সব
‘না’-এর মমার্থ অসম্মতি
নয়। অনেক সময় ‘না’-এর আড়ালে লুকিয়ে
থাকে মধুর সম্মতি। ‘না’
বলেই ভালোবাসার মানুষের পাগলামিকে স্বাগত জানান প্রিয়তমা। কূটনীতিতেও ‘না’ মানেই নেতিবাচক
না। সবকিছু শেষ না। গাজা
আক্রমণে ইসরায়েলকে মার্কিন ‘না’ আসলে সম্মতি।
প্রচ্ছন্ন মার্কিন সমর্থনেই ইসরায়েল গাজায় নারকীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে। এরকম অনেক উদাহরণ
দেওয়া যায়। যেখানে ‘না’-এর অর্থ ‘হ্যাঁ’। অনেক সময়
‘না’-এর অর্থ থাকে
অস্পষ্ট, রহস্যময়তার চাদরে ঢাকা। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ‘নো নো’ উচ্চারণ
নিয়ে গবেষণা হতেই পারে।
গত বৃহস্পতিবার নিয়মিত ব্রিফিং করছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এ মুখপাত্র। যথারীতি
এ ব্রিফিংয়ে এসেছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ নিয়ে একাধিক প্রশ্নের
উত্তরে মিলার যা বলেছেন, তার
সারসংক্ষেপ এরকম—বাংলাদেশে ৭
জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু
হয়নি। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের
ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন এবং নির্বাচনের দিন
সহিংসতার ঘটনা সম্পর্কে তারা
অবহিত এবং এর নিন্দা
জানায়। ম্যাথু মিলারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘যখন
আপনারা বলছেন বাংলাদেশের এ নির্বাচন অবাধ,
সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য হয়নি তাহলে যুক্তরাষ্ট্র
কি টানা চতুর্থ মেয়াদে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বীকৃতি
দেবে না? উত্তরে মিলার
ইংরেজিতে দুটি শব্দ উচ্চারণ
করেন। তা হলো—‘নো
নো’। এর বাইরে
তিনি কিছু বলেননি।
মার্কিন
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের এই ‘নো নো’-এর অনেক ব্যাখ্যা
হতেই পারে। প্রথমত; প্রশ্নটি ছিল নেতিবাচক বা
না সূচক। যদি প্রশ্ন করা
হতো যুক্তরাষ্ট্র কি স্বীকৃতি দেবে?
এর উত্তরে যদি মিলার বলতেন
‘নো নো’, তাহলে এটি
হতো সরাসরি ও স্পষ্ট। যার
অর্থ দাঁড়াত নতুন সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র
স্বীকৃতি দেবে না। কিন্তু
প্রশ্নটি ছিল ‘স্বীকৃতি দেবে
না?’—এর উত্তরে ম্যাথু
মিলার নো নো বলেছিলেন।
যার অর্থ দাঁড়ায় স্বীকৃতি
না দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।। স্বীকৃতি
না দেওয়াকেই নো বলেছেন মার্কিন
এ কূটনীতিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মিলারের ডাবল নো নিয়ে
কিছুদিন চর্চা হবে। যে যার
মতো করে ব্যাখ্যা দেবে।
কিন্তু ঝানু কূটনৈতিকরা ঠিক
বুঝবেন, এর মানে হলো,
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন অবস্থান
এখনো ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’। এজন্যই পররাষ্ট্র
দপ্তরের মুখপাত্র রহস্যময় উত্তর দিয়েছেন। যে উত্তরের নানারকম
ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রও অবস্থান
পরিবর্তন করতে পারবে অনায়াসে।
নির্বাচনের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে রহস্যময় আচরণ করছে। এটাকে আরও সহজ করে বলা যায় দ্বিমুখী নীতি। নতুন সরকার শপথ গ্রহণের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন মিস্টার হাস। ১১ জানুয়ারি শপথ অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গভবনে তাকে সপ্রতিভ এবং স্বতঃস্ফূর্ত দেখা গেছে। পিটার হাসের মুখে কদিন আগেও যে কালো মেঘের আবরণ ছিল, তা সরে গিয়েছিল সেদিন। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ‘অংশীদারত্বের সম্পর্ক’ এগিয়ে নেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
পিটার ডি হাস স্বপ্রণোদিত হয়ে এসব করেছেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ওয়াশিংটনের সবুজ সংকেত ছাড়া তিনি এসব করতে পারেন না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এসব তৎপরতার মধ্যে দিয়ে নতুন সরকারকে এরই মধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন সরকার এরই মধ্যে বৈধতা পেয়ে গেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বা যে কোনো দেশের কাছে যদি ১১ জানুয়ারির গঠিত সরকার গ্রহণযোগ্য না হতো, তাহলে এভাবে মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘটা করে বৈঠক হতো না। তাই নতুন সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। তবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই তাদের অস্বস্তি ও নেতিবাচক অবস্থানের কথা বলছে। নির্বাচনের পর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট যে বিবৃতি দিয়েছিল, তার সঙ্গে বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের বক্তব্যের একচুলও দূরত্ব নেই। হুবহু একই কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি। এ প্রতিবেদনেও যে, মার্কিন বিবৃতিরই অনুরণন হবে, তা বলাইবাহুল্য। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্র ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এ কথা বললেও নির্বাচনের পরপরই কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। যেমনটি দিয়েছিল কম্বোডিয়া ও নাইজেরিয়ার নির্বাচনের পর। ওই দুই দেশে নির্বাচনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি এ মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। তবে অনেক দেশেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা বা অন্য ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সময় নেয় যুক্তরাষ্ট্র। কোথাও ছয় মাস, কোথাও এক বছর পর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বিশ্বের ক্ষমতাধর এ রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং ভোট বর্জনকারী বিএনপি ভালো করেই জানে। নির্বাচন এবং নতুন সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী একাধিক বক্তৃতায় এ প্রসঙ্গটি সামনে এনেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র এখনো চলছে।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথাকথিত গবেষণা রিপোর্ট থেকে। এটি কি গবেষণা রিপোর্ট না বিএনপির বিবৃতির ভাবসম্প্রসারণ, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। টিআইবির রিপোর্টটি যে উদ্দেশ্যমূলক এবং দুরভিসন্ধির একটি অংশ, তা একাধিক কারণে অনুভব করা যায়। প্রথমত; টিআইবি একটি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা। প্রতিটি সংস্থার কাজের আলাদা ম্যান্ডেট থাকে। টিআইবি যদি নির্বাচনে দুর্নীতি কিংবা কালো টাকার ব্যবহার, প্রার্থীদের সম্পদ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করত, তাহলে কোনো কথা ছিল না। কারণ এ ধরনের গবেষণা করাটা তাদের দায়িত্ব। এসব বিষয়ে গবেষণা টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমেরই অংশ। কিন্তু ৭ জানুয়ারির নির্বাচন পাতানো ছিল কি না, কত শতাংশ ভোট পড়েছে—এসব অনধিকার চর্চার সাহস তারা কোত্থকে পেল? টিআইবি কি নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান? এনজিও ব্যুরো থেকে তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক গবেষণার অনুমতি নেওয়া আছে? এ প্রশ্নের উত্তরগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। টিআইবি যদি তার ঘোষিত কাজের পরিধির বাইরে গিয়ে কাজ করে তাহলে অবশ্যই এ প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন বাতিল করা দরকার। পৃথিবীর যে কোনো দেশ হলে, এখতিয়ারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের জন্য টিআইবি শাস্তি পেত।
দ্বিতীয়ত; টিআইবির গবেষণার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। ন্যূনতম গবেষণার নীতি এবং নৈতিকতা অনুসরণ করা হয়নি। তথ্য-উপাত্ত যাচাই ছাড়াই কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। অতীতেও এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু নিম্নমানের গবেষণা করেছে। তবে এবারের কথিত গবেষণা একেবারে আবর্জনা। গবেষণার জগতে এটি একটি নিকৃষ্টতম কাজগুলোর একটি। এই বানোয়াট, উদ্ভট প্রতিবেদনের দুর্গন্ধ বহুদিন সত্যিকারের গবেষকদের বিব্রত করবে। যে কোনো নির্মোহ গবেষক এ ধরনের প্রতিবেদন পড়ে বিরক্ত হবেন, বমি করবেন। টিআইবি উদ্দেশ্য ছাড়া এ কাল্পনিক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। টিআইবি, বিএনপি, সুশীল গোষ্ঠী এবং যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন নিয়ে যা বলছে তা একই সূত্রে গাঁথা। বিএনপি-জামায়াতের গৃহপালিত কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নির্বাচনের পর থেকে ইনিয়ে-বিনিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে যা বলছে এবং লিখছে, তার সামষ্টিক রূপ হলো টিআইবির রিপোর্ট। এ রিপোর্টে নির্বাচনবিরোধী সুশীলদের বক্তব্যকে একত্রিত করা হয়েছে। যারা নির্বাচনের বদলে একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে চেয়েছে, তাদের চেষ্টা যে এখনো অব্যাহত আছে তার প্রমাণ টিআইবির রিপোর্ট। টিআইবি এবং তাদের ছাতার নিচে থাকা গৃহপালিত সুশীলরা আসলে পশ্চিমাদের ক্রীতদাস। স্বপ্রণোদিত হয়ে তারা এমন উদ্ভট গবেষণা নামের মিথ্যাচার প্রসব করেছে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অচিরেই আমরা দেখব, টিআইবি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকারের মতো সংগঠনের একপেশে বক্তব্যগুলো মার্কিন প্রতিবেদনে উদ্ধৃত হবে। এদের বক্তব্য উল্লেখ করেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করবে? নতুন নির্বাচনের দাবি করবে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচন এবং নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে দ্বৈত কৌশল গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে তারা চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাচ্ছে। নতুন সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে কী দেবে, কতটা দেবে তা বোঝার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ব্যবসা করতে চায়। গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের হিস্যা চায়। মার্কিন সামরিক বলয়ে বাংলাদেশকে রাখতে চায়। বঙ্গোপসাগরের সামরিক উপস্থিতি চায়। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব বলয় থেকে বের করে আনতে চায়। কয়েক বছর ধরে এসব চাওয়া নিশ্চিত করতেই এ দেশে মার্কিন মনোযোগ। নতুন সরকারের সঙ্গে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ ঠিকঠাক হলে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য পরিণত হবে স্রেফ কথার কথা। মার্কিন রিপোর্ট শোভা পাবে মহাফেজখানায়। আর নতুন সরকারের সঙ্গে যদি বোঝাপড়া ঠিকঠাক মতো না হয়, তাহলে শুরু হবে নতুন চাপ। আসবে নানা নিষেধাজ্ঞা। নতুন নির্বাচনের আওয়াজ তুলবেন যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত অনুগত সুশীলরা আর সব হারিয়ে নিঃস্ব বিএনপি।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল কী তা বুঝতে তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ কৌশল ক্রমেই হোঁচট খাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। গত শুক্রবার জাতিসংঘের মহাসচিবও অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এর ফলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যে যাই বলুক, তা জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি এ সরকারকে গ্রহণযোগ্যতার সংকট থেকে মুক্ত করবে। তা ছাড়া চীন-রাশিয়া-ভারত আগেই নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পালা করে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই একলা হয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখন সংকুচিত। যুক্তরাষ্ট্র এখন বিবর্ণ, ক্ষমতাহীন জমিদারের মতো। যাদের অতীত দাপুটে, একসময় প্রভাবশালী ও অত্যাচারী। কিন্তু এখন তাদের প্রতাপ শুধু ইতিহাস। হুংকার দেওয়া, ধমক দেওয়া ছাড়া তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের কথা কেউ শোনে না। তাদের হুংকারে কেউ ভয় পায় না। ম্যাথু মিলারের ‘নো নো’ বিবর্ণ জমিদারের অর্থহীন আর্তনাদ কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
সুশীল ডোনাল্ড লু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বদিউল আলম মজুমদার আদিলুর রহমান খান
মন্তব্য করুন
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চীন সফর ভারত যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য করুন
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।
গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। তার আগে একটা রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে ২ হাজার ৬০০ কাউন্সিলরের মধ্যে দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি পেয়েছে ১ হাজার ৬১টি পদ। অন্যদিকে ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ৫০৪টি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়ে দলগতভাবে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। নির্বাচনে দ্বিতীয় হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। ৪০ বছরের ইতিহাসে এটি কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা যে ভীষণ নড়বড়ে, তা এই নির্বাচনেই প্রমাণ হয়েছে। নির্বাচনের পর পার্লামেন্ট নির্বাচনে কনজারভেটিভদের ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা না বলা গেলেও কনজারভেটিভ পার্টি যে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, সেটি হলফ করে বলা যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ বছর নভেম্বরে। এই নির্বাচনে জো বাইডেনের অবস্থা তথৈবচ। জো বাইডেনকে কোনো জনমত জরিপেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। আইনি মারপ্যাঁচ, যৌন কেলেঙ্কারি ডেমোক্রেটদের নানামুখী বাধা ইত্যাদি নানা সংকট থেকে মুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আবার প্রার্থী হওয়া ট্রাম্পের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না সেটি যেমন প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো যে, জো বাইডেন এই নির্বাচনে কি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ এবং ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে জ্ঞান দেয়, মানবাধিকার চর্চার জন্য শাসন করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এখন মানবাধিকার সংকটে। গাজায় ইসরায়েলের তাণ্ডবের প্রতিবাদে মার্কিন তারুণ্যের গণবিস্ফোরণ পুরো বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এই গণবিস্ফোরণকে ঠেকাতে যেভাবে জো বাইডেন সরকার দমন নীতি গ্রহণ করেছে, তা তাকে সবচেয়ে কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে গেছে। জনগণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশ্বাস করছে না, জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তিনি এখন তলানিতে অবস্থান করছেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিজয়ী হয়েছিলেন অনেক লড়াই করে। বিজয়ের পর জনগণ তার পক্ষে কতটুকু আছে বা জনগণের মনোভাব কী, তা যাচাইয়ের একটি উপায় ছিল গত মার্চের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দলের শোচনীয় ভরাডুবি ঘটেছে। তিনি বড় শহরগুলোতে মেয়র পদে যাদের প্রার্থী দিয়েছিলেন, তারা ধরাশায়ী হয়েছেন বিরোধী পক্ষের কাছে।
সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর অবস্থা ভালো না। নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের মুখে। জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক স্থানেই বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছে নাগরিকরা। এর একটি বড় কারণ হলো, মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। এরকম বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশে এখন পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচন চলছে। প্রথম ধাপের উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত ৮ মে (বুধবার)। এ উপজেলা নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে চেয়েছে; কিন্তু সে উদ্যোগও সফল হয়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রথম ধাপে ৩৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এটি সর্বনিম্ন ভোটের রেকর্ড। এটি নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতে যেমন ক্ষমতাসীন দল চ্যালেঞ্জের মুখে, পুনরায় তাদের ক্ষমতায় আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি তেমনটি নয়।
বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে কেউ ক্ষমতাসীন দলের বিপর্যয়ের কথা কল্পনাও করেনি। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল তারা কেউই ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেনি বা ক্ষমতায় আসার মতো জনপ্রিয়তা, নেতৃত্ব বা সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের ছিল না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল অবধারিত। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে যারা দলের মনোনয়ন পাননি সে বিদ্রোহী প্রার্থীদের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৮ জন স্বতন্ত্র বিজয়ী হয়ে নির্বাচনের মান বাঁচিয়েছে। নির্বাচনকে ‘জীবন’ দিয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। উপজেলাতেও তাই আওয়ামী লীগ একই কৌশল গ্রহণ করেছে। উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা ছিল দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করলে বিএনপির জন্য নির্বাচনে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে—এমন গুঞ্জনও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি পুরোনো পথে হেঁটেছে। তারা উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শতাধিক বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনে তাদের ৭ জন বিজয়ী হয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। তবে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিকূল রাজনীতির পরিবেশে নির্বাচন করে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা যায় না। তার পরও যে উপজেলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে বিএনপি নেতারা অংশগ্রহণ করেছে সেজন্য তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ সুস্থ রাজনীতির জন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার পরও উপজেলা নির্বাচন গণতন্ত্রের সংকটের বার্তা। নির্বাচন নিয়ে জনগণের অনীহা ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তির। আওয়ামী লীগের সামনে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নেই। আওয়ামী লীগের এমন কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই যারা জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তা ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের তীব্র সংকট চলছে। কদিন আগেই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে হটিয়ে তারা ক্ষমতা নিতে চায়, তাদের নেতা কে?’ এই নেতৃত্বের সংকটই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, নেতৃত্ব সংকটের কারণেই বিএনপি নির্বাচনবিমুখ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে এখন ‘স্বেচ্ছা বন্দি’। তিনি ফিরোজায় বাসভবনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি নির্বাচনের অযোগ্য। অন্যদিকে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ একাধিক মামলায় দণ্ডিত। তার দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এ কারণে বিএনপি এখন নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। বিএনপির লক্ষ্য সুস্পষ্ট। তারা নির্বাচন থেকে দূরে থেকে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলতে চায়। গণতন্ত্রে সংকট দেখা দিলে তৃতীয় কোনো পক্ষের ক্ষমতায় আসার পথ উন্মুক্ত হবে।
তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতায় এলে বিএনপি তার রাজনৈতিক পুনর্গঠন নতুন করে শুরু করতে পারবে। অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে তারেক জিয়া দেশে ফেরা, খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফের বিষয়গুলো তারা ফয়সালা করতে চায়। এজন্য নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক রীতিতে ক্ষমতায় আসা নয়; বরং একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এ কারণেই তারা যতটা না জনমুখী কর্মসূচি পালন করে তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ধর্ণা দেয়, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশগুলোকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা বিএনপির রাজনীতির প্রধান কৌশল। ফলে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের খুশি বা আত্মতুষ্টির কারণ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪২ শতাংশ। এ নিয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় এবং সন্দেহ রয়েছে। তার পরও একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতিকে সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে ভোটার উপস্থিতি কম হবে—এটাই স্বাভাবিক বিষয়। বিএনপি অংশগ্রহণ না করার পরও যে একতরফা নির্বাচন হয়নি, বিশেষ করে ২০১৪-এর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসতে পেরেছে, সেটি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের বড় অর্জন। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন জনগণ আরও ভোটবিমুখ। এটি আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই অশনিসংকেত। গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভোটাররা যদি গণতন্ত্রের প্রতি অনাগ্রহী হন, ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে না যান, ভোটাররা যদি তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখান তাহলে গণতন্ত্র সংকটে পড়বেই। আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বে আওয়ামী লীগ। এ কারণে অন্য দেশগুলোতে যখন ক্ষমতাসীনরা ভোটে জিতবে কি জিতবে না সেই অনিশ্চয়তায়, সেখানে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে আমি মনে করি। নির্বাচনে পরাজয়ের শঙ্কার চেয়ে গণতন্ত্রের মৃত্যুর শঙ্কা বেশি ভয়াবহ।
উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে অতীতে দেখা গেছে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকে জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহী হয়। এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক হয় এবং একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এবার উপজেলা নির্বাচনে সেটি হয়নি। কেন হয়নি তার কারণ আওয়ামী লীগকে খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ সমর্থক আছে। তারাও কেন ভোট দিতে যাচ্ছেন না? এর উত্তর খুঁজতে হবে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটিকে। দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করেও আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারেনি। এই না পারার কারণ হলো আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতা লোভ, বাড়াবাড়ি এবং এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনা। তারা দমন করার চেষ্টা করেছে পেশি শক্তি প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করেছে। সাধারণ মানুষ সব জানে, সব বোঝে। তারা এসব ঝুট-ঝামেলার মধ্যে যেতে চায়নি। সে কারণেই তারা ভোট থেকে আগ্রহ ফিরিয়ে নিয়েছে। অনেক জায়গায় নির্বাচনের ফল ছিল পূর্ব অনুমিত। তারা জানত যে, এমপির ভাই দাঁড়িয়েছে, এমপির ছেলে দাঁড়িয়েছে কাজেই তাদের বিজয় ঠেকাবে কে। এই বোধটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগকে এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না বটে, তবে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না, তা হলফ করে কে বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে আবার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকে তিনি এই ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। অতিডান এবং অতিবামরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করেছে বলে তিনি নেতাদের সতর্ক করেছেন।
আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের কাছেই আওয়ামী লীগ বারবার পরাজিত হয়েছে, হয়েছে বিপর্যস্ত। আর এই ষড়যন্ত্র শুধু বাইরে থেকে হয়নি, দলের ভেতর থেকেও হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর একটাই উপায়, তা হলো গণতন্ত্রকে মুক্ত স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে দেওয়া, জনগণকে উৎসাহিত করা, ভোটকেন্দ্রে যাতে ভোটাররা যান, তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন সে পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া। উপজেলা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি দলের নেতাকর্মীদের ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য প্রচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেখ হাসিনা মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করার জন্য যে নির্দেশ দেন, তা কেউ মানেনি। যারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তারাও ষড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংকটে। বিরোধী দলহীন গণতন্ত্র মুণ্ডুহীন দেহ। সরকারের কোনো জবাবদিহি থাকে না। এতে ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের দূরত্ব তৈরি হয়। এভাবেই পল্লবিত হয় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। অবৈধ ও অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হয়। তেমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছেই যেতে হবে।
লেখক:
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল:
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৭ মে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালিত হলো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করলাম। যে যেভাবে পেরেছে ১৭ মে তে নিজেদেরকে জানান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সংবাদপত্রগুলো ভরে গেছে শেখ হাসিনার স্তুতিতে। শেখ হাসিনাকে নিয়ে বন্দনা কতটা আসল, কতটা চাটুকারিতা তা নিয়ে গবেষণা হতেই পারে। ১৭ মে ১৯৮১ তে যখন তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তখন সাধারণ মানুষের ভালবাসা আবেগ ছিলো হৃদয় নিংড়ানো, পুরোটাই নিখাঁদ। ৪৩ বছর পর এই উচ্ছ্বাস কি তেমনি অকৃত্রিম?
বাংলাদেশে সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি আছেন যাদেরকে মনে করা হয় তারা মার্কিনপন্থী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে তারা গর্ব অনুভব করেন। কথায় কথায় মার্কিন দূতাবাসে যান। সেখানে প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, নৈশভোজে মিলিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বলে তারা তার চেয়ে তিন ধাপ গলা উঁচিয়ে কথা বলেন। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের কোন ভালবাসা নেই, প্রেম নেই, আগ্রহ নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং নীতি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করাই যেন তাদের প্রধান লক্ষ্য। এই সমস্ত সুশীলদেরকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোফোন।
আওয়ামী লীগ এবং তার আদর্শিক জোট ১৪ দলের নেতাদের চীন সফরে হিড়িক পড়েছে। আওয়ামী লীগ এবং তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর এই চীন সফরকে ঘিরে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলাপ আলোচনা। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই ১৪ দল এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের চীন সফরের ব্যাপারে দৃষ্টি রাখছেন। তবে তারা এই বিষয় নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হচ্ছেন না। বিষয়টি তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় হিসেবেই মনে করছেন।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।
দেশের মানুষের এমনিতেই নাভিশ্বাস অবস্থা। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ সংকটে চেয়েও বড় অস্থিরতা হলো জিনিস পত্রের দাম। অস্থির সময়ে মানুষের জন্য বিনোদনের কোন খোরাক নেই। তবে প্রধান নির্বাচন কাজী হাবিবুল আউয়াল মানুষের জন্য অস্বস্তির তাপদাহে এক পশলা বৃষ্টির মতো, বিনোদনের খোরাক যোগালেন। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ১৩৯ টি উপজেলার নির্বাচনের পর সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘ধান কাটার কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে আসেননি।’ নিষ্প্রাণ উপজেলা নির্বাচনে সিইসির বক্তব্যই একমাত্র চমক।