আগামীকাল ৩০ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। ব্যতিক্রমী এবারের সংসদে সবার চোখ থাকবে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের ওপর। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। রেকর্ডসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী এবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এত অধিকসংখ্যক স্বতন্ত্র এমপি আগে কখনো নির্বাচিত হননি। যে ৬২ জন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, তাদের ৫৮ জনই বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। নৌকা প্রতীক না পেয়ে ঈগল, ট্রাক ইত্যাদি প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেন। নির্বাচনের পর তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের পদপদবিতে বহাল আছেন। আওয়ামী লীগও কৌশলগত কারণে এসব বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। যেহেতু বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ নির্বাচন বর্জন করে, তাই প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ এ কৌশল গ্রহণ করে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, নির্বাচন যেটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়েছে, তা স্বতন্ত্রদের অবদান। বিদ্রোহী প্রার্থীদের ছাড় না দিলে নির্বাচন হতো আরও একপেশে, বিবর্ণ। তাই ভোটের পরও ক্ষমতাসীনদের কাছে স্বতন্ত্রদের গুরুত্ব কমেনি। ২৮ জানুয়ারি গণভবনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানোর মধ্যে দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। স্বতন্ত্র এমপি কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন? তারা কি মুক্ত স্বাধীন হিসেবে সংসদে জনগণের কণ্ঠস্বর হবেন, নাকি একান্ত অনুগত আওয়ামী লীগের গৃহপালিত হিসেবে সংসদে শুধু ক্ষমতাসীনদের বন্দনা করবেন; অথবা একটা মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকবেন?
সংসদীয় গণতন্ত্রে দুই পক্ষ থাকে। ট্রেজারি বেঞ্চ বা সরকারি দল এবং বিরোধী দল। সরকারি ও বিরোধী দল মিলেই সংসদ পায় পূর্ণতা। সংসদে সরকারি দলের চেয়ে বিরোধীদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সংসদ কতটা কার্যকর, প্রাণবন্ত তা নির্ভর করে বিরোধী দল কতটা সক্রিয় তার ওপর। সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা, সরকারের ভুলত্রুটির সমালোচনা করা বিরোধী দলের প্রধান কাজ। বিরোধী দল যত ভালোভাবে এ কাজটি করতে পারে, গণতন্ত্র তত বিকশিত হয়, শক্তিশালী হয়। বিরোধী দলহীন সংসদ অকার্যকর। এরকম সংসদ সরকারি দলকে বেপরোয়া করে। তারা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে চলে যায়। এ প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য ভালো নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো গত দুটি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ও হতাশাজনক। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি কাগজে-কলমে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে ছিল। কিন্তু বাস্তবে তারা ছিল সরকারের বাধ্যগত, গৃহপালিত। ২০১৪ সালে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এরশাদের ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে দেননি রওশন এরশাদ। বেশ কিছু প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও শেষ পর্যন্ত দলটি নির্বাচনে থাকে। এরশাদ নিজেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, মশিউর রহমান রাঙ্গা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের অন্তর্ভুক্তি, ব্যতিক্রমী ও বিরল ঘটনা। এ কারণে ২০১৪ সালের সরকারকে সর্বদলীয় জাতীয় সরকারও বলা যায়। নানা চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে জাতীয় পার্টির নেতারা সংসদে সরকার বন্দনার প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন। সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল বটে কিন্তু প্রধান বিরোধী দল হতে পারেনি। টানা দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পায় জাতীয় পার্টি। এবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে একলা চলো নীতি গ্রহণ করে। জাতীয় পার্টি তো নয়ই, ১৪ দলের কোনো শরিককেও মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। এ সময় জাতীয় পার্টির পোষা বিরোধী দলের কলঙ্ক মুছে ফেলার চেষ্টা করে। সংসদে বিশেষ করে শেষদিকে তাদের সরকারের সমালোচনায় বেশ তৎপর দেখা যায়। এতে সংসদও খানিকটা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল বটে। কিন্তু তখনো জাতীয় পার্টির কারও কারও মধ্যে সরকারের গুণকীর্তন করে কিছু প্রাপ্তির চেষ্টা ছিল দৃশ্যমান। ফলে সাধারণ জনগণ জাতীয় পার্টিকে সত্যিকারের বিরোধী দল ভাবতে পারেনি কখনো, বরং তারা অনুগত বিরোধী দল হিসেবেই পরিচিতি পায়। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে ১৯৭৩-এর প্রায় বিরোধী দলশূন্য সংসদও দশম ও একাদশ সংসদের থেকে প্রাণবন্ত ছিল। হাতেগোনা কয়েকজন বিরোধী দলের সদস্যকে অবারিত সমালোচনার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ এবং কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। বিরোধীদের সমালোচনাকে তিনি স্বাগত জানাতেন। এরপর সংসদীয় গণতন্ত্রের অবসান হয়। সামরিক স্বৈরাচাররা সংসদকে রাবার স্ট্যাম্প বানায়। কিন্তু তারপরও ’৭৯ ও ’৮৬-এর সংসদ ছিল প্রাণবন্ত। বিরোধী দলের উপস্থিতি এবং সক্রিয় অবস্থান ছিল দৃশ্যমান। সরকারের তীব্র সমালোচনা করে আলোচিত হয়েছিলেন বেশ কজন পার্লামেন্টারিয়ান। কিন্তু ’৮৮ সালের এরশাদের সাজানো নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বিরোধী দল। এ সময় এরশাদ কাছে টানেন জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রবকে। রবের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ বা কপ। এই বিরোধী দলের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’। আ স ম রব এরশাদ বন্দনায় তার নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকেই শুধু সংকটে ফেলেননি, সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাকেও হাস্যকর করেছেন। ’৯১, ’৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদগুলো ছিল প্রাণবন্ত, উত্তেজনাপূর্ণ। বিশেষ করে ’৯১-এর সংসদ সম্ভবত বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর সংসদ। বিরোধী দলে থেকেও আওয়ামী লীগ কোস্টগার্ড বিল পাস করিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে দেশে কার্যত সংসদীয় গণতন্ত্রের বদলে প্রধানমন্ত্রীশাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এত প্রশ্ন, তার একটি বড় কারণ হলো অকার্যকর সংসদ। অনুগত বিরোধী দল। এবারের নির্বাচনে বিএনপি এবং তার মিত্রদের অংশগ্রহণ না করার ফলে আবারও একটি গুরুত্বহীন সংসদ গঠিত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকা সংসদে সরকারের ন্যূনতম সমালোচনাও হবে না বলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় অনেকেই একটি প্রাণবন্ত সংসদের আশায় বুক বেঁধে আছেন। সংসদে ন্যায্য কথা বলা হবে, দুর্নীতি অর্থ পাচারকারীদের স্বরূপ উন্মোচন হবে, ব্যর্থ এবং অযোগ্য মন্ত্রীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে, এমন প্রত্যাশার প্রদীপ জ্বলতে শুরু করেছে। এরকম প্রত্যাশার কারণ, স্বতন্ত্রভাবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের কেউ কেউ জাতীয়ভাবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত। রীতিমতো সেলিব্রেটি। ব্যারিস্টার সুমনের কথাই ধরা যাক, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রিয় মুখ। জনগণ যেসব বিষয়ে উদ্বিগ্ন, বিরক্ত; সেসব বিষয় নিয়ে তিনি গত কয়েক বছর কথা বলেছেন। অর্থ পাচার, দুর্নীতি নিয়ে তার বক্তব্য যেন সাধারণ মানুষের মনের কথার প্রকাশ। এবার তিনি স্বতন্ত্রভাবে এমপি হয়েছেন। তিনি শুধু তার নির্বাচনী এলাকাতেই পরিচিত মুখ নন, সারা দেশেও জনপ্রিয়। জাতীয় সংসদে এসব বিষয়ে তার শক্তিশালী অবস্থান দেখতে চায় দেশবাসী। এ. কে. আজাদ স্বতন্ত্রভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ব্যবসায়ী নেতা বহু আগেই। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হলেও লুটপাট, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই খোলামেলা কথা বলছেন। সংসদে তিনি এসব কথা বলবেন এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে। মুজিবর রহমান চৌধুরী বা নিক্সন চৌধুরীও সরকারের ভেতরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী, দুর্নীতিকারী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, এটা জনগণ চায়। এরকম বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব এবার নির্বাচনে নিজেদের জনপ্রিয়তায় জয়ী হয়েছেন। যাদের জনপ্রিয়তা শুধু তাদের নির্বাচনী এলাকায় নয়, সারা দেশে। জনগণ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তারা জাতীয় সংসদে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
সংসদে স্বতন্ত্রদের অদ্ভুত এক সুবিধাজনক অবস্থান আছে। সংসদীয় গণতন্ত্র স্বতন্ত্র এমপিদের বলা হয় ‘গ্রে মেম্বার’। সাদা ও কালোর মাঝামাঝি যে অবস্থান তাকে বলা হয় গ্রে বা ধূসর। সেই ধূসর অবস্থানে থেকে স্বতন্ত্রদের যেমন সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করতে পারবেন, তেমনি সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনা করতে পারবেন। এই স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের শৃঙ্খলমুক্ত। ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একজন দলীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য সংসদে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবেন না। তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। তিনি শৃঙ্খলিত। অথচ একজন ‘স্বতন্ত্র’ সংসদ সদস্য মুক্ত, স্বাধীন। এই স্বাধীনতার কি সঠিক প্রয়োগ করতে পারবেন স্বতন্ত্ররা?
আমি জানি, যারা স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মনোনয়ন না পেয়ে নিজেদের যোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ হিসেবে তারা নির্বাচন করেছিলেন। তাদের অনেকেরই লক্ষ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকা। আগামী নির্বাচনে যেন তারা ‘নৌকা’ প্রতীক পান তা নিশ্চিত করা। সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলে তাদের নড়বড়ে অবস্থান সংহত করা। এজন্য অনেকেই সংসদে আওয়ামী লীগেরই অংশ হিসেবে কাজ করতে চাইবেন। নির্বাচনের পর থেকে বেশিরভাগ স্বতন্ত্রের মধ্যে এই প্রবণতা দৃশ্যমান। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে ‘নৌকা’র প্রতিপক্ষ হিসেবে; আওয়ামী লীগ হিসেবে নয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করেই স্বতন্ত্র জয়ী করেছেন ভোটাররা। তাই স্বতন্ত্ররা যদি আওয়ামী লীগের অনুগত এবং গৃহপালিত হন তাহলে সেটি হবে ভোটারদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। এর ফলে জাতীয় সংসদ হবে স্তাবকদের ক্লাব। অতি স্তুতি, চাটুকারিতা সরকারকে জবাবদিহিতা ঊর্ধ্বে নিয়ে যাবে। জনবিচ্ছিন্ন করবে। সংসদের প্রতিও জনগণের আস্থা নষ্ট হবে। এই সরকারের বিগত ১৫ বছরে যেমন অনেক ভালো কাজ আছে, তেমনি আছে অনেক ব্যর্থতা। পৃথিবীর কোনো সরকারই সব কাজ ভালো করে না। দেশ চালালে ভালো-মন্দ দুটিই হবে। সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনার সব দরজা বন্ধ হলে তা হবে দেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। ক্ষমতাসীনদের জন্যও ভালো নয়। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক লুট, খেলাপি ঋণ—এসব বিষয়ে সংসদে কথা বলা না হলে, সংসদ গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। হারাবে কার্যকারিতা। আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগে সয়লাব এ সংসদ হবে চাটুকারদের প্রতিযোগিতা মঞ্চ। এর ফলে গণতন্ত্রবিরোধীরা, নির্বাচন বর্জনকারীরা সুযোগ পাবে। রাজনীতি সংসদ থেকে চলে যাবে রাজপথে। অথচ স্বতন্ত্ররা যদি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হন, নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি এবং মেধা দিয়ে পরিচালিত হন, তাহলে এই সংসদ একটি অনবদ্য সংসদ হতে পারে। সংসদ হতে পারে রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। যারা স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্যও স্বাধীন অবস্থান জরুরি। আমরা তো জানি, এই জাতীয় সংসদ বহু কিংবদন্তি পার্লামেন্টারিয়ান তৈরি করেছে। আসাদুজ্জামান খান, সুধাংশু শেখর হালদার, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, রাজাকার সবুর খান, শাহ আজিজরা জাতীয় রাজনীতিতে আলোচিত হয়েছেন সংসদের মাধ্যমে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে বক্তৃতা দিয়েই তারকা হয়ে ওঠেন আন্দালিব রহমান পার্থ। আর তারা কেউ ট্রেজারি বেঞ্চে থেকে দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হননি। বিরোধী দলে থেকে সরকারের সমালোচনা করেই তারা ‘তারকা’ হয়েছিলেন। এবার যারা স্বতন্ত্র এমপি হয়েছেন তাদের সামনে ‘তারকা’ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। সংসদে সত্য কথা বলে, ন্যায় দাবি তুলেই তারা জনগণের হৃদয় জয় করতে পারেন। তাহলে এই সংসদও হবে প্রাণবন্ত। জনগণের আস্থার প্রতীক। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের সাফল্য বড় কৃতিত্ব যেমন স্বতন্ত্রদের, তেমনি এই সংসদ কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করছে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের ওপর। বাস্তবতা হলো, এই সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দল নেই। বিরোধী দল ছাড়া সংসদ অপূর্ণ। জাতীয় সংসদে ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কি এই অপূর্ণতার অন্ধকার ঘোচাবেন? জাতির কণ্ঠস্বর হবেন? এটা যদি তারা সাহস নিয়ে করেন, তাহলে লাভ হবে গণতন্ত্রের, আওয়ামী লীগ সরকারের। কিন্তু তারা যদি অনুগত আচরণ করেন, তাহলে সংকটে পড়বে গণতন্ত্র।
লেখক:
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে
জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে
দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির
স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি
অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই
মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা
ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী
লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে
বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার
মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী
লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে
না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে
প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে
সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।
আরও পড়ুন: আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার
কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার
সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ
করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া
অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা
কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি
নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের
সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি
একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত,
ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক
কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত।
ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি
অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম
হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয়
কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত
মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল।
কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর
বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়
কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে
আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর
সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান
ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও
আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন
নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা
হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে।
এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন
না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের
বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে
পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল।
যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক
দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই
অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি
২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ
ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির
কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা
তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের
শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান।
চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়,
তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি
নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল
দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই।
দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই।
সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ
হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির
চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান
একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই
কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র
ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে
বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।
শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৪ দল আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।