আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সংসদীয় বিরোধীদল জাতীয় পার্টি এবং সরকার বিরোধী প্রধান দল বিএনপি ও এর সমমনা জোটগুলোর সমসাময়িক রাজনৈতিক কার্যকলাপে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন অডিটোরিয়ামে ‘জাতীয় ভোটার দিবস-২০২৩’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না হলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সংকটের মুখে পড়বে। আমরা একটা সংকটে আছি, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ ভোট নিয়ে আমরা এখনও রাজনৈতিক কোনো ঐক্য দেখতে পাচ্ছি না। এটা খুব প্রয়োজন। যদি ঐক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। আমরা চাই না, নির্বাচনের পূর্বে বা নির্বাচনের সময়ে কোনো রাজনৈতিক সংকট তৈরি হোক।’
এদিকে গতকাল বুধবার (১ মার্চ) দুপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীস্থ কার্যালয়ের মিলনায়তনে জাতীয় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে এক মতবিনিময় সভায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, ‘দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা শুণ্যের কোটায়। দেশের মানুষ নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই, দেশের মানুষ এখন ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হচ্ছে না। কারণ, উৎসবের নির্বাচন এখন আতংকের হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে।’
এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ মানুষের মত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর প্রশাসনের কর্তারাও নিরপেক্ষ থাকে না নির্বাচনে। আবার, ক্ষমতাসীনদের পেশী শক্তির কারণে নির্বাচনের মাঠে দাঁড়াতেই পারছে না প্রতিপক্ষ। ফলে, নির্বাচনে খুব নগন্য সংখ্যক ভোটার উপস্থিত হচ্ছে। তাই, নির্বাচনে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন হচ্ছে না। এমন নির্বাচন আমরা চাই না। আমরা চাই, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। আমরা মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। দেশের সাধারণ মানুষ হচ্ছে দেশের মালিক। দেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে কারা দেশ পরিচালনা করবে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে।’
‘জাতীয় ভোটার দিবস-২০২৩’- এর আলোচনা সভায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনা এখনও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেনি। আজকেও পত্রিকায় দেখলাম জাতীয় পার্টির নেতা জিএম কাদের বলেছেন, নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় আস্থার জায়গা শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়, তবে কিছুটা হলেও সত্য। ভোটারদের আস্থা বর্ধিত করতে হবে। মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। নির্বাচন আয়োজক হিসেবে ভোটার এডুকেশন আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
অন্যদিকে, দীর্ঘদিন থেকেই দেশের সরকার বিরোধী প্রধান শক্তি বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে আসছে। গত রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরেও রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক আলোচনা সভায়- যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার না আসছে ততক্ষণ কোনো নির্বাচন হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার না আসছে। আগামী নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।’
এ সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলেও উল্লেখ করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ জেগে উঠেছে।’ এছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাদের দেয়ালের লেখা পড়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের চোখের ভাষা দেখেন। দেখবেন এই সরকারের প্রতি মানুষের শুধু ঘৃণা আর ঘৃণা। এই মুহূর্তে সবাই চায় এই সরকারের পরিবর্তন।’
এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেকরা বলছেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যে ধরনের বক্তব্য দিয়ে আসছে, তাতেই ঘাবরে গিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সরকার বিরোধী দলগুলো নিজস্ব সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে একটি কৌশল অবলম্বন করেছে মাত্র, রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বহুল প্রচলিত। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকার কারণেই সরকার বিরোধী দলগুলো সরকারের সমালোচনা করে এ ধরনের সরকার বিরোধী বক্তব্য দিয়ে আসছে। এইটা স্বঅবাবিক। তবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের যে দায়িত্বগুলো রয়েছে- সে দায়িত্বগুলো প্রতিপালন করা অত্যন্ত জরুরী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, ইতিপূর্বেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ সংসদীয় উপ-নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত করেছে এই নির্বাচন কমিশন। এই নির্বাচনগুলোতে বিভিন্ন অভিযোগের অজুহাতে কেউ কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। তাতে করে নির্বাচন থেমে থাকেনি। এমনকি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেনি। সংসদীয় উপ-নির্বাচনে বগুড়া- ৪ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে কারচুপির অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা-ও প্রমাণিত হয়নি। কাজে কাজেই অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের শঙ্কা থাকার কোনো কারণ নেই। তবে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশনের উচিৎ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে গণমানুষের আস্থা অর্জন করা। এখন দেখার বিষয় জনসাধারণের আস্থা অর্জন করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয় নির্বাচন কমিশন।