ডিসেম্বর
মাস বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে
৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীন হয় আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি
হয় বাংলাদেশ নামক একটি ভূখন্ড। বাংলাইনসাইডার এই বিজয়ের মাসে ধারাবাহিক ভাবে ‘ষষ্ঠ
পর্বে’ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড’ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী জাফর আহমদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে-
১৯৭১ সালে প্রকাশ্য রাজনীতির
ক্ষেত্রে আমরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও কৃষক সমিতি
এবং আমাদের সরাসরি নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন ও পূর্ব বাংলা বিপ্লবী
ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিলাম। আমি ছিলাম বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি। আমাদের
মূল সংগঠন ছিল 'কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি'। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক
পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী আমরা এই গোপন
সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি।
১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী ঢাকার
পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) আয়োজিত এক সভায় অতিথি বক্তা
হিসেবে আমরা এই কর্মসূচীর ভিত্তিতে রচিত ১১ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করি। এই অভিযোগে পাকিস্তানের
সামরিক আইনের অধীনে আমাকে এবং রাশেদ খান মেননকে সাত বৎসরের সশ্রম কারদণ্ড ও সমস্ত সম্পত্তি
বাজেয়াপ্তের আদেশ দেয়া হয়, মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাহকে দেয়া হয় এক বৎসরের
কারাদণ্ডাদেশ। আমরা আত্মগোপনে চলে যাই, অবশ্য মাহবুব উল্লাহ পরবর্তীকালে গ্রেফতার হন।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের
আমরা বিরোধিতা করি। এর কারণ আমরা তখন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে আর বিশ্বাস করতাম না,
তদুপরি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবননাশী নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাস এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম
পাকিস্তানী শাসকদের ক্ষমার অযোগ্য উপেক্ষায় আমরা ছিলাম বিক্ষুব্ধ। অন্যদিকে ইয়াহিয়া
ঘোষিত 'লীগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারে'র অধীনে নির্বাচন এবং এতে বিজয় পূর্ব বাংলার জনগণের
অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করতাম না। তাই আমরা নির্বাচন বর্জনের
আহবান জানাই এবং পাশাপাশি শ্লোগান তুলে ধরি। 'শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা অস্ত্র ধরো, পূর্ব
বাংলা স্বাধীন করো'।
'৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন
শুরু হলে আমাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। ৭ই মার্চ প্রচারিত এক প্রচারপত্রে আমাদের আহবান ছিল,
'আঘাত হানো, সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করো, জনতার স্বাধীন পূর্ব বাংলা কায়েম করো'।
আমাদের (বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন)
উদ্যোগে ২৫ মার্চ বিকেলে পল্টন ময়দানে আয়োজিত জনসভায় সভাপতির ভাষণে আমি স্বাধীনতা সংগ্রামের
১৩ দফা কর্মসূচী তুলে ধরি। এই সভায় আমরা বলেছিলাম, আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য, আর তাই
সারাদেশে অবিলম্বে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে হবে।
এটাই ছিল তৎকালীন 'পূর্ব পাকিস্তানের' পল্টন ময়দানের শেষ জনসভা। সভাশেষে এক প্রকাণ্ড
মিছিলযোগে আমরা শহীদ মিনারে যাই এবং সেখানে শপথ গ্রহণ করি।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের
সেনাবাহিনী তাদের পৈশাচিক হত্যাকান্ড শুরু করলে আমি আশ্রয় নেই এ দেশের প্রগতিশীল সিনেমা
আন্দোলনের পথিকৃত শহীদ জহির রায়হানের বাসায়। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী নিজেদের জীবনের ঝুঁকি
নিয়ে আমাকে তিনদিন আশ্রয় দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, জহির রায়হানের গাড়িটিও আমাদের দিয়েছিলেন
ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য। এই গাড়ী নিয়েই আমরা ঢাকা জেলার শিবপুর চলে যাই।
২৫ বা ২৬ এপ্রিল আমি পূর্ব
বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা দেবেন সিকদারের আগরতলা থেকে লেখা একটি চিঠি পাই। এতে
জানানো হয়েছিলো যে, ৩০ এপ্রিল ভারতের জলপাইগুড়িতে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে বামপন্থীদের
এক নীতিনির্ধারণী সভা হবে, আমি যেন অন্য সকলকে জানিয়ে নিজেও চলে আসি।
পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়,
কিন্তু মাওলানা ভাসানী উপস্থিত চছিলেন না। তার লেখা একটি চিঠি পড়ে শোনানো হয় যাতে তিনি
লিখেছিলেন যে, বাইরে বেরানার ব্যাপারে তার অসুবিধা আছে, তিনি ভালো আছেন।
মওলানা ভাসানী আমাদের কাজ চালিয়ে
যেতে বলেছিলেন, তাঁর নির্দেশ ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার সংগ্রামে
অংশ নেয়ার জন্য। চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে গণচীনসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের প্রধানদের নিকট
তিনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন সমর্থন চেয়ে। মওলানা ভাসানীর এই চিঠিটি এসেছিল ভারতের একজন
দায়িত্বশীল নাগরিকের মাধ্যমে। এ প্রসংগে বলা দরকার যে কাগজে-কলমে না হলেও পরোক্ষভাবে
সুকৌশলে মওলানা ভাসানীকে বন্দী দশায় রাখা হয়েছিল।
কলকাতায় এ সভায় সভাপতিত্ব করেন
দিনাজপুরের কৃষক নেতা শ্রবরোদা ভূষণ চক্রবর্তী। বিস্তারিত আলোচনা শেষে মওলানা ভাসানীকে
সভাপতি করে 'জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি' গঠন করা হয়। কমিটিতে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত
হন দেবেন সিকদার (পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টি), নাসিম আলী (বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট
পার্টি) অমল সেন (কমিউনিষ্ট সংহতি কেন্দ্র), ডাঃ সাইফ-উদ-দাহার (কমিউনিষ্ট কর্মী সংঘ)
এবং আনি (কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি)। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে আওয়ামী
লীগের প্রতি ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানানো হয় এবং এ ব্যাপারে যোগাযোগের
দায়িত্ব লাভ করি আমরা।
দেশে ফেরার পথে জুনের মাঝামাঝি
আগরতলায় আমাকে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' আটক করে নিয়ে যায় শিলং-এর একটি
ডাক বাংলোয়। সেখানে আমাকে সাত দিন রাখা হয়। ঘটনাটিকে আমি গ্রেফতার বলবো না, কেননা,
কোন খারাপ আচরণ আমার সাথে করা হয়নি। কিন্তু সাত দিনব্যাপী অবিরাম প্রশ্নের মাধ্যমে
আমাকে ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়। আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা
'র'-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান মিঃ সুব্রামনিয়াম। তিনি অবশ্য সমগ্র ব্যাপারটিকে 'নিজেদের
মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা' হিসাবে বোঝাতে চেয়েছিলেন।
অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী
তাজউদ্দিন আহমদের সাথে ব্যর্থ আলোচনার পর আমরা নিজেদের উদ্যোগে যেখানে যতটুকু শক্তি
নিয়ে যেভাবে সম্ভব স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখি। মুজিব নগর সরকারকে আমরা
অস্বীকার করিনি, কিন্তু তাই বলে প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগও রাখিনি, সহযোগিতাও পাইনি।
সরকার সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন ছিল, সমালোচনা ছিল, কেননা তারা আওয়ামী লীগের বাইরে বিশেষ
করে বামপন্থীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রশ্নে অযৌক্তিক সংকীর্ণ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই
নীতি আমাদের হতাশ করেছিল। এজন্যেই আমরা নিজেদের উদ্যোগে লড়াই চালিয়েছিলাম।
স্বাধীনতাযুদ্ধকালে আমাদের
সংগঠনের নীতি ছিল দুটিঃ
১। যেখানে সম্ভব বেংগল রেজিমেন্ট,
ই পি আর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারী মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে তাদের নির্দেশ
মান্য করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এবং
(২) কোথাও তেমন বাহিনী না থাকলে,
কিংবা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে যোগদান সম্ভব না হলে আলাদাভাবে 'গেরিলা ফৌজ' গঠন করে যুদ্ধ
পরিচালনা করা। উল্লেখ্য যে, আমাদের সংগঠনের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর নাম ছিলো 'গেরিলা ফৌজ'।
এর পঠন প্রণালী ছিল-পাঁচ থেকে সাতজন নিয়ে একটি গ্রুপ, কয়েকটি গ্রুপ নিয়ে একটি স্কোয়াড
এবং কয়েকটি স্কোয়াড নিয়ে গঠিত হতো এক একটি আঞ্চলিক ইউনিট। এ ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ
২৫ মার্চের জনসভাতেই ঘোষণা করা হয়েছিল।।
আগেই বলেছি। কেবল সেই সব অঞ্চলেই
গেরিলা ফৌজ গঠিত হয়েছিল যেখানে সরকারী মুক্তিবাহিনী (বেংগল রেজিমেন্ট, ইপিআরসহ) ছিল
না কিংবা থাকলেও সংকীর্ণতার কারণে আমাদের কর্মীরা ওতে যোগ দিয়ে পারেনি। দেশের অন্য
সকল এলাকায় কর্মীরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে অধিনায়কের নির্দেশে যুদ্ধ করেছেন-কোনো
প্রকার দলীয় বিভেদাত্মক কার্যকলাপ তারা চালাননি। সেই প্রেক্ষিতে যুদ্ধশেষে হিসেব অনুযায়ী
সারা দেশে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমাদের সংগঠনের কর্মীদের সংখ্যা সব মিলিয়ে ছিল প্রায়
ত্রিশ হাজার।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,
যুদ্ধকালে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটির পক্ষে সরাসরি নেতৃত্ব বা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা
করা সম্ভব ছিল না, ফলে যেখানে কমিটির যে সংগঠন বেশী শক্তিশালী ছিলে সেখানে অন্য সংগঠনের
সদস্যরা তার অধীনে মিলিতভাবে যুদ্ধ করতো। সংগঠন হিসেবে শামাদের কমিউনিষ্ট বিতধারার
রাতো পেপারে নিজেদের মধ্যে মোটামুটি নিয়মিত যোগাযোগ সংগঠন হিসেবে আমাদের জমি উদাগাযোগ
কর ইবির নির্দেশানুযায়ী কর্মীরা যুদ্ধে অংযোগ বন্ধন করতে পারতো।
কলকাতার একটি মোটেলে আমার সাথে
আলোচনা হয় মুজিব বাহিনীর দুই নেতা এবং আমার এককালীন বন্ধু ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শেখ
ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের। মুজিব বাহিনী গঠনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা আসছিলেন।
আমরা নিশ্চিত নই যে মুজিব বেঁচে আছেন কিনা, কিংবা তিনি জীবিত অবস্থায় ফিরে আসবেন কিনা।
যদি না আসেন তাহলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তার জন্যেই মুজিব বাহিনী-যাতে (পরিহাসচ্ছলে)
তোমরা কিংবা সামরিক বাহিনীর কোনো বাঙালী অফিসার সে শূন্যতার সুযোগ নিতে না পারে। তাঁদের
বক্তব্যে বোঝা আসছিলো যে তাঁরা বেংগল রেজিমেন্টের কোনো কোনো কমান্ডার সম্পর্কে যথেষ্ট
সংশয় এবং আশংকায়
ভারতসহ বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী
প্রগতিশীলরাও আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। বিশেষ করে বৃটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
বাঙালীয়া এ ব্যাপারে ছিলেন বিশির ভূমিকায়।
তাজউদ্দিন মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পাকিস্তান
মন্তব্য করুন
কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ইফতেখার রাফসান
মন্তব্য করুন
পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার মিতু হত্যা
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
সরকারি সফর যুক্তরাষ্ট্র সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন