা নিবেন এবং আদৌ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন কিনা। কারণ এর আগেও দেখা গেছে যারা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, দলের নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন তাদের খুব কম লোকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এবারেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাবান, স্বার্থান্বেষী এবং স্বজনপ্রীতি করা নেতাদের কাছে আওয়ামী লীগ কি পরাজিত হবে, নাকি সত্যি সত্যি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আওয়ামী লীগ কী ঘুরে দাড়াবে নাকি তৃণমূল প্রতারিত হবে। এই প্রশ্নটি এখন সবার সামনে বড় হয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ যদি এই সমস্ত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগের ভিতরে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যা ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনা হলেন আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক, শেখ হাসিনা হলেন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তার নির্দেশই যদি নেতারা অমান্য করেন তাহলে তাদের নেতৃত্বে থাকা উচিত? 

একটা কথা খুব স্পষ্ট, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ছাড়া কেউই অপরিহার্য না। আওয়ামী লীগ যদি কঠোরভাবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে তাহলে আওয়ামী লীগের তৃণমূল মুখ থুবড়ে পড়বে, সাংগঠনিক শক্তি হারাবে আওয়ামী লীগ। সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নাজুক অবস্থা নগ্নভাবে প্রস্ফুটিত হবে। যদি আওয়ামী লীগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তাহলেই দলটি ঘুরে দাড়াবে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে। প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে সহায়তা দিচ্ছে। দেশে কোন বিরোধী দল নেই। সেই কারণে আওয়ামী লীগ একটা স্বাচ্ছন্দ্য অবস্থায় আছে এবং কোনরকম চাপ অনুভব করছে না। কিন্তু যদি সংগঠন না থাকে, সংগঠন যদি এরকম হতশ্রী অবস্থায় চলে যায় তাহলে দুর্বল সংগঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ কী টিকে থাকতে পারবে। এই প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগকেই খুঁজতেই হবে।  

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

বিএনপি কি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল। বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।

কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।

যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত। ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী। অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।

বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না। জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।

বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে। দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে উত্তর নেই।

খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী? নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন, ‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর। দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে।

জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা। আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।

এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি, আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।

আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন, দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ। বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিএনপি   জিয়া   পরিবারমুক্ত  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

৩০ এপ্রিল কী হবে আওয়ামী লীগে

প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ্যতা, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কীভাবে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন সেটির দিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ। 

উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একটা নিরপেক্ষ অবস্থান রাখতে চেয়েছিল। দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। শুধু দলীয় প্রতীক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নয়, আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, উপজেলা নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করতে পারবেন তাদেরকে মন্ত্রী-এমপিরা সমর্থন দেবে না এবং আওয়ামী লীগ দলগত ভাবে কোন প্রার্থী দেবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের এই নির্দেশনা অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপিরা মানেননি। তারা তাদের আত্মীয় স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন এবং যারা আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী করেননি তারা নিজস্ব ব্যক্তিকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন এলাকায় আধিপত্য রক্ষার জন্য। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার নির্দেশনা দিলেও সেই নির্দেশনা মানেননি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা। এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের ৩০ এপ্রিলের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এ নিয়ম আওয়ামী লীগের মধ্যে নানারকম চর্চা হচ্ছে। 

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা কারা কারা দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে উপজেলা নির্বাচন করছেন, স্বজনদেরকে উপজেলা নির্বাচনের মাঠে নামিয়েছেন সেই তালিকা তৈরি করেছেন। আগামী ৩০ এপ্রিলের বৈঠকে এই তালিকা আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে দেওয়া হবে। 

দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র গুলো বলছে, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে থাকবে। বিশেষ করে নির্বাচনকে যেন কেউ প্রভাবিত করতে না পারে, নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি কোনো ছাড় দেবেন না- এই বার্তাটি প্রধানত দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে দেওয়া হবে। 

বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, যে সমস্ত মন্ত্রী এবং এমপিরা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নিজেদের স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে পর্যায়ক্রমে। আওয়ামী লীগ আকস্মিকভাবে তাদেরকে বহিষ্কার করা বা চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে যাবে না। বরং প্রথমে তাদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং যে সমস্ত নেতারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে তাদের স্বজনদেরকে প্রার্থী দিয়েছেন তাদের কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করার বিষয়টিও সামনে আসতে পারে। এ ছাড়া যারা মন্ত্রী এবং এমপি তাদের জন্য এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের বার্তা দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

একাধিক সূত্র বাংলা ইনসাইডারকে জানিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে আছেন। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো তাৎক্ষনিকভাবে সবাইকে বহিষ্কার করা বা দলে থেকে বের করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ তিনি নেবেন না। তবে বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য হলো উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা। নির্বাচনে যেন ভোটার উপস্থিতি বাড়ে সেটি নিশ্চিত করা। এই বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে উপজেলা নির্বাচনে যেন মানুষ ভোট দিতে যায় সে বিষয়ে জনগণকে উদ্ধ করার পর জোর দিবেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ যেন উপজেলা নির্বাচনের যাকে ইচ্ছা মানুষ ভোট দিক সে বার্তাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সেই নির্দেশনা দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ   কার্যনির্বাহী কমিটি   উপজেলা নির্বাচন   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন