নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০৭ পিএম, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭
এ এইচ এম নূরুল ইসলাম। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৭ সালে জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে একটি সাক্ষাৎকার দেন নূরুল ইসলাম, যেখানে তাঁর কথায় উঠে আসে বেগম জিয়ার ছেলে ও স্বজনদের অসখ্য দুর্নীতির কথা। একই সঙ্গে জানা যায় এসব দুর্নীতির কথা জেনেও বেগম জিয়া নিশ্চুপ ছিলেন। নূরুল ইসলামের ওই সাক্ষাৎকার পরে ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’। এ এইচ এম নূরুল ইসলামের সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারের চুম্বক কিছু অংশ বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য দেওয়া হলো:
প্রশ্ন: টানা পাঁচ বছর আন্তর্জাতিক দুর্নীতির তালিকার শীর্ষে অবস্থান করেছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা এবং এর ঘনিষ্ঠ অনেক ব্যক্তি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। ওই বছরগুলোর মধ্যে তিন বছর আপনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করেছেন। আপনার মন্তব্য কী?
এ এইচ এম নূরুল ইসলাম: প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের জন্য এর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এরপরও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ছাড়া কোনো মন্ত্রীরা দুর্নীতি করতে পারে না। জোট সরকারের গত পাঁচ বছরে দুর্নীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়গুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করেছে। এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ যদি বিপদে পড়লে তাঁকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতো অপর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গম কেনা, বেসামরিক বিমান চলাচাল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যন্ত্রাংশ কেনা, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পিলার ও ট্রান্সফরমার কেনা এবং খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের গ্যাসক্ষেত্র বরাদ্দ। এই বিষয়গুলো দেশের গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। কিন্তু এখানে সরকারের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের সর্বস্তর থেকে বিষয়গুলো ঢাকবার চেষ্টার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে সরকার সংশ্লিষ্ট চার ধরনের মানুষ দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল। প্রথমত, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্মকর্তারা। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রীদের সন্তান ও স্বজনরা যারা অবৈধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন (সামাজিক চাপ)। তৃতীয়ত, সংসদ সদস্যরা (রাজনৈতিক চাপ)। চতুর্থত ও শেষ, পেশাদার লবিস্ট, সুবিধাভোগী এবং দালালরা (আর্থিক প্রভাব)।
চারটি শ্রেণির মধ্যে কারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ছিল?
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও স্বজনরা। বেগম জিয়ার (বড়) ছেলে তারেক রহমান প্রায়ই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আসতেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর একজন রাজনৈতিক সচিব তাঁর (তারেকের) এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করতেন। ক্যাবিনেট মিটিংয়ে বড় কোনো ক্রয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্তের আগে প্রধানমন্ত্রীর নিকট আত্মীয়দের আনাগোনা বাড়তো। বড় অংকের কেনাকাটায় তারা প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করতেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংরক্ষিত অংশেও তাঁদের যাতায়াত ছিল। বেগম জিয়ার সাবেক ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলাম ডিউক তাঁদের সহায়তা করতেন। সেও প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর কোন স্বজনের সবচেয়ে বেশি যাতায়াত ছিল?
একটি পরিত্যাক্ত গ্যাসক্ষেত্র কানাডার কোম্পানি নাইকোর কাছে বরাদ্দের আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাতায়াত বাড়ে তারেক রহমানের। এছাড়া পায়শই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আসতো বেগম জিয়ার ছোট ছেলে অরাফাত রহমান, বোনের ছেলে শাহরিন ইসলাম তুহিন, ভাই সৈয়দ ইস্কানদার ও দেবর এবং আরেক ভাই শামীম ইস্কানদার।
গত পাঁচ বছরের দুর্নীতি হাওয়া ভবনের নাম কখনো এসেছে?
পাঁচ বছরে অনেক দুর্নীতি ও অনিয়ম ঘটেছে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিবের মাধ্যমে, যাঁরা হাওয়া ভবনের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্কে রেখেছেন এবং সেখান থেকে সমর্থন ও সহায়তা পেয়েছেন।
ক্ষমতায় গিয়ে খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন হারিস চৌধুরী ও মোসাদ্দেক আলী ফালুকে। গত পাঁচ বছরের দুর্নীতিতে তাঁদের ভূমিকা কী?
প্রথম জন হাওয়া ভবনের স্বার্থ উদ্ধার করতো। বিভিন্ন খাতে লবিংয়ে যুক্ত ছিলেন তিনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এই লবিং হতো। আর বড় ছেলের ইচ্ছাপূরণ করতেন তিনি। দ্বিতীয় জন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তিন বছর কাজ করেছেন। তাঁর সম্পদ যেভাবে বেড়েছে তা বৈধভাবে তিনি আয় করতে সক্ষম নন। ধারণা করা হয়, তাঁর প্রদর্শিত সম্পদের চেয়ে অপ্রদর্শিত সম্পদের পরিমাণই বেশি। আর বিশেষ গোষ্ঠির মানুষের অবৈধ অর্থ রাখার ব্যবস্থা করেন তিনি। বিষয়গুলোর তদন্ত হলে অনেক কিছুই জানা যাবে।
জোট সরকারের বড় কোনো দুর্নীতির কথা মনে আছে?
২০০২-২০০৩ সালের গম কেলেঙ্কারি উল্লেখযোগ্য। ওই কেলেঙ্কারিতে সরকারের বড় অংকের ক্ষতি হয়। এ ঘটনায় খাদ্যমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান এবং বগুড়ার এমপি হেলালুজ্জামানের নাম আসে। তারেক জিয়ার অন্যতম সহযোগী হেলালুজ্জামান। তারেক বগুড়ায় গেলেই সবসময় পাশে থাকতেন হেলাল। গণমাধ্যমে আলোচিত হওয়ায় ওই ঘটনায় কয়েক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও রাজনীতিবিদরা থেকে যান বহাল তবিয়তে। হাওয়া ভবনের প্রভাবেই বেঁচে যান রাজনীতিবিদরা। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে পরিষ্কার ভাবে প্রমাণিত।
দুর্নীতির অভিযোগ এলে প্রধানমন্ত্রী কী চাপ প্রয়োগ করতেন?
হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতা থাকলে, দুর্নীতি প্রমাণিত হলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকতেন প্রধানমন্ত্রী। আর কোনো মন্ত্রী দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হলে অন্যান্যরা তাঁর সমর্থনে এগিয়ে অসতো।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে দুর্নীতি?
আমাদের সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল চুক্তভিত্তিক নিয়োগ ও বদলি নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কোনো নিয়ম মানা হয়নি। সরকার সবসময় চিন্তা করেছে কাকে নিয়োগ দেওয়া হলে দুর্নীতি ও অনিয়মে সর্বোচ্চ সহায়তা পাওয়া যাবে। আইন ও নিয়মের বাইরে গিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী যোগ্যাতা নেই এমন অন্তত ২০০ কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সুশাসনের স্বার্থে বিষয়গুলোর তদন্ত হওয়া উচিত।
সরকারি সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে বিক্রির অভিযোগও গণমাধ্যমে এসেছে?
সরকারের দুর্নীতির আরেকটি খাত ছিল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ এবং সরকারি বাড়ি, জমি ও সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে বিক্রি। একটি ঘটনা আমি মনে করতে পারি। লিরা ইন্ডাস্ট্রিজ ইন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান পিভিসি পাইপ তেরি করতো। টঙ্গিতে ১০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল। তবে মাত্র দুই কোটি ৮০ লাখ টাকায় ওই জমি প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিক্রি করা হয়। ওই সময় টঙ্গিতে বিঘাপ্রতি জমির দাম ছিল নূন্যতম এক কোটি। এই হিসেবে ওই জমির দাম হয় ১৮ কোটি। কিন্তু ১০ বিঘা জমি সহ, প্রতিষ্ঠানের সবকিছু বিক্রি করা হয় মাত্র দুই কোটি ৮০ লাখ টাকায়। কে এস আলমগীর নামে এক ব্যক্তি এটি কেনেন। হারিস চৌধুরী নিজে চুক্তি সম্পন্ন করতে উঠে পড়ে লাগেন। অনেক সরকারি সম্পত্তি বিক্রিতে তাঁকে বেশ দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়।
নামমাত্র মূল্যে সরকারি সম্পদ বিক্রির আরেকটি ক্ষেত্র ছিল গুলশানের পরিত্যক্ত বাড়ি। সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে। অধিকাংশ বাড়িই কেনে জোট সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি বাড়ির জন্য দুই থেকে তিনটি আবেদন পড়তো। এ বিষয়ে তদন্ত করলেই সবকিছু বেরিয়ে আসবে।
অনিয়মের মাধ্যেমে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হতো। এ বিষয়ে কোনো উদাহরণ?
গ্লোবার অ্যাগ্রো ট্রেড প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) দায়িত্বে ছিল সাত বছর। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষের দরপত্র অনুযায়ী কাজটি দেওয়া হয় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য। আর ওই প্রতিষ্ঠানেরও এমন কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার মনে আছে ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য লবি করতে আরাফাত রহমান কয়েকবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসেছিল। একবার বাদ দিয়েও পরে আবার প্রতিষ্ঠানটি কাজ দেওয়া হয়।
ছেলেদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কেমন হতো?
২০০৩ সালের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছেলে আরাফাত রহমান হংকংয়ে যান। তাঁর সঙ্গে ছিল ছয়-সাতজন বন্ধু। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরাফাত রহমান কোনোর বিষয়ে হংকংয়ে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল একেএম আতিকুর রহমানকে অবহিত করে। কিন্তু তাঁর বন্ধুদের ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। রাষ্ট্রদূত তাই আরাফাতের বন্ধুদের ব্যাপারে জানতেন না। হংকংয়ের ইমিগ্রেশন আরাফাত রহমানকে দ্রুত ভিসা দিলেও তাঁর বন্ধুদের ভিসা আটকে যায়। আরাফত রেগে মেগে তাঁর মাকে ফোন করে। বেগম জিয়া আতিকুর রহমানকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেন। তবে এরই মধ্যে ২৫ বছর সরকারি চাকরি করায় তাঁকে বরখাস্ত করা যাবে না বলে জানায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পরে আরাফাত রহমানকে বলে কয়ে কর্মকর্তারা আতিকুর রহমানকে হংকংয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তবে পরে আবার কোনো কারণ ছাড়াই আতিকুর রহমানের পদোন্নতি আটকে দেন বেগম জিয়া।
কোনো বিশেষ ঘটনার কথা কি মনে আছে?
সরকারের ক্রয় কমিটির মাধ্যমে টেলিটকের যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তাব দুবার প্রত্যাখ্যান হলে প্রধানমন্ত্রী অস্থির হয়ে পড়েন। তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে ছিলেন তাঁর এক ছেলে। তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দিতে গেলে বিষয়টি আদালতে নিয়ে যায় সর্বনিম্ন দরদাতা। আদালত বিষয়টি সমাধানে পদক্ষেপ নেয়। আর বরাদ্দকৃত বাজেটের চেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতার দেওয়া মূল্য ছিল বেশি। তাই বাজেটও বাড়ানো হয়। দুবার পত্যাখ্যানের পর তৃতীয়বার বিষয়টি ক্রয় কমিটির বৈঠকে ওঠে। তবে পরে আইনি জটিলতার আশঙ্কায় ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দুজন জ্বালানি মন্ত্রী এ কে এম মোশারফ হোসেন এবং অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান।
বৈঠকের সংক্ষিপ্ত বিবরণ যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে, আমি একটি নোট সংযুক্ত করি। সেখানে আমি লিখেছিলাম, দুর্নীতি দমন কমিশন এরই মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগে মামলা করেছে। নোটটি দেখেই আমার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কে মামলা করবে?’ প্রধানমন্ত্রী হারিস চৌধুরীকে বলেন, নোটটি সরিয়ে নিতে। এখনো আমি ওই নোটটি পাইনি।
বাংলা ইনসাইডার/জেডএ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে। রাজনৈতিকভাবে যারা নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছিল, নির্বাচন প্রতিহত করতে বলেছিল তারা ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনের পর তারা সঙ্কুচিত, কোণঠাসা এবং হতাশাগ্রস্ত। আওয়ামী লীগের সামনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই বললেই চলে। না সংসদে, না রাজপথে।
বিএনপি এখন হতাশাগ্রস্ত একটি রাজনৈতিক দল। তাদের ভিতর অবিশ্বাস-কোন্দল প্রচণ্ড আকার ধারণ করেছে। যার ফলে দলটি এখন নতুন আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় নেই। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অস্তিত্বের সংকটে আছে। তাদের কর্মী সমর্থক নেই। কাজেই রাজনীতিতে তারা সরকারের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রভাব বিস্তারের সুযোগই পাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচনের আগে মনে করা হয়েছিল সরকার বড় ধরনের সংকটে পড়বে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচনের আগে যেভাবে সরকারকে সতর্ক করেছিল, হুঁশিয়ারি দিয়েছিল; অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে নিষেধাজ্ঞার মত ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছিল- নির্বাচনের পর সেই অবস্থা পাল্টে গেছে।
বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলা সত্ত্বেও নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্যই বেশি চেষ্টা করছে। অন্যান্য দেশগুলো যেমন- ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য; তারাও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এখন গুরুত্ব দিচ্ছে। বর্তমানে নির্বাচনের বিষয় তারা তেমন সামনে আনতে রাজি নন। এরকম একটি পরিস্থিতিতে সরকারের জন্য একটি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকার কথা।
কিন্তু বাস্তবতা হল সরকার স্বস্তিতে নেই। বরং আস্তে আস্তে সরকারের উপর চাপ বাড়ছে। আর সরকারের এই চাপের প্রধান কারণ হল অর্থনীতি। বিগত মেয়াদেই অর্থনীতিতে বিবর্ণ চেহারাটা সামনে উঠেছিল। এটি আস্তে আস্তে ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে এবং সরকারের জন্য অর্থনৈতিক সংকটগুলো মোকাবেলা করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ছে বলেই অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার জন্য সরকার বেশ কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করছে। কিন্তু সেই উদ্যোগগুলো নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যেমন অর্থনৈতিক সংকটের একটি প্রধান বিষয় হল মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলেছে, মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য সরকার যত ব্যবস্থাই নেক, সেই ব্যবস্থাগুলো এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত হয়নি।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-বিশৃঙ্খলতা। আর এটি দূর করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কয়েকটি ব্যাংক একীভূত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কৌশল এখন ব্যাপক সমালোচিত হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকিং সেক্টরে বিশৃঙ্খল অবস্থারও একটা উন্নতি হয়নি।
ব্যাংকিং সেক্টরের বিশৃঙ্খলার হওয়ার প্রধান কারণ হল খেলাপি ঋণ এবং অর্থপাচার। ঋণ খেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে কঠোর অবস্থান গ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে বটে। কিন্তু বাস্তবে এই পরিকল্পনাগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হবে সে নিয়েও বিভিন্ন মহলের সন্দেহ রয়েছে। কারণ অতীতেও দেখা যে, ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর হতে পারছে না।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্কট বাড়ছে, বিশেষ করে এখন বাংলাদেশকে ঋণের দায় মেটাতে হচ্ছে। ঋণের দায় মেটানোর চাপ সামলাতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় টান পড়ছে। আর বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান যে উৎস প্রবাসী আয় এবং রপ্তানী আয়- সে দুটোতেও কোনওরকম ইতিবাচক ব্যবস্থা নেই। সামনে বাজেট, আর এই বাজেটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের একটি মহাপরিকল্পনা সরকারকে করতেই হবে। অর্থনৈতিক সংকট যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তাহলে সরকারের জন্য সামনের দিনগুলো আরও কঠিন, চ্যালেঞ্জিং এবং সংকটাপন্ন হবে বলেই মনে করে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অর্থনীতি হাসান মাহমুদ আলী আয়শা খান আওয়ামী লীগ সরকার
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে। রাজনৈতিকভাবে যারা নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছিল, নির্বাচন প্রতিহত করতে বলেছিল তারা ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনের পর তারা সঙ্কুচিত, কোণঠাসা এবং হতাশাগ্রস্ত। আওয়ামী লীগের সামনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই বললেই চলে। না সংসদে, না রাজপথে।