৭৫’এর ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন এবং মদদ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং চীনের।
বিভিন্ন দলিল এবং নথিপত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার একাধিকবার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এবং খুনিরা তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময় সহায়তা ও পরামর্শ নিয়েছিল।
মার্কিন দলিলপত্রই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ১৯৭২ থেকে ফারুক নিয়মিতভাবে মার্কিন মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। এমনকি ১৯৭৪ সালে তিনি মার্কিনীদের কাছে তাঁর অভ্যুত্থান পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। চুয়াত্তরে ফারুকের অভ্যুত্থান ঘটানোর আগ্রহ প্রকাশের বিষয়টি ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরকে ২১৫৮ নম্বর গোপন তারবার্তার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের ১৫ মে অবহিত করেছিলেন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সঙ্গে মার্কিন-সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে দীর্ঘ জল্পনাকল্পনার প্রেক্ষাপটে এই প্রথম অন্তত মার্কিন সরকারি দলিলের মাধ্যমেই প্রমাণিত হলো যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি চক্র মুজিব সরকারকে উৎখাত করতে মার্কিন দূতাবাসের কাছে ধরনা দিয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ১৩ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট — অন্তত এই ১৫ মাস ধরে ফারুক রহমানই খুনিদের সংগঠিত করার কাজে নেতৃত্ব দেন বলে প্রতীয়মান হয়।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধ ও সাক্ষ্য- প্রমাণ নিশ্চিত করে যে, সে সময় সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়া প্রস্তাবিত অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা সম্পর্কে আগেভাগে অবহিত হলেও তিনি তা প্রতিহত করতে কোনো উদ্যোগ নেননি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সঙ্গে আমেরিকা কীভাবে, কতখানি যুক্ত-তা প্রকাশ করেছেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুল্টজ তাঁর ‘বাংলাদেশঃ দ্যা আনফিনিশড রেভল্যুশন’ গ্রন্থে মিঃ লিফসুল্টজ নিউইয়র্কের ‘দি নেশন’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক কাই বার্ডের সঙ্গে বিষয়টি দীর্ঘ আড়াই বছরে প্রায় ২০০ লোকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সব সাক্ষাৎকার গৃহীত হয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও বাংলাদেশে। এ নিয়ে দীর্ঘ দিন সমীক্ষা চালিয়ে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, মুজিব হত্যায় আমেরিকারও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
ঐ গ্রন্থে মিঃ লিফসুল্টজ নিম্নলিখিত তথ্যগুলো পেশ করেছেন-
মার্কিন বিদেশ দপ্তরের অফিসার’রা তাঁদের বলেছেন যে, চক্রটি মুজিবকে হত্যা করে, তাদের প্রতিনিধিগণ ১৯৭৪ সালের শরৎকালে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে এসে এ ব্যাপারে সাহায্য চায়। (পৃষ্ঠা -১৭৭)
ঐ বিদেশ দপ্তরের সূত্র থেকেই জানা যায়, ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ-এর ‘স্টেশন চিফ’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অর্থাৎ মুজিব হত্যার দিন পর্যন্ত চক্রান্তকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলো।
এই হত্যার সঙ্গে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসেরও যে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, অন্যদিক থেকেও তার প্রমাণ মিলে। মুজিব হত্যার প্রথম ঘোষণা আসে ওয়াশিংটনে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ থেকে। সে ঘোষণা পৃথিবীময় ছড়িয়ে যায় এমন একটা সময়ে, যখন হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ শেষ হয় নি। হত্যাকারীদের গাড়িগুলি তখনও ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে এ-দিক সে-দিক ছুটোছুটি করছে।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ এর স্টেশন অফিসার ফিলিপ চেরি নিজেই স্বীকার করেছেন, চক্রান্তকারীদের সঙ্গে বরাবরই তাঁর যোগাযোগ ছিল। মুজিব-হত্যার সংবাদ তিনিই ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছিলেন। ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র সেই সংবাদ বুলেটিনই প্রমাণ করে মুজিব-হত্যায় আমেরিকার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল।
পাকিস্তানী গোয়ন্দা সংস্থার নথিতে দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন খুনি ফারুককে সবুজ সংকেত দেয় তখন আইএসআই বাংলাদেশে কাজ করা শুরু করে। একাধিক নথিতে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, জিয়াউর রহমান, খুনি ফারুক, রশিদ, বজলুল হুদা, মেজর ডালিম, এরা সবাই আইএসআই-এর প্যারোলে ছিল। আইএসআই মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে যখন বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত তখন বিজয়ের পর যেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা লক্ষ্যচ্যুত হয় সেজন্য আইএসআই এর এসকল এজেন্টদের বাংলাদেশে যুদ্ধের জন্য পাঠিয়েছিলেন।
যুদ্ধের শুরু থেকেই জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার প্যারোলে ছিল। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে উদ্দেশ্য করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই সময়ের কর্নেল আসলাম বেগের লেখা একটি চিঠি তা প্রমাণ করে। চিঠিতে জিউয়ায়র রহমানকে আসলাম বেগ লিখেন, ‘তোমার কাজে আমরা সবাই খুশি। আমাদের অবশ্যই বলতে হবে, তুমি ভালো কাজ করছ। খুব তাড়াতাড়ি তুমি নতুন কাজ পাবে।’ এই বার্তা জিয়াউর রহমানের সাথে পাকিস্তানীদের ঘনিষ্ঠ এবং সুসম্পর্ক ছিল সেটি নিশ্চিত করে।