ভাষা আন্দোলেন শেখ মুজিবের অবদান নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের মন্তব্য করেছেন। কেউ প্রতিহিংসাবশত তার অবদানকে ছোট করে দেখানোর প্রয়াস দেখিয়েছেন। আবার কেউ স্তুতি গাইতে গিয়ে অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত করে ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছেন। আবার কেউ সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মী বা সহযোদ্ধা হয়েও ভিন্ন মতাদর্শের কারণে বা নিজের অবদানকে বড় করে দেখাতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে অবমূল্যায়ন করেছেন।
বাংলা ইনসাইডারে গত সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা- ইতিহাস বিকৃতি এবং ঐতিহাসিক সত্য’- শীর্ষক একটি নিবন্ধে বলেছিলাম বাংলার ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা- ইতিহাস বিকৃতি এবং ঐতিহাসিক সত্য নিয়ে কিছু পড়াশেনা এবং গবেষণার আলোকে বিচার বিশ্লেষণ।
আজকের এই নিবন্ধে এই ধরনের ইতিহাস বিকৃতির আরও কিছু নিদর্শন তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস ব্যক্ত করতেই লেখনীর ধারা প্রসারিত করছি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আজও তুলে ধরতে এবং বিশ্লেষন করতে চাইছি ‘রাষ্ট্রভাষা- বাংলা চাই’ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খণ্ডিত ও বিকৃত করতে যাঁরা লেখনী ধারণ করেছেন তাদের কিছু উদ্ধৃতি এবং এর আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ। ওই নিবন্ধে জানিয়েছিলাম, বাংলা ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে যারা বিকৃতভাবে উপস্থান করতে লেখনী তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক, বদরুদ্দীন উমর প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন: ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা- ইতিহাস বিকৃতি এবং ঐতিহাসিক সত্য
মোহাম্মদ তোয়াহা এবং বদরুদ্দীন উমর ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, একইভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদান-প্রসঙ্গে যুক্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আহমদ রফিক এবং মোহাম্মদ সুলতানও ঢালাওভাবে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে তাঁর যুক্ত থাকা এবং কারাগার থেকে ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টিকে ইতিহাসের ‘কল্পকাহিনী’, ‘ইতিহাস বিকৃত করার অনাচারী প্রবণতা’, ‘মনগড়া বক্তব্য’ প্রভৃতি বলে অভিহিত করেছেন আহমদ রফিক এবং মোহাম্দ সুলতান।
অলি আহাদ তাঁর ‘জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে ৭৫’- গ্রন্থে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিজের সাক্ষাৎ করা প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেও, সার্বিকভাবে বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি কারামুক্তি পেলেন। কিন্তু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ঢাকায় এলেন না নেতৃত্ব দিতে। বিদ্রোহের অনলে ঝাপও দিলেন না। এমন কি খুনী শাসক নূরুল আমীনের বিরুদ্ধে ৫ই মার্চ দেশব্যাপী যে হরতালের ডাক দেওয়া হয় শেখ মুজিব তাতে অংশগ্রহণ করে মারমুখো জনতাকে নেতৃত্ব দিতে ঢাকায় আসেন নাই। তারপরও মুখপোড়া আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় দালাল চামচারা বলে ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবর নাকি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ধিক তাদেরকে।’ (সূত্র: জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, পৃ. ১৪৭)
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেনে আবদুল মতিন, আহমদ রফিক এবং বদরুদ্দীন উমর। আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক ‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য’- গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ের ‘ইতিহাস নিয়ে কল্পকাহিনী’ অংশে লিখেছেন, ‘বলা বাহুল্য তাদের মুক্তির জন্য রাজনৈতিক চাপ, ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা এবং সর্বোপরি তাদের অনশন ধর্মঘটের কারণে সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন আহমদকে ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। আন্দোলন তখনও চলছে। কিন্তু সদ্যমুক্ত শেখ মুজিব সাহেব তখন ঢাকায় এসে আন্দোলনে যোগ না দিয়ে সম্ভবত স্বাস্থ্যগত কারণে তার গ্রামের বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।’ (সূত্র: দৈনিক আজাদ, ৮ ফেব্রুয়ারি-১৯৫২)
‘ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য’-গ্রন্থে আবদুল মতিন ও আহমদ রফিকের ভাষ্যমতে, ‘শুধু তাই নয়, দুই মাস পর নতুন করে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ সাহেবের বক্তব্য থেকেও এই ঘটনা সঠিক মনে হয়। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত।’ এমনি একাধিক তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, একুশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অথচ দীর্ঘকাল পর বৃথাই একুশের আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে ‘মিথ’ তৈরির চেষ্টা চলছে, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে, সে চেষ্টা এখনো চলছে এবং এজন্য দায়ী কয়েকজন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’ (সূত্র: ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য, সাহিত্য প্রকাশ, তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৫; পৃ. ৮৫-৮৬)
বদরুদ্দীন উমর ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তৃতীয় খণ্ড)- গ্রন্থে ১৯৫২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে শেখ মুজিবের একটি চিঠি আসার কথা উল্লেখ করলেও পরবর্তীকালে দেশ পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদান অস্বীকার করে বলেছেন, ‘শেখ মুজিব ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, যে সময়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকারীদেরকে বিপুল সংখ্যায় গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অনেক সদস্য আত্মগোপন করে আছেন। এই পরিস্থিতিতে জেল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি লাভ থেকেই প্রমাণিত হয় যে তৎকালীন ভাষা আন্দোলনে তারও কোন ভূমিকা ছিল না এবং আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেওয়াটা সরকার নিজেদের জন্য অসুবিধাজনক বা বিপজ্জনক কিছুই মনে করেনি।’ (সূত্র: দেশ, কলকাতা : ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)।
অলি আহাদ, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক ও বদরুদ্দীন উমরের উপর্যুক্ত বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাতে তথ্যবিভ্রাট যেমন আছে তেমনি আছে খণ্ডিত তথ্য। তাঁরা ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকারে যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে, - ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারামুক্ত হয়ে ঢাকায় এসে ভাষা-আন্দোলনে যুক্ত হননি। তাঁদের দাবি ভাষা-আন্দোলন ‘তখনও চলছে’, তাই ওই সময় তাঁর মুক্তি পাওয়াটা প্রমাণ করে আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। তাঁরা আরও বলেছেন, কারাগার থেকে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির তুঙ্গ মুহূর্তের আন্দোলন বিষয়ে তার নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টি যথার্থ নয়।
এছাড়া কারাগার থেকে মুক্তির ২ মাস পর ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’র সভায় শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তব্য দেন, তার ফলে তাঁরা ৫২’র ভাষা-আন্দোলনে তাঁর যুক্ত না থাকার ঘটনা সঠিক বলে মনে করেছেন।
তাঁদের এ জাতীয় বক্তব্য খণ্ডন করার পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। ১৯৫২ সালের পুরো ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে তাঁদের এসব বক্তব্য অযৌক্তিক, খণ্ডিত, একপেশে, স্ববিরোধিতাপূর্ণ এবং ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস বলেই মনে হয়। তাঁদের বক্তব্য ও যুক্তি কতটা ভিত্তিহীন তা এখানে তথ্য-প্রমাণসহ তুলে ধরা হচ্ছে।
প্রথমত, অলি আহাদ, আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এ তথ্য সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তির আদেশ পান ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে আর মুক্তি লাভ করেন ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।
১৯৫২ সালে কারাবন্দি অনশনরত শেখ মুজিব।
দ্বিতীয়ত, তাঁরা বলেছেন, মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিব কেন ঢাকায় এসে ভাষা-আন্দোলনে যোগ দিলেন না। কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তো ভাষা-আন্দোলনের কর্মসূচি চলমানই ছিল না (যদিও আহমদ রফিক ও আবদুল মতিন বলেছেন, ‘আন্দোলন তখনও চলছে’)। ওই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রেপ্তার হন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, খয়রাত হোসেন, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, মনোরঞ্জন ধর এবং গোবিন্দলাল ব্যানার্জী। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, ড. পিসি চক্রবর্তী এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে। ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সভায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ইং তারিখ থেকে সাধারণ ধর্মঘট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরের সর্বত্র স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়।
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে এ বিবরণ উল্লেখ আছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে তিনি লিখেছেন, ‘সেন্ট্রাল কমিটি অব অ্যাকশন ও সিভিল লিবার্টিস কো-অর্ডিনেটিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ থেকে শহরের সর্বত্র স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলো। লাগাতার ৫দিন ধর্মঘট চলার পর রিকশাওয়ালাদের মতো দরিদ্র জনগণ তাদের বিরাম দেওয়ার জন্য আমাদের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করল।’ (তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫২, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ৫৪)।
ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ হলের হাউস-টিউটর ড. মফিজউদ্দিন আহমদসহ ৩০ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে এবং মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণের শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি এক গেজেট প্রকাশ করে কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, সৈয়দ এম নূরুল আলম, আজিজ আহমদ, আবদুল আওয়াল ও মোহাম্মদ তোয়াহাকে এক মাসের মধ্যে নিজ স্ব-স্ব জেলা প্রশাসকের কাছে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এমন পরিস্থিতিতে এ সময় ভাষা-আন্দোলনের নতুন কোনো কর্মসূচি ছিল না, নেতাদের প্রায় সবাই গা’ঢাকা দিয়েছেন, কাউকেই ঐ সময় রাজপথে দেখা যায়নি। শেখ মুজিবের মুক্তির সপ্তাহ খানেক পর, অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ৭ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য গোপীনগরের এক বাড়িতে গোপন বৈঠক করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন।
তৃতীয়ত, তাঁরা বলেছেন, যখন সকলকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তখন শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া প্রমাণ করে ভাষা আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল না। তাঁরা এ-ও বলতে চেয়েছেন যে, শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া আন্দোলনের জন্য বিপজ্জনক মনে করেনি সরকার। কিন্তু একটু তথ্য-প্রমাণ হাজির করলেই দেখা যায়, তাঁদের এ বক্তব্য যুক্তিহীন, স্ববিরোধিতাপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর। আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক নিজেরাই শেখ মুজিবের মুক্তির পেছনে ‘রাজনৈতিক চাপ’, ‘ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা’ এবং ‘সর্বোপরি তাদের অনশন ধর্মঘটের’ কথা উল্লেখ করেছেন। বাস্তবেই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশেই আন্দোলন হয়েছে। তাছাড়া টানা এক সপ্তাহের বেশি অনশনে তাঁর শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয় পড়ে। ফলে বাধ্য হয়েই সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমেদকে মুক্তি দেয়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পূর্ব থেকেই অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে। তাছাড়া সরকার শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলেও তাঁর ওপর ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পুলিশি নজরদারি। অবস্থা এমন ছিল যে, কারাগার থেকে মুক্ত হলেও প্রকারান্তরে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গৃহবন্দি। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনসূত্রে এ তথ্য জানা যায়। ১৯৫২ সালের ১ মার্চ পূর্ববঙ্গ পুলিশের আইজি এ কে এম হাফিজুদ্দীন এক টেলিগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানকে কঠোর নজরদারিতে রাখার জন্য ফরিদপুরের পুলিশকে যে নির্দেশ দেন, তা হচ্ছে- ‘Please keep continuous on Sk. Mujibur Rahman and if he indulges again in prejudicial activities he should be arrested.’
তাছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফেরেন তখনও তাঁর উপর কঠোর পুলিশী এবং গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হয়। ১৮ এপ্রিল, ১৯৫২ তারিখের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, - ‘It appears from a report of D. I. O. (Gopalganj) that Sk. Mujibar Rahman (AML-Ex-Security Prisoner) S/O Lutfar Rahman of Tungipara, Gopalganj, faridpur was to start for Dacca on 16.4.52. Arrangements were however made to shadow him up to dacca.’
ফলে বদরুদ্দীন উমর, অলি আহাদ এবং মোহাম্মদ তোয়াহাসহ অন্যরা শেখ মুজিবের মুক্তিদান প্রসঙ্গে তাঁর ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ততা না থাকা বিষয়ে যে কল্পকাহিনি ফেঁদেছেন, তা যুক্তিযুক্ত নয়। কাজেই ঐ সময় শেখ মুজিবের মুক্তিদান-প্রসঙ্গ তুলে তাঁরা তাঁর ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করার যে চেষ্ট করেছেন, তা যুক্তসঙ্গতভাবে এবং তথ্য-প্রমাণে টেকে না।
চতুর্থত, তাঁরা বলার চেষ্টা করেছেন, ফরিদপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় এবং কারামুক্ত হয়ে শেখ মুজিব ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে নীরব ছিলেন। তাঁদের এ ধরনের ভাবনাও যথার্থ নয়। কারণ সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, শেখ মুজিবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা ‘কাল নিরবধি’ থেকে জানা যায়, ঢাকায় গুলিচালনা ও ধরপাকড়ের সংবাদ শুনে শেখ মুজিবুর রহমান অতিশয় মর্মাহত হন, তাঁদের অনশনের দাবির সঙ্গে একুশের গুলিচালনার ঘটনার প্রতিবাদ যুক্ত করেন এবং মুক্ত হয়ে শহিদদের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। একুশের গুলিচালনার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে তিনি দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ১৯৫২ সালের ৫ই মার্চ এবং ৩১ মার্চ ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
বাস্তবেই কিছুটা সুস্থ হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন সভা-সমাবেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন ও কারাবন্দিদের মুক্তির দাবি করেন। তিনি করাচী গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিবৃতি প্রদান করান। সেখানে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করেন।
পঞ্চমত, আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সম্মেলনে শেখ মুজিব প্রদত্ত বক্তব্য খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করে লিখেছেন , ‘দুই মাস পর নতুন করে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ সাহেবের বক্তৃতা থেকেও এই ঘটনা (ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ততা না থাকা) সঠিক বলে মনে হয়।’ তাঁরা শেখ মুজিবের ভাষণের যে অংশটুকু দৈনিক আজাদ পত্রিকার সংবাদ থেকে তুলে ধরেছেন, তা হচ্ছে,- ‘দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত।’ বস্তুতপক্ষে, শেখ মুজিব ওই সম্মেলনে এর বাইরে আরও অনেক কথা বলেছিলেন, যা ইত্তেফাক, আজাদ, সৈনিকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি ভাষা-আন্দোলনকে জনগণের ন্যায্য দাবি বলে অভিহিত করেন।
আজাদ পত্রিকায় তাঁর বক্তৃতার বাকী অংশে যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে,- ‘আপনারা সংঘবদ্ধ হোন, মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রাহে মওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাশেম ও অন্যান্য কর্মীরা আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না, বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই; ভাষা চাই’। এ সময় তিনি রাষ্ট্রভাষার উপর গণভোট দাবি করে বলেন, ‘মুসলিম লীগ সরকার আর মর্নিং নিউজ গোষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।’ এদিনের বক্তৃতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে বিবৃতি প্রদানের বিষয়টিকে তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। কাজেই, ‘আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত’,- এ উক্তি থেকেই বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদান খারিজ করে দেওয়া যায় না।
ইতিহাসের সত্য হলো, শেখ মুজিবুর রহমান ৫২’র ভাষা-আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলেও কারাগারে বসে ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে এ আন্দোলনকে সফল করে তুলেছেন, যা ছাত্রনেতাদের বক্তব্য ও আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি থেকে প্রমাণ করা যায়। তিনি সরকারের জন্য কতটা আতঙ্কের ছিলেন, তা তাঁর উপর পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কঠোর নজরদারি থেকেই উপলব্ধি করা যায়।
ষষ্ঠত, জেলখানা থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চিরকুট পাঠিয়ে নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টিকে বদরুদ্দীন উমর প্রথম দিকে পরোক্ষভাবে মেনে নিলেও, পরবর্তীকালে বিভিন্ন লেখায় তা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘যিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পায়খানার গবাক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলন পরিচালনা করছিলেন তাঁকে কীভাবে সেই সংকটজনক সময়ে সরকার মুক্তি প্রদান করলো? এই রাজনৈতিক মারফতী বা অধ্যাত্মবাদের মহিমা বোঝা আমাদের মতো ক্ষুদ্র বুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের কর্ম নয়।’ (সূত্র: দেশ, কলকাতা : ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)।
বদরুদ্দীন উমরের এ মন্তব্য শিশুসুলভ আচরণ ছাড়া আর কিছু নয়। যেখানে ভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃবৃন্দ, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ বলেছেন ভাষা-আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদসহ অনেক ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সাক্ষাৎ করেছেন এবং আন্দোলনে নির্দেশনা দিয়েছেন; সেখানে বদরুদ্দীন উমর স্বভাবসুলভ ভাষায় যে উক্তি করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়।
বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে জেলখানা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের প্রত্যেকটি মত বিভিন্ন যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘উমরকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। বায়ান্ন সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারেকাছেও তিনি ছিলেন না। একটি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলে পদে পদে যে ভুল হয়, ১৪৪ ধারা সম্পর্কে উমরের বালখিল্য উক্তিই তার প্রমাণ।’
অলি আহাদ লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারী হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। চিকিৎসার কারণে সরকার তাঁহাকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। প্রহরী পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযোগ গ্রহণ করিয়া আমরা তাঁহার সহিত হাসপাতালেই কয়েক দফা দেখা করি। তিনি ও নিরাপত্তা বন্দী মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ই ফেব্রুয়ারী হইতে মুক্তির দাবিতে অনশন ধর্মঘট করিবেন, সেই কথা শেখ সাহেবই আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে শেখ মুজিবর রহমানকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এই ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে নারায়ণগঞ্জ নেতৃবৃন্দের সহিত শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ ঘটে।’ (সূত্র: জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, পৃ. ১৩৬-১৩৭)।
এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, আহমদ রফিক, বদরুদ্দীন উমরসহ যাঁরা ভাষা-আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবদানকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে যুক্তিযুক্ত ও যথাযথ ঐতিহাসিক সত্য বলে মনে হয় না। তাঁরা কেবলই ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে খাটো করে দেখানো প্রয়াস ব্যক্ত করেছেন এবং নিজেরা নিজেদের কৃতিত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণ থেকে ছিটকে পড়েছেন, নিজেরাই খাটো হয়েছেন, নিঃশেষ হয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন শেখ মুজিবের অবদান ইতিহাস বিকৃতি
মন্তব্য করুন
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ইফতেখার রাফসান
মন্তব্য করুন
পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার মিতু হত্যা
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
সরকারি সফর যুক্তরাষ্ট্র সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন