গত মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাত ৯টার দিকে বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেখলাম গুলির মতো মেসেজ। একটা বই পড়ছিলাম। মেসেজের টুংটাং শব্দে নজর দিলাম। কী এমন হলো যে, সবাই সব ছেড়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিতে মরিয়া হয়ে গেল। বই বন্ধ করে, ফোনে চোখ রাখলাম। দেখি ফেসবুক বন্ধ নিয়ে রীতিমতো আর্তনাদ। সরকার ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে, ফেসবুকে ঢোকা যাচ্ছে না, এ নিয়ে রীতিমতো হাহাকার। আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, সরকার কেন ফেসবুক বন্ধ করবে? দেশে কী এমন পরিস্থিতি হলো যে ফেসবুক বন্ধ করতে হবে? টেলিভিশন অন করলাম। ওমা, দেখি ‘মেটা’র সার্ভার ডাউন হওয়র কারণে বিশ্বব্যাপী ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও ইনস্টাগ্রাম সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ‘মেটা’কে দোষ দেবে কে? সব দোষ সরকারের।
আকারে ইঙ্গিতে কেউ কেউ বোঝাতে
চাইল সরকারই ‘ফেসবুক’ বন্ধ করে দিয়েছে।
এক বিশাল বুদ্ধিজীবী যেন সব জানেন।
কী অবলীলায় বেইলি রোডের দুর্ঘটনার সঙ্গে ফেসবুক বন্ধের ঘটনা মেলালেন। তার
কল্পনা শক্তিতে আমি মুগ্ধ। রাতের
মধ্যেই সত্য জানা গেল,
ফেসবুক বন্ধে সরকারের কোনো হাত ছিল
না। এটা বিশ্বব্যাপী একটা
প্রযুক্তি বিভ্রাট। কিন্তু এই ছোট্ট একটা
ঘটনা অনেক কিছু প্রমাণ
করে দিল। বাংলাদেশের মতো
জনসংবেদনশীল দেশগুলোতে নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের এক অবিশ্বাসের আলো-আঁধারি খেলা চলে। নাগরিকরা
তাদের যে কোনো সমস্যার
জন্য সরকারকে দায়ী করে। যে
কোনো ‘মুশকিল’ সরকারই ‘আসান’ করে দেবে, এমন
প্রত্যাশা করে। কারণ এ
দেশগুলোতে সরকার অনেক ক্ষমতাবান। তাদের
ব্যাপ্তি সর্বত্র বিরাজমান।
হাসপাতাল
সেবা থেকে ব্যবসা, বিয়ে
থেকে মৃত্যু, সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এ দেশে ব্যবসা
করতে, টেন্ডার পেতে, চাকরি এবং পদোন্নতির জন্য
ক্ষমতাবানদের সুনজরে থাকতে হয়। সরকারি দল
মানেই ক্ষমতাবান। জনতুষ্টির আশায় সরকারই জনগণের
সামনে প্রতিশ্রুতির মস্ত মস্ত বেলুন
ওড়ায়, যা পারবে না,
তাও করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি
দেয়। নির্বাচনে জিততে দেশের জনগণকে দুধে-ভাতে রাখার
অঙ্গীকার করে। সরকার গঠন
করে, মন্ত্রী, এমপি হয়ে রাজনীতিবিদরা
যখন তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে
না, তখন জনগণ বিশ্বাস
হারায়। এভাবেই রাজনীতির প্রতি মানুষ অনাগ্রহী হয়। সাধারণ মানুষ
তাদের সব ভোগান্তির জন্য
সরকারকেই দায়ী করে। বাংলাদেশে
বিষয়টি আরও জটিল এবং
স্পর্শকাতর। এখানে একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা মনে
করেন, তাদের জীবনে সবকিছু ঠিকঠাক করে দেওয়ার দায়িত্ব
এককভাবে সরকারের। একজন নাগরিক চান
তার সন্তান সেরা স্কুলে পড়বে।
যদি দেশে সেরা স্কুলে
তার সন্তান ভর্তি হতে না পারে,
তাহলে ‘সরকার দায়ী’।
একজন
অভিভাবক তার সন্তানের জিপিএ
৫ নিশ্চিত করার জন্য সবকিছু
করতে প্রস্তুত। এজন্য সব কোচিং সেন্টারে
নিয়ে যান প্রিয় সন্তানকে,
এসব কোচিং সেন্টারে যৌন হয়রানির মতো
ঘটনা ঘটলে দোষ সরকারের।
সব অভিভাবক কোচিং ব্যবসায়ের সমালোচনা করেন। আবার কোচিং বন্ধ
করলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে
যান। বলেন, সরকার কি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া
বন্ধ করবে? শিক্ষায় সৃজনশীলতা নেই বলে যারা
হতাশা প্রকাশ করেন, তারাই আবার সৃজনশীল শিক্ষার
বিরুদ্ধে নানা গুজব ছড়ান।
পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন হলে অধিকাংশ অভিভাবক
বিশ্বাস করেন, সরকারের গাফিলতির জন্যই তার সন্তানের শিক্ষাজীবন
অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। একজন
মানুষ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সর্বোচ্চ সেবা
চান। কিন্তু এজন্য পয়সা খরচ করতে
রাজি নন।
সরকারি
হাসপাতালে সর্বোচ্চ সেবা না পেলে
স্রেফ সরকারই দায়ী। এরকম ঘটনা প্রতিটি
ক্ষেত্রে। সম্প্রতি বেইলি রোডে আগুন এবং
তার প্রেক্ষাপটে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের কথাই ধরা যাক।
বেইলি রোডে আগুনের ঘটনার
পর সরকারকে তুলাধুনা করার লোকের অভাব
হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা।
টকশো-বাগীশ থেকে শুরু করে
বেকার, সবাই সরকারকে প্রায়
খেয়ে ফেলে অবস্থা। সরকারের
সমালোচনা করে রীতিমতো চামড়া
ছিলে লবণ লাগানো হলো।
সরকারের দোষ কী?Ñএকটু
বোঝার চেষ্টা করলাম। অফিসের আড্ডায়, টকশোতে, সংবাদপত্রের পাতায় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এরকম
অবৈধভাবে যেখানে সেখানে রেস্টুরেন্ট চলে কীভাবে? অনুমোদনবিহীনভাবে,
ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দোকান, শপিং মল হয়
কীভাবে? ফায়ার ব্রিগেড কী করে, রাজউক
তো দুর্নীতিতে সেরা, সিটি করপোরেশন লাইসেন্স
দেয় কীভাবে—ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। একজন
টকশোতে বললেন, আমরা যারা ঢাকায়
বাস করছি তারা যেন
এক জ্বলন্ত উনুনে বসে আছি। এটা
চলতে দেওয়া যায় না। একজন
বললেন সরকার ব্যর্থ। অবিলম্বে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁ,
শপিং মল, ভবন বন্ধ
করে দিতে হবে।
একজন
বললেন, সরকারের লোকজনই এসব রেস্তোরাঁর মালিক,
তাই সরকার এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। এত
তীব্র সমালোচনা, উপদেশ আর পরামর্শের পর
কে চুপচাপ বসে থাকে! সরকারের
সব সংস্থা, যাদের দায়িত্ব এসব অনিয়ম তদারকি
করা, তারা জেগে উঠল।
রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার
ব্রিগেড নানা সংস্থা ঝাঁপিয়ে
পড়ল। শুরু হলো অভিযান।
অভিযানে বহু রেস্তোরাঁ বন্ধ
করে দেওয়া হলো। কারও ফায়ার
ব্রিগেডের অনুমোদন নেই, কারও রাজউকের
নকশার অনুমোদন নেই, কেউ সিটি
করপোরেশনের লাইসেন্স না নিয়েই ব্যবসা
করছে। কিছু কিছু অভিযানে
দেখা গেল রেস্তোরাঁগুলো এতই
ঝুঁকিপূর্ণ যে, আরেকটি বেইলি
রোড ট্র্যাজেডি হওয়া সময়ের ব্যাপার
মাত্র। আমি ভাবলাম দেরিতে
হলেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার এ উদ্যোগ টুপিখোলা
অভিনন্দন পাবে। জনগণ খুশি হবে।
সমালোচকরা সরকারকে বাহবা দেবে। কোথায় কী, অভিযান শুরুর
২৪ ঘণ্টার মধ্যে শোনা গেল আর্তনাদ।
আবার তীব্র সমালোচনা শুরু হলো সরকারের
বিরুদ্ধে।
এবার
সরকারের অপরাধ কী বোঝার চেষ্টা
করলাম। একজন বললেন, রোজার
আগে এভাবে অভিযান তো রেস্তোরাঁ ব্যবসার
সর্বনাশ করবে। রেস্টুরেন্ট মালিকরা সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ‘এই
ব্যবসা বন্ধ করে দোকানের
চাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়ে আসব।’
একটি টেলিভিশনে সংবাদ শিরোনামে বলা হলো ‘হ-য-ব-র-ল অভিযান’।
কেউ কেউ বলছে, এসব
অভিযান করে সবকিছু ধ্বংস
করে দেওয়া হলো। কেউ বলল,
অভিযানের নামে চাঁদাবাজি চলছে।
আমি হতবাক। সরকার তাহলে করবে কী? অভিযান
না করলে সরকার নাকে
তেল দিয়ে ঘুমায় আর
অভিযান করলে দেশ ধ্বংস
হয়ে যায়! সব দোষ
সরকারের। এই অভিযান তো
একটি উদহারণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরকম অবস্থা।
কিছুদিন ধরে এসএসসি পরীক্ষা চলছে। বিভিন্ন রাস্তা পরীক্ষার্থীদের গাড়িতে সয়লাব। রাস্তা বন্ধ করে গাড়ি পার্কিং করা হয়েছে। তীব্র যানজট। আপনি বলবেন, ভাই রাস্তার ওপর এভাবে গাড়ি পার্ক করে রেখেছেন, সাধারণ মানুষ তো কষ্ট পাচ্ছে যানজটে। উত্তর আসবে, ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে, গাড়ি রাস্তায় রাখব না তো কি সরকারের মাথায় রাখব? স্কুলের সামনে সরকার পার্কিং রাখেনি কেন? কী তাজ্জব কথা? এর মধ্যে সরকার এলো কোথা থেকে? যে ভদ্রলোক তিন ঘণ্টা রাস্তায় গাড়ি রেখে তীব্র যানজট সৃষ্টি করলেন, তিনিই পরীক্ষার্থীদের নিয়ে ফেরার সময় যানজটে নাকাল হয়ে, সরকারকে গালি দেবেন। বলবেন, কীসব বানাইছে এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মেট্রোরেল খালি পয়সা চুরি, দুর্নীতি। যানজট তো এক ফোঁটাও কমেনি। অথচ তার জন্য যে এ রাস্তাটাই যানজট তা তাকে কে স্মরণ করিয়ে দেবে। আপনি যত্রতত্র অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করবেন, পুলিশ এসে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করলেই সর্বনাশ। সরকারের সমালোচনায় মুখর হবেন। বলবেন আপনি নির্যাতিত। যানজট নিরসনে আপনার কোনো দায়িত্ব নেই। আপনি ট্রাফিক আইন মানবেন না, কিন্তু সরকারকে ম্যাজিক করে শহরকে যানজটমুক্ত রাখতে হবে।
আপনি সরকারের রাজস্ব নীতির সমালোচনা করবেন। সরকার ঋণ নিয়ে দেশকে দেউলিয়া করে ফেলল বলে হাহাকার করবেন। আবার নিজে আয়কর ফাঁকি দেবেন, ভ্যাট ফাঁকি দেবেন। সরকারের পাওনা ট্যাক্স দিতে গড়িমসি করবেন। ট্যাক্স বাড়িয়ে সরকার জনগণকে জুলুম করছে বলে অভিযোগ করবেন। সব দোষ সরকারের। আপনি উন্নয়ন চান, কিন্তু ট্যাক্স দিতে রাজি নন। আপনি আইনের শাসন, ন্যায়বিচারের কথা বলবেন। অভিযোগ করবেন, আইন সবার জন্য সমান নয়। ওপরতলার মানুষরা আইনের ঊর্ধ্বে—এমন কথা বলে সরকারের সমালোচনা করবেন। আবার ড. ইউনূসের মতো ওপরতলার মানুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচারের তদন্ত হলে আপনি হৈহৈ করে উঠবেন। বলবেন, সরকার কি পাগল হয়ে গেল? ড. ইউনূসের মতো লোককে আদালতপাড়ায় চরকির মতো ঘোরাচ্ছে। এ দেশে গুণীদের মান-ইজ্জত বলে কিছু থাকল না, এরকম বক্তব্য রেখে আপনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। সব দোষ সরকারের। তাহলে ড. ইউনূস, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?
আপনি
কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ
দেবেন। সেখানে নিয়মনীতির প্রশংসা করতে করতে আপনি
মুখে ফেনা তুলবেন। কিন্তু
দেশে আপনি নিয়মনীতি মানবেন
না। হাসপাতালে সিটের জন্য তদবির করবেন।
চাকরি পেতে ঘুষের থলি
নিয়ে ঘুরবেন। সরকারি অফিসে গেলে প্রভাবশালী পরিচিতের
নাম ভাঙাবেন। এমনকি ব্যাংকেরও একটু পরিচিতি থাকলেই
লাইনে দাঁড়াবেন না। চলে যাবেন
ম্যানেজারের খাসকামরায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনি টেলিভিশন
ক্যামেরার সামনে কান্নাকাটি করবেন। কিন্তু দাম বেশি এজন্য
কোনো পণ্য কেনা বাদ
দেবেন না। আপনি চান
সবকিছু হোক আপনার মতো
করে। আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী। আপনি যা খুশি
করবেন, বাধা দিলেই দোষ
সরকারের।
কিন্তু
আরেকজন যা খুশি করলে
আপনি ক্ষেপে যাবেন। আপনি মনে করবেন,
সবকিছু ঠিকঠাক করার দায়িত্ব শুধুই
সরকারের। স্রেফ সরকারের। কিন্তু নাগরিক হিসেবে কি একবার ভাবেন,
আপনার কিছু দায়িত্ব আছে?
সরকারের সমালোচনার আগে আয়নায় নিজের
চেহারাটা কি একটু দেখবেন?
যে রেস্টুরেন্টে গেলেন, তা ঠিকঠাক কি
না, সেটা দেখার দায়িত্ব
কি আপনারও না। যে হাসপাতালে
যাচ্ছেন সেটা বৈধ কি
না, তা দেখা আপনার
নাগরিক দায়িত্ব। যানজটের সমালোচনা করার আগে আপনি
ট্রাফিক আইন মানছেন কি
না, সেটা নিশ্চিত করবেন
না? সব দোষ সরকারের
ঘাড়ে চড়ানোর আগে, আপনি নাগরিক
হিসেবে আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব
যথাযথভাবে পালন করলেন কি
না, তা একটু ভেবে
দেখবেন?
লেখক:
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে
জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে
দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির
স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি
অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই
মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা
ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী
লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে
বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার
মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী
লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে
না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে
প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে
সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।
আরও পড়ুন: আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার
কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার
সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ
করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া
অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা
কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি
নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের
সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি
একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত,
ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক
কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত।
ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি
অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম
হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয়
কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত
মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল।
কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর
বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়
কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে
আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর
সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান
ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও
আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন
নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা
হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে।
এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন
না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের
বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে
পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল।
যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক
দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই
অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি
২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ
ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির
কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা
তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের
শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান।
চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়,
তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি
নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল
দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই।
দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই।
সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ
হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির
চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান
একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই
কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র
ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে
বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।
শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৪ দল আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।