হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৫ আগস্ট খুব ভোরে বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে সাতটায় আর জার্মান সময় ভোর সাড়ে তিনটার দিকে অভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ পান জার্মান লেখিকা ও সাংবাদিক গিজেলা বনের (Gisela Bonn) একটি ফোনের মাধ্যমে। ৬৬ বছর বয়সী গিজেলা বনকে রাষ্ট্রদূত চৌধুরী বেশ আগে থেকেই চিনতেন তাঁর ভারত উপমহাদেশ নিয়ে আগ্রহ, লেখালেখি ও কাজকর্মের কারণে। সাংবাদিকতা করায় নানা বিষয়েই খবরাখবর রাখতেন গিজেল বন। ওই দিন গভীর রাতে তিনি বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের খবর পান। এর পরপরই তিনি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ফোন করে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সবাই যে নিহত হয়েছেন, সে সম্পর্কে জানান। ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকেও হুমায়ুন। রশীদ চৌধুরীর কাছে একই ধরনের সংবাদ জানিয়ে ফোন আসে।
এই সংবাদ শোনার পর রাষ্ট্রদূত চৌধুরী হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। একদিকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের কন্যারা তাঁর অতিথি, অন্যদিকে ওই একই দিন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামালের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর ফ্রাঙ্কফুর্ট রাইন—মাইন বিমানবন্দরে যাওয়ার কথা। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তাঁর দুই সহকর্মী তারিক এ করিম ও আমজাদুল হককে ফোন করে দ্রুত তাঁর বাসায় আসতে বলেন। রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তারিক এ করিমকে বলেন তাঁর স্ত্রী নাগমাকেও সঙ্গে নিয়ে আসতে। জানান যে তাঁর গাড়িটি তিনি তাঁদের জন্য পাঠাচ্ছেন। তিনি তাঁদের দ্রুত তৈরি হতে বলেন।
অত ভোরে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর আতঙ্কজড়িত কণ্ঠ শুনে তারিক এ করিম বিচলিত হন। তিনি মনে করেছিলেন, রাষ্ট্রদূতের বাসায় সম্ভবত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। নইলে কেন স্ত্রী নাগমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলছেন! তিনি থাকতেন বন শহরের রেমাগেন এলাকায়। একটু পরেই রাষ্ট্রদূতের গাড়ি তাঁর বাসায় এসে পৌঁছায়। কিন্তু তারিক এ করিম কাজে লাগতে পারে ভেবে নিজের গাড়ি নিয়েই রাষ্ট্রদূতের বাসায় যান। রেমাগেন থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ছিল রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর বাসা। সকাল পৌনে ছয়টার মধ্যে তাঁরা সেখানে পৌঁছে যান।
ওদিকে ভোর পাঁচটার দিকে রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর কাছ থেকে ফোন পেরেছিলেন আমজাদুল হক। বিছানার পাশেই রাখা ফোনটা ধরতেই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আপনাকে এখনই আমার বাসায় আসতে হবে।’ আমজাদুল হক এই লেখককে জানান, ওই দিন ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য তাঁর সকাল সাড়ে সাতটায় রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর বাসায় মিলিত হওয়ার কথা ছিল। তাই তিনি রাষ্ট্রদূতকে বলেন, ‘এখন বাজে ভোর পাঁচটা, আমাদের তো আরও পরে মিলিত হওয়ার কথা।’ রাষ্ট্রদূত তখন বলেন, ‘বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু আহত বা গ্রেপ্তার হয়েছেন, আপনি এখনই চলে আসুন।’ এই কথা শুনে আমজাদুল হক। কাঁদতে থাকেন।
তারিক এ করিম সস্ত্রীক রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে পৌঁছে দেখেন, আমজাদুল হক তাঁর আগেই পৌঁছে গেছেন। আমজাদুল হক তখন অবিবাহিত ছিলেন। রাষ্ট্রদূতের বাড়ির কাছেই থাকতেন। তারিক এ করিম তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলেন রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তাঁর শোবার ঘরের ফোন থেকে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। এ সময় রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী মাহজাবিন চৌধুরী তারিক এ করিমকে এক পাশে ডেকে নিয়ে জানান, ভোর সাড়ে তিনটা থেকে এভাবে একটার পর একটা ফোন আসছে। বাংলাদেশে নাকি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। তিনি একটার পর একটা ফোন রিসিভ করেই চলেছেন।
তাঁদের আসার খবর পেয়ে একটু পর রাষ্ট্রদূত চৌধুরী উদ্ভ্রান্তের মতো ওপর থেকে নিচে নেমে আসেন। তাঁর বসার ঘরে ঢুকে তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে কিছুক্ষণ বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। এরপর রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তখন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নিহত হওয়ার ঘটনা সম্বন্ধে যা শুনেছেন, তা তাঁদের দুজনকে জানান। তিনি আরও জানান, আজ ব্রাসেলস থেকে শেখ হাসিনাদের প্যারিস যাওয়ার কথা। আমার মনে হয় তাঁদের নিরাপত্তার জন্য আর কোথাও যাওয়া সমীচীন নয়।‘তাহলে কী করা যায়’, এই স্বগতোক্তি করে তিনি বলেন, আমি ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাঁদের এখানে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করব।’
এরপর কীভাবে এই খবর শেখ হাসিনাকে দেওয়া যায়, তা নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন। আমজাদুল হক বলেন, এই মুহূর্তে এই ঘটনার কথা কোনোভাবেই টেলিফোনে শেখ হাসিনাকে জানানো ঠিক হবে না। তিনি তা সহ্য করতে পারবেন না। আলোচনা করে তাঁরা সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর বিষয়টি শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানাকে না জানিয়ে ওয়াজেদ মিয়াকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
আলোচনার পর রাষ্ট্রদূত চৌধুরী বাংলাদেশের ঘটনা জানাতে রাষ্ট্রদূত সানাউল হককে ফোন করেন। সানাউল হক ফোনে ঘটনা শোনার পর কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আপনারা বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের এখানে পাঠিয়ে আমাকে তো বিপদে ফেললেন।’ প্রতি—উত্তরে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা যে ঘটবে, তা আমরা আগে থেকে জানতাম না। আপনার অসুবিধা হলে এখনই তাদের বন অভিমুখে রওনা হতে বলেন।’ এরপর তিনি সানাউল হককে জানান, তিনি ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু ওয়াজেদ মিয়ার পরিবর্তে ফোন ধরেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রদূত চৌধুরী শেখ হাসিনাকে জানান, তিনি ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। ওয়াজেদ মিয়া ফোন ধরলে তিনি তাঁকে জানান বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। তিনি তাঁকে বলেন ফ্রান্সে না গিয়ে বনে ফিরে আসতে। সব ঘটনা শুনে ওয়াজেদ মিয়া জিজেস করেন, ‘তাঁর শাশুড়ির কী হয়েছে?’ শাশুড়ির কথা শুনে তিনি ফোনের পাশে থাকা চেয়ারে বসে পড়েন। এ কথা পরে আমজাদুল হককে জানিয়েছিলেন। ওয়াজেদ মিয়া।
রাষ্ট্রদূত চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে ফোনে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিহত হওয়ার ঘটনা শেখ হাসিনাকে না জানাতে। ক্যু হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু হয়তো আহত হয়েছেন—এ কথা বলতে। আর শেখ রেহানা ছোট, তাকে এসব কিছুই না জানাতে।
রাষ্ট্রদূত চৌধুরী টেলিফোনে যখন ওয়াজেদ মিয়া ও সানাউল হকের সঙ্গে কথা বলেন, তখন সেখানে রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী মাহজাবিন চৌধুরীসহ তারিক এ করিম, নাগমা করিম ও আমজাদুল হকও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাও এই কথোপকথন শোনেন।
ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে ফোনে আলাপের পর রাষ্ট্রদূত চৌধুরী সানাউল হকের সঙ্গে আবার কথা বলেন। তিনি সানাউল হককে শেখ হাসিনাদের বনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলেন। এতে সানাউল হক তার অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, দূতাবাসের পতাকাবাহী গাড়ি দিয়ে আমি যদি তাঁদের বনে পাঠানোর ব্যবস্থা করি, তাহলে আমার তো চাকরি থাকবে না। রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তখন তাঁকে জানান, তাদের দূতাবাসের আছে মাত্র দুটি গাড়ি। সেই দুটি গাড়িই ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে যাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনকে নিয়ে আসতে। আগে থেকেই এই পরিকল্পনা করা রয়েছে। ফলে গাড়ির সংকট আছে।
রাষ্ট্রদূত চৌধুরী সানাউল হকের সঙ্গে কথা বলার পর খুব হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়েন। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা উঁচুগ্রামে স্বগতোক্তির মতো করে বলেন, `I am the captain of the ship. let me take decision. (আমিই জাহাজের ক্যাপ্টেন, এখন আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।) বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের আমি ইউরোপের রাস্তাঘাটে ফেলে দিতে পারি না। আমি তাঁদের এখানেই ফিরিয়ে আনব।
কী অবাক ঘটনা, একজন রাষ্ট্রদূত তাঁর চাকরি হারানোর ভয়ে সদ্য মা— বাবা হারানো দুই মেয়েকে অনতিবিলম্বে তাঁর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাগাদা দিচ্ছেন, আর অন্য একজন রাষ্ট্রদূত অতি আপনজনের মতো পরম মমতায় তাঁর নিজ গৃহে তাঁদের আশ্রয় দিচ্ছেন।
কিছুক্ষণ পর সানাউল হক রাষ্ট্রদূত চৌধুরীকে ফোন করে জানান, ব্রাসেলসের বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব জাহাঙ্গীর সাদাতের ব্যক্তিগত গাড়িতে শেখ হাসিনাদের বেলজিয়াম—পশ্চিম জার্মানি সীমান্তের আখেন পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা তিনি করেছেন। বেলজিয়াম সীমান্ত থেকে তাঁদের বনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন।
এ সময় তারিক এ করিম ও আমজাদুল হক রাষ্ট্রদূতকে তাঁদের নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়িতে করে শেখ হাসিনাদের আখেন থেকে বনে নিয়ে আসার প্রস্তাব দেন। তখন মাহজাবিন চৌধুরী বলেন, আমজাদুল হক সাহেবের লাল গাড়িটি ছোট। তাঁরা দুই বাচ্চাসহ মোট পাঁচজন। এ ছাড়া সঙ্গে তাঁদের মালপত্রও আছে। বরং তারিক এ করিমের হলুদ ভক্সওয়াগন প্যাসাট গাড়িটি কিছুটা বড়। সেটি পাঠালে তাঁদের অসুবিধা হবে না।
এরপর তাঁরা সিন্ধান্ত নিলেন শেখ হাসিনাদের আনতে দূতাবাসের গাড়িচালক শাহাজাহান তালুকদার তারিক এ করিমের গাড়ি নিয়ে আখেন যাবেন । তাঁকে ওই দিন ছুটি দেওয়া হবে। আর দূতাবাসের যে দুই গাড়ির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে যাওয়ার কথা, তার একটি চালিয়ে বিমানবন্দরে যাবেন তারিক এ করিম। অপরটি চালাবেন দূতাবাসের অপর গাড়িচালক মুহাম্মদ আনোয়ার আলী।
২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের এক অনুষ্ঠানে ওই ঘটনার কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, জার্মানিতে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা হয়েও সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু আব্বার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশে ছিলেন। তাঁর কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। একটা বিবৃতি দিতে অনুরোধ করলেও রাজি হননি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী
মন্তব্য করুন
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ইফতেখার রাফসান
মন্তব্য করুন
পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার মিতু হত্যা
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
সরকারি সফর যুক্তরাষ্ট্র সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন