বিশ্বায়নের এ যুগে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এক দেশ থেকে আরেক দেশে নানা প্রয়োজনে ছুঁটছে মানুষ। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের অনেক তরুণ তরুণী উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কেউ কেউ শিক্ষা জীবন শেষে দেশে ফিরলেও খাপ খাওয়াতে না পেরে ভুগছে হতাশায়। অনেকেই আবার উচ্চশিক্ষা থেকে থেকে যাচ্ছে বিদেশে। ফলে একদিকে যেমন মেধাবী শিক্ষার্থীদের হারাচ্ছি আমরা, অন্যদিকে তারাও দেশকে দিতে পারছেন না শিক্ষার ফসল।
উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান আলভিন আলী শাহীন। ক্যালিফোর্নিয়ার ইউনিভার্সিটি লা ভার্ন থেকে ম্যানেজমেন্ট এবং ফিন্যান্সে ব্যাচেলর ডিগ্রি চলাকালীন সময়েই তার ভাবনায় আসে দেশে ফিরে নিজে একজন খামারি হবেন। স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় গিয়ে অনেকেই নিজের শেকড় ও দেশকে ভুলে গিয়ে সেখানে থিতু হবার পরিকল্পনা করলেও নিজের লালন করা স্বপ্ন পূরণে অবিচল ছিলেন শাহীন। স্নাতক শেষ করে দেশে ফিরে এখন পুরোদস্তুর একজন সফল খামারি হয়ে উঠেছেন আলভিন আলী শাহীন। নিজের জ্ঞান ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন “মেঘডুবি” নামের একটি স্মার্ট ও আধুনিক গরুর খামার।
বাংলা ইনসাইডারের সাথে আলাপকালে শাহীন বলেন, আমি দেশের বাইরে থাকতেই দেখেছি এই খাতে অনেক কিছু করার আছে। আলাদা একটা সম্ভাবনায়ময় খাত বলতে পারেন এটিকে। আমাদের দেশে একটা সময় ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ীদের মানুষ কাপড়ওয়ালা বলে ডাকত। কিন্তু আপনি দেখেন এই ইন্ডাস্ট্রিটি আজ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ আমাদের দেশের অর্থনীতিকে পাল্টে দিয়েছে। ভবিষ্যতে প্রাণিসম্পদ খাত সেখানে দাঁড়াবে বলে আমার কাছে মনে হয়। দেশে এসে আমার বন্ধুরা আমাকে খামারি বলে ডাকে। কিন্তু আমি এটা বেশ উপভোগ করি।
আলভিন আলী শাহীন, পরিচালক, মেঘডুবি এগ্রো
আলভিন আলী শাহীন আরও জানান যে, আসন্ন কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে প্রতিবছরের মতো এবারও আমাদের খামারে প্রায় ১১০০ পশু প্রস্তুত রয়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। প্রতিবছর রোজার পরপরই আমাদের কোরবানির গরু বিক্রি শুরু হয়ে যায়। পাশাপাশি অনলাইনেও আমরা গরু বিক্রির ব্যবস্থা করি। কোরবানির সময়ে অনলাইনে ৬০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার এই মূল্যের গরুর চাহিদা বেশি থাকে। আমরা আমাদের খামারে সর্বনিম্ন ৬০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ পর্যন্ত দামের গরু বিক্রি করে থাকি।
বিদেশে ডিগ্রি নিয়ে দেশে এসে কেন খামারি হলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে আলভিন আলী শাহীন বলেন, আমাদের দেশে এখনও অনেক খামারি আছেন যারা এই খাতে লাভ-লোকসান না বুঝে ব্যবসা করতে আসেন। অথচ এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত। আমাদের মতো শিক্ষিত মানুষেরা যদি কাজ এই খাত নিয়ে কাজ না করি তাহলে তো দেশ উপকৃত হবে না। আমি দেশের বাইরে পড়াশুনা করেছি বটে কিন্তু আমার কাছে দেশের চাওয়া আছে। দেশের প্রতি আমার একটা দায়িত্বরোধ আছে। আমি উচ্চ শিক্ষিত হয়েছি এবং এর ফল শুধু আমার পরিবার ভোগ করবে সেটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। দেশেরও প্রত্যাশা আছে আমার কাছে। সেজন্য আমি বিদেশে থাকিনি। দেশে এসেছি।
শাহীনের মতো আরও অনেক তরুণের হাত ধরেই প্রাণিসম্পদ খাত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কুটির শিল্পের মতো গড়ে ওঠা এই খাতটি এখন শিল্পে রুপ নিয়েছে। ভারত ও মিয়ানমার নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাত। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ এখন গরু পালন করছে। কোরবানিতে পশু বিক্রয়ের মাধ্যমে বছরের বৃহৎ অংশ জুড়ে পরিবারিক অর্থনীতি সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে গরু ও ছাগল উৎপাদনে। দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান হচ্ছে গ্রামীণ জনপদের হাজার হাজার নারী পুরুষের। কয়েক বছর আগেও কোরবানিতে পশুর চাহিদার বড় অংশ মিটতো প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত এবং মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি করে। বর্তমানে সে চিত্র আর নেই।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, দেশে এবার প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭ টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩ লাখ ৬০ হাজার ৭১৬টি গরু ও মহিষ, ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ৮০১টি ছাগল-ভেড়া, এক হাজার ৮৫০টি অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী প্রস্তুত আছে। দেশের চাহিদা কোটি ৭ লাখ দুই হাজার ৩৯৪টি। অর্থাৎ কোনরকম সংশয়, সংকট বা আশঙ্কায় থাকতে হয় না দেশের মানুষদের। অথচ কয়েক বছর আগেও চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু বর্তমান সরকারের সাহসী ও যুগোপযোগী নানা পদক্ষেপের কারণে গবাদি পশু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। উল্লেখ্য যে, গরু-মোটাতাজাকরণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে আড়াই শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয় খামারিদের। ওই সুবিধা পেয়ে সারাদেশে অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ গরুর খামার গড়ে তুলতে শুরু করেন, যার সুফল পাচ্ছে দেশ।
সম্প্রতি রাজধানীর ফার্মগেটে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ ও পরিবহন নিশ্চিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান জানান, এবার কোনবানির জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। খামারিদের নানা ধরনের পরামর্শ ও কোরবানির পশুর স্বাস্থ্যগত সেবা দেওয়া হয়। মাঠ পর্যায়ে মনিটরিংয়ের জন্যও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা নেমে পড়েছেন। কেউ যাতে কোরবানির পশু মোটাতাজাকরণে ওষুধ ব্যবহার না করেন, সে বিষয়েও পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
গবাদি পশু উৎপাদনে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বেসরকারি খাতকে সাথে নিয়ে একযোগে প্রাণিসম্পদের বিকাশ। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে ক্ষুদ্র খামারিদের নিয়ে প্রডিউসার গ্রুপ গঠন, তাদের কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন সহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে একটি সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠেছে প্রাণিসম্পদ খাত। এ খাতে সম্ভাবনা থাকায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসায় নামছেন নতুন নতুন খামারি। এক দশকে ১৪২ শতাংশের বেশি গবাদিপশুর উৎপাদন বেড়েছে। অনেকে গৃহস্থ থেকে এখন পুরোপুরি খামারিতে পরিণত হয়েছেন। যুক্ত হচ্ছেন উচ্চ শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি সারাদেশে গরু-ছাগলের চাষ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে ব্যাপক সাড়া পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে যেসব এনজিও কাজ করছে, তাদের অধিকাংশ এখন ঋণ দিচ্ছে গরু পালনে। এ খাতে বিনিয়োগ করছে ব্যাংকগুলোও। এতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গরু ও ছাগল পালন বৃদ্ধির পাশাপাশি চামড়াশিল্পেও রপ্তারি আয় বাড়ছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ইমরান হোসেন বলেন, দেশি গরুর চাহিদা বাড়ায় শিক্ষিত তরুণ ও প্রবাসীরা গবাদিপশুর খামারে বিনিয়োগ করছেন। গরু আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে এ খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। কোরবানির হাটে ক্রেতারা দেশি গরু খোঁজেন হন্য হয়ে। তারা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মোটা করা বিদেশি গরু কিনতে চান না। তাই বর্তমানে দেশী গরুর চাহিদা বাড়ায় স্বস্তিতে আছেন আমাদের দেশী গরুর খামারিরা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোঃ আব্দুর রহমান।
প্রাণিসম্পদ খাতে শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারের পরিকল্পনার বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোঃ আব্দুর রহমান বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, যারা একদম ছোট পর্যায়ে শুরু করার চিন্তা ভাবনা করে আমরা তাদেরকে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার একটা পরিকল্পিত প্রস্তাব চিন্তা ভাবনা করছি। এটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলার বিষয়টি নিয়ে প্রস্তুতি চলছে। ধরুন, একজন মানুষের দুটি গাভীর দাম ৫ লাখ টাকা। সেক্ষেত্রে যদি তার নিজস্ব একটা পুঁজি থাকে এবং বাড়তি পুঁজি যদি লোনভিত্তিক হয় তাহলে তার একটা মনস্ততাত্ত্বিক সাহস বা আগ্রহ সেটা বাড়বে। এছাড়া আমাদের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। যেটা বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলছে। সেক্ষেত্রে যারা নিজেরা খামার করতে চায় তাদের জন্য ৬০:৪০ এই অনুপাতে একটা সহযোগিতা আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সেটা অনুদান হিসেবেও দেওয়া হয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এটা লোন আকারে দেওয়া হয়। সুতরাং যারা এই ব্যাপারে উৎসাহী হবে এবং আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসবে তাদের জন্য এই সুযোগগুলো আছে।
মন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে নানা উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আছে এবং একদমেই যাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উপার্জন করার বিকল্প কোন ব্যবস্থা নাই সেক্ষেত্রে আমরা একটা সাহায্য তাদের দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে কিছু ছাগল বা বকনা বাছুর আমরা দিয়ে থাকি।
সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তরুণরা দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে আজ সম্ভাবনা ছড়াচ্ছে। শাহীনদের মতো উচ্চশিক্ষিত তরুণরা একদিকে যেমন উন্নত ও নতুন নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে গড়ে তুলছে স্মার্ট ও আধুনিক খামার, তেমনি অনেক বেকার যুবক দরকারি প্রশিক্ষণ, জ্ঞান এবং প্রয়োজনীয় ঋণ নিয়ে নিজেরাই শুরু করছে আধুনিক ও স্মার্ট খামার। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই খাত, স্মার্ট লাইভস্টোকের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।